Wednesday 31 October 2018

Nobel Laureates in Physics: Born in October



Brief information about fourteen scientists who won Nobel Prize in Physics and born in October.





Vitaly Ginzburg
Born: 4 October 1916, Moscow, Russian Empire
Died: 8 November 2009
Nobel Prize in Physics: 2003 
"for pioneering contributions to the theory of superconductors and superfluids."





Ernest Thomas Sinton Walton
Born: 6 October 1903, Dungarvan, Ireland
Died: 25 June 1995, Belfast, Northern Ireland
Affiliation at the time of the award: Trinity College, Dublin, Ireland
Prize motivation: "for their pioneer work on the transmutation of atomic nuclei by artificially accelerated atomic particles."
Prize share: 1/2



Riccardo Giacconi
Born: 6 October 1931, Genoa, Italy
Affiliation at the time of the award: Associated Universities Inc., Washington, DC, USA
Prize motivation: "for pioneering contributions to astrophysics, which have led to the discovery of cosmic X-ray sources."
Prize share: 1/2



Niels Henrik David Bohr
Born: 7 October 1885, Copenhagen, Denmark
Died: 18 November 1962, Copenhagen, Denmark
Affiliation at the time of the award: Copenhagen University, Copenhagen, Denmark
Prize motivation: "for his services in the investigation of the structure of atoms and of the radiation emanating from them."
Prize share: 1/1




Max von Laue
Born: 9 October 1879, Pfaffendorf, Germany
Died: 23 April 1960, Berlin, West Germany (now Germany)
Affiliation at the time of the award: Frankfurt-on-the-Main University, Frankfurt-on-the-Main, Germany
Prize motivation: "for his discovery of the diffraction of X-rays by crystals."
Prize share: 1/1





Raymond Davis Jr.
Born: 14 October 1914, Washington, DC, USA
Died: 31 May 2006, Blue Point, NY, USA
Affiliation at the time of the award: University of Pennsylvania, Philadelphia, PA, USA
Prize motivation: "for pioneering contributions to astrophysics, in particular for the detection of cosmic neutrinos."
Prize share: 1/4







Subramanyan Chandrasekhar
Born: 19 October 1910, Lahore, India (now Pakistan)
Died: 21 August 1995, Chicago, IL, USA
Affiliation at the time of the award: University of Chicago, Chicago, IL, USA
Prize motivation: "for his theoretical studies of the physical processes of importance to the structure and evolution of the stars."
Prize share: 1/2




James Chadwick
Born: 20 October 1891, Manchester, United Kingdom
Died: 24 July 1974, Cambridge, United Kingdom
Affiliation at the time of the award: Liverpool University, Liverpool, United Kingdom
Prize motivation: "for the discovery of the neutron."
Prize share: 1/1




Wolfgang Ketterle
Born: 21 October 1957, Heidelberg, West Germany (now Germany)
Affiliation at the time of the award: Massachusetts Institute of Technology (MIT), Cambridge, MA, USA
Prize motivation: "for the achievement of Bose-Einstein condensation in dilute gases of alkali atoms, and for early fundamental studies of the properties of the condensates."
Prize share: 1/3





Clinton Joseph Davisson
Born: 22 October 1881, Bloomington, IL, USA
Died: 1 February 1958, Charlottesville, VA, USA
Affiliation at the time of the award: Bell Telephone Laboratories, New York, NY, USA
Prize motivation: "for their experimental discovery of the diffraction of electrons by crystals."
Prize share: 1/2



Felix Bloch
Born: 23 October 1905, Zurich, Switzerland
Died: 10 September 1983, Zurich, Switzerland
Affiliation at the time of the award: Stanford University, Stanford, CA, USA
Prize motivation: "for their development of new methods for nuclear magnetic precision measurements and discoveries in connection therewith."
Prize share: 1/2




Il´ja Mikhailovich Frank
Born: 23 October 1908, Leningrad (now Saint Petersburg), Russia
Died: 22 June 1990, Moscow, USSR (now Russia)
Affiliation at the time of the award: University of Moscow, Moscow, USSR, P.N. Lebedev Physical Institute, Moscow, USSR
Prize motivation: "for the discovery and the interpretation of the Cherenkov effect."
Prize share: 1/3




Pierre-Gilles de Gennes
Born: 24 October 1932, Paris, France
Died: 18 May 2007, Orsay, France
Affiliation at the time of the award: Collège de France, Paris, France
Prize motivation: "for discovering that methods developed for studying order phenomena in simple systems can be generalized to more complex forms of matter, in particular to liquid crystals and polymers."
Prize share: 1/1




Theodor W. Hänsch
Born: 30 October 1941, Heidelberg, Germany
Affiliation at the time of the award: Max-Planck-Institut für Quantenoptik, Garching, Germany , Ludwig-Maximilians- Universität, Munich, Germany
Prize motivation: "for their contributions to the development of laser-based precision spectroscopy, including the optical frequency comb technique."
Prize share: 1/4



শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৯ম পর্ব



সেরাহ আর তার বন্ধুরা চলে গেলো সকালে। তারা যাবার পরে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। আজ সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান। ম্যাকডোনাল্ডস থেকে ব্রেকফাস্ট করে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। সেন্ট্রাল রোড ধরে সোজা হাঁটতে হাঁটতে হাইড পার্ক। সিডনি সেন্ট্রালের সামনেই এই বিশাল হাইড পার্ক। ইংল্যান্ডেও নাকি একটা হাইড পার্ক আছে। বেশ সুন্দর পার্ক। বেশ কিছু মূর্তি আছে এখানে সেখানে। একটা সুন্দর ঝরনা আছে পার্কের মাঝখানে। অনেক মানুষ শুয়ে বসে আছে পার্কের ঘাসে, বেঞ্চে। পার্কের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে ম্যাককুয়ারি স্ট্রিট। এই রাস্তা পার্ক থেকে শুরু হয়ে মিশেছে অপেরা হাউজে গিয়ে। কাছেই পার্লামেন্ট হাউজ, ট্রেজারি। হাইড পার্কে সুন্দর একটা মিউজিয়াম আছে। আগে নাকি এটা জেলখানা ছিলো। বিশাল একটা সিনেগগ রাস্তার ওপারেই। এর স্থাপত্য দেখার মতো। ধর্মের সাথে স্থাপত্যের একটা চমৎকার সম্পর্ক আছে। যে কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপত্যই দেখার মতো।



পার্কের কাছেই অ্যানজেক মিউজিয়াম। অ্যানজেক হলো অস্ট্রেলিয়া এন্ড নিউজিল্যান্ড অক্সিলিয়ারি কর্পস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের অনেক মানুষ অংশ নিয়েছিলো। তাদের স্মরণে এই মিনার আর জাদুঘর। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদদের নামও যোগ করা হলো এখানে। দেয়ালে অনেক নাম খোদাই করা, শহীদদের নাম। শহীদ পরিবারের লোকজন এসে এখনো বাতি জ্বালিয়ে ফুল রেখে যায় এখানে।
       
হাইড পার্কে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে পিট ষ্ট্রিটে ঘুরলাম কিছুক্ষণ। সেখান থেকে সিডনি টাওয়ার পার হয়ে কুইন ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং এ ঢুকলাম। কিছুক্ষণ উইন্ডোসশপিং করে গেলাম চায়না টাউনে। চায়না টাউনের পুরোটাই চায়নিজদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মনে হয় যেন সিডনির ভিতরে ছোট্ট একটা চায়না ভূখণ্ড । তার একটু পরেই প্যাডি মার্কেট। এখানে সব অস্থায়ী দোকানের সমাবেশ। মাছ থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স পর্যন্ত সব কিছু পাওয়া যায় এখান। মেলবোর্নের কুইন ভিক্টোরিয়া মার্কেটের মতো। এখানের দোকানপাট মেলবোর্নের মতো সুন্দর মনে হলো না খুব একটা।



রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে একটা মনোরেল। কাছেই স্টেশন। তিন ডলার ভাড়া লাগে প্রতি ট্রিপের জন্য। সাতটা স্টপ। শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকার উপর দিয়ে চলে যায় এই মনোরেল। শহর দেখার বেশ ভালো ব্যবস্থা।  মেলবোর্নে শহর দেখার জন্য সিটি সার্কেল ট্রাম আছে। তার জন্য ভাড়াও লাগে না। সিডনিতে ট্রাম নেই বললেই চলে। একটা মাত্র ট্রাম লাইন আছে, সেটা খুব একটা বেশি এলাকা কভার করতে পারে না।



মনোরেলে একটা চক্কর দিয়ে নামলাম ডার্লিং হারবারে। শহরের পশ্চিম প্রান্তে ওয়াটার ফ্রন্টে অলস সময় কাটানোর চমৎকার জায়গা। প্রচুর রেস্টুরেন্ট। হাত বাড়ালেই সমুদ্র। সিডনি অ্যাকোয়ারিয়াম, মেরিটাইম মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি আর প্যানাসনিক আইম্যাক্স থিয়েটার সব এখানে যেন পর পর সাজানো। আইম্যাক্স থিয়েটারে থ্রি-ডাইমেনশনাল সিনেমা দেখানো হয়। এর পর্দা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়। মেলবোর্নেও আছে এই আইম্যাক্স থিয়েটার। কিন্তু এখনো দেখার সুযোগ হয়নি। আজ এখানে টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম ডকুমেন্টারি দেখার জন্য। 
হলে ঢোকার সময় একটা কালো চশমা দেয়া হলো। ত্রিমাত্রিক ছবি দেখার জন্য এই চশমা চোখে দেয়া দরকার। ডকুমেন্টারির নাম ‘গ্যালাপাগোস'। ছোট্ট একটা দ্বীপের নাম। চার্লস ডারউইন গিয়েছিলেন সেখানে তার জীবদ্দশায়। তারপর আর কেউ নজর দেয়নি এদিকে। সম্প্রতি ডক্টর মিশেল নামে একজন প্রাণিবিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন এই দ্বীপের প্রাণিগুলো নিয়ে। প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণিগুলো দেখতে অনেকটা গিরগিটির মতো। ত্রিমাত্রিক ছবির কল্যাণে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ধরা যাবে এগুলোকে।
ডক্টর মিশেল নামে ছিপছিপে এই তরুণীর সাহস দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। একদম হাতের দূরত্বে বসে ছবি আঁকছেন একশ’ বছর বয়সী বিশাল কচ্ছপের। এক একটার ওজন পাঁচ ছয় মণের কম হবে না। সাগর তলের অনেক রহস্যময় প্রাণির দেখা মিললো পর্দায়।
হলের ভিতর পরিচয় হলো মেডিক্যাল স্টুডেন্ট মোহান্তের  সাথে। সে ইন্ডিয়ান কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের তিন পুরুষের বাস। ভালো লাগলো তার সাথে কথা বলে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সে এসেছে সিডনির বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দেখতে।


হল থেকে বেরিয়ে দেখি আকাশ আবার মেঘে ছেয়ে গেছে। সিডনির আকাশ ঘন ঘন মুড বদলায়। হাজার হাজার ট্যুরিস্ট এখানে। প্রতি বছর বিশ লাখ ট্যুরিস্ট আসে সিডনিতে। ইন্টারন্যাশনাল ‘ট্রাভেল আন্ড লেইজার’ ম্যাগাজিনের জরিপে দেখা গেছে ৮৭ ভাগ ট্যুরিস্ট সিডনিকে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে দর্শনীয় শহর মনে করেন।
কাল রাতে সেরাহ বলছিলো সিডনি শহর সম্পর্কে। ম্যাপ দেখে বোঝা যায় না এই শহরটা কত বড়। ক্ষেত্রফলের হিসেবে সিডনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটি। সিডনি শহরের ক্ষেত্রফল ১৫৮০ বর্গকিলোমিটার। লন্ডন শহরের প্রায় সমান। আর নিউইয়র্ক শহরের দ্বিগুণ।  নিউইয়র্ক শহরের ক্ষেত্রফল ৭৮০ বর্গকিলোমিটার। আমস্টার্ডাম শহরের ক্ষেত্রফল মাত্র ১৬৭ বর্গকিলোমিটার আর বিখ্যাত প্যারিসের মাত্র ১০৫ বর্গকিলোমিটার। সে তুলনায় সিডনি জায়ান্ট সিটি।
এই শহরে মাত্র সাড়ে পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ বাস করে। সরকারি হিসাব মতে এখানে সাড়ে চৌদ্দ লাখ বাসা আছে। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতি হলো সিডনিতে।  তারপরও দেখা যাচ্ছে টোকিওর একজন বাসিন্দার চেয়ে ছয়গুণ বেশি জায়গা নিয়ে থাকে একজন সিডনিবাসী। সিডনি শহরে যারা থাকে তাদের প্রায় অর্ধেকেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। সিডনি যুবকদের শহর। সিডনি শহরে নাকি ১৮০টি দেশের নাগরিক বাস করে। ১৪০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে তারা। কালচারাল মেলটিং পট এমনিতে বলা হয় না সিডনিকে ।
             
হারবার ব্রিজে উঠার জন্যে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ব্রিজের গোড়ায়। সিঁড়ি আছে এখানে। সিঁড়ি বেয়ে অনেক উপরে ওঠার পর ব্রিজের পায়ে হাঁটার পথ। ডান দিকে তাকালে পুরো সিডনি শহর দেখা যাচ্ছে। সামনে অনেক নিচে অপেরা হাউজ মনে হচ্ছে পানির মাঝে ভেসে আছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে অসংখ্য গাড়ি। একটা ট্রেন এসে থামলো ব্রিজের ওপর স্টেশনে।



সিডনি হারবার ব্রিজ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় (সবচেয়ে লম্বা নয়) স্টিল ব্রিজ। সেরাহর কথা মনে পড়ছে। কাল রাতে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে সে আমাকে এই ব্রিজ সম্পর্কে। ১৯২২ সালে এই ব্রিজ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার দেয়া হয়। ছয়টি কোম্পানি বিশটি দরপত্র জমা দেয়। ১৯২৪ সালের ২৪ মার্চ তারিখে ব্রিটিশ ফার্ম ডোরম্যান লং এন্ড কোম্পানিকে ব্রিজ তৈরির কাজ দেয়া হয়। বাজেট ছিলো ৪২ লাখ ১৭ হাজার ৭২১ পাউন্ড ১১ শিলিং ১০ পেন্স। এই তথ্যগুলো এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
এই ব্রিজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ডক্টর ব্রাডফিল্ড। ডক্টর ব্রাডফিল্ডকে এই ব্রিজের পিতা বলা হয়। ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিজের কাজ শেষ হয়। সেই বছরই মার্চের ১৯ তারিখে ব্রিজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন  ঘোষণা করেন নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার জন লেং। শুরু হয় এক নতুন সভ্যতার।
৫০৩ মিটার লম্বা এবং ৪৯ মিটার চড়া ব্রিজ। আট লাইনে গাড়ি চলে এর ওপর দিয়ে। দুটো ট্রেন লাইন, একটা সাইকেল ট্রাক আর পায়ে হাঁটার ফুটপাত। হেঁটে পার হতে গিয়ে নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে ওঠে। অথচ অনেকেই এই ব্রিজের উপরে লোহার সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। রেগুলার এই ব্রিজ ক্লাইম্বিং চলে এখানে। পাঁচ ডলার দিতে হয় এর জন্য। আমার সাহস নেই অত উপরে উঠে ব্রিজ পার হবার। কিন্তু সাহসী মানুষের অভাব নেই। ব্রিজ ক্লাইম্বিং অফিসে ভিড় লেগে আছে।
                  



হারবার ব্রিজকে আদর করে কোট হ্যাঙ্গার নামেও ডাকা হয়। দূর থেকে দেখতে বিশাল একটা কোট হ্যাঙ্গারের মতোই লাগে এটাকে। সমুদ্র সমতল থেকে এই ব্রিজের উচ্চতা ১৩৪ মিটার। প্রায় ষাট লাখ স্ক্রু লাগানো হয়েছে এই ব্রিজে। সব স্ক্রু নাকি হাতেই লাগানো হয়েছে। ৫২ হাজার ৮০০ টন ইস্পাত ঝুলে আছে এই ব্রিজে। ব্রিজ তৈরির পরে প্রথম তিনবার পেইন্ট কোটিং করতে রঙ লেগেছে দু’লাখ বাহাত্তর হাজার লিটার। এই ব্রিজে প্রতিদিনই রং করা হয় কোন না কোন অংশে। সারা বছর ধরে  এ প্রক্রিয়া চলে। ব্রিজের মেন্টেইনেন্সের জন্য এই কাজ খুব জরুরি। ব্রিজের যে সমস্ত অংশে রঙ লাগাতে হয়, সব মিলিয়ে তার মোট ক্ষেত্রফল হিসেব করলে তা ষাটটি বড় বড় স্টেডিয়ামের ক্ষেত্রফলের সমান হবে। সাড়া বছর গড়ে দৈনিক প্রায় দেড় লাখ গাড়ি পার হয় এই ব্রিজের ওপর দিয়ে।
ব্রিজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে গেলাম। এপারে খুব বেশি কিছু নেই। আবাসিক এলাকায় কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে এলাম আবার।



রাত হয়ে যাচ্ছে। কাল চলে যাবো মেলবোর্নে। আজ সারাদিন হেঁটেছি। পা টনটন করছে এখন। ক্ষুধাও লেগেছে খুব। একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। মনে হচ্ছে সিডনি শহরের অনেক কিছুই  দেখা হয়ে গেলো। অনেক কিছুই বাদ রয়ে গেছে যদিও, তবুও মনে হচ্ছে মেলবোর্ন এর চেয়েও সুন্দর। কেন মনে হচ্ছে জানি না, হয়তো আমি মেলবোর্নে থাকি বলেই। হাঁটতে হাঁটতে আবার কিংস ক্রস। আলো ঝলসিত রং মাখা সং সাজা সভ্যতার দেউলেপনা দেখতে দেখতে ঘরে ফেরা। আজ সারা ঘরে আমি একা।

******

আমি মনে করেছিলাম আমার বাস সোয়া দশটায়। সে হিসেবে আটটার দিকে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ গুছাতে গিয়ে টিকেটে চোখ বুলিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ার জোগাড়। সোয়া ন'টায় বাস আমার। তাড়াহুড়ো কাকে বলে আর কত প্রকার! কিংস ক্রস থেকে আরাম করে হেঁটে সেন্ট্রাল আসার সময় আর নেই। রাস্তা পার হয়েই কিংস ক্রস আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন স্টেশন। কয়েক মিনিট পর পর সিটি সার্কেল ট্রেন। সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌঁছাতে খুব একটা দেরি হলো না। কাল সিটিতে ঘুরে সিডনির রাস্তা ঘাট সব চিনি এরকম একটা ভাব চলে এসেছিলো আমার। কিন্তু এখন ট্রেন থেকে বের হয়ে হাঁটছি তো হাঁটছিই। স্টেশন থেকে বের হবার রাস্তা আর খুঁজে পাই না। একটা সুড়ঙ্গ পথে হাঁটছি আরো অনেকের সাথে। শেষ পর্যন্ত যেখানে বেরোলাম সেখান থেকে সেন্ট্রালের লেজও দেখা যাচ্ছে না। কিলবিল করে মানুষ বেরুচ্ছে মাটির নিচের গর্ত থেকে যেটা দিয়ে একটু আগে আমিও বেরিয়েছি। কোথায় এলাম আমি!
               
হাতে সময় আছে মাত্র পনের মিনিট। এখনো চেক ইন করা, বোর্ডিং পাস নেয়া কিছুই হয়নি। বাসের নিয়ম অনুযায়ী বাস ছাড়ার কমপক্ষে পনের মিনিট আগে রিপোর্ট করার কথা। হেঁটে হেঁটে পথ খুঁজে বের করার সময় হাতে নেই। একটা ট্যাক্সি নিলাম। চায়নিজ ট্যাক্সিওয়ালাকে সেন্ট্রাল স্টেশান যাবো বলার পরে মাথা নেড়ে স্টার্ট দিলো ট্যাক্সিতে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে যখন মোড়টা ঘুরলো আমার নিজেকে একটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করলো। মোড়টা আমি হেঁটে দু’মিনিটেই ঘুরতে পারতাম। আর মোড় ঘুরলেই আমার বাসস্টপ। কিন্তু কোন কিছু ভালো ভাবে না চিনলে এরকম আক্কেল সেলামী তো দিতেই হবে। ট্যাক্সিওয়ালা আমার তাড়া দেখেই ঘোষণা করলো তার কাছে খুচরো ডলার নেই। ফেরত নেবার সময় নেই আমার। ব্যাগটা নিয়ে এক দৌড়ে টিকেট কাউন্টার।
           
আগে ভাগে এসে গেলে দেখা যায় গাড়ি ছাড়তে দেরি হয়। কিন্তু যখন তাড়াহুড়ো হয়, তখন গাড়িও পারলে সময়ের আগে ছেড়ে দেয়। মারফির সূত্র। দেখা গেলো বাসে সব যাত্রী উঠে বসে আছে, যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বাসে উঠে বসার প্রায় সাথে সাথেই ড্রাইভারের স্বাগত ভাষণ শুরু হয়ে গেলো। মেলবোর্নের বর্ণনা দিচ্ছেন, পথে কোথায় কোথায় থামবেন তা বলছেন। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে পেছনে চলে যাচ্ছে সিডনি সিটি, হাইড পার্ক, সিডনি টাওয়ার। যৌক্তিক বিচারে একবিংশ শতাব্দী এখনো না এলেও সবাই একবিংশ শতাব্দীকেই বরণ করে নিয়েছে এই সিডনিতে, শতাব্দীর মোহনায় দাঁড়িয়ে। গতি বাড়ছে বাসের।                       

__________
দ্বিতীয় অধ্যায়  এডেলেইডে সাত দিন
____________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Tuesday 30 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৮ম পর্ব



কিংস ক্রস ট্যুরিস্ট আর ব্যাকপ্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। দিনের আলো কমার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় নাইট লাইফ। বোঝাই যাচ্ছে কিংস ক্রস সিডনির রেড লাইট এরিয়া। এখানে নাইট লাইফ মানে বড় বেশি উচ্ছৃঙ্খলতা। পলিশের গাড়ি ঘন ঘন টহল দিতে শুরু করেছে। রাস্তার দু’পাশেই অনেকগুলো নাইট ক্লাব। একটু পর অ্যাডাল্ট শপ। লাইভ অ্যাডাল্ট শো চলছে নানা রকম ছোট বড় থিয়েটারে। সংক্ষিপ্ত পোশাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ, শরীর বিক্রি করা এদের পেশা। যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে পার হয়ে এলাম এই এলাকা। সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখের সামনে সাগর। একদম সাগর ঘেঁষে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গার নাম দেখলাম উলুমুলু বে। নামটা বেশ সুন্দর। আরেকটু সামনে যেতেই রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন। সিডনি শহরের বেশ কয়েকটা পার্কের একটা। সেই ১৮১৬ সালে গোড়াপত্তন হয়েছে এই পার্কের। পার্কের মাঝখানে পিরামিড আকৃতির গ্রিন হাউজে আছে হাজার রকমের ট্রপিক্যাল প্ল্যান্ট। বৃষ্টি না হলে পার্কে ওপেন এয়ার সিনেমা দেখানো হয় গ্রীষ্মকালে। পার্কের একপাশ দিয়ে সাইকেল ট্র্যাক আর পায়ে চলার পথ। এই পথ গিয়ে মিশেছে সিডনি অপেরা হাউজে।




অপেরা হাউজের চত্বরে এসে চোখ জুড়িয়ে গেলো। আলো ঝলমলে সিডনি অপেরা হাউজ যে এত সুন্দর তা নিজের চোখে না দেখলে মনে হয় খুব একটা বিশ্বাস করতাম না।
সিডনি শুধুমাত্র এই অপেরা হাউজ নিয়েই গর্ব করে বলতে পারে ‘আমিই অনন্য’। পৃথিবীর সেরা কয়েকটি স্থাপত্যের একটি হলো এই সিডনি অপেরা হাউজ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাগর থেকে জেগে উঠেছে  বিরাট বিরাট ছয়টি সাদা ঝিনুক।
এই অপেরা হাউজ সম্পর্কে পড়েছিলাম একটা ম্যাগাজিনে। সিডনি শহরে কনসার্ট আর অপেরা মঞ্চস্থ করার জন্য ভালো কোন অডিটোরিয়াম ছিলো না। ১৯৪৭ সালে স্যার ইউজিন গুজেনস নিউ সাউথ ওয়েলসের কনজারভেটোরিয়াম অব মিউজিকের ডিরেক্টর হয়ে আসার পর উদ্যোগ নিলেন একটা ভালো কনসার্ট হল তৈরি করার। কিন্তু পরবর্তী সাত বছরেও তিনি তেমন কিছু করতে পারলেন না এ ব্যাপারে। রাজ্যের মান তো আর থাকে না অবস্থা যখন হলো, তখন ১৯৫৪ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস এর প্রিমিয়ার জোসেফ কেহিল একটা কমিটি করে কনসার্ট হল তৈরির ব্যাপারটা এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলেন।
প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছিল সত্তর লাখ ডলার। এই টাকা সংগ্রহ করার জন্য নানারকম সাহায্য তহবিল করা হলো। কিন্তু সব মিলিয়ে নয় লাখ ডলারের বেশি সংগ্রহ করা গেলো না। তখন অপেরা হাউজের নামে লটারি ছাড়া হলো। হু হু করে বিক্রি হলো লটারি। অনেক বছর ধরে চললো এই লটারি বিক্রি আর উঠে এলো এক কোটি ডলারেরও বেশি। অপেরা হাউজের বাজেটও বেড়ে গেলো সেভাবে।
যেখানে অপেরা হাউজ তৈরি হয়েছে সেই জায়গার নাম ছিলো বেনেলাং পয়েন্ট। বেনেলাং নামে একজন আদিবাসি জন্মেছিলেন এখানে এবং তিনিই ছিলেন প্রথম আদিবাসি যিনি ইংরেজি ভাষাকে নিজের ভাষা করে নিয়েছিলেন।
ডিজাইনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সেরা সেরা স্থপতিরা ২৩৩টি ডিজাইন সাবমিট করলেন। ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হলো। ডেনমার্কের স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোনের ডিজাইন সেরা ডিজাইন মনোনীত হলো। ধারণা করা হয়েছিল পরবর্তী চার বছরের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে অপেরা হাউজ। কিন্তু তা হয়নি।
১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে নির্মাণ কাজ শুরু হলো। কিন্তু এতই ধীরে ধীরে কাজ চলতে লাগলো যে পরবর্তী চৌদ্দ বছরেও কাজ শেষ হলো না। এর কারণও ছিলো অনেক। নির্মাণ কাজ শুরু করার পর দেখা গেলো স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোন তাঁর ডিজাইন কমপ্লিট করেননি তখনো। ডিজাইন আর কন্সট্রাকশন একই সাথে চলতে লাগলো।
এদিকে সরকারের মনোভাবও ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। প্রথমে বলা হয়েছলো সাড়ে তিন হাজার দর্শক বসতে পারে এরকম একটা বড় অপেরা হল হবে আর একটা বারোশ' লোক বসার মতো ড্রামা হল হবে। সে হিসেবে প্রাথমিক ডিজাইন করা হয়েছিলো। এখন সরকার হাতে বেশি কিছু টাকা পেয়ে মনে করলো দুটোর জায়গায় চারটা থিয়েটার হল করা যেতে পারে। সে হিসেবে ডিজাইন চেঞ্জ করতে গিয়ে জোয়ের্ন উৎজোনের মাথা খারাপ হবার জোগাড়। 
সরকার অবশ্য আবারো তার মনোভাব চেঞ্জ করে চারটার জায়গায় পাঁচটা থিয়েটার বানিয়েছে এই অপেরা হাউজে। জোশের বশে প্রথমে যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছিলো, কাজে হাত দিয়ে দেখা গেলো সেভাবে হাউজ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। পরে ছাদের ডিজাইন বদলে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসতে আরো চার বছর গবেষণা করতে হয়েছে উৎজোনকে। কাজ কিছুদিন এগোয় কিছুদিন বন্ধ থাকে। বাজেটে কুলোয় না, নির্মাণ খরচ বেড়েই চলেছে। সব দোষ গিয়ে পড়েছে স্থপতি উৎজোনের ঘাড়ে। কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে উৎজোনের ওপর।
১৯৬৫ সালের নির্বাচনে এই অপেরা হাউজ নির্মাণ একটা বিরাট ইস্যুতে পরিণত হলো, সরকারই বদলে গেলো। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলো অপেরা হাউজের নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করবে এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
ক্ষমতায় এসেই তারা স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোনের বেতন বন্ধ করে দিলো, আর নানারকম দোষ ধরতে লাগলো উৎজোনের ডিজাইনের। একজন শিল্পীর পক্ষে এরকম অপমান সহ্য করা সম্ভব নয়। উৎজোন পদত্যাগ করলেন। এটাই চাইছিলো নতুন সরকার।
১৯৬৬ সালে নির্মাণ কাজের হাল ধরলো অস্ট্রেলিয়ান স্থপতিদের একটি টিম। তারাই কাজ শেষ করলো। ১৯৭৩ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হলো এই অপেরা হাউজ। অস্ট্রেলিয়ান অপেরা গোষ্ঠীর ‘ওয়ার এন্ড পিস’ ছিলো প্রথম অপেরা এই সিডনি অপেরা হাউজের। এর এক মাস পরে অক্টোবরের ২০ তারিখে অপেরা হাউজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রানি এলিজাবেথ।
অপেরা হাউজের প্রশস্থ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। সামনেই হারবার ব্রিজ। ব্রিজের রেলিং এ এখনো জ্বলজ্বল করছে ‘ইটারনিটি’। দু’দিন আগে এখানে লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছিলো, আজ সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা। নীরবতা চারিদিকে। অনেক মানুষ অবাক চোখে দেখছে এই অপূর্ব সৃষ্টি।
প্রায় এক হাজার ছোট বড় রুম আছে এই অপেরা হাউজে। পাঁচটি অডিটোরিয়াম, বিরাট এক রিসেপশান হল, পাঁচটি রিহার্সাল স্টুডিও, চারটি রেস্টুরেন্ট, ছয়টি থিয়েটার বার, ষাটটি গ্রিনরুম। অপেরা হাউজের এরিয়া হলো মোট সাড়ে পাঁচ একর। সাড়ে চার একর জায়গা জুড়ে এই ভবন সমুদ্রতলের চেয়ে ৬৭ মিটার উঁচুতে মাথা তুলে বসে আছে।
কী পরিমাণ লোহা সিমেন্ট লেগেছে এই বিশাল ভবন তৈরিতে তা নিয়ে সাধারণ কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু কেউ যদি জানতে চায় তাহলে খুব সহজেই জানা যায় এখানের অফিস থেকে। পুরো অপেরা হাউজের ওজন এক লাখ একষট্টি  হাজার টন। ৫৮০টি বিশাল বিশাল কংক্রিট পিলার চলে গেছে সমুদ্রের নিচে ৮২ ফুট গভীরে। তার ওপর বসে আছে এই বিশাল আইকন। এই বিল্ডিংএর সব কাঁচ এসেছে ফ্রান্স থেকে। পরিমাণও কম নয়, ৬৭ হাজার বর্গফুট। বৈদ্যুতিক তার যা ব্যবহার করা হয়েছে তা একটার সাথে অন্যটা যোগ করলে দৈর্ঘ্য হবে প্রায় চারশ মাইল। একদিনে এখানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে তা দিয়ে পঁচিশ হাজার লোক বাস করে এমন একটা শহর আলোকিত করা যাবে।
সিঁড়ি বেয়ে একদম উপরের তলায় উঠে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সামনেই সমুদ্র। ঢেউ এসে লাগছে অপেরা হাউজের দেয়ালে। ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকে। অপেরা হাউজের তিনদিকে ঘুরে দেখা যায় নৌকায় বসে। মনে হচ্ছে সিডনি শহর পুরোটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এরকম একটা পরিবেশে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। ছোট ছোট দুঃখ কষ্ট যেন দূর হয়ে যায়। যে কোন বিশালত্বের এটাই হয়তো বিশেষত্ব। সিডনির সব মানুষ কি সময় পায় এখানে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকার? কোন কিছু না করে শুধু সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার! ইন্ডিয়ান কারি পয়েন্টের ছেলেটা কি কখনো এসেছে এখানে?


আস্তে আস্তে নেমে এলাম। হারবার ব্রিজের ‘ইটারনিটি’ আমাকে টানছে। বাম দিকের পায়ে চলার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ব্রিজের কাছে। যতটা কাছে মনে হয়েছিল আসলে ততটা কাছে নয়। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ হাঁটতে হলো। ব্রিজের কাছে এসে দেখি উঠতে হবে প্রায় একশো ধাপ উপরে। পায়ে শক্তি নেই তত। কাল আবার আসতে হবে ভেবে জর্জ স্ট্রিটে উঠে এলাম।
রাত এখন গভীর। কিন্তু মনে হচ্ছে না এই শহর ঘুমাবে কখনো। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম  কিংস ক্রসে। এখানে এখন আরো ভিড়। ফুটপাতে হাঁটতে গেলে অন্যের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বা অন্যের ধাক্কা খেয়ে হাঁটতে হচ্ছে। উচ্চস্বরে বাজনা বাজছে। তার উপরে মাতাল দেহজীবীদের উপদ্রব আছে। গায়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করে সঙ্গী লাগবে কিনা। আর সবচেয়ে বেশি আছে ড্রাগ ডিলিং। পুলিশ সব জানে। তারা পয়সা হয়তো খায় না, কিন্তু কঠিন হাতে দমনও করে না। জাস্ট রুটিন টহল দিয়েই খালাস। আর ঘুষ তারা খায় না এটাও বলি কিভাবে। একটা বোঝাপড়া না থাকলে এরকম প্রকাশ্যে ড্রাগের ব্যবসা চলে কীভাবে? কোন রকমে গা বাচিয়ে চলে এলাম আমার হোস্টেলে।
রুম অন্ধকার। বাতি জ্বালালাম। সারাহ ঘুমাচ্ছে। রুমে আর কেউ নেই। আমি জুতো খুলে বাথরুমে ঘুরে এসে আমার দোতলা বিছানায় উঠে বসতেই চোখ খুলল সেরাহ - "হাই!"
সেরাহর চোখ ফোলা ফোলা। অনেকক্ষণ থেকে কি ঘুমাচ্ছে সে? 
জিজ্ঞেস করলাম, "বাইরে যাওনি আর?"
"গিয়েছিলাম, ফিরে এসেছি।"
"বন্ধুরা কোথায়?"
"তারা নাইট ক্লাবে গেছে। সেখানে আমাকে আর দরকার নেই তাদের। তাছাড়া নাইট ক্লাবে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। তুমি কোথায় কোথায় ঘুরলে?"
গল্প করার মুডে আছে সেরাহ। আমারও খারাপ লাগছে না তার সাথে কথা বলতে। এরকম মিষ্টি গলা আমি অনেকদিন শুনিনি। সেরাহ তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছে। আমি আমার বিছানায়। মুখোমুখি কথা বলছি আমরা। মাঝখানে লোহার বিছানার ছয় ইঞ্চি উচ্চতার রেলিং।
সিডনি শহরের অনেক তথ্য জানে সেরাহ। মনে হচ্ছে কলেজে তার মেজর সাবজেক্ট সিডনির ইতিহাস। কিন্তু না, তার মেজর সাবজেক্ট হলো সাইকোলজি। সিডনি শহর সম্পর্কে অনেক জানা-অজানা তথ্য শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে


শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৭ম পর্ব



হোটেলের ভাড়ার সাথে কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট ইনক্লুডেড। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম হোটেলের নিয়ম কানুন লেখা কাগজটা। ব্রেকফাস্ট খেতে চাইলে ন'টার ভিতর যেতে হবে ডাইনিং হলে। পোশাকের ব্যাপারে লেখা আছে অবশ্যই জুতো পরে যেতে হবে। আর কিছু লেখা নেই পোশাক সম্পর্কে। অস্ট্রেলিয়ানরা পোশাকের ব্যাপারে মোটেই খুঁতখুঁতে নয়। এখানে কেন যে জুতোর কথা লিখেছে জানি না। কোন জামাকাপড় ছাড়া শুধুমাত্র পায়ে জুতো গলিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে হাজির হলে কেমন হয়? আইনত কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু সভ্যতার সব নিয়ম তো আর লিখে দিতে হয় না। এখন বাজে সাড়ে আটটা। নটার ভিতরে ডাইনিং রুমে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ছুটির দিনে শুধুমাত্র ফ্রি ব্রেকফাস্ট করার জন্য কেউ এত তাড়াতাড়ি উঠবে না ঘুম থেকে। আসলে উইকডেতে এখানে যারা আসে বেশির ভাগই আসে প্রশাসনিক বা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। তাদের জন্য রেডি ব্রেকফাস্ট খুবই জরুরি।
হোটেল রুমটা বেশ সুন্দর করে সাজানো।  কাল রাতে এত সব চোখে পড়েনি। জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই দিনের আলোয় ভরে গেলো সারাঘর। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ক্যাপিটাল হিল। যেখানে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। বাংলাদেশের হাই কমিশনও সেখানে। অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পার্লামেন্ট দেখতে যেতে হবে সেখানে।
সিডনি ফিরে যাবার বাসের টিকেট করা আছে সাড়ে বারোটায়। হাতে কয়েক ঘন্টা সময় আছে ঘুরে বেড়ানোর। রেডি হয়ে হোটেলের চাবি জমা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। পা রাখলাম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানীতে। চোখের সামনে উড়ছে অস্ট্রেলিয়ান পতাকা। ক্যাপিটাল হিলে পার্লামেন্ট হাউজের উপর থেকে উড়ছে পতপত করে।
ছোট্ট শহর ক্যানবেরা। মাত্র তিন লাখ মানুষের বাস এখানে। দু'হাজার চারশ’ স্কয়ার কিলোমিটারের ছোট্ট টেরিটরি। এ-সি-টি বা অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি। নিউ সাউথ ওয়েলস ষ্টেটের মাঝখানে এই টেরিটরিতে সম্পূর্ণ পরিকল্পিত এই রাজধানী শহর। ক্যানবেরা সিটির চারপাশে একটা কৃত্রিম হ্রদ, নাম লেক বার্লি গ্রিফিন।
অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রফলের সাথে তুলনা করলে ক্যাপিটাল টেরিটরিকে একটা বিন্দুর মতো মনে হবে। উত্তর দক্ষিণে মাত্র ৮৮ কিলোমিটার লম্বা আর পূর্ব পশ্চিমের দূরত্ব মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার। এই শহরের প্রায় সবকিছুই পূর্ব পরিকল্পিত। এখানকার প্রত্যেকটি গাছও নাকি পরিকল্পনা মতো লাগানো। এ সিটির শতকরা চল্লিশ ভাগ জায়গা জুড়ে আছে ন্যাশনাল পার্ক। মুরামব্রিজ নদী বয়ে গেছে শহরের দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে। ক্যাপিটাল হিলকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন অঞ্চল গড়ে উঠেছে অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে। এলাকার নামও তাই নানারকম ক্রিসেন্ট। ঝলমলে সূর্যের আলোয় এত সবুজ ভরা ক্যানবেরা দেখে বোঝাই যায় না যে এখানের সমস্ত প্রাকৃতিক দৃশ্যকেও মানুষের শাসনে বেড়ে উঠতে হয়েছে।
ক্যানবেরার বয়স এখনো একশ বছরও হয়নি। ১৯০১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশন গঠিত  হবার পরে একটা ন্যাশানাল ক্যাপিটাল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সমস্যা হলো কোথায় হবে তা নিয়ে। মেলবোর্ন চায় তাদের ওখানেই হোক, আর সিডনি চায় তাদের শহরেই  হোক ফেডারেল ক্যাপিটাল। শেষ পর্যন্ত ১৯০৮ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো মেলবোর্ন বা সিডনি কোথাও না হয়ে এই দুই শহরের মাঝামাঝি কোন জায়গায় হবে রাজধানী শহর।
শহরের ডিজাইন করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিযোগিতায় জিতলো একজন আমেরিকানের ডিজাইন। আমেরিকান স্থপতি ওয়ালটার বার্লি গ্রিফিনের ডিজাইন অনুসারে গড়ে তোলা হয়েছে এই ক্যানবেরা শহর। নতুন শহরের নাম কী হবে তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ১৯২৭ সালে নাম ঠিক করা হয় ‘ক্যানবেরা’। আদিবাসীদের শব্দ ক্যানবেরা যার অর্থ হলো মিটিং প্লেস বা সম্মিলন ক্ষেত্র। 
ক্যানবেরার বেশির ভাগ স্থাপনা তৈরি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯৪৬ সালে গড়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি। সেই হিসেবে বেশ নতুন বলা চলে এই শহরটাকে।

পার্লামেন্ট হাউজের সামনে

পার্লামেন্ট হাউজের কাছে এসে অভিভূত হয়ে গেলাম। প্রথমেই চোখ যায় চার পায়ের উপর দাঁড়ানো বিরাট ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের ওপর। জাতীয় পতাকাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেখানো হয় এখানে। তবে এই সম্মান একেক জনের কাছে একেক রকম। জাতীয় পতাকার রঙে এরা অন্তর্বাসও তৈরি করে।
অনেক ট্যুরিস্ট এসে গেছে এর মধ্যেই। দর্শকদের জন্য সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে এই পার্লামেন্ট হাউজ, সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত। গেট দিয়ে ঢুকতেই বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি অফিসার দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে ভয় পাবার কথা হলেও তারা কেউ ভয়ানক দর্শক নয়। বেশ হাসি খুশি। সিকিউরিটি অফিসারদের হাসিখুশি দেখলে তাদের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা হয় না। কিন্তু আমার ধারণা নিয়ে তারা কেউ খুব একটা বিচলিত বলে মনে হলো না। হাসি মুখেই ওয়েলকাম জানালো আমাকে।
সিকিউরিটি ইউনিটে একটা মেটাল ডিটেক্টরের ভিতর দিয়ে যেতে হয় সবাইকে আর সাথের সব জিনিসপত্র চালান করে দিতে হয় স্ক্যানারের ভিতর দিয়ে। খুব সহজ যান্ত্রিক ব্যবস্থা। এটাই একমাত্র প্রবেশপথ সাধারণের জন্য। আর কোথাও কোন চেকিং এর ব্যবস্থা নেই। গাইড আছে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই। কিছু জানাতে চাইলে ঝটপট করে বলে দিচ্ছে। ভিতরের প্রত্যেকটা ঘরেই যাওয়া যায়। বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো।
এই পার্লামেন্ট হাউজের বয়স মাত্র বারো বছর। ১৯৮৮ সালে তৈরি হয়েছে এই ভবন। ইতালিয়ান স্থপতি রোমালডো জিউরগোলা এই ভবনের ডিজাইন করেছেন। বার্লি গ্রিফিন লেকের ঠিক দক্ষিণ পাড়েই এই পার্লামেন্ট হাউজ। সবুজ পাহাড়ের চূড়োয় বসে আছে এক টুকরো ছবির মতো।
পার্লামেন্ট হাউজের ভিতর অসংখ্য পেইন্টিংস। সবগুলিই অস্ট্রেলিয়ান শিল্পীর আঁকা। সিনেট হল, পার্লামেন্ট হল সব ঘুরে ঘুরে দেখালাম। যখন পার্লামেন্ট অধিবেশন চলে তখনো নাকি দর্শক এসে দেখতে পারে। এদেশের এমপিরা সম্ভবত জনগণকে খুব একটা ভয় পায় না। অথবা জনগণকে খুব বেশি আলাদা মনে করে না। জনগণ যে এদেশের কাউকেই ছেড়ে কথা কয় না।

সিনেট হাউজ

অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের জন্য ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক আর এদেশের সরকারের মেয়াদ তিন বছর। পার্লামেন্ট হাউজের তিন তলায় বিরাট একটা আর্ট গ্যালারিও আছে আর আছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস সম্বলিত ছবির প্রদর্শনী। ইতিহাসকে এরা আড়াল করে না। মনে হয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার মানসিকতাও আছে এই জাতির।
পার্লামেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যায় বার্লি গ্রিফিন লেকের পাড়ে। এই লেক কাটা হয়েছে ১৯৬৩ সালে। মুলুংগুলু নামে একটা নদী ছিলো আগে এখানে। নদীটি মরে যায় প্রবাহ না থাকায়। তখন নগর কর্তৃপক্ষ এই লেক কাটার ব্যবস্থা করে। শহরের স্থপতি বার্লি গ্রিফিনের নামে নামকরণ হলো এই হ্রদের। লেকের চারপাশে বাঁধানো পাড়ে সাইকেল চালানো যায়, স্কেটিং করা যায়। ইচ্ছে করলে হেঁটে পার হওয়া যায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পথ।
হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট নৌকা। ভাড়া করা যায় ঘন্টা হিসেবে। পানিতে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে হলে একটা নৌকায় চড়ে বসলেই হলো। হ্রদের মাঝখানে এক জায়গায় ক্যাপ্টেন কুক মেমোরিয়াল ওয়াটার জেট। এখান থেকে শূন্যে পানি উঠে যাচ্ছে প্রায় দেড়শো মিটার। সূয্যের আলোয় হীরক কুচির মতো ঝরে পড়ছে এই জেটের পানি।
হাতের সময় দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। চলে এলাম বাস টার্মিনালে। সাড়ে বারোটার বাস সাড়ে বারোটাতেই ছাড়লো। এই বাস আসছে মেলবোর্ন থেকে। এখানে যাত্রী নামিয়ে সিডনিগামী যাত্রীদের তুলছে। আমার সিট একদম পেছনের দিকে। আবার চলছি সিডনির দিকে। এবার সিডনি শহরকে দেখতে হবে নিজের মতো করে।
চার ঘন্টা লাগলো সিডনি পৌঁছাতে। পথে একবারও থামেনি বাস। সিডনি শহরে ঢোকার সময় একটু রোদ ছিলো আকাশে। কিন্তু বাস থামতে না থামতেই বৃষ্টি নেমে এলো। প্রথমে এক দুই ফোঁটা, একটু পরেই অঝোর ধারায়। আকাশ আলকাতরা হয়ে আছে। এই বৃষ্টি কখন থামবে জানি না। হোটেল খুঁজতে হবে রাতে থাকার জন্য।
সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে একটা ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল আছে। কিন্তু কোন সিট খালি নেই। আরো কয়েকটা হোটেলে ফোন করে দেখলাম। ছোট বড় সব হোটেলেই ক্রেডিট কার্ড চায়। আমার কোন ক্রেডিট কার্ড নেই। সুতরাং আমার কোন আইডেন্টিটি নেই বড় হোটেলে থাকার জন্য। উঠতে হবে ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেলে।
কিংস ক্রস অ্যারিয়া হলো ব্যাকপ্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। অনেকগুলো ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেল আছে এখানে। বিছানা থেকে শুরু করে সব কিছু প্যাক করে পিঠে নিয়ে যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের জন্য কম খরচে থাকার ব্যবস্থা থাকে বলেই তা ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেল। বৃষ্টি ধরে এসেছে একটু। কয়েক ফোঁটা যা ঝরছে এখনো, তাকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না। রেইনকোটটা গায়ে চড়িয়ে পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটতে লাগলাম কিংস ক্রসের উদ্দেশ্যে।
সিডনি সিটি ম্যাপ ফলো করতে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না।  আকাশ মেঘলা হলেও আলোর অভাব নেই কোথাও। রাস্তার আনাচে-কানাচে আলো। পার্কের মাঝখানে পায়ে চলার পথে আলো। আক্ষরিক অর্থেই আলোয় ভুবন ভরা। কিংস ক্রস এলাকায় এসেই বুঝতে পারলাম কত ব্যস্ত আর মনোহারি এলাকা এটা। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে আবার। কিন্তু ফুটপাতে শেড দেয়া আছে।
রাস্তার ধারেই একটা ব্যাকপ্যাকার্স চোখে পড়লো। দোতলায় রিসেপশান। ম্যানেজার ইন্ডিয়ান, নাম ভিক্টর। আমি জায়গা পেলাম ওয়ান সি রুমে। ছয়জনের একটা রুমে একটা সিট খালি আছে। চাবি নিয়ে রুমে ঢুকলাম। ছয়জনের জন্য তিনটা দোতলা বিছানা। চট্টগ্রামের স্টেশন রোডে কিছু ঢালাও বিছানার হোটেল আছে। সারি সারি বিছানা পাতা। ঘুমানোর জন্য বিছানা ভাড়া দেয়া হয়, রুম নয়। এখানেও সেরকম। ছয়জনের জন্য একটা বাথরুম, ঘরের ভিতরেই আছে। ফলে রুম থেকে বেরোবার দরকার নেই। টেলিভিশন ফ্রিজ সবকিছু আছে। এত কম ভাড়ায় এর চেয়ে বেশি আশা করা উচিত নয়। তাছাড়া বেড়ানো যেখানে মূল উদ্দেশ্য সেখানে হোটেলে বসে তো কেউ সময় কাটাবে না। সামর্থ্য না থাকলে কত ধরনের যুক্তিই দেখানো যায়। আমার বেশ থ্রিলিং লাগছে।
রুমের ভিতর এই বিকেলবেলায় চার বিছানায় চার জন ঘুমাচ্ছে। তিনটে দোতলা বিছানায় একটার উপরের একটা আর অন্যটার নিচের একটা বিছানা খালি আছে। কিন্তু নিচের খালি বিছানায় একটা জ্যাকেট মেলে দেয়া, আর ওপরেরটায় দুটো বই রাখা। এই দুটোর মধ্যে ঠিক কোন বিছানাটা খালি বুঝতে পারছি না। বামদিকের দেয়াল ঘেঁষে লম্বালম্বি লাগানো দুটো বিছানার একটার দোতলায় ঘুমাচ্ছে একটা মেয়ে। আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি এ সময় মেয়েটি চোখ খুলে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো, "হাই"।

"হাই, ডু ইউ নো, হুইচ সিট ইজ ভ্যাকেন্ট হিয়ার?"
"দিস ওয়ান। প্লিস টেক দিস ওয়ান।" বলেই সে উঠে বসলো বিছানার ওপর। হাত বাড়িয়ে অন্য বিছানার উপর থেকে বই দুটো টেনে নিলো নিজের বিছানায়। মেয়েটার গলার স্বর অদ্ভুত মিষ্টি।

ছেলে আর মেয়ে একই রুমে থাকাটা এদেশে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমি ধীরে সুস্থে আমার লকার গুছালাম। লকারের লক ছিলো না, ম্যানেজারের কাছ থেকে তালা চেয়ে নিয়ে এলাম। তালার জন্য আলাদা দশ ডলার জমা দিতে হলো। যাবার সময় তালা ফেরত দিলে টাকা ফেরত দেবে।
লকারে ব্যাগটা রেখে সিডনি সিটির ম্যাপ নিয়ে উঠে এলাম আমার দোতলা বিছানায়। মেয়েটি দেয়ালের দিকে পা দিয়ে শুয়ে আছে। এখন আমি যদি অন্য দেয়ালের দিকে মাথা দিয়ে শুই তাহলে তার মাথায় আমার পা লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং আপাতত তার মাথার দিকেই আমাকে মাথা দিতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ট্রেনের বাংকে শুয়ে আছি। কয়েক মিনিট পরেই মেয়েটি আলাপ শুরু করলো।

"হাই, আয়াম সেরাহ।"
সেরাহ নামটা খুব প্রচলিত একটা নাম এখানে। বোধহয় প্রতি দশ-বিশজন মেয়ের মধ্যে একজনের নাম সেরাহ। আমরা যাকে সারা বা সারাহ উচ্চারণ করি তাই হয়ে গেছে সেরাহ। আমি আমার নাম বললাম। সে তা উচ্চারণ করার চেষ্টা করলো। এরা ‘দ’ উচ্চারণ করতে পারে না। প্রদীপ হয়ে যায় প্রাডিব।
জানা গেলো সারাহ সিডনির মেয়ে। এখানেই থাকে, পড়ে কোন একটা কলেজে। যে ছেলেরা ঘুমাচ্ছে তারা সব তার বন্ধু। ব্রিসবেন থেকে এসেছে তারা। সারাহ তাদের সিডনি শহর দেখাচ্ছে।
আমি আর দেরি করলাম না। পরে দেখা হবে বলে ছাতা আর রেইনকোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঘরে বসে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
রাস্তায় বেরিয়ে বুঝতে পারলাম ক্ষুধা লেগেছে। ম্যাকডোনাল্ডস খাব কিনা ভাবছি - চোখে পড়লো ‘ইন্ডিয়ান ক্যারি পয়েন্ট’ ঠিক রাস্তার ওপারেই।
ইন্ডিয়ান টেকওয়ে প্লেস যেরকম হয়ে থাকে সেরকম। খুব ছোট ছোট দোকান। মাত্র তিনটা টেবিল আর গোটা দশেক চেয়ার পাতা আছে। টেবিলের ওপর ময়লার আস্তরণ। কাউন্টারে তরকারি যেগুলো রাখা আছে সব আমার পরিচিত। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করতে করতে আমি মোটামুটি বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি এ ব্যাপারে।
ভাত আর একটা তরকারি নিয়ে খেতে বসলাম। প্লেটেও মনে হচ্ছে ময়লা লেগে আছে। মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করেছে। ভাবছি যাবার সময় এই বিষয়ে কথা বলবো। হঠাৎ কাউন্টারে ছেলেটাকে টেলিফোনে বাংলায় কথা বলতে শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কথায় ঢাকাইয়া আঞ্চলিক টান। বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে খারাপ হয়ে যাওয়া মেজাজ আবার ভালো হয়ে গেলো। টেবিলের ময়লাকেও আর অসহ্য মনে হচ্ছে না । খুব বাজে স্বাদের রোগেনজোশকেও খুব একটা খারাপ লাগছে না।
পয়সা দেবার সময় জানতে চাইলাম, "ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনি কি বাংলাদেশি?"
"হুঁ" - গলার ভেতর ছোট্ট একটা শব্দ করলো ছেলেটা। মনে হচ্ছে  আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয় সে খুব একটা। আমার বাংলা কথা শুনেও তার মুখে হাসি ফুটলো না। আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার নাম বললাম। সে হ্যান্ডশেক করা বা তার নাম বলা - কোনটাই করলো না। তার চোখে-মুখে বিরক্তি।
আমি জানতে চাইলাম, "দোকানের মালিক কি ইন্ডিয়ান?"                                                               
        "না, বাংলাদেশি"
"তবে দোকানের নাম ইন্ডিয়ান কেন? বাংলাদেশি দোকান বললে বুঝি চলে না?"
আমার কথা শুনে ছেলেটা এত রেগে যাবে বুঝতে পারিনি। বেশ রাগী রাগী কন্ঠে বললো, "খাবারগুলো সব যে ইন্ডিয়ান তা চোখে দেখেন না?"
 
ইন্ডিয়ান তরকারি সম্পর্কে সে আমাকে যা বলতে চাচ্ছে তাতে আমার সন্দেহ হচ্ছে সে আদৌ কিছু জানে কিনা। তার কথা বলার ভঙ্গিতে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। আমার সঙ্গে বাংলাদেশি মানুষের এরকম বিতৃষ্ণ ব্যবহার এই বিদেশে আশা করিনি।
মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, কোন রকমে সামলে নিলাম। কী দরকার! ছেলেটা হয়তো বড় কষ্টে আছে এখানে। হয়তো অবৈধভাবে আছে। কাজ করে যা পায় সব যায় উকিলের পেটে। শুনেছি এই সিডনি শহরে অনেক ছেলে অবৈধভাবে এক রুমে দশ-বারোজন গাদাগাদি করে থাকে। ঘন্টায় দু’তিন ডলার মজুরিতে কাজ করতে হয় রেস্টুরেন্টের কিচেনে বা গ্রোসারির গুদামে। বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নেই বলে কম মজুরির জন্য কোথাও নালিশও করতে পারছে না। দেশেও চলে যেতে পারছে না। কী দরকার তার সাথে রাগারাগি করার। নিজের দেশের একজন মানুষ পেয়েও ভালভাবে কথা বলতে না পারাতে একটু কষ্ট লাগছে বৈকি।
___________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Monday 29 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৬ষ্ঠ পর্ব



নতুন বছরের প্রথম দিনের সূর্যালোক জানালায় আসার সাথে সাথেই ঘুম ভেঙেছে। স্বপনদারা ফিরেছেন একটু আগে। গতকাল সারাদিন, সারারাতের ক্লান্তির পরে এখন তাঁদের দরকার একটা দীর্ঘ নিরুপদ্রব ঘুম। আমি যথাসম্ভব নীরবে সকালের কাজ সেরে ব্যাগ গুছিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি। আমাকে যেতে হবে। দাদা বৌদিকে কিছু না বলে বেরোই কীভাবে? আবার এসময়ে ঘুম থেকে তাঁদের জাগাতে ইচ্ছে করছে না একটুও। তাঁদের উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে ঘরের অটোম্যাটিক লক অন করে বেরিয়ে গেলাম। মিনিট খানেক পরেই চেপে বসেছি সিডিনিগামী ট্রেনে। পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে নামলাম সিডিনি সেন্ট্রাল স্টেশনে।

নিউ ইয়ার্স ডে উপলক্ষে শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ আজ। স্টেশনেও খুব একটা ভিড় নেই। আমার ক্যানবেরার বাস সোয়া দশটায়। হাতে এখনো ঘন্টাখানেক সময় আছে। এ শহরের রাস্তায় রাস্তায় নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে আছে। কাল ক্যানবেরা থেকে ফিরে এসে তা করা যাবে।

সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনের বিল্ডি-এর মধ্যেই গ্রেহাউন্ড বাস কাউন্টার। চেক ইন করে বোর্ডিং পাস নেবার পরও দেখি হাতে আরো কিছু সময় আছে। স্টেশন চত্বরে হাঁটতে লাগলাম। রোদে ঝলমল করছে চারদিক। স্টেশনের যাত্রীদের বেশির ভাগই  ট্যুরিস্ট। 

এই সেন্ট্রাল স্টেশনের ২৬ আর ২৭ নম্বর প্লাটফরমকে বলা হয় ভুতুড়ে প্লাটফরম। তার কারণ হলো ১৯৭৯ সালে এই প্লাটফরম দুটো তৈরি হবার পর থেকে একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। এ দুটো প্লাটফরম থেকে কোন ট্রেন ছাড়ে না বা কোন ট্রেন থামেও না এ দুটো প্লাটফরমে।    একজন দু'জন করে যাত্রী এসে জমা হতে শুরু করেছে ক্যানবেরাগামী বাসের কাছে। সোয়া দশটার বাস ছাড়লো প্রায় দশ মিনিট দেরিতে। ছুটির দিন। কারো কোন তাড়া নেই। সবার মুখ হাসি হাসি। অস্ট্রেলিয়ার মানুষ গায়ে পড়ে আলাপ জমায় অনেক সময়। ভালোই লাগে তাদের দিলখোলা ভাব। অষ্টাদশী ক্যারেনের সাথে আলাপ হলো। সে ক্যানবেরার মেয়ে। সিডনিতে এসেছিল কোন কাজে, এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ক্যাবেরার ঠিক কোথায় বাড়ি তা তো আর সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না, আর সে বললেও আমি চিনবো না। ঊর্মিরা থাকে নারাবুন্ধায়। ক্যারেনের কাছে জানতে চাইলাম নারাবুন্ধা কীভাবে যেতে হয়। সে বললো ক্যানবেরা গিয়ে দেখিয়ে দেবে।

হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছে আমাদের বাস। একটা সিনেমা দেখানো হচ্ছে বাসের টেলিভিশনে। রাস্তার দু’পাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে ঘন গাছপালা, বেশির ভাগই ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি। অস্ট্রেলিয়ান গরু চরছে। এদিকে সম্ভবত প্রচুর ডেইরি ফার্ম আছে। সিডনি থেকে ক্যানবেরার সড়ক দূরত্ব সাড়ে তিনশ কিলোমিটারের মতো। বিরাট চওড়া হাইওয়ে। ওয়ান ওয়ে হওয়াতে অন্যদিক থেকে আসা গাড়ির সাথে তাদের দেখা হচ্ছে না। বাইরের ঝকঝকে নীল আকাশ আর দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর দেখতে দেখতে এক সময় ক্লান্তিই চলে আসে। সুন্দরের সরবরাহ বেশি হয়ে গেলে সুন্দরও মনোটোনাস হয়ে পড়ে।
ক্যারেনের দিকে চোখ গেলো। সে সিটে পা তুলে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। দিনের বেলায় ঘুমানোটা এদেশের সংস্কৃতির সাথে ঠিক মেলে না। কিন্তু বাসে ট্রেনেতো অনেককেই ঘুমাতে দেখি।

বাসের গতি ক্রমশ কমে আসছে। অনেক রকম বিল্ডিং আর সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে। মনে হচ্ছে ক্যানবেরা পৌঁছে গেছি। ক্যারেন চোখ খুলে বাইরে তাকিয়ে বললো, "আমরা এসে গেছি"।
সোয়া দুটোয় গাড়ি থামলো ক্যানবেরা সেন্ট্রাল স্টেশনে। এদেশের সব সিটিতে একটা করে সেন্ট্রাল স্টেশন থাকে মনে হয়। বেশ সুন্দর লাগল ক্যানবেরা সেন্ট্রাল। এখানে শুধু বাস থামে। ক্যানবেরায় ট্রেন আছে কিনা আমি জানি না। ক্যারেনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও জানে না। ট্যুরিস্টদের জন্য ইনফরমেশন সেন্টার আজ বন্ধ।  তবে বিভিন্ন হোটেলের টেলিফোন নম্বর আর ছবিসহ বিরাট বিলবোর্ড  দেখা যাচ্ছে। বিলবোর্ডে লাগানো নম্বরে ডায়াল করলে বিনামূল্যে হোটেলের রিসেপশনে কথা বলা যায়। বুকিং করার পর হোটেলের লোক এসে নিয়ে যাবে এখান থেকে। ব্যবস্থাটা খুব ভাল লাগলো।
আমি আপাতত হোটেলে যাচ্ছি না। আগে ঊর্মিদের ওখান থেকে ঘুরে আসি। রায়হানকে ফোন করলাম। তারা বসে আছে আমার জন্য। এখন হোটেলে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ক্যারেন অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমাকে সিটি বাসে তুলে দেবে। ক্যানবেরার সবাই এরকম পরোপকারী কিনা জানি না।

ক্যারেন একটা ম্যাপ নিয়ে এলো কোত্থেকে। বাসের রুট আর সময় দেয়া আছে সেখানে। মার্কেট টার্কেট সব বন্ধ আজ। ক্যারেন আমাকে নিয়ে কয়েকটি রাস্তায় হাঁটলো, যদি কোন দোকানপাট খোলা থাকে। আমি ঊর্মির জন্য কিছু কিনতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু একটা দোকানও খোলা পেলাম না। ক্যারেন খুঁজছে সিগারেট। আমি সিগারেট খাই না জেনে একটু লজ্জিত হওয়ার ভঙ্গিতে হাসলো। কিন্তু তার নাকি সিগারেটের তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। দোকান খোলা না পাওয়াতে এবার সে একজন পথচারীকে থামিয়ে একটা সিগারেট চেয়ে নিলো। ভিক্ষা চাইতে লজ্জা লাগলেও সিগারেট চাইতে সম্ভবত লজ্জা লাগে না। নেশার কাছে মানুষের অনেক বোধেরই মৃত্যু ঘটে।
আমাকে ধরতে হবে ৩৫ নম্বর বাস। নারাবুন্ধায় যায় এই বাস। ঊর্মি আর রায়হান থাকে সেখানে। ক্যারেন যাবে ঠিক উল্টো দিকে। তার বাস আমার বাসের আগে। সে বারবার জিজ্ঞাসা করছে আমি যেতে পারবো কিনা। ভালো লাগলো তার আন্তরিকতায়। তার সাথে আমার হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না। কিন্তু হু কেয়ারস ফর দ্যাট? মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারটা হয়তো ক্যারনের সহজাত একটা গুণ। তার সাবলীলতায় আমি মুগ্ধ। হাত নাড়তে নাড়তে চলে গেল সে। আমি ৩৫ নাম্বার বাসে চড়ে বসলাম।
বাসে আমিসহ মাত্র চারজন যাত্রী। সবাই বৃদ্ধ। ড্রাইভারও বেশ বয়স্ক। ক্যানবেরাতে বৃদ্ধদের সংখ্যা বেশি বলে শুনেছি। তরুণরা এইরকম একটা ছোট চুপচাপ এলাকায় থাকতে চায় না হয়তো।
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী এই ক্যানবেরা। কিন্তু রাজধানী বলতে যেরকম একটা ব্যস্ত বাণিজ্যিক শহরের কথা মনে হয়, এটা সেরকম নয়। শুধুমাত্র প্রশাসনিক কাজের জন্য প্ল্যান করে এই শহর গড়ে তোলা হয়েছে। ক্যানবেরাই নাকি পৃথিবীর একমাত্র সিটি যেটা আগে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তারপর নগরায়ন হয়েছে। সাধারণত হয়ে থাকে উল্টো। কোন ভাবে বসতি গড়ে ওঠে কোথাও তারপর পরিকল্পনা করা হয় কীভাবে তার উন্নয়ন করা যায়।
      
বাসের জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি আমি। কোথাও কোন জনমানুষ চোখে পড়ছে  না। মনে হচ্ছে রূপকথার কোন ঘুমন্ত শহরে এসে পৌঁছেছি। বিরাট বিরাট রাস্তা । সব গাছপালার ছায়ায় ঢাকা। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। এ যেন সেই ‘গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়’। বাসের ভিতরে যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে দেখি চারজনেই তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই একজন বললেন "হ্যাপি নিউ ইয়ার মাইট"।
আজ নিউ ইয়ার্স ডে এটা এখানে কীভাবে সেলিব্রেট করেছে আমি জানি না।

"হোয়ার ইউ গোয়িং?"
আমি কোথায় যাবো? সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন এরা। বাসের টিকেট করার সময় কোথায় যাবো একবার বলেছি। তখন হয়তো খেয়াল করেননি কেউ। কারণ এখানে সিটি বাসের ভাড়া যেখানেই যাও, সমান। দুই ডলার প্রতি ট্রিপ।
বাসের ড্রাইভার আর যাত্রীরা প্রতিযোগিতা করে সাহায্য করলেন আমাকে। ৪৭ নম্বর বাড়ির সামনে কোন স্টপেজ নেই। কিন্তু ড্রাইভার সেখানেই গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, আমি যে ঠিক জায়গায় নেমেছি তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন।  আমাকে দেখে রায়হান ছুটে আসার পরে বাস ড্রাইভার হাত নেড়ে চলে গেলেন তাঁর গন্তব্যে। ভালো লাগলো খুব। মনে হল নিয়ম যে মানুষের জন্য তৈরি তা এরা খুব ভালোভাবে জানেন। আসলে নিয়মের চেয়ে মানুষের সংখ্যা কম হলে এই রকম বদান্যতা দেখানো সব দেশে সম্ভব।
রায়হানকে আমি আগে কখনো দেখিনি। ঊর্মির যখন বিয়ে হয়, তখন আমি দেশের বাইরে। রায়হান আমাকে দেখে দৌঁড়ে রাস্তায় চলে এসেছে। লুঙ্গি আর টিশার্ট পরা মোটা পাওয়ারের চশমা চোখে রায়হানকে দেখেই ভালো লেগে গেলো আমার। কত দিন পরে ঊর্মিকে দেখলাম। ঊর্মি আমার দিদির ননদের মেয়ে। খুব শুকিয়ে গেছে মেয়েটা।
ছোট্ট ছিমছাম বাসা। ঢুকতেই রান্নাঘর, তারপর বসার ঘর আর শোবার ঘর। সবকিছু চমৎকারভাবে গোছানো। রান্না হিটিং সবকিছু ইলেকট্রিক এখানে। গ্যাস থাকলে ভালো হতো। এদেশে ইলেকট্রিসিটির দাম গ্যাসের চেয়ে বেশি।
ক্যানবেরার বড় সমস্যা হলো এখানে বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না সহজে। কারণ ভাড়া দেওয়ার জন্য বাড়ি এখানে খুব একটা বানায় না কেউ। বৃদ্ধ আর চাকরিজীবীরাই মূল বাসিন্দা ক্যানবেরার। এখন অবশ্য ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু ঘর তৈরি হচ্ছে। রায়হানের বাড়িওয়ালা নিজের থাকার ঘর থেকে একটা অংশ ভাড়া দিয়েছে এদের। এর চেয়ে বড় বাসা লাগে না আসলে এখানে। দু'জনের সংসার। রায়হান কাজ করে উলওয়ার্থে। ঊর্মি ভর্তি হয়েছে ক্যানবেরা ইউনিভার্সিটিতে। সুখে আছে তারা। দেখে খুব ভালো লাগলো আমার।
           
পোলাও, মাংস, মাছ ইত্যাদি হরেক রকম আয়োজন করে রেখেছে তারা। খেতে খেতে গল্প আর গল্প করতে করতে খাওয়া হলো। দেশের গল্প। দেশের মানুষের গল্প। এখানকার বাঙালিদের গল্প, রায়হানের বন্ধুদের গল্প, ক্যানবেরার চাকরির বাজার আর বাংলাদেশের রাজনীতি সবকিছু নিয়ে প্রাণ খুলে আড্ডা মারলাম অনেকক্ষণ। রায়হানের সাথে গল্প করে বেশ মজা পাওয়া যায়। ছেলেটা মামাশ্বশুর বলে আমার সাথে কোন সংকোচজনক দুরত্ব রাখছে না এজন্যই তাকে এত ভালো লাগছে।
            
সন্ধ্যার দিকে বেরোলাম একটু। ঘুরে বেড়ানোর জন্য। রায়হান সাথে আসতে চাইলো। কিন্তু ঊর্মিকে বাসায় একা রেখে বেরোতে মানা করলাম। এমনিতেই তো তাকে অনেকটা সময় একা কাটাতে হয়। আজ ছুটির দিনেও সেটা করা উচিত হবে না। তাছাড়া একটু একা ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করলো। নতুন জায়গা দেখার জন্য একা ঘুরে বেড়ানো খুব ভালো মনে হয় আমার।
              
ক্যানবেরার রাস্তাগুলো বিশাল। সে তুলনায় ফুটপাত খুব ছোট। রাস্তা আর ফুটপাতের মাঝে বেশ চওড়া, রাস্তার চেয়েও প্রশস্ত জায়গা। সেখানে গাছ আর ঘাসে ভর্তি। স্ট্রিট লাইট খুব কম। যে কয়টা লাইট আছে সেখান থেকে আলো যা আসে তাও খুব টিমটিমে। এখানে বোধ হয় সন্ধ্যার পরে কেউ হাঁটতে বেরোয় না। আমি ছাড়া আর কোন ব্যক্তির দেখা পেলাম না রাস্তায়। হেঁটে হেঁটে ক্লে ক্রিসেন্ট থেকে মানুকা সেন্টার পর্যন্ত আসার পথে আর একটা মানুষও দেখলাম না। ছুটির দিন বলেই হয়তো।
মানুকা সেন্টারে বেশ কিছু দোকানপাট, ব্যাংক আর সুপার মার্কেট আছে। এখান থেকে একটা ট্যাক্সি নিলাম। ট্যাক্সিওয়ালা ভিয়েতনামি। এগারো বছর ধরে নাকি আছে এই ক্যানবেরায়। কথা শুনে মনে হলো সে ক্যানবেরার প্রেমে পড়ে গেছে। ক্যানবেরার সব কিছুই ভালো তার কাছে। এখানে ট্যাক্সির সংখ্যা খুব বেশি না হওয়াতে খুব একটা প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে না তাকে। সে আমাকে নিয়ে চললো ম্যাককোয়ারি হোটেলে।
   
বেশ বড় হোটেল এই ম্যাককোয়ারি। রুম পেতে কোন অসুবিধা হলো না। চাবি নিয়ে একই ট্যাক্সিতে ফিরে এলাম মানুকা সেন্টারে। আমি ট্যাক্সি ছাড়তে চাইলেও সে আমাকে ছাড়তে চাচ্ছে না। সে বলছে ফেরার পথে আমি রাস্তা ভুল করতে পারি। সে তখন দেখা যাবে। একটু আগে আমি হেঁটে এসেছি এই পথে। ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। অস্ট্রেলিয়ায় ট্রিপস দেওয়ার প্রথা চালু নেই। কিন্তু আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে বেশ ভালোই ট্রিপস দিলাম।  উলওয়ার্থে ঢুকলাম। এই চেইন সুপার মার্কেটের নাম সব জায়গায় উলওয়ার্থ, কিন্তু মেলবোর্নে সেফওয়ে। আমি জানি না কেন।  উলওয়ার্থ সাহেবের এই ব্যবসা পৃথিবী বিখ্যাত। ভিতরে ঢুকে স্বাভাবিক ভাবেই  তুলনা এসে যাচ্ছে মেলবোর্নের সাথে। দেখলাম মেলবোর্নের তুলনায় এখানে জিনিস পত্রের দাম অনেক বেশি। একই কোম্পানির জিনিস একেক জায়গায় একেক দাম। দ্রব্যমূল্য কীভাবে নির্ধারিত হয় আমি জানি না।
সুপার মার্কেট থেকে বেরিয়ে দেখলাম রাস্তার রাউন্ড এবাউট থেকে দুই-তিনটি রাস্তা চলে গেছে ভিন্ন ভিন্ন দিকে। এর কোনটা ধরে এসেছিলাম আমার আর মনে নেই। ট্যাক্সিওয়ালার কথা মনে হলো। রাস্তা ভুল করতে পারি! পকেটে ম্যাপ আছে। খুলে বের দেখলাম আর খুব নিশ্চিত হয়ে পথ ঠিক করলাম। এবার মিনিট দশেক হাঁটলেই পৌছে যাব ঊর্মিদের বাসায়। কিন্তু না, পথ শেষ হচ্ছে না। আমি কি বাড়ির নম্বর ভুল করছি? সবগুলো বাড়িই একই রকম দেখতে। আসার সময় দিনের আলো কিছুটা অবশিষ্ট ছিলো। এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনের আলোয় যেটুকু বৈষম্য দেখা যেতো বিভিন্ন বাড়ির মধ্যে এখন তা আর চোখে পড়ছে না। কোন রাস্তায় আছি তা বোঝার কোন উপায় নেই। রাস্তায় কোন লাইট নেই। লোক নেই। বাস বন্ধ হয়ে গেছে ছ’টার সময়। পকেটের ম্যাপতো নিজে নিজে কথা কইবে না। ম্যাপ খুলে যে দেখবো, আলো নেই কোথাও। মানুষের বাসার সামনে লাগানো বাতির আলোয় গিয়ে ম্যাপ দেখেও কিছু বোঝার উপায় নেই। রাস্তায় নির্দেশক সাইনগুলো এতো দূরে যে তা পড়া যায় না কোনটা কোন স্ট্রিট।
শহরটার পরিকল্পনাকারীদের কেউই আমার মতো ট্যুরিষ্টদের কথা ভাবেননি তাতে আমি নিঃসন্দেহ হলাম। মনে হচ্ছে আমি এক ভুতুড়ে শহরের গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছি। প্রায় দুঘন্টা হাঁটার পরে মনে হলো যথেষ্ট হয়েছে। এবার ট্যাক্সি ডাকা দরকার। ডাকবো যে টেলিফোন বুথ কোথায়? আশে পাশে থাকার কথা। প্রতি রাস্তাতেই থাকার কথা। কিন্তু সব কথা সম্ভবত ক্যানবেরার জন্য খাটে না। চোখেই পড়ছে না টেলিফোন বুথ। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর মেইন স্ট্রিটে এসে একটা মার্কেট টাইপের চোখে পড়লো। কিন্তু তা বন্ধ। একটা টেলেস্ট্রা ফোনবুথ চোখে পড়লো। ট্যক্সিকে ফোন করলাম। একটা কলের জন্য চল্লিশ সেন্ট লাগার কথা। আমি দুই ডলারের কয়েন দিয়েছি টেলিফোন কয়েন স্লটে। এক ডলার ষাট সেন্ট ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু কয়েন রিটার্ন স্লটে কোন শব্দ নেই। বার কয়েক ঝাঁকুনি খেয়েও নির্বিকার টেলিফোন বক্স। কোন কোন মেশিন পয়সা ফেরত দেয় না, সেটা কিন্তু লেখা থাকে। এখানে সেরকম কিছু লেখাও নেই। ব্যাথা লাগা আঙুলেই ব্যাথা লাগে বার বার। সেরকম হচ্ছে এখানে। অবশেষে ট্যাক্সি এলো। ঊর্মিদের বাসায় আসতে ট্যাক্সিতেই লাগলো পুরো বিশ মিনিট। আমি যে শহরের কোন প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। রায়হান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করছিলো আমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলাম! তাকে তো আর বলা যায় না যে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম!
রাতের খাবার খেলাম বারোটার দিকে। ঊর্মিদের দৈনন্দিন রুটিন অনেকটা এরকম। রায়হানের রাতের শিফটে কাজ থাকে বারোটা থেকে তিনটা। সে ফিরে এলে তাদের রাত হয়। সে হিসেবে সকাল হয় দশটা এগারোটার দিকে। এদেশে ভালোভাবে থাকার জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। আগে অভ্যাস কারো থাকে না এরকম কষ্ট করার। কিন্তু আস্তে আস্তে সিস্টেমের সাথে এডজাস্ট হয়ে যায়।
আমি হোটেলে চলে যাবো শুনেই মন খারাপ করে ফেললো ঊর্মি আর রায়হান। বিদেশে এতোদিন থাকার পরেও এরা একটুও প্র্যাকটিক্যাল হয়নি এখনো। আমি কাল দুপুরে চলে যাবো। আজ তাদের দেখে গেলাম। কাল সকালে ক্যানবেরা ঘুরবো নিজের মতো করে। কিন্তু তারা কিছুই বুঝতে চাচ্ছে না। ঊর্মিটা বরাবরই খুব চাপা। নিজের কষ্টের কথা সে কাউকেই বলে না। এখন তার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি আমি তাদের বাসায় রাতে থাকছি না এটা সে মেনে নিতে পারছে না। তার মামা তার শহরে এসে হোটেলে থাকবে এটা তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তাকে বলি আমার নিজের অসুবিধার কথা, আবার এক সময় এসে বেড়িয়ে যাবার কথা।
রায়হান ফোন করে ট্যাক্সি ডেকে দেয়। আমার খুব কষ্ট হয় তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে। কষ্ট তাড়াতে আলাপ জমাই ট্যাক্সিওয়ালার সাথে। দশ মিনিটেই আমাকে পৌঁছে দেয় লেবানিজ ট্যাক্সিওয়ালা।
           
হোটেলের বামদিকে ‘এ’ ব্লকে আমার ঘর। গেটের চাবি আর রুমের চাবি আলাদা। আমার রুম একদম ভিতরের দিকে। রুমে ঢুকে বিছানায় ছুঁড়ে দিলাম নিজেকে। মনে হচ্ছিলো শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়বো। কিন্তু হলো উল্টো। বিছানায় আরামে শুলাম ঠিকই, কিন্তু ঘুম পালালো। দিনের বেলায় খুব গরম লাগলেও এখন বেশ ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড শীত পড়ছে। ক্যানবেরায় শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাসে চলে যায়। এখন প্রচণ্ড গ্রীষ্মকালেও দেখি শীতকালের ঠাণ্ডা। পাশের রুম থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। হাসির সাথে সাথে প্রচণ্ড দাপাদাপি। হয়তো নিউ ইয়ার্স সেলিব্রেশান চলছে। আমার মন ঘুরে ফিরে চলে যাচ্ছে আবারো বাংলাদেশে। মনের উপর জোর খাটানো যায়। কিন্তু কতক্ষণ? 
______________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts