Thursday, 14 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ৩




ছেলেবেলা

          "আপনি নিশ্চয়ই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন?"
রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে পাঁচ শতাধিক হীরা ও মণিমুক্তার সংগ্রহশালা দেখে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন রামনকে।
          রামন তাঁর স্বভাবসুলভ ঘরকাঁপানো হাসি দিয়ে বলেছিলেন, "জন্মানোর সময় চামচ যদি মুখে থেকে থাকে তা ছিল তামার চামচ। আমার জন্মের সময় আমার বাবার মাসিক আয় ছিল দশ রুপি।"
          রামনের জন্মের সময় তাঁর বাবা চন্দ্রশেখরনের উপার্জন মাসে দশ রুপি হলেও তাঁদের পূর্বপুরুষের প্রচুর জমি ছিল। রামনের বড়ভাই সুব্রাহ্মণ্য একটা পারিবারিক ইতিহাস লিখেছিলেন। সেখান থেকে জানা যায় আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর জেলায় ছিল রামনের পূর্বপুরুষদের বাস। রামনের ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদার বাবার নাম ছিল আয়ামুথিয়ান। আয়ামুথিয়ান দক্ষিণ-পশ্চিমের মালাবার অঞ্চলে গিয়ে প্রচুর টাকা-পয়সা উপার্জন করে ফিরে আসেন। তারপর সেই টাকা দিয়ে তিরুনেলভেলি জেলার মানগুডি গ্রামে প্রায় দুইশ' একর ফসলি জমি কিনে বিরাট জমিদার হয়ে যান। তিন পুরুষ পরেও রামনের ঠাকুরদাদার বাবার ১০৪ একর জমি ছিল।[1]
          রামনের ঠাকুরদাদার নাম ছিল রামনাথন। চার ভাইয়ের মধ্যে রামনাথন ছিলেন সবার ছোট। রামনাথনের শারীরিক গঠন ছিল প্রকান্ড, শক্তি ছিল পালোয়ানের মতো। গ্রামের মধ্যে লাঠি চালনায় তাঁর সাথে পারতো না কেউ। তখনকার সময়ে প্রচুর ডাকাতের উৎপাত হতো। জমির ফসল কেটে নিয়ে যেতো তারা। ডাকাতদের বাধা দেয়ার জন্য গ্রামের পুরুষরা লাঠি চালনা শিখতো।
          রামনাথন তামিল পড়তে পারতেন এবং লিখতে পারতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ সন্তান হওয়ার কারণে সংস্কৃত অনেক শ্লোক মুখস্ত ছিল তাঁর এবং প্রায়ই সেগুলো আওড়াতেন। রামনাথন নিজে ইংরেজি না জানলেও দেখেছেন সেই সময়ে ইংরেজদের গড়া স্কুল-কলেজে যারা লেখাপড়া করেছে তাদের উন্নতি কত দ্রুত হচ্ছে। তাই ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাঁর একটা সম্মানজনক অনুভূতি ছিল।
          সেই সময় ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতো অনেক ছোটবেলায়। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতো ছয়-সাত বছর বয়সে। অবশ্য বিয়ের পর মেয়েরা নিজের মা-বাবার সাথেই থাকতো বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানো পর্যন্ত। তারপর একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মেয়েকে তার স্বামীর কাছে পাঠানো হতো। এই অনুষ্ঠানকে বলা হতো শান্তি কল্যাণম। স্বামীর কাছে যাবার আগেই যদি মেয়ে মারা যায় কোন কারণে তাহলে স্বামীর কোন সমস্যা নেই। সে দ্রুত আরেকটি বিয়ে করে নেয়। কিন্তু যদি স্বামীর কাছে যাবার আগেই স্বামীর মৃত্যু ঘটতো তাহলে সেই মেয়েটিকে সারাজীবন বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে কাটাতে হতো এবং সেটা খুব একটা সুখের হতো না।
          রামনাথনের শিশু-স্ত্রী বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়। রামনাথন আবার বিয়ে করে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল সীতালক্ষ্মী। সীতালক্ষ্মী ও রামনাথনের পাঁচটি সন্তান। প্রথম ছেলেটি দুই বছর বয়সে মারা যায়। দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় ১৮৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। নাম রাখা হয় চন্দ্রশেখরন। চন্দ্রশেখরনের পরে তিনটি কন্যা সন্তান পরপর - জ্ঞানম, রঙ্গম, ও সুন্দরম।
          এই চন্দ্রশেখরন ছিলেন রামনের বাবা। রামনের পিসি জ্ঞানম চৌদ্দ বছর বয়সে বিধবা হয়ে বাবার বাড়িতেই কাটিয়েছেন সারাজীবন। প্রথমে মা-বাবার সাথে, পরে ভাইয়ের সংসারে, আরো পরে ভাইপোর সংসারে। রঙ্গমের স্বামী বৈদ্যনাথ আয়ার ছিলেন স্কুল শিক্ষক। আর  সুন্দরমের স্বামী শিবানন্দ সুব্রহ্মণ্য ছিলেন ভাগবতার। ভাগবতারদের কাজ ছিল ধর্মগ্রন্থের কাহিনিগুলো গান আর অভিনয়ের সাথে পরিবেশন করা।
          রঙ্গমের জন্মের পরপরই রামনাথন সপরিবারে মানগুডি গ্রাম থেকে পাশের গ্রাম পরশকুডিতে চলে যান। তাঁর জমি থেকে যা উপার্জন হতো তার চেয়ে খরচ হচ্ছিলো অনেক বেশি। ফলে আস্তে আস্তে অনেক জমি বন্ধক দিয়ে টাকা নিতে হচ্ছিলো তাঁকে।
          ইংরেজদের প্রচলিত ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটছিলো তখন। বিশেষ করে ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলে এই শিক্ষার প্রভাব ছিল অনেক বেশি। রামনাথন নিজের ছেলে চন্দ্রশেখরনকে দশ বছর বয়সে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্কুলটি ছিল বাড়ি থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে কুম্বাকোনাম শহরে। বাড়ি থেকে যাতায়াতের উপায় ছিল হেঁটে যাওয়া অথবা গরুর গাড়িতে। এতদূর রাস্তা প্রতিদিন যাওয়া-আসা সম্ভব নয়। রামনাথন স্কুলের কাছে একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে তাঁর শাশুড়ির মায়ের তত্ত্বাবধানে চন্দ্রশেখরনকে রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করলেন। প্রতি মাসে তিনি কয়েকবার গিয়ে খাবার-দাবারসহ যা যা লাগে কিনে দিয়ে আসতেন। ১৮৮১ সালে পনেরো বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করলেন চন্দ্রশেখরন।
          ম্যাট্রিক পাস করার আগেই চৌদ্দ বছর বয়সে চন্দ্রশেখরনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বারো বছর বয়সী পার্বতী আম্মালের সাথে। পার্বতী আম্মালের বাবার (রামনের নানা) নাম ছিল সপ্তঋষি শাস্ত্রীয়ার। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট পন্ডিত। তিনি ধর্মমতে কাশীযাত্রা করার জন্য পায়ে হেঁটে তিরুচিলাপল্লী থেকে বারানসীর কাশী পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। সেখানে কিছুদিন তিনি নবন্যায় শাস্ত্র পড়াশোনা করেন। এই নবন্যায় হলো হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিষয়কে যুক্তির মোড়কে পরিবেশন করা।
          সেই সময় মেয়েরা বিয়ের আগপর্যন্ত যতটুকু পারে পড়াশোনা করতো। তারপর শ্বশুরবাড়িতে গেলে পুরোটাই নির্ভর করতো স্বামীর মর্জির ওপর। তাই বেশিরভাগ বাড়িতেই দেখা যেতো মেয়েরা মাতৃভাষায় কিছু লিখতে এবং পড়তে পারে, তার বেশি কিছু নয়। পার্বতী আম্মালেরও একই অবস্থা। স্বামী চন্দ্রশেখরন তাঁকে তামিল লিখতে ও পড়তে শেখালেন। আর কিছু গান শিখিয়েছিলেন যেগুলো নিজে গাইতে পারতেন।
          ১৮৮৪ সালে চন্দ্রশেখরন মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। তাঁর বিষয় ছিল ইংরেজি, গণিত, ও তামিল। ইংরেজি ও গণিতে পাস করলেও তিনি তামিলে ফেল করলেন। এক সাবজেক্ট ফেল করলে সবই ফেল। পাস করতে হলে সব বিষয়ের পরীক্ষা আবার দিতে হবে পরের বছর। কিন্তু তাঁদের আর্থিক অবস্থা আসলেই খারাপ। পরীক্ষার ফিসের জন্যও বাপের জমি বন্ধক দিতে হবে। তিনি ফিরে এলেন নিজের গ্রামে। শুরু করলেন তিরুবেদামারুথুর স্কুলে শিক্ষকতা।
          ১৮৮৫ সালের ৮ অক্টোবর চন্দ্রশেখরন ও পার্বতী আম্মালের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। সামাজিক নিয়ম অনুসারে সন্তান জন্মের আগে মা তার নিজের মা-বাবার কাছে চলে যেতেন। তাই সব সন্তানেরই জন্ম হতো তাদের মামার বাড়িতে।
          এখানে দক্ষিণ ভারতে ছেলেমেয়েদের নামকরণের নিয়ম একটু জেনে রাখলে বুঝতে সুবিধা হবে। সন্তানদের  সাধারণত এক শব্দের একটা নাম দেয়া হয়, কোন পদবি থাকে না। নামের আগে বাবার নামটাও জুড়ে দেয়া হয়। চন্দ্রশেখরনের বাবার নাম ছিল রামনাথন। সেই হিসেবে চন্দ্রশেখরনের পুরো নাম দাঁড়িয়েছিল রামনাথন চন্দ্রশেখরন। চন্দ্রশেখরনের প্রথম ছেলের নাম রাখা হলো সুব্রাহ্মণ্য। পুরো নাম দাঁড়ালো চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মণ্য। সুব্রাহ্মণ্য মন্দিরের নাম অনুসারে এই নাম রাখা হয়েছিল।
          তিন বছর পর ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর তামিলনাড়ুর ত্রিচিনোপলির (বর্তমান নাম তিরুচিরাপাল্লি) তিরুভানাইকাভাল নামে ছোট্ট একটা গ্রামে চন্দ্রশেখরন ও পার্বতীর দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। তিরুপতি মন্দিরের দেবতা ভেঙ্কটরামনের নামানুসারে নাম রাখা হলো ভেঙ্কটরামন। পুরো নাম দাঁড়ালো চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন। পরবর্তীতে ভেঙ্কটরামন দুটো শব্দে বিভক্ত হয়ে ভেঙ্কট রামন হয়ে যায়। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন - ডাকার সুবিধার্থে হয়ে যায় সি ভি রামন।


রামনের বাবা-মা


এই বাড়িতে রামনের জন্ম হয়েছিল



রামনের জন্মের সময় রামনের বাবা চন্দ্রশেখরন ছিলেন ত্রিচিনোপলির এস-পি-জি (Society for the Propagation of the Gospels) কলেজ সংলগ্ন স্কুলের দশ রুপি বেতনের শিক্ষক। দশ রুপিতে সংসার চলে না। তাই শ্বশুরের কাছ থেকে প্রতি মাসে আরো দশ রুপি ধার নিতে হতো নিয়মিত।
          কিছুদিন পর বিএ পরীক্ষার নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়। তিন সাবজেক্টের পরীক্ষা এক সাথে দেয়ার বদলে একটি একটি বিষয়ের আলাদা আলাদা পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হলো। চন্দ্রশেখরন তামিলে ফেল করেছিলেন। তিনি এবার তামিলের পরিবর্তে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষা দিলেন। বেশ কিছু ভালো বই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। সেগুলো পড়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পাস করলেন। ১৮৮৯ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে চন্দ্রশেখরন পদার্থবিজ্ঞান, ইংরেজি ও গণিতে বিএ পাস করলেন। সেই সময় উপার্জন বাড়ানোর জন্য তিনি ধনী লোকের ছেলেদের প্রাইভেট পড়াতেন।
          ১৮৯২ সালে বিএ পাস করার পর বিশাখাপট্টমের মিসেস এ ভি এন কলেজে শিক্ষকতার চাকরি পান চন্দ্রশেখরন। ততোদিনে তাঁদের তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়েছে। তাঁরা তাঁদের প্রথম মেয়ের নাম রাখলেন মঙ্গলম। বড় ছেলে সুব্রাহ্মণ্যকে নিজের মা-বাবার কাছে রেখে চন্দ্রশেখরন ছোট ছেলে রামন ও এক বছরের শিশুকন্যা মঙ্গলমকে নিয়ে ত্রিচিনোপলি থেকে বিশাখাপট্টমে চলে এলেন। পরিবহন ব্যবস্থা সবে উন্নতি হতে শুরু করেছে তখন। রেললাইন সবে বসতে শুরু করেছে। তাঁদের কিছুটা পথ গরুর গাড়িতে, কিছুদূর ট্রেনের মালগাড়িতে করে অনেক কষ্টে আসতে হয়েছে। কিন্তু চন্দ্রশেখরনের কাছে শারীরিক কষ্ট কোন কষ্টই নয়। তিনি তাঁর বাবা রামনাথনের মতোই বলশালী। নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। কাবেরি নদী সাঁতরে এপার-ওপার করতেন প্রতিদিন। কলেজে তিনি পড়ানোর পাশাপাশি ছাত্রদের নিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল এবং অন্যান্য খেলাধুলার আয়োজন করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রত্যেক ছাত্রকেই তিনটি ব্যাপারে ভালো করতে হবে: পড়াশোনা, সঙ্গীত, এবং খেলাধুলা। তিনি নিজে তিনটাতেই ভালো ছিলেন। চমৎকার বেহালা বাজাতে পারতেন। বড় ছেলে সুব্রাহ্মণ্যকে পড়াশোনার পাশাপাশি বেহালা বাজাতেও শিখিয়েছিলেন। তাঁর ছেলেদের পড়াশোনা ও সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ থাকলেও খেলাধুলার প্রতি কোন আগ্রহই জন্মায়নি।
          বিশাখাপট্টমে আসার পর চন্দ্রশেখরন ও পার্বতী আম্মালের আরো পাঁচটি সন্তান হয়। ১৮৯৪ সালে ৩য় পুত্র কুমারস্বামী, ১৮৯৮ সালে ৪র্থ পুত্র সুন্দরম, ১৯০১ সালে ২য় কন্যা সীতালক্ষ্মী, ১৯০৩ সালে ৩য় কন্যা মীনা, এবং ১৯০৭ সালে পঞ্চম পুত্র রামস্বামীর জন্ম হয়।

মা-বাবা ও ভাই-বোনের সাথে কিশোর রামন। বাম দিক থেকে পেছনের সারিতে রামন, সুব্রাহ্মণ্য, চন্দ্রশেখরন, পার্বতী (কোলে মীনা), ও মঙ্গলম। সামনের সারিতে সীতালক্ষ্মী, কুমারস্বামী, ও সুন্দরম।






[1] Uma Parameswaran, C. V. Raman, Penguin Books, India, 2011


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts