Saturday 23 May 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৩০

30

“ইস্‌ দুইটা ব্যাজে গেচে। আচকে বাছে ভির হবে।“
ছোলাইমান স্যার তাঁর কবজির সোনালী ঘড়িটার ডায়াল থেকে অদৃশ্য ধূলি ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্ত মুখে বললেন। কলেজের গেটের কাছে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ থেকে। এক বছর ধরে বিমান বাহিনীর এই বাসে আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি ছোলাইমান স্যারের কথা ঠিক। তাঁর অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর পাশে দাঁড়ানো বিমল স্যার, অঞ্জন স্যার ও সুপাল স্যার। সুচরিত স্যার একটু দূরে দাঁড়িয়ে নাসরীন বানু ম্যাডাম আর রিফাৎ আরা ম্যাডামের সাথে কথা বলছেন। রিফাৎ আরা ম্যাডামও এখন এই বাসের যাত্রী। তিনি এখন শহরে বাসা নিয়েছেন।
“অ্যাই অঞ্জনবাবু, এবার কি কলেজে কোন গাড়িওয়ালা ছেলে-মেয়ে ভর্তি হয় নাই?” – বিমল স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
“হয় নাই মনে হয়। হইলে কি আর অঞ্জনবাবু এতক্ষণ এখানে থাকতেন? ছেলেদের গাড়িতে করে কত আগেই চলে যেতেন।” – ছোলাইমান স্যার বললেন।
“না বিমলদা, এখনো কাউকে পাইনি।“ – অঞ্জন স্যার হাসিমুখে বললেন।
অঞ্জন স্যার খুব ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। তাঁকে উত্তেজিত হতে আমি কখনো দেখিনি। ছোলাইমান স্যার অনেকসময় তাঁকে খোঁচাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অঞ্জন স্যার দক্ষ রাজনীতিবিদের মত ঠান্ডা মাথায় তার জবাব দেন। আজও হাসিমুখে বললেন, “ছোলাইমান ভাই, স্টুডেন্টদের গাড়িতে কি আমি একা চড়ি? আমি কি আপনাকে অনেকবার নিয়ে যাইনি গাড়িতে করে?”
“বাইদ্য হয়ে নিয়ে গেচেন আর কি।“
স্যারদের কথোপথন শুনতে বেশ মজা লাগছে। অঞ্জন স্যারের বেশ কয়েকজন মোটা মোটা ছাত্র আছে। তাঁর মুখে শুনেছি প্রিন্সিপাল স্যার নাকি ওদের নাম দিয়েছেন – ‘অঞ্জন স্যারের হাতি’। বড় বড় গাড়ি নিয়ে তারা আসে। ছুটির পর স্যারদের লিফ্‌টও দেয়। স্কুল সেকশানের বার্ষিক পরীক্ষা, রেজাল্ট সব হয়ে গেছে। জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হলে তাদের এবং তাদের গাড়ির আগমন ঘটবে আবার।
সোয়া দুটোর দিকে বাস এলো। যেমন ভেবেছিলাম – প্রচন্ড ভীড় বাসে। শিক্ষকদের জন্য যে কয়টি সিট খালি থাকার কথা সেগুলোতেও বসে গেছেন অনেকে। ম্যাডামদের জন্য জায়গা খালি করে দিলো কয়েকজন। কিন্তু স্যারদের বসতে হলো বিভিন্ন সিটে। আমি সবার পেছনে উঠেছি। একেবারে পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম কোনরকমে। এরকম বসার চেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া অনেক আরামের। কিন্তু এই বাসে দাঁড়িয়ে যাবার নিয়ম নেই। কেউ দাঁড়ালেই সামনের দিক থেকে একজন লিকলিকে সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে দাঁত কটমট করে হুকুম দেন, “অ্যাই এডজাস্ট করে বসেন।“
একেবারে সামনের সারির তিনটি সিটই খালি। গার্ড-রুম থেকে অফিসার উঠে বসবেন সেখানে। একজন অফিসার তিনজনের সিটে আধ-শোয়া হয়ে বসবেন। তবুও নন্‌-অফিসার কেউ সেখানে গিয়ে বসতে পারবেন না।
ঝড়ের বেগে বাস ছুটলো। রাফ ড্রাইভিং-এ জুড়ি নেই এই চালকের। কয়েক সেকেন্ডেই চলে এলো গার্ডরুমে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পরও কোন অফিসার উঠলেন না। নন-অফিসারের সর্দারেরা খুশি হয়ে অফিসারের সিটে গিয়ে বসলেন। গাড়ি এক টানে রাস্তায় উঠে যেতো – কিন্তু হঠাৎ হার্ড ব্রেক কষে থেমে গেলো। গতি জড়তার কারণে আরেকটু হলেই সামনে ছিটকে পড়তাম। প্রভোস্ট হুইসেল বাজিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। রিভার্স গিয়ারে গিয়ে পিছু হটতে শুরু করলো বাস। অনেকের মুখ থেকে বিরক্তি শব্দ বের হয়ে গেল।

ড্রাইভার তাঁর ডানপাশের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রভোস্টের সাথে কী কথা বললেন শুনতে পেলাম না। কিন্তু অফিসারের সিটে যাঁরা বসেছিলেন তাঁরা দ্রুত উঠে গিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেয়া সিট পুনরুদ্ধার করছেন দেখে বুঝতে পারলাম – অফিসারের কাছ থেকে ডাক এসেছে। গাড়ি ইউ-টার্ন নিয়ে ছুটলো আর-টি-এস বিল্ডিং-এর পাশের রাস্তা দিয়ে। অফিসার্স মেসের সামনে এসে বাস থামলো। আমার পাশে জানালার দিকে যিনি বসেছেন – তিনি জানালার কাচে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবুও ভালো যে অফিসার বাসে উঠলে – নন্‌-অফিসারদের উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করতে হয় না। ছোলাইমান স্যার একবার বলেছিলেন – কলেজের টিচাররা নাকি এই অফিসার্স মেসে ঢোকার যোগ্যতা রাখেন। সেই যোগ্যতা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি কোনদিন। তাঁর সঙ্গে একবার সার্জেন্ট মেসে খেতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল – তাতে সার্জেন্ট মেসেই দ্বিতীয়বার যাবার সাহস হয়নি, অফিসার্স মেস তো দূর অস্ত।
এখানে আরো মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর দেখা গেল একজন সতেরো-আঠারো বছরের কিশোর গাড়িতে উঠলো। এত কম বয়সে কি অফিসার হওয়া যায়? ছেলেটি বাসে উঠে সামনের সিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু হঠাৎ সম্ভবত ম্যাডামদের দেখে সামনে না গিয়ে পেছনের দিকে চলে এলো। ড্রাইভার আবার জানালা দিয়ে মুখ বের করে কারো সাথে কথা বললেন। তারপর বাস চলতে শুরু করলো। কোন অফিসার উঠলেন না। অফিসারের সংরক্ষিত আসন আবার নন-অফিসারের দখলে এলো। এই ছেলেটির জন্যই এতদূর থেকে এতগুলো মানুষসহ বাস ফিরিয়ে আনা হয়েছে! অফিসারের আত্মীয়-স্বজন কেউ হবে হয়তো।
ছেলেটি পেছনে এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বসার জায়গা খুঁজছে। তাকে জায়গা দেয়ার মত জায়গা কারো কাছেই নেই। আমার কাছে এসে সে বললো, “একটু চেপে বসো ভাই।“
আমি বেশ অবাক হলাম। আমাকে কি সে তার সমবয়সী মনে করেছে? নাকি অফিসার-ইফেক্ট? যথাসম্ভব সরে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে তার বসার জায়গা করলাম। একেই বলে এডজাস্ট করা।
মেইন রোডে উঠার পর পাগলের মত বাস চালাচ্ছেন ড্রাইভার। দেখলাম এই গতিতে অনেকেই খুব আনন্দ প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে যাঁরা ষোলশহরে নামেন। তাঁরা মনে করছেন এই গতিতে চললে ষোলশহর স্টেশনে গিয়ে দোহাজারি লাইনের ট্রেন ধরতে পারার সম্ভাবনা এখনো আছে।
“তুমি কি কলেজে পড়ো?” – ছেলেটি প্রশ্ন করলো।
আমি ঘাড় ফিরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। তার ঝাঁকড়া লম্বা চুল, চিকন জুলফি কানের অনেক নিচে এসে থেমেছে। মুখে ও কপালে অনেকগুলো ব্রনের দাগ। টাইট জিন্স – টি-শার্টের উপর একটা জ্যাকেট পরনে।
“আমাকে জিজ্ঞেস করছো?” – নিশ্চিত হবার জন্য জানতে চাইলাম। আমাকে তো এত কমবয়সী মনে হবার কোন কারণ নেই। অনেক সময় মানুষের ব্রেন ঠিকমত কাজ করে না। হয়তো এই ছেলেটার মস্তিষ্কও এখন ঠিকমতো কাজ করছে না।
“হ্যাঁ। আমি তো কলেজে ভর্তি হয়েছি।“
“শাহীন কলেজে?”
“হুঁ।“
“সায়েন্সে?”
“হুঁ।“
“ক্লাসে তো দেখিনি।“
“কয়েকদিন আগে ভর্তি হয়েছি। তুমিও কি ফার্স্ট ইয়ারে?”
কী বলবো বুঝতে পারছি না। যেভাবে গা ঘেষে বসে আছে – এখন যদি বলি – আমি তোমার মাস্টার, বেচারা লজ্জা পাবে। তারচেয়ে কথা ঘোরানো যাক। ভর্তি শেষ হয়ে গেছে সেই অক্টোবরে। এখন এই ডিসেম্বরে এসে সে কীভাবে ভর্তি হলো কে জানে। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি অফিসার্স মেস থেকে কীভাবে উঠলে?”
“আমার ভাই অফিসার তো।“
অফিসারের ভাইয়ের কী দাপট। তবুও ভালো যে অন্তত ম্যাডামদের দেখে চিনতে পেরেছে। সামনে গিয়ে বসেনি। ভাবলাম বেশি কথাবার্তা বলা ঠিক হবে না অফিসারের ভাইয়ের সাথে। তাছাড়া ক’দিন পরেই নাসির স্যারের হাতে তার সৌখিন কেশবিন্যাসের যে করুণ দশা হবে তা চিন্তা করেই হাসি পাচ্ছিলো।
“ক্লাসে দেখা হবে” – বলে আগ্রবাদে নেমে গেল সে।
মনে মনে বললাম, ক্লাস করলে তো অবশ্যই দেখা হবে।
চকবাজারে যখন নামলাম তখন প্রায় পৌনে চারটা বেজে গেছে। ছোলাইমান স্যার বাস থেকে নেমেই কীভাবে যেন দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যান। রিফাৎ আরা ম্যাডাম রিকশা নিয়ে চলে গেলেন পাঁচলাইশের দিকে। আমি রাস্তা পার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি – এমন সময় লাইলুন্নাহার ম্যাডাম ডাকলেন – ‘প্রদীপ’।
“জ্বি ম্যাডাম।“
“এটা আপনার জন্য।“ – ম্যাডাম একটা প্লাস্টিকের কৌটো এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ভেতরে হলুদ রঙের পদার্থ দেখা যাচ্ছে।
“গাজরের হালুয়া বানিয়েছিলাম। খাবেন।“
লাইলুন্নাহার ম্যাডাম কলেজের সবার সিনিয়র হবেন বলে আমার ধারণা। বাচ্চাদের কী যে আদর করে পড়ান। এখন দেখছি তাঁর আদর-স্নেহের ভাগ আমিও পাচ্ছি। অথচ তাঁর সাথে আমার কোনদিন ভালো করে কথাই হয়নি। সংসারে কিছু কিছু মানুষ এরকমই থাকেন – যাঁদের কাজ হলো সবাইকে স্নেহ করা।

>>>>>>>>>>>>>>>
বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেয়া হচ্ছে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও কলেজ সেকশানে। জানুয়ারির শুরুতেই নিয়োগ পরীক্ষা। পাঁচ ছয়টি পোস্টের জন্য কয়েক শ প্রার্থী। অনেকগুলো রুমে লিখিত পরীক্ষা হচ্ছে। আমার ডিউটি দেয়া হয়েছে সেকেন্ড ইয়ার সি সেকশানের ক্লাসরুমে। কেজি’র টিচারের জন্য পরীক্ষা দিচ্ছেন এক শ’র উপরে। নেয়া হবে সম্ভবত দুই বা তিন জন। শিক্ষক হবার জন্য পরীক্ষা দিচ্ছেন, কিন্তু সমানে কথা বলছেন একজন আরেকজনের সাথে। খাতা দেখাদেখিও করছেন। আমি শিক্ষকদের সম্মান দেখিয়ে যথাসম্ভব বিনয়ের সাথে বললাম, “প্লিজ এরকম করবেন না।“ কিন্তু কে শোনে কার কথা। কয়েকজনের আচরণ দেখে ইচ্ছে করছে খাতা কেড়ে নিই। আমার স্টুডেন্ট হলে কত আগেই খাতা কেড়ে নিতাম। দু’জনের কাছে গিয়ে মৃদুকন্ঠে হুসিয়ারি দিলাম। কিন্তু তাঁরা আমাকে পাত্তা দিলেন না। আমি ডায়াসে ফিরে আসতে না আসতেই দেখলাম  তারা একজন আরেকজনের খাতার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। মনে হচ্ছে এদের মধ্যে একজন পরীক্ষা দিতে এসেছেন অন্যজনকে সাহায্য করার জন্য। আমি গিয়ে দুজনের খাতাই নিয়ে নিলাম। তাঁরা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন – কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন।
দেখলাম একজন এয়ারফোর্স অফিসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। নিয়োগ পরীক্ষার সময় শাহীনের এডুকেশন উইং থেকে অফিসাররা আসেন। মূলত তাঁদের তত্ত্বাবধানেই সবকিছু হয়ে থাকে। ইউনিফর্ম পরা অফিসারকে সবাই ভয় পায়। তাঁকে দেখেই সমস্ত এতক্ষণ যাঁরা ফিসফিস করছিলেন, তাঁরাও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
অফিসার রুমে ঢুকে আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, “প্রদীপ, দোস্ত তুই এখানে?”
“আরে শফিক, তুই! আমি তো ভয়ে তাকাইনি তোর দিকে।“
পরীক্ষার হল না হলে এতক্ষণে কোলাকুলি লাফালাফি অনেককিছু করে ফেলতাম। কিন্তু আপাতত সব উচ্ছ্বাস চাপা দিতে হলো।
“কতদিন হলো এখানে?” – শফিক জানতে চায়।
“এক বছর হয়ে গেছে।“
“আমারও তো প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে এয়ারফোর্সে।“
পরীক্ষার হলে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না বুঝতে পারলো শফিক। বললো, “পরে কথা বলবো। আমি অন্যরুমগুলোও একটু ঘুরে দেখি।“ – বলে চলে গেল সে।
শফিক আমার ক্লাসমেট। পাস করেই এয়ারফোর্সে ঢুকেছে। এখন তাকে আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারও স্যার ডাকবেন।
যাঁদের খাতা নিয়ে ফেলেছিলাম – তাঁরা খাতা আর ফেরত পেলেন না। যেটুকু লিখেছেন তাতে যদি পাস করেন তবে মৌখিক পরীক্ষায় যাবেন, নইলে নয়।
পরীক্ষা শেষ হলো। খাতাগুলো ভাইস-প্রিন্সিপাল শিরিন ম্যাডামের রুমে রেখে আসার সময় দেখলাম শফিক প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বের হচ্ছে।
“আমি তো জানতাম না তুই শাহীন কলেজে জয়েন করেছিস।“
“আমিও তো জানতাম না যে তুই এয়ারফোর্সে জয়েন করেছিস।“
“বিসিএস দিসনি?”
“দিয়েছি। দেখি কী হয়।“
দুই বন্ধুর অনেকদিন পরে দেখা হলে যা হয় – অনেক কথাবার্তা হলো। কিছুক্ষণ পরেই সে ব্যস্ত হয়ে গেল। তার বস আমজাদ সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন।
“প্রদীপ, তুমি নাকি দুইজন লেডি ক্যান্ডিডেটের খাতা কেড়ে নিয়েছো?” – সাঈদ স্যার বললেন।
“উনারা খুব দেখাদেখি করছিলেন, আর কথা বলছিলেন। আমার নামে কি নালিশ করেছেন উনারা?”
“জানি না। তবে করলে খবর আছে তোমার।“
উনারা কি খুব পাওয়ারফুল কেউ ছিলেন? জানার আগ্রহ হলো না। আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি।
এক সপ্তাহের মধ্যেই কয়েকজন নতুন শিক্ষক জয়েন করলেন। কলেজে এতদিন যুক্তিবিদ্যা পড়ানো হতো না। এবছর থেকে যুক্তিবিদ্যা শুরু হলো। যুক্তিবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা দীর্ঘদেহী জামান সাহেব। কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন মোরশেদ সাহেব। মোরশেদ সাহেবের বাড়ি চকরিয়া। খাস চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন – আহা শুনতে কী যে ভালো লাগে।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>


নতুন রুটিন তৈরি হচ্ছে। মহিউদ্দিন স্যার আর সাঈদ স্যার ভীষণ ব্যস্ত রুটিনের কাজে। শোনা যাচ্ছে ভাইস-প্রিন্সিপাল শিরিন ম্যাডাম ঠিক করে দিচ্ছেন – কাকে কোন্‌ সাবজেক্ট পড়াতে দেয়া হবে। আমি ফিজিক্সের মানুষ – আমাকে তো আর অর্থনীতি পড়াতে দেয়া হবে না। কিন্তু স্কুলে যে ক্লাস দেবে। আমাকে কি আবারও ক্লাস সেভেনের গণিত পড়াতে হবে? গণিতের চেয়ে বিজ্ঞান যদি পড়াতে পারতাম তাহলে মনে হয় অনেক আনন্দ নিয়ে পড়াতে পারতাম। শিরিন ম্যাডামকে একবার বলে দেখবো নাকি? এমনিতেও ভাইস-প্রিন্সিপাল হবার পর তাঁর সাথে একবার হলেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করা উচিত ছিল আমার। সেটা করিনি। অথচ মোরশেদ যোগ দিয়েই সব স্যার-ম্যাডামের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে ফেলেছেন। অনেক সাহস সঞ্চয় করে শিরিন ম্যাডামের অফিসে গেলাম।
“ম্যাডাম আসি?”
“আসেন।“
“ম্যাডাম, আমার নাম প্রদীপ দেব। আমি এই কলেজের…”
“আমি আপনাকে চিনি। পরিচয় দিতে হবে না। কাজের কথা বলেন।“
“ম্যাডাম, আমি গতবছর ক্লাস সেভেনে অংক করিয়েছি। সেই ক্লাসটা এবার এইটে উঠেছে। আমাকে যদি এবার ক্লাস এইটের বিজ্ঞান পড়াতে দেন তাহলে আমি খুব আনন্দ-সহকারে পড়াতে পারবো।“
“তা তো বটেই, তা তো বটেই। আচ্ছা, আমি দেখবো।“
বাহ্‌ এত সহজে হয়ে গেল। খুশি হয়ে চলে এলাম।
দু’দিন পরে রুটিন প্রকাশিত হলো। আমাকে ক্লাস ফাইভের অংকের ক্লাস দেয়া হয়েছে। কলেজে পড়াতে এসে হাইস্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতাও হয়েছে গতবছর। এবছর প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোর সুযোগও হলো। ফারুকী স্যারের মতে  যত নিচের দিকের ক্লাস – ততই পড়াতে আরাম। আমার এবার আরো খুশি হবার কথা। কিন্তু খুশি লাগছে না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমাকে শাস্তি দেয়া হলো। হাই স্কুলের ক্লাসে হয়তো ঠিকমতো পড়াতে পারিনি, তাই প্রাইমারি স্কুলে নামিয়ে দেয়া হলো। দেখি এখানে ঠিকমত পড়াতে পারি কি না।

আগের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts