Showing posts with label জীববিজ্ঞান. Show all posts
Showing posts with label জীববিজ্ঞান. Show all posts

Tuesday, 17 May 2022

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন

 



আমাদের শরীরের মূল নক্‌শা বা ব্লু-প্রিন্ট থাকে আমাদের ডিএনএ-তে। বলা চলে শারীরিক কার্যাবলির সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত ডিএনএ দ্বারা। এই ডিএনএ’র আণবিক গঠন আবিষ্কৃত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। ১৯৬২ সালে ফ্রান্সিস ক্রিক, জেম্‌স ওয়াটসন এবং মরিস উইলকিন্‌স চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের জন্য। ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের পর জীবের শারীরবৃত্তিক কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি নিঁখুতভাবে জানার অনেকগুলি পথ খুলে গেল।

শরীরের তথ্যনির্দেশ জমা থাকে জিনে। এই তথ্যনির্দেশ কার্যকর করার জন্য তথ্যগুলি কপি করে কোষের বাইরের অংশে পাঠানো হয়। সেখানে এগুলি প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেয়। মূলত বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন মিলে আমাদের শারীরিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই তথ্য কপি করার ব্যাপারটাকে বলা হয় ট্রান্সক্রিপশান। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবকোষ থেকে শুরু করে অতিকায়  ডায়নোসর – সব রকমের জীবনের জন্যই এই ট্রান্সক্রিপশান অপরিহার্য। ট্রান্সক্রিপশান বা তথ্যনির্দেশ যদি কোষের বাইরে আসতে না পারে বা কপি করা না হয়, তাহলে কোষগুলি বুঝতে পারে না কী করতে হবে। ফলে দেহের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে জীবকোষের মৃত্যু হয়। এই ট্রান্সক্রিপশানের সময় যদি কোন গন্ডগোল হয়, তবে কোষগুলির বাইরে ভুল তথ্যনির্দেশ চলে আসে। ফলে নানারকম রোগের উৎপত্তি হতে পারে, বিশেষ করে কোষঘটিত রোগ – যেমন ক্যান্সার।

এই ট্রান্সমিশান কীভাবে ঘটে তার পারমাণবিক পর্যায়ের নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কার করে ২০০৬ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানী রজার কর্নবার্গ। ডিএনএর পাশাপাশি আমরা জেনেছি আরএনএর কথা। ডিএনএ-তে যেমন সিঁড়ির মতো পাশাপাশি দুটো স্ট্র্যান্ড থাকে, আরএনএতে থাকে একটি স্ট্র্যান্ড। প্রধানত তিন ধরনের আরএনএ পাওয়া যায় – ম্যাসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ), রাইবোজোমাল আরএনএ (আরআরএনএ), এবং ট্রান্সফার আরএনএ (টিআরএনএ)। রজার কর্নবার্গ আবিষ্কার করেছিলেন ডিএনএর তথ্যনির্দেশ কীভাবে এমআরএনএ-তে যায় যেখান থেকে কোষগুলি দরকারি প্রোটিন তৈরির নির্দেশ পায়।

তখনো পর্যন্ত আরআরএনএগুলি কীভাবে কাজ করে – অর্থাৎ রাইবোজোমের আণবিক গঠন নিঁখুতভাবে জানা সম্ভব হয়নি। রাইবোজোমকে বলা হয় জীবকোষের প্রোটিন তৈরির কারখানা। এই রাইবোজোমের কার্যপদ্ধতি হলো কোষের কাজগুলির মধ্যে সবচেয়ে জটিল কাজ। রাইবোজোম এই জটিল কাজগুলি কীভাবে করে তা আবিষ্কার করেছেন যে তিনজন বিজ্ঞানী – তাঁদের একজন হলেন ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন – যাকে পরিচিতরা সবাই ভেঙ্কি বলে ডাকেন।

রাইবোজোমের কার্যপ্রণালী আবিষ্কার করার জন্য ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন অ্যাডা ইওনাথ, থমাস স্টিজ এবং ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন। তাঁদের আবিষ্কারের ফলেই শরীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজকর্মের অনেক অজানা জটিল রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। আমরা এখন জানি কীভাবে ডিএনএ/আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরির নির্দেশ আসে, এবং রাইবোজোম কীভাবে যথাসময়ে যথামাত্রায় যথাযথ প্রোটিন তৈরি করে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আবিষ্কৃত এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে অনেক নতুন অ্যান্টি-বায়োটিক। সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অতিদ্রুত ভ্যাক্সিন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে রাইবোজোমের কাজকর্ম ভালোভাবে জানা ছিল বলেই।

পারমাণবিক পর্যায়ে গেলে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান – বিজ্ঞানের এরকম শাখাপ্রশাখার মধ্যে খুব বেশি বিভেদ থাকে না। রসায়নে নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানী ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন ছিলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী। পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করার পর তিনি জীববিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই তিনি সাফল্যের চূড়ায় উঠেছেন, নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনিই ছিলেন রয়েল সোসাইটির সাড়ে তিন শ বছরের ইতিহাসে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। 

বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বনেদী আর গৌরবজনক সংগঠন হলো লন্ডনের রয়েল সোসাইটি। ১৬৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের ফেলোশিপ পাওয়াটা বিজ্ঞানীদের জন্য খুবই গৌরবজনক ব্যাপার। স্যার আইজাক নিউটন, স্যার হামফ্রে ড্যাভি, থমাস হাক্সলি, লর্ড কেলভিন, লর্ড রেলে, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, উইলিয়াম ব্র্যাগ, প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট প্রমুখ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী যারা রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মনোনীত হয়েছিলেন, তাঁদের পাশে রয়েল সোসাইটির এপর্যন্ত একমাত্র প্রেসিডেন্ট স্যার ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন যার জন্ম আমাদের উপমহাদেশে।

ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন - ভেঙ্কির জন্ম তামিলনাড়ুর চিদাম্বরমে ১৯৫২ সালে। তাঁর বাবা সিভি রামকৃষ্ণন এবং মা রাজলক্ষ্মী – দু’জনই ছিলেন জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের পরিমন্ডলে বড় হয়েছেন ভেঙ্কি। তাঁর জন্মের সময় তার বাবা আমেরিকার উইসকনসিনে পোস্টডক্টরেট গবেষণা করছিলেন। আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে তিনি সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে তামিলনাড়ুতে রেখে গিয়েছিলেন। রাজলক্ষ্মীকে সাথে নিয়ে গেলে ভেঙ্কি জন্মসূত্রে আমেরিকান হতে পারতেন। বাবা পোস্টডক্টরেট করে ফিরে আসার পর মা গেলেন কানাডায় পিএইচডি করার জন্য। তখন বাবাও সাথে গেলেন দেড় বছরের ভেঙ্কিকে নানা-নানীর জিম্মায় রেখে। ফিরে আসার পর তারা চিদাম্বরম থেকে বরোদায় চলে গেলেন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে।

বরোদায় ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে লেখাপড়া শুরু হলো ভেঙ্কির। ১৯৫৯ সালে ভেঙ্কির ছোটবোন ললিতার জন্ম হয়। ১৯৬০-৬১ সালে বাবা-মায়ের অস্ট্রেলিয়ায় ফেলোশিপ নিয়ে আসার সুবাদে এক বছর অস্ট্রেলিয়ার এডেলেইডের স্কুলে পড়াশোনা করে ভেঙ্কি। আবার ভারতে ফিরে গিয়ে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করলো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কী নিয়ে পড়াশোনা করবে স্থির করতে পারছিলেন না ভেঙ্কি। তাঁর বাবা চাচ্ছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। ডাক্তারিতে ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টিকেছিল ভেঙ্কি। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চরম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টিকে আই-আই-টিতে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মেডিকেল কলেজে পড়াশোনাটাকে খুব একটা আকর্ষণীয় মনে হলো না ভেঙ্কির কাছে- কারণ সেখানে অনেক জিনিস মুখস্থ করতে হয়। তাঁর কাছে মৌলিক বিজ্ঞানের পড়াশোনাকেই অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো। সেইসময় মৌলিক বিজ্ঞানে পড়াশোনায় উৎসাহিত করার জন্য ভারত সরকার একটা আকর্ষণীয় বৃত্তি দিচ্ছিলো মেধাবী শিক্ষার্থীদের। ভেঙ্কি সেই বৃত্তি নিয়ে বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন বিএসসি কোর্সে।

বিএসসি পাস করার পর তিনি আমেরিকার ওহাইও ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করলেন। দুই বছর কোর্সওয়ার্ক করার পর  অধ্যাপক তমোইয়াসু তানাকার তত্ত্বাবধানে সলিড-স্টেট ফিজিক্সের তত্ত্বীয় গবেষণা শুরু করলেন। কিন্তু গবেষণা শুরুর কিছুদিন পরেই মনে হলো তিনি ভুল বিষয়ে ভর্তি হয়েছেন। সায়েন্টিফিক আমেরিকানে জীববিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কারের কাহিনি পড়তে পড়তে ভেঙ্কির মনে হলো পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কার হচ্ছে শামুকের গতিতে, কিন্তু জীববিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। পদার্থবিজ্ঞানে কোন উত্তেজনাই পাচ্ছেন না তিনি। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের দীর্ঘ জটিল সমীকরণ ও গাণিতিক হিসেবে তিনি কোন আনন্দ পাচ্ছিলেন না। কিন্তু অন্য কোন বিষয়ে যে চলে যাবেন সেই সুযোগও নেই। এই বিষয়ে তিন বছরের বেশি সময় ব্যয় করেছেন তিনি। যে জীববিজ্ঞানকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সময় অযৌক্তিক মুখস্থ করার বিষয় বলে মনে করেছিলেন, এখন মনে হচ্ছে সেখানেই আছে অনেক বেশি উত্তেজনার খোরাক।

গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলার পর ভেঙ্কি পড়াশোনা বাদ দিয়ে হাইকিং করতে লাগলেন, গান শুনতে লাগলেন, দাবা খেলতে শুরু করলেন। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানোর সময় তাঁর সাথে পরিচয় হলো ভেরা রোজেনবারির সাথে। ভেরা ফাইন আর্টসের ছাত্রী। পেইন্টিংস নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। সত্তরের দশকের শুরুতে ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বেশি নিরামিষভোজী ছিল না। ভেরা ছিলেন নিরামিষাশী, ভেঙ্কিও। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ক্রমে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। ভেরা ছিলেন ডিভোর্সি। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী একটা মেয়েও আছে। ১৯৭৫ সালে তেইশ বছর বয়সী ভেঙ্কি তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ভেরাকে বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করলেন। ভেঙ্কির পিএইচডি তখনো শেষ হয়নি। কোন উপার্জন নেই। ভেরা নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটদের জন্য বই লিখতে শুরু করলেন। তাঁর ভেরা সিরিজের বইগুলি শিশুরা খুবই পছন্দ করে।

ঘরসংসার, স্ত্রী এবং সৎকন্যার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি ইচ্ছের বিরুদ্ধেই পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি শেষ করলেন। সেই সময় তাঁদের সন্তান রামনের জন্ম হয়। তিনি জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন। জীববিজ্ঞানের যেসব খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে তিনি জানতে আগ্রহী, তারজন্য সবচেয়ে ভালো হয় যদি ডাক্তারিতে ভর্তি হতে পারেন। ভারতে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েও পড়েননি। এখন আমেরিকায় পিএইচডি শেষ করার পর ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। এম-ক্যাটে অনেক ভালো ফলাফল করার পরেও তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পেলেন না। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় মৌখিক সাক্ষাৎকারের জন্য ডেকেছিল। কিন্তু ভেঙ্কি যখন বললেন যে তিনি ডাক্তারি করবেন না, শুধুমাত্র শরীরের বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য ডাক্তারি পড়তে চান, তাকে ভর্তি হবার সুযোগ দেয়া হলো না।

ডাক্তারিতে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়ে তিনি জীববিজ্ঞানে পিএইচডি করার জন্য দরখাস্ত করতে শুরু করলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই ফিজিক্সে পিএইচডি করা একজনকে আরেকটি পিএইচডি করার জন্য অনুমতি দিলো না। মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পিএইচডি কোর্সে ভর্তির অফার দিলো। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগোতে ভর্তি হলেন। জীববিজ্ঞানের গবেষণার কোন নিয়মকানুন তিনি জানতেন না। সবকিছু একেবারে গোড়া থেকে শিখতে শুরু করলেন। পরের বছর গবেষণাগারে কীভাবে গবেষণা করতে হয় তা শিখে ফেলার পর তাঁর মনে হলো এবার তাঁর পিএইচডি থিসিস লেখার কোন দরকার নেই। তিনি সরাসরি জীববিজ্ঞানের গবেষণাই শুরু করতে পারেন।

ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক পিটার মুরের সাথে রাইবোজোম সংক্রান্ত গবেষণা করার জন্য পোস্টডক্টরেট শুরু করলেন। বছরখানেক পোস্টডক গবেষণার পর তাঁর একটা স্থায়ী পদের দরকার হলো। কিন্তু পঞ্চাশটির অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করার পরেও কোন সাড়া পেলেন না। পদার্থবিজ্ঞান থেকে পিএইচডি করে জীববিজ্ঞানে গবেষণা করছেন এরকম কাউকে নিয়োগ দেবার ব্যাপারে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই খুব একটা আগ্রহী হলো না। শুধুমাত্র ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবে একটি টেকনিশিয়ানের পদ পাওয়া গেল। সেখানে যোগ দিয়ে দেখলেন স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ খুব বেশি নেই সেখানে। কিছুদিন পরেই তাঁকে আবার চাকরি খোঁজায় মন দিতে হলো। ইয়েলে নিউট্রন স্ক্যাটারিং-এর মাধ্যমে রাইবোজোম সংক্রান্ত গবেষণা করছিলেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবে তাঁর চাকরি হলো। ব্রুকহ্যাভেনে তিনি গবেষণার স্বাধীনতা পেলেন। রাইবোজোম সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফলও পেতে শুরু করলো।

ব্রুকহ্যাভেনে স্থায়ী গবেষক পদে নিয়োগ পেলেন তিনি। পদার্থবিজ্ঞানের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির প্রয়োগে রাইবোজোমের আণবিক গঠন সম্পর্কে অনেক নতুন ফলাফল পাওয়া গেল। ভেঙ্কি এই ব্যাপারে আরো গভীরভাবে জানার জন্য তিনি ব্রুকহ্যাভেন থেকে ছুটি নিয়ে ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবে গেলেন। সেখানে তিনি বিজ্ঞানী জন ফিঞ্চের তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করলেন। এক বছর সেখানে গবেষণা করে তিনি রাইবোজোমাল প্রোটিনের ক্রিস্টালোগ্রাফির অনেক নতুন কিছু শিখলেন। ব্রুকহ্যাভেনে ফিরে তিনি শুধুমাত্র ক্রিস্টালোগ্রাফি ও রাইবোজোম নিয়ে গবেষণা করতে চাইলেন। কিন্তু আকাঙ্খিত স্বাধীনতা পেলেন না। তিনি অন্য জায়গায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ভেঙ্কি যোগ দিলেন উটাহ্‌ ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে। সেখানেই তিনি রাইবোজোমের বেশ কয়েকটি প্রোটিনের গঠন আবিষ্কার করলেন। তিনি দেখলেন এ কাজে প্রচুর ফান্ডিং দরকার। উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভবিষ্যত চিন্তা করে তিনি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমেরিকান ভেঙ্কি চলে এলেন ইংল্যান্ডে। সেখানেই তিনি রাইবোজোমের সাবইউনিট 30S এর আণবিক গঠন নির্ণয়ের মূল গবেষণা শুরু করেন।

সেই সময় একই বিষয়ে ইসরায়েলে গবেষণা করছিলেন অ্যাডা ইয়োনাথ। এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হলো ভেঙ্কি ও অ্যাডার মধ্যে। ভেঙ্কি ক্রিস্টালোগ্রাফির সবচেয়ে সূক্ষ্ম পরীক্ষা করার জন্য চলে গেলেন আমেরিকার আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবের এডভান্সড ফোটন সোর্স ফ্যাসিলিটিতে। ভেঙ্কি তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করলেন ২০০০ সালে। এই কাজের জন্য ২০০৯ সালের রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ভেঙ্কি। রাইবোজোমের আণবিক গঠন আবিষ্কারের জন্য ভেঙ্কির সাথে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন অ্যাডা ইয়োনাথ এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল বায়োলজিস্ট থমাস স্টিজ।

এপর্যন্ত মাত্র পাঁচজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন আমাদের উপমহাদেশ থেকে। সিভি রামন, হরগোবিন্দ খোরানা, আবদুস সালাম, চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের পর  ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন। ভেঙ্কির আবিষ্কারের প্রয়োগ সুদুরপ্রসারী। তাঁর আবিষ্কারের ফলে এখন আরো অনেক শক্তিশালী এবং কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।

ভেঙ্কি রামকৃষ্ণনকে ব্রিটিশ নাগরিকত্বও দেয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি দেয় ২০১২ সালে। যদিও ভেঙ্কি কখনো ‘স্যার’ উপাধি ব্যবহার করেননি। ২০১০ সালে তাঁকে ভারত সরকার পদ্মবিভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করে। ২০১৫ সালে ভেঙ্কি রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি সম্মানের সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন। করোনা মহামারির সময়ে কোভিড ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন ও উদ্বুদ্ধকরণে ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

তথ্যসূত্র:

ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন, ফ্রম চিদাম্বরম টু কেমব্রিজ – এ লাইফ ইন সায়েন্স ২০০৯; পিএনএএস সেপ্টেম্বর ২০, ২০১১।

_______________

বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত







Saturday, 4 December 2021

প্রাণের কোয়ান্টাম

 

সূত্র: Nature Vol. 474, 16 June 2011

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর মানুষ যুদ্ধ করছে করোনা ভাইরাসের সাথে। এই ভাইরাস এত ছোট যে খালি চোখে তো দূরের কথা সাধারণ লাইট মাইক্রোস্কোপ বা আলোক-অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও এদের দেখা যায় না। কিন্তু সুযোগ পেলেই এরা আমাদের শরীরে ঢুকে যাচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে। ঢুকেই অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, আক্রমণ করছে আমাদের ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। শরীরের প্রতিটি কোষের কার্যক্রম এমনভাবে ব্যহত করছে যে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হচ্ছে। কীভাবে কাজ করছে এরা? আমাদের নাক-মুখ-চোখ দিয়ে ঢোকার সময় আমরা কোন ব্যথা পাচ্ছি না। বাতাসের উপাদানের সাথে এরা কীভাবে মিশছে? এই যে মিশে যাওয়া – বা ফিউশান ঘটা, আবার শরীরের কোষের ভেতর ঢুকে যাওয়া – এরজন্য যে শক্তির দরকার হয়, তা তারা কোথায় পায়? এই ভাইরাসগুলি শরীরে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এত দ্রুত কীভাবে বাড়ে এবং বিবর্তন ঘটায়? এত ক্ষুদ্র প্রাণসত্ত্বায় একইসাথে এত জটিল কাজ কীভাবে হয়? এসব রহস্য বের করতে বিজ্ঞানীরা হিমসিম খাচ্ছেন। আমরা প্রাণীকোষের গঠন এবং কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। কিন্তু এখনো অনেক কিছুই অজানা। আমাদের ধ্রুপদী বলবিজ্ঞান বা ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স দিয়ে জীবকোষের কার্য-প্রণালী পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীদের এখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আশ্রয় নিতে হচ্ছে – জীবনের মৌলিক উপাদান জীবকোষের মূল রহস্য বোঝার জন্য। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের আকার ও গতিপ্রকৃতি দেখার জন্য আমরা ইতোমধ্যেই ব্যবহার করছি যেসব যন্ত্র – যেমন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, কিংবা পদ্ধতি – যেমন এক্স-রে ডিফ্রাকশান, এসবের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। 

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগত – এক অত্যাশ্চর্য জগত। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এসে এর আগের কয়েক শ বছরের চিরায়ত বিজ্ঞানের অনেক প্রচলিত ধারণা বদলে দেয়। এরপর থেকে বিজ্ঞানীরা অনেক আবিষ্কৃত ব্যাপারও নতুন ভাবে আবিষ্কার করেন, নতুন ভাবে বুঝতে শুরু করেন। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিছু কিছু ব্যাপার এখনো এতটাই আশ্চর্যের যে – কোয়ান্টাম মেকানিক্স কীভাবে কাজ করে তা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো গলদঘর্ম হচ্ছেন। যেমন আলো – কণা রূপেও থাকতে পারে, আবার তরঙ্গ রূপেও থাকতে পারে। 

কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের বয়স এখন ১২০ বছর।  এপর্যন্ত কোয়ান্টাম জগতের যতটুকু পরীক্ষাগারে সরাসরি প্রমাণ করা গেছে, সেটুকু খুবই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, খুবই ছোট ন্যানোমিটার স্কেলে এবং অন্ত্যন্ত কম তাপমাত্রায়। কিন্তু  জীবন্ত জীবকোষের পরিবেশ মোটেও সেরকম নয়। জীবন্ত জীবকোষের নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আছে এবং পরীক্ষাগারের আরোপিত শৃঙ্খলা সেখানে নেই। সেকারণে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব, জীববিজ্ঞানে সেভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যতই উন্নতি ঘটছে, বিজ্ঞানীদের সেই ধারণা বদলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন প্রকৃতিতে জীবকোষের ভেতর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়েই সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। 

একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আমরা সূর্যের শক্তি নিয়ে বেঁচে আছি। পৃথিবী টিকে আছে সূর্যের শক্তির উপর। সূর্যের ভেতর এই শক্তি কীভাবে উৎপন্ন হচ্ছে? সূর্যে আছে প্রচুর হাইড্রোজেন। যা নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়ামে পরিণত হচ্ছে এবং এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটির পুরোটাই কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া। কীভাবে? একটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন আছে। তার সাথে নিউক্লিয়ার ফিউশান হতে হলে আরেকটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস এসে মিশে যেতে হবে। এখন আরেকটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসও তো একটি ধনাত্মক প্রোটন। একটি প্রোটন তো অন্য আরেকটি প্রোটনকে আকর্ষণ করবে না। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স অনুযায়ী একটি ধনাত্মক চার্জ অন্য একটি ধনাত্মক চার্জকে বিকর্ষণ করবে। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স মেনে চললে তো সূর্য থেকে কোন শক্তিই উৎপন্ন হতো না, সৌরজগতও হতো না, মহাবিশ্বও হতো না।  তাহলে এখানে একটি নিউক্লিয়াস আরেকটি নিউক্লিয়াসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে কীভাবে? কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে, যা শুধু কোয়ান্টাম মেকানিক্সই ব্যাখ্যা করতে পারে। অনবরত কোয়ান্টাম টানেলিং-এর ফলে যে শক্তি বিকির্ণ হয়, সেই শক্তিই আমাদের পৃথিবীসহ সৌরজগতের সব গ্রহকে শক্তি জোগায়। 

এই কোয়ান্টাম টানেলিং আমাদের শরীরের কোষে কোষে অনবরত চলছে। আমরা এনজাইম বা উৎসেচকের কথা জানি। এগুলো মূলত প্রোটিন। জীবকোষের ভেতর যত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে সেগুলোকে ত্বরাণ্বিত করতে সাহায্য করে এনজাইম। কিন্তু কীভাবে এই কাজ করে এরা? কোষের মেমব্রেন বা কোষের আবরণ ভেদ করে কীভাবে এরা ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটায়? 'কোয়ান্টাম টানেলিং' এর মাধ্যমে। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের সূত্র মেনে কোন একটি বাধা পার হয়ে যেখানে ইলেকট্রনের যাওয়ার কোন উপায় নেই, সেখানেও দেখা যায় কিছু ইলেকট্রন সেই বাধা অতিক্রম করে ফেলেছে। জীবকোষের কোটি কোটি কোষের ভেতর অনবরত চলছে কোয়ান্টাম টানেলিং। 

পৃথিবীতে যে প্রাণের উৎপত্তি এবং প্রাণ-বিকাশের পরিবেশ তৈরি হয়েছে – তা কীভাবে হয়েছে? ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স তার পুরোটা ব্যাখ্যা করতে পারে না। আমাদের পৃথিবীর খাদ্যভাণ্ডার তৈরি হয় প্রধানত জৈব-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ব্যাকটেরিয়া, গাছপালা ইত্যাদি কীভাবে সূর্যালোক, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, পানি থেকে জৈব-খাদ্য তৈরি করে – তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে। 

পৃথিবীর সবচেয়ে দরকারি এবং জটিল জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া সালোক সংশ্লেষণ। এর ভেতর মূল কাজ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। উদ্ভিদের পাতায় যে ক্লোরোফিল আছে তার সাথে সূর্যালোকের বিক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ আছে। আমাদের পরিবেশে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প বা পানির কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতার ক্লোরোফিল সূর্যের আলোর সাথে বিক্রিয়া করে অর্থাৎ সূর্যের আলোর ফোটন কণার শক্তি কাজে লাগিয়ে পানি থেকে ইলেকট্রন বের করে নিয়ে আসে। সেই ইলেকট্রন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে যুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বোহাইড্রেড বা গ্লুকোজ। ইলেকট্রনের আদান-প্রদানের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমতে থাকে এবং অক্সিজেন তৈরি হতে থাকে। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ তৈরির রাসায়নিক সমীকরণ: 6CO2 + 12H2O + ফোটন (সূর্যের আলো) = C6H12O6 + 6O2 + 6H2O. সব সালোকসংশ্লেষণেই যে অক্সিজেন উৎপন্ন হবে এমন কোন কথা নেই। সাধারণত উদ্ভিদ, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া (সায়ানোব্যাকটেরিয়া) সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। আবার কিছু বেগুনি ও সবুজ ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমায় ঠিকই, কিন্তু অক্সিজেন তৈরি করে না। সেখানে পানির বদলে অন্য পদার্থ ব্যবহৃত হয়। সেধরনের সালোকসংশ্লেষণের রাসায়নিক সমীকরণ লেখা যায় এভাবে: CO2 + 2H2A + ফোটন (আলো) = [CH2O] + 2A + 2H2O. এখানে A হলো এমন একটি যৌগ যেটা থেকে ফোটনের বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন বের হয়ে আসবে। আলোর ফোটন কী প্রক্রিয়ায় পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের হয়ে আসতে সাহায্য করে সেই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া চলবে না। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে প্রত্যেকটি ধাপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে এই ধাপগুলো ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন ফোটনগুলো শোষিত হবার পর কোষের ভেতর একটি কেন্দ্রে গিয়ে মিলিত হচ্ছে - যাকে রিঅ্যাকশান সেন্টার বলা হয়। এই কেন্দ্রেই সালোক সংশ্লেষণ ঘটে। ফোটনগুলো এই কেন্দ্রে সরাসরি যায় না। একই সাথে অনেকগুলো পথে এই ফোটনগুলো রিঅ্যাকশান সেন্টারে যায় - যা কোয়ান্টাম সুপারপজিশান, অর্থাৎ একই সাথে একাধিক অবস্থায় থাকা। 

শীতপ্রধান দেশের যেসব অঞ্চলে খুব বেশি শীত পড়ে সেখান থেকে শীতকালে হাজার হাজার পাখি হাজার হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে উড়ে চলে যায় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ কোন অঞ্চলে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর নিজের দেশে শীত কমে গিয়ে বসন্ত আসতে শুরু করলে সেই পাখিগুলি আবার একই পথে উড়তে উড়তে নিজের দেশে একই জায়গায় ফিরে আসে। কীভাবে পথ দেখে তারা? তাদের কি কোন জিপিএস আছে? বিজ্ঞানীরা আজ প্রমাণ পেয়েছেন এসব পাখি পৃথিবীর চুম্বকত্ব কাজে লাগিয়ে পথ দেখে। সব পাখির কিন্তু এই ক্ষমতা নেই, শুধুমাত্র পরিযায়ী পাখিদের আছে। এদের চোখের রেটিনায় আলো পড়ে প্রতিটি ফোটন থেকে দুটো ফ্রি রেডিক্যাল তৈরি হয়। এই ফ্রি রেডিক্যালগুলির নিজস্ব কৌণিক ঘূর্ণনবেগ আছে, নিজের অক্ষে একে অপরের সাথে অনুরণনে তারা ঘুরতে থাকে।  পৃথিবীর চৌম্বকত্বের প্রভাবে এই ফ্রি রেডিক্যালের ঘূর্ণনবেগ প্রভাবিত হয়। উড়ে চলার সময় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তনের কারণে পাখির রেটিনার ফ্রি রেডিক্যাল দুটির একটির সাথে অন্যটির রেজোনেন্স পরিবর্তিত হলে তাদের শরীরে প্রতিক্রিয়া হয় এবং এই পরিবর্তন শরীর মনে রাখে। ফিরে যাওয়ার সময়ও একই ধরনের চৌম্বকীয় পরিবর্তন তৈরি করতে করতে তারা ফিরে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই চৌম্বকীয় ব্যাখ্যা আরো অনেক কীট-পতঙ্গের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। 

আমরা কীভাবে গন্ধ পাই – তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স লাগবে। আমাদের ঘ্রাণ-ইন্দ্রীয় বা অলফ্যাক্টরি নার্ভ অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ বুঝতে পারে। কিন্তু কীভাবে কাজ করে এই ঘ্রাণ ইন্দ্রীয়? জীববিজ্ঞানের সাধারণ ব্যাখ্যা হলো গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতির উপর নির্ভর করে আমরা কী ধরনের গন্ধ পাবো। আমাদের নাকের মধ্যে আছে গন্ধ চেনার সেন্সর বা সংবেদী কোষ যাদের বলা হয় স্মেল রিসেপ্টর। এই কোষগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির সেন্সর। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতি যে সেন্সরের আকার ও আকৃতির সাথে মিলে যাবে সেই গন্ধের সিগনাল চলে যাবে মস্তিষ্কে। তখন মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি নার্ভ সেই সিগনাল প্রসেস করে আমাদের গন্ধের অনুভূতি দেয়। কিন্তু আমাদের নাকের মধ্যে আছে মাত্র চারশ রকমের স্মেল রিসেপ্টর। অথচ আমরা কয়েক হাজার রকমের গন্ধ পাই। যদি একেক গন্ধের জন্য একেক রকমের রিসেপ্টর নির্দিষ্ট থাকতো তাহলে আমরা চারশ রকমের চেয়ে বেশি গন্ধ পেতাম না কোনভাবেই। অথচ কয়েক লক্ষ রকমের গন্ধ আমরা বুঝতে পারি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই গন্ধরহস্য ভেদ করতে পেরেছে। কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান এই গন্ধতত্ত্বের নাম দিয়েছে ভাইব্রেশান থিওরি অব অলফেকশান। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুর পারমাণবিক বন্ধন বা অ্যাটমিক বন্ড তরঙ্গের মত কাজ করে। আর আমাদের নাকের সেন্সর এই তরঙ্গের কম্পন শনাক্ত করে। গন্ধের তীব্রতা ও প্রকৃতিভেদে অসংখ্য কম্পাঙ্কের গন্ধ-তরঙ্গ তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকে। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুযায়ী আমরা অসংখ্য ধরনের গন্ধ পেতে পারি। 

আমাদের রোগনির্ণয় ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক অত্যাধুনিক যন্ত্র এবং পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে – যাদের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ভাইরাস দেখতে পাওয়া যায় -  যেমন গুটিবসন্তের ভাইরাস ভ্যারিওলা। কিন্তু যেসব ভাইরাসের আকার আরো ছোট, অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সেগুলি দেখা যায় না। সেগুলো দেখার জন্য ব্যবহার করা হয় এক্স-রে। ১৮৯৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানী রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করার পর পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞানেও অনেক নতুন পথ খুলে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং বোরের পারমাণবিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ১৯১২ সালে পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স ফন লাউ আবিষ্কার করেন যে এক্স-রে'র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কোন ক্রিস্টালের ভেতরের পরমাণুগুলোর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্যের সাথে তুলনীয়। অর্থাৎ কোন ক্রিস্টালে এক্স-রে প্রয়োগ করলে সেই এক্স-রে বিচ্ছুরিত হয়। শুরু হলো এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি। পরের বছর এক্স-রে ডিফ্রাকশান ব্যবহার করে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ ও তাঁর ছেলে লরেন্স ব্র্যাগ । এক্স-রের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করা যায় যে পদ্ধতিতে সেই পদ্ধতিতে জীববিজ্ঞানের অনেককিছুর গাঠনিক বিশ্লেষণ ও আকার-আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৩৪ সালে আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন বার্নেল এবং তাঁর ছাত্রী ডরোথি হজকিন মলিকিউলার বায়োলজিতে এক্স-রে ডিফ্রাকশান প্রয়োগ করে পেপসিনের গঠন বিশ্লেষণ করেন। বার্নেল ও হজকিনের এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি স্ট্রাকচারাল বায়োলজি-র বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে। এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতিতে সরাসরি প্রোটিন বা অন্য কোন জৈব পদার্থের অভ্যন্তরীণ ছবি তোলা হয় না, কিন্তু জৈব পদার্থের আণবিক বিন্যাস থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আসা এক্স-রে সিগনালগুলোকে একত্রিত করে পুরো বিন্যাসটি পুনর্গঠন করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জৈব যৌগ বিশ্লেষণ খুব সহজ হয়ে গেছে। 

১৯৩৩ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নস্ট রুশকা এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ম্যাক্স নল (Max Knoll) ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবন করেন। সাধারণ মাইক্রোস্কোপে আলোর মাধ্যমে বিবর্ধন ঘটানো হয়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে আলোর কণা ফোটনের পরিবর্তে ইলেকট্রন ব্যবহার করা হয়। ইলেকট্রনও আলোর মত কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্মই প্রদর্শন করে। ইলেকট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ ছোট। তার মানে হলো স্বাভাবিক মাইক্রোস্কোপে যত ছোট বস্তু দেখা সম্ভব, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে তার চেয়েও এক হাজার গুণ ছোট বস্তু দেখা সম্ভব। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবিত হবার পর থেকে জীববিজ্ঞানে অণুজীব, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির গঠন নির্ণয় করা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে লেজারের ব্যবহার হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। লেজার উৎপাদনের মূলনীতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মে এগুলি কক্ষপথে বিন্যস্ত থাকে – প্রথম কক্ষপথে ২টি, ২য় কক্ষপথে ৮টি, ৩য় কক্ষপথে ১৮টি ইত্যাদি। ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলি হলো তাদের শক্তিস্তর। একটি কক্ষপথে যতগুলি ইলেকট্রন থাকে সবগুলি ইলেকট্রনের শক্তি সমান। নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের যে কক্ষপথ (১ম কক্ষপথ) – সেই কক্ষপথে যেসব ইলেকট্রন থাকে তাদের শক্তি সবচেয়ে কম। এই শক্তিস্তরকে গ্রাউন্ড স্টেট বলা হয়। ইলেকট্রনগুলি যদি কোনভাবে শক্তি শোষণ করে তখন তারা উত্তেজিত হয়ে নিজেদের শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু একটু পরেই সেই অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে। স্বতস্ফূর্তভাবে শক্তি নির্গমনের এই প্রক্রিয়াকে স্পনটেনিয়াস এমিশান (spontaneous emission) বলা হয়। পরমাণুর ইলেকট্রনগুলিকে যদি নির্দিষ্ট শক্তির ফোটনের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটানো যায়, তাহলে ফোটনের শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনগুলি উত্তেজিত হয়ে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর যখন নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে তখন যে শক্তি শোষণ করেছিল তা ফোটনের মাধ্যমে বের করে দেয়। এই নির্গত ফোটনের শক্তি শোষিত ফোটনের শক্তির সমান। ফোটনের প্রবাহ যদি অনবরত চলতে থাকে – তাহলে একটি ফোটন থেকে একই শক্তির ২টি ফোটন, ২টি থেকে ৪টি, ৪টি থেকে ৮টি ফোটন – এভাবে সেকেন্ডের মধ্যে কোটি কোটি ফোটনের প্রবাহ পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ফোটনের শক্তি সমান এবং প্রত্যেকেই একই সাথে একই দিকে যায়। তীব্র প্রাবল্যের এই ফোটনপ্রবাহই লেজার। চিকিৎসাব্যবস্থায় অনেক রকমের ও শক্তির লেজার ব্যবহার করা হয়। কসমেটিক সার্জারি, ত্বকের চিকিৎসায়, ক্ষতস্থান নিরাময়ে, অসাড় স্নায়ুর উদ্দীপনা জোগাতে, দাঁতের চিকিৎসায়, চোখের চিকিৎসায় – ভিন্ন ভিন্ন রকমের লেজার রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। কী ধরনের লেজার প্রয়োগ করা হবে তা নির্ভর করে শরীরের সাথে লেজারের কী ধরনের ইন্টার অ্যাকশান বা মিথস্ক্রিয়া ঘটানো দরকার তার উপর।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা হলো এম আর আই বা ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং। মানুষের শরীরের হাইড্রোজেন পরমাণুকে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের মাধ্যমে অনুরণন ঘটিয়ে শরীরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গণিত দিয়ে শরীরের ভেতরের চিত্র তৈরি করা হয়। এম-আর-আই এক্স-রে’র চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে। জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে শরীরে ওষুধ প্রয়োগেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ভূমিকা রাখবে। 

একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার – কোয়ান্টাম মেকানিক্সের রহস্যময়তার সুবিধা নিয়ে অনেকে কোয়ান্টাম নাম দিয়ে অনেক রকমের অপবিজ্ঞান ও অপচিকিৎসা চালু করেছে। বিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের পার্থক্য বুঝতে পারাটা অত্যন্ত জরুরি। অপবিজ্ঞান প্রতিহত করাও বিজ্ঞানপ্রেমীদের দায়িত্ব। 


তথ্যসূত্র

১। ফিলিপ বল, ন্যাচার, সংখ্যা ৪৭৪, ২০১১।

২। আড্রিয়ানা ম্যারিস প্রমুখ, ইন্টারফেস, সংখ্যা ১৫, ২০১৮।

৩। জনজো ম্যাকফ্যাডেন ও জিম আল-খলিলি, লাইফ অন দি এজ, ক্রাউন পাবলিশার্স, নিউইয়র্ক, ২০১৪।

৪। মাসানারি আসানো প্রমুখ, কোয়ান্টাম অ্যাডপ্টিভিটি ইন বায়োলজি: ফ্রম জেনেটিক্স টু কগনিশান, স্প্রিঙ্গার, ২০১৫। 

_______________
বিজ্ঞানচিন্তা এপ্রিল ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত






Tuesday, 31 August 2021

ভাইরাস কীভাবে দেখা যায়

 


সারা পৃথিবীর মানুষ এখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে ভীত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই এক বছর আট মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাপী একুশ কোটি সতের লক্ষের বেশি মানুষ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছে। পঁয়তাল্লিশ লক্ষের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে করোনায়।[1] এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য কত ধরনের চেষ্টা করতে হচ্ছে - মানুষের দৈনন্দিন স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ করতে হচ্ছে, সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করতে হচ্ছে, শহর গ্রাম জনপদ লকডাউন করতে হচ্ছে। অনেক মানুষ এখনো বুঝতে পারছে না ভাইরাস আসলে কীভাবে সংক্রমিত হতে পারে। অনেকে এত মৃত্যুর পরেও সচেতন নন। খালি চোখে ভাইরাস দেখা গেলে এই সমস্যা হতো না। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে বলেই এত সমস্যা হচ্ছে।

ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ নতুন নয়। ১৮৮৯-৯০ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল।[2] ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৫০ কোটি মানুষ, যার মধ্যে প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।[3] ১৯৫৬-৫৮ সালে চীনে আরেক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রকোপ ঘটে। প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল সেই সময়।[4] ১৯৬৮ সালে হংকং-এ উদ্ভুত হয় আরেক ধরনের ফ্লু ভাইরাস। সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ।[5] ১৯৭৬ সালে প্রথম বারের মত এইচ-আই-ভি এইডস ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। পরবর্তী বছরগুলোতে এপর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ মারা গেছে এইডস-এ আক্রান্ত হয়ে।[6]

১৯৬৫ সালের দিকে প্রথম বারের মত করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। বর্তমানের নভেল করোনা ভাইরাসসহ সাত ধরনের হিউম্যান করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে - যা মানুষের শরীরে বিস্তারলাভ করে। এদের মধ্যে আছে মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা মার্স-করোনা ভাইরাস, সিভিয়ার একিউট রেসিপিরেটরি সিনড্রোম বা সার্স-করোনা ভাইরাস, এবং বর্তমান সার্স-করোনা ভাইরাস-২ বা SARS-CoV-2[7] এই ভাইরাসগুলোর আকৃতি অনেকটা মুকুটের মতো। মুকুটের গ্রিক প্রতিশব্দ হচ্ছে করোনা। সেখান থেকেই এদের নাম হয়েছে করোনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ভাইরাসগুলো কীভাবে দেখা যায়?

বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের গঠন সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেছেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ভাইরাস দেখতে পাওয়া যায় -  যেমন গুটিবসন্তের ভাইরাস ভ্যারিওলা।[8]

কিন্তু যেসব ভাইরাসের আকার আরো ছোট - অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সেগুলি দেখা যায় না। সেগুলো দেখার জন্য ব্যবহার করা হলো এক্স-রে। ১৮৯৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানী রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করার পর পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞানেও অনেক নতুন পথ খুলে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং বোরের পারমাণবিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ১৯১২ সালে পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স ফন লাউ আবিষ্কার করেন যে এক্স-রে'র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কোন ক্রিস্টালের ভেতরের পরমাণুগুলোর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্যের সাথে তুলনীয়। অর্থাৎ কোন ক্রিস্টালে এক্স-রে প্রয়োগ করলে সেই এক্স-রে বিচ্ছুরিত হয়। শুরু হলো এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান ম্যাক্স ফন লাউ।

পরের বছর এক্স-রে ডিফ্রাকশান ব্যবহার করে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ ও তাঁর ছেলে লরেন্স ব্র্যাগ। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯১৫ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন এই পিতা-পুত্র। এক্স-রের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করা যায় যে পদ্ধতিতে সেই পদ্ধতিতে জীববিজ্ঞানের অনেককিছুর গাঠনিক বিশ্লেষণ ও আকার-আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।

১৯৩৪ সালে আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন বার্নেল এবং তাঁর ছাত্রী ডরোথি হজকিন মলিকিউলার বায়োলজিতে এক্স-রে ডিফ্রাকশান প্রয়োগ করে পেপসিনের গঠন বিশ্লেষণ করেন।

বার্নেল ও হজকিনের এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি স্ট্রাকচারাল বায়োলজি-র বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে। এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতিতে সরাসরি প্রোটিন বা অন্য কোন জৈব পদার্থের অভ্যন্তরীণ ছবি তোলা হয় না, কিন্তু জৈব পদার্থের আণবিক বিন্যাস থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আসা এক্স-রে সিগনালগুলোকে একত্রিত করে পুরো বিন্যাসটি পুনর্গঠন করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জৈব যৌগ বিশ্লেষণ খুব সহজ হয়ে গেছে।

১৯৩৩ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নস্ট রুশকা এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ম্যাক্স নল ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবন করেন। সাধারণ মাইক্রোস্কোপে আলোর মাধ্যমে বিবর্ধন ঘটানো হয়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে আলোর কণা ফোটনের পরিবর্তে ইলেকট্রন ব্যবহার করা হয়। ইলেকট্রনও আলোর মত কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্মই প্রদর্শন করে। ইলেকট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ ছোট। তার মানে হলো স্বাভাবিক মাইক্রোস্কোপে যত ছোট বস্তু দেখা সম্ভব, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে তার চেয়েও এক হাজার গুণ ছোট বস্তু দেখা সম্ভব।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবিত হবার পর থেকে জীববিজ্ঞানে অণুজীব, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির গঠন নির্ণয় করা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপেরও অনেক উন্নতি হয়েছে।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা যায় - স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ও ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে পদার্থের উপর ইলেকট্রন প্রয়োগ করা হয়। ইলেকট্রন ও পদার্থের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ায় সেকেন্ডারি ইলেকট্রন নির্গত হয়। সেই সেকেন্ডারি ইলেকট্রন শনাক্ত করা হয় সংযুক্ত ডিটেক্টরে। সেই ইলেকট্রনগুলোর শক্তি বিশ্লেষণ করে পিক্সেল টু পিক্সেল ডাটা সংগ্রহ করা হয় এবং সেখান থেকে পদার্থের পুরো চিত্র পাওয়া যায়। অন্যদিকে ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে ইলেকট্রনগুলো পদার্থের ভেতর দিয়ে ট্রান্সমিট করে গিয়ে ডিটেক্টরে পৌঁছায়। ট্রান্সমিশানের সময় তার শক্তির যে পরিবর্তন হয় - সেই তথ্য থেকে পিক্সেল টু পিক্সেল ডাটা তৈরি হয়ে পুরো ছবি পাওয়া যায়।

ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের ক্ষমতা যতই ভালো হোক না কেন, সেখানে কিছুটা সমস্যা থেকে যায়। সমস্যা হলো ইলেকট্রনের শক্তি অনেক বেশি হওয়াতে পদার্থের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন যাওয়ার সময় রেডিয়েশানের কারণে পদার্থের সূক্ষ্ম গঠনের কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। 

এই পরিবর্তন রোধ করার জন্য ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদার্থ দেখার জন্য বিজ্ঞানীরা একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন - যার নাম ক্রায়োজেনিক ট্রান্সমিশান ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি। এই পদ্ধতিতে যে নমুনার ছবি তোলা হবে সেই নমুনাকে অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় (ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রা) ঠান্ডা করা হয়। ফলে এর ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন যাবার সময় রেডিয়েশানের ক্ষতি হয় না। এই পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ২০১৭ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন জার্মানির জীবপদার্থবিজ্ঞানী জ্যাকুস ডুবোশেট ও ইয়োকিম ফ্রাঙ্ক এবং স্কটিশ জীবপদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড হেনডারসন।

বর্তমান করোনা ভাইরাসের আকার ও আকৃতিও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ক্রায়োজেনিক ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপির সাহায্যে।

ভাইরাসগুলোকে পূর্ণাঙগ জীব বলা যাবে না। অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়াও নয় তারা। ভাইরাস নিজে নিজে বেঁচে থাকতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য একটা পোষকশরীর লাগে তাদের। ব্যাকটেরিয়ার চেয়েও অনেক ছোট আকারের হতে পারে ভাইরাস।

সবচেয়ে ছোট অণুজীবের সাইজ কত? জীব হতে হলে প্রাণ থাকতে হবে এবং সেই প্রাণের প্রাথমিক উপাদান হলো ডিএনএ, আর-এন-এ, এম-আর-এন-এ, রাইবোজোম এবং অন্যান্য সব প্রাণরাসায়নিক উপাদান। এই সবগুলো উপাদান কার্যকরভাবে থাকতে হবে এই অণুজীবের শরীরে। তাহলে এগুলো সব থাকার জন্য কমপক্ষে কতটুকু জায়গার দরকার? পরীক্ষা করে দেখা গেছে সবচেয়ে ছোট ব্যাকটেরিয়ার সাইজ ০.২ মাইক্রোমিটার। অর্থাৎ এক মিটারের পঞ্চাশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। তার মানে ৫০ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া পাশাপাশি রাখলে এক মিটার লম্বা হবে। কিন্তু এক বর্গ মিটার জায়গায় থাকতে পারবে ২৫ হাজার কোটি ব্যাকটেরিয়া। আর ভাইরাসের সাইজ এর চেয়েও এক হাজার গুণ ছোট। তার মানে এক বর্গ মিটার জায়গায় ২৫০০ কোটি কোটি ভাইরাস থাকতে পারবে। বোঝাই যাচ্ছে কী পরিমাণ অদৃশ্য শক্তির সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

গত জানুয়ারিতে করোনা ভাইরাসের জিনোম প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই জিনোম পরীক্ষা করে এমন কোন জিন খুঁজে পাননি - যেটা তার কাঠামো রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। যদি এরকম কিছু পাওয়া যেতো তাহলে এই ভাইরাস ধ্বংস করারও একটা পদ্ধতি হাতে আসতো। এখন পরীক্ষাগারে প্রাণিকোষের উপর এই ভাইরাসের সংযোগ ঘটিয়ে পরীক্ষা করে দেখছেন কীভাবে প্রাণিকোষের প্রোটিন ভাইরাস পার্টিক্যালে পরিণত হয়।

করোনা ভাইরাস কি তাপমাত্রার উঠানামার সাথে কার্যকরিতা হারায়, কিংবা অধিক সক্রিয় হয়? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমরা জানি না। পদার্থবিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের উপর তাপমাত্রার প্রভাব পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করেছেন। এই পরীক্ষা করার জন্য ভাইরাসের মডেল তৈরি করা হচ্ছে গবেষণাগারে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস যেভাবে ছড়ায় সেভাবেই ছড়ায় করোনা ভাইরাস। তাপমাত্রার প্রভাবে ভাইরাসের গঠন যদি বদলে যায় তাহলে এর কার্যকারিতা কমে যাবে। এখন হাঁচি কাশির সাথে যে তরল ড্রপ্লেট বের হয় সেটাই গাঠনিক আকার। বিভিন্ন তাপে তা কীভাবে পরিবর্তিত হয় তাই দেখতে চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।

এই ভাইরাস প্রতিরোধের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। এখন টিকা দেয়া হচ্ছে। এপর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৫২৬ কোটির বেশি টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে।[9] বিশ্ব হয়তো কখনোই করোনামুক্ত হবে না, কিন্তু করোনা প্রতিরোধে সক্ষম হবে পৃথিবীর মানুষ।

 



[1] COVID-19 Dashboard by the centre for Systems Science and Engineering (CSSE) at Johns Hopkins University (JHU). Cited 31/8/2021.

[2] Kempińska-Mirosławska, B., & Woźniak-Kosek, A. (2013). The influenza epidemic of 1889-90 in selected European cities--a picture based on the reports of two Poznań daily newspapers from the second half of the nineteenth century. Medical science monitor : international medical journal of experimental and clinical research19, 1131–1141. https://doi.org/10.12659/MSM.889469

[3] Centers for Disease Control and Prevention, https://www.cdc.gov/flu/pandemic-resources/1918-pandemic-h1n1.html, cited on 31/8/2021

[4] Centers for Disease Control and Prevention, https://www.cdc.gov/flu/pandemic-resources/1957-1958-pandemic.html, cited on 31/8/2021.

[5] Centers for Disease Control and Prevention, https://www.cdc.gov/flu/pandemic-resources/1968-pandemic.html, cited on 31/8/2021.

[6] Global HIV & AIDS statistics – Fact Sheet, UNAIDS, https://www.unaids.org/en/resources/fact-sheet, cited on 31/8/2021.

[7] Origins of the SARS-CoV-2 virus, World Health Organization, https://www.who.int/health-topics/coronavirus/origins-of-the-virus, cited 31/8/2021.

[8] Institute of Medicine (US) Committee on the Assessment of Future Scientific Needs for Live Variola Virus. Assessment of Future Scientific Needs for Live Variola Virus. Washington (DC): National Academies Press (US); 1999. 2, Variola Virus and Other Orthopoxviruses. Available from: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK230917/ cited on 31/8/2021

[9] COVID-19 Dashboard by the centre for Systems Science and Engineering (CSSE) at Johns Hopkins University (JHU). Cited 31/8/2021.


Saturday, 19 June 2021

কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান

 



বিংশ শতাব্দীর পুরোটাই ছিল পদার্থবিজ্ঞানের দখলে। শতাব্দীর শুরুতেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আগমণ বিগত কয়েক শত বছর ধরে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের আধিপত্যে ব্যাঘাত ঘটায়। নিউটনিয়ান মেকানিক্সের দুর্বলতাগুলো কাটানোর জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীতেই আমরা পেয়েছি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার নীতি। আমরা পেয়েছি পরমাণুর নিউক্লিয়াস। আমরা বুঝতে পেরেছি নিউক্লিয়াসের ভেতরের উপাদানগুলোর গতিপ্রকৃতি।  অনেক মৌলিক কণা আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। সেজন্য তৈরি হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। আমাদের হাতে এসেছে পারমাণবিক শক্তি, নিউক্লিয়ার শক্তি। আমরা মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহে নভোযান পাঠিয়েছি। চাঁদের বুকে হেঁটে এসেছেন বারো জন নভোচারী। পুরো বিংশ শতাব্দীজুড়ে পদার্থবিজ্ঞান দাপট দেখিয়েছে। তারপর বিজ্ঞানীরা ধারণা দিয়েছেন একবিংশ শতাব্দী হবে জীববিজ্ঞানের শতাব্দী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে এসে জীববিজ্ঞানের ভূমি দখল করতে শুরু করেছে পদার্থবিজ্ঞান। এই শতাব্দীর বিজ্ঞানের সম্ভাবনাময় নতুন শাখার নাম কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান।

একসময় মনে করা হতো পদার্থবিজ্ঞানের সাথে জীববিজ্ঞানের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যাঁরা জীববিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করতেন তাঁদের অনেকেই পদার্থবিজ্ঞানের ধারেকাছেও ঘেঁষতেন না। কিন্তু এখন সেসব দিন আর নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় বিশেষ করে ক্যান্সার চিকিৎসায় ও মস্তিষ্কের কোষের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি লাগে সেগুলো সব পদার্থবিজ্ঞানের অবদান। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ শুরু হয়েছে আসলে প্রায় একশ বছর আগে থেকে - যখন ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করেছিলেন। এক্স-রে'র হাত ধরে পরবর্তীতে কম্পিউটার টমোগ্রাফি বা সিটিসহ আরো অনেক চিকিৎসা-প্রযুক্তি মানুষের হাতে এসেছে। কিন্তু জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় ভালোভাবে বুঝতে গেলে যে পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে, তাও আবার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো খটমট পদার্থবিজ্ঞান - তা বিশ বছর আগেও মানুষ তেমন করে ভাবেনি। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পদার্থবিজ্ঞানীরা তো বটেই - জীববিজ্ঞানীরাও বুঝতে শুরু করেছেন যে জীববিজ্ঞানের অনেক প্রতিষ্ঠিত বিষয় সঠিকভাবে বুঝতে গেলে ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স নয় - কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দরকার।

ধরা যাক সালোক সংশ্লেষণের ব্যাপারটা। আমাদের ছোটবেলার বিজ্ঞান বইতেই আমরা পড়েছি উদ্ভিদের পাতায় সূর্যের আলো পড়লে সেখান থেকে উদ্ভিদের খাদ্য তৈরি হয়। আরেকটু বড় হয়ে আমরা জেনেছি উদ্ভিদের পাতায় যে ক্লোরোফিল আছে তার সাথে সূর্যালোকের বিক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ আছে। আমাদের পরিবেশে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প বা পানির কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতার ক্লোরোফিল সূর্যের আলোর সাথে বিক্রিয়া করে অর্থাৎ সূর্যের আলোর ফোটন কণার শক্তি কাজে লাগিয়ে পানি থেকে ইলেকট্রন বের করে নিয়ে আসে। সেই ইলেকট্রন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে যুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বোহাইড্রেড বা গ্লুকোজ। ইলেকট্রনের আদান-প্রদানের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমতে থাকে এবং অক্সিজেন তৈরি হতে থাকে। আমরা উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ তৈরির রাসায়নিক সমীকরণও জানি: 6CO2 + 12H2O + ফোটন (সূর্যের আলো) = C6H12O6 + 6O2 + 6H2O. সালোকসংশ্লেষণের এই ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক বছর আগে। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় একটি ফাঁক রয়ে গেছে। সেটা হলো আলোর ফোটন এখানে কীভাবে কাজ করে। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স দিয়ে আলোর ধর্ম পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। আলো একই সাথে কণা ও তরঙ্গ আকারে থাকতে পারে। একটি ফোটন একই সময়ে একাধিক জায়গায় থাকতে পারে। বিশ্বাস হয় না? এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে।

সব সালোকসংশ্লেষণেই যে অক্সিজেন উৎপন্ন হবে এমন কোন কথা নেই। সাধারণত উদ্ভিদ, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া (সায়ানোব্যাকটেরিয়া) সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। আবার কিছু বেগুনি ও সবুজ ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমায় ঠিকই, কিন্তু অক্সিজেন তৈরি করে না। সেখানে আসলে পানির বদলে অন্য পদার্থ ব্যবহৃত হয়। সেধরনের সালোকসংশ্লেষণের রাসায়নিক সমীকরণ লেখা যায় এভাবে: CO2 + 2H2A + ফোটন (আলো) = [CH2O] + 2A + 2H2O. এখানে A হলো এমন একটি যৌগ যেটা থেকে ফোটনের বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন বের হয়ে আসবে। আলোর ফোটন কী প্রক্রিয়ায় পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের হয়ে আসতে সাহায্য করে সেই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া চলবে না।

বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে প্রত্যেকটি ধাপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে এই ধাপগুলো ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন ফোটনগুলো শোষিত হবার পর কোষের ভেতর একটি কেন্দ্রে গিয়ে মিলিত হচ্ছে - যাকে রিঅ্যাকশান সেন্টার বলা চলে। এই কেন্দ্রেই সালোক সংশ্লেষণ ঘটে। ফোটনগুলো এই কেন্দ্রে সরাসরি যায় না। একই সাথে অনেকগুলো পথে এই ফোটনগুলো রিঅ্যাকশান সেন্টারে যায় - যা কোয়ান্টাম সুপারপজিশান, অর্থাৎ একই সাথে একাধিক অবস্থায় থাকা। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিখ্যাত 'শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল' - যা একই সাথে মৃত বা জীবিত যে কোন অবস্থায় থাকতে পারে - কোয়ান্টাম সুপারপজিশানেরই উদাহরণ।

আমরা এনজাইম বা উৎসেচকের কথা জানি। এগুলো মূলত প্রোটিন। জীবকোষের ভেতর যত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে সেগুলোকে ত্বরাণ্বিত করতে সাহায্য করে এনজাইম। কিন্তু কীভাবে এই কাজ করে এরা? কোষের মেমব্রেন বা কোষের আবরণ ভেদ করে কীভাবে এরা ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটায়? এই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে হলেও আমাদের দরকার হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স - যেখানে আমরা পাই 'কোয়ান্টাম টানেলিং'। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের সূত্র মেনে কোন একটি বাধা পার হয়ে যেখানে ইলেকট্রনের যাওয়ার কোন উপায় নেই, সেখানেও দেখা যায় কিছু ইলেকট্রন সেই বাধা অতিক্রম করে ফেলেছে। বোঝার সুবিধার্থে বলা যায় - যদি ইলেকট্রনের সামনে বিরাট উঁচু একটা দেয়াল থাকে, সেই দেয়াল ডিঙিয়ে যদি ইলেকট্রনের যাওয়ার শক্তি না থাকে- তখন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স বলে যে দেয়ালের ওপাশে কোন ইলেকট্রন যেতে পারবে না। কিন্তু দেখা যায় অনেক সময় ইলেকট্রন দেয়ালের ওপাশে চলে গেছে। তখন ধরে নেয়া হয় দেয়াল পার হয়ে নয়, দেয়ালে সুড়ঙ্গ বা টানেল তৈরি করে ইলেকট্রনগুলো গিয়েছে।  ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সে কোয়ান্টাম টানেলিং সম্ভব নয়। জীবকোষের কোটি কোটি কোষের ভেতর অনবরত চলছে কোয়ান্টাম টানেলিং। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স দিয়ে কি তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

আমরা কীভাবে গন্ধ পাই? আমাদের ঘ্রাণ-ইন্দ্রীয় বা অলফ্যাক্টরি নার্ভ অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ বুঝতে পারে। পশুপাখিরাও গন্ধ বুঝতে পারে। কুকুরের ঘ্রাণ চেনার ক্ষমতা মানুষের চেয়েও বেশি। কিন্তু কীভাবে কাজ করে এই ঘ্রাণ ইন্দ্রীয়? জীববিজ্ঞানের সাধারণ ব্যাখ্যা হলো গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতির উপর নির্ভর করে আমরা কী ধরনের গন্ধ পাবো। আমাদের নাকের মধ্যে আছে গন্ধ চেনার সেন্সর বা সংবেদী কোষ যাদের বলা হয় স্মেল রিসেপ্টর। এই কোষগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির সেন্সর। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতি যে সেন্সরের আকার ও আকৃতির সাথে মিলে যাবে সেই গন্ধের সিগনাল চলে যাবে মস্তিষ্কে। তখন মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি নার্ভ সেই সিগনাল প্রসেস করে আমাদের গন্ধের অনুভূতি দেয়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা এত সোজা নয়। আমাদের নাকের মধ্যে আছে মাত্র চারশ রকমের স্মেল রিসেপ্টর। অথচ আমরা কয়েক হাজার রকমের গন্ধ পাই। যদি একেক গন্ধের জন্য একেক রকমের রিসেপ্টর নির্দিষ্ট থাকতো তাহলে আমরা চারশ রকমের বেশি গন্ধ পেতাম না কোনভাবেই। অথচ লক্ষ রকমের গন্ধ আমরা বুঝতে পারি। তাছাড়া একই গন্ধের অণুর ভিন্ন ভিন্ন গঠন হতে পারে, কিন্তু তাদের সবার গন্ধ একই রকম। যেমন হাইড্রোজেন ও সালফারের যৌগের বিভিন্ন রকমের আকৃতি হতে পারে, কিন্তু তাদের সবারই একই রকম পচা ডিমের গন্ধ।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই গন্ধরহস্য ভেদ করতে পেরেছে। কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান এই গন্ধ তত্ত্বের নাম দিয়েছে ভাইব্রেশান থিওরি অব অলফেকশান। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুর পারমাণবিক বন্ধন বা অ্যাটমিক বন্ড তরঙ্গের মত কাজ করে। আর আমাদের নাকের সেন্সর এই তরঙ্গের কম্পন শনাক্ত করে। গন্ধের তীব্রতা ও প্রকৃতিভেদে বিভিন্ন অসংখ্য কম্পাঙ্কের গন্ধ-তরঙ্গ তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকে। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুযায়ী আমরা অসংখ্য ধরনের গন্ধ পেতে পারি। মাঝে মাঝে অনেকেই কোন গন্ধ বস্তুর উপস্থিতি ছাড়াই গন্ধ পায়। আমাদের মস্তিষ্ক কিছু কিছু গন্ধ-তরঙ্গের স্মৃতি ধরে রাখে। সেই স্মৃতি মাঝে মাঝে ফিরে আসে গন্ধ হয়ে। একটু রহস্যময় মনে হতেই পারে। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগত রহস্যময়। পদার্থবিজ্ঞান ছাপিয়ে এখন জীববিজ্ঞানের দিকেও সফলভাবে অগ্রসর হচ্ছে কোয়ান্টাম বিজ্ঞান। এই শতাব্দীতে কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান জীবকোষের আরো অনেক নতুন রহস্যের জট খুলে দেবে। 


বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০১৯  সংখ্যায় প্রকাশিত



Monday, 7 June 2021

জীবকোষের অমরত্বের রহস্য



বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল কোষের পরিবর্তন  সময়ের মতই একমুখি, তাকে কিছুতেই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না। ডিম্বাণু  ও শুক্রাণুর মিলনের ফলে যে ভ্রুণ তৈরি হয় সেখানে শুরুতে সামান্য যে ক'টি কোষ থাকে তা নবীন অবিশেষায়িত কোষ। অর্থাৎ এই কোষগুলি থেকেই শরীরের সমস্ত কোষ তৈরি হয়। এই কোষগুলো বিভাজিত হতে হতে আস্তে আস্তে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য বিশেষায়িত হয়ে যায়ভ্রুণের বৃদ্ধির সাথে সাথে নবীন প্রাথমিক কোষগুলো পরিণত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠিত হতে থাকে। কিছু কোষ পরিণত হয় স্নায়ুকোষে, কিছু যকৃতে, কিছু মস্তিষ্কে, কিছু হৃৎপিন্ডে, ইত্যাদি। তারপর যকৃতের কোষগুলো শুধু যকৃতের কাজই করে, হৃৎপিন্ডের কোষগুলো হৃৎপিন্ডের। কোষগুলো একবার পরিণত হয়ে বিশেষায়িত হয়ে গেলে তাকে আর কখনো অবিশেষায়িত তরুণ কোষে পরিবর্তন করা যায় না এরকম বিশ্বাসই ছিল বিজ্ঞানীদের। প্রাথমিক নবীন কোষগুলো শুরুতে  যে কোন অঙ্গের অংশ হতে পারে কিন্তু পরে ক্রমশ বিভাজিত হতে হতে যখন বিশেষায়িত হয়ে যায় তখন আর কিছুতেই প্রাথমিক অবিশেষায়িত অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না কিন্তু ১৯৫৮ সালে বিজ্ঞানীদের এই ধারণা বদলে দিলেন একজন ব্রিটিশ তরুণ জন গর্ডন। জীববিজ্ঞানে ক্লোনিং-এর সূত্রপাত হয়েছে জন গর্ডনের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। জন গর্ডনের লেখাপড়া ও গবেষণা সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তাঁর বিজ্ঞান পড়ার সুযোগই যেখানে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, সেখানে  নোবেল পুরষ্কার পাওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার।

জন গর্ডনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ২রা অক্টোবর, ইংল্যান্ডে। তাঁর বাবা-মা তাঁকে সবচেয়ে নামী-দামী স্কুলে পড়িয়েছেন। বারো বছর বয়সে গর্ডনকে ভর্তি করিয়েছেন ইউরোপের সবচেয়ে দামী প্রাইভেট স্কুল - ইটন কলেজে। ইটন কলেজের শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের 'মানুষের মত মানুষ' তৈরি করে দেন বলে বিশ্বাস অনেকের। কিন্তু গর্ডন ঠিক তাল মেলাতে পারলেন না সেখানে। বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল ঠিকই - কিন্তু নিজের মত করে পড়াশোনা করতে গিয়ে কিছুই হলো না। এই দামী কলেজের বিজ্ঞান পড়ানোর পদ্ধতি ছিল অনেকটাই মুখস্থনির্ভর। ক্লাসে নোট নাও, দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনসহ সবকিছু মুখস্থ করে পরীক্ষায় হুবহু লিখে দাও, শিক্ষকরা তোমাকে ভাল ছাত্র বলবে। কিন্তু জন গর্ডনের পক্ষে এটা করা সম্ভব হয়নি। তাই সেখানে মোটেও ভাল ফলাফল করতে পারেননি তিনি। ইটনের শিক্ষকদের মতে ক্লাসের ২৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে গর্ডন ছিলেন সবচেয়ে খারাপ ছাত্র।  ফলে ইটন কলেজের পড়াশোনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলেও বিজ্ঞানের কোন শাখায় ভর্তির দরখাস্তও করতে পারেননি তিনি ক্লাসিক সাহিত্যে ভর্তি হবার দরখাস্ত করেছিলেন অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে কিন্তু ভর্তি অফিসে কিছু কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। অ্যাডমিশান অফিস থেকে তাঁকে ফোন করে জানানো হয় যে ক্লাসিক সাহিত্যের বদলে তাঁকে প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে হবে। পরে জানা গিয়েছিল সেই বছর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে ৩০টি সিট খালি ছিল। সেই খালি সিট ভর্তি করার জন্যই জন গর্ডনকে প্রাণিবিজ্ঞানে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়েছিল। স্কুলে থাকতেই তাঁর আকর্ষণ জন্মেছিল প্রাণিবিজ্ঞানের প্রতি। তাঁর সেই আগ্রহকে শেষ করে দেয়ার সব চেষ্টা তাঁর শিক্ষকরা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও এই সুযোগ যখন এসে গেল তিনি তার পুরোটাই কাজে লাগালেন।

শুরু হলো  গর্ডনের তুমুল বিজ্ঞানচর্চা স্নাতকোত্তর শেষ করে পিএইচডি করেন অধ্যাপক মাইকেল ফিশবার্গের অধীনে নিউক্লিয়ার ট্রান্সপ্লেন্টেশান বা কোষের নিউক্লিয়াস স্থানান্তর প্রক্রিয়ার ওপর জীবকোষ রূপান্তরের একমুখি ধারণা সম্পর্কে গর্ডন ভাবলেন এতদিনের বদ্ধমূল ধারণাতো ভুলও হতে পারে। একটা কোষ যখন এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয় তখন কি তার প্রাথমিক অবস্থার সব স্মৃতিই মুছে যায়? যে জিনেটিক কোড তাদের পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে সেই কোডের কিছুই কি অবশিষ্ট থাকে না? যদি কিছু স্মৃতিও কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে তাহলে সেই স্মৃতি কাজে লাগিয়ে পরিণত কোষের মধ্যে নবীন কোষের বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। ১৯৫৮ সালে তিনি ব্যাঙের ডিম্বকোষের অপরিণত অবিশেষায়িত নিউক্লিয়াস সরিয়ে সেখানে পাকস্থলির প্রবীণ কোষের নিউক্লিয়াস ঢুকিয়ে দেন এই পরিবর্তিত ডিম্বকোষগুলো যথাসময়ে স্বাভাবিক ব্যাঙাচিতে পরিণত হয় তারপর পি-এইচ-ডি থিসিস জমা দিয়ে ব্যাঙাচিগুলো প্রফেসর ফিশবার্গের কাছে রেখে তিনি পোস্ট-ডক্টরেট করতে চলে যান আমেরিকায় ক্যালটেকে ব্যাকটেরিয়ার বংশগতির ওপর তিন বছর গবেষণা করে ফিরে আসেন অক্সফোর্ডে ১৯৬২ সালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে যোগ দেন সহকারী প্রভাষক হিসেবে

ততদিনে ব্যাঙাচিগুলো পূর্নাঙ্গ ব্যাঙে পরিণত হয়েছে সফল ভাবে ব্যাঙের ক্লোন তৈরি হয়েছে সে বছরই প্রকাশিত হলো তাঁর কালজয়ী গবেষণাপত্র "দি ডেভেলপমেন্টাল ক্যাপাসিটি অব নিউক্লিয়াই টেকেন ফ্রম ইন্টেস্টাইনাল এপিথেলিয়াম সেলস অব ফিডিং ট্যাডপোলস" জন গর্ডন আবিষ্কার করলেন যে পরিণত প্রবীণ কোষগুলোকে আবার ঝকঝকে নবীন কোষে রূপান্তরিত করা যায়  'ক্লোন' শব্দটি গাছের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে প্রচলিত হলেও প্রাণির ক্ষেত্রে প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী হ্যালডেন ১৯৬৩ সালে গর্ডনের গবেষণালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে  

গর্ডনের আবিষ্কারকে শুরুতে পাত্তা দিতে চাননি অনেকেই। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা যখন গর্ডনের পদ্ধতি ব্যবহার করে সাফল্য পেতে শুরু করলেন - স্টেমসেল গবেষণার পালে হাওয়া লাগলো। নিম্ন-প্রজাতির প্রাণী থেকে শুরু করে স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্লোন তৈরি করার চেষ্টা চললো। ১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডের রোজলিন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী আয়ান উইলমুট ও কিথ ক্যাম্পবেলের নেতৃত্বে যখন প্রথম স্তন্যপায়ী ক্লোন ভেড়া ডলির জন্ম হলো পৃথিবীব্যাপী হৈ চৈ পড়ে গেলো।

 

চিত্র: জন গর্ডন পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙের একটি কোষের নিউক্লিয়াস নিয়ে ব্যাঙের ডিমের কোষের নিউক্লিয়াসে ঢুকিয়ে দেন। সেখান থেকে সৃষ্টি হয় স্বাভাবিক ব্যাঙাচি। যা নির্দিষ্ট সময়ে পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে। একই পদ্ধতিতে সৃষ্টি হয় ভেড়ার ক্লোন ডলি। এবং আরো অনেক প্রাণির ক্লোন তৈরি হতেই থাকে।


এদিকে গর্ডন ১৯৭১ সালে কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে সেল বায়োলজি ডিভিশানের প্রধান বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের জন হামফ্রে প্লামার প্রফেসর পদে যোগ দেন সেখানে প্রফেসর লাসকির সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ক্যান্সার গবেষণার 'মলিকিউলার এমব্রায়োলজি ইউনিট' ১৯৯০ সালে তিনি  'ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার এন্ড ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি'র সভাপতির দায়িত্ব নেন বর্তমানে এই ইনস্টিটিউটের সতেরটি স্বতন্ত্র গবেষণা গ্রুপে দু'শতাধিক বিজ্ঞানী গবেষণারত গর্ডনের আবিষ্কৃত পদ্ধতির ভিত্তিতে স্টেমকোষের বিভিন্ন রকমের গবেষণা চলতে থাকে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের সূচনা হয় এমব্রায়োনিক স্টেমসেল সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ২০০৭ সালের চিকিৎসাবিদ্যার নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় মারিও ক্যাপেচি, মার্টিন ইভান্স ও অলিভার স্মিথকে

জন গর্ডনের পদ্ধতিতে একটা পরিণত বিশেষায়িত কোষকে অপরিণত অবিশেষায়িত কোষে রূপান্তরের জন্য একটা কোষ থেকে নিউক্লিয়াস বের করে সেখানে অন্য পরিণত কোষের নিউক্লিয়াস স্থাপন করতে হয় পরীক্ষাগারে একটার পর একটা এই জটিল পদ্ধতির কোন বিকল্প কি আছে? পুরো একটা পরিণত কোষকে কি সরাসরি নবীন কোষে পরিণত করা সম্ভব? জাপানের প্রফেসর শিনিয়া ইয়ামানাকা প্রমাণ করেছেন এটা সম্ভব কোষের নিউক্লিয়াস স্থানান্তর করে বিশেষায়িত কোষ থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রাণী তৈরি করার যে পদ্ধতি গর্ডন আবিষ্কার করেছিলেন তার ফলাফল প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬২ সালে আর সে বছরই জাপানের ওসাকায় জন্ম হয় শিনিয়া ইয়ামানাকার। শিনিয়া ইয়ামানাকার বাবা ছিলেন জাপানের বিশিষ্ট শিল্পপতি। সেলাই কলের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা ছিল তাঁর। শিনিয়া মা-বাবার একমাত্র সন্তান। জাপানীদের রীতি অনুযায়ী তাঁর বাবার শিল্প-কারখানার দায়িত্ব নেয়ার কথা। কিন্তু তিনি ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে গেলেন না। তিনি ডাক্তার হলেন। ১৯৮৭ সালে কোবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম-ডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং অর্থোপেডিক সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করেন কিন্তু কিছুদিন পরেই সার্জারি বাদ দিয়ে গবেষণায় ফিরে আসেন ১৯৯৩ সালে ওসাকা সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি লাভ করেন তারপর পোস্টডক্টরেট গবেষণা করেন গ্ল্যাডস্টোন সানফ্রান্সিসকোর গ্ল্যাডস্টোন ইনস্টিটিউট ও জাপানের নারা ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে বর্তমানে তিনি কায়তো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

 

চিত্র: প্রফেসর শিনিয়া ইয়ামানাকা

 

২০০৭ সালের নোবেল বিজয়ী মার্টিন ইভান্স ইঁদুরের এমব্রায়োনিক স্টেমসেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের ভ্রুণ থেকে অবিশেষায়িত নবীন কোষ আলাদা করে নিয়ে ল্যাবোরেটরিতে সেই কোষগুলোর সফল বিভাজন ঘটিয়ে অনেকগুলো স্টেমসেল তৈরি করেছেন ইয়ামানাকা সেই ব্যাপারটাকে কাজে লাগালেন তিনি দেখতে চাইলেন নবীন কোষগুলোকে নবীন থাকতে সাহায্য করে কোন্কোন্জিন? ইয়ামানাকা বিভিন্ন রকমের জিনের সমন্বয় করে পরীক্ষা চালালেন চার ধরনের জিনের একটা সহজ সমন্বয় এনে দিল তাঁর গবেষণার সাফল্য ইয়ামানাকা ইঁদুরের শরীর থেকে একটা বিশেষায়িত প্রবীণ কোষ নিয়ে সেখানে চারটা জিন প্রবেশ করিয়ে পুরো কোষটাকেই অবিশেষায়িত নবীন কোষে রূপান্তরিত করতে সফল হলেন। তিনি এই কোষগুলোর নাম দিলেন ইনডিউজড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল বা আই-পি-এস সেল। এই আই-পি-এস সেল থেকে পূর্ণাঙ্গ ইঁদুর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ইয়ামানাকা। ২০০৬ সালে ইয়ামানাকা'র গবেষণাপত্র "ইনডাকশান অব প্লুরিপুটেন্ট স্টেম সেলস ফ্রম মাউস এমব্রায়োনিক এন্ড এডাল্ট ফাইব্রোব্লাস্ট কালচারস বাই ডিফাইন্ড ফ্যাক্টরস" প্রকাশিত হয় 'সেল' জার্নালে

 

চিত্র: ইঁদুরের স্টেমসেল থেকে পূর্ণাঙ্গ ইঁদুরের জন্ম

 

প্রবীণ কোষকে নবীন কোষে পরিণত করার পদ্ধতি যখন জানা হয়ে গেল তখন কোষের অমরত্ব প্রাপ্তির রহস্য জানা হয়ে গেল। যে কোন পরিণত কোষকে অপরিণত কোষে রূপান্তর করা সম্ভব। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আশা করছেন অনেক জটিল রোগের সমাধান পাওয়া যাবে এখন। পার্কিনসন্স, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। আই-পি-এস কোষ কাজে লাগিয়ে শরীরের সব প্রত্যঙ্গের কোষ তৈরি করা সম্ভব। যেমন একজন রোগীর ত্বক থেকে একটা কোষ নিয়ে তাকে আই-পি-এস কোষে রূপান্তর করে আবার বাড়তে দিলে দেখা যাবে কীভাবে রোগের সংক্রমণ ঘটে। ফলে রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হবে। জন গর্ডন ও অধ্যাপক শিনিয়া ইয়ামানাকা'র এ আবিষ্কার লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রাণিদেহের ম্যাচিউর সেল বা প্রবীণ কোষকে কৃত্রিমভাবে আবার নবীন কোষে রূপান্তরিত করার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ২০১২ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছেন স্যার জন গর্ডন এবং অধ্যাপক শিনিয়া ইয়ামানাকা।




৮৫ বছর বয়সেও জন গর্ডন প্রতিদিন ভোর চারটায় তাঁর গবেষণাগারে গবেষণা শুরু করেন। অন্য গবেষকরা আসার আগেই প্রতিদিন পাঁচ ঘন্টা গবেষণাকাজ হয়ে যায় তাঁর। ছবিতে স্যার গর্ডনকে দেখা যাচ্ছে তাঁর ল্যাবের ডেস্কে। ফ্রেমবন্দী যে সনদ-পত্র দেখা যাচ্ছে তা অভিনব। জীবনে এত কিছু অর্জন করেছেন - কোন সনদই তিনি ফ্রেমবন্দী করেননি। অথচ এই বিশেষ সনদটি বাঁধাই করে কাজের টেবিলে রেখে দিয়েছেন চোখের সামনে। কী আছে এতে?  নিচে সনদটির ক্লোজ-আপ দেয়া হলো।

 



১৯৪৯ সালে ইটন কলেজে পড়ার সময় জীববিজ্ঞান শিক্ষকের দেয়া 'সায়েন্স রিপোর্ট'ব্রিটেনের সবচেয়ে দামী স্কুল (বাৎসরিক টিউশন ফি তেত্রিশ হাজার পাউন্ড; বাংলাদেশি টাকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা) ইটন কলেজ থেকে পাওয়া গর্ডনের এই সায়েন্স রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে আঠারো জনের গ্রুপে তিনি আঠারোতম হয়েছেন। তাঁর পড়াশোনার হাল হতাশাজনক। পঞ্চাশ নম্বরের পরীক্ষায় তিনি দুই পেয়েছেন। তিনি শিক্ষকের কথা কানে নেন না। রিপোর্টে আরো লেখা আছে, "আমি জানি সে বিজ্ঞানী হতে চায়। কিন্তু তার বর্তমান আচরণ বিরক্তিকর। জীববিজ্ঞানের সাধারণ বিষয়ই সে বুঝতে পারে না, বিশেষজ্ঞ হবে কীভাবে? বিজ্ঞানী হবার চেষ্টা করাটা হবে পুরোপুরি সময় নষ্ট, তার জন্য তো বটেই, যাঁরা তাকে পড়াবেন তাঁদের জন্যও।" ষোল বছর বয়সের কিশোর জন গর্ডন তার শিক্ষকের কাছ থেকে এরকম একটা রিপোর্ট পেয়ে হতাশ হওয়ার বদলে কঠোর পরিশ্রম করে হয়ে উঠেছেন - নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী।

 

তথ্যসূত্র:

নোবেল পুরষ্কার ওয়েবসাইট, গর্ডন ইনস্টিটিউট, দি গার্ডিয়ান। 

____________________

বিজ্ঞানচিন্তা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায় ইষৎ সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts