Showing posts with label চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়. Show all posts
Showing posts with label চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়. Show all posts

Thursday, 21 July 2022

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌনহয়রানি

 


সারা পৃথিবীতেই শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ অঙ্গন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। সন্তান যেমন তার মায়ের বুকে নিরাপদে থাকে, তেমনি শিক্ষার্থীরাও তাদের ক্যাম্পাসে সবচেয়ে নিরাপদে থাকার কথা। যে শিক্ষায়তন থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি, সেই শিক্ষাঙ্গনকে আমরা সারাজীবন সম্মান করি আলমা ম্যাটার হিসেবে। আলমা ম্যাটার শব্দযুগলের আক্ষরিক অর্থ অনেকটা ধাত্রী মায়ের মতো – যে আমাদের আদরযত্নে লালনপালন করে, শিক্ষা দিয়ে, নিরাপত্তা দিয়ে কাজের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। শিক্ষাঙ্গনের ভালোমন্দ সবকিছুই নির্ভর করে তার নীতিনির্ধারকদের উপর। বাংলাদেশের  বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকরা ভীষণ ক্ষমতাবান। পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কীভাবে চলে তা তাঁদের না জানার কথা নয়। নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা থাকলে শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানিসহ যেকোনো ধরনের অন্যায়ের প্রতিরোধ শুধু নয়, নির্মূল করাও যে অসম্ভব নয়, তা সবাই জানে। কিন্তু বড়কর্তারা লোভের বশে, আর ছোটকর্তারা বড় হতে পারবে না এই ভয়ের বশে সবসময়ই একটা নতজানু নীতি বজায় রেখেছে। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই – যেখানে কোন অন্যায় ঘটনা প্রায় হয় না বললেও চলে – সেখানকার ক্যাম্পাসেরও বিভিন্ন জায়গায় জরুরি ফোনবুথ থাকে। একটা বোতাম টিপলেই  নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে ফোন চলে যায়। নিরাপত্তা রক্ষীরা সেখানে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেতন নেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। কোন ঘটনা ঘটলে, বা ঘটার উপক্রম ঘটলেও – তা ধামাচাপা না দিয়ে সেই ঘটনার পুঙ্খানুপুংখ তদন্ত করা হয়, এবং সেরকম ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে তার ব্যবস্থা করা হয়।

আমার প্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সাথে একই রকমের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। গত পঞ্চাশ বছরে অনেকবার ঘটেছে। অথচ ক্যাম্পাস ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ করার কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রতিটি ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে যেকোনোভাবে – শক্তি দিয়ে কিংবা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন থামানো হয়েছে, কিন্তু প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কষ্ট লাগে – যখন দেখি যারা এক সময় শিক্ষার্থী হিসেবে এই একই অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে আন্দোলন করেছিলেন, তাঁরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা হবার পর হাত গুটিয়ে বসে আছেন আরো উপরে উঠার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে।

রাতারাতি হঠাৎ সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে এটা আশা করার কোন উপায় নেই। ক্যাম্পাসে ঢুকে যারা শিক্ষার্থীদের সম্ভ্রম নষ্ট করার চেষ্টা করতে পারে, তাদের মতো নষ্ট মানুষ কীসের ক্ষমতার জোরে বুক ফুলিয়ে ক্যাম্পাসে ঘোরে তা সবাই জানে। নষ্টরা যে পার্টির ছায়াতেই থাকুক, তাদের নষ্ট বলে পরিত্যাগ করার সৎ সাহস বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকদের কেন থাকবে না?

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে দেখে ভালো লাগছে। আশা করি একদিন তারা যখন নীতিনির্ধারক হবে, তাদের এই প্রতিবাদী মনোভাব অটুট থাকবে।
*প্রতিবাদের ছবিটি নিয়েছি তন্ময় শাওনের ওয়াল থেকে।

Tuesday, 12 April 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬৭ (শেষ পর্ব)

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬৭ (শেষ পর্ব)

পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। কমনওয়েলথভুক্ত দেশে গিয়ে গবেষণা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের এই বৃত্তিগুলি থাকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে। কমিশনের অফিস থেকে নির্ধারিত ফরম সংগ্রহ করে দরখাস্ত করেছিলাম। ঢাকায় মঞ্জুরি কমিশনের অফিসে স্কলারশিপের ইন্টারভিউ হলো। অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস থাকলেই দরখাস্ত করা যায় বলেই দরখাস্ত করেছিলাম। আগে যদি জানতাম যে এই বৃত্তিগুলি অলিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই সংরক্ষিত, তাহলে দরখাস্তই করতাম না। তবে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হলো। দেখতে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে কত ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষমতা থাকে। 

ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস – এই আপ্তবাক্য অনুসারে একের পর এক নতুন পিলার গজাচ্ছে আমার। বুদ্ধিমান মানুষ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বুঝে ফেলে কোন্‌ বিষয় কীভাবে কাজ করে। আমার সেই ক্ষমতা নেই। তাই আমি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে দেখে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেসব বিদেশী বৃত্তির জন্য দরখাস্ত চাওয়া হয় – সেগুলিতে দরখাস্ত করতে থাকি। কোনোটা থেকেই কোন সাড়া পাই না। কিন্তু একদিন হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম এলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। ভারত সরকারের বৃত্তির জন্য পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে। মার্চের ১৮ তারিখের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মূল ফরম জমা দিতে হবে। কিন্তু টেলিগ্রাম আমি পেয়েছি মার্চের ২৪ তারিখ। খামের উপর সিল দেখে বোঝা যাচ্ছে পাঠানো হয়েছে ১৯ তারিখ। এরকম ঝামেলা কি শুধু আমার সাথে হয়, নাকি আরো অনেকের সাথে হয়? কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকায় গেলাম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মন্ত্রণালয়ে ঢুকে দেখতে পেলাম – শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়ালে দেয়ালে অনেক বিদেশী বৃত্তির নোটিশ ঝুলছে। এই সংরক্ষিত এলাকায় যেখানে প্রবেশ করার জন্য বিশেষ অনুমতি লাগে, সেখানে এই বিজ্ঞপ্তিগুলি ঝুলিয়ে রাখার কারণ কী? দেখলাম মন্ত্রণালয়ের পিয়ন, কেরানি সবাই হা করে আছে টাকার জন্য। দেরি করে এসেছি এই কারণ দেখিয়ে একটা ফরমের জন্য তিন শ টাকা নগদ নিলো। মাত্র তিনশ টাকার জন্য আমার পাওয়া বৃত্তি হাতছাড়া হয়ে যাবে! তাই অন্যায় জেনেও আমি তিন শ টাকা দিয়ে ফরম নিলাম। রাত জেগে ফরম পূরণ করে, সমস্ত কাগজপত্র জোগাড় করে পরদিন ফরম জমা দিলাম। এরপর কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি – ফাইনাল রেজাল্ট আসবে। দুই সপ্তাহ পর ভারতীয় হাই কমিশন থেকে চিঠি এলো – মন্ত্রণালয় থেকে আমার নাম পাঠানো হয়েছে, কিন্তু নির্ধারিত ফরমে আমার দরখাস্ত পাঠানো হয়নি। অথচ এই দরখাস্ত আমি নিজে জমা দিয়ে এসেছি মন্ত্রণালয়ে।

চাইলেই চট্টগ্রাম থেকে যখন খুশি ঢাকায় চলে যাওয়া যায় না। কলেজ থেকে ছুটি পাওয়া সহজ নয়। একদিনের ছুটির জন্যও ‘আকুল আবেদন’ করতে হয়। আবার গেলাম মন্ত্রণালয়ে। তারা বললো – দরখাস্ত ভারতীয় হাই কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছে। গেলাম ভারতীয় হাই কমিশনে। তারা জানালো – আমার দরখাস্ত তারা পায়নি। এখন উপায়? হাই কমিশনের একজন ‘দাসবাবু’ উপায় বাতলে দিলেন। আবার সমস্ত কাগজপত্র নতুন করে জোগাড় করে দরখাস্ত জমা দিলাম। এবার নিশ্চয় হয়ে যাবে। কিন্তু দাসবাবুর মৎস্য শিকারের খুব শখ। তিনি জানতে চাইলেন তাঁকে চট্টগ্রামে এনে তাঁর মৎস্য শিকারের শখ মেটাতে আমি কোন ভূমিকা রাখতে পারি কি না। তাঁর শখ মেটানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমার সরকারি স্কলারশিপের ওখানেই ইতি।

চতুর্দশ বিসিএস ছিল শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস। ওই বিসিএস আমরা দিতে পারিনি, কারণ আমাদের মাস্টার্স পরীক্ষা হয়নি তখনো। এরপর আমাদের জন্য সুযোগ এলো ষোড়শ বিসিএস। ওটাও শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে আমার ওই বিসিএস হয়ে যাবে। মৌখিক পরীক্ষায় শুধুমাত্র পাসমার্ক পেলেও আমি মেধাতালিকায় চলে আসবো এরকম আস্থা ছিল নিজের উপর। কিন্তু আস্থা আর বাস্তব এক জিনিস নয়। আমি ষোড়শ বিসিএস ফেল করলাম। আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকলো। বছরখানেক পর সপ্তদশ বিসিএসও ফেল করলাম। আত্মবিশ্বাস অবশিষ্ট যা ছিল তাও বাষ্প হয়ে উড়ে গেল।

কলেজে কাজে ব্যস্ত থাকি। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সাথে যতক্ষণ থাকি – আনন্দেই থাকি। ক্লাসরুম আমার প্রিয় জায়গা, শিক্ষার্থীরা আমার প্রিয়জন। কিন্তু তারপরও মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে।

যতই অনুভূতি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি – কাছের মানুষগুলি ঠিকই বুঝতে পারে। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে বাবার মুখোমুখি হই। এই মানুষটির সাথে আমার এখন যতটা পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, তার চেয়েও বেশি বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাঁর বয়স এখন পঁচাত্তর। তাঁর নিজস্ব সংগ্রামের কথাগুলি এখন আমি বুঝতে পারি। তিনিও খুলে বসেন তাঁর অতীত দিনের কথার ঝাঁপি।

আমার বাবার জীবন অনেকটা সাপ-লুড়ুর মতো। কতোবার তাঁর জীবনের পাকা গুটি সাপে খেয়েছে। তিনি শীর্ষ থেকে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছেন, কিন্তু তিনি থেমে যাননি। একটা কথার ভগ্নাংশ তিনি প্রায়ই বলেন – “মা ফলেষু কদাচন – কর্ম করে যাও, ফলের আশা করিও না।” মূল কথাটি অবশ্য এরকম “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” – অর্থাৎ মানুষের অধিকার শুধু কর্মে, কর্মফলে নয়। তার মানে কী দাঁড়ালো?  ফল যাই হোক, আমার চেষ্টা আমাকে করেই যেতে হবে।

নতুন করে চেষ্টা শুরু হলো। লালদীঘির পাড়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি। সেখানে রেফারেন্স সেকশানে কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিগুলির বিস্তারিত পরিচিতিসহ রেফারেন্স বই আছে। সেখান থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ঠিকানা জোগাড় করে উচ্চতর ডিগ্রিতে ভর্তির তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠাতে শুরু করলাম। প্রতিদিন কলেজ থেকে আসার পর সারা বিকেল এখানেই কাটে। এরপর রাত জেগে চিঠি টাইপ করি। মুসলিম হলের পাশে বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরির চার তলায় রেফারেন্স রুমে আছে আমেরিকান ইউনিভার্সিটির লিস্ট। ওখান থেকেও ঠিকানা জোগাড় হয়। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে প্রায় কয়েক শ’ চিঠি পোস্ট করলাম আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ আরো কিছু দেশে – যেখানে ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা হয়।

মাসখানেক পরে চিঠি আসতে শুরু করলো। বড় বড় খামের ভেতর বড় বড় প্রস্পেক্টাস। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্পেক্টাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের নতুন চারা গজাতে শুরু করে। কিন্তু স্বপ্নের ডানা ছেটে দিতে হয়। কারণ ভর্তির দরখাস্ত করার জন্য ফি আছে – পঞ্চাশ ডলার থেকে এক শ ডলার পর্যন্ত। ছিয়ানব্বই সালে আমেরিকান ডলারের দাম ছিল প্রায় পঞ্চাশ টাকা। সেই হিসেবে আমার এক মাসের বেতন মাত্র এক শ ডলার। দুইটা ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত করতে গেলেই আমি ফতুর হয়ে যাবো। তাই কয়েক শ ইউনিভার্সিটিতে চিঠি পাঠিয়ে প্রসপেক্টাস আনা গেলেও – ভর্তির দরখাস্ত করার ব্যাপারে খুব হিসেবী হয়ে উঠতে হলো। প্রথমে দেখলাম ফি ছাড়া দরখাস্ত করা যায় কোন্‌ কোন্‌ ইউনিভার্সিটিতে। আমেরিকার হাতে গোনা কয়েকটি ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত করতে ফি লাগে না, কিন্তু টোফে্‌ল, জিআরই লাগে।

নতুন যন্ত্রণার নাম টোফেল, জিআরই। বইপত্র কিনে উল্টেপাল্টে দেখে বুঝতে পারলাম – আমার ইংরেজির অবস্থা ভয়াবহ। অরিজিনাল বইপত্রের দামও অনেক। পরীক্ষার ফিও ষাট-সত্তর ডলার। এই ডলারের চেক জোগাড় করতেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। আগ্রাবাদে সোনালী ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা থেকে অনেক কাগজপত্র জমা দিয়ে ডলারের চেক জোগাড় করতে হয়।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপের জন্য দরখাস্ত করলাম। দরখাস্ত করার জন্য কোন ফি লাগলো না বলে অনেক খুশি হয়েছি। তবে দরখাস্তে উল্লেখ করা আছে আমার ইউনিভার্সিটি থেকে সরাসরি অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট পাঠাতে হবে। এই অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট বস্তুটা যে কী জিনিস – কোন ধারণা নেই। আমাদেরকে মার্কশিট দেয়া হয়েছে, সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট নামে কিছুই তো দেয়া হয়নি। অথচ জানতে পেরেছি আন্তর্জাতিক সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট দেয়া হয় – যেখানে কী কী সাবজেক্টে পরীক্ষা দিয়ে কত নম্বরের মধ্যে কত পেয়েছি, কী গ্রেডের কী মান, গ্রেড কীভাবে দেয়া হয়, কত নম্বরের মধ্যে কত পেলে ফার্স্ট ক্লাস, ইত্যাদি সব তথ্য থাকে সেই ট্রান্সক্রিপ্টে। ইউনিভার্সিটিগুলি ইউনিভার্সাল হবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ আমাদের ইউনিভার্সে অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টই নেই!

ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। ডেপুটি রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর জানা গেল অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টের জন্য নির্ধারিত ফরমে দরখাস্ত করতে হবে। অনার্সের জন্য একটি দরখাস্ত, মাস্টার্সের জন্য আরেকটি দরখাস্ত। দরখাস্তে আমি কোন্‌ পরীক্ষায় কত পেয়েছি তা লিখে দিতে হবে। সাথে আমার মার্কশিটের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হবে। প্রতিটি দরখাস্তের ফি দুইশ টাকা। সেই টাকা আবার অগ্রণী ব্যাংকে জমা দিতে হবে। আমি কোন্‌ পরীক্ষায় কত পেয়েছি সেই রেকর্ড তো বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকার কথা। সেখান থেকে তথ্য নিয়েই তো ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করে দেয়ার কথা। কিন্তু না, আমাকেই সব সরবরাহ করতে হবে। অফিসাররা সেই তথ্য মিলিয়ে দেখবেন ঠিক আছে কী না।

পুরো দুই দিন লাগলো ট্রান্সক্রিপ্ট রেডি হতে। পাতলা ফিনফিনে কাগজে টাইপ করা হলো ট্রান্সক্রিপ্ট। টাইপ করার সময় বেশ কয়েকবার ভুল হলো। সাদা ফ্লুইড দিয়ে সেই ভুল মোছা হলো। তার উপর আবার টাইপ করা হলো। এরকম ছন্নছাড়া ট্রান্সক্রিপ্ট যাবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। বলা হয়েছে ইউনিভার্সিটি থেকে সরাসরি পাঠাতে। সেজন্য পোস্টাল স্টাম্পের খরচ নেয়া হয়েছে পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু আমাকে ট্রান্সক্রিপ্ট দুটো এবং একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ মারা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো – “আপনি পোস্ট করে দিয়েন কোথায় দিতে হয়।“

“তাহলে পোস্টেজ বাবদ যে পঞ্চাশ টাকা নিলেন?”

“হে হে হে।“ মনে হলো এরকম হাস্যকর প্রশ্ন তিনি আর কখনো শোনেননি।

যাই হোক, অক্সফোর্ডে দরখাস্ত পাঠালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের খামে অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট পাঠালাম। প্রামাণিকস্যারকে অনুরোধ করেছিলাম একটি রেফারেন্স লেটারের জন্য। তিনি বলেছেন, নিয়ম মোতাবেক তিনি সরাসরি অক্সফোর্ডেই পাঠিয়ে দেবেন।

মাসখানেক পর অক্সফোর্ড থেকে চিঠি এলো। আই-ই-এল-টি-এস করতে হবে। ওভারঅল ব্যান্ড স্কোর কমপক্ষে সেভেন হতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম বা আই-ই-এল-টি-এস সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। ব্রিটিশ কাউন্সিলে খোঁজ নিলাম। চট্টগ্রামে তেমন কোন তথ্য নেই। ব্রিটিশ কাউন্সিল ঢাকায় এই পরীক্ষার আয়োজন করে এবং সেখানে তথ্যও পাওয়া যায়। তবে চট্টগ্রাম ব্রিটিশ কাউন্সিলের তরুণ লাইব্রেরিয়ান আনঅফিশিয়ালি জানালেন – আমি আগ্রহী হলে মিসেস সুতপা বড়ুয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। মিসেস বড়ুয়া আগে ব্রিটিশ কাউন্সিলে কাজ করতেন। এখন নিজেই একটি ইংরেজি শেখানোর প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন রহমতগঞ্জে।

সুতপা ম্যাডামের সাথে দেখা করলাম। বেশ বড় প্রতিষ্ঠান তাঁর। অনেক ছাত্রছাত্রী ইংরেজিতে কথা বলা শিখছে। আই-ই-এল-টি-এস কোর্সে আপাতত কোন স্টুডেন্ট নেই। কারণ ওই পরীক্ষাটা এখনো খুব একটা পরিচিত হয়নি এখানে। এখনো সবাই টোফেলই করে। সুতপাম্যাডাম আমাকে একাই পড়াবেন। এক ঘন্টা করে মোট দশটি ক্লাস নেবেন, প্রতি ক্লাস ছয় শ টাকা। তবে ব্যান্ড স্কোরের কোন গ্যারান্টি তিনি দিতে পারবেন না। ভর্তি হয়ে গেলাম।

মাস খানেক পরে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এলাম। ওভারঅল ব্যান্ড স্কোর এলো সাড়ে ছয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রিজেকশান লেটার এলো কয়েক সপ্তাহ পর।

দেখলাম অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটিগুলিতে আই-ই-এল-টি-এস ব্যান্ড স্কোর ছয় হলেই হয়। তাহলে তো অস্ট্রেলিয়ায় দরখাস্ত করতে হয়। কিন্তু দরখাস্তের ফি আছে সেখানে। অস্ট্রেলিয়ান ডলারের দাম আমেরিকান ডলারের চেয়ে কম। সাতানব্বইতে বাংলাদেশী টাকায় অস্ট্রেলিয়ান ডলার ছিল সাতাশ টাকা। এএনজেড গ্রিনলেজ ব্যাংকে অস্ট্রেলিয়ান ডলার পাওয়া যায়। আমার কলেজজীবনের বন্ধু সুরজিত কাজ করে সেখানে। তার সাহায্যে অস্ট্রেলিয়ান ডলার জোগাড় হলো। দরখাস্ত করলাম কয়েকটি অস্ট্রেলিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। এখানে অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ইউনিভার্সিটি থেকে পাঠাতে হয় না, দরখাস্তের সাথে নিজেই পাঠানো যায়। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে আবার ফরম ও টাকা জমা দিয়ে আরেক সেট ট্রান্সক্রিপ্ট নিয়ে এলাম। এবার ওগুলির ফটোকপি দিয়ে কাজ চালালাম।

প্রথম অফারটা এলো ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটি থেকে। শুধু ভর্তির অফার, কোন স্কলারশিপ নেই। টিউশন ফি বছরে আঠারো হাজার ডলার। অত টাকা দিয়ে পড়াশোনা করার সামর্থ্য নেই। পরের অফার এলো ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড থেকে। ওখানেও কোন স্কলারশিপ নেই। তৃতীয় অফারটা এলো ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন থেকে। প্রথম চিঠিতে কোন স্কলারশিপ নেই, কিন্তু বলা হলো স্কলারশিপের সিদ্ধান্ত কিছুদিন পরে জানানো হবে। এক মাস পর জানানো হলো – আমাকে একটা রিসার্চ স্কলারশিপ দেয়া হচ্ছে।

তারপর অন্য দেশ, অন্য কাহিনি।

<<<<<<<<< আগের পর্ব

Saturday, 2 April 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬৬

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬৬

ইন্টারভিউর চিঠি পাবার পর স্বপ্নটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন জেগে উঠলেই ভেঙে যায়। কিন্তু জেগে জেগে যে স্বপ্ন দেখছি তা পিছু ছাড়ছে না। প্রামাণিকস্যার বলেছিলেন ইন্টারভিউর চিঠি নাও পাঠাতে পারে। কিন্তু ইন্টারভিউর চিঠি তো পেলাম। নভেম্বরের আট তারিখ সকাল দশটায় ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে ইন্টারভিউ। স্বপ্নের ঠেলায় প্রামাণিকস্যারের উপর রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাস্তববাদীর আড়ালে তিনি একজন নৈরাশ্যবাদী মানুষ। সোবহানস্যার যখন বলেছেন আমার আর হারুনের সমান যোগ্যতা, তখন নিশ্চয়ই তিনি আমাদের দু’জনের জন্যই সমানভাবে ভাবছেন। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কথার একটা দাম থাকবে না তা কি হয়?

স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি নিজের যোগ্যতাও তো প্রমাণ করতে হবে। ইন্টারভিউতে নিশ্চয় পদার্থবিজ্ঞানের গভীর জ্ঞান যাচাই করা হবে। আমার থিসিসের বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক খুঁটিনাটি আলোচনা করা হবে। ইতোমধ্যে একটি বেসরকারি কলেজে লেকচারার হবার জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছি। সেখানেও লিখিত, মৌখিক, ডেমনস্ট্রেশন – মোট তিন ধাপের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হবার জন্য যে ইন্টারভিউ সেখানে নিশ্চয় আরো অনেক গভীর অর্থবহ ধাপ অতিক্রম করতে হবে। পুরো একটা সপ্তাহ ধরে নিজেকে তৈরি করলাম নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে কী কী যোগ্যতা থাকা চাই – সে ব্যাপারে নিজস্ব কিছু মতামতও তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের স্বরূপ কী হওয়া উচিত – তা আমাদের শিক্ষকরা হয়তো ভালো জানেন। কিন্তু তাঁদের আচরণে কিংবা পাঠদানে তার প্রতিফলন পাইনি তেমন একটা। শিক্ষার্থীর চোখ দিয়ে না দেখলে অনেক জিনিস বোঝা যায় না। আমাদের শিক্ষকরা শিক্ষক হয়েই ভুলে যান যে তাঁরাও একসময় শিক্ষার্থী ছিলেন। এই ভুলটা আমি কখনো করবো না। শিক্ষকের কাজ যে শুধু শেখানো নয়, আবার নতুন করে শেখাও – সেটা আমি বুঝতে পেরেছি।

জীবনে প্রথমবার ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে ঢুকার সুযোগ হলো। মূল অফিসে ঢুকার আগে একটা মাঝারি আকারের বসার ঘর। সেখানে চারপাশের দেয়াল ঘেঁষে বেশ কিছু চেয়ার আর ছোট ছোট সোফা রাখা আছে। ভেবেছিলাম আমিই সবার আগে এসে পড়েছি। কিন্তু না, অঞ্জন চৌধুরি মানে অঞ্জনদা আরো আগে এসেছেন। আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বললেন, “তুমিও এসে পড়েছো? ইউনিভার্সিটির ইন্টারভিউর হাতেখড়ি হবে আজ তোমার।“ 

মনে হচ্ছে অঞ্জনদা এর আগেও ইন্টারভিউ দিয়েছেন। জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের তত্ত্বাবধানে এমফিল করেছেন তিনি। পয়েন্টের দিক থেকে তিনি অনেক এগিয়ে। ইন্টারভিউতে তাঁর সাথেও আমার প্রতিযোগিতা করতে হবে ভেবে একটু অস্বস্তিও লাগছে। একটু পর আরো অনেকে আসতে শুরু করেছেন। অপরিচিত অনেকজন। পরিচিতদের মধ্যে রফিকভাইকে দেখলাম। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রভাই হিসেবে আমি তাঁকে চিনি, তিনি আমাকে চেনেন না। হারুন রুমে ঢুকে আমার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে বের হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরে ফিরে এলো নুরুল ইসলামস্যার আর সোবহানস্যারের সাথে। সোবহানস্যার আর নুরুল ইসলামস্যার রুমের ভেতর দিয়ে হেঁটে মূল অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন।

ভিসিস্যারের রুমে ঢোকার আরো অনেক পথ আছে সম্ভবত। কারণ এখানে আসার পর শুনেছিলাম ভিসিস্যার তখনো আসেননি। একটু আগেই বলতে শুনলাম ভিসিস্যার এসে গেছেন। কোন্‌ দিক দিয়ে এলেন দেখতে পাইনি।

ইন্টারভিউ শুরু হলো। শুরুতেই অঞ্জনদার ডাক পড়লো। তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

আমার ধারণা ছিল কমপক্ষে ঘণ্টাখানেক লাগবে একেকজনের ইন্টারভিউ শেষ হতে। কিন্তু পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যেই বের হয়ে এলেন অঞ্জনদা। ডাক পড়লো আমার।

ভিসিস্যারের অফিসরুমটা বিশাল। আমি রুমে ঢুকেই হাত তুলে সালাম দিয়ে মনে হলো স্যাররা এত দূরে বসে আছেন যে সালাম ঠিকমতো পৌঁছায়নি তাঁদের টেবিলে। চার জনের ইন্টারভিউ বোর্ড। ভিসি রফিকুল ইসলাম চৌধুরিস্যার, আমাদের নুরুল ইসলামস্যার এবং সোবহানস্যার। আর এক্সটার্নাল হিসেবে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর শামসুল হক। বসার আদেশ পেয়ে বসলাম তাঁদের সামনে চেয়ারে। প্রত্যেকের হাতেই আমার দরখাস্তের ফাইল। ভিসিস্যার ফাইল দেখতে দেখতে বললেন, “এসএসসি ফার্স্ট ডিভিশন, এইচএসসি ফার্স্ট ডিভিশন, অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড – বাহ্‌ ভেরি গুড। তোমাকে তো আমার মনে আছে। তোমাদের ফেয়ারওয়েলে তোমার কথাগুলি আমার খুব ভালো লেগেছিল। তোমার চিন্তাভাবনা খুব পজিটিভ। তোমাকে তো আমাদের দরকার।“

ভিসিস্যারের কথা শুনে আমার মাথার ভেতর স্বপ্নের পায়রাগুলি ডানা মেলে উড়তে শুরু করলো। মনে হলো স্বপ্নলোকের চাবি আমার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কিন্তু সোবহানস্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে দমে গেলাম। সোবহানস্যার গম্ভীরমুখে বললেন, “আমাদের আরো ক্যান্ডিডেট আছে স্যার।“

সোবহানস্যারের কথা শেষ হবার আগেই প্রফেসর শামসুল হক বললেন, “আপনার পোস্ট তো আছে মাত্র দুইটা। দরকার বলে তো সবাইকে আপনি রাখতে পারবেন না।“

ভিসিস্যার আর কোন কথা বললেন না। শামসুল হকস্যার বললেন, “দ্যাখো, এমএসসিটা আসলে তেমন কোন ডিগ্রি নয়। এমফিল করো, পিএইচডি করো – তারপর ট্রাই করো।“

মাথার ভেতর স্বপ্নের পায়রাগুলি ততক্ষণে আর্তনাদ করতে শুরু করেছে। সোবহানস্যার প্রশ্ন করলেন, “এমএসসিতে তোমার কী কী সাবজেক্ট ছিল?” বুঝতে পারছিলাম না স্যার আমার সাথে মজা করছেন কি না। কী কী সাবজেক্ট ছিল তা আমার মার্কশিটে লেখা আছে। স্যার নিজে আমাদের পড়িয়েছেন। কিন্তু যেকোনো প্রশ্নই প্রশ্ন। উত্তর দিলাম। নুরুল ইসলামস্যার একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। সোবহানস্যার বললেন, “ঠিক আছে, যাও।“

পাঁচ মিনিটেই শেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হবার ইন্টারভিউ। আমি জানতাম চাকরিপ্রার্থীদের জন্য বিভীষিকার অন্য নাম নিয়োগ পরীক্ষা। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কত রকমের পরীক্ষা দেয়ার পর চাকরি জোটে। বিসিএস পরীক্ষার কথাই ধরা যাক – প্রিলিমিনারি, লিখিত, মনস্তাত্ত্বিক, মৌখিক, স্বাস্থ্য, পুলিশ-চেক ইত্যাদি অনেকগুলি ধাপ পার হতে হতে অনেক সময় বছর পেরিয়ে যায়। বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও কত রকমের ইন্টারভিউ দিতে হয়। শাহীন কলেজের মতো একটা উচ্চমাধ্যমিক কলেজের লেকচারার হবার জন্যও কত দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে। আর এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার জন্য ইন্টারভিউতে আমাকে একটি মাত্র প্রশ্ন করা হলো – “এমএসসিতে তোমার কী কী সাবজেক্ট ছিল?” এরকম চরম একটা প্রহসনের ভেতর দিয়ে নিজে না গেলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না যে এরকমই হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে স্বায়ত্ত্বশাসন দেয়া হয়েছিল নিশ্চয়ই কোন মহৎ উদ্দেশ্যে। জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরিতে যেন অহেতুক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সৃষ্টি না হয় – সেজন্য। কিন্তু তার সুযোগে যে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়েছে তার শেষ কোথায় জানি না। স্বপ্নভঙ্গ হবার পরে মনে হচ্ছে প্রামাণিকস্যার ঠিক কথাই বলেছিলেন।

সময় থেমে থাকে না। নতুন দিন আসে। দু’দিন পর শাহীন কলেজ থেকে নিয়োগপত্র পেলাম। জীবনের প্রথম যে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি – সেই চাকরির নিয়োগপত্র পেয়েছি। শাহীন কলেজের নিয়োগকর্তারা আমাকে যোগ্য মনে করেছেন। এবার আমারই দায়িত্ব যোগ্য হয়ে ওঠা। নভেম্বরের চৌদ্দ তারিখ শাহীন কলেজে যোগ দিলাম। শিক্ষক পদে যোগ দিলেই সত্যিকারের শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের সাথে নতুন করে শিখতে শিখতেই শিক্ষক হয়ে ওঠার সাধনা করতে হয়। বছর শেষে পরীক্ষায় পাস করলেই শিক্ষার্থীদের কাজ শেষ। একই ক্লাসের পড়া তাদের আর পড়তে হয় না। কিন্তু শিক্ষকদের সেই সুযোগ নেই। তাঁদের প্রতি বছরই নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে নতুন করে পড়তে হয়। আমি আবার নতুন করে উচ্চমাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞান পড়তে শুরু করলাম। তারপর শিক্ষক হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে করতে সাড়ে চার বছর কেটে গেছে শাহীন কলেজে। সেই কাহিনি অন্য কোথাও বলা যাবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায় ফিরে আসি। সেবার দুইটি পদে তিনজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি নিজেদের লোক থাকলে তাদের জন্য পদ তৈরি করা যায়। ইচ্ছে করলে একটি পদের বিপরীতে একাধিক লোক নিয়োগ দেয়া যায়। হারুনকে নেয়া হয়েছিল সেই সময়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান শামসুল হকের নিজের একজন প্রার্থী ছিলেন। সেই ওবায়েদ সাহেবকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। শুনেছি তিনি যোগ দিয়েই চলে গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর নগরে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার সম্পর্ক কি একটা ইন্টারভিউতেই শেষ হয়ে যাবে? অরুনস্যার অবশ্য সেরকমই উপদেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “মাথায় ঘিলু থাকলে আর এইমুখো হবি না। পারলে আমেরিকা চলে যা। ওখানে গিয়ে কুলিগিরি করাও ভালো।“

কিন্তু আমার মাথায় ‘ঘিলু’ খুব একটা নেই। আমি অরুনস্যারের পরামর্শ না মেনে দু’বছর পর  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হবার জন্য আবার দরখাস্ত করেছিলাম। তখন নুরুল মোস্তফাস্যার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। আবারো এক্সটার্নাল হয়ে এসেছিলেন প্রফেসর শামসুল হক। সেবার হারুন আর রফিকভাইয়ের সাথে আবার দেখা হয়েছিল। তাঁরা দু’জনই গিয়েছিলেন সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য। আমার ক্ষেত্রে আবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বিষয়ভিত্তিক কোন প্রশ্ন নেই। শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার খাতিরে সার্টিফিকেট মার্কশিটে চোখ বুলাতে বুলাতে উপদেশ দেয়া – ‘বিসিএস দাও, চেষ্টা করতে থাকো।‘

চেষ্টা করতেই থাকলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় এবং শেষবার ইন্টারভিউ দিলাম ১৯৯৬ সালে। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে দীর্ঘ একুশ বছর পর। আশা করেছিলাম পুরনো অনিয়মগুলি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি। সেবার সিলেকশান কমিটিতে প্রামাণিকস্যার ছিলেন। আমি সত্যিই আশা করেছিলাম ভালো কিছু হবে। হয়নি। পরে প্রামাণিকস্যার বলেছিলেন, "সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তোমার ধর্ম তো পরিবর্তন হয়নি।“

দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি ইন্টারভিউ দিয়েছি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ক্লাসমেটদের কয়েকজনের সাথে দেখা হয়েছিল। আনন্দ আর দীলিপও ইন্টারভিউ দিয়েছিল। কারোরই হয়নি। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে এতদূর থেকে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি দেখে ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষক হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “সহজ ব্যাপারগুলি কেন যে আপনারা বোঝেন না! একটু ভেতরের খবর নেবেন না? এসব ইন্টারভিউ হচ্ছে চাকরি রেগুলারাইজ করার জন্য।“

ভেতরের খবর কীভাবে পাওয়া যায় আমি জানি না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করেছিলাম। এটাই তো নিয়ম বলে জানতাম। এর ভেতর যে ভেতরের খবর নিতে হয় সেই খবর আমার জানা ছিল না।

আরেকজন তরুণ শিক্ষক আরো জোরে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “চিটাগং থেকে এসেছেন, ডক্টর ইউনুসের সুপারিশ নিয়ে আসেননি তো আবার? তাহলে তো আমাদের কপাল পুড়বে। হাহাহা।“ তখন সেখানে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপার্সন ছিলেন প্রফেসর আফরোজি ইউনুস। তিনি যে ডক্টর ইউনুসের স্ত্রী তা আমি জানতাম না। সেই শিক্ষকদের হাসিঠাট্টা আমার কাছে খুবই অপমানজনক মনে হয়েছিল। এই তরুণ লেকচারাররা কয়েক বছর পরেই প্রফেসর হয়ে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দন্ডমুন্ডের মালিক হবেন। এখনই তাঁরা যা করছেন, তখন যে কী করবেন ভাবতেই ভয় হচ্ছিল।  

দিন যায়, কিন্তু মাথার ভেতর থেকে প্রফেসর শামসুল হকের কথাগুলি যায় না। কথাগুলি মাথার মধ্যে পেরেকের মতো গেঁথে গেছে – ‘এমএসসিটা আসলে তেমন কোন ডিগ্রি নয়। এমফিল করো, পিএইচডি করো।‘ কিন্তু কীভাবে? দেশের বাইরে গিয়ে পিএইচডি করতে হলে স্কলারশিপ পেতে হবে। কীভাবে পাওয়া যায় স্কলারশিপ, কারা দেয় – কোনো ধারণা নেই। 

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>

<<<<<< আগের পর্ব

Tuesday, 29 March 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬৫

 



#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬৫

রবিঠাকুর কত সহজেই বলে দিয়েছেন - “সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি –“, কিন্তু সহজ হওয়া কি এতই সহজ? গত কয়েকদিন ধরে কী যে যাচ্ছে মনের ওপর- তাতে মনকে যতই বলি “ওরে মন, সহজ হবি” – মন তো সহজে মেনে নিচ্ছে না। গীতবিতানের পাতা উল্টে রবিঠাকুরের সহজ হবার মন্ত্র যতই পড়ি – সহজ হওয়া তো দূরের কথা, পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন জটিল হয়ে হচ্ছে। কী করবো বুঝতে পারছি না। “মন রে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যরে লও সহজে।“ – বুঝলাম। কিন্তু সত্যরে যে সহজে মেনে নেবো, সেই সহজ সত্যটা কী? আমি সেকেন্ড হয়েছি এটাকে সত্য জেনে আমি তো সহজে মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু প্রামাণিকস্যার যখন বললেন আমাকে সেকেন্ড করা হয়েছে তখন সহজ সত্য আর সহজ থাকলো না। বাধ্য হয়ে মেনে নেয়ার মধ্যে এক ধরনের অপমানবোধ থাকে। সেটাই যন্ত্রণা দিচ্ছে।

আগস্টের মাঝামাঝি প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপের রেজাল্ট দিয়েছে। কেউ ফার্স্ট ক্লাস পায়নি প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপে। প্রদীপ নাথ সেকেন্ড ক্লাস থার্ড হয়েছে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই সে কেডিএস গার্মেন্টস-এ কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছে। আমার রেজাল্ট বের হবার আগেই তার দুটো চাকরির অভিজ্ঞতা হয়ে যাচ্ছে। আমরা সেটা চৌধুরিহাটের চায়ের দোকানে বসে চা-মিষ্টিযোগে উদ্‌যাপন করেছি।

এরপর আমাদের রেজাল্ট যেকোনোদিন হতে পারে শুনতে শুনতে দু’সপ্তাহ কেটে গেলো। সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ বিকেলে আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে। ক্যাম্পাস থেকে সেই খবর নিয়ে এখলাস এলো আমার রুমে। আমি সেকেন্ড হয়েছি সেই কারণে তার ভীষণ মন খারাপ। কিন্তু এরকম কিছুর জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। সুতরাং সহজ সত্যকে সহজে মেনে নিতে খুব একটা সমস্যা হলো না। হারুন ফার্স্ট হয়েছে। আনন্দ, মইনুল, দিলীপ, আর প্রেমাঙ্করও ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। যীশু, রিনা আর অঞ্জনের জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তারা তিনজনই ফার্স্ট ক্লাস ডিজার্ভ করে। সেই যে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় যীশু সোবহানস্যারকে পাশ কাটিয়ে আগে উঠে গিয়েছিল – সেটারই কি খেসারত দিতে হলো তাকে?

পরদিন ডিপার্টমেন্টে গেলাম। চেয়ারম্যানের অফিসের সামনেই করিডোরে দেখা হয়ে গেলো এস-কে-সাহাস্যারের সাথে। তিনি বললেন, “এরকম তো হবার কথা ছিল না। মনে হচ্ছে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে।“ এসময় চেয়ারম্যান সোবহানস্যার বেরিয়ে এলেন তাঁর অফিস থেকে। একগাল হেসে বললেন, “তোমাদের তো রেজাল্ট দিয়েছে গতকাল। আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার রেজাল্টে। এসো ভেতরে এসো, কথা বলি।“

চেয়ারম্যানের অফিসে ঢুকতে কী এক অজানা কারণে গা ছমছম করে। গত সাত বছরে এই অফিসে একবারও ঢুকিনি। আজ প্রথম ঢুকলাম। অফিসে এখন কেউ নেই। সোবহানস্যার অফিসে ঢুকে তাঁর চেয়ারে না বসে কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে খুব উৎফুল্লভাবে বললেন, “তুমি অনার্সে ফার্স্ট হয়েছিলে, এবার সেকেন্ড হয়েছো। হারুন অনার্সে সেকেন্ড হয়েছিল, এবার ফার্স্ট হয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তোমাদের দু’জনের পয়েন্ট সমান। তোমাকে দরখাস্ত করতে বলেছিলাম, করেছিলে তো?”

“জ্বি স্যার।“

“গুড। এবার মার্কশিট নিয়ে রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে জমা দিয়ে বলো তোমার দরখাস্তের ফাইলে রেখে দিতে। বাকিটা আমি দেখবো।“

অলৌকিকতায় আমার বিশ্বাস না থাকা সত্ত্বেও সোবহানস্যারকে হাসিখুশি দেবদূতের মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তিনি আমার স্বপ্নপূরণের দেবদূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার চোখের সামনে। আমি ভুলে গেলাম যে যীশুর সেকেন্ড ক্লাস পাওয়ার পেছনে তাঁর হাত আছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই একজন মানুষ আরেকজন মানুষের ভালো-মন্দ বিচার করে। আমিও তাই করলাম। সোবহানস্যার আমাকে ডিপার্টমেন্টে নেবেন এরকম আভাস দিতেই আমি তাঁকে একেবারে দেবতার আসনে বসিয়ে ফেললাম।

এক সপ্তাহ পরে মার্কশিট হাতে পেলাম। তত্ত্বীয় পরীক্ষায় আমি যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক ভালো করেছি। অনার্সে পেয়েছিলাম ৬৫% নম্বর, এখানে পেয়েছি ৭১%। কিন্তু থিসিস আর ভাইভাতে যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক কম নম্বর পেয়েছি। হারুন যখন আমার মার্কশিট দেখতে চাইলো, আমিও তারটা দেখতে চাইলাম। তত্ত্বীয় পরীক্ষায় সে আমার চেয়ে ১৫ নম্বর কম পেয়েছে। কিন্তু থিসিসে আমার চেয়ে ১৮ নম্বর বেশি পেয়েছে। ভাইভাতেও তিন নম্বর বেশি পেয়েছে। এরকম হতেই পারে। দু’জন সম্পূর্ণ দুই বিষয়ে থিসিস করেছি – তাই এরকম হতেই পারে। তত্ত্বীয় পরীক্ষায় যেমন একই পরীক্ষক এক বিষয়ের সব খাতা দেখেন, সেরকম সবগুলি থিসিস যদি একই পরীক্ষক দেখতেন, তাহলেই নম্বরবন্টনে ন্যায্যতা থাকতো। এখন মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। তাছাড়া সোবহানস্যার তো বলেছেন, হারুন আর আমার সমান পয়েন্ট। ডিপার্টমেন্টে তো দু’জনেরই জায়গা হবে।

খুশিমনে প্রামাণিকস্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। রেজাল্ট বের হবার পরদিন যখন এসেছিলাম তখন তিনি ছিলেন না। এবার তাঁকে তাঁর অফিসেই পেয়ে গেলাম। তাঁকে বললাম সোবহানস্যার কী বলেছেন।

“তুমি কি বিশ্বাস করছো নাকি ওসব?”

“জ্বি স্যার, করছি।“

“কবে যে ম্যাচিওরিটি আসবে তোমার! ঐ সিলেকশান কমিটির মিটিং হবার কথা ছিল আট-নয় মাস আগে। এতদিন ধরে আটকে রেখেছে বিশেষ উদ্দেশ্যে – সেটা তোমাকে নেয়ার জন্য নয়। তোমাকে দরখাস্ত করতে বলেছেন যাতে পরে কেউ বলতে না পারে – অন্য কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শুধু শুধু অলীক স্বপ্ন দেখবে না। এরা কোন হিন্দুকে এখানে নিয়োগ দেবে না। তোমাকেও নয়, অঞ্জনকেও নয়। অঞ্জন এমফিল করেছে, তারপরও নয়।“

অঞ্জনদা মানে অঞ্জন কুমার চৌধুরি অনার্স মাস্টার্সে দুর্দান্ত রেজাল্ট করার পর জামাল নজরুল ইসলামস্যারের তত্ত্বাবধানে এমফিল করেছেন। তারপরেও তাঁর জায়গা হচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার স্বপ্নের বেলুন চুপসে যেতে শুরু করেছে। তবুও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারছি না স্বপ্নজাল থেকে।  বললাম, “কিন্তু সোবহানস্যার তো বলেছেন হারুন আর আমি দু’জনেরই সমান পয়েন্ট।“

“তুমি একটা বোকা। তোমাকে যে সেকেন্ড করা হয়েছে সেটা বুঝতে পারছো না? থিওরিতে এত নম্বরের ডিফারেন্স তোমাদের। তারপরেও!”

“আমার থিসিসের নম্বর কমানো হয়েছে?”

“না, তারটা বাড়ানো হয়েছে।“

মনটা খারাপ হয়ে গেলো খুব। প্রামাণিকস্যার না জেনে কথা বলার মানুষ নন। কিন্তু এখানে মন খারাপ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আমি প্রমাণ করতে পারবো না কিছুই। প্রতিযোগিতায় হেরে গেলেই মানুষ বিচারব্যবস্থার ত্রুটি বের করে। এই ক্ষেত্রেও সেটাই বলা হবে। সেটা শুনতে আরো খারাপ লাগবে। মেনে না নেয়ার কোনো উপায় নেই।

তবুও ক্ষীণ আশা জেগে থাকে মনের কোণে। মার্কশিটের আটটি কপি নিয়ে গেলাম রেজিস্ট্রার অফিসে। ডেপুটি রেজিস্ট্রারের অফিস সহকারী ইউসুফ সাহেব হৃষ্টপুষ্ট মানুষ। তাঁর সহকর্মী ইব্রাহিম সাহেব তুলনামূলকভাবে চিকন। দু’জন পাশাপাশি টেবিলে বসে গল্পগুজব করছিলেন। আমি কী কারণে এসেছি শুনে বললেন, “বসেন বসেন। বাড়ি কোথায় আপনার?”

“বাঁশখালী”

“চিটাগাইংগা নে? আঁর বাড়ি দোহাজারি।“ – ইব্রাহিম সাহেব বললেন।

ইউসুফ সাহেব আমার মার্কশিটগুলি হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে খুবই উদাসীনভাবে বললেন, “ফাইল তো অনেক দূরে আছে। খুঁজে বের করতে তো চা-পানি লাগবে।“

চা-পানি খাওয়ার টাকা চাচ্ছেন? ঘুষ? বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির দরখাস্তের সাথে একটি মার্কশিট যোগ করার জন্য ঘুষ দিতে হবে?

পকেট থেকে বিশ টাকার একটি নোট বের করে টেবিলে রাখতেই ইউসুফ সাহেব হাত বাড়িয়ে ওটা নিতে গিয়ে হাত সরিয়ে নিলেন।

“মাত্র বিশ টাকা দিলেন? জানেন, আপনার দরখাস্তের ফাইল যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, আপনাকে ইন্টারভিউতেও ডাকা হবে না। কখন সিলেকশান হয়ে যাবে আপনি জানতেও পারবেন না।“

ইউসুফ সাহেব প্রচ্ছন্নভাবে আমার দরখাস্ত গায়েব করে দেয়ার হুমকি দিয়ে নির্লজ্জভাবে হাত পেতে বসে আছেন চোখের সামনে। মাথার ভেতর কেমন যেন যন্ত্রণা হচ্ছে। সরাসরি ঘুষ দেয়ার লজ্জাজনক হাতেখড়িও আমার এই বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশ টাকার নোট দেয়ার পর সেটার সাথে বিশ টাকার নোটটাও টেনে নিতে নিতে বললেন, “অঁনে চিটাগাইংগা মানুষ বলি লইলাম দে। নইলে একশ টেঁয়ার কম ন লই।“ এক শ’ টাকার কম ঘুষ তিনি খান না এটা বলার সময় তাঁর ভেতর একটা গর্বের ভাব দেখা গেলো, যেন ঘুষ খাওয়া খুব অহংকারের বিষয়।

রেজাল্ট যখন বের হয়ে গেছে – বেকারের সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি এখন পূর্ণবেকার। কিন্তু কোচিং সেন্টারের ক্লাস আর একটা টিউশনি থেকে যা উপার্জন হচ্ছে এখন তাতে আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে দরখাস্ত করে ফেলেছি অনেক জায়গায়। সিভিল এভিয়েশানে, স্পারসোতে, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে। কিন্তু এগুলির পরীক্ষা কখন হবে জানি না।

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যীশু চলে গেল সৌদি আরবে। প্রদীপ নাথের সাথেও খুব একটা দেখা হয় না। সে এখন শহরে থাকে। কেডিএস গার্মেন্টস-এ ভোরে কাজে ঢোকে, সন্ধ্যায় বের হয়। এরপর আর শক্তি থাকে না ঘুরে বেড়ানোর।

আমি শহরে ব্যাচেলর বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছি, পাচ্ছি না কোথাও। অঞ্জনরা এখন দিদার মার্কেটের ওদিকে থাকে। সময় পেলে মাঝে মাঝে তার বাসায় যাই। কিছুক্ষণ গল্প করি। তবে সেই আড্ডাও বন্ধ হয়ে গেল তার চাকরি পাবার পর। এখন সে কম্পিউটার কোম্পানি – ডেস্কটপে যোগ দিয়েছে। আগ্রাবাদে অফিস তার।

সবাই চাকরি করছে, আমি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠতে থাকি। বাড়িতে গিয়েছিলাম কয়েক দিনের জন্য। বাবা বলেছেন, “চিন্তা করিস না, চাকরি একটা হয়ে যাবে কোথাও না কোথাও।“ পুত্রের জন্য পিতার স্বাভাবিক শুভ কামনাযুক্ত বাক্য এটা। কিন্তু আমি কবিগুরুর ”সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন সহজ হবি” মন্ত্র ভুলে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছি। তাই বাবার সহজ বাক্যের জটিল অর্থ করে বসে আছি। আমার মনে হচ্ছে বাবা চাচ্ছেন আমার যেন কোথাও না কোথাও দ্রুত একটা চাকরি হয়ে যায়। তার মানে আমার বেকার থাকা চলবে না। আমি আরো অস্থির হয়ে উঠতে থাকি।

বিএএফ শাহীন কলেজে ফিজিক্সের লেকচারার নেবে। এয়ারপোর্টের কাছে এই কলেজ। শাহীন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছিলাম কয়েকবার। এই কলেজটি তারই আশেপাশে। অক্টোবরের শুরুতে সেই কলেজে গিয়ে দরখাস্ত জমা দিয়ে এলাম। অক্টোবরের নয় তারিখ কলেজে ইন্টারভিউ দিয়ে এলাম। অনেক দীর্ঘ ইন্টারভিউ। লিখিত পরীক্ষা হলো। তারপর ক্লাসে পড়ানোর পরীক্ষা। এরপর মৌখিক পরীক্ষা। ইংরেজিতে মৌখিক পরীক্ষা, কী বলতে কী বলেছি জানি না। কলেজটি বাংলা মাধ্যমের। কিন্তু শিক্ষকদের নিয়োগ পরীক্ষায় ইংরেজিতে কেন কথা বলতে হলো বুঝতে পারছি না। বিমান বাহিনীর কলেজ, ভাবসাবই আলাদা।

পরের সপ্তাহে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। তাদেরও ফিজিক্সের লেকচারার দরকার। সেখানেও নিজে গিয়ে দরখাস্ত জমা দিয়ে এলাম। ভাইস-প্রিন্সিপাল দরখাস্ত জমা নেয়ার সময় জানালেন যে আমাদের হারুন সেখানে ইতোমধ্যে অস্থায়ীভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছে। হারুনের চাকরিও হয়ে গেছে। আমি আরো অস্থির হয়ে উঠতে থাকি।

ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ইণ্টারভিউর চিঠি পেয়ে আমার অস্থিরতা চরমে উঠলো। চিঠি এসেছে ইন্টারভিউ হয়ে যাবার দু’দিন পর। ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুরাদপুরে দিদির অফিসে চিঠি আসতে একদিনের বেশি লাগার কথা নয়। সেক্ষেত্রে এক সপ্তাহ আগের তারিখ দেয়া চিঠি এতদিন পরে এলো! পোস্ট অফিসের সিল দেখে বুঝতে পারলাম – চিঠি পোস্ট করা হয়েছে ইন্টারভিউ হয়ে যাবার পর। যে এই কাজটি করেছে – এমনভাবে করেছে যেন আমি কোনভাবেই ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে ইন্টারভিউ দিতে না পারি। তার মানে কেউ বা কারা আমাকে চেনে এবং আমার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভয় পাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি এই মানুষটাকে চিনতে পেরেছি। এতটা নিচে নামার দরকার ছিল না তার।

<<<<<<<<< আগের পর্ব

Saturday, 19 March 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬৪

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬৪

কর্মজীবীদের যেমন শ্রেণিবিভাগ আছে, যারা বেকার তাদেরও নিশ্চয় শ্রেণিবিভাগ আছে। ক্যাডারভিত্তিক কর্মজীবীদের শ্রেণিবিভাগ মোটামুটি সহজ। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মজীবী। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির যাঁরা তাঁরা কর্মকর্তা। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির যাঁরা তাঁরা কর্মচারী। প্রথম শ্রেণির কর্মচারী কিংবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা – কেন বলা হয় না জানি না। বেকারদের ক্ষেত্রে এই শ্রেণিবিভাগ কী রকমের হবে? প্রথম শ্রেণির বেকার, দ্বিতীয় শ্রেণির বেকার, তৃতীয় শ্রেণির বেকার ইত্যাদি? এই শ্রেণিবিভাগ কীভাবে করা হবে? অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, নাকি কে কতদিন ধরে বেকার আছে তার ভিত্তিতে? বেকারত্বের অভিজ্ঞতা কীভাবে মাপা হবে? 

বেকারত্বের শ্রেণিভেদ অনুযায়ী আমি কোন্‌ শ্রেণির বেকার এখনো বুঝতে পারছি না। তবে যেসব কর্মজীবী মাসশেষে বেতন পাবার গর্বে স্ফীত হয়ে “বেকারদের আবার সময়ের অভাব!” জাতীয় তির্যক বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেন  – তারা যে ঠিক বলেন না তা বুঝতে পারছি। পুরনো বেকারদের কথা জানি না, কিন্তু আমার মতো নতুন বেকারদের সময়ের সত্যিই অভাব। আমি এখন সিনেমা দেখার সময়ও পাচ্ছি না – এই ব্যাপারটা নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অথচ ক’দিন আগেও পরীক্ষার সময়গুলিতেও হলে গিয়ে সিনেমা দেখে আসতে পারতাম। 

এখন দিন শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সকাল সাতটার আগেই আক্কাস এসে হাজির হয়। আমি এই বিল্ডিং ছেড়ে চলে যাবার আগেই সে ফিজিক্স শেষ করে ফেলার প্রতিজ্ঞা করেছে। তার জেদ দেখে ভালোই লাগছে। 

আটটায় তাকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ছি নন্দীর হাটের উদ্দেশ্যে। সেখানে রেললাইনের পশ্চিম দিকের পাড়ায় একটা টিউশনি গছিয়েছে অসীম। ক্লাস নাইনের তিনজন মেয়েকে অংক করানোর কথা ছিল। কিন্তু প্রথমদিন যাবার পরে দেখা গেলো বাড়িতে যত ছেলেমেয়ে আছে সবগুলি এসে লাইন ধরে বসে গেছে বারান্দায়। সর্বকনিষ্ঠটি সবে বর্ণমালা শিখছে। ছয় বোনের ওটিই একমাত্র ভাই। বড় তিনজন এক ক্লাসেই পড়ছে। কে কোন্‌ ক্লাসে আটকে গিয়ে তারা একজোট হয়েছে জিজ্ঞেস করিনি। তাদের বয়স বাড়ছে, কিন্তু অপুষ্টির কারণে স্বাস্থ্য কিংবা মেধা কোনটারই বিকাশ হচ্ছে না। তাদের পিতার কথাবার্তা শুনে মনে হলো শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছেন তিনি। কন্যাদেরকে কোনরকমে এসএসসি পরীক্ষায় বসাতে পারলেই তাঁর কাজ শেষ। পাস-ফেল যাই করুক – বিয়ে দিয়ে দেবেন। তাহলে এখানে আমার ভূমিকা কী? পাস অপ্রয়োজনীয় হলে তো মাস্টারের দরকার হয় না। জিজ্ঞেস করার আগেই উত্তর পাওয়া গেলো – “আপনি শুধু আমার ছেলেটাকে বিশেষভাবে দেখবেন। ওটাই আমার বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।“ পিতার এ কথা শুনে ছয়কন্যা মুখ কালো করে বসে রইলো, আর বংশের মুখ উজ্জ্বল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিশুটি তার নাসিকানির্গত তরল হাতে মাখিয়ে হাতটা বইয়ের পাতার অ-তে ঝুলন্ত অজগরের গায়ে মুছে ফেললো।

প্রথমদিনের পরেই এখানে আর যাচ্ছি না বলে দেয়ার জন্য অসীমকে খুঁজছি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সে কিংবা ইলোরা-মিতু-দীলিপ কেউই আসছে না। হয়তো পরীক্ষা আছে বা অন্যকিছু। 

সপ্তাহে তিন দিন বিকেল তিনটা থেকে কর্নিয়া কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে যাই। সেজন্য দুপুরের আগেই বের হয়ে যাই। ফতেয়াবাদ থেকে তিন নম্বর বাসে উঠে চকবাজার গিয়ে নামি। হোটেলে ভাত খেয়ে পাঁচলাইশে কোচিং সেন্টারে যাই। মেডিকেল অ্যাডমিশানের এই কোচিং সেন্টারটি দিয়েছে মেডিকেলের কয়েকজন ছাত্র। তাদের মধ্যে দু’জন – সুজন ও ভাগ্যধন আমার খুবই স্নেহভাজন। রেটিনার সাথে পাল্লা দেবার জন্য তারা কর্নিয়া নাম দিয়ে কোচিং সেন্টার শুরু করেছে। ফিজিক্সের কয়েকটি ক্লাস নিতে পারবো কি না জিজ্ঞেস করতেই আমি সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছি। প্রথমদিন ক্লাস নিতে গিয়েই বলে দিয়েছি আমি মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় তিন বার ফেল করেছি। তাতে সারাক্লাস হো হো করে হেসেছে। আমার বেশ মজা লেগেছে। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক দেয়া হবু-ডাক্তারদের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের অলিতে গলিতে ঘুরতে বেশ ভালো লাগছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য সাজেস্টিভ পড়াশোনা করলেও এখন ভর্তি পরীক্ষার বহুনির্বাচনী পরীক্ষার জন্য সবকিছু পড়তে হচ্ছে। সুতরাং এখানে যে অনাগ্রহ দেখাবে সে পিছিয়ে পড়বে। তাই সবাই চোখ বড় বড় করে শুনছে আমি কী বলছি। মনে হচ্ছে মাস্টারি ব্যাপারটা আমি পছন্দ করতে শুরু করেছি।  

আজ কর্নিয়ায় যেতে হবে না। দুপুরটা হাতে আছে। বিকেলটাও। বিকেলে প্রদীপ নাথের সাথে একটা ব্যাচেলর বাসা দেখতে যাবার কথা ছিল। চট্টগ্রাম শহরে ব্যাচেলর বাসা পাওয়া খুবই মুশকিল। এখানে-সেখানে মেস আছে অনেক। কিন্তু আমি চাচ্ছি নিজের মতো স্বাধীনভাবে থাকার জন্য এক রুমের একটা বাসা – যেখানে বাথরুম শেয়ার করতে হবে না। নাথের এক আত্মীয় নালাপাড়ার ওদিকে একটা বাসার খোঁজ দিয়েছিল। বিকেলে সেখানে খোঁজ নিতে যাবার কথা ছিল। কিন্তু সকালে টিউশনি থেকে এসে রুমে ঢুকে প্রদীপ নাথের চিরকুট পেলাম। সে এসে আমাকে না পেয়ে চিঠি লিখে গেছে। বাসাটি আমরা দেখতে যাবার আগেই ভাড়া হয়ে গেছে। সুতরাং আর যাবার দরকার নেই। 

শহরে বাসা পাওয়া মুশকিল। কিন্তু পেলেও যে ভাড়া দিতে হবে, সেই ভাড়া জোগানোর সামর্থ্য আমার এই মুহূর্তে নেই। সামর্থ্য বাড়াতে হবে। মাসে আট নয়শ টাকার কমে কোন রুম পাওয়া যাবে না। এই মুহূর্তে আমার উপার্জন ধরতে গেলে কিছুই নেই। টিউশনির টাকা পাবো মাস শেষ হলে। কোচিং সেন্টারে তিনটি ক্লাস নিয়ে তিন শ টাকা পেয়েছি। এটা নিয়মিত করতে পারলে হয়ে যাবে। পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলেই চাকরির দরখাস্ত করছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দরখাস্তের সাথে দেড়শ দুশ’ টাকার পোস্টাল অর্ডার পাঠাতে হচ্ছে। একজন পূর্ণবেকারের পক্ষে এই টাকা জোগাড় করা খুব কঠিন কাজ। চাকরির দরখাস্তের সাথে টাকা নেয়ার নিয়মটা বাতিল হওয়া দরকার। কিন্তু এই নিয়মটা নিশ্চয় চালু আছে অনেক বছর আগে থেকে। অনেক আগেই হয়তো অনেকে ভেবেছিলেন এটা বাতিল হওয়া দরকার। যারা ভেবেছিলেন তাঁরাই হয়তো এখন এসব অফিসের বড়কর্তা যাঁরা ইচ্ছে করলেই এই নিয়ম বাতিল করতে পারতেন। কিন্তু মানুষের স্বভাবই হয়তো এরকম – অর্থ, ক্ষমতা ও সামর্থ্য লাভ করার সাথে সাথে আমরা অতীত ভুলে যাই। 

অতীত ভুলে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। নিজেরা শিক্ষার্থী থাকার সময় যেসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, শিক্ষক হবার পর সেসব অনিয়ম দূর করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দূর করার কোন চেষ্টাই করেননি। শিক্ষকরা ইচ্ছে করলেই বিশ্ববিদ্যালয়কে সব অনিয়ম থেকে দূরে রাখতে পারতেন। অন্তত আমাদের সেশনজট থেকে মুক্ত করতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ – বিশেষ করে আমাদের শিক্ষকদের অব্যবস্থাপনার কারণে চার বছরের পড়াশোনা শেষ করতে আমাদের আট বছর লেগেছে। এর জন্য যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি দায়ি সেই দায়স্বীকারটা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় করছে না। অনার্সের সার্টিফিকেটে লেখা আছে ১৯৮৮ সালের অনার্স পরীক্ষায় আমি পাস করেছি। অবশ্য সেই পরীক্ষা যে ১৯৯০ সালে হয়েছে তা লেখা আছে সার্টিফিকেটে – কিন্তু কেন ১৯৯০ সালে হয়েছে তা লেখা নেই। ১৯৮৯ সালের মাস্টার্স পরীক্ষা যে ১৯৯৩ সালে হলো তার পেছনের কারণটাও লেখা থাকবে না। আমাদের যে চারটা বছর নষ্ট হয়ে গেছে – সেই চার বছরে আরেকটা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করা যেতো অন্য কোন দেশে। 

তিনটার দিকে অসীম এলো। তার বাম হাতে্র প্রায় পুরোটাই মোটা ব্যান্ডেজে জড়ানো। 

“তোমার হাতে কী হয়েছে? মুখেও তো লেগেছে দেখি।“

“ও কিছু না দাদা।“ হাসিমুখে আমার উৎকন্ঠা উড়িয়ে দেয় অসীম। তার মানে কী হয়েছে সে বলতে চাচ্ছে না। হয়তো শিবিরের হাতে মার খেয়েছে। নিজে থেকে না বললে হাজার বার জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। 

“আপনার জন্য একটা বাসা পেয়ে গেছি। চলেন আজ গিয়ে দেখে আসি।“

“তুমি যাবে এই অবস্থায়?”

“সমস্যা নেই, চলেন।“

অনেকদিন আগে অসীমকে একবার বলেছিলাম বাসার কথা। মনে রেখেছে সে। আমানত খান বিল্ডিং থেকে বের হয়ে ছরারকুল পর্যন্ত হেঁটে আসার সময় দেখলাম অসীম বেশ খোঁড়াচ্ছে। হয়তো তার পায়েও ব্যথা। নির্ঘাৎ মার খেয়েছে। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, কিছুই বলবে না। 

রিকশা করে ফতেয়াবাদ এসে তিন নম্বর বাসে কোতোয়ালির সামনে নেমে গেলাম। এদিকের গলির ভেতর সেই বাসা। অসীমের পিছু পিছু অলিগলি পার হয়ে একটা পাঁচ তলা ভবনের ছোট্ট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বাইরে জুলাই মাসের বিকেলেও কাঠফাটা রোদ। কিন্তু ভেতরে কেমন যেন আবছা অন্ধকার। অপ্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। অসীম বেল বাজালো। একটা পনেরো-ষোল বছরের থলথলে ছেলে এসে দরজা খুললো। 

“মাসীমা আছেন? বলো অসীম এসেছে।“

ছেলেটা ভেতরে চলে গেল। অসীম নিজের বাড়ির মতো করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ভেতরে। পুরনো আমলের বড় বড় আসবাবপত্রে ঠাসা বসার ঘর। দেয়ালে ঝুলছে বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি। অনুকুল ঠাকুরের একটা ছবিও দেখা যাচ্ছে হলুদ দেয়ালের এক পাশে। 

ভেতরের দিক থেকে মোটাসোটা একজন মহিলা রুমে ঢুকতেই “মাসীমা কেমন আছেন?” বলে অসীম প্রণাম করলো তাকে। 

“দাদাকে নিয়ে এসেছি বাসা দেখানোর জন্য।“ অসীম সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলো। কিন্তু দ্রুতই প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে আমার প্রশংসা শুরু করলো। একটা বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফল কে্ন উল্লেখ করতে হবে বুঝতে পারছি না। অসীম এত বেশি বাড়িয়ে বলতে শুরু করেছে যে আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না কার প্রসঙ্গে বলছে। মনে হচ্ছে স্বয়ং আইনস্টাইনকে সে নিয়ে এসেছে এই ভদ্রমহিলার বাড়িতে একটা রুম ভাড়া নেয়ার জন্য। 

ইচ্ছে হচ্ছিলো অসীমকে থামিয়ে দিয়ে বলি বাসাটা আগে দেখাতে। যদি এই বিল্ডিং-এরই একটা বাসা হয় – তাহলে তার ভাড়া হবে কমপক্ষে তিন হাজার টাকা। অসীম জেনেশুনে আমাকে এখানে নিয়ে এলো! নাকি এই বাসারই একটা রুম? 

অসীমকে খোঁচা দেয়ার পর সে থামলো। বাসা দেখার ব্যবস্থা হলো। নিচের তলায় খোলা একটা বারান্দার দুই পাশে দেয়াল তুলে রুমের আকার দেয়া হয়েছে। আলো-বাতাস নেই। প্রথম দর্শনেই অপছন্দ হবার মতো বাসা। ভাড়া নয় শ টাকা। আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু অসীমকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না তার পছন্দ হয়েছে কি না। অবশ্য তার পছন্দ-অপছন্দে কিছুই যায় আসে না। থাকবো তো আমি। 

দোতলায় উঠে আবার অসীমের মাসীমার সামনে কাঠের বেঞ্চে বসলাম। 

“আমার বাড়িতে বাসাভাড়া নেয়ার কিছু শর্ত আছে।“ – ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বর প্রাচীনকালের জমিদারদের মতো। ভারতীয় বাংলা সিনেমায় এরকম চরিত্র দেখা যায়। 

“রাত এগারোটার পর বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে যায়। কোন অবস্থাতেই রাত এগারোটার পর বাসায় ঢোকা যাবে না। বাসায় কোন মুসলমান আসতে পারবে না। বাসায় প্রাইভেট পড়ানো যাবে না। …” 

ভদ্রমহিলা আরো কী কী শর্তের কথা বলেন শোনার আর ধৈর্য হলো না। বললাম, “আপনার শর্তগুলির একটাও মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাসা দেখানোর জন্য ধন্যবাদ। নমস্কার।“

রাস্তায় বের হয়ে অসীমকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইনি তোমার কেমন মাসীমা?”

“বাসাতুতো মাসীমা।“

“মানে?”

“মানে বাসা খুঁজতে এসে মাসীমা ডেকেছি আরকি!” 

বাসা হলো না বলে অসীমের মনে একটু দুঃখ রয়ে গেলো বুঝতে পারছি। সে বললো, “আপনার জন্য একটা টিউশনিও জোগাড় করেছি।“

“নন্দীর হাটেরটা আমি আর করছি না।“

“আমি জানি আপনি করবেন না। কেউই করবে না ওটা। এখন যেটা বলছি সেটা ওরকম নয়। এখানে কাছেই। ক্লাস এইট আর ফাইভ। ইস্পাহানি স্কুল।“ 

অসীম নিয়ে গেল সেই বাসায়। বেশ অভিজাত বাসা। বিশাল ড্রয়িং রুম। দেয়ালের ঝুলছে কাবা-শরীফের বাঁধানো ছবি। যাদের পড়াতে হবে তারা বাসায় নেই। তাদের মা বেশ সমাদর করলেন। বললেন পরের দিন বিকেল থেকে শুরু করতে। ছেলে-মেয়েদের সাথে কথা বলে ঠিক হবে সপ্তাহের কোন্‌ চারদিন পড়াবো। 

এবার নন্দীর হাট আউট, পাথরঘাটা ইন। 

পরদিন বিকেলে গেলাম সেই বাসায়। ড্রয়িং রুমের এক পাশে ছোট্ট একটা টেবিলের একদিকে একটি চেয়ার, অন্যদিকে দুটি। ক্লাস ফাইভের ছেলে আর ক্লাস এইটের মেয়ে – চুপচাপ বসে আছে চেয়ারে। তাদের মা দরজা খুলে আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে – এরাই আপনার ছাত্রছাত্রী বলে উধাও হয়ে গেলেন। 

আমি কীভাবে শুরু করবো ভাবছি। ভাইবোন যেভাবে শক্ত হয়ে গম্ভীরভাবে বসে আছে, মনে হচ্ছে খুব ভয় পাচ্ছে আমাকে। বললাম, “আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।“

“আপনাকে ভয় পাচ্ছি কে বললো?” – মনে হলো পাথরের গলা থেকে বের হয়ে এলো কথাগুলি। ইস্পাহানি স্কুলের ক্লাস এইট মনে হচ্ছে ভীষণ স্মার্ট। স্মার্ট ছেলেমেয়েদের পড়াতে বেশ ভালোই লাগবে মনে হচ্ছে। 

পরদিন কর্নিয়ায় যেতে পারবো না বলে দিয়ে ইস্পাহানীর ফাইভ-এইটকে পড়াতে গেলাম। দরজা খুললো একজন অপরিচিত তরুণী। দেখলাম ড্রয়িং রুমের পড়ার টেবিলে ওরা ভাই-বোন পাশাপাশি বসে আছে। তাদের সামনের চেয়ারে বসে আছেন আরেকজন ভদ্রলোক। মনে হচ্ছে তিনি তাদের পড়াচ্ছেন। আমি কি একটু আগে এসে পড়লাম? 

তরুণী আমাকে দরজা খুলে দিয়েই ভেতরে চলে গেছেন। আমি ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কী করবো বুঝতে পারছি না। 

এমন সময় ছাত্রছাত্রীর মা এসে নিচু গলায় বললেন, “বাচ্চাদের টিচার কিছুদিন আসেননি বলেই আপনাকে রাখতে চেয়েছিলাম। এখন তিনি চলে এসেছেন। আপনাকে আর দরকার নেই।“ 

Monday, 14 March 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬৩

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬৩

মহাভারতের ভীষ্ম চরিত্রটিকে আমার বেশ লাগে। প্রচন্ড শক্তিধর এই মানুষটির জীবন ঘটনাচক্রে ট্র্যাজিক। এমন এমন পরিস্থিতির সামনে তাঁকে পড়তে হয় যখন তাঁর শক্তি, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা কিছুই তেমন কাজে আসে না। পান্ডবরা তাঁর প্রিয় হলেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষ নিয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে পান্ডবদের বিপক্ষে। তিনি এতই শক্তিশালী ছিলেন যে তাঁকে কিছুতেই পরাস্ত করা যাচ্ছিল না। শেষে তিনিই পান্ডবদের বলে দেন কীভাবে তাঁকে মারা যাবে। তাঁর দেখানো পথে অর্জুন তাঁকে বাণের পর বাণ মেরে রথ থেকে ফেলে দিয়েছিলেন। অর্জুন এত বেশি বাণ মেরেছিলেন যে ভীষ্মের শরীরের প্রতি ইঞ্চিতে তীর গেঁথে গিয়েছিল। রথ থেকে পড়ে গিয়েও ভীষ্ম মাটিতে পড়েননি, তীরের উপর ছিলেন। ওভাবেই শরশয্যায় তিনি ছিলেন আরো আটান্ন দিন। থিসিসের ভাইভা দিতে গিয়ে আমার ভীষ্মের কথাই মনে হচ্ছিলো বারবার। স্যাররা সবাই কেন যেন একেকটা অর্জুন হয়ে উঠেছিলেন। প্রশ্নের তীর-ধনুক নিয়ে অনবরত প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করেছেন যেদিক থেকে পেরেছেন।

আমার ধারণা ছিল থিসিসের ভাইভা হবে থিসিসের বিষয়ের উপর। আমি কী কাজ করেছি তা বলবো, তারপর স্যাররা সেই সংক্রান্ত প্রশ্ন করবেন, আমি উত্তর দেবো কিংবা আলোচনা করবো। সবচেয়ে ন্যায্য হতো যদি ভাইভার বদলে থিসিস প্রেজেন্টেশান হতো।

আমি কাজ করেছি কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল থ্রি পার্টিক্যাল সিস্টেম নিয়ে। পুরোটাই থিওরেটিক্যাল। অকথ্য লম্বা লম্বা সমীকরণ -  যেগুলি কোন রকমে লেখা যায়, কিন্তু মুখে উচ্চারণ করা যায় না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বাবাও নাকি কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝেন না। সেটা স্বাভাবিক, পিতার পক্ষে পুত্রকে বুঝতে পারা সহজ নয়। কিন্তু যাঁরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স আবিষ্কার করেছেন, অর্থাৎ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বাবারাই নাকি বলেছেন যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পুরোপুরি বোঝা সহজ নয়, সেক্ষেত্রে আমরা যদি কোয়ান্টাম মেকানিক্স মোটেও না বুঝি আমাদের দোষ দেয়া কি উচিত? যাই হোক, স্যাররা ইচ্ছেমতো ধোলাই করলেন আমাকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে শুরু করে পদার্থবিজ্ঞানের অলিগলি খুঁজে খুঁজে এমন সব প্রশ্নের তীর নিক্ষেপ করলেন – ভীষ্মের মতো আমারও সারা শরীরে প্রশ্নবাণ গেঁথে রইলো। প্রামাণিকস্যারের কাছে থিসিস করেছি – কোথায় তিনি আমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ষা করবেন – তা না করে তিনি নিজেই আক্রমণ করতে শুরু করলেন। প্রাচীন কালের গুরুরা নাকি এরকম করতেন - শিষ্যদের শিক্ষা পূর্ণ করার জন্য বাঘের মুখে ছেড়ে দিতেন। এতে শিষ্যের প্রাণ যায় তো যাক।

কোনোরকমে প্রাণ হাতে নিয়ে ফেরার সময় ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা বহিরাগত পরীক্ষক। “তোমার থিসিস কোন্‌ কাজে লাগবে?” আসলেই তো, পরীক্ষায় পাস করা ছাড়া আমার এই থিসিস আর কী কাজে লাগবে? এতে এমন কোন নতুন জিনিস নেই যা দেখিয়ে আমি বলতে পারি যে এটা একটা বিরাট আবিষ্কার! মাস্টার্সের মিনি থিসিস আসলে গবেষণার হাতেখড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই থিসিস করার সময় আমি জীবনের প্রথমবার ফিজিক্যাল রিভিউর পাতা উল্টিয়েছি। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির অসংখ্য বই ঘেঁটেছি যেগুলিতে আক্ষরিক অর্থেই ধুলো জমে ছিল। একই বিষয়ে কত শত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তা জার্নাল খুঁজে খুঁজে বের করার নিয়মকানুন কিছু শিখেছি। এটুকুই লাভ হয়েছে বলতে পারি। কিন্তু আর কী কাজে লাগবে? এক্সপ্যানসান অব নলেজ – গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। সেখানে খুব সামান্য হলেও কিছুটা ভূমিকা রাখবে।

বিচারালয়ে বিচারকের মুখ দেখে যেমন তাঁর সিদ্ধান্ত বোঝা যায় না, সেরকম মৌখিক পরীক্ষাতেও আমাদের স্যাররা কী এক অদ্ভুত কায়দায় মুখমন্ডল এমনই গম্ভীর করে রাখেন যে দেখে বোঝার উপায় থাকে না খুশি হলেন কি অখুশি।

মোবাশ্বেরস্যারের রুম থেকে বের হয়েই বুঝতে পারলাম – এখানে আমার আর কোন কাজ নেই। যীশুর ভাইভা আমার আগে হয়ে গেছে। সে অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। অঞ্জন, মইনুল, প্রেমাঙ্কর, দীলিপ, রিনা – এদের পরীক্ষা এখনো হয়নি। যীশু কারো জন্য অপেক্ষা করতে রাজি না।

“চল্‌ যাই গই” – তাগাদা দেয় সে।

আমার কেমন যেন যেতে ইচ্ছে করছে না। এতদিন অস্থির হয়েছিলাম কখন সবকিছু শেষ হবে। এখন শেষ হবার পর মনে হচ্ছে কেন শেষ হয়ে গেলো। চার বছরের জায়গায় সাত বছর লেগেছে বলে যে ক্ষোভ, যে হা-হুতাশ ছিল তা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।

যীশু তাগাদা দিচ্ছে, কারণ যীশুর গন্তব্য ঠিক হয়ে গেছে। তার সৌদি আরবের ভিসা হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে সে চলে যাবে। প্রদীপ নাথও কক্সবাজার চলে গেছে। কলাতলী চিংড়ি প্রজেক্টের অফিসার হয়ে এমন অনেক কাজ করছে যেগুলির সাথে পদার্থবিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমার এখনো কোনকিছুই ঠিক নেই। সম্ভবত সেই কারণেই ভালো লাগছে না।

সায়েন্স ফ্যাকাল্টি থেকে বের হয়ে ক্যাফেটোরিয়ার সামনে আসতেই দেখা হয়ে গেলো অনামিকাদের গ্রুপের সাথে। অনামিকা, প্রীতি, মুক্তি, মইনুল – সবাই মিলে জোর করে ক্যাফেটরিয়ায় নিয়ে গেল। যীশুর তাড়া আছে। সে চলে গেল। মুক্তি বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। এটা বিদায়ী খানা কিনা জিজ্ঞেস করলাম না। গত দুই বছরে এদের সাথে একটা স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে আর নিয়মিত আসা হবে না। এদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না তাও জানি না।

রুমে এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। টেবিলভর্তি বইপত্র গোছানো দরকার। অসীমদের আসার কথা আছে আজ। অসীম, ইলোরা, দীলিপ আর মিতু কয়েকদিন এসেছিল পদার্থবিজ্ঞানের কিছু বিষয় আলোচনা করতে। ভাইভা উপলক্ষে গত ক’দিন আসতে মানা করেছিলাম। আজ আসতে পারে। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না এখন। কী করা উচিত তাও ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

মানুষের নাকি স্বপ্ন থাকে। বড় হবার স্বপ্ন, কোন একটা জায়গায় পৌঁছে যাবার স্বপ্ন। আমার স্বপ্ন কী? কী হতে চাই আমি? কোথায় পৌঁছতে চাই? অনেক ভেবে দেখলাম - আমার নির্দিষ্ট কোন স্বপ্নই তৈরি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার ইষৎ একটা স্বপ্ন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে মাথার ভেতর, কিন্তু তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। কারণ বাস্তবতা বিবেচনা করে যতটুকু বুঝতে পারছি – তাতে সেই স্বপ্নলোকের চাবি আমার হাতে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।

দরজায় শব্দ শুনে দ্রুত উঠে গেলাম। সম্ভবত অসীমরা এসেছে। কিন্তু দরজা খুলে দেখি – আকর্ণবিস্তৃত হাসিমুখে প্রদীপ নাথ দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। মাত্র ক’দিন আগেই সে কক্সবাজার ফিরে গেছে। আবার ছুটিতে চলে এলো?

“কী রে, কখন এলি আবার?”

“চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।“ – হাসতে হাসতে বসতে বসতে বললো সে।

“কী বলিস?”

ঘটনা সত্যি। তার ম্যানেজার তার উপর বেশি খবরদারি করতে গিয়েছিল। সে তার মুখের উপর বলে এসেছে – “তোমার চাকরির ক্যাথা পুড়ি।“

আমি আবার অবাক হয়ে, অনেকটা ঈর্ষান্বিতভাবে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। আমি এখনো কোন চাকরির ইন্টারভিউই দিতে পারিনি। সে এরমধ্যে চাকরি করেছে, আবার সেই চাকরির ক্যাথাও পুড়িয়ে ফেলেছে।

পনেরোতম বিসিএস-এর ফরম ফিল আপ করার পরিকল্পনা করি দু’জনে। চতুর্দশ বিসিএস আমরা দিতে পারিনি। শিক্ষা ক্যাডারের স্পেশাল বিসিএস ছিল। আমাদের সিনিয়র ব্যাচের অনেকেই সরকারি কলেজের শিক্ষক হয়ে গেছেন এই বিসিএস পাস করে। কিন্তু আমাদের জন্য ওরকম কোন সুযোগ আসবে কি না জানি না।

আমানত খান বিল্ডিং-এর পাট গুটাতে হবে। চাকরিবাকরি খুঁজতে গেলে শহরে থাকাই উত্তম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কাজ যেহেতু শেষ হয়েছে, এখন এদিকে থাকার আর দরকার নেই। কিন্তু শহরে বাসা ভাড়া করার মতো একটা আর্থিক সঙ্গতি তো অর্জন করতে হবে আগে। পরীক্ষা শেষ করার পর বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে ইচ্ছে করছে না আর। ছোট্ট একটা দোকান থেকে বাবার আয় অত্যন্ত সীমিত। এখন দিনে দিনে খরচ যেভাবে বেড়েছে, আয় সেভাবে বাড়েনি। এখন আমার স্বাবলম্বী হওয়া উচিত।

যে কাজটি এখনই করতে পারি সেটা হচ্ছে টিউশনি। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু টিউশনি করেছি এতদিন। কিন্তু তাতে পড়ানোর আনন্দেই পড়িয়েছি, টাকা পয়সার দিকটা ভাবিওনি। ফতেয়াবাদ স্কুলের হেডমাস্টারের শালাকে পড়িয়েছিলাম তার উচ্চমাধ্যমিকের আগে। সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হয়েছে। খানসাহেব একদিন ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন ফতেয়াবাদ স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারের বাসায়। তাঁর ছেলেও উচ্চমাধ্যমিক দেবে। ফিজিক্স দেখিয়ে দিতে হবে। সেখানেও আনন্দ আছে অনেক, অর্থ নেই।

আক্কাস নামে এক ছেলে আছে এই বিল্ডিং-এ। দোতলায় থাকে। ঠিক কার ভাগনে জানি না, সবাইকে সে মামা ডাকে। পড়ে হাটহাজারি কলেজে। একদিন সকালে ফিজিক্স বই নিয়ে হাজির হয়েছিল আমার রুমে। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই আসে। পড়ার প্রতি আগ্রহ আছে অনেক, কিন্তু বুঝতে সময় লাগে। তাকে বলেছি আমি এই বিল্ডিং থেকে শীঘ্রই চলে যাচ্ছি। শুনে সে মুখ গোমড়া করে বলে, “মামা, অঁনে যাইবার আগদ্দি আঁর ফিজিক্স শ্যাষ গরাইয়েনে যাইবান্‌দে।“  

আক্কাসের জন্য কেমন যেন মায়া লাগে। ছেলেটাকে দেখলে ক্লাস সেভেন এইটের বেশি মনে হয় না। অপুষ্টির কারণেই হয়তো শরীর বাড়ার সুযোগ পায়নি। মগজের পুষ্টিও সেভাবে হয়নি। কিন্তু আগ্রহ আছে অনেক। যাবার আগে মাসখানেকের মধ্যে তার ফিজিক্স শেষ করানো কতটুকু সম্ভব হবে জানি না।

ইলোরারা এলো পরদিন বিকেলে। অসীম সকালে এসে জানিয়ে গিয়েছিল বিকেলে থাকার জন্য। ইলোরা আমার বন্ধু। এক ইয়ার ড্রপ করে আমাদের পরের ব্যাচে চলে গেছে। এখন সে অসীমদের সহপাঠী। অসীম, ইলোরা, দীলিপ, মিতু – এরা মাঝে মাঝে বিকেলে আমার রুমে এসে ফিজিক্স পড়ে। আমারও বেশ ভালো লাগে তাদের সাথে মাস্টার্সের যে বিষয়গুলি মাত্র কিছুদিন আগে পরীক্ষা দিয়েছি – সেগুলি নিয়ে আলোচনা করতে। বুঝতে পারছি – মাস্টারি করতে বেশ ভালোই লাগছে আমার।

মিতু খুব গোছানো স্বভাবের মানুষ। সে রুমে এসে টেবিলের বইপত্র আগে গোছায় – তারপর নিজের বইখাতা খোলে। অসীম যতটুকু পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তার চেয়েও বেশি গায়ক ও সংগঠক। সে সবাইকে সাথে করে নিয়ে আসে। অসীম যখন মাঝে মাঝে গলা খুলে গায় – অদ্ভুত ভালো লাগে।  

“তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই

কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই”

কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়তে পড়তে অসীম গলা খুললো। আমার মনে হচ্ছে জটিল ফিজিক্সের মাঝে মাঝে এরকম উদাত্ত জীবনের গান হলে – সব জটিলতাই কেটে যেতো। গানের মাঝেই দেখলাম আমার জানালার বাইরে একজন শিবিরকর্মী এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই চলে গেল। একটু পরে দেখি আরেকজন এসে উঁকি দিচ্ছে। তার চোখ মিতু আর ইলোরার দিকে ঘুরছে।

ওরা চলে যাবার সময় দেখলাম শিবিরের বেশ কয়েকজন ছেলে করিডোরে হাঁটাহাঁটি করছে। এদের সমস্যা হয়তো গান, হয়তো মেয়ে, হয়তো উভয়ই। পেছন থেকে তাদের মন্তব্য কানে এলো – “ব্যাচেলর মেসে মেয়ে আসা নিষেধ। কিছু হয়ে গেলে আমরা দায়ি নই।“

ওদের বাসে তুলে দিয়ে আসার সময় দেখলাম ছেলেগুলির একটাও নেই করিডোরে। সবগুলি ফার্স্ট ইয়ার বা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। এদেরকে খুঁজে বের করে মুখোমুখি হয়ে ঝগড়া করার রুচি হচ্ছে না। এড়িয়ে চললেও প্রশ্রয় দেয়া হয়। কিন্তু ওরা যদি ইলোরা বা মিতুকে অপমান করে বসে? মিতু কতটা শক্ত আমি জানি না, কিন্তু ইলোরা এতটাই নরম মনের মানুষ যে সমাজের কদর্য দিকটা সম্ভবত সে চোখেই দেখেনি কোনদিন। তার অধ্যাপক মা-বাবা হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ যত্ন দিয়ে বড় করেছেন তাঁদের মেয়েকে। সমাজে যে কতগুলি মানুষের মতো কীট আছে সে সম্পর্কে মেয়েকে সচেতন করেছেন কি না আমি জানি না। তার চেয়ে ওরা এখানে না এলেই ভালো হয়। বরং আমিই ক্যাম্পাসে গিয়ে তাদের সাথে বসবো।  

ফতেয়াবাদ স্টেশনের পেছনে একটা বাড়িতে মেস করে থাকে অসীমরা কয়েকজন। পরদিন খুব সকালে অসীমদের মেসে গেলাম। সব শুনে অসীম বললো, “ওদের কমেন্ট আমি শুনেছি দাদা। ওদের ব্যবস্থা আমি করবো।“ এবার আমি ভয় পেয়ে গেলাম। অসীম কী ব্যবস্থা করতে কী ব্যবস্থা করে কে জানে। সে রবীন্দ্রসঙ্গীত যেমন ভালো গায়, শুনেছি হাত-পাও ভালো চালায়। 

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>

<<<<<< আগের পর্ব

Friday, 11 March 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬২

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬২

“বিল ক্লিনটন আমেরিকার কততম প্রেসিডেন্ট বল্‌।“

মাসখানেক আগে বিল ক্লিনটন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন সেটা জানি, কিন্তু তিনি কততম প্রেসিডেন্ট সেটা তো জানি না। অজ্ঞানতার লজ্জা ঢাকতে তর্কের আশ্রয় নেয়ার প্রচলিত কৌশল অবলম্বন করে যুক্তি দেখালাম, “আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে আমাকে কেন জানতে হবে?”

“এখন তো এগুলিই জানতে হবে। জনতা ব্যাংকের পরীক্ষায় তো আর বোরের কোয়ান্টাম মডেল আসবে না। আসবে আজারবাইজানের রাজধানীর নাম, হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্টের নাম, কিংবা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কুকুরের নাম। এসব নামযপ করতে না পারলে নো চাকরি।“

প্রদীপ নাথের কথায় যুক্তি আছে। এরকম অদরকারি তথ্য মুখস্থ রাখতে পারলেই নাকি চাকরিলাভ হয়। আমানত খান বিল্ডিং-এর ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে সে। একটু আগে তৌহিদভাই ছাদে এসেছিলেন রোদে কাপড় মেলতে। রোজার মাস বলে তৌহিদভাইকে দেখে সিগারেট লুকিয়েছিল সে। তৌহিদভাই নেমে যাবার পর এখন আবার মুখে দিয়েছে। আমাদের জেনারেল ভাইভা যেদিন শেষ হয় – সেদিন চাকসু ক্যাফেটরিয়ার সামনের ভ্রাম্যমান সিগারেট-বালকের কাছ থেকে সিগারেট কিনে মুখে দিতে দিতে বলেছিল – “আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একাডেমিক লাইফের লাস্ট দিন, এই সিগারেটও আমার লাইফের লাস্ট সিগারেট।“ আমার চোখের সামনে ঘোষণা দিয়ে এরকম লাস্ট সিগারেট সে এর আগেও অনেকবার খেয়েছে। বার বার শপথ ভাঙে জানার পরেও আশা করেছিলাম এবার হয়তো কথা রাখবে। কিন্তু ক্যাম্পাস থেকে ফতেয়াবাদ আসার পরেই আবার সিগারেট ধরিয়েছিল। শপথের কথা মনে করিয়ে দেবার পর বলেছিল, “পরীক্ষা শেষের একটা আনন্দ আছে না? জীবনের শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম, তার মুখাগ্নি করতে হবে না?” সিগারেট খাওয়া যদি মুখাগ্নি করা হয়, তাহলে আর কিছু বলার থাকে না।

পরীক্ষা শেষের আনন্দের কথা বললেও মাস্টার্স পরীক্ষার পর আনন্দের চেয়ে উদ্বেগই বেশি হতে থাকে। পড়াশোনা শেষ করার পর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের একটা চাপ থাকে। এমনই একটা গৎবাঁধা পড়াশোনার পদ্ধতি আমাদের – কেউই ঠিকমতো জানি না আমরা কে কী কাজ করবো। চাকরির জন্য প্রথম যে দরখাস্তটা আমরা তিন বন্ধু মিলে করলাম – সেটা হলো জনতা ব্যাংকের অফিসার পদের জন্য। মার্চের এক তারিখে জিপিওতে গিয়ে রেজিস্টার্ড পোস্টে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছি। আড়াইশ টাকার পোস্টাল অর্ডার জমা দিতে হয়েছে দরখাস্তের সাথে। ব্যাংকের চাকরিতে পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান কী কাজে লাগবে জানি না।

কয়েক বছর আগেও  ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে ব্যাংকের অফিসার পদে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া যেতো। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিলাম – তখনো বিজ্ঞপ্তি দেখেছিলাম – প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফলে মেধার ভিত্তিতে প্রথম পাঁচজনকে সোনালী ব্যাংকের অফিসার পদে সরাসরি নিয়োগের ব্যাপারটা। আমরা পাশ করার আগেই সেই সুযোগ চলে গেছে।

একটু আগেই আমরা আলোচনা করছিলাম – ঠিক কখন থেকে আমাদেরকে বেকার বলা হবে। যীশু ও আমার এখনো থিসিস জমা দেয়া বাকি। তাই আমরা এখনও ছাত্র। সুতরাং আমাদের এখনো বেকার বলা যাবে না। প্রদীপ নাথের পরীক্ষা শেষ হলেও এখনো রেজাল্ট দেয়নি। সুতরাং সে-ও এখনো পূর্ণবেকার হয়নি।

রশীদুন্নবীস্যারের কাছে থিসিসের কাজ করছে যীশু। ইলেকট্রনিক্সের কাজে তার আগ্রহ অনেক। ইদানীং প্রায়ই স্যারের বাসায় যেতে হয় তাকে থিসিসের কাজে। ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলে আমার এখানে থেকে যায়।

আমি ইদানীং সারাদিন রুমে বসে থিসিস টাইপ করি। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের বড় বড় সমীকরণগুলি টাইপ-রাইটারে টাইপ করতে অনেক সময় লাগে। যীশুর মাধ্যমে রূপকের কাছ থেকে যে টাইপ-রাইটারটা এনেছিলাম সেটা ফেরত দিতে হয়েছে। বিপ্লবের প্রতিবেশী বন্ধু অপু আন্দরকিল্লায় টাইপ শিক্ষার স্কুলে কাজ করে। অপুর মাধ্যমে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড টাইপ-রাইটার কিনে এনেছি তিন হাজার টাকা দিয়ে। ওটার সাথেই এখন আমার বেশিরভাগ সময় কাটছে। এক একটা চ্যাপ্টার হাতে লেখা হলে প্রামাণিকস্যারের বাসায় গিয়ে স্যারকে দিয়ে আসি। স্যার দেখে দেয়ার পর টাইপ করতে বসি। অনেকগুলি চ্যাপ্টার অনেকবার করে লিখতে হয়েছে। এপ্রিলের সাত তারিখের মধ্যে থিসিস জমা দেয়ার কথা। তার আগেই আমার থিসিস রেডি হয়ে যাবে আশা করি।

আজও রুমে বসে টাইপ করছিলাম। যীশু আর প্রদীপ একসাথে ঢুকলো। তারপর এটাওটা গল্প করতে করতে প্রদীপ নাথের ধুম্রতৃষ্ণা নিবারণের জন্য ছাদে আসা। ছাদ থেকে নেমে রুমে আসার সময় সিঁড়ির কাছে সেলিমভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল।

“আমি তো তোমাকে খুঁজছিলাম।“

“ছাদে গিয়েছিলাম। কেন খুঁজছিলেন আমাকে?”

“এমনি, গল্প করার জন্য।“

সেলিমভাই এবারও পরীক্ষা দেননি। তবে কি আমাদের পরের ব্যাচের সাথে পরীক্ষা দেবেন? ছাত্রনেতা হতে গেলে সম্ভবত বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষা এড়িয়ে চলা বাধ্যতামূলক।

সেলিমভাই রুমে ঢুকলেন আমাদের সাথে।

“মাংসের গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে! রান্না করেছো নাকি?”

যীশু বাসা থেকে মাংস নিয়ে এসেছে। এখন ভাতটা বসিয়ে দিলেই দুপুরের খাবার হয়ে যাবে। বুঝতে পারছি সেলিমভাইয়ের জন্যও চাল নিতে হবে। বললাম, “আপনার তো রোজা।“

সেলিমভাই মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে একবার যীশু আর প্রদীপের দিকে তাকালেন। মুখে কিছুই বললেন না। ধর্মের ব্যাপারে রাজনীতির নেতারা খুব সতর্ক থাকেন। রোজা রাখেননি বললে যদি প্রতিবেশীরা কেউ শুনে ফেলেন! তিনি ঘরের ভেতর নিরবে গোপনে খাবেন, বাইরে গিয়ে রোজার ফজিলত ব্যাখ্যা করবেন।

“তোমার পরীক্ষা কেমন হলো? আবারো ফার্স্ট হতে পারবে তো?” সেলিমভাই আরাম করে খাটে বসে পা তুলতে তুলতে বলেন।

“জানি না।“

“তুমি তো কারো সাথে কোন কানেকশান রাখো না। কানেকশান না থাকলে তো কেউ তোমাকে চিনবে না।“

“স্যাররা আমাকে চেনেন বলেই তো সমস্যা।“

“তোমার ডিপার্টমেন্টের বাইরে আর কেউ তো তোমাকে চেনেন না। সিন্ডিকেট মেম্বার, সিনেট মেম্বার, ডিন, শিক্ষক সমিতির নেতা – সবার সাথে কানেকশান তৈরি করতে না পারলে তুমি ইউনিভার্সিটিতে কীভাবে ঢুকবে?”

“কানেকশান কীভাবে তৈরি করতে হয় তো জানি না।“

“সরাসরি তো কানেকশান তৈরি হবে না। মিডলম্যান কাউকে ধরতে হবে। জানাশোনা ছাড়া কি কিছু হয়? ডায়নামিক না হতে পারলে তো কিছুই পাবে না। এখন জামায়াত-শিবির-বিএনপি ইউনিভার্সিটি নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা ক্ষমতায় গেলে আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো। তোমার তো কোন দলের সাথেই কোন জানাশোনা নেই।“

সেলিমভাই যে ধরনের জানাশোনার কথা বলছেন সে ধরনের জানাশোনার প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই। এ জাতীয় কথাবার্তা শুনতে আমার বেশ বিরক্তিই লাগছে। প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বললাম, “আপনারা তো অনেক ডায়নামিক। খন্দকার মোশতাক যে দশ পার্টির নেতা হয়েছে সে ব্যাপারে আপনারা কী করছেন?”

বঙ্গবন্ধুর সাথে যে সবচেয়ে বেশি বেইমানি করেছে সেই খন্দকার মোশতাক এখনো সক্রিয়! ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম রোজার দিন দশটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স এর নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে খন্দকার মোশতাক। কী অদ্ভুত সময় এখন। একাত্তরের পরাজিত যুদ্ধাপরাধীরা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ। আর পঁচাত্তরের ঘাতকেরা বুক ফুলিয়ে নতুন রাজনৈতিক জোট তৈরি করছে। আমরা সাধারণ মানুষ বলেই হয়তো আমাদের এত ক্ষোভ জাগে। রাজনৈতিক নেতারা এসব ব্যাপারে বড়ই সহনশীল। হয়তো ভবিষ্যতে দেখা যাবে – রাজাকাররা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দেবে, আর নেতারা তাদের স্বীকৃতি দেবে।

“আমরা ক্ষমতায় গেলে দেখবা কী করি।“

সেলিমভাই ক্ষমতায় গেলে কী করবেন আমি জানি না। তবে আমাকে যে আর চিনতে পারবেন না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

দেশের ভেতর একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে ভেতরে ভেতরে। আমাদের উদারনৈতিক চেতনায় আস্তে আস্তে পরিকল্পিতভাবে দূষণ ঘটানো শুরু করেছে কিছু সংঘবদ্ধ মানুষ। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বাতিল করার লক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশেপাশের এলাকায় পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে। বাইশে এপ্রিল গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ অবৈধ ও আইনগত ক্ষমতাবহির্ভূত বলে ঘোষণা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরি। তার মানে গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার পথ পরিষ্কার। এদিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গোলাম আযমের বিচার করার দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে পুলিশ গিয়ে জাহানারা ইমামকে লাঠিপেটা করে আসে।

দিন দ্রুত চলে যেতে থাকে। থিসিস যথাসময়েই রেডি করে ফেলি। জমা দিতে গিয়ে জানতে পারি – সময় আরো বাড়ানো হয়েছে, মে মাসের তিরিশ তারিখের মধ্যে জমা দিলে হবে। এতদিন ডিপার্টমেন্টে যাইনি বলে জানতে পারিনি।

ডিপার্টমেন্টে গেলে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সেলিমভাই ঠিক কথাই বলেছেন – আমার তেমন কোনো জানাশোনা নেই কারো সাথেই। অন্য ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক তো দূরের কথা, আমার নিজের ডিপার্টমেন্টের অন্য ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথেও আমার তেমন কোন পরিচয় নেই। আমাদের পরের ব্যাচের মাত্র কয়েকজনকে আমি চিনি। এর পরের ব্যাচের কারো সাথেই আমার পরিচয় নেই। এতটা বছর একটা ক্যাম্পাসে কাটিয়ে দিলাম পর্যায় সারণির নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলির মতোই।

মে মাসের শেষে থিসিস জমা দেয়ার পর কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগতে শুরু করেছে সবকিছু। প্রদীপ নাথ কক্সবাজার চলে গেছে। সেখানে সে একটা চিংড়িচাষ প্রকল্পের কর্মকর্তা হয়েছে। এখনো তার রেজাল্টও বের হয়নি। পূর্ণবেকার হবার আগেই চাকরি পেয়ে গেছে। কক্সবাজার থেকে ছুটিতে এসেছিল কয়েকদিনের জন্য। তার সাথে কয়েকদিন ঘুরলাম। তার সাথে ভ্রমণের এখন একটা গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। কারণ তার হাতে এখন প্রচুর টাকা। প্রতি মাসে চার হাজার টাকা বেতনের কিছুই খরচ হয় না কক্সবাজারে। এখন ট্যাক্সিটাকেই সে পছন্দ করছে চলাচলের বাহন হিসেবে। মাঝে মাঝে কেমন যেন একটু অচেনা লাগে তাকে।

যীশু বিদেশে চলে যাবার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তার দিদি, দাদাসহ পরিবারের বেশ কয়েকজন সৌদি আরবে থাকেন। যীশুও সম্ভবত সৌদি আরবে চলে যাবে। বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ড্রাইভিং শিখছে। একদিন আমাকেও চড়িয়েছিল তার চালানো শেখার গাড়িতে।

দিনগুলি ক্রমশ বিষন্ন হয়ে উঠছে। দিনে দিনে এগিয়ে আসছে বিচ্ছিন্নতার দিন। এখনো একটা নির্দিষ্ট কাজ বাকি আছে – সেটা হলো থিসিসের ভাইভা। ওটা শেষ হয়ে গেলেই সবকিছু চুকেবুকে যাবে। 


পরের পর্ব >>>>>>>>>>>

<<<<<<<< আগের পর্ব

Friday, 4 March 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬১

 



#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬১

হরতালের খবরটা কাল রাতেই পেয়েছিলাম। মৌখিক পরীক্ষার দিন হরতাল আর ভালো লাগছে না। পরীক্ষা যত তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইছি, ততই যেন পিছিয়ে যাচ্ছে। সকালে যতটুকু সম্ভব তাড়াতাড়ি বের হয়েছি। জামায়াত-শিবিরের হরতাল হলে পরীক্ষা হবে না সে ব্যাপারে শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যেতো। কিন্তু আওয়ামী লীগের হরতাল। দেখা যাবে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষাসহ সবকিছু ভেতরে ভেতরে হয়ে গেছে। হরতালের কারণে কেউ যদি পরীক্ষা দিতে না পারে তার বারোটা বাজবে।

ঢিমেতালে হরতাল হলে অনেকসময় ট্রেন চলে। সকালে আগেভাগে চলে এসেছি ফতেয়াবাদ স্টেশনে, থুড়ি জংশনে। ফতেয়াবাদ সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জংশন। প্লাটফরমের কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। স্টেশনমাস্টারের বদলে জংশনমাস্টার বলে কিছু হয় কি না জানি না, কেউই নেই। বিশ্রামাগারে কয়েকটি ছোটবড় ছাগল দেখা যেতো অন্য সময়। আজ তাদের দুর্গন্ধ বাহ্যি ছড়িয়ে আছে বিশ্রামাগারের সিমেন্টের বেঞ্চে, কিন্তু তাদের দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

ফেব্রুয়ারির দশ তারিখ আজ। মাঘ মাসের শেষের দিকে। এখনো কুয়াশার চাদরে মোড়া রেললাইন, লাইনের দুপাশে সবুজ গ্রাম। নাজিরহাট লাইনের একটি ট্রেন এর মধ্যে চলে আসার কথা। আসেনি। মনে হচ্ছে আজ জোরেশোরে হরতাল হচ্ছে। বাস-ট্রেন বন্ধ করে কি মিরপুর উপনির্বাচনের ফলাফল বদলানো যাবে? ছয় তারিখও তো হরতাল ছিল ঢাকায়। কিছু কি হয়েছে?

সকাল দশটা থেকে মৌখিক পরীক্ষা শুরু হবার কথা। কার কখন হবে তার ঠিক নেই। তাই শুরু থেকে গিয়ে বসে থাকতে হবে কখন ডাক পড়ে। মোবাশ্বেরস্যার আমাদের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। পরীক্ষা শুরুর পর থেকে তিনি আগের চেয়েও বেশি গম্ভীর হয়ে গেছেন। ইলেকট্রনিক্স থিওরি পরীক্ষার সময় তিনি আমাদের রুমে এসেছিলেন। আমার জ্যামিতিবাক্সের ঢাকনা খুলতে খুলতে অনেকটা চোর ধরার ভঙ্গিতে হিসহিস করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “অ্যাই ছেলে, নকল করছো নাকি?”

আমি ঠিক জানি না মোবাশ্বেরস্যার আমাকে ঠিক কী কারণে অপছন্দ করেন। হতে পারে আমার চেহারাটাই তাঁর মেজাজ বিগড়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সকলেই আমাকে চেনেন। আমার নাম জানেন। কিন্তু মোবাশ্বেরস্যারের কাছে আমি এখনো “অ্যাই ছেলে”ই রয়ে গিয়েছি। আর পরীক্ষার হলে বসে আমি নকল করতে পারি এই সন্দেহ করছেন তিনি! অপমানের কাঁটা খচখচ করতে থাকে মাথার ভেতর। আমরা আনন্দ ভুলে যাই, কিন্তু পরম দুঃখের স্মৃতিগুলি মনে থেকে যায়। সম্মানের স্মৃতি আমরা বিস্মৃত হই। কিন্তু অপমানের স্মৃতি আমরা ভুলে যেতে চাইলেও ভুলতে পারি না।

আজ মৌখিক পরীক্ষায় যদি সময়মতো উপস্থিত থাকতে না পারি – তাহলে সাংঘাতিক অবস্থা হবে। মোবাশ্বেরস্যার কথার চাবুকে চামড়া খুলে নেবেন। রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশিক্ষণ লাগবে না ফ্যাকাল্টিতে পৌঁছতে।

“কী রে প্রদীপ, এদিক দিয়ে কই যাস?”

লুঙ্গিপরা মাফলারমোড়া মুখের ছেলেটিকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড বেশি লাগলো। শুকদেব! রেললাইনের পাশ দিয়ে ধানক্ষেতে নেমে যাওয়া মেঠোপথের মাঝখানে কয়েকজন বয়স্ক মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে আছে শুকদেব। শুকদেব রুদ্র।

“ভাইভা আছে। তোর তো আরাম, পরীক্ষা শেষ।“

“আজ হরতালের মধ্যে কিসের ভাইভা? ভাইভা হবে না। চল্‌ বাড়িত চল্‌।“

শুকদেবের বাড়ি এদিকে। সে আমাদের ব্যাচের – ম্যাথের। তাদের প্র্যাকটিক্যাল নেই, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন হলো। আমাদের পরীক্ষা শেষ হবার আগেই তাদের রেজাল্ট হয়ে যাবে।

কিছুদূর আসার পর দেখলাম রেললাইন ধরে  আমার আগে আগে চলমান এক ব্যক্তির গতি ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো টিফিন ক্যারিয়ার হাতে সুশীলদা – আমাদের সেমিনার লাইব্রেরিয়ান।

“আপনাকে দেখে দাঁড়ালাম।“

একবারও পেছনে না ফিরে তিনি আমাকে কীভাবে দেখলেন জানি না। হয়তো শুকদেবের সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন দেখেছেন। সুশীলদা শুকদেবের দাদা, সে হিসেবে আমাদেরকে তাঁর তুমি বলারই কথা। কিন্তু সুশীলদা আমি তাঁর ছোটভাইয়ের বন্ধু – এই পরিচয়ের চেয়েও ডিপার্টমেন্টের ছাত্র পরিচয়কে বেশি গুরুত্ব দেন।

সুশীলদা প্রতিদিনই এই পথে হেঁটে হেঁটে ইউনিভার্সিটিতে যান। তাঁর সাথে নানারকম কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম।

“আপনাদের থিসিস শেষ হতে তো আরো কয়েক মাস আছে, তাই না?”

“এপ্রিলের বারো তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে।“

“তাহলে তো আরো দুই মাস আছে। এই দুই মাস তো আপনি ছরারকুলেই আছেন। আমার একটা উপকার করেন। আমার ছেলেটা ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়ছে। তাকে একটু ফিজিক্সটা দেখিয়ে দেন। সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন হলেও চলবে। আমি তাকে পাঠাবো আপনার কাছে।“ সুশীলদার কথায় এক ধরনের আন্তরিক অধিকারবোধ প্রকাশ পায় – যা ভালোই লাগে আমার।

সায়েন্স ফ্যাকাল্টির গেটের কাছেই দেখা হয়ে গেলো হাফিজ, ফারুক, প্রদীপ নাথসহ আরো অনেকের সাথে। তাদের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ থেকে। হরতাল হলেও পরীক্ষা বন্ধ হয়নি। ক্যাম্পাসে বাসগুলি চলছে না। কিন্তু অন্যান্য সবকিছু মনে হচ্ছে স্বাভাবিক। ছাত্রলীগ এখনো কোনঠাসা হয়ে আছে এই ক্যাম্পাসে।

আজ যাদের ভাইভা আছে সবাই চলে এসেছে। হাটহাজারি রোডে বাস চলছে না, কিন্তু টেম্পু, টেক্সি এসব চলছে। দশটা থেকে ভাইভা শুরু হবার কথা। মোবাশ্বেরস্যারের রুমের সামনে আমরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছি। সোয়া দশটায় জানানো হলো – আজকের ভাইভা হবে না। আগামীকাল থেকে রুটিন অনুসারে ভাইভা হবে। আজকেরটা হবে সবার ভাইবা হয়ে যাবার পরের দিন। তারিখ পরে ঘোষণা করা হবে।

মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। মাস্টার্সে উঠে হল পরিবর্তন করে সোহরাওয়ার্দী থেকে আলাওলে নাম লিখিয়েছিলাম শুধুমাত্র আগে পরীক্ষা শেষ করার জন্য। পরীক্ষার রোলনম্বরগুলি আলাওল থেকে শুরু হয়। ভাইভার রুটিন হয় সেভাবে। ভেবেছিলাম ভাইভার ভারমুক্ত হয়ে যাবো তাড়াতাড়ি। কিন্তু এখন কী হলো? সবার ভাইভা হয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে!

আজ যাদের প্র্যাকটিক্যাল বা ভাইভা ছিলো না তারাও অনেকে এসেছে ডিপার্টমেন্টে। ছেড়ে যাবার আগে মায়া বেড়ে যায়। এখন ডিপার্টমেন্টের প্রতি আমাদের মায়া সম্ভবত বেড়ে যাচ্ছে। সেমিনার লাইব্রেরিতে গিয়ে বসলাম। অনেকেই ছোট ছোট ডায়েরি বের করে সহপাঠীদের হাতের লেখা সংগ্রহ করছে। অটোগ্রাফ!!

তাই তো – এই ক্যাম্পাস ছেড়ে যখন একেবারে চলে যাবো – আর তো দেখা হবে না সহপাঠীদের সাথে। সবাই যে যার পথে চলে যাবে, যে যার মতো বদলে যাবে। সময় কাউকেই একই রকম থাকতে দেয় না। ক্লাসিক্যাল কিংবা কোয়ান্টাম – যে মেকানিক্সই হোক – টাইম ডেরিভেটিভ বা সময় হলো সবচেয়ে বড় অপেক্ষক। টাইম ইজ দ্য মোস্ট স্ট্রেজ ভেরিয়েবল ইন লাইফ মেকানিক্স।

সহপাঠীদের দিকে তাকালাম। আজ থেকে অনেক বছর পর অনেকের নামও মনে থাকবে না। আমাদের ক্লাসে প্রায় একশ ত্রিশ জন শিক্ষার্থী। এখনও কি নাম জানি সবার? সবার সাথে সমানভাবে মেলামেশাও তো করিনি। এই যে ঝর্ণা-আপা – যাকে আমাদের সোবহানস্যারও এখন ঝর্ণাভাবী বলে ডাকেন – ম্যাকস্যারের বউ হবার সুবাদে। তাঁর সাথে আবার কোনোদিন যদি দেখা হয় তিনি কি আমাকে চিনতে পারবেন? এই যে সুনীলদা – ঘোড়াশালের একটি সরকারি অফিসের কর্মকর্তা। আমাদের কত সিনিয়র। এতবছর পরে শিক্ষাছুটি নিয়ে মাস্টার্স করতে এসেছেন। তাঁর কি মনে থাকবে আমার কথা? প্রিলিমিনারি থেকে, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট থেকে অনার্স করে যারা এখানে এসে আমার সহপাঠী হয়েছে – তাদের অনেকের সাথে ভালো করে কথাও বলা হয়ে ওঠেনি। অনেক বছর পরে যদি অন্য কোন পরিবেশে দেখা হয়ে যায়, তাদের চিনতে পারবো তো? তারা চিনতে পারবে তো? কেমন যেন একটা বিষাদ এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াতে শুরু করে আমায়। কেমন যেন স্বার্থপরও মনে হতে থাকে নিজেকে। কেবলই ভাবছি – আমাকে মনে থাকবে কি না। কেন ভাই? আমি কী এমন হয়েছি যে আমাকে মনে রাখতে হবে? যার যার নিজস্ব পরিবেশ, নিজস্ব সময় – গড়ে দেবে নিজেদের নতুন পৃথিবী। সেখানে এইসব দিনগুলি কেবল অতীত হয়ে থাকবে। মাঝে মাঝে ঝড় ঝাপটার মতো কিছু স্মৃতির ধুলো উড়বে, তারপর আবার সামনে চলা জীবন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন সবার সাথে একটা সৌজন্যমূলক সম্পর্ক বজায় রেখেছি। কিন্তু সবারই আলাদা আলাদা বৃত্ত ছিল। এটাই স্বাভাবিক। এখন মনে হচ্ছে সময়টা বড্ড বেশি নষ্ট করে ফেলেছি। চার বছরের জায়গায় সাত বছর কাটিয়েছি এই ক্যাম্পাসে। অথচ সময়টাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারিনি। সময় – বড় বিচিত্র অপেক্ষক বলেই তা চলে যাবার পরেই আক্ষেপটা আসে যখন তাকে আর ফিরিয়ে আনার কোন উপায় থাকে না।

“তোর ঠিকানাটা লিখে দে।“ – লিপি একটা বাঁধানো খাতা এগিয়ে দেয়। তার ডায়েরিও যে তার মতো এত সুদর্শনা হবে ভাবিনি।

“কেন? চিঠি লিখবি?”

“না, বিয়ের চিঠি পাঠাবো।“ – লিপি হাসতে হাসতে উত্তর দেয়।

ঠিকানা লিখে দেয়ার অনুরোধ আরো অনেকেই করেছে। জানি, কেউই লিখবে না কোন চিঠি। বিয়ের চিঠি পাঠাবার কথাও মনে থাকবে না কারো। তবুও ঠিকানা লিখি, আমাদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা।

আমার থলের ভেতরও একটা ‘অটোগ্রাফ’ খাতা আছে। অনেক বছর আগে শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চের অভিনেতাদের অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম। রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, আবদুল্লাহ আল মামুন, আসাদুজ্জামান নূর, শান্তা ইসলাম এরকম আরো অনেকের। কিন্তু কিছুদিন পর সেলিব্রেটিদের দস্তখত শিকারের ইচ্ছেটা চলে গেছে। তবে খাতাটা রয়ে গেছে। ওটা বের করলাম – আমার বন্ধুরা আমার কাছে সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি। তাদের স্বাক্ষর রয়ে যাক।

রিনা আমার খাতাটা টেনে নিয়ে খসখস করে লিখলো, “তোর মতো কুফা আমি আমার জীবনে আর একটাও দেখি নাই।“

“বাহ্‌, আর একটাও দেখিসনি? মানে আমি ইউনিক বলতে চাচ্ছিস? প্রশংসা করছিস মনে হচ্ছে!“

“জ্বি না, প্রশংসা করছি না। কুফা কোন প্রশংসাবাচক শব্দ নয়। নিন্দাবাচক শব্দ।“ – রিনা ঠোঁট উল্টে উত্তর দিলো। সে রেগে আছে বুঝতে পারছি, কিন্তু রাগের কারণটা বোঝা যাচ্ছে না।

পরবর্তী কয়েকদিনে সহপাঠীদের অনেকের সাথেই হাতের লেখা বিনিময় হলো। স্মৃতি ধরে রাখার কত রকমের চেষ্টা আমাদের। ভবিষ্যতই বলে দেবে স্মৃতির ভাণ্ডার কতটা পূর্ণ থাকে।

হরতালের পরদিন থেকে ভাইভা শুরু হয়েছে। আমরা দল বেঁধে সেমিনার লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকি। মোবাশ্বেরস্যারের রুম থেকে ভাইভা দিয়ে কেউ বের হলেই আমরা তাকে ঘিরে ধরে জানতে চেষ্টা করি কী কী প্রশ্ন করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সটার্নাল এসেছেন। তিনি নাকি সবাইকে নাস্তানাবুদ বানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। জেনারেল ভাইভাতে ৫০ নম্বর। সতেরোর কম দিলেই ফেল। ভাইভাতে ফেল করলেই কম্মো সাবাড়। সব পরীক্ষা আবার দিতে হবে আগামী বছর। এরকম জীবন-মরণ সমস্যা হলে স্নায়ুর উপর চাপ তো পড়বেই। ভাইভা দিতে গিয়ে মাথাঘুরে পড়ে যাবার অবস্থা হয়েছে কয়েকজনের।

সবার ভাইভা শেষ হবার পরের দিন আমাদের প্রথম দিনের না হতে পারা ভাইভা শুরু হলো। মৌখিক পরীক্ষা আমার কোনোদিনই ভালো হয় না। স্যাররা যে প্রশ্নগুলি করলেন সেগুলি লিখতে দিলে হয়তো লিখতে পারতাম। কিন্তু মৌখিকভাবে উত্তর দিতে গিয়ে ঘাম বের হয়ে যাবার জোগাড়। পরীক্ষাশেষে কী পারলাম কী পারিনি তা মনেই রইলো না। পরীক্ষা যে হয়ে গেছে তাতেই বেশ হালকা লাগছে নিজেকে।

পরদিন থেকে থিসিসের কাজে মন দিলাম আবার। ডিপার্টমেন্টের সেমিনার লাইব্রেরিতে গিয়ে ফিজিক্যাল রিভিউর পাতা উল্টাই। একদিন সোবহানস্যার সেমিনারে ঢুকলেন। আমাকে দেখে বললেন, “প্রদীপ, তুমি একটু আমার অফিসে আসো।“ আমার সহপাঠী জাফর ছিল সুশীলদার সামনের চেয়ারে বসা। সোবহানস্যার জাফরকেও ডাকলেন।

আমি ভেবেছিলাম সোবহানস্যার দোতলায় চেয়ারম্যানের রুমে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি তাঁর তিন তলার অফিসরুমে ঢুকলেন। সেমিনার রুমের যে পাশে মোবাশ্বেরস্যারের অফিস, তার বিপরীত দিকে সোবহানস্যারের অফিস।

“তুমি সেদিন অনেক ভালো কথা বলেছিলে। বই পড়ছি না বলেই লাইব্রেরির বইয়ের উপর ধুলো জমে যাচ্ছে কথাটা একদম ঠিক বলেছো। তাই তোমাকে ডেকে এনেছি আমার লাইব্রেরি প্রজেক্টের বইগুলি একটু গুছিয়ে রাখতে।“

আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানে আমার বলা কথাগুলির কিছুটা স্যার এখনো মনে রেখেছেন দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু স্যার কি এখন তাঁর বইয়ের আলমারি পরিষ্কার করাবেন জাফর আর আমাকে দিয়ে? সোবহানস্যার ডিপার্টমেন্টে ছাত্র-পাঠাগার প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প চালু করেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে তিনি তাঁর অফিসের আলমারিতে রাখছেন। ছাত্ররা এখান থেকে বই ধার নিতে পারবে। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে সেমিনার লাইব্রেরি থাকতে আরেকটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি কী কারণে লাগবে? এটার মূল উদ্দেশ্য কী? ছাত্রদের কাছ থেকে বই নেয়া কতটা ন্যায়সঙ্গত? এসব প্রশ্ন প্রামাণিকস্যার সরাসরি করেছেন বলে সোবহানস্যারের সাথে প্রামাণিকস্যারের সম্পর্ক এখন আরো খারাপ হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রামাণিকস্যারের ছাত্রকে ডেকে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরি প্রকল্পের কাজ করানোটা উদ্দেশ্যমূলক নয় তো?

সোবহানস্যারের নির্দেশমতো জাফর আর আমি স্যারের টেবিল থেকে বইগুলি একটি আলমারিতে তুলে রাখতে শুরু করলাম। হঠাৎ স্যার বললেন, “তুমি কি জানো যে ডিপার্টমেন্টে লেকচারার নিয়োগ করা হচ্ছে? তুমি একটা দরখাস্ত করে দাও।“

“আমার তো এখনো পরীক্ষাই শেষ হয়নি স্যার।“

“তা তো আমি জানি। সিলেকশান কমিটির মিটিং হতে হতে তোমাদের পরীক্ষা হয়ে যাবে। হারুনকেও বলেছি দরখাস্ত করতে। তুমিও করো।“

সোবহানস্যারকে হঠাৎ খুব মহানুভব মানুষ বলে মনে হচ্ছে। টেবিলের সব বই আলমারিতে গুছিয়ে রেখে স্যারের রুম থেকে বের হতেই জাফর আমার পিঠে চাপড় দিয়ে বললো – “তোমার তো কপাল খুলে গেছে। তুমি তো মিয়া ডিপার্টমেন্টে জয়েন করবা!”

কপালে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু সোবহানস্যার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, তিনি যখন দরখাস্ত করতে বলেছেন, তখন নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই বলেছেন। স্বপ্নের বুনন কখন কীভাবে যে শুরু হয়ে যায়! বাস্তবতা ভুলে গিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হবো। রোকসানা লিপি আমার খাতায় লিখেছে – “প্রামাণিকস্যারের কাছে থিসিস করে আরেকটা প্রামাণিকস্যার হয়ো না।“ কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে শিক্ষক যদি হতে পারি – চেষ্টা করবো প্রামাণিকস্যারের মতোই হতে।

পরদিন প্রামাণিকস্যার পুরো ব্যাপারটা শুনে বললেন, “ওসব স্বপ্ন দেখা বাদ দাও। বর্তমান প্রশাসনের আমলে তোমাকে ডিপার্টমেন্টে নেবে না।“

স্যারের অপ্রিয় সত্যকথা আমার ভালো লাগলো না।  

<<<<<<<< আগের পর্ব 

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts