Friday 31 March 2023

বাবা - ৩

 



বাহুল্য কী জিনিস সেটা আমাদের বাড়িতে ছোটবেলায় আমি কখনো দেখিনি। প্রয়োজন এতই সীমিত ছিল, অভাব বোধ করিনি কোনোকিছুরই। সেই ছোটবেলাতেই কীভাবে যেন বুঝে গিয়েছিলাম, বাবা দিনরাত খেটেখুটে আয় করেন সামান্যই। মনে আছে, একবার চৈত্রসংক্রান্তির দিনে আমাদের দুই ভাইকে মেলা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা – মাইল তিনেক দূরের একটা গ্রামে। সকালে যাবার সময় উৎসাহে টগবগ করতে করতে হেঁটে যেতে কোন সমস্যাই হয়নি। লালসালুতে মোড়া একটি লম্বা বাঁশের সামনে বসে অনেকে পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছে দেখতে দেখতে, আর কাঠি-লাগানো বরফের আইসক্রিম চুষতে চুষতে দুপুর হয়ে গেল। ফেরার সময় মাথার উপর প্রচন্ড রোদ। বাবা ছাতা খুলে ধরেছেন আমাদের দুই ভাইয়ের মাথায়, নিজে ঘামছেন দরদর করে। 

“আর হাঁটতে পারছি না বাবা, রিকশা …”

তখন রিকশার সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। অনেকক্ষণ রাস্তার পাশে গাছতলায় দাঁড়ানোর পর একটা রিকশা দেখা গেল। বাবা এগিয়ে গিয়ে কথা বললেন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন রিকশাওয়ালা। রিকশায় প্যাডেল মারার সময় রিকশাওয়ালা ঘাড় ফিরিয়ে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন আমাদের দিকে চেয়ে। সেই হাসিটা আমি কখনো ভুলতে পারবো বলে মনে হয় না। রিকশা তখন বড়লোকের বাহন ছিল। সামর্থ্যহীনরা তখন মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতো। 

বাবা আমার কাছে এসে বললেন, “আমার পিঠে উঠ।“ 

আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। আমি তখন স্কুলে পড়ি। যুদ্ধ শেষ হয়েছে বছরখানেক আগে। যুদ্ধে বাবা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হবার পর বাবার সংগ্রাম শুরু হয়েছে পোড়াঘরের ছাইভস্ম থেকে আবার উঠে দাঁড়ানোর। যুদ্ধ মানুষের মানসিক বয়স বাড়িয়ে দেয়। নিজের অজান্তেই আমরা বুঝতে শিখে গিয়েছি অনেক কিছু। আমি বুঝতে পারি – বাবার পিঠ পেতে দেয়ার কারণ কী। আমার পায়ের ব্যথা চলে যায়। আমরা হাঁটতে থাকি বাবার ধরা ছাতার ছায়ায়। 

সন্তানের একটু সুখের জন্য মা-বাবা জীবনপাত করে ফেলে। তাতেও না কুলোলে দার্শনিক কথাবার্তা বলেন। “টাকা-পয়সা ধন-সম্পদ মান-মর্যাদা কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। যেকোনোদিন যে কোনো কারণেই এসব চলে যেতে পারে। এই যে আমার সবকিছু লুট করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু যে জিনিস কখনো নষ্ট হয় না, চুরি হয় না, কিংবা কেউ কেড়েও নিতে পারে না, সেটা হলো শিক্ষা। টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা কিছুই হয়তো আমি তোদের দিয়ে যেতে পারবো না। আমি তো লেখাপড়া করতে পারিনি, কিন্তু তোরা যদি লেখাপড়া করিস, সেটা কোনোদিন কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।“

সেদিন সেই বয়সে এসব কথা শুনে কী মনে হয়েছিল আমার মনে নেই। কিন্তু এখন কথাগুলি যতবারই মনে পড়ে, অবাক হয়ে ভাবি – অভাব থেকেই কি খাঁটি দর্শনের সৃষ্টি হয়? 


Saturday 25 March 2023

প্রফুল্লচন্দ্র রায়: কিমিয়াবিজ্ঞানের পিতামহ

 


উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর কয়েক দশক পর্যন্ত রসায়নবিজ্ঞান যখন ইওরোপে দ্রুত বিস্তার লাভ করছিলো শিল্পবিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে, তখনো কিমিয়াবিদ্যা বলা হতো সেই বিদ্যাকে আমাদের দেশে। ভারতীয় উপমহাদেশে কিমিয়াবিদ্যা তথা রসায়নের গবেষণা যার হাত ধরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল তিনি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, যিনি বিশ্বের কাছে স্যার পি সি রায় নামে পরিচিত। পরবর্তীতে খ্যাতিমান রসায়নবিদ, স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের প্রথম পরিচালক শান্তিস্বরূপ ভাটনগর যখন স্যার পি সি রায়কে কিমিয়াবিদ্যার পিতামহ বিশেষণে বিশেষিত করেন, তাতে একবর্ণও অতিরঞ্জন থাকে না। ভারতীয় উপমহাদেশের অগ্রণী রসায়নবিদদের অনেকেই ছিলেন আচার্যের সরাসরি ছাত্র কিংবা ছাত্রের ছাত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগদীশচন্দ্র বসুর হাতে যেভাবে পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার পসার ঘটেছে, তেমনি রসায়নের গবেষণাবৃক্ষ পুষ্পপল্লবে বিকশিত হয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে। তিনিই বাংলায় প্রথম রাসায়নিক কারখানা স্থাপন করেন। মাত্র আটশ টাকা পূঁজি করে ছোট্ট একটা অন্ধকার ঘর থেকেই জন্ম হয়েছিল বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড কোম্পানির। 

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। খুলনা জেলার রাঢুলি গ্রামের খুবই অবস্থাপন্ন পরিবারে তাঁর জন্ম ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট। প্রপিতামহ মানিকলাল, পিতামহ আনন্দলাল প্রচুর ধনসম্পদের মালিক ছিলেন। পিতা হরিশচন্দ্রের আমলে উপার্জন কিছুটা কমে এলেও বিত্তবৈভবের অভাব হয়নি কখনো। বাড়িতে প্রচুর বই ছিলো। একেবারে শৈশব থেকেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল প্রফুল্লচন্দ্রের। স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো ছিল না। হজমের সমস্যা আর ঘুমের সমস্যা লেগেই থাকতো। তাই স্কুলের পড়াশোনায় কয়েক বছর ছেদও পড়েছিল। 

গ্রামের স্কুলে প্রাথমিকের পাঠ শুরু হবার কয়েক বছর পর ১৮৭০ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে, এরপর ১৮৭৪ সালে এলবার্ট স্কুলে ভর্তি হলেন প্রফুল্লচন্দ্র। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন। ১৮৭৮ সালে স্কুল ফাইনাল পাস করার পর ভর্তি হলেন মেট্রোপলিটন ইন্সটিউশানে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে এই কলেজের নাম রাখা হয় বিদ্যাসাগর কলেজ। এখানে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়েই প্রফুল্লচন্দ্রের সাথে পরিচয় হয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিপ্লবী সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সাথে। তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। 

এফএ  পাস করার পর মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনেই বিএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। কিন্তু সেখানে তখন পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়ন পড়ানো হতো না। প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে কেমিস্ট্রির ক্লাস করতেন বহিরাগত ছাত্র হিসেবে। সেখানে কেমিস্ট্রির প্রফেসর ছিলেন আলেক্সান্ডার পেডলার। তিনি হাতেকলমে এত চমৎকারভাবে রসায়ন পড়াতেন যে রসায়নের প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মে গেল প্রফুল্লচন্দ্রের। বিএ পড়ার সময়েই গিলক্রিস্ট বৃত্তির জন্য পরীক্ষা দেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষায় মাত্র দুজনকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি দেয়া হয়। প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন এই দু’জনের একজন। 

গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন বিএসসি ক্লাসে। রসায়নের প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং ভালোবাসা আরো পাকাপোক্ত হলো। ১৮৮৫ সালে বিএসসি পাস করার পর পরই শুরু করলেন ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য গবেষণা। দু’বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করলেন ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি। 

১৮৮৮ সালে কলকাতায় ফিরে এলেন ডক্টর প্রফুল্লচন্দ্র রায়। কিন্তু ব্রিটিশ রাজত্বে এত উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণাসম্পন্ন ভারতীয়ের তেমন কোন দাম নেই। ইন্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিসের সবগুলি চাকরি ছিল ব্রিটিশদের জন্য সংরক্ষিত। প্রাদেশিক সরকারের অধীনে কলেজে পড়ানোর জন্য কিছু চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হতো ভারতীয়দের। কিন্তু বেতন দেয়া হতো অনেক কম। অর্থবিত্ত কিছুই ছিল না তাঁর সেই সময়। বাবার সম্পত্তিও দেনার দায়ে সব বন্ধক দেয়া হয়ে গেছে। সেই সময় তিনি বাধ্য হয়ে জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়িতে থেকেছেন পুরো এক বছর। রাসায়নিক গবেষণা চালিয়ে যাবার কোনো সুযোগই তিনি পাননি পুরো এক বছর। এর পর ১৮৮৯ সালের জুলাই মাসে মাসিক মাত্র ২৫০ টাকা বেতনে রসায়নের অস্থায়ী একটি পদে যোগ দেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। 

পরবর্তী সাতাশ বছর তিনি অধ্যাপনা করেছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে খ্যাতি লাভ করেছেন। মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ কর্মকার, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের রসায়ন শিখিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। শুধুমাত্র বই মুখস্ত করে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার কোন গুরুত্বই ছিল না তাঁর কাছে। তিনি চাইতেন তাঁর ছাত্ররা সবাই রসায়নকে এমনভাবে শিখবে যেন তা কাজে লাগানো যায়, যেখান থেকে গবেষণা করে আরো নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা যায়। গৎবাঁধা নিয়মে পরীক্ষায় পাস করে চাকরি করতে করতে জীবনীশক্তি ক্ষয় করে ফেলার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। তিনি চাইতেন বাঙালি যুবক পড়াশোনা করে শিল্পউদ্যোক্তা হয়ে উঠুক। চাকরি খোঁজার বদলে নিজেরাই যেন চাকরি সৃষ্টি করতে পারে সেরকম উদ্যোগ নিক। নিজের বাড়িতেই তিনি ছোট্ট পরিসরে গবেষণাগার তৈরি করেন যেখানে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে তিনি অনেক ধরনের প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি করতেন। তাঁর সেই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থেকে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্ক্স। 

প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন গবেষণাগার তিনি নিজের হাতে একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন। সেখানে বসে তিনি করে গেছেন নিরলস গবেষণা। যা বেতন পেতেন শুধুমাত্র দুই সেট জামাকাপড় আর নামমাত্র খাওয়ার খরচ রেখে বাকি সবটাই তিনি খরচ করতেন বই আর গবেষণার পেছনে। ১৮৯৫ সালে তিনি আবিষ্কার করলেন মারকিউরাস নাইট্রাইট। ১৮৯৬ সালে লন্ডনের প্রসিডিংস অব কেমিক্যাল সোসাইটিতে এই গবেষণাপত্র প্রকাশের পর আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিলাভ করেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তারপর অবিরাম গবেষণা চলতে থাকে। ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসরের আগপর্যন্ত বিশ বছরে সত্তরটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তিনি। 

প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে তিনি দু’বার ইওরোপ ভ্রমণ করেন। ১৯০৪ এবং ১৯১২ সালে। ১৯১২ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অব দি ইউনিভার্সিটিজ অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার-এ যোগ দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেন। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি দেয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কম্পেনিয়ন অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার উপাধি দেন। 

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র যোগ দিলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজে। নতুন এই প্রতিষ্ঠানে রসায়নের গবেষণা এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ভারতে রাসায়নিক শিল্প কারখানা তৈরিতে তাঁর উদ্যোগের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইটহুড দিয়ে সম্মান প্রদান করে ১৯১৯ সালে। তখন থেকে তিনি হলে স্যার পি সি রায়। ১৯২০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর হাত দিয়েই ১৯২৪ সালে গঠিত হয় ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি। তিনি হলেন সোসাইটির প্রথম প্রেসিডেন্ট। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজে কর্মরত ছিলেন। 

যদিও আনুষ্ঠানিক ধর্ম এবং মূর্তিমান ঈশ্বরের প্রতি তেমন কোন ভক্তি কিংবা বিশ্বাস প্রফুল্লচন্দ্রের ছিল না, মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস এবং ভালোবাসা। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই সন্নাসী। দুই সেট সাধারণ ধুতি আর শার্ট, দুটি চাদর, একটি শীতের কোট – এ ছাড়া আর কোন পোশাক তাঁর ছিল না। একটি ছোট্ট খাট, একটি টেবিল, একটি চেয়ার, আর একটি বইভর্তি আলমারি ছাড়া আর কোন আসবাবপত্র তাঁর ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর ১৯২১ সালে তাঁর বয়স যেদিন ষাট পূর্ণ হলো – সেদিন থেকে তিনি তাঁর সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগকে দান করে দিলেন। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে যে বেতন দেবে – সেই বেতন যেন রসায়ন বিভাগের উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হয়। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র তাঁর বেতন বাবত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছেন এক লক্ষ আশি হাজার টাকা। ১৯২২ সালে আরো দশ হাজার টাকা তিনি দান করেন রসায়ন গবেষণার পুরষ্কার দেয়ার জন্য। ১৯৩৬ সালে অবসরের পর আরো দশ হাজার টাকা দান করেন জীববিজ্ঞান গবেষণায় পুরষ্কার দেয়ার জন্য। 

খুবই নিয়মনিষ্ঠ এবং সাদামাটা জীবনযাপন করতেন প্রফুল্লচন্দ্র। ঘরসংসার করেননি। মানুষের জন্যই সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর নিজের যা কিছু ছিল তার সবকিছুই দিয়ে দিয়েছেন গবেষণাগার করার জন্য। নিজে থাকতেন রসায়ন বিভাগের ছোট্ট একটি রুমে। সাদামাটা জীবন আর উচ্চতর চিন্তা – এই ছিল তাঁর জীবনব্রত। 

প্রচন্ড দেশপ্রেমিক ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। ভারতীয় ঐতিহ্যকে কেউ অপমান করছে দেখলে তিনি ফুঁসে উঠতেন। বিজ্ঞানে গবেষণায় প্রাচীন ভারতীয়দের অবদান তিনি খুঁজে বের করেন হাজার হাজার প্রামাণিক পুঁথি ও দলিলদস্তাবেজ ঘেঁটে। অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি রচনা করেছেন দুই খন্ডের হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি। প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে এবং দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। নিজের হাতে চরকা কেটেছেন, মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, জনসংযোগ করেছেন। 

১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহণ করলেও আমৃত্যু অধ্যাপনা চালিয়ে গেছেন। তাঁর শারীরিক স্বাস্থ্য কখনোই তেমন ভালো ছিল না। কিন্তু মনোবল ছিল অটুট। ১৯৪২ সালের পর থেকে তাঁর শরীর খুব বেশি খারাপ হতে থাকে। বিছানা থেকে উঠতেই পারতেন না। ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন তাঁর জীবনাবসান হয়। 

এই ২০২২ সালের ২ আগস্ট এক শ একষট্টি বছর পার হলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। রসায়ন গবেষণায় তিনি যে পথ তৈরি করে গিয়েছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই পথে হাঁটছে, সেই পথ আরো বিস্তৃত হয়েছে। তাঁর স্মরণে প্রতিবছর নানারকম অনুষ্ঠান হয়। আশা করা যায়, শুধুমাত্র অনুষ্ঠানসর্বস্ব হবে না তাঁকে ঘিরে যেসব আয়োজন। সেখানে তাঁর আদর্শকে ধারণ করার, নিস্বার্থভাবে মানুষের জন্য কাজ করার প্রতিজ্ঞাও থাকবে। তাঁর আদর্শকে ধারণ করতে পারলেই হবে তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। 

________________

অধ্যাপক রণজিৎ কুমার মন্ডল সম্পাদিত "প্রফুল্লদর্পণ"- এ প্রকাশিত। জুন ২০২২।









Monday 20 March 2023

চা বাগানে পিকনিক এবং টং-এর চা

 



রেডি হয়ে বসে আছি অনেকক্ষণ থেকে। গুলশানের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি। শামাকে ডেকে তুলেছি আমি বের হলে দরজা বন্ধ করার জন্য। সে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ভ্রু-কুচঁকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ছুটির দিনের আটটা তার কাছে ভোরের সমতুল। ভোরে উঠতে আমার নিজেরও ভালো লাগে না। কিন্তু আমার এখনো জেটল্যাগ চলছে। চট্টগ্রামের আটটা আমার কাছে দুপুর একটা। আমি শামার মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টায় হাসিমুখে মোলায়েমভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “যাবি নাকি আমার সাথে? চা-বাগান দেখে আসবি! অনেক মজা হবে।“

“আমার যাবার দরকার নেই। তুমি বের হও এখন।“ আমার বাক্য শেষ হবার আগেই দাঁত কিড়মিড় করে ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে। “পিকনিকে যাবার জন্য রাত থেকে উঠে বসে আছো। যাচ্ছো না কেন এখনো?”

আমি মোটেও রাত থেকে উঠে বসে থাকিনি। তবে আরেকটু পরে রেডি হলেও ক্ষতি ছিল না। গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সাড়ে আটটায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও কেউই সময় মতো আসবে না। কিন্তু সময়ের ব্যাপারে আমার সামান্য একটু খুতখুতানি আছে। কোথাও যাবার কথা থাকলে ঠিক সময়ে পৌঁছার জন্য ভেতরে এক ধরনের ছটফটানি হয়। কিন্তু যস্মিন দেশে যদাচার। জাপানিরা নাকি সময়ের কয়েক মিনিট আগে চলে আসে। আবার চৈনিকরা নাকি দশটায় কারো সাথে কোন জায়গায় দেখা করার কথা থাকলে – দশটায় ঘর থেকে বের হয়। আবার আফ্রিকানরা নাকি দশটায় দেখা করার কথা থাকলে এগারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠে। এখানে ব্যাপারটা কী রকম তা ঠিক বলা যায় না। আন্তনগর বাস-ট্রেন এখানে ঠিক সময়েই যাত্রা করে। কিন্তু পিকনিকের বাস? কখনোই না।

শামার দিকে তাকালাম। সে পারলে আমাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দরজা বন্ধ করতে পারলে বাঁচে। বাসার আর কাউকে এখন ডাকা যাবে না। শুক্রবার সকালের ঘুম তাদের ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’। আবার দেখা যায় দুপুরেও ঘুমাতে হয় তাদের। আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেই শান্তিতে ঘুমাতে পারে সবাই।  কিন্তু আমি অপেক্ষা করছি গুলশানের ফোনের জন্য। আটটার দিকে তার বাসা থেকে বের হবার সময় আমাকে ফোন করার কথা। গতবার ভাটিয়ারির পিকনিকের সময় গুলশান সবাইকে সাড়ে আটটায় আসার জন্য তাগাদা দিয়ে নিজে এসেছিল পৌনে দশটায়। এবার তাই তাকেই বলেছিলাম বের হয়ে ফোন করতে। কিন্তু তার আটটা ক’টায় বাজবে কে জানে।

“ফিজি দ্বীপপুঞ্জের মানুষ সময়ের ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। তাদের কথা হলো – এত তাড়াহুড়ো করে কী হবে? দু-তিন ঘন্টা দেরিতে পৌঁছালে এমন কোন ক্ষতি নেই।“ দীর্ঘদিন মাস্টারি করলে সারাক্ষণ বকর বকর করে তথ্য বিলি করার বদভ্যাস তৈরি হয়। আমারও হয়েছে। কিন্তু সব শিক্ষার্থীর মতো শামারও পরীক্ষায় আসে না এরকম তথ্যের প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণা আছে। সে মেজাজ হারিয়ে আমাকে ঠেলে বের করে দেয়ার সময়েই ফোন বেজে উঠলো। ফোনের পর্দায় আটটা একচল্লিশ। গুলশানের গলায় উচ্ছ্বাস, “স্যার, অঁনে কন্ডে?”

“এই তো বের হচ্ছি। তোমরা কি চলে এসেছো?”

“আমরাও বের হচ্ছি।“

মনে হলো তাদের আরো সময় লাগবে আসতে। হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যাবে ওয়াসার মোড়। ভালোবাসা গলি শুরু হয়েছে যেখানে সেখানে ফুটপাতে বাজার বসেছে। ফুটপাত বলা ঠিক হচ্ছে না। পথচারীদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই ভালোবাসা গলিতে। ভালোবাসায় যেরকম খানাখন্দ বাঁচিয়ে চলার দায়িত্ব নিজের, এই গলিতেও তাই।

চমৎকার দিন। জানুয়ারির শীত গায়ে লাগছে না একটুও। হালকা একটু কুয়াশার আভাস দেখতে দেখতেই মিলিয়ে গেল। আউটার স্টেডিয়ামের সামনে অন্যান্য দিন কর্মজীবী মানুষের ভীড় থাকে, আজ ফাঁকা।

সার্কিট হাউজের সামনের রাস্তা পার হতে একটুও অপেক্ষা করতে হলো না। দীর্ঘদিন অটোম্যাটিক ট্রাফিক লাইটের শৃঙ্খলে অভ্যস্ত হয়ে যাবার ফলে এখানে রাস্তা পার হওয়াটা একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আজ সেই সমস্যায় পড়তে হলো না দেখে বেশ হালকা লাগলো।

ভি-আই-পি টাওয়ারের দিকে চোখ গেল। বাংলাদেশের শহরগুলির সম্প্রসারণ এখন উর্ধ্বমুখি। আমেরিকার শহরগুলির মতো আকাশ ছুঁয়ে না ফেললেও আমরা মোটামুটি আমাদের আকাশ আড়াল করে ফেলেছি কংক্রিটের জঞ্জাল দিয়ে। আমাদের ইকবাল এখন টাওয়ারসূত্রে ভিআইপি। আজ তার সাথে দেখা হবে কি না জানি না। গতকাল গুলশান বলেছিল – এবার অনেকেরই অনেক কাজ পড়ে গেছে।

সবার এতসব ব্যক্তিগত কাজের পরেও পিকনিকের মতো দলগত অকাজ করার উৎসাহ ও শক্তি যে এদের এখনো আছে সেটা দেখেই আমি অবাক এবং উৎসাহিত হই। তারুণ্য অনেকটা চৌম্বকীয় আবেশের মতো কাজ করে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই তরুণদের সংস্পর্শে এলে আমার মতো বুড়োর মনেও তারুণ্য সঞ্চালিত হয়।

পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সেই স্কুলে থাকতেই শিখেছি ক্ষমতা কাকে বলে। কাজের পরিমাণকে সময়ের পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে ক্ষমতার হিসেব করা হয়। সে হিসেবে এরা এত কম সময়ে এত বেশি কাজ করে ফেলেছে যে এদের ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। আজকের পিকনিকের দিনতারিখ অনেকদিন আগে ঠিক হলেও তারা কেনাকাটা করেছে গতকাল বিকেলে। এব্যাপারে গুলশান একাই একশ। পরে শুনেছি রুনুও গিয়েছিল গুলশানের সাথে, কিন্তু ব্যাগ বহন করা ছাড়া আর কোন কাজ করেছে বলে মনে হয় না। কারণ তার কানাডায় বাজার করার অভিজ্ঞতা চট্টগ্রামের বাজারে কোন কাজে লাগবে বলে মনে হয় না।

আলমাস সিনেমার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। আমার কৈশোর-তারুণ্যে সিনেমাদেখার দিনগুলিতে কত সিনেমা যে দেখেছি এই হলে। একসময়ের অভিজাত এই হল এখন মৃত। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথার ভেতর। প্রায়-ফাঁকা রাস্তা শিথিল পায়ে পার হয়ে গেলাম অন্যপাড়ে। বহুতল ভবনের কাজ চলছে এদিকে। নির্মাণসামগ্রী পড়ে আছে ফুটপাত জুড়ে। জংধরা লোহার শিক সুঁচালো বর্শার মতো মাথা উঁচিয়ে আছে। একটু অসাবধান হলেই বিধবে যে কারো যে কোনো জায়গায়, যার দায়িত্ব কেউ নেবে না।

সিটি কর্পোরেশন কোনো এক সময় যাত্রীছাউনি বানিয়েছিল এখানে ফুটপাত ঘেঁষে। এখন সেখানে অস্থায়ী চায়ের দোকান। বন্ধ দোকানের ছাউনি থেকে ঝুলছে ময়লা কার্ডবোর্ডে লেখা “বেলেক কপি ১০ টাকা, দুত কপি ২০ টাকা”। কফি সংস্কৃতি খুব জনপ্রিয় হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য এই সংস্কৃতিরও প্রকারভেদ আছে। মূল প্রভেদ অর্থমূল্যে। কাল সন্ধ্যায় গুলশান যে কফি খাইয়েছে তার সাথে এই “দূত কপি”র পার্থক্য পনেরো গুণ।

পিকনিকের আয়োজনে আমি কোন কাজে লাগতে পারি কি না, ভদ্রতার খাতিরে জানতে চেয়েছিলাম গতকাল। গুলশান ততোধিক ভদ্রভাবে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দিয়েছিল - আমাকে তাদের কোন কাজে লাগবে না। তবে আমি চাইলে কফি খেতে যেতে পারি। অকর্মাকে কফি খাওয়ানোটাও নেট লস জানার পরেও গুলশান ভদ্রতার খাতিরে প্রস্তাবটা দিয়েছিল। মনে মনে নিশ্চয় আশা করেছিল – আমি ‘সময় নেই’ বলবো। কিন্তু বাংলাদেশে আমার আর যাই হোক, সময়ের অভাব নেই।

আমি ড্যাং ড্যাং করে চলে গিয়েছিলাম কফি খেতে। চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় জ্যাম, ভীড় আর উপচে পড়া মানুষের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে। কাউকেই চিনি না, অথচ মনে হয় কতদিনের চেনা।

চট্টগ্রাম শহরে এখন কফিশপের অভাব নেই। বাহারি তাদের নাম, ভারী ভারী মেন্যু, আর আকাশছোঁয়া দাম। ডলারে কনভার্ট করলে অস্ট্রেলিয়া কিংবা কানাডার চেয়েও বেশি কিছু কিছুর দাম। গৌরী গৌরী সেন গুলশানের সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে পারলে কেকপেস্ট্রি চা কফি সব একসাথে অর্ডার দেয়। এখানে কফির সাথে বিস্কুট ফ্রি!


কফি আড্ডা

দুর্গার মতো দশটি হাত না থাকলেও দুই হাতে দশ হাতের কাজ সামলাতে দেখলাম গুলশানকে। একটু পরপর ফোন আসছে তার। নিজেও করছে একে ওকে। কান আর কাঁধের মাঝখানে ফোন চেপে কথা বলতে বলতে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। এরই মধ্যে জিজ্ঞেস করছে আমার কুশল। দেশে আসার পর এই প্রথম দেখা তাদের সাথে।

“স্যার, শুটকি খাবেন?”

“কফির সাথে শুটকি? এখানে পাওয়া যায়? তাইলে খাওয়া যায়।“ – আমি নির্লজ্জ পেটুকের মতো বলে ফেলি। রুনু শব্দ করে হেসে ওঠে। গুলশান বিরক্তি চেপে বলে, “এখন না। কালকের কথা বলছি। মেন্যুতে কি শুটকি রাখবো?”


জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদের সাইড গেটের সামনে পিকনিকের বাস দেখা যাচ্ছে। কোট পরা একজন হন্তদন্ত হয়ে বাসের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পেছন থেকে জাভেদের মতো লাগছে। এরা তো দেখি আজ ঠিক সময়েই চলে এসেছে! আমিই তো মনে হচ্ছে দেরি করে এলাম! মহাভারতের অর্জুন লক্ষ্যভেদ করার জন্য যেরকম একাগ্রমনে মাছের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, ঠিক সেরকম না হলেও, বেশ খানিকটা সেরকমভাবে আমিও বাসের দিকে নজর দিয়ে এগুচ্ছি। বাসের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম যাকে এতক্ষণ জাভেদ ভেবেছিলাম তাকে আমি আগে কোনদিন দেখিনি। বাসের ভেতরে আশেপাশে যারা আছে তাদের কাউকেই আমি চিনি না। লক্ষ্য ভুল ছিল।

এতক্ষণে কানে এলো ওপারের ডাক - “এদিকে, এদিকে স্যার, এদিকে, টার্ন ব্যাক স্যার।“

মুন যে গলায় “টার্ন ব্যাক” বললো – কাছের ল্যাম্পপোস্টে বসা কাক গেলো উড়ে, রাস্তায় চলমান গাড়ির গতি গেলো কমে। সে যে শাহীন কলেজের ভূতপূর্ব প্রিফেক্ট তা তার গলার জোরেই বোঝা যায়।

রাস্তার অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আছে বাস, আর তার সামনে জুয়েলভাই, গুলশান, রুনু, আর মুন। আমাকে নাকি অনেকক্ষণ থেকে ডাকাডাকি করছে তারা। একটু লজ্জা পেলাম।

“কোন্‌ জগতে থাকেন স্যার? ডাকাডাকি শুনতে পান না?”

ডাক শুনতে পাই না – আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন নয়। তাই গুলশানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানলাম। “আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অনেক দেরি করে আসবে আজ। এখন তো দেখি সবার আগে চলে এসেছো। এই নাহলে ক্যাপ্টেন?”

“গুলশান আপুকে তো আমি নিয়ে এসেছি স্যার। ছোটাপু ক্যা ক্যা করছিল – সবাই চলে আসবে, দেরি করা যাবে না। তাই ছোটাপুকে নিয়ে গুলশান আপুর বাসায় গেলাম। তারপর রাস্তা ফ্রি ছিল, এক টানে চলে এসেছি।“ – মুনের কথা শুনতে শুনতে চোখ গেলো তার গাড়ির দিকে। মুন পিকনিকে যাচ্ছে না, কিন্তু রুনু তাকে যতটা পারে খাটিয়ে নিচ্ছে। এরকম করিৎকর্মা ছোটভাই থাকলে আপুদের অনেক সুবিধা।

মুনের বাসায় (বাম থেকে - জাভেদ, গুলশান, রুনু, হারুন, প্রদীপ, লায়লা)

 

দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর মুনের সাথে দেখা হয়েছে গত সন্ধ্যায়। প্রাক-পিকনিক প্রস্তুতি মিটিং করার উদ্দেশ্যে কফি শেষে হাঁটতে হাঁটতে মুনের বাসায় গিয়েছিলাম সবাই মিলে। কফিশপ থেকে কাছেই। এত্তোগুলি বছর পর দেখা হলেও মনেই হলো না যে তার এসএসসি পরীক্ষার পর আর দেখা হয়নি কোনদিন। ধন্যবাদ ফেসবুক। ইতোমধ্যে সে  বিরাট কোম্পানির বিরাট অফিসার হয়েছে। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে রুম্পা আর মুনের সুখের সংসার দেখে খুব ভালো লাগলো। একটু পরে সুমন, জাভেদ-লায়লা, হারুনও এসেছিল তাদের বাসায়। সবাই যার যার কর্মক্ষেত্রে সফল কর্মবীর। রুম্পা নিজেও অফিস থেকে ফিরেছে একটু আগে। অথচ দশ মিনিটের মধ্যেই বিশাল ডাইনিং টেবিল ভর্তি করে ফেললো হরেক রকমের খাবার দিয়ে। আমি জানি না কোন্‌ জাদুবলে এরা এতসব আয়োজন করে ফেলে এত কম সময়ে। হৈচৈ গল্প আর প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করতে করতে দেখলাম গুলশান হারুন-জাভেদ-সুমনের সাথে তার দরকারি কথা সেরে নিচ্ছে। এরপর তারা আবার শপিং-এ গেলো র‍্যাফেল ড্র’র পুরষ্কার কিনতে। নয়টা-পাঁচটা কাজ করে বাসায় আসার পর আমার আর নড়াচড়া করতেও ইচ্ছে করে না, অথচ এরা সবাই সারাদিন অফিস করে আসার পরও উদ্যমে ভরপুর। 

জুয়েলভাইয়ের সাথে তিন বছর পর আজ প্রথম দেখা। কিন্তু মনেই হয় না এই তিন বছরে তার কোন পরিবর্তন হয়েছে। কাঁচাপাকা চুলদাড়িগোঁফের আধুনিক কবির মতো লাগে তাকে। শাহীনের ছাত্রী বিয়ে করে নিজেই শাহীন হয়ে গেছেন। গুলশান যথারীতি ফোন করে ডাকতে শুরু করেছে সবাইকে। মনে হচ্ছে ঘুম থেকে ডেকে তুলছে সবাইকে। 

চঞ্চল এসেই চঞ্চল হয়ে সেলফি তুলতে শুরু করলো। ইদানীং সে গানের ভিডিও করছে খুব। বিভিন্ন জনপ্রিয় গানের সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছে আর ফেসবুকে আপলোড করছে। সম্ভবত সে ইতোমধ্যে অনেক জনপ্রিয় হয়ে গেছে। কথা বলার সময় তার গলার স্বাভাবিক স্বর বদলে যায়। খুব সহজ এলেবেলে ব্যাপারকেও যে গুরুগম্ভীর করে তুলতে পারে। জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছো চঞ্চল?”

“ঠিক আছি স্যার, তবে একটু ব্যস্ত আছি। প্রতি সপ্তাহে পাঁচ-ছটা প্রোগ্রাম অ্যাটেন্ড করতে হয়। বন্ধুরা ছাড়তে চায় না। অফিস আছে, বউ-বাচ্চা আছে –তার উপর মিউজিক ভিডিও বানাতে হয়, লিপ দিতে হয়। সব ম্যানেজ করে মাঝে মাঝে দিনে দুই-তিনটা দাওয়াতেও যেতে হয়। “

“দিনে দুই তিনটা দাওয়াত? কীভাবে?”

“স্কিলের ব্যাপার স্যার। স্কিল লাগে। আমি ম্যানেজ করে ফেলি। এক কমিউনিটি সেন্টারে একটা মারার পর আরেক জায়গায় গিয়ে আরেকটা মেরে দিই।“

“মেরে দাও মানে?”

“মেরে দেই মানে, খেয়ে ফেলি আর কী।“ কথা বলতে বলতেই অনবরত সেল্‌ফি তুলছে চঞ্চল। তার সেল্‌ফি স্টিকের গতি সর্বত্র – বাসের সামনে, পেছনে, সাইডে, মুনের গাড়িতে হেলান দিয়ে। সব ছবিতে একই রকম না লাগার জন্য সে একাধিক শার্ট-টি শার্ট সাথে রাখে। দেখলাম তার গাঢ় কমলা রঙের টিশার্টে ঝুলছে দুইটি রোদচশমা – কখন কোন্‌টা পরবে সেটা সে কীভাবে ঠিক করে জানি না।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে নাসির, আখতার, স্বপ্না, কাইয়ুম, মোজাম্মেল, সুমন, সাঁজলি সবাই এসে পড়লো। বাসে উঠার আগেই সবার সাথে হৈচৈ করে আনন্দ প্রকাশ করা হলো। ইভা আসার পর আরেক প্রস্থ হৈ চৈ হলো। শাহীন কলেজে থাকতে ইভা যেরকম জনপ্রিয় ছিল, এত বছর পরেও সমান জনপ্রিয়। বায়েজিদ বোস্তামি থেকে উঠলো মনির। বালুচরা থেকে উঠলো রাসেল।

অনেকদিন পর পুরনো বন্ধুর দেখা হলে যা হয়, অনেক স্মৃতিচারণ, হাসিঠাট্টা খুনসুটি। মনে হলো অনেক বছর অতীতে– শাহীনের সেই দিনগুলিতে  ফিরে গেলাম। শহর থেকে এয়ারফোর্সের বাসে আসা-যাওয়ার সময়ের কত স্মৃতি, কলেজের করিডোর, টিচার্স রুম – কত শত কথা হতো আমাদের। গুলশানদের ধন্যবাদ দিতেই হয়। তারা না ডাকলে হয়তো দেখাই হতো না কারো সাথে।

হাটহাজারি রোড – অত্যন্ত পরিচিত স্মৃতিজাগানিয়া রোড। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটাই কেটেছে এই রাস্তায় আসা-যাওয়ায়। এখন বদলে গেছে পথের দু’ধার। মানুষ, বিল্ডিং, ব্যবসা, গাড়ি, জ্যাম, আমাদের বয়স - সবই বেড়েছে। কিন্তু রাস্তার প্রস্থ বাড়েনি। অনেক বছর পর পরিচিত পথ ধরে যাওয়া মানেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসা।

শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয় আমাদের গন্তব্য - উদালিয়া চা বাগান। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। নাজিরহাট-ফটিকছড়ি মেইন রোড থেকে পুবদিকে ছোট্ট একটা রাস্তা ধরে যেতে হয়। উন্নয়নের জোয়ার এখানেও পৌঁছে গেছে। ছোট্ট রাস্তার দুপাশেও গড়ে উঠেছে দোকানের পর দোকান। এই অঞ্চলটা চট্টগ্রামের বিদেশপাড়া নামে পরিচিত আমাদের কাছে। বাংলাদেশের মানুষ যখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া শুরু করেছিল, তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যমুখী হয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষ। ফলে অনেক পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ফিরেছে। তার নিদর্শন এদিকে সর্বত্র। তবে এদিকে যে এত সুন্দর চা বাগান আছে তা কেন যেন শুনিওনি এতদিন।

উদালিয়া চা-বাগান শুরু হয়েছে যেখান থেকে সেখানে স্কুলের মাঠে বাস পার্ক করে নামলাম সবাই। আরো একটি পিকনিক-পার্টি ইতোমধ্যেই এসে জড়ো হয়েছে মাঠের এক কোণায়। মাঠের বিপরীত কোণায় চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলো। বাংলোর দারোয়ান গেট খুলে দিলেন আমাদের দেখে। এলোমেলো ইট বিছানো রাস্তা পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে। খুব গোছানো বলা যাবে না। তবে বাংলোর আয়তন এবং সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে এখনো রাজকীয়। একসময় চা-বাগানের ম্যানেজাররা চা-সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন। সম্ভবত এখনো আছেন।

চঞ্চল অস্থিরভাবে সেলফি তুলে চলেছে, পথের সাথে, গাছের সাথে, ফুলের সাথে এবং অবশ্যই মানুষের সাথে। ফ্রেশ হবার জন্য সবাই ম্যানেজারের বাংলোয় ঢুকে গেলো। বাংলোর প্রশস্ত বারান্দার সামনে সুন্দর লন। অনেকরকম ফুলের গাছ সেখানে। বোঝা যাচ্ছে ম্যানেজারের মালির সংখ্যাও অনেক।

“স্যার, আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি।“ – পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রাসেল বললো। এই গরমেও সে দাবার বোর্ডের মতো বড় বড় চেকের স্যুট পরে আছে।

“অবশ্যই রাসেল। নিশ্চয়ই। তুমি তো এক কথার মানুষ, কথা বললে সেই কথা রাখার ব্যাপারে তুমি এক নম্বর। এবার বলো কোন্‌ কথা।“

“সেই যে স্যার, ভাটিয়ারি থেকে আসার সময় বলেছিলাম – বিয়ে করবো। বিয়ে করেছি স্যার।“ – রাসেলের আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখে মনে হলো বিয়ে করেছে বেশিদিন হয়নি,  এখনো ঘোরের মধ্যে আছে।

“এবার স্যার আপনি একটা বিয়ে করে ফেলেন।“ রাসেল একেবারে কানের কাছে নিশ্বাস ফেলে বললো। চঞ্চল ছিল কাছে। সে সেল্‌ফি স্টিক আকাশে তুলে নিজের মুখ স্ক্রিনে ফিট করতে করতে বললো  – “রাসেল তার বিয়ের দাওয়াত এখনো খাওয়ানি স্যার।“

একটা দাওয়াত মিস হয়ে যাওয়াতে চঞ্চলের কী কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে পারছি।

ম্যানেজারের বাংলোর আশেপাশে অনেক জায়গা। বিশাল এক বরই গাছে অনেক বরই ধরেছে। পাহাড় থেকে একটু নিচে বেশ বড় পুকুর। তার অন্যপাশে আগাছাভর্তি জংলা। বেশি কিছু মুরগীর ছানা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মায়ের পিছু পিছু।

গুলশান একজন হাফপ্যান্ট-টিশার্ট পরা যুবকের সাথে কথা বলছে। কাছে যেতেই পরিচয় করিয়ে দিলো - এই বাগানের ডেপুটি ম্যানেজার, শাহীন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। বললো, শুক্রবারেও তাদের পালাক্রমে ডিউটি করতে হয়।


আমলকি গাছে চার শাখামৃগ


বাংলোর একপাশের কাঠের গেট খুলে গেলাম পুকুরের দিকে। এখানে সম্ভবত অনেক মাছ আছে। বড়শি পেতে মাছ ধরার ব্যবস্থাও আছে দেখলাম। পুকুরপাড়ে বরই গাছ, জলপাই গাছ, আর আমলকি গাছ – ঝুঁকে আছে পানির দিকে। কিছু আমলকি এখনো অবশিষ্ট আছে। বেশ কয়েকটি বড় বড় কামরাঙা গাছ পুকুরপাড়ের লাগোয়া বাগানে। থোকা থোকা কামরাঙা ঝুলে আছে হাতের নাগালের বাইরে। সুমন লাফ-ঝাপ দিয়ে ডাল ধরে টেনে ঝাঁকিয়ে অনেকগুলি পাকা কামরাঙা পেড়ে ফেললো। ফলগুলি এত নরম – গাছ থেকে মাটিতে পড়েই কেমন যেন চ্যাপ্টা হয়ে যায়। এদেরকে ‘কামরাঙা’ নাম কেন দেয়া হয়েছে জানি না। কামনার কি রঙ হয়? পানিতে ঝুঁকে পড়া আমলকি গাছে তরতর করে উঠে গেলো সুমন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় তার যে ওজন ছিল – এখনো সেই ওজনই আছে। তার ভরে গাছের কিছুই হলো না। সে শাখামৃগের মতো দাপাদাপি করতে করতে আমলকি পাড়তে লাগলো। গাছে ওঠার লোভ সামাল দেয়া মুশকিল। শৈশব কৈশোরের দিনগুলি যেন ফিরে ফিরে আসছে। গাছে উঠে গেলাম। গাছ ভেঙে পড়ার ভয়ে সুমন কিছুটা আঁৎকে উঠলেও তেমন কিছু বললো না। কিন্তু গুলশানও যখন গাছে উঠে গেলো – তখন আমারও ভয় লাগছিলো যদি গাছ গোড়াসহ থুপড়ে পড়ে পানিতে! পানি কি খুব ঠান্ডা!

“অ্যাই রুনু, খবরদার তুই উঠিস না গাছে।“ – সুমনের নিষেধ রুনুর কানে গেল বলে মনে হলো না। রুনুও উঠে দাঁড়ালো আমলকি গাছের উপর। আর যায় কোথায়। পাড়ে দাঁড়ানো পাঁচ ছ’টা ক্যামেরা ছবি তুলতে শুরু করলো আমলকি বৃক্ষে নৃত্যরত শাখামৃগদের।

চঞ্চল তো আছেই, সাথে সাঁজলি। মাওয়াহেবের নাম যে সাঁজলি সেটা আমি জানতাম না। সাঁজলি শুনে ভেবেছিলাম মেয়েদের নাম। সাঁজলির ছবি তোলার হাত ভালো। সে কয়েকটা ছবি দেখালো – বেশ নতুন নতুন অ্যাঙ্গেলে তোলা।

পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে এসে বাংলোর গেট পার হয়ে রাস্তায় এলাম। বাগানের বাইরে ইট বিছানো ছোট্ট রাস্তা ধরে কিছুদূর হেঁটে এসে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। এধরনের দোকানগুলিকে বলা হয় – টং-এর দোকান। চায়ের তৃষ্ণা জাগলো সবার। গুলশান  টং-এর দোকানের চা খাওয়াবে বলেছিল – সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে ভোলেনি। সকালে গাড়িতেই হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়েছি সবাই। চা খাওয়া হয়নি তখন।

টং-এর চা

দোকানের ভেতরে বাইরে চেয়ার পেতে বসলাম সবাই। গরম পিঁয়াজু, কলা, চা – আর পরিবেশ সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগার একটা অনুভূতি। এই অনুভূতি শহরের চাকচিক্যময় আলোঝলসিত অভিজাত রেস্তোরাতেও পাই না অনেক সময়। স্বাদ নয়, সামগ্রী নয় – এই অনুভূতি জন্মে নস্টালজিয়া থেকে। যেসব দিন আমরা ফেলে আসি, সেইসব দিনগুলির কাছাকাছি কোনকিছু পেলে কী যে ভালো লাগে।

হাঁটতে হাঁটতে চা-বাগানে ঢুকলাম এবার। নাসির এই চা-বাগান সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। টিলা ও সমতল মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার একর জায়গাজুড়ে এই বাগান। রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ হাঁটলাম। কেমন যেন নির্জন এলাকা। রাস্তায় ধুলো আছে, কিছুটা রুক্ষতাও। কিন্তু দৃষ্টি রাস্তা পেরিয়ে বাগানের দিকে নিলেই ঘন সবুজে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবাই মিলে কিছু ছবি তোলা হলো। এখানে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু ডাক পড়লো।


(বাম থেকে) আখতার, প্রদীপ, চঞ্চল, রুনু, নাসির


দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে জাভেদ-লায়লা, আর হারুন। তাদের ক্ষমতা দেখে আমি মুগ্ধ। গুলশানের কাছে শুনলাম কাল গভীর রাতে খাবারের মেন্যু ঠিক করে তা আজ সকালের মধ্যে রান্না করে দুপুরে সোজা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে তারা যেন আমরা সদ্য তৈরি গরম খাবার খেতে পারি। চিকেন, মাটন, শুটকি আর সীমের বিচি – এ স্বাদের নেই কোন তুলনা। রান্না কে করেছে জানি না – হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় বলা যায় – তাঁর হাত সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া উচিত। সবাই মিলে একসাথে বসে খাওয়ার মধ্যেও খাদ্যের স্বাদ এবং আনন্দ বেড়ে যায় বহুগুণ। যারা এত কম সময়ে এরকম আয়োজন করতে পারে – বড় বড় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তাদের জন্য কিছুই না।


(বাম থেকে) স্বপ্না, ইভা, প্রদীপ, রুনু, গুলশান, সাজলি


আনন্দের ঘড়ি জোরে চলে। মিউজিক্যাল চেয়ারের নিজস্ব সংস্করণ – বালিশ খেলা হলো। অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বলা চলে জ্যাকেট খেলা হলো। একজনের একটা জ্যাকেট দলা পাকিয়ে সেটাকেই মিউজিকের সাথে বালিশের মতো ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়া। কোন কোন ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় এই খেলাকে শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়। কিন্তু আমরা জেন্ডার ইক্যুয়েলিটি বিশ্বাস করি। খেলায় জিতলো আখতার। স্বপ্না, মোজাম্মেল, ও কাইয়ুমের ছেলে-মেয়েদের সাথে শিশুতোষ এই খেলা খেলতে গিয়ে সবাই যেভাবে শিশু হয়ে উঠেছিল – দেখে ভীষণ ভালো লাগলো। আমাদের ভেতরের শিশুটা যদি গম্ভীরভাবে বড় হয়ে যায়, জীবন থেকে আমাদের আনন্দ চলে যায়। এরা সবাই বয়সভুলে এখনো যেভাবে একজন আরেকজনের পেছনে লাগে নির্মল হাসিঠাট্টায়, একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়ায় যখন দরকার পড়ে – তা অমূল্য।

সন্ধ্যা নামতেই বাস ছাড়লো। র‍্যাফেল ড্র’র ব্যবস্থাও করেছে তারা। সাধারণত র‍্যাফেল ড্রর টিকেট বিক্রি করার পর লটারি হয়। এরা কোন টিকেট বিক্রি করেনি। বিনামূল্যেই টিকেট দিলো প্রত্যেককে একটি করে। দুটো এক্সট্রা টিকেট ছিল। জাভেদ সে দুটোর একটি আমাকে দিয়ে বললো – ওটা ম্যাডামের – অর্থাৎ ইভার। অন্যটি ইভাকে দিয়ে বললো ওটা আমার। তার মানে আমার টিকেটে যদি পুরষ্কার ওঠে, ওটা ইভা পাবে। আর ইভার যদি ওঠে ওটা আমি পাবো। গতকাল অনেক রাতে বের হয়ে গুলশানরা পুরষ্কারগুলি কিনেছে, রাতজেগে র‍্যাপিং করেছে। শুধুমাত্র আনন্দের খাতিরেই এরা এত কাজ হাত পেতে নেয়।


সাজলির নির্দেশে লাইন

ইউনিভার্সিটির এক নম্বর  গেটের কাছে নতুন একটি কমিউনিটি সেন্টার হয়েছে। বাস থামানো হলো এখানে। আজ কোন অনুষ্ঠানে নেই। কমিউনিটি সেন্টার বন্ধ। তার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ইচ্ছে হলো সাঁজলির। সাঁজলি ছবি তোলার সময় অনেক খুঁতখুঁত করে – একটু ডানে কাত হও, মাথা সোজা করো, সামনে আসো, পেছনে যাও! অবশ্য এসব না করলে ভালো ছবি ওঠে না। সাঁজলির ছবি ভালো হবার এটাও একটি কারণ। এবার সাঁজলি সবাইকে কমিউনিটি সেন্টারের সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে দিলো। সবাই একসাথে দাঁড়ালে কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু তার কথা হলো এক সিঁড়িতে শুধু একজন দাঁড়াতে পারবে। শাহীন কলেজের অ্যাসেম্বলির মতো একজনের পেছনে একজন করে দাঁড়াতে হবে। ইভা নিচের সিঁড়িতে ক্যামেরার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে প্রায় টেনে উপরে তুলে ফেললাম। সিঁড়ির সবচেয়ে উপরের ধাপে উঠতে উঠতে হাঁটু ব্যথা হয়ে গেল। এবার সাঁজলির ক্যামেরা এতদূর দেখতে পেলেই হয়। অবশ্য আশেপাশে ইভা থাকলে ক্যামেরা তাকে মিস করবে না এ ব্যাপারে নিশ্চিত।

এখানে একটি টং-দোকান আছে – যেখানে ‘রং ছা’ ‘ধুত ছা’ আর ‘ধুত কপি’ পাওয়া যায়। সবার জন্যই চা-কফির ব্যবস্থা হয়ে গেলো। রঙ-চা পাওয়া যায় কি না জিজ্ঞেস করতেই দ্রুত রঙ চা তৈরি হয়ে গেল, সাথে লেবু। কে কী করছে তা আলাদাভাবে দেখাও যাচ্ছে না, অথচ সবাই কী এক আশ্চর্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর। এই প্রাণশক্তির উৎসের নাম বন্ধুত্ব। এদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব ঈর্ষণীয়। কলেজ ছাড়ার আটাশ বছর পরও কলেজের বন্ধুদের এক হয়ে থাকা সহজ কথা নয়।

ওরা তো বন্ধু সবাই। কিন্তু আমি? কিছুদিন তাদের ক্লাস নিয়েছিলাম শুধু – এর বাইরে আর কিছুই করিনি তাদের জন্য। আটাশ বছরের মধ্যে চব্বিশ বছর আমি দেশের বাইরে। ঠিকমতো যোগাযোগও রাখা হয় না কারো সাথে। তারপরও তারা কীভাবে যেন আমাকে মনে রেখেছে। শাহীন কলেজে আমার এক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী বলতেন, কষ্ট না দিলে কেউ কাউকে মনে রাখে না। এদেরকে আমি কত কষ্ট দিয়েছিলাম কে জানে। 


Saturday 11 March 2023

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন: উড়ন্ত গবেষণাগার

 




মহাবিশ্বের রহস্য ভেদ করার জন্য মানুষ মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো শুরু করেছে আজ থেকে প্রায় ৬৫ বছর আগে। ১৯৫৭ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন  সফলভাবে মহাকাশে প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ পাঠাতে সক্ষম হয়। তারপর মহাবিশ্বের গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকে একের পর এক। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মহাকাশ  সংস্থা নাসা। এক নতুন যুগের সূচনা হয় মহাকাশে। পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে আধুনিক থেকে আধুনিকতর স্যাটেলাইট। বর্তমানে পৃথিবীর বাইরে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য স্যাটেলাইট। এই স্যাটেলাইটগুলিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় – বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট ও ব্যবহারিক স্যাটেলাইট। বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইটগুলি মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন জ্ঞানের সন্ধান দিচ্ছে আর ব্যবহারিক স্যাটেলাইটগুলি ক্রমশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। পৃথিবী থেকে মানুষ এ পর্যন্ত যতগুলি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্যাটেলাইট হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন – যাকে বলা যায় মহাকাশের উড়ন্ত গবেষণাগার যা গত চব্বিশ বছর ধরে পৃথিবী থেকে চারশ কিলোমিটার দূরে থেকে দেড় ঘন্টায় একবার করে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসছে ঘন্টায় প্রায় আটাশ হাজার কিলোমিটার বেগে। রাতের বেলা পৃথিবীর আকাশে এই স্টেশন উজ্জ্বলভাবে দেখা যায়। খালি চোখেই দেখা যায়। এই স্টেশন একদিনে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তা পৃথিবী থেকে চাঁদে গিয়ে আবার ফিরে আসার দূরত্বের সমান।

সাধারণ স্যাটেলাইটের সাথে মহাকাশ স্টেশনের পার্থক্য আছে। সাধারণ স্যাটেলাইটগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন নির্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে মহাকাশে নির্দিষ্ট গতিতে এবং গতিপথে ঘুরতে ঘুরতে পূর্বনির্ধারিত কাজগুলি সম্পন্ন করতে পারে। তাদের মূল নিয়ন্ত্রণ থাকে পৃথিবীতে অবস্থিত নিয়ন্ত্রণকক্ষে। এই স্যাটেলাইটগুলিতে কোন মানুষ থাকে না। কিন্তু মহাকাশ স্টেশনের মূল উদ্দেশ্যই হলো সেখানে মানুষের যাতায়াত থাকবে। এই স্টেশনগুলিকে পৃথিবী থেকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তেমনি স্টেশনে থেকে নভোচারীরাও অনেক কিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন সরাসরি। মহাকাশ স্টেশনগুলি সীমিত পরিসরে ভাসমান বিমানবন্দরের মতো কাজ করে যে বন্দরে পৃথিবী থেকে পাঠানো নভোযান ভিড়তে পারে।

মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে প্রথম সাফল্য দেখিয়েছে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই ১৯৭১ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘স্যালিউট’ প্রকল্পের আওতায় ১৯৭১ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে ছয়টি মহাকাশ স্টেশন মহাকাশে পাঠায়। সোভিয়েত স্যালিউট-১ ছিলো পৃথিবীর প্রথম মহাকাশ স্টেশন যে স্যাটেলাইটে মানুষ পাঠানো হয় মহাকাশে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ছয়টি মহাকাশ স্টেশনের মধ্যে তিনটি ছিল বেসামরিক এবং বাকি তিনটি ছিল সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য। সামরিক মহাকাশ স্টেশনগুলিকে বলা হতো ‘আলমাজ’ স্টেশন। সোভিয়েত ইউনিয়নের রকেট ‘সয়ুজ’ তাদের মহাকাশ স্টেশনগুলিকে কক্ষপথে পাঠায়।

এদিকে আমেরিকানরাও তাদের প্রথম মহাকাশ স্টেশন ‘স্কাইল্যাব’ তৈরি করে ফেলে। ১৯৭৩ সালে মহাকাশে পাঠানো হয় স্কাইল্যাব। স্কাইল্যাব-২, ৩, এবং ৪ এর মাধ্যমে তিন জন করে মোট নয়জন নভোচারী পর্যায়ক্রমে এই মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান এবং গবেষণা করেছেন। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কর্মক্ষম ছিল স্কাইল্যাব।

স্কাইল্যাবের কার্যকারিতা শেষ হয়ে যাবার পর মহাকাশ স্টেশনের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠায় আরো আধুনিক মহাকাশ স্টেশন ‘মির’। পৃথিবীর কক্ষপথের একটু নিচে (লো আর্থ অরবিট) কক্ষপথ নির্ধারিত হয় মিরের। পরবর্তী দশ বছর ধরে ধাপে ধাপে অনেকগুলি কারিগরি মডিউল যোগ হয় মির মহাকাশ স্টেশনে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত মহাকাশে থেকে মহাকাশ গবেষণায় দোর্দন্ড প্রতাপে কাজ করেছে মির।

আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ স্টেশনের চেয়েও বড় এবং বেশি কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন মহাকাশ স্টেশন তৈরি করার এক মহাপ্রকল্প গ্রহণ করে। ১৯৮৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এই প্রকল্প ‘ফ্রিডম’-এর ঘোষণা দিয়ে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে আমেরিকার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা যে অনেক বেশি তা প্রমাণ করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। কিন্তু পরে এই প্রকল্পের খরচ এত বেশি বেড়ে যায় যে আমেরিকার পক্ষে আর তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। খরচ মেটানোর জন্য আমেরিকা ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মাধ্যমে ইওরোপ এবং জাপানের স্পেস প্রকল্পকে আমেরিকার সাথে যোগ দিয়ে একযোগে ফ্রিডম প্রকল্পে কাজ করার আহ্বান জানায়।

স্যাটেলাইট যুগের প্রথম কয়েক দশকজুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চললেও আশির দশক থেকে মহাকাশ গবেষণায় আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা প্রাধান্য পেতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাকাশে একটি সমন্বিত আন্তর্জাতিক  স্টেশন স্থাপন করার উপযোগিতার ব্যাপারে উন্নত দেশের রাষ্ট্রনেতাদের বোঝাতে সক্ষম হন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে আমেরিকা রাশিয়ার সাথেও মহাকাশ স্টেশন প্রকল্পে সহযোগিতার আহ্বান করে। ফলে ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল-গোর এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর চেরনোমিরডিন এ ব্যাপারে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরির কাজ শুরু হয়। আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, কানাডা, এবং ইওরোপের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার ফসল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।

মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে সময় লেগেছে বেশ কয়েক বছর। স্টেশন তৈরি করা হয়েছে ধাপে ধাপে। বিভিন্ন কাঠামো নিয়ে যাওয়া হয়েছে একের পর এক, এবং পরে জোড়া দেয়া হয়েছে কক্ষপথে স্থাপনের পর। ভারী কাঠামো নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে নাসার স্পেস শাটল। কিছু কিছু অংশ রকেটের মাধ্যমেও পাঠানো হয়েছে। সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছে বৈদ্যুতিক জ্বালানি সংগ্রহের জন্য। ১৯৯৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে সমন্বিত হয়েছে এর অনেকগুলি অংশ। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পের প্রয়োজনে সংযুক্ত হয়েছে নতুন নতুন যন্ত্রাংশ এবং পরিকাঠামো।

১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর রাশিয়ার ‘প্রোটন’ রকেটের মাধ্যমে প্রথম মডিউল ‘রাশিয়া জারিয়া’ কক্ষপথে পাঠানো হয়। এর দু’সপ্তাহ পর স্পেস শাটল ফ্লাইটের মাধ্যমে পাঠানো হয় নাসার ইউনিটি/নোড-১ মডিউল। নভোচারীরা স্পেসওয়াক করে এই মডিউলের সাথে অন্য মডিউল জুড়ে দেন। এভাবে ধাপে ধাপে অনেকগুলি মডিউল যোগ করা হয় স্টেশনের সাথে। প্রথম দুই মডিউলের পর পাঠানো হয় কাঠামোগুলিকে একটির সাথে অন্যটি শক্তভাবে আটকে রাখার জন্য ধাতব কাঠামো এবং সোলার প্যানেল। ২০১৭ সালে যোগ করা হয় ডকিং অ্যাডাপ্টার যার মাধ্যমে যে কোনো নতুন মহাকাশযান স্টেশনে ভিড়তে পারে। ২০০০ সালে পাঠানো হয় রাশিয়ান জেভেজদা। ২০০১ সালে পাঠানো হয় নাসার ডেসটিনি ল্যাবরেটরি মডিউল। একই বছর কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির উদ্যোগে পাঠানো হয় রোবোটিক হাত ‘কানাডার্ম-২’। স্পেসওয়াক এবং রিমোট-কন্ট্রোল মেরামতের সময় এই হাত ব্যবহার করা হয়। স্পেস স্টেশনে কার্গো মহাকাশযান ভিড়লে সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও এই যান্ত্রিক হাত ব্যবহার করা হয়। ২০০৭ সালে নাসা পাঠায় হারমোনি/নোড-২। ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি পাঠায় কলম্বাস অর্বিটাল ফ্যাসিলিটি, কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি পাঠায় ডেক্সটার রোবোটিক হ্যান্ড। ২০০৮-২০০৯ সালে জাপান পাঠায় এক্সপেরিমেন্ট মডিউল – কিবো। ২০১০ সালে নাসা পাঠায় ট্রাঙ্কুইলিটি/নোড-৩। ২০১১ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি পাঠায় লিওনার্ডো পার্মানেন্ট মাল্টিপারপাস মডিউল। ২০১৬ সালে স্থাপিত হয় বিগেলো এক্সপ্যান্ডেবল এক্টিভিটি মডিউল। ২০২০ সালে স্থাপিত হয় ন্যানোরক বিশপ এয়ারলক। ২০২১ সালে স্থাপিত হয় মাল্টিপারপাস ল্যাবোরেটরি মডিউল – নৌকা। ২০২১ সালে রাশিয়ান ডকিং মডিউল – প্রিশাল।

মহাকাশ স্টেশনের ক্ষেত্রফল একটি ফুটবলের মাঠের সমান। শুধুমাত্র স্টেশনটির ভর প্রায় ৪২০ টন। স্টেশনে নভোচারীদের জন্য থাকার ঘর, বাথরুম, ব্যায়ামাগারসহ সব আধুনিক ব্যবস্থাই আছে। স্টেশনের ভেতরে সাতজন নভোচারীর থাকা এবং কাজ করার ব্যবস্থা আছে। তবে মাঝে মাঝে এই সংখ্যার তারতম্য ঘটে। ২০০৯ সালে ১৩ জন নভোচারী ছিলেন। নভোচারীদের ঘুমানোর জন্য ছোট্ট বিছানা আছে। ছোট্ট ঘরের মধ্যে এই  বিছানায় ভাসমান অবস্থায়ও ঘুমাতে পারেন, অথবা দেয়ালের সাথে বেঁধে রেখে স্থিরভাবেও ঘুমাতে পারেন। 

পৃথিবী থেকে নভোচারীরা স্টেশনে যান স্পেস এক্স-এর ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুলে করে। রাশিয়ান নভোচারীরা ব্যবহার করেন রাশিয়ান সয়ুজ ক্যাপসুল। ২০১১ পর্যন্ত আমেরিকান নভোচারীরা ব্যবহার করতো নাসার স্পেস শাটল। কিন্তু স্পেস শাটল বন্ধ হয়ে যাবার পর আমেরিকানরাও ব্যবহার করতো রাশিয়ান সয়ুজ ক্যাপসুল। ২০২০ সাল থেকে স্পেস-এক্স এর ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুল চালু হয়েছে।

২০০০ সালের ২ নভেম্বর থেকে এই স্টেশনে সবসময়েই কোন না কোন মহাকাশচারী এই স্টেশনে আছেন। মহাকাশে পাঠানোর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াইশোর বেশি মানুষ মহাকাশ স্টেশনে থেকে এসেছেন। পৃথিবীর বিশটি দেশের ২৫৮ জন (মে ২০২২ পর্যন্ত) নভোচারী এই স্টেশনে থেকেছেন। আমেরিকা থেকে সবচেয়ে বেশি ১৫৮ জন, রাশিয়া থেকে ৫৪ জন। নাসার নভোচারী মার্ক হেই একটানা ৩৫৫ দিন স্টেশনে ছিলেন ২০২১-২২ সালে। আমেরিকান নভোচারী ক্রিস্টিনা কোচ একটানা ৩২৮ দিন স্টেশনে ছিলেন ২০১৯-২০ সালে। পেগি হিটসন মোট ৬৬৫ দিন স্টেশনে ছিলেন। ২০০৯ সালের এনডোভার মিশনে ১৩ জন নভোচারী স্টেশনে ছিলেন। পরবর্তীতে আরো কিছু মিশনেও এরকম হয়েছিল।

কোন্‌ দেশের কতজন বিজ্ঞানী কতক্ষণ এই স্টেশন ব্যবহার করতে পারবেন তা নির্ধারিত হয় সেই দেশের মহাকাশ সংস্থা কী পরিমাণ অর্থ কিংবা প্রকল্প সহায়তা করেছে তার উপর। নাসা প্রতি বছর প্রায় তিনশ কোটি ডলার খরচ করছে এই প্রকল্পের পেছনে। রাশিয়া, কানাডা, জাপান এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাকি খরচ সামলায়।

নভোচারীরা সাধারণত একবারের মিশনে স্টেশনে গেলে ছয় মাস থাকেন এবং কাজ করেন। এই ছয় মাস ধরে তাঁরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি স্টেশন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা যা করতে হয় সব করেন। কাজের বাইরে নিজেদের ফিট রাখার জন্য দিনে কমপক্ষে দুঘন্টা ব্যায়াম এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজ করেন।

মাঝে মাঝে তাঁদের স্টেশন থেকে বাইরে গিয়ে মহাশূন্যে ভেসে ভেসেও তাঁদের কিছু কারিগরী ত্রুটি সারাতে হয় (স্পেসওয়াক)। যখন স্টেশনের বাইরের দিকের কোন যান্ত্রিক রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের দরকার হয় তখন তাদের স্পেসওয়াক করতে হয়। কয়েকবার অ্যামোনিয়া সিস্টেম কাজ করছিল না যখন তখন সারাতে হয়েছে বাইরে গিয়ে। আমেরিকান নভোচারী জিম ভস এবং সুজান হেল্‌মস স্টেশনের একটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য আট ঘন্টা ছাপ্পান্ন মিনিট স্টেশনের বাইরে শূন্যে ভেসে কাজ করেছেন। স্টেশনের অ্যান্টেনা মেরামত করার জন্য রাশিয়ান নভোচারী আলেক্সান্ডার মিসুরকিন এবং আন্তন স্কাপ্লেরভ আট ঘন্টা তেরো মিনিট স্পেসওয়াক করেছেন – শূন্যে ভেসেছেন।

স্পেস স্টেশনের বাইরে গিয়ে মহাশূন্যে হাঁটা অনেক বিপজ্জনক। এই বিপদ এড়াতে নাসা এখন মানুষের মতো রোবট রোবোনট তৈরি করেছে। মানুষের বদলে এই রোবটগুলিকে এখন স্পেস স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রন করে কাজ করানো হয়। কিছু রোবটিক হাতও তৈরি করা হয়েছে (প্রায় ৫৭ ফুট লম্বা) যাদেরকে স্টেশনের বাইরে পাঠিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া হয়। ইওরোপিয়ান রোবোটিক আর্ম তৈরি করা হচ্ছে এখন।

মহাকাশ স্টেশনে নিয়মিত যাতাযাত করেছে আমেরিকান স্পেস শাটল এবং রাশিয়ান সয়ুজ। এগুলি ছাড়াও আরো অনেক মহাকাশযান এই স্টেশনে ভিড়েছে বিভিন্ন সময়ে। মানুষহীন রাশিয়ান প্রগ্রেস নভোযানগুলি নিয়মিত আসাযাওয়া করে। ইওরোপের স্বয়ংক্রিয় নভোযানগুলিও নিয়মিত যাতাযাত করছে। ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কমার্শিয়ান অরবিটাল ট্রান্সপোর্টেশান সার্ভিস প্রোগ্রামের আওতায় কমার্শিয়াল কার্গো নভোযান এই স্টেশনে ভেড়ার সুযোগ দিয়েছিল। ২০১২ সাল থেকে চালু হয়েছে স্পেস-এক্স এর বাণিজ্যিক নভোযান – ড্রাগনের যাত্রা যা এখনো চালু আছে। বোয়িং কোম্পানি স্টারলাইনার নভোযানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের জন্য বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

মানুষ ভবিষ্যতে চাঁদে কিংবা মঙ্গলে গিয়ে বসবাস করার কথা ভাবছে। কিন্তু দীর্ঘদিন মহাশূন্যের অভিকর্ষহীন পরিবেশে বসবাস করলে শরীরের উপর কী প্রভাব পড়ে তা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ঘটে এই মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীরা যখন মাসের পর মাস বাস করেন তখন। মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে থাকতে থাকতে নভোচারীদের মাংসপেশী, হাড়, চোখ, পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রে প্রভাব পড়ে। এই প্রভাবের ফলে কী কী পরিবর্তন হয় তা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই পরিবর্তন কতটুকু স্থায়ী কিংবা ক্ষতিকর তাও দেখা হয়। পৃথিবীর যন্ত্রপাতিগুলি মহাকাশে ব্যবহার করলে তার কোন পরিবর্তন হয় কি না, আবার উদ্ভিদ কিংবা অন্যান্য প্রাণির উপর কী প্রভাব আছে তাও দেখা হয়। ছোট ছোট শাকসব্জি স্টেশনে ফলানোর চেষ্টা করা হয়, যা পরীক্ষার অংশ আবার খাদ্যেরও। এপর্যন্ত এই মহাকাশ স্টেশনই মহাকাশে ভাসমান একমাত্র গবেষণাগার যেখানে এই পরীক্ষাগুলি করা হচ্ছে। এপর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গবেষক আড়াই হাজারেরও বেশি গবেষণা-প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন এই মহাকাশ স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার করে।

মহাকাশ স্টেশনের মিশন কন্ট্রোল সেন্টার আছে আমেরিকার হিউস্টনে এবং রাশিয়ার মস্কোয়। জাপান, কানাডা এবং ইওরোপ থেকেও সীমিত পর্যায়ে কিছু মিশন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে মহাকাশ স্টেশন কিছুদিন পর পর পৃথিবীর দিকে ঝুঁকে পড়ে। তখন তাকে আবার কক্ষপথে ঠেলে দিতে হয়। এই কাজগুলির নিয়ন্ত্রণ করে রাশিয়া।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে রাশিয়ার সাথে আন্তর্জাতিক মহাকাশ চুক্তির অনেক কিছুই বাতিল করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। ফলে  রাশিয়ার প্রভাব এবং গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রাশিয়া ২০২৪ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তাদের অংশগ্রহণ প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া প্রত্যাহার করে নিলে বেশ কিছু কারিগরী জটিলতা দেখা দেবে। আমেরিকা মহাকাশ স্টেশনে জ্বালানি সরবরাহ করে, কিন্তু রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশ স্টেশনের চলাচল। রাশিয়ার কারিগরী নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হয়ে গেলে নাসাকেই সব দায়িত্ব নিয়ে মহাকাশ স্টেশন পরিচালনা করতে হবে।

আশা করা হচ্ছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মহাকাশ স্টেশন যেভাবে চলছে সেভাবে চলবে। এরপর এর পরিচালনায় কিছু পরিবর্তন ঘটবে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত নাসা এর অর্থায়ন যেভাবে করছিল সেভাবে করবে। ২০৩০ সালের পর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ভবিষ্যত কী হবে তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।


তথ্যসূত্র:  (১) এলিজাবেথ হাওয়েল, স্পেস ডট কম (২০২২); (২) প্রদীপ দেব, সবার জন্য স্যাটেলাইট, তাম্রলিপি, ঢাকা (২০১৮); (৩) জন ক্যাচপোল, দি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশান বিল্ডিং ফর দ্য ফিউচার, স্প্রিঙ্গার, জার্মানি (২০০৮); (৪) ফিলিপ ব্যাকার, দ্য স্টোরি অব ম্যানড স্পেস স্টেশানস, স্প্রিঙ্গার, জার্মানি (২০০৭);

______________

বিজ্ঞানচিন্তা জানুয়ারি ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত










Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts