Saturday, 23 May 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ১১


11
"কাশেমভাই, আপনি বলেন, প্রদীপের কি চাকরি থাকা উচিত?"

সাঈদ স্যার হেসে হেসে কথাগুলো বললেও আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম।  জয়েন করেছি তিন সপ্তাহও হয়নি, এর মধ্যেই চাকরি নিয়ে টানাটানি! আমি কাশেম স্যারের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে তাঁর মতামতের উপরেই নির্ভর করছে আমার চাকরির ভবিষ্যৎ। কাশেম স্যার  মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাদ্যাংশ উদ্ধারে তৎপর। সেই অবস্থাতেই গোঁ গোঁ করে কিছু একটা বললেন। কিন্তু তাতে ঠিক বোঝা গেল না আমার চাকরি থাকা উচিত কি উচিত নয়।

সাঈদ স্যার এবার সুচরিত স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, "সুচরিত, প্রদীপের কি চাকরি থাকা উচিত?"

সুচরিত স্যার এতক্ষণ বাইরে ছিলেন। টিচার্স রুমে কী নিয়ে কথা হচ্ছে তা তাঁর জানার কথা নয়। তিনি গভীর মনোযোগে নিয়তিদির রেখে যাওয়া সিঙাড়ার সন্ধিবিচ্ছেদ করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, "কী হয়েছে সাঈদ ভাই?"
"প্রদীপ চকবাজারে থাকে, কিন্তু ভাইস-প্রিন্সিপালের বাসা চেনে না। এই অপরাধে তার তো চাকরি চলে যাওয়া উচিত। হা হা হা।"

সাঈদ স্যারের হাসির সাথে টিচার্স রুমের অনেকেই যোগ দিলেন টিচার্স রুমের এই হাসিখুশি পরিবেশটা আমার বেশ ভালো লাগে। প্রতিদিন সাত ঘন্টা ক্লাসের মধ্যে প্রায় সবারই গড়ে পাঁচ ঘন্টা ক্লাস থাকে এর মধ্যে এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটা - এই আধঘন্টা সময়ের জন্য সবার সাথে দেখা হয় টিচার্স রুমে। টিচাররা কারো ক্লাসে কোন রকমের অস্বাভাবিক কিছু বা মজার কিছু ঘটলে তা শেয়ার করেন। স্টুডেন্টদের সম্পর্কেও কথা হয়। যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনায় খুব ভালো, ভদ্র এবং কথা শোনে - তাদের নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। বেশিরভাগ কথাবার্তা হয় ত্যাঁদড়দের সম্পর্কে। টিচার্স রুমের আলোচনা থেকেই জানা হয়ে যায় কোন্‌ ক্লাসে কোন্‌ ত্যাঁদড় কী করে। আমি এখনো শুধুমাত্র ইলেভেন ক্লাসের তিনটি সেকশানে ক্লাস নিচ্ছি সেই ক্লাসগুলোতে কাউকেই এখনো সেরকম কোন দুষ্টুমি করতে দেখলাম না। অবশ্য দুষ্টুমির সংজ্ঞা একেক টিচারের কাছে একেক রকমের। আমার মনে হয় যে স্টুডেন্ট ক্লাসে কোন দুষ্টুমি করে না, সে আসলে তার স্টুডেন্ট লাইফকে ঠিকমতো উপভোগ করতে পারছে না। ক্রিয়েটিভ দুষ্টুমির মধ্য দিয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। আমি মনে করি টিচারদের উচিত স্টুডেন্টদের ভেতরের ক্রিয়েটিভিটিকে জাগিয়ে তোলা। কিন্তু স্যারদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় এখানে দুষ্টুমিকে খুব একটা প্রশ্রয় দেয়া হয় না। কামরুজ্জামান স্যার তো প্রায়ই বলেন, "ছাত্ররা হচ্ছে বানরের মত লাই দিলেই মাথায় উঠে বসে থাকবে। একবার মাথায় উঠলে আর নামবে না।"

শরীরচর্চা শিক্ষকরা মনে হয় সব স্কুলেই একই রকমের ধারণা পোষণ করেন। তাঁদের ভেতর এক ধরনের মিলিটারি মানসিকতা কাজ করে। আইনস্টাইন কারণেই স্কুলকে তুলনা করেছিলেন মিনি ক্যান্টনমেন্টের সাথে,  যেখানে শিক্ষকরা নিজেদের একেকজন জেনারেল ভাবেন।

এখন ডিসেম্বর মাস। স্কুল সেকশানের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। এখানে অবশ্য বার্ষিক পরীক্ষা বলে না, বলে তৃতীয় মেয়াদী পরীক্ষা। কলেজের টিচারদের স্কুলেরও ক্লাস নিতে হয়। টিচাররা কলেজের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে স্কুলের পরীক্ষার খাতা কাটছেন। সাঈদ স্যার যখন রুমে থাকেন বেশিরভাগ আলোচনায় তিনিই স্পিকারের ভূমিকা পালন করেন।

আজ ফোর্থ পিরিয়ড শেষ করে টিচার্স রুমে আসার সাথে সাথেই সাঈদ স্যার বললেন, "কাল সকাল সাড়ে আটটায় গাড়ি চকবাজার পৌঁছাবে। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের বাসার গলির মুখে গাড়ি দাঁড়াবে। আপনি ওখান থেকে উঠবেন।"
"ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডামের বাসার গলি তো আমি চিনি না।" - বলার সাথে সাথেই সাঈদ স্যার কাশেম স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার চাকরি থাকা উচিত কি না।

হাসাহাসি থামার পর সাঈদ স্যার আবার মনে করিয়ে দিলেন, "তাহলে প্রদীপ আর ছোলাইমান ভাই, কাল সকাল সাড়ে আটটায় রেডি থাকবেন। গাড়ি ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের বাসার গলির মুখে থামবে। আপনারা সাড়ে আটটার মধ্যে ওখানে চলে আসবেন। সুচরিত, আপনি তো আন্দরকিল্লা থেকে উঠবেন।"
"জ্বি সাঈদ ভাই।" - সুচরিত স্যার জবাব দিলেন।
"আইভি ম্যাডামও ওখান থেকে উঠবেন। আজকে যদি আর কথা নাও হয়, কালকে দেখা হবে।" - খুব ব্যস্তভাবে চলে গেলেন সাঈদ স্যার।

আগামীকাল কলেজের টিচারদের পিকনিক। সাঈদ স্যার সম্ভবত  পিকনিক কমিটির হেড। অঞ্জন স্যার, নাসির স্যার তো আছেনই, সম্ভবত ছোলাইমান স্যারও আছেন কমিটিতে।

আমাকে আজকের মধ্যে ভাইস প্রিন্সিপালের বাসার গলি খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? আজকে যাবার সময় বাস থেকে নেমে ভাইস প্রিন্সিপালকে ফলো করবো? কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। ছোলাইমান স্যারও চকবাজার থেকে উঠবেন। তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম, কাল চকবাজারের কোথায় দাঁড়াতে হবে। ছোলাইমান স্যার যেখানে দাঁড়াতে বললেন সেই জায়গাটা আমার অতিপরিচিত জায়গা। 
টিফিনের পর আজ আমার আর ক্লাস নেই। কাশেম স্যার আর অঞ্জন স্যার খাতা কাটছেন আমার টেবিলে। অভিজ্ঞতা মানুষকে দক্ষতা দেয়। দেখলাম কত দ্রুত খাতা কাটা হয়ে যাচ্ছে। নিয়তিদি এলেন। খালি কাপ-প্লেট নিয়ে যাবার সময় টাকাও নিয়ে যান। কে কী খেয়েছেন কীভাবে মনে রাখেন কে জানে।
"আপনি কীভাবে মনে রাখেন কার কত টাকা হয়েছে?" - টাকা দিতে দিতে নিয়তিদিকে জিজ্ঞেস করি। "কোথাও কি লিখে রাখেন?"
"না স্যার, লিখে রাখি না কোথাও। আমার এমনিতেই মনে থাকে স্যার। কীভাবে মনে থাকে জানি না।" - নিয়তিদির সরল উত্তর।
"নিয়তি হলো আমাদের হিউম্যান ক্যালকুলেটর।" - খাতা কাটতে কাটতে অঞ্জন স্যার বললেন।
"এই নিয়তি, তুমি আমাকে আরেক কাপ চা দিও। ভাইজান, আপ্নে খাবেন নি?"
"আপনি খাওয়ালে খাবো না কেন? দিতে বলেন।" - কাশেম স্যারের সাথে অঞ্জন স্যারের সম্পর্ক যে খুবই ভালো তা বোঝা যায়। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ভেতর কোন দলাদলি নেই, ব্যক্তিগত কোন্দল নেই, সবাই এক সাথে মিলেমিশে কাজ করছেন - এটা দেখে খুবই ভালো লাগছে আমার।

>>>>>>>>>>>> 
'টা বেজে গেছে। ছোলাইমান স্যার যেখানে দাঁড়াতে বলেছিলেন আধঘন্টা ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। এখনো তাঁর দেখা নেই, বাসও আসেনি। এই জায়গাটি আমার অতি-পরিচিত। এই শহরে পড়তে এসে এই অঞ্চলেই আমার কেটেছে বেশিরভাগ সময়। উচ্চমাধ্যমিকের পুরো সময় কেটেছে প্যারেড কর্নারে শেরে বাংলা হোস্টেলে।  চট্টগ্রাম কলেজের পূর্বদিকে সিরাজদ্দৌল্লা রোড, আর পশ্চিম দিকে কলেজ রোড ধরে কত শত বার যে হেঁটেছি তার কোন হিসেব নেই। চকবাজার পোস্ট অফিসের সামনের একটা বিল্ডিং- আমার দিদিরা থাকতো। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সেখানেও যাওয়া হতো প্রায় প্রতি সপ্তাহে। পোস্টাপিসের পাশেই চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ। সাইনবোর্ডটা বেশ ময়লা হয়ে গেছে। আমাদের দেশে সংস্কৃতিচর্চা তবুও কিছুটা হয়, কিন্তু বিজ্ঞানচর্চা সে তুলনায় সেভাবে হয় না

ফুটপাত ধরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। 'টায় পোস্ট অফিস খুলেছে। পিকনিক সাধারণত ছুটির দিনে হয়। কিন্তু আমরা আজ মঙ্গলবারে পিকনিকে যাচ্ছি। সাঈদ স্যার বলেছিলেন ঠিক সাড়ে আটটায় এখানে থাকতে। আমি তারও আগে চলে এসেছি। চন্দনপুরার গলির ভেতর আমার বাসা থেকে এখানে হেঁটে আসতে প্রায় পনের মিনিট লেগেছে। ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডামের বাসার গলি চিনতে পেরেছি। ছোলাইমান স্যার হয়তো ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডামের বাসায় চলে গেছেন। আমি গলির মুখে অন্যদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি কখন বাস আসবে।

রাস্তা থেকে একটু দূরে দিনমজুরদের কয়েকজন এখনো রাস্তায় বসে আছেন কাজের সরঞ্জাম নিয়ে। চকবাজারের এই মোড়ে প্রতিদিন সকালে দিনমজুররা এসে জড়ো হন। বিভিন্ন কাজের কন্ট্রাকটররা এসে তাঁদের নিয়ে যান যেদিন যে কাজের জন্য যতজন লাগে। এই শ্রমিকদের দেখলে আমার কেমন যেন মায়া হয়। প্রতিদিন ভোরে এসে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয় কখন কেউ এসে তাঁদের কাজের জন্য ডাকবে। প্রত্যেকেরই মনে আশা যেমন থাকে, তেমনি আশংকাও থাকে - যদি কাজ না পায়! তাহলে চলবে কীভাবে। এই দেশে কায়িক শ্রমের দাম কত্তো কম।

"গাড়ি এখনো আসেনি না?" ছোলাইমান স্যার কোন্‌ পথে এলেন টেরও পাইনি।
"আপনি কতক্ষণ আগে এসেছেন?" - ছোলাইমান স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
"আমি তো সাড়ে আটটায় চলে এসেছি।"
"আমি জানতাম তারা বেস থেকে এখানে সাড়ে আটটায় কিছুতেই আসতে পারবে না। তাছাড়া এত আগে ওখানে গিয়ে কী করবে। এখান থেকে কাপ্তাই যেতে খুব বেশি হলে দেড় ঘন্টা লাগবে। মাত্র ৫০ কিলোমিটার রাস্তা।"

ছোলাইমান স্যার অভিজ্ঞ মানুষ। আমি কাপ্তাই গিয়েছিলাম একবার ইউনিভার্সিটি থেকে। তখন ঠিক খেয়াল করিনি কতক্ষণ লেগেছিল।
"ওই তো গাড়ি আসছে।"

আমি আশা করেছিলাম বিমান বাহিনীর বাস আসবে। কিন্তু দেখলাম কাপ্তাই রোডের একটি পাবলিক বাস এসে দাঁড়ালো ফুটপাত ঘেঁষে। বাসের জানালায় সুচরিত স্যারকে দেখা গেলো মিটিমিটি হাসছেন। বাস থেকে সাঈদ স্যার ব্যস্তভাবে নেমে বললেন, "আপনারা উঠে পড়েন। আমি ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে নিয়ে আসি।"
ছোলাইমান স্যার দ্রুত উঠে গেলেন বাসে।

"ছার, আমরা এখানে ছার।" - দেখলাম বাসের ছাদে বড় বড় ডেকসি-পাতিলের সাথে বসে আছেন আবুল হোসেন, ইদ্রিস, মিজান, কাশেম, বাবুল, আর বাঁশিদা।

এই বাসগুলোকে আমরা বলি দোতলা বাস। এর পেছনে লোহার সিঁড়ি লাগানো থাকে, উপরে থাকে লোহার ছোট্ট রেলিং-ঘেরা জায়গা। যেখানে প্রচুর মালপত্র তোলা হয় এবং সাথে মানুষও। ছরারকুলের মেস থেকে ইউনিভার্সিটি যাবার সময় প্রায় প্রতিদিনই আমাকে বাসের পেছনের সিঁড়িতে ঝুলতে ঝুলতে যেতে হতো। আজও খুব ইচ্ছে করছে বাসের ছাদে উঠে ইদ্রিসদের সাথে গিয়ে বসি। কিন্তু তাতে ইদ্রিসরাই হয়তো অস্বস্তি বোধ করবে।

ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আর লাইলুন্নাহার ম্যাডাম বাসে উঠে বসতেই সাঈদ স্যার বাস ছাড়ার নির্দেশ দিলেন। বাসভর্তি ছোটছোট অনেক ছেলেমেয়ে। স্যার ম্যাডামদের ছেলেমেয়েদের কাউকেই চিনি না এখনো। পুরো পরিবেশটাকেই কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে। আমি বসেছি ছোলাইমান স্যারের পাশে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন, "কেমন আছো প্রদীপ?"
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি কাইয়ুম স্যার, অঞ্জন স্যারের পাশে বসে আছেন।
"জ্বি স্যার, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?"
"তোমাদের মায়া কাটাতে পারছি না। তাই তো সুযোগ পেলেই চলে আসি।"

যে যার মত কথা বলছে। পিকনিকের বাসে যা হয়। সবাই কথা বলছে বলে কেউ কাউকে ভালো করে শুনতে পাচ্ছে না। তাই আরো জোরে কথা বলছে। ফলে আরো শোর হচ্ছে, আরো শোনা যাচ্ছে না। ছোলাইমান স্যার বসেছেন জানালার পাশে। কিন্তু তিনি জানালার বাইরে তাকাচ্ছেন না। বাসের ভেতরের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন অঞ্জন স্যার আর কাইয়ুম স্যারের সাথে। তাঁদের কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম প্রিন্সিপাল স্যার ইতোমধ্যেই চলে গেছেন অফিসারদের সাথে অফিসারদের গাড়িতে। তাতে আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। কারণ বাসে অফিসার কিংবা প্রিন্সিপাল থাকলে সম্ভবত যথেচ্ছ কথাবার্তা বলা যেতো না।

সোয়া বারোটার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম। জায়গাটি বেশ সুন্দর। সম্ভবত কোন সরকারি রেস্ট হাউজ। পিকনিকে গিয়ে কোন কাজ না করতে হলে কেমন যেন অতিথি অতিথি লাগে। এই প্রথম কোন পিকনিকে এসে নিজেকে একেবারে অতিথি অতিথি মনে হচ্ছে। কলেজের পিয়নরা সব কাজ করে ফেলছে। সাঈদ স্যার, অঞ্জন স্যার, নাসির স্যার বেশ হৈ চৈ করে কাজ আদায় করে নিচ্ছেন।

ছেলেমেয়েরা হৈ চৈ করতে করতে নিজেদের মধ্যে খেলছে। তারা প্রত্যেকে প্রত্যেককে চেনে বলে মনে হচ্ছে। ম্যাডামরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন। কেউ কেউ ছবি তুলছেন। আমার কোন ক্যামেরা নেই, তাই ছবি তোলার ঝামেলা নেই। আমি জায়গাটা একবার ঘুরে দেখলাম। সুচরিত স্যার কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন।

প্রিন্সিপাল স্যারকে দেখলাম দু'জন জিন্স-জ্যাকেট পরা লোকের সাথে গদগদ হয়ে একটু পর পর 'ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার, জ্বি স্যার, ইয়েস স্যার' করছেন। স্যারের 'স্যার' বলার ভঙ্গি এবং ফ্রিকোয়েন্সি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ভদ্রলোকেরা কত পাওয়ারফুল। এই পাওয়ারের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা সম্ভব ততটাই দূরে থাকার চেষ্টা করলাম।

কাপ্তাই-এর প্রকৃতি খুবই সুন্দর। ডিসেম্বরের দুপুর। রোদের উজ্জ্বলতা আছে, কিন্তু তেমন উত্তাপ নেই। ছোট্ট একটা শাখানদী বয়ে চলেছে এই রেস্ট হাউজের পাশ দিয়ে। নদীর পানি ঘোলাটে সবুজ। নানা রকম শ্যাওলা দেখা যাচ্ছে সেখানে।

"এক্সিউজ মি স্যার।"
খুবই মিষ্টি গলায় কেউ ডাকলো পেছন থেকে। দেখলাম সুন্দর লাল রঙের ফ্রক পরা প্রজাপতির মতো একটা বাচ্চা মেয়ে। তার কয়েক ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে তারই সমবয়সী আরো একজন।
"স্যার, আপনাকে একটু ডাকছেন।"
"আমাকে ডাকছেন? কে ডাকছেন বলতো?"
"রিফাৎ আরা ম্যাডাম।"

রিফাৎ আরা ম্যাডাম আমাকে কেন ডাকবেন? তিনি তো বাস থেকে নেমেই সদলবলে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। রিফাৎ আরা ম্যাডামের তো আমার সাথে কোন কাজ নেই। হয়তো সুচরিত স্যারকে ডাকছেন, আর এরা আমাকে সুচরিত স্যার মনে করছে।
"ম্যাডাম কাকে ডাকতে বলেছেন?"
"আপনাকে।"
"আমি কে?"
"আপনি প্রদীপ স্যার।"
"ম্যাডাম তো সুচরিত স্যারকে ডাকতে বলেছেন।"
"না স্যার। সুচরিত স্যার ম্যাডামের সাথে আছেন।"

এই বাচ্চা মেয়েটার স্মার্টনেস দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমি পা বাড়াতেই তারা প্রজাপতির মত প্রায় উড়ে চলে গেল রেস্ট হাউজের দিকে।

একটা বড় টেবিলে অনেক খাতাকাগজ খুলে গম্ভীর মুখে বসে আছেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম। তাঁর পাশে নাসরীন ম্যাডাম, আর সামনের একটা চেয়ারে বসে আছেন সুচরিত স্যার। তাঁদের গাম্ভীর্য দেখে মনে হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনের মিটিং চলছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে যাবার আগে যেমন নার্ভাস লাগে, অনেকটা সেরকম লাগছে আমার। কী প্রশ্ন করবেন কে জানে।

"প্রদীপ, আসেন, বসেন।" - মনে হলো হাসিমুখেই ডাকলেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম। কিন্তু বাঘ হাসলেই কি আর বাঘের ভয় কমে যায়?

কোন রকমে জিজ্ঞেস করলাম, "কেন ডেকেছেন ম্যাডাম?" খুবই সতর্ক ছিলাম যেন -এর উচ্চারণ ঠিক থাকে। চট্টগ্রামবাসীর উচ্চারণের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আর -এ।

"বিতর্কের স্ক্রিপ্ট নিয়ে একটু কথা বলার জন্য। আপনি যে স্ক্রিপ্টটা দিয়েছেন আমরা চাচ্ছি আমাদের প্রথম বক্তা তারই একটা অংশ দিয়ে শুরু করুক। এখন আপনি যদি ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করে দিতেন।"

তো মস্ত বিপদে পড়লাম। কেন যে দুটো লাইন লিখতে গেলাম। প্রিন্সিপাল লিখে দিতে বলেছিলেন, লিখে দিয়েছি। কাজ শেষ। এখন আবার সেটার ব্যাখ্যা দিতে হলে তো মরে যাবো। ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু হঠাৎ এখান থেকে দৌড়ে পালালে আবার কী কৈফিয়ৎ দিতে হয়। শুনেছি শাহীন কলেজে কথায় কথায় 'কারণ দর্শাও' নোটিশ আসে। যদি নোটিশ আসে, "আপনি ৭ই ডিসেম্বর দুপুর একটার সময় কাপ্তাই পিকনিক স্পট হইতে ছুটিয়া পালাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন কেন তার কারণ দর্শান" তাহলে তো আরো বিপদ। 

যথাসম্ভব বিনীতভাবে বললাম, "তা শুরু করুক ম্যাডাম। আমার কোন সমস্যা নেই ওগুলো তো আমার লেখা নয় ম্যাডাম। আমি সানন্দার পৃষ্ঠা থেকে হুবহু লিখে দিয়েছি। আপনি চাইলে আপনাকে সানন্দাটা এনে দিতে পারি।"

বুঝতে পারছি রিফাৎ আরা ম্যাডাম আমার উত্তরে খুবই বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে বিরক্তি প্রকাশ করতে পারছেন না। ভদ্র মানুষদের এই বিড়ম্বনা সহ্য করতেই হয়। তিনি কোন কথা না বলে ভ্রু কুঁচকে হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোন কথা বলছেন না। মনে হচ্ছে ঝড়ের পূর্বাভাস। বাইরে রান্না হচ্ছে। মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে। এই কাজপাগল মানুষগুলোর নাকে মনে হয় খাবারের গন্ধও ঢুকছে না এখন। আর দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ হয় না।

"আমি এখন যাই ম্যাডাম।" - বলে ম্যাডাম কিছু বলার আগেই যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে চলে গেলাম একেবারে নদীর পাড়ে সেখানে গিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে শ্যাওলার মধ্যে ছোট ছোট মাছের আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।

"কী দেখছ ওখানে?"

ঘাড় ফিরিয়ে দেখি ইভা দাঁড়িয়ে আছে। তার দুই কানে বিরাট বিরাট দুটো চুড়ি ঝুলছে। এত বড় কানের দুল এর আগে কখনো দেখিনি।
"এখানে ছোট ছোট অনেক মাছ আছে। সেগুলো দেখছি।"
" তাই নাকি? দেখি দেখি!"
ইভার উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছে সে জীবনে কোনদিন মাছ দেখেনি।

"আরে ইভা, তুমি এখানে? আমি তো তোমাকে ওদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।" - বলতে বলতে কাইয়ুম স্যার এসে দাঁড়ালেন নদীর পাড়ে।
"কেমন লাগছে স্যার এখানে?" - কাইয়ুম স্যারকে প্রশ্ন করলাম।
"ভেরি বিউটিফুল। বাট বিউটি ইজ ইন দি আই অব দি বিহোল্ডার। শেক্সপিয়ার বলেছেন,..."
শেক্সপিয়ার কী বলেছেন তা জানার কোন আগ্রহ আমার এই মুহূর্তে নেই। কাইয়ুম স্যার ইংরেজিতে অনেক কিছু বলে যাচ্ছেন। তার মধ্যেই ইভা বললো, "প্রদীপ দেখো দেখো, একটা কচ্ছপ।"
"কৈ, কোথায় কচ্ছপ?" বলতে বলতে অঞ্জন স্যার ছুটে এলেন। দেখতে দেখতে নদীর পাড়ে ভীড় জমে গেল। দেখলাম সুচরিত স্যারও চলে এসেছেন।

খাবারের সময় হয়ে গেল। প্রিন্সিপাল তাঁর বিমান-বাহিনীর বসদের সাথে সাথে আছেন। আমরা খাবারের প্লেট নিয়ে যে যার মতো বসে গেলাম।

খাওয়ার পর শিশুদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। আমাদের স্যার ম্যাডামদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কী সুন্দর করে গান গাইলো, কবিতা আবৃত্তি করলো। সবাই মিলে এরকম বাইরে বেড়াতে এলে সবার মন কত্তো ভালো থাকে।

শীতের বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসে। জিনিসপত্র গাড়িতে তোলা হলো। কথা ছিল কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দেখতে যাবার। কিন্তু জানা গেল তার পারমিশান পাওয়া যায়নি। তার বদলে নৌবাহিনীর ঘাঁটি শহীদ মোয়াজ্জেম- যাওয়া হবে। প্রিন্সিপাল স্যার সবাইকে বললেন সেখানে আমাদের সবার জন্য চা তৈরি করে অপেক্ষা করছেন কর্মকর্তারা।

প্রিন্সিপাল তাঁর অফিসার বসদের গাড়িতে চলে গেলেন শহীদ মোয়াজ্জেমে। আমরা বাসে করে যখন পোঁছলাম সেখানে তখন সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে। খাড়া পাহাড়ি পথে ওঠার সময় এক জায়গায় বাসের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি দ্রুত পেছনের দিকে নেমে যেতে শুরু করলো। বাসের অ্যাসিস্ট্যান্ট বড় কাঠের গুড়ি চাকার নিচে দিয়ে বাসের গতি আটকালো। একটু পরে অবশ্য বাসের ইঞ্জিন আবার চালু হলো। করতে করতে সূর্য ডুবে যাচ্ছে যখন তখন সাঈদ স্যারকে স্যার-ম্যাডামরা বললেন, আমরা গাড়ি থেকে না নেমে এভাবেই ফিরে যাই। অন্ধকারে তো আর কিছু দেখা যাবে না।

সাঈদ স্যার প্রিন্সিপালকে বললেন কথা। প্রিন্সিপাল আগেই সেখানে চলে এসেছিলেন অফিসারদের গাড়িতে। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, "উনারা সবাই আপনাদের জন্য চা নিয়ে বসে আছেন। আর আপনারা চা না খেয়ে চলে যেতে চাচ্ছেন? নামুন সবাই। এভরিবডি গেট ডাউন।"

মনে হচ্ছে বি এন এস শহীদ মোয়াজ্জেমে চা খাওয়া বাধ্যতামূলক। বাস থেকে সবাইকে নামানো হলো। ছোট ছোট বাচ্চারাসহ সবাই গেলাম ঘাঁটির অভ্যর্থনা কক্ষে। পাহাড়ের উপর থেকে অস্তগামী সূর্যের শেষ কয়েক মিনিট দেখা গেলো। অপরূপ সুন্দর প্রকৃতির দেখা মিললো। কিন্তু যে চা নিয়ে কর্মকর্তাদের বসে থাকার কথা - সেই কর্মকর্তা কিংবা চা কোনটারই দেখা পাওয়া গেলো না। বড় হলঘরের মধ্যে আমরা সবাই এদিক ওদিক কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। একটু পরে প্রিন্সিপালকেও আর দেখা গেল না।
সাঈদ স্যারকে খুব মনমরা মনে হলো। সবাইকে এভাবে ডেকে এনে এভাবে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে ভালো লাগছিল না তাঁর। কিন্তু কিছুই করার নেই। 

আবার বাসে উঠলাম সবাই। বাস ছাড়ার পর দেখা গেলো সবাই চুপচাপ। কেউ কোন কথা বলছে না। যে শিশুরা এতক্ষণ বাক-চঞ্চল ছিল - তারা হঠাৎ যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ মনে হলো প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের সবাইকে অদৃশ্য বায়বীয় চা খাইয়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, "আপনারা সবাই কেমন খেলেন বায়বীয় চা?"

সবাই হেসে উঠলো। বাসে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এলো। একটু পরে বাচ্চারা সবাই গান শুরু করলো। কী চমৎকার যে গায় ওরা। চকবাজারে যখন নামলাম, তখনো কানে বাজছে, "গ্রাম ছাড়া রাঙামাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে।"

>>>>>>>>>>>>>> 
পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় আমার ডাক পড়লো প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে। আমি ভাবলাম নিশ্চয় রিফাৎ আরা ম্যাডাম নালিশ করেছেন আমার নামে। বিতর্কের স্ক্রিপ্ট লেখার ব্যাপারে সহযোগিতা করিনি বলে প্রিন্সিপাল স্যার এখনই ধমকাবেন আমাকে। ভয়ে ভয়ে প্রিন্সিপালের অফিসে হাজির হলাম, "স্যার আসবো?"
"প্লিজ কাম ইন।"
"স্যার ডেকেছেন?"
"ইয়েস। প্লিজ বি সিটেড।"
প্রিন্সিপালের মুখে হাসির চিহ্ন নেই। থমথমে মুখে বেল টিপলেন। কর্কশ শব্দে বেল বাজলো।
"দু'কাপ চা দিতে বলো।"
"স্যার, আমি চা খাবো না।"
"কেন খাবেন না? আলবৎ খাবেন। এটা বায়বীয় চা নয়, তরল চা। অবশ্যই খাবেন।"

রাগে প্রিন্সিপাল স্যারের কপালের দু'পাশের রগ ফুলে উঠেছে। আমি বুঝতে পারছি না 'বায়বীয় চা' এর খবর প্রিন্সিপালের কানে কে দিলেন। থমথমে মুখে আমি তরল চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।


2 comments:

  1. আপনি যে বাসের রেলিং ধরে চড়তে পছন্দ করেন- এটা শুনে আমার মজাই লেগেছে। তবে বায়বীয় চা শব্দটা আমার বেশি ভালো লেগেছে। এই পর্বের এনডিংটা অসাধারণ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক।

      Delete

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts