Showing posts with label সাহিত্য. Show all posts
Showing posts with label সাহিত্য. Show all posts

Monday, 24 March 2025

মহিউদ্দিন মোহাম্মদের ‘টয়োটা করোলা’




 ___________________________

টয়োটা করোলা ।। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ ।। জ্ঞানকোষ প্রকাশনী ।। প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০২৩ ।। প্রচ্ছদ - সব্যসাচী মিস্ত্রী ।। মূল্য ২৮০ টাকা ।। ১০৪ পৃষ্ঠা।।
____________________________


মহিউদ্দিন মোহাম্মদের মুক্তগদ্যের প্রথম সংকলন ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’ পড়ার সময় তাঁর শক্তিশালী গদ্যে মুগ্ধ হয়েছি। তাই জ্ঞানকোষ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় বই ‘টয়োটা করোলা’র প্রতি প্রত্যাশা ছিল আরো বেশি। তেরোটি নাতিদীর্ঘ গল্পের সংকলন ‘টয়োটা করোলা’। আমি সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র নই, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আছে – আনন্দের জন্যই আমি সাহিত্য পড়ি। তাই সাহিত্যের শাখাপ্রশাখার খটমট সংজ্ঞা নিয়ে আমার তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। ছোটগল্পের সংজ্ঞা কী? ছোটগল্প হয়েছে কি না দেখার জন্য রবীন্দ্রনাথের “ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা, নিতান্তই সহজ সরল“ জাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলি মিলিয়ে দেখার কোন দরকার আছে  বলে আমি মনে করি না। “নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করে মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ।“- মিলিয়ে নিতে গেলে দেখা যাবে এই বইয়ের সবগুলি গল্পেই বর্ণনার ছটার ছড়াছড়ি, ঘটনার ঘনঘটাও কম নয়। আর তত্ত্ব এবং উপদেশ তো আছেই। তবুও লেখার গুণে এই তেরোটি রচনাই আলাদা আলাদা ছোটগল্প হয়ে উঠেছে।

প্রথম গল্প “একটি পুকুর কী বলিতে চায়?” পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ঘাটের কথা” মনে পড়ে যায়। ভাষাগত শুধু নয়, আবহও একই রকমের। শুধু সেকাল আর একালের পার্থক্য। অবশ্য লেখক নিজেও এটা স্বীকার করেছেন বইয়ের ভূমিকায়। আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন,”রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন তাঁর নিজের সময় ও সমাজকে, আর আমি ব্যবহার করেছি পুরো একুশ শতকের সময় ও সমাজকে।“ রবীন্দ্র-আশ্রিত এই রচনাকে তাই পুরোপুরি মৌলিক রচনা বলা যাচ্ছে না। তবুও কিছু কিছু বাক্যে বিদ্যুৎ চমকায় – যেমন, “সূর্যেরও কী দয়া, নিজ হাতে মেঘ পরিষ্কার করিয়া তাহাদিগকে খরতাপ বিলাইয়া যাইতো।“ [পৃ ২৫]।

একটি পুরনো মসজিদের আত্মকথা ‘মসজিদের চিঠি’। কাল্পনিক এই চিঠিতে মসজিদের জবানিতে লেখক ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বেশ কিছু সাহসী বাক্য উচ্চারণ করেছেন যেগুলি আমাদের বর্তমান সমাজের দুঃখজনক অথচ সঠিক প্রতিফলন। “ইউটিউবে ওয়াজ শুনিয়া আপনাদের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে। নানা আনর-বানরের কথা শুনিয়া ইহুদিদের বকাবকি করিতেছেন, বৌদ্ধদের বংশচয়নিকা উদ্ধার করিতেছেন। গত শুক্রবার এক ফেসবুক পোস্ট পড়িয়া মিছিল লইয়া ছুটিয়া গেলেন শান্তিপুর গ্রামে, গিয়া জ্বালাইয়া দিলেন আট-দশটি হিন্দু ঘরবাড়ি।“ [পৃ ২৮]। “ধীরে ধীরে নবীর উম্মত হইতে খারিজ হইয়া আপনারা সমাজের উম্মতে পরিণত হইতেছেন। আল্লাহর নামে কোরবানি দেওয়ার কথা বলিয়া সমাজের নামে কোরবানি দিতেছেন। সমাজকে ভয় পাইয়া শুক্রবারে নামাজ পড়িতেছেন।“ [পৃ ৩০]। শুধুমাত্র হিন্দু পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের বই মসজিদের লাইব্রেরি থেকে বাতিল করে দেয়ার ঘটনারও সমালোচনা করেছেন লেখক। বর্তমান বৈরি সময়ে এটুকু করতেও অনেক বেশি সৎ সাহস লাগে। লেখক সে সাহস দেখাতে পেরেছেন।

‘দেশটি নষ্ট হইয়া গেলো’ গল্পটি বাংলাদেশের একদিন প্রতিদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলিকে কেন্দ্র করে লেখকের ধারাবাহিক সমালোচনা। বাংলাদেশে প্রতিদিন এতবেশি আজেবাজে ঘটনা ঘটে যে সেগুলি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে লেখকের মতে তা একটা ময়লার গাড়ির মতো মনে হয়। তাই লেখক সংবাদপত্রের নাম দেন ‘ময়লাপত্র’। সমাজের নানা দুর্নীতি, অন্যায়-অনাচার প্রতিদিন দেখতে দেখতে মানুষ এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে তাতে কারোরই মনে হয় না দেশ নষ্ট হয়ে গেলো। কেবল কোন মেয়ে যদি একটু সাহসী পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় সাথে সাথে সবাই চিৎকার দিয়ে ওঠে – দেশটি নষ্ট হয়ে গেল। লেখকের সমাজ-পর্যবেক্ষণের এখানে প্রশংসা করতেই হয়।

‘মানুষ ও বানরের পার্থক্য’ গল্পের নায়ক যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করে একটি ব্যাংকে আশি হাজার টাকা বেতনে কর্মরত। একদিন নায়ক কোনো এক জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে জঙ্গলের বানরের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন মানুষ ও বানরের মধ্যে আসল পার্থক্য কী। এখানে মানুষ ও বানরের জীববিজ্ঞানিক পার্থক্যের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মানুষের লোভ এবং অন্যায়ের প্রতি সীমাহীন আনুগত্যের প্রতি লেখকের তীব্র শ্লেষ। “কিছু কিছু রূপক ও  বাক্যবিন্যাস অপূর্ব। উদাহরণ – ‘ছড়িটিতে তিনটি পাকা কলা রোদের ঘষা খাইয়া চকচক করিতেছে।“ [পৃ ৪০]। “যেন চাঁদের আলো পাইয়া কোনো দীঘির জল মোমবাতির মতো গলিয়া পড়িতেছে।“ [পৃ ৪১]।

বাংলাদেশের এক শ্রেণির পুরুষ নারীদের ভীষণ অসম্মানের চোখে দেখে। ওয়াজ মাহফিল থেকে অপমান করে নারীদের বের করে দেয়া হয়। এরকম সমাজের নানাস্তরে নারীর অপমানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী গল্প ‘ভণিতা’। সোজাসুজি বলা যায়, এই গল্পে লেখকের বক্তব্য – আমাদের অনেকেরই বক্তব্য – যেখানে কোন ভণিতা নেই। কয়েকটা উদাহরণ দিই – “শূকর যেমন ময়লাভান্ডে হঠাৎ গোলাপের দেখা পাইলে আঁতকিয়া ওঠে, ইহারাও তেমনি স্বসৃষ্ট মলের ভাগাড়ে কোনো সৌন্দর্যের দেখা পাইলে পাগলা কুত্তা হইয়া ছোটে।“ [পৃ ৪৬]। “মনে হইতেছে, লজ্জাদেবী ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা হারাইয়া ভগিনীকুলের স্কন্ধে খুব শক্ত করিয়া চাপিয়া বসিয়াছেন। ওইদিকে গৌরবপুত্ররা, ঢিলা-কুলুপ লইয়া, লুঙ্গি উঁচা করিয়া পথেঘাটে নাচানাচি করিতেছে, বিড়ি টানিতেছে, শিস মারিতেছে, এবং রাস্তায় কোনো মেয়েলোকের দেখা পাইলে উঁহু শব্দে উচ্চারণ করিতেছে: শালী এই সন্ধ্যাবেলা একা একা কোথায় যায়?” [পৃ ৪৭]। “এ আসমানী দ্বিপদমন্ডলী চারপাশে উলঙ্গ নারী আবিষ্কার করিতেছে। দৃষ্টি-অভেদ্য জিন্স-প্যান্ট টি-শার্ট সালওয়ার-কামিজ ভেদ করিয়া নারীকুলের সর্বাঙ্গ দেখিতেছে। বোধ হইতেছে, ইহারা জোঁকের চোখ লইয়া জন্মাইয়াছে। জোঁক তা-ও মুখ লাগাইয়া রক্ত চোষে, কিন্তু এই নারীকাতর নেমাটোডগণ চোখ লাগাইয়াই সর্বস্বাদ লুটিয়া লয়।“ [পৃ ৪৮]

ধর্ম এবং ঈশ্বরের ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করা তো দূরের কথা, যৌক্তিক সমালোচনা করলেও সমূহ বিপদ বাংলাদেশে। মুক্তচিন্তার একটি ঢেউ খেলেছিল বাংলাদেশে বছর দশ আগে।  মুক্তচিন্তকদের অনেককেই নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, বেশিরভাগকেই করা হয়েছে ঘরছাড়া, দেশছাড়া। সেখানে সরাসরি ঈশ্বরের সমালোচনা করা কিংবা বিরোধিতা করা এখন মারাত্মক বোকামি। “ঈশ্বরের টেলিফোন”-এ লেখক সেই ভুল করেননি। তিনি ঈশ্বরের কাল্পনিক টেলিফোনে ঈশ্বরের মুখ দিয়েই বলিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের ধর্মান্ধ মানুষ ঈশ্বরের নামে কীসব কুকীর্তি করে বেড়াচ্ছে। দুটো উদাহরণ উল্লেখ করা যাক। “কিছু নফর আমাকে দানব সাজাইয়াছে। নিজেদের প্রতিশোধপরায়ণতা আমার ওপর আরোপ করিয়াছে। ভাবিতেছে, তাহাদের শত্রু নিশ্চয়ই আমারও শত্রু। মূলত এরা নিষ্ঠুর বলিয়াই কল্পনা করিয়াছে আমিও নিষ্ঠুর।“ [পৃ ৫২] “আমি নাকি নারীদিগকে সর্বদা হাত, মুখ, চোখ ঢাকিয়া চলিবার নির্দেশ দিয়াছি! একটি নারী নিজেকে লুকাইয়া রাখিলে উহাতে ঈশ্বরের কী সুবিধা হয়, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। মনে হয় গোলামেরা নিজেদের সুবিধার কথা ভাবিয়াই এ রূপ হুকুম আমার নামে জারি করিয়াছে।“ [পৃ ৫৩]। গল্পচ্ছলে লেখক ধর্মান্ধতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন ঈশ্বরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেই। তবে তিনিও ঈশ্বরকে খুবই অসহায় এক স্বত্ত্বা হিসেবে চিত্রায়ন করেছেন – যে ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই তার বান্দাদের বদমায়েশি বন্ধ করার, কেবল টেলিফোন করে নিজের সাফাই গাওয়া ছাড়া।

মোসায়েবি বাংলাদেশে এক ছোঁয়াচে রোগের নাম। কোনো এক অজানা কারণে এদেশের মানুষের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্যে দাঁড়িয়ে গেছে মোসায়েবি। নিজের চেয়ে যেকোনোকিছুর মাপকাঠিতে একটু উঁচু কাউকে দেখলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোসায়েবি শুরু হয়ে যায়। কে কত শৈল্পিকভাবে এই কাজটি করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলে বাংলাদেশে। ভয়াবহ রকমের দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরাচারী সরকারকেও তেল দেয়ার প্রতিযোগিতা চলে সর্বত্র। এই দগদগে সমস্যাটির আংশিক প্রতিফলন ঘটেছে ‘দরখাস্ত’ গল্পে যেখানে জনৈক আলি কামাল বর্ণনা দেন কত নির্লজ্জভাবে তিনি সরকারকে তেল দিতে পারবেন যদি তেল মারার দায়িত্ব পান।

‘আমাদের দাদী’ গল্পে বাস্তবের সাথে কিছুটা পরাবাস্তব কল্পনা [দাদী চাঁদের বুড়িকে বলে মেঘ সরিয়ে দিতেন…] মিশিয়ে বেশ কিছু আপ্তবাক্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন [স্বর্ণ মূল্যবান, এ বিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিলে পিতলের সাথে স্বর্ণের আর কোনো পার্থক্য থাকে না। স্বর্ণ দামি, এ কথা প্রচার করে একদল চতুর তোমাদের কাছ থেকে সম্পদ হাতিয়ে নিচ্ছে।]। গল্পের দাদীর উচ্চমার্গের দর্শনের সাথে কোনো তর্ক চলে না।

বইয়ের অন্যান্য গল্পগুলির তুলনায় বেশ দীর্ঘ গল্প ‘পাখির বাসা’। কোনো এক রমজান মাসে কোনো এক বাড়ির ছেলেরা তাদের বাড়ির ছোট্ট আমগাছে একটি পাখির বাসা আবিষ্কার করে। তারপর পাখিদের ঘিরে মানুষের জীবনের নানারকম ঘটনার দার্শনিক বিশ্লেষণ। “আমাদের শিশুরা, আমাদের বুড়োরা, কখন যে বন্দুকের ভক্ত হয়ে গেলো, আমরা টেরই পেলাম না। একটি বইয়ের চেয়ে একটি বন্দুক তাদেরকে বেশি উত্তেজনা দেয়। আকাশে ঘুড়ি দেখে এখন আর কেউ খুশি হয় না। শিশুরাও বুঝে গেছে, বন্দুকই আসল।“ [পৃ ৬৯]। “মানুষ কিছুতেই তার জন্মদিনের কথা মনে করতে পারে না। হয়তো এ শোকেই সে ঘটা করে জন্মদিন পালন করে।“ [পৃ ৭৫]। বর্ণনা শৈল্পিক হলেও মাঝেমাঝে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। কমলকুমার মজুমদারের ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এর কথা মনে পড়ে।

বাংলাদেশের কাঠমোল্লারা দিনরাত বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করে। মাঝে মাঝেই ঘোষণা দেয় বিজ্ঞান বর্জনের। গলা ফুলিয়ে বিজ্ঞানের বিরোধিতা করে আবার একই গলায় ঘোষণা করে বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার তাদের ধর্মের পবিত্র বই থেকেই হয়েছে। এসংক্রান্ত অনেক শক্তিশালী গদ্য রচিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। ‘বিজ্ঞান ছাড়া একদিন’ গল্পে লেখক সুনিপুণভাবে এঁকেছেন ধার্মিক আলিম মিয়ার বিজ্ঞান ব্যবহার না করে একটা দিন কাটাবার নিষ্ফল চেষ্টার রেখাচিত্র। “টাইলসের মেশিন নিশ্চয়ই কোনো ইহুদির বাচ্চা তৈরি করেছে। ওই ইহুদির বাচ্চা মহা ইবলিশ। মসজিদে মসজিদে সে টাইলস ঢুকিয়ে দিয়েছে। সবার নামাজ সূক্ষ্মভাবে বরবাদ করে দিচ্ছে।“ [পৃ ৭৯] বিজ্ঞানছাড়া একটি দিনও কাটাতে ব্যর্থ হয়ে আলিম মিয়ার বোধোদয় হয়, “ধর্মগ্রন্থ কোনো বিজ্ঞানগ্রন্থ নয়। মানুষ হীনম্মন্যতা থেকে ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানগ্রন্থ দাবি করে থাকে। পৃথিবীতে যখন কোনো কোরান শরীফ ছিলো না, তখনও বিজ্ঞান ছিলো। মানুষের মাঝে বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা ছিলো।“ [পৃ ৮২] লেখককে ধন্যবাদ গল্পের ভেতর হলেও এই সত্যি সোজাসুজি বলার জন্য।

জাপানের একটি টয়োটা করোলা গাড়ির বাংলাদেশে গিয়ে কী কী অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয় – তারই একটি সকৌতুক বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে ‘টয়োটা করোলা’ গল্পে। গাড়ি যদি কথা বলতে পারতো এরকমভাবেই বলতো। “টোকিওতে দেখিতাম, অফিসগুলোতে কেবলই সেবা উৎপাদন হইতো; আর এখানে দেখিতেছি, প্রতিটি অফিসেই রাতদিন টাকা উৎপাদন হইতেছে। কিন্তু এত টাকা উৎপাদন করিয়াও দেশটির টাকার অভাব কেন ঘুচিতেছে না, এ উত্তর খুঁজিয়া পাইলাম না।“ [পৃ ৮৮] বাংলাদেশের দায়িত্বজ্ঞানহীন পথচারীদের চরিত্রও ফুটে উঠেছে গাড়ির দৃষ্টিতে – “পথচারীদের কথা কী বলিবো! মশা যেমন কামড় মারিবার সময় কাহারও ঘুমের তোয়াক্কা করে না, এই পঙ্গপালেরাও তেমনি রাস্তা পার হইবার সময় নিজের জীবনের কোনো পরোয়া করে না। দৌড় মারিয়া, হেলিয়া দুলিয়া, কতো কসরত ও নাটক করিয়া যে ইহারা রাস্তার এ পাড় হইতে ওই পাড়ে যায়, তাহা বর্ণনা করিতে গেলে কয়েক দিস্তা কাগজ লাগিবে।“ [পৃ ৯০] “পায়ে হাঁটা দূরত্বেও গাড়ি-রিকশা ব্যবহার করিতেছে। পরিণামে অল্পদিনেই মোটাসোটা হইয়া ডায়াবেটিস বাঁধাইয়া অকেজো মাংস রূপে অন্ধকার ঘরে লুটাইয়া পড়িতেছে।“ [পৃ ৯১]

‘জার্নি বাই বাস’ গল্পটিকে প্রেমের গল্প বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রকাশক বইয়ের শুরুতে ভূমিকায়। বাস ভ্রমণে সহযাত্রীর প্রেমে পড়ে যাওয়ার ঘটনা গল্পে নতুন নয়। এরকম গল্প হাজার জন হাজারবার লিখেছেন এর আগে। কিন্তু এই গল্পের বিবরণে নিজের তারুণ্যের সময়ে বাংলা সিনেমা দেখার কিছু উদাহরণ দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। “নায়ক্ জসিম যে-কালে উপর্যুপরি লটারি জিতিয়া ভ্যানচালক হইতে আচমকা কোটিপতি পদে উন্নীত হইতো, বাড়িগাড়ি করিয়া আসমানে হুলস্থুল ফেলিয়া দিতো …” [পৃ ৯৩] নায়িকার দৃষ্টি আকর্ষণ করার আগ্রহে নিজের পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান জাহির করার উদ্দেশ্যও কেমন যেন পরিচিত মনে হলো – “একবার ভাবিলাম, মোবাইল কানে লাগাইয়া ফেইক-কলে কাহারও সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্স লইয়া আলাপ করি। আবার ভাবিলাম, জেনারেল রিলেটিভিটির কোনো ইউটিউব ভিডিও ফুল ভলিউমে ছাড়িয়া দিই।“ [পৃ ৯৫]

বইয়ের শেষ গল্প ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স’। বাংলাদেশে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবার জন্য কী কী করতে হয় তা আমার ছিল না। কিন্তু এই গল্প পড়ে আঁৎকে উঠেছি বিআরটিএ নামক প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ খাওয়ার আয়োজন দেখে। শুধু তাই নয়, গল্পের ভেতরই মারাত্মক প্রশ্ন উঠে এসেছে – “গাড়ি চালাইতে লাইসেন্স লাগিলেও দেশ চালাইতে কোনো লাইসেন্স লাগে না। একটি ছোট চার চাকার যান চালাইতে এত টেস্ট, এত আয়োজন, অথচ এমন বিশাল দেশখানা যাহারা চালাইতেছে, তাহাদিগকে কোনো পরীক্ষার ভেতর দিয়া যাইতে হইতেছে না। দেশের স্টিয়ারিংয়ে বসিবার যোগ্যতা তাহাদের আছে কি না, দেশটি খাদে পড়িলে টানিয়া তুলিবার কৌশল তাহারা জানে কি না, এ সত্য যাচাই না করিয়াই রাষ্ট্ররূপী গাড়িটিকে মন্ত্রী নামক ড্রাইভারদের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে।“ [পৃ ১০২]

ভাষাশৈলীর কারণে প্রত্যেকটি গল্পই উপভোগ্য এবং ভাবনা জাগানিয়া – এবং লেখক সেকারণেই সার্থক। তবুও বইয়ের শুরুতে প্রকাশকের কথা এবং লেখকের কথা নিয়ে দুএকটি কথা না বললে নিজের অনুভূতির সাথে প্রতারণা করা হবে।

প্রকাশকের কথায় জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর প্রকাশক শাহীদ হাসান তরফদার ডক্টর আশিষ পালের জবানিতে লিখেছেন, “বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথে থেমে আছে, এ কথাটি আজ এই পাণ্ডুলিপি পড়ে আমার ভেতর থেকে দূর হয়ে গেল।“ ডক্টর আশিষ পাল সম্ভবত এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি যে কজন পড়েছেন তাঁদের একজন। তাঁর লেখা কিছুই আমি পড়িনি। তাঁর সাহিত্যবিবেচনাবোধ সম্পর্কেও আমার কোন ধারণা নেই। কিন্তু তিনি যদি এই বইকে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী অন্যসব রচনার উর্ধ্বে স্থান দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ বলে থাকেন, তাহলে তাঁর বিবেচনাবোধে আমার আস্থা নেই। প্রকাশক পাঠকদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন – “অনেক কাঁচা পাঠক আছেন, যারা নাম পুরুষে বর্ণনা করা গল্পের ভাষ্যকারের কন্ঠকে লেখকের নিজস্ব প্রাবন্ধিক কন্ঠ মনে করে তালগোল পাকাতে পারেন।“ – তার কি কোন দরকার ছিল? লেখা পাঠ করার পর পাঠক কে কী ভাববেন তাও ঠিক করে দিতে হবে? পাঠকের বোধশক্তি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলেই কি গল্পের গুণগত মান বেড়ে যাবে? আর গল্পগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণের সাথে যে পৃষ্ঠা নম্বর দেয়া আছে তার সাথে মূল পৃষ্ঠা নম্বরের মিল নেই।

লেখকের কথায় লেখক নিজের লেখার স্টাইল আর যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তার সপক্ষে কথা বলতে গিয়ে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা বিনাবাক্যে মেনে নেয়া যায় না। তিনি লিখেছেন, “শিল্প সাহিত্যের শূন্য গোয়ালে গরু সেজে হানা দিচ্ছে ছাগল।“ প্রশ্ন হলো শিল্প-সাহিত্যে কে গরু, কে ছাগল তা নিরুপন করবেন কে? লেখক নিজেকে এই গোয়ালের উন্নততম গরু ঘোষণা করলেই কি তিনি হয়ে গেলেন, আর তাঁর সমসাময়িক সবাই ছাগল হয়ে গেল? এই বইতে তিনি সাধু আর চলিত ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি খিঁচুড়িভাষা তৈরি করেছেন এবং বলছেন তা অতীব সুস্বাদু এবং মসৃণ হয়েছে। এই জগাখিচুড়ির পক্ষে বলতে গিয়ে বলছেন, “আমি বিশুদ্ধবাদের দালাল নই। সবসময় বিশুদ্ধবাদিতার চাকর সেজে থাকা একজন সৃষ্টিশীল লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়।“ বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে লেখার নাম যদি বিশুদ্ধবাদের দালালি করা হয় বা বিশুদ্ধবাদিতার চাকরি করা হয়, তাহলে অশুদ্ধভাবে লেখার নামই কি হবে সৃষ্টিশীলতা? অন্য কেউও যদি যেকোনকিছু অশুদ্ধভাবে লিখে যদি দাবি করেন যে শুদ্ধবাদিতার চাকর তিনি নন – তাহলে কি মেনে নেয়া হবে?

লেখক সাহিত্য সমালোচকদেরও খাটো করেছেন তাঁদেরকে ‘কিছু নির্দিষ্ট নামের খাদেম’ বলে। তিনি আরও বলেছেন, “আমি অবাক হবো না, যদি এ বইয়ের আলোচনায় কেউ অপ্রাসঙ্গিকভাবে কোনো মিনি-ফ্রয়েড বা মিনি দস্তয়েভস্কিকে টেনে আনেন।“ আমার পড়াশোনা খুবই সীমিত। ফ্রয়েড এবং দস্তয়েভস্কি সামান্যই পড়েছি – তাতে এই লেখকের কোন গল্পেই তো তাঁদের নাম মনে পড়লো না। প্রচন্ড আত্মগরিমা থেকেই তিনি এসব লিখে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিজে দাবি করেছেন। তবে “কাঁচা পাঠক” যদি লেখকের নিজের কথা “বাঙালি যে-রূপে দুই কলম লেখাপড়া শিখিয়া রবীন্দ্রনাথের জন্মদাত্রী সাজে, ডিকনস্ট্রাকশন, পোস্ট-কলোনিয়াল, সাব-অল্টার্ন, ফ্যাটালিজম, প্রভৃতি জার্গন মুখস্থ করিয়া বুদ্ধিজীবীর উর্দি পরিধান করিয়া থাকে, সে-রূপে শুক্র গ্রহটি তাহার আসল রূপ লুকাইয়া স্টার হইয়া মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করিতেছে।“ [পৃ ৩৬] – ব্যতিক্রমহীনভাবে সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য মনে করে বসে!

Saturday, 1 March 2025

রিফাৎ আরার 'মেলবোর্নে দেশ বিদেশ' - পর্ব ৩৮-৪৪

 



৩৮

 

রনিকে বললাম, রনিবাবা, বোটানিক্যাল গার্ডেনটা আরেকবার ঘুরে দেখতে চাই

          শনিবারের ছুটির দিনে রনি আমাদের নিয়ে গেল বোটানিক্যাল গার্ডেনে। অন্য যে দিন এসেছিলাম সেদিন স্রাইন অব রিমেম্বারেন্স দেখে গার্ডেনে ঢুকতেই বেলা পড়ে এসেছিল। আজ সকাল সকাল আসাতে রৌদ্রস্নাত উজ্জ্বল বাগানে ঢুকেই মন ভাল হয়ে গেল।

          এখানে ঘাস যেন মখমল পাতা। ইচ্ছে করলেই যে কোন জায়গায় শুয়ে পড়া যায়। অনেককেই দেখলাম রৌদ্রস্নান করছে। এক তন্বী তরুণী উর্ধাঙ্গে অন্তর্বাস পরেই উপুড় হয়ে গভীর মনযোগে লেখাপড়া করছে। অনভ্যস্ত চোখ আমার সুন্দরী মেয়েটির দিকে বার বার যায়, আর ভাবি মেয়ে, তোমরা কত নিরাপদ। আর আমাদের দেশের মেয়েরা সর্বাঙ্গ ঢেকেও মনুষ্যস্বাপদের নখ-দন্ত থেকে রেহাই পায় না।

          অনেক পরিবার এসেছে যাদের শিশুরা নানারকম খেলায় মেতেছে। খেলার সরঞ্জাম ওরা নিয়েই এসেছে।

          আমি হেঁটে বেড়াই। মেয়ে বারবার সাবধান করে আম্মু, ব্যাকপেইন বাড়বেবাড়ুক। আমি পাত্তা দিই না। এত সুন্দর প্রকৃতি, এতো আলো, উদার আকাশ, প্রাণময় সজীব বৃক্ষ দেখতে গিয়ে ব্যথা বাড়লে আমি সয়ে নেব।

          কত রাস্তা কত দিকে গেছে। কত রকমের গাছ। কিন্তু একটা জিনিসের অভাব বোধ করলাম গাছের গায়ে তার প্রজাতির নাম, বয়স এগুলো লেখা নেইঅথচ একেকটা গাছের গুঁড়ি আর বিশাল ডালপালা ছড়ানো শাখাপ্রশাখা দেখে মনে পড়ল লেখক মোতাহার হোসেন চৌধুরির জীবন ও বৃক্ষ প্রবন্ধের স্মরণীয় উক্তি নিরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের জীবনের সার্থকতার গান শোনায়রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষ কবিতার কথাও মনে এল। সত্যিই তো এই সবুজ সতেজ গাছগুলো না থাকলে এই জায়গাটাওতো নিরস মরুভূমির মতই লাগত।

          কোথাও কোথাও আবার ছোট ছোট লেক। যত দিকে রাস্তা গেছে ততদিক আজকেও পুরোটা দেখা সম্ভব হবে না। হঠাৎ একটা জলাশয়ের সামনে আপাত সমতল জায়গায় দাঁড়িয়ে রনি আঙুল তুলে দেখাল সামনের দিকে। সে জায়গাটা কিছুটা উঁচু কিন্তু সূর্য ডোবার প্রহরে কী যে অপরূপ দেখাচ্ছে ঐ জায়গাটাকে তা আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। অবাক হয়ে আমরা কিছুক্ষণ সবাই দাঁড়িয়ে দেখলাম মহাপৃথিবীর এক টুকরো সৌন্দর্য যা যুগপৎ প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্টি। কারণ এটি একটি পরিকল্পিত প্রকৃতি-বাগান। এ বাগানে গবেষণার নানা উপাদান সংরক্ষণ ও পরীক্ষাগারও রয়েছে।

          আর নাই যে বেলা নামল ছায়া ধরণীতে হ্যাঁ, বেলা প্রায় শেষ প্রান্তে। তবুও দিনের শেষ প্রহরের আলোয় পথে যেতে যেতে আরো কিছু দেখা যাবে।

          বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পথের মোড় ঘুরতেই নানারকম ক্যাকটাস। ক্যাকটাস যে কতরকম, তা এই প্রথম দেখলাম এবং মনে হলো শেষবারও।

          যেখানেই গিয়েছি রনি আর প্রদীপ অনেক ছবি তুলেছে। কিন্তু স্মৃতির রঙ প্রত্যেকেরই ভিন্ন। এর আগে ফিটজ্‌রয় গার্ডেনে গ্রিনহাউজের মত একটি ঘরে অর্কিড দেখে কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। গঠন সৌষ্টবে, বর্ণিলতায় সেগুলো একের মধ্যে অনন্তকে যেন ধরে রেখেছে। এসব জায়গায় গেলে কেবলই মনে হয় বসে থাকি। আমাদের জীবনের একেকটি পর্বকে আমরা নিরন্তর বয়ে চলা সময়কে ভাগ করে নিজেদের শৃঙ্খলে বেঁধেছি। তাই সময় হয়েছে ঘরে ফেরার।

 

*****

৩৯

 

এই শনিবারে এখানকার একজন বাংলাদেশি ডাক্তারের বাসায় দাওয়াত। এর আগে অবশ্য রনিদের বন্ধু ডাক্তার আনোয়ার হোসেনের বাসায় দাওয়াত খেয়েছি। ওনাদের সাথে একসাথে বেড়াতেও গিয়েছি। তিনটি ফুটফুটে মেয়ে তাদের। বড়জন নবনী দশ-এগারো বয়স হবে হয়তো, কিন্তু খুব মিশুক, আর ছোটবোনদের বিষয়ে খুবই কেয়ারিং।

          অস্ট্রেলিয়াতে ডাক্তারদের উপার্জন বেশি। কেউ কেউ বলে প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বেশি। কিন্তু ডাক্তার ওখানে সবাই হতে পারে না। অনেক বেশী মেধাবী এবং নাইনটি প্লাস স্কোর না করলে মেডিক্যালে ভর্তির চান্স পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ থেকে যারা যায় তারা ওখানে আবার অস্ট্রেলিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিলের বিশেষ পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে তারপর জি-পি হয়। তারপর কারো ইচ্ছে থাকলে আরো উচ্চতর ডিগ্রির জন্য লেখাপড়া করে। তবে জিপি হতেইতো পেট্রোল শেষ। কারণ একবারে তা হওয়া কঠিন। আমার ছোট মেয়ে দিঠির বন্ধুরাও দু-একজন ওখানে আছে। কেউ পাশ করে চাকরি করছে, আর কেউ পড়াশোনা করছে।

          আজ যে ডাক্তারের বাসায় যাব তিনি প্রবীণ। তার স্ত্রী যতটুকু বলেছিলেন তাতে মনে আছে তারা প্রথমে নিউজিল্যান্ডে ছিলেন। তারপর অস্ট্রেলিয়ায় অর্থাৎ মেলবোর্নে স্থায়ী হয়েছেন। রাকাদের কামরুল ভাই (আর-এম-আই-টি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক) আমাকে বললেন, আন্টি এতদিন গরীবদের বাসাবাড়িতে দাওয়াত খেয়েছেন। আজ বড়লোকের বাড়ি দেখবেন

          সন্ধ্যায় আমরা গেলাম। বিরাট জায়গা নিয়ে সুবিশাল ডুপ্লেক্স। সামনে পেছনেও অনেক জায়গা। ডাক্তার গৃহিনীকে আগেও দেখেছি। দুই ছেলে তার। একজন বিয়ে করেছে। পুত্রবধু সহসাই মা হবে।

          কিছু কিছু মানুষকে দেখলে মনে হয় তারা এই পৃথিবীর ধুলোমাটির কিছুটা উপরে থাকেন। তাই তাদের চেহারায় কোন মালিন্য থাকে না। মধ্যবয়সী এই ভদ্রমহিলাটিকে যখনই দেখেছি প্রশান্ত মুখ, হাসিখুশি আর সর্বঅবয়বে সুখি সুখি ভাব। তার বেয়ান এবং বেয়ানের পুত্রবধুও এসেছে। ননদ-ভাবী কাজ করছে। বেয়ানও মাঝে মাঝে সামাল দিচ্ছে। অ্যাডভান্স স্টেজ-এর হবু মাও কিচেন সামলাচ্ছে। এরা এদেশে জন্ম এবং বেড়ে ওঠার কারণে শরীরে মনে অনেক বেশি শক্ত। আর এ রকম বৈবাহিক সম্পর্ক দাম্পত্যের মানসিক সাম্যের জন্যেও ভাল। কারণ এখানেই দু-একটি আলোচনায় শুনেছি বা আগেও বন্ধুদের পুত্র-কন্যাদের দেখেছি বিদেশে বড় হয়ে দেশ থেকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর সমস্যা হয়।

          ভাল লাগল। যেখানেই যাই নতুন দু-চারজনের সাথে আলাপ হয়, আর পুরানোরাতো আছেই। এদের সামাজিক সম্পর্কে শিশু বেশি হওয়াতে টিনএজারদের তেমন দেখলাম না। স্বভাবতই শিশু আর বড়দের আড্ডায় তারা আসতে চায় না। অনেকে এভাবে একাকী হয়ে নিজের ও পরিবারের জন্য নানা সমস্যা তৈরি করে। বয়ঃসন্ধিকাল এমনিতেই জটিল সময়।

         

*****

৪০

 

দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় এগিয়ে আসছে। তাই কন্যাসম কন্যারা এটা সেটা স্মৃতির সুগন্ধি রুমালের মত হাতে তুলে দিচ্ছে। হায় এত ভালবাসা কি হাতের মুঠোয় ধরা যায় এসব রইল আমার প্রাণে। তন্বী, মেঘলা, জ্যোতি, এনথিয়া, রুমকি, ফওজিয়া, নবনীর মা, নায়লার মা, লুনা সবাই যেন আমার রাকামণির মত। ওরাও বন্ধুদের মা-কে পেলে কিছুটা হলেও হয়তো মায়ের সুবাসটুকু পায়। আমিও আন্তরিক আলিঙ্গনে ভাললাগা ভালবাসার স্পর্শটুকু জানিয়ে দিতে চাই। মনে মনে বলি তোমরা ভাল থেকো, সুখে থেকো।

 

*****

৪১

 

যাবার সময় হল বিহঙ্গের। সত্যি সত্যিই সময় এগিয়ে আসছে। যা কিছু টুকটাক কেনাকাটা করেছি সেগুলো বাঁধা ছাঁদা হচ্ছে। পূর্বার মন খারাপ। আর আমার কন্যারতো যতই চাপুক চোখের জল চোখ ছাপিয়ে যখন তখন ঝরছে

          এমন সময় একদিন রনি বলল, অস্ট্রেলিয়াতে এসে বারবিকিউ না করে আম্মারা চলে যাবেন তা কী করে হয়?

          অস্ট্রেলিয়ায় বারবিকিউ ভীষণ জনপ্রিয়। প্রত্যেক পার্কেই বারবিকিউর চুলা, গ্যাসলাইন সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। রনি নিজেও একটা কিনেছে। কিন্তু যেহেতু মেলবোর্নের গ্রেট ওশ্যান রোডে আমাদের যাওয়া হয়নি, তাই সাব্যস্ত হল গ্রেট ওশ্যান রোড পর্যন্ত দূরত্বের কারণে যাওয়া না গেলেও ঐ পথে লর্‌ন বিচে যাওয়া যায়।

          সুতরাং সাব্যস্ত হল ফেরদৌস-তন্বী, রাকা-রনি, সাকি-রুমকি, লুনা-মেহেদি এই চার পরিবার যাবে। বারবিকিউতে ছেলেদের কাজ একটু বেশি। মেয়েরা সেদিন খায়-দায়, আড্ডা দেয়। আর খাবার হচ্ছে সাধারণত প্রসেসড মাটন, বিফ, চিকেন। শুধু চুলা জ্বালিয়ে ঝলসে নাও, আর গরম গরম খাও। সাথে নানা পদ মেশানো সালাদ।

          একটু সকাল সকালই রওনা দিলাম আমরা। অনেক দূরের পথ। গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটার দূরত্বও কমপক্ষে ঢাকা-চট্টগ্রামের সমান। যদিও মসৃণ রাস্তার কারণে সেটা গায়ে লাগে না।

          আরামের যাতায়াত। দুপাশে সুন্দর প্রকৃতি। কখনও সমতল, কোথাও পাহাড়-জঙ্গল। তবে রাস্তা পাহাড় কেটে করাতে পাকদন্ডীর মত কিছুটা ঘুরে ঘুরে গেছে। তাই বাঁক ঘুরতে চালককে সাবধানে থাকতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলে নির্ঘাত দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। তবে সেটা হয় না। প্রত্যেক পথের বাঁকেই সতর্ক সংকেত দেয়া আছে।

          বেশ অনেকটা যাওয়ার পর শুরু হল একপাশে সমুদ্র, অন্যপাশে পাহাড়। পাহাড়ে প্রচুর গাছপালামাটিধ্বসের বিপদাশঙ্কায় পাহাড়ের ঢাল লোহার কঠিন জালে বাঁধা।

          পথে দুএকটা মফস্বল শহরের মত শহরও দেখলাম। পাহাড় আর সমতল মিলিয়ে শহর। আর সমুদ্রে ভাসমান ইয়ট নিয়ে ঘুরছে সমুদ্র-বিলাসীরা।

          একটা জায়গায় এসে আমরা থামলাম। লর্‌ন থেকে কিছুটা আগে। এ জায়গাটার নাম অ্যাঙ্গেল-সি। শান্ত জল, বাতাসে একটু ঝিরিঝিরি কাঁপছে। সূর্যের আলোর প্রতিফলনে অ্যাঙ্গেল সির পানিতে রূপালী আলোর নাচ। মনে পড়ল আমাদের বাড়ির পুকুরের টলটলে জল একবার ইচ্ছে হল ঝাঁপ দিই রবীন্দ্রনাথের ছেলেটা কবিতার ছেলেটার মত দেখি না কী আছে ওখানে।

          আম্মু আসেন। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে লর্‌ন-এ পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে

          মুহূর্তের অন্যমনস্কতা কাটিয়ে ত্রস্ত পায়ে এসে গাড়িতে উঠলাম।

          এবার দেখছি একপাশে নীল সমুদ্র। অন্যপাশে পাহাড়ে খুব সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি। রনি বলল, এখানে সাধারণ অত্যন্ত ধনীরা বাস করে। আবার কেউ কেউ নিজেরা যখন থাকে না, তখন পর্যটকদের ভাড়া দেয়।

          সুরম্য অট্টালিকা, খোলা বারান্দা, বসলেই সমুদ্র সৈকত আর অপার নীল জলরাশিউপরে আকাশের নীল সামিয়ানা আর পুঞ্জ মেঘের ভেসে বেড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে মন গুনগুনিয়ে ওঠে কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা ...। হায় খোদা, গলায় একটু সুর দিলে না যে মন খুলে গাইব।

          আমাদের দলের সবাই কিছু আগে পরে এসে পৌঁছালাম মহাসাগরের বালুকাবেলায়। সবুজ ঘাসে ঢাকা বেলাভূমি আবার মাঝে মাঝে বালুকারাশি। ঘন ঝোপে ঘেরা সমুদ্রের একপাশ। সেখানে মাঝে মাঝে বসার জন্য হেলানো বেঞ্চি। তারপরই ওয়াকওয়ে। একদিক একবারে খালি। সেখানে সমুদ্রে নামার সৈকত। এই সমুদ্রের পরে কী আছে? আমি জানি না। যারা দুঃসাহসী কেবলমাত্র তারাই জানতে পারে, জানার জন্য জীবন দেয়, মানুষকে জানিয়ে যায়। এভাবে সভ্যতার স্তরে স্তরে মানুষের জানার পরিধি বাড়ে।

          আমরা বাঙালি দুধে-ভাতে সুখেই ছিলাম। তাই কবিও বলেছেন, ঘর হৈতে আঙিনা বিদেশএখন আর তেমন দিন নেই। দিন বদলের পালায়। ঔপনিবেশিক শাসনে-অত্যাচারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের সন্তানেরা ঘর বন্ধক রেখে শ্রম বিক্রি করতে দেশান্তরে যায়। সাগর মহাসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারায়। তবুও প্রাণ হাতে নিয়ে পরের দল এগিয়ে যায়।

          এই মহাসাগর (গ্রেট ওশ্যান) পানি নিয়ে খেলছে শান্ত লয়ে। বাংলাদেশের পতেঙ্গা বা কক্সবাজারে যে দুরন্ত ঢেউ এখানে তেমন। মহাসমুদ্র মানে তো বিরাট বিশালত্বের ব্যাপার তাই কি সে নিজের উচ্ছ্বাসকে নিজের ভিতরে ধরে রাখতে চায়?

          আমি আর সাজু আপা গল্প করছি। শামসুল আলম ভাই আর সিরাজুল ইসলাম সাহেবও হাত ধরাধরি করে ঘুরছেন, দেখছেন। শিশুরা বালি নিয়ে খেলছে। পূর্বা, মেহরিন এই দলে একটু বড় তবু তাদের বন্ধু তানিশা। দিব্য, তাসিন, সারিক আর সোফি একটা খেলার জায়গায় ব্যারিকেড ডিঙিয়ে খেলছে। আমাদের কন্যারা রুমকী, রাকা, তন্বী, লুনা গল্প করছে। আজ তাদের আপ্যায়নের ভাবনা নেই।

          ছেলেরা বারবিকিউ চুলা পরিষ্কার করে তাতে খাবার ঝলসানো শুরু করে দিয়েছে। সাজু আপার কনিষ্ঠ পুত্র বাবন সালাদ কাটছে। রান্না হতে হতেই চুলোর উপর থেকে নিয়ে খাচ্ছে সবাই। ইয়ামি -ইয়াম্মি।

          বাচ্চাদেরও জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। তাদের মন খেলায়। বেশ কিছু হলদে ঝুঁটি কাকাতুয়া খাবারের গন্ধে ঘুরে ফিরে আসছে। একটাতো একটু আদর আহ্লাদ করতেই বাবনের কাঁধে চড়ে বসল, তারপর আর যেতে চায় না।

          মজা করেই খেলাম। রান্নার খুন্তি ধরে ছবিও তুললাম। তবে সালাদপাতা আর সালাদড্রেসিং দিয়ে বানানো বাবনের সেদিনের সালাদের স্বাদটা চিরদিনের জন্য আমার মুখে লেগে থাকবে।

          খাওয়ার পর সবাই মিলে বিচে ঘোরাফেরা, ছবি তোলা হল। সার্ফাররা নামতে শুরু করেছে। এখানে সাগর এবং সৈকত এত নিরাপদ যে রোদ পড়ে আসতে শুরু করে সার্ফাররা সাগরে নামে।

          মহাসিন্ধু পারে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ক্ষুদ্রতম আমি হৃদয়ের একান্ত অর্ঘ্য নিবেদন করলাম। আর কোনদিন দেখা হবে না। ফেরার সময় দেখলাম সন্ধার পরেও সমুদ্রে জলকেলি করে বেড়াচ্ছে কিছু মানুষ। জীবন আমাদের প্রতি পদে দিল শঙ্কা-অনিশ্চয়তা, আর ওদের এত বরাভয়।

          রনি বলল, পাহারা আছে। বিপদ হলেই উদ্ধার করবে

          যত শঙ্কাই থাক, তবু সসীম জীবন সীমাহীন বেঁচে থাকার আকাঙ্খা নিয়ে এগিয়ে যায়। আমাদের দেশের ষোল কোটি মানুষও তাই ভয়কে জয় করে এগিয়ে যায়।

          ফেরার পথে একটা বাঁকে একটা রাস্তা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। রনি বলল, এটা লাইট হাউজে যাওয়ার পথ

          নিরব নির্জন। দুএকটা গাড়ি হঠাৎ হুসহাস পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। একুশ শতকের অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তির যুগে লাইটহাউজের উপযোগিতা আর নেই। তবু অতীতের স্মৃতি হিসেবে এটি মূল্যবান নিদর্শন। মানুষের ক্রমোন্নতির সাক্ষী। গাড়ি রেখে আমরা নামলাম। রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা উঁচুতে উঠতে হয়। নাবিকদের দিকচিহ্ন প্রদর্শক বিশাল উঁচু লাইটহাউজটি দেখে গোধূলি সন্ধ্যায় মনটা কেমন যেন কোন সুদূরের পিয়াসী হয়ে উঠল। প্রকৃতি আমাদের উৎফুল্ল করে আবার বিষন্নও করে। ধূপছায়া সেই সন্ধ্যায় হয়তো প্রিয়জনদের সাথে আসন্ন বিচ্ছেদ ব্যথায় আমি আমার পূর্বা-দিব্যকে জড়িয়ে ধরলাম।

 

*****

৪২

 

প্রদীপ ফিরে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকার কনফারেন্স শেষ করে। মাঝে মাঝে এসে আমাদের সামান গুছিয়ে দেয়। এটা-সেটা টুকিটাকি জিনিস যেগুলোর মূল্য স্যুভেনির হিসেবে সেগুলো কোনটা কোথায় রাখলে ভাল থাকবে এসব দেখে শুনে রাখছে। রাকা-রনিও সাথে আছে। পূর্বার ভীষণ মন খারাপ নানু কেন চলে যাবে।

          আবার আমি দোটানায়। একদিকে ছেড়ে যাবার কষ্ট, অন্যদিকে অথৈর কাছে ফিরে যাওয়ার আনন্দ। আর ছোট্ট কল্প যাকে রেখে এসেছি সে এখন হাত-পা ছুঁড়ে দাপাদাপি করে। স্কাইপে দেখেই বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে। আর রাকা তার দুচোখে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছেই।

          হায় খোদা, পৃথিবীতে এ মায়ার মিলনে বাঁধন যেমন আনন্দের, বিচ্ছেদ তেমনি কষ্টের। সন্তানের মত প্রিয় আর কোন কিছু কি পৃথিবীতে আছে!

          এর মাঝেই জেরিনদের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলাম। গেলাম মহুয়া আর জীবনের বাসায়। ওদের পুত্র আধৃত একেবারেই শিশু, কিন্তু হাসিটা উত্তমকুমারের মত মন-কাড়ানিয়া।

          সুনীল, শীর্ষেন্দুর গল্প-উপন্যাসে প্রবাসী সমাজের কথা পড়েছি। পড়েছি জাহানারা ইমাম, সাম্প্রতিক রেজাউর রহমান ও অন্যদের লেখায়। আর ভ্রমণ কাহিনি সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, ডাক্তার বরেন চক্রবর্তী এরকম অনেকের লেখা আরো টুকিটাকি যেখানে যা পেয়েছি। প্রদীপের প্রথম দেখা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে, ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন এছাড়াও সাময়িকপত্রে যখন যা চোখে পড়েছে পড়েছি। কিন্তু মেলবোর্নে এসে তিন মাস থেকেও আমি কিছুই লিখতে পারিনি। তবে আমি দেখেছি আমাদের বাংলাদেশের একদল উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে, তাদের পরিবার ও শিশুদের। ওরা এখানে ভাল আছে, মিলেমিশে আছে। হয়তো অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য পদমর্যাদায় সমান হওয়ার কারণে অসুস্থ কোন প্রতিযোগিতা চোখে পড়েনি এবং এটা মনে হয়েছে ওদের সবচেয়ে পজিটিভ দিক। বাংলাদেশকেও তারা ভোলেনি। দেশের বিভিন্ন ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন থাকে।

 

*****

৪৩

 

অনেকেই দেখা করতে আসছে সাথে এটা-সেটা গিফ্‌ট। মেয়েগুলোর জন্য মায়া লাগে। হয়তো দেশে নিজের ফেলে আসা মায়ের কথা মনে করে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। যাদের সাথে বেশি ওঠা-বসা ছিল সেই তন্বী আর মেঘলাতো কেঁদেই অস্থির। আমার জন্য ওদের এ ভালবাসা আমিও বুকের ভেতর স্মৃতির সুগন্ধি রুমালের মত বয়ে বেড়াব আর যে কটা দিন বাঁচি।

          শিশুদের জন্যও মায়া হচ্ছে। তাসিন, তানিশা, মেহরীন, সারিক, ফিওনা, সোফি আর মেঘলার মেয়ে জায়না এরা সবাই এখন আমার নাতি-নাতনি। এদের সবাইকে আবার কি দেখব? আর কি হে হবে দেখা? দেখা না হোক, প্রবাসী কবি তার নদী কপোতাক্ষের জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছিলেন। আমি তার মত মনে মনে এদেরকে বলি যদি দেখা নাও হয় তোমরা ভালো থেকো। তোমাদের জন্য ভালবাসা।

          সাজু আপার মন খারাপ আমি চলে গেলে তিনি একা হয়ে যাবেন, বেড়াতে গেলে ভাল লাগবে না। মেঘলা আর তন্বী তো দেখা করতে এসে কেঁদেই সারা। আমাদের মেয়েরা এত মায়াবতী কেন? মাত্র কটা দিনের মেলামেশায় এরা এমন মায়ার জালে জড়িয়ে নিল। মেঘলার মেয়ে জায়না অপরূপ সুন্দর একটি শিশু। একবার মাকে দেখে, একবার আমাকে দেখে। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করি।

 

*****

৪৪

 

মে মাসের ২২ তারিখ দুপুর দুটোয় আমাদের ফ্লাইট। বাঁধাছাঁদা শেষ। রনি কয়েকবার ওজন নিয়ে দেখল। প্রদীপ কাল থেকে আমাদের সাথে আছে। ভাল লাগছে না কিছুই। বাসার বাগানে হাঁটি। থোকা থোকা গোলাপ, লিলি, আরো নানা জাতের ফুলগুলিকে ছুঁয়ে দিই। সবজির গাছ দেখি, আকাশের দিকে তাকাই। সীমাহীন নীলের সমুদ্রে পালতোলা মেঘের নৌকা। শৈশব-কৈশোরে এ দৃশ্য মনে কত যে কল্পনার রঙিন স্বপ্ন বুনে দিত। আজ আর তা হয় না। এখন শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করি, উড়ে যাওয়ার বাসনা ডানা মেলে না।

          আকাশকে বলি বিদায়। মেঘকে বলি এসো তুমি বাংলার বুকে। তোমার ভ্রমণে তো পাসপোর্ট লাগে না। এভাবে শকুন্তলার মত মনে মনে আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিই। হুমায়ূন আজাদের মত কবিত্ব শক্তি থাকলে বলতাম, ভাল থেকো ফুল ...

          আজ দুপুরে আমাদের ফ্লাইট। রাকার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। তার বাবা নরম মনের মানুষ। কাঁদছে, দোয়া করছেন। রনি স্থিতধী। তার মনের ভাব সহজে প্রকাশ করে না। আর প্রদীপ সে তো জমাটবাঁধা নির্ঝরের পাষাণপাথর, ঘুম ভাঙলে ফল্গুধারা বইবে, কিন্তু ঝর্ণাধারা দৃশ্যমান হবে না।

          এয়ারপোর্টে বিদায় নিতে গিয়ে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ি। একে একে আলিঙ্গনে, আদরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইমিগ্রেশন এরিয়াতে ঢুকে যাই। বুকের কাছটায় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

          আবার সেই মেলবোর্ন-কুয়ালালামপুর-ঢাকা। বাংলাদেশে পৌঁছাবো মধ্যরাতে।

          এবার আস্তে আস্তে মন ঘুরছে দেশের দিকে। সারা আকাশ পাড়ি দিতে দিতে আবারও অস্ট্রেলিয়া-মেলবোর্ন-বাংলাদেশ। কত স্মৃতি, বিদেশের সম্পদ ঐশ্বর্য্য, দেশের সমস্যা ভাবতে ভাবতে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে প্লেন ঘোষণা দিল আমরা এখন বাংলাদেশের আকাশসীমায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ল্যান্ড করব, সবাই সিটবেল্ট বেঁধে নিন।

          রাতের ঢাকায় বাতি জ্বলছে। কিন্তু তার উজ্জ্বলতা উর্ধ্বমুখী নয়। কোথাও অন্ধকার। মনে পড়ল সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশের পানশীরের আবদুর রহমানের। আফগানিস্তানের ঊষর মরুতে যেখানে গ্রীষ্মে প্রচন্ড গরম আর শীতে বরফ ঢাকা পাহাড়, দারিদ্র্য আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কষ্টকর বেঁচে থাকা তবু তার চোখে পানশীর হচ্ছে পৃথিবীর সেরা। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তো সে এখানে ইনহাস্ত ওয়াতানাম।

          আমিও মনে মনে বললাম ইনহাস্ত ওয়াতানাম। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তো এখানে আমার বাংলাদেশে।

_______


রিফাৎ আরার 'মেলবোর্নে দেশ বিদেশ' - পর্ব ৩০-৩৭

 


৩০

 

আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে তুমি কোন্‌ শহরের কোন্‌ দর্শনীয় স্থানটা সবার আগে দেখতে চাও? আমি বলব বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং একবার নয় অসংখ্যবার। কিন্তু দুঃখ হল চিড়িয়াখানার মত আমাদের বাংলাদেশের বোটানিক্যাল গার্ডেনও অযত্নে অবহেলায় এখন একরকম পরিত্যক্ত। গণমাধ্যমে মাঝে মাঝে সংবাদ আসে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ইত্যাদির অকুস্থল হিসেবে। তাই একসময়ে অনেক বড় এলাকা নিয়ে ঢাকা চিড়িয়াখানার পাশে পরিকল্পিত বিশাল বোটানিক্যাল গার্ডেন নব্বইয়ের দশকেও দ্রষ্টব্য ছিল। এখন আর সেই পরিবেশ নেই। জনজীবনের নিরাপত্তার অভাবে নির্জনতার সুখ উপভোগের সুযোগ হারিয়ে গেছে। প্রচুর টাকাকড়ি থাকলে এখন আছে সাজানো ফুলদানির মত রিসোর্ট। আর সাধারণের বিনোদনের জন্য? ওদের আবার বিনোদন কী? তাই সুস্থ বিনোদনের অভাবে আমাদের দেশে অসুস্থ বিনোদন আর অপসংস্কৃতি ক্রমশ বর্ধমান।

          মেলবোর্নের বোটানিক্যাল গার্ডেন আয়তনে যেমন বৃহৎ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও তেমনি এবং এক দুদিনে এটি দেখে শেষ করা যাবে না।

          এর আগে একদিন আমরা স্রাইন অব রিমেম্বারেন্স দেখতে গিয়ে সাজেদা আপারাসহ গিয়েছিলাম। ওনার কর্তা শামসুল আলম সাহেব বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তরের ডিজি হিসেবে রিটায়ার করেছেন। ব্যক্তিজীবনে এই দম্পতি ও তাদের সন্তানেরা অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, সজ্জন এবং সৎমানুষও বটে। আলম ভাই আবার রাকার আব্বুকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চান যেমন কোথাও যেতে গেলে আমি চাই সাজু আপাকে।

          আমার কর্তাটি সিনিয়র বলে তিনি তাকে যথেষ্ট সম্মান করেন, আবার তার কৌতুক শুনে এত মুগ্ধ যে কোথাও গেলে দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটেন। বয়স্য বলে একটা অন্তরঙ্গতা দুজনের মধ্যে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে। আমি আর সাজু আপাও তাই। কোন বাসায় দাওয়াতে গেলে একজন না গেলে অন্যজন কিছুটা ম্রিয়মান থাকি। আমাদের প্রবাসী কন্যারা সকলেই প্রায় একবয়সী। তাদের গল্পে সবসময় আমাদের ঠাঁই হয় না। কারণ মা-খালারা তো গুরুজন।

          আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলাম যে কোন দাওয়াতে পুরুষরা একদিকে, মেয়েরা অন্যদিকে এবং শিশুরা তাদের জগতে। আমি পেশাগত কারণে কিনা জানি না, সবার সাথে কথা বলতে, গল্প করতে পছন্দ করি। কথার আদান প্রদানেই তো জ্ঞান, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা বাড়ে। অথচ সুদূর অস্ট্রেলিয়াতেও এই বিভাজন আমাকে বিস্মিত করল। দুএকজনকে দেখলাম পরিবারের নারীরা যেমন নেকাবে ঢাকা, পুরুষরাও তেমনি মেয়েদের কক্ষের আশেপাশেও আসেন না। বুঝি ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তারা হয়তো এসব করেন। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা তাহলে তারা ঐসব বেপর্দার দেশে যান কেন? শালীনতাবোধই কি আসল পর্দা নয়?

 

*****

৩১

 

আউটিং-এর কথা শুনলে পূর্বা-দিব্য লাফিয়ে ওঠে। এবার দ্বিগুণ লাফ দিল যখন শুনল পরদিন আমরা শহরে সি-লাইফ অ্যাকুয়ারিয়াম দেখতে যাব। ওরা আগে যখন গিয়েছিল সেই ছবি দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। এবার স্বচক্ষে দেখব স্বভাবত আগ্রহ আমারও অপরিসীম। সাজু আপাদের আজ অন্যত্র যাওয়ার প্রোগ্রাম, তাই আমরা একক পরিবারই যাত্রা করলাম শহরের উদ্দেশে।

          রনি টিকেট জমা দিলো। আমরা ভেতরে ঢুকতেই একজন আমাদের দাঁড়াতে অনুরোধ করল। তারপর দাঁড় করিয়ে ফটাফট কয়েকটা পারিবারিক শট নিল। এবার আমরা যাত্রা করলাম অ্যারো চিহ্ন দেয়া পথ অনুসরণ করে সাগরতলের প্রাণী দেখতে শুরু করলাম। আমাদের বিজ্ঞানলেখক ড. আবদুল্লাহ আল-মূতির সাগরতলের রহস্য পড়ে জেনেছিলাম পৃথিবীর উপরিভাগে যত প্রাণী আছে, জীববৈচিত্র্য আছে, সাগরতলে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি এবং সৌন্দর্যে ও সম্পদে অতুলনীয়।

          প্রবাল, নানারঙের মাছ-হলুদ, বেগুনি, কমলা, নীল আবার নানা রঙের মিশেলে অপূর্ব সুন্দর মাছগুলো লেজ আর পাখনা নেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অ্যানিমেল প্ল্যানেটে যেমন দেখি এখানে তাই দেখছি বাস্তবে। দেহ রোমাঞ্চিত, মন বিস্ময়মুগ্ধ। যে যে অবস্থায় থাকে ঠিক তেমনি পরিবেশ তৈরি করে সবাইকে রাখা হয়েছে। সামুদ্রিক উদ্ভিদ, নানারকম আর নানা রঙের প্রবাল, ঝিনুক, শামুক দেখতে দেখতে ভুলে যাই আরো দেখার আছে, হাতে সময় কম। একমাত্র তিমি মাছ ছাড়া হাঙর, কুমির, ডলফিন, স্টিং রে, আরো কতরকম সামুদ্রিক প্রাণী দেখে শেষ করা যায় না।

          হাঙর আর স্টিং রে দেখার সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত প্রাণিপ্রেমিক স্টিভ আরউইনের কথা মনে পড়ে গেল। অ্যানিমেল প্ল্যানেটে এই মানুষটির কুমিরের সঙ্গে নানারকম কসরৎ দেখতাম। তার কথা, হাসি, দুঃসাহসী কাজ অবলীলায় করার প্রবণতা আমাকে এত মুগ্ধ করত যে আমি তার ভক্ত বনে গিয়েছিলাম। আমেরিকান স্ত্রীকে সাথে নিয়ে তার একটি চলচ্চিত্রও দেখেছিলাম। হঠাৎ একদিন টিভি সংবাদে জানা গেল স্টিং রে মাছের আঘাতে তিনি মারা গেছেন। অথচ জীবস্বভাবে স্টিং রে নাকি নিরীহ। আপনজন হারানোর মত দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমাদের মত আবেগপ্রবণ নয়ঘটনার পর পরই তার বাবা, ভাই, স্ত্রী, এমনকি শিশুকন্যাটিও বাবার অসম্পূর্ণ কাজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। পারিবারিক কুমীরের খামার আছে তাদের। ছোট্ট শিশুটি সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যোগ দিল। কী দুঃসাহস। এখন মেয়েই খামারে দর্শনার্থীদের খেলা দেখায়।

          সেই স্টিং রে? অনেকটা রূপচাঁদা মাছের মত, কিন্তু আকৃতি বিশাল আর পেছনের লেজটা অনেকটা লম্বা। দেখে মনে হচ্ছে বাঁশের লম্বা কঞ্চির মত চিকন, কিন্তু শক্ত।

          এমনভাবে অ্যাকুরিয়ামকে তৈরি করা হয়েছে ঘুরে দেখার জন্য। মাঝখানে করিডোর অনেকটা সুড়ঙ্গ পথের মত। মাথার উপর দিয়ে হাঙর, স্টিং রে, আরো নাম না জানা নানা জাতের বড়মাছ ঘুরছে ফিরছে। কাচের গায়ে লেখা আছে এই প্রাণিগুলো আমরা যা দেখছি তার চেয়ে কমপক্ষে তিনগুণ বড়, কারণ নিরাপত্তার খাতিরে কাঁচের দেয়াল অনেক পুরু যাতে কোন বড় আঘাতেও ভেঙে না যায়।

          সাগরতলের প্রবাল প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি। রঙে, গঠনে, রূপে-বৈচিত্র্যে এগুলো অতুলনীয়। মহাসাগর বেষ্টিত অস্ট্রেলিয়ায় মনে হয় এসবের বৈচিত্র্য আরো বেশি।

          অ্যাকুরিয়ামের ভিতরে একটি রুমে শিশুদের মেলা বসেছে। এতক্ষণ তারা যেসব সামুদ্রিক প্রাণী দেখেছে রং-পেন্সিল দিয়ে কাগজে সেগুলোর ছবি আঁকছে। সাথে সাথে ওখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীটি কম্পিউটারে স্ক্যান করে দিতেই একপাশের দেয়ালে পর্দায় সেই ছবি ভেসে উঠছে, এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা করছে। পূর্বা-দিব্যও ছবি আঁকল এবং পর্দায় সেগুলো দেখা মহাউচ্ছ্বসিত। দিব্যর উৎসাহ সবচেয়ে বেশি।

          এবার আমরা যাব দক্ষিণ মেরুতে কারণ যেখানে যাচ্ছি সেখানে বরফে ঢাকা সমুদ্র, তার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো পেঙ্গুইন নানা জাতের পেঙ্গুইন

          ডিজিটাল যুগে সবার হাতে ক্যামেরা অতএব ছবি তোলা হচ্ছে খটাখট একদিকে বরফভাসা পানিতে মহাআনন্দে সাঁতার কাটছে পেঙ্গুইনের দল আমার খুব ইচ্ছে হল সাঁতার কাটি ওদের সাথে বাস্তবে না হোক, মনে মনে ডুব দিলাম বরফঢাকা পানির নিচে উফ্‌ কী ঠান্ডা!

          আম্মু, এবার চলেন হঠাৎ রাকার ডাকে চমক ভাঙল হ্যাঁ, এবার তো যেতে হবে ফেরার পথে যে মেয়েটি ছবি তুলছিল সে একটা কাগজের অ্যালবামে আমাদের কয়েকটা ছবি ধরিয়ে দিল গেটে তোলা ছবির পেছনে অ্যাকুয়ারিয়ামের নানারকম দৃশ্য ইমপোজ করে দিয়েছে এটুকুর দাম ৪০ ডলার আমি রাকাকে বললাম, দরকার আছে নেয়ার?

          নিই স্মৃতি হিসেবেতো মূল্য আছে আর আসবেন এখানে এমন সিওরিটিতো নেই

          যুক্তি আছে মেয়ের কথায় বললাম, তাহলে নাও

          ক্ষিধে পেয়েছে আজ আমরা খেতে যাবো ইন্দোনেশিয়ান রেস্টুরেন্টে 

 

*****

৩২

 

প্রদীপ ছুটি কাটাতে সাউথ আফ্রিকা যাবে অবশ্য রথদেখা-কলাবেচার মত সেখানে তার একটা কনফারেন্সও আছে সুতরাং শেষবারের মত তার বাসায় আজ ঘুরে আসব

          তার বাসা থেকে আসার আগে আমরা লাঞ্চ সেরে নার্সারিতে গেলাম তিনটা গাছের চারা কিনলাম আমাদের পছন্দে তারপর একটা তার দুলাভাই আর বাকি দুটো গাছ আমি লাগালাম তার ব্যাকইয়ার্ডে খাটুনি যা সে নিজেই করল আমরা ভিনদেশী রাষ্ট্রপ্রধানের মত মাটি ছুঁয়ে, পানি দিয়ে স্মৃতির চিহ্ন রেখে গেলাম বেশ ভি-আই-পি মনে হল নিজেকে

 

*****

৩৩

 

যাবার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে মেয়ের মন ততই খারাপ পূর্বারও আর আমাদের কথা নাইবা বললাম আবার কবে দেখব ওদের কখন কাছে পাব এই ভাবনায় মন নিয়ত ক্রন্দনশীল কিন্তু বাইরে তা দেখানো যায় না দিব্যকে ছোটবেলায় আমি তেমন কাছে পাইনি কিন্তু এবার সে নানুর সাথে খুব স্বতঃস্ফুর্ত স্কুল থেকে ঘরে ঢুকেই নানুকে খোঁজে পূর্বাতো আছেই আমার হিয়ার মাঝে

ওদের স্কুলে দিয়ে এসে রাকা বাসার কাজে হাত লাগায়, রান্না করে আমাকে কিছুই করতে দেয় না ভয় যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি মা-মেয়ে গল্প করি পুরনো দিনের কতশত স্মৃতি বন্ধু-স্বজন কে কেমন আছে মাঝে মাঝে বাগানে যাই গাছ, ফুল, আকাশ, মেঘ, সূর্যডোবার রঙ দেখি মাঝে মাঝে নাতি-নাতনির সাথে লুডো খেলি কিন্তু বেশিক্ষণ খেলা হয় না দিব্যবাবু সব পন্ড করে দেয় তবু আনন্দ, কত আনন্দ

          দিঠুনের সাথে প্রতিদিন কথা বলি বাংলাদেশে প্রচন্ড গরম পড়েছে বিশ্বজলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর পরিকল্পনাহীন নগরায়ন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে ষোল কোটি মানুষের বসত গরম তো লাগবেই এবার কালবৈশাখী বেশি হচ্ছে এবং বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা গেছে- যাচ্ছে সরকার বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করেছে অপঘাতে মৃত্যু যেন আমাদের নিয়তি

          আর এখানে এসে অবধি দুটো দুর্ঘটনার কথা শুনেছি একটি একজন আফ্রিকান মা নাকি তার বাচ্চাসহ গাড়িকে ঠেলে পানিতে ফেলে দিয়েছে এটা আসলে দুর্ঘটনা নয়, মায়ের মনোবিকার আরেকটি ধর্ষণের ঘটনা অবশ্য এদেশে ঘটনা ঘটে না দেখে এগুলোকে অনেক বড় করে দেখে

          একদিন কোথায় যেন যাওয়ার পথে প্রদীপ জেলখানা দেখিয়েছিল কিন্তু সেখানে কোন কয়েদি নেই কারণ সুদৃশ্য জেলখানায় থাকা-খাওয়া, সেবা-সুশ্রুষার যে ব্যবস্থা তাতে কয়েদির যেমন আরাম, তেমনি সরকারের প্রচুর অর্থের অপচয় তাই অপরাধীকে জামাই আদরে রাখার চেয়ে অর্থদন্ডের শাস্তিই বেশি দেয়া হয়

 

 

*****

৩৪

 

এখানে মাদার্স ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ইস্টার পরব সবকিছুতে দোকানগুলোতে মূল্যহ্রাসের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় মানুষও দেখলাম প্রচুর কেনাকাটা করে কিন্তু একটা বিষয় আমাকে অবাক করল আজ যে পোশাক বা দ্রব্যের দাম ১০ ডলার দেখলাম, কাল গেলে দেখি সেই একই টি-শার্ট আট ডলার এবং আরো দুদিন পরে গেলে ছয় ডলার আগে কিনে ফেললে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে প্রত্যেক দোকানে প্রতি সপ্তায় কিছু না কিছু মূল্যছাড় থাকে আর ক্রেতারাও সেই সুযোগে কিছু বেশি জিনিস কিনে রাখে এতে সাশ্রয় হয় কারণ অস্ট্রেলিয়ায় খাবার ছাড়া অন্যান্য জিনিসের দাম অনেক বেশি রাকাকেও দেখলাম খুঁজে খুঁজে সংসারের দরকারি জিনিস বেশি করে কিনে রাখছে কারণ অন্যান্য পণ্য তারা বেশিরভাগই আমদানি করে যেহেতু এদেশে শ্রমিকের পারিশ্রমিক অনেক বেশি

          কিন্তু এত দাম কমায় কেন? প্রথম দিন থেকে কমালেই তো পারে জানতে চাইলাম এখানে স্টোরেজ বা গুদামের ভাড়া বেশি জিনিস জমে গেলে বেশি কড়ি গুণতে হয়, তাই যত তাড়াতাড়ি পারে বিক্রি করে যে জিনিসটা দেখে সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল হলাম সেটা হচ্ছে টি-শার্ট, গেঞ্জি, জিন্‌সের ট্যাগে লেখা আছে মেড ইন বাংলাদেশ'

          এখানে শ্রমের দাম বেশি বলে ওরা আমাদের দেশ থেকে পোশাক আমদানি করে তাহলে কত কম দামে আমাদের পোশাক শ্রমিকেরা (যাদের প্রায় সবাই নারী) তাদের শ্রম বিক্রয় করছে তাদের জীবন পিষ্ট করে গার্মেন্টস মালিকরা একেকজন ধনকুবের হচ্ছে, আর মালয়েশিয়া, আমেরিকায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে সন্তানকে বিদেশে পড়াচ্ছে জীবন-যাপন, বিবাহ-উৎসবাদিতে প্রাচুর্য উপচে পড়ছে অন্যদিকে রানা প্লাজা, তাজরিন গার্মেন্টস-এ শ্রমিকের কংকালসার শরীর পোড়া কংকাল ভাস্কর্য তৈরি করছে

 

*****

৩৫

 

মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মাদার্স ডে। এখন আমাদের দেশেও ঘটা করে এটা পালিত হয়। এটি মূলত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। বাবা-মা থেকে আলাদা থাকে বলে তারা বৃদ্ধাশ্রমে অথবা বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়ে তাদের গিফ্‌ট দেয়, খাওয়াতে নিয়ে যায়। যারা দূরে থাকে তারা পার্সেল পাঠায়। আমাদের দেশে এখনও এই সংস্কৃতি এতটা প্রবল হয়নি। শৈশবে বাবা-মা, আর বার্ধক্যে সন্তান এখনও পরস্পরের অবলম্বন। নগরায়নের কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে অণুপরিবার। হলেও আমরা মা-বাবাকে কাছে রাখতেই ভালবাসি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। তবু এই সংস্কৃতি আমার ভাল লাগে এই জন্যে যে অন্তত একদিন হলেও আমার সন্তানরা আমাকে নিয়ে আনন্দ করে।

          সকালেই রনি-রাকা আমাকে উইশ করল। রনি স্বভাবে মিতভাষী, কথা বলে নিচুস্বরে। সেই ঘোষণা দিল, আম্মার অনারে আজ আমরা বাইরে খাব

          দুপুরে আমরা গেলাম ওয়্যারবি প্লাজার মালয়েশিয়ান রেস্টুরেন্ট মাকান প্লেস-এ। ওরে বাবা এত ভীড়। টেবিলই খালি নেই। বুড়ো মা-বাবাকে নিয়ে তরুণ-তরুণীরা ভীড় জমিয়েছে। প্রায় সবার হাতে গিফ্‌ট আর ফুলের তোড়া।

          মালয়েশিয়ান খাবার এখানে খুব জনপ্রিয়। অজিরাও পছন্দ করে। কিন্তু চীনে খাবার নাকি একেবারে যাচ্ছেতাই। বাংলাদেশের বঙ্গীয় স্টাইলে চাইনিজ খাওয়া ছেলেমেয়েরাতো সে খাবার মুখে তুলতে পারে না। তাই এখানে তারা সবচেয়ে বেশি মিস করে বাংলাদেশের নানারকম ও নানাস্বাদের মিষ্টি আর চাইনিজ খাবার।

 

*****

৩৬

 

কাল ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, আজ আবার সকাল থেকে আকাশের মুখভার। টিপ টিপ বৃষ্টি। অথচ আজ আমাদের যাওয়ার কথা মেসিডোন গার্ডেন। বৃষ্টিতে যাতায়াতে অবশ্য সমস্যা নেই কারণ এই বৃষ্টি বাংলাদেশের শ্রাবণধারা বাঁধনহারা নয়।

          সকাল বেলাতেই রওনা দিলাম। আজ ফেরদৌস-তন্বী পরিবার আছে সাথে। আছেন শামসুল আলম ভাই ও সাজু আপা। রাকার আব্বু ওনাদের সাথে যায়। রনির গাড়িতে আমি বসলে আরেকজন বসার জায়গা থাকে  না এবং এতজন চড়া দন্ডনীয় অপরাধও বটে। ফেরদৌসের একটা গাড়ি সে চালায়, আরেকটা ওর ছোটভাই বাবন। সেই গাড়িতে আলমভাই আর সাজু আপাদের যাত্রাসঙ্গী হয় রাকার আব্বু। ওনারা না থাকলে গাড়িতে কোথাও যাওয়া আমাদের জন্য একটা সমস্যাই হত। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গায় আমরা একসাথে বেড়াতে গিয়েছি।

          মেসিডোন গার্ডেন বেশ দূরের পথ। যেতে যেতে দেখছি তৃণভূমি ভেড়া, গরু, ঘোড়া চরছে। স্বাস্থ্যসম্পদে আকর্ষণীয় প্রতিটি পশুই দর্শনীয়। আর প্রাণিদের মধ্যে সৌন্দর্যে, দৈহিক গঠন এবং চলনে ঘোড়া অতুলনীয়। যেতে যেতে একটা মাঠে দেখলাম অনেক ঘোড়া, অনেক মানুষও। অ্যানাউসমেন্ট হচ্ছে। রনি বলল, রেস আছে মনে হচ্ছে। বৃটিশ রক্তের উত্তরাধিকারী অস্ট্রেলিয়ানরা রেসের বাজিতো খেলবেই।

          তৃণক্ষেত্র, গাছপালা, আন্ডারওয়ে পার হয়ে আমরা মেসিডোন গার্ডেনে এলাম। এখানে বেশ কয়েকটি বাগান কিন্তু সব একদিনে দেখে শেষ করা যাবে না। ওদিকে আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে

          মেসিডোন গার্ডেনের বৈশিষ্ট্য এর বহুবর্ণিল ম্যাপেল পাতা। কত যে রঙ কোনটি হালকা, গাঢ়, আগুন রঙ, মিষ্টি আপেল রঙ, সোনালী। প্রকৃতিতে এক ম্যাপেল পাতারই এত সৌন্দর্য যে না দেখেছে সে ভাবতেই পারবে না। রাস্তা নিচু থেকে ওপরের দিকে  উঠে গেছে। এখানে  হুইল চেয়ার চলবে না, মাটিও ভিজে ঈষৎ কর্দমাক্ত। আমি মুক্তি পেলাম। মাঝখানে সমতল মাঠ, চারপাশে উঁচু পথচলা রাস্তা, দূরে ঘন ছাই রঙা মেঘ এত গর্ভবতী মনে হচ্ছে তাকে যেন এখনই ঝরে পড়বে বৃষ্টি হয়ে।

          আমাদের সৌভাগ্য  - মাঝে মাঝে টিপ টিপ ফোঁটা ছাড়া বর্ষণ হলো না। বাগানের মাঝে মাঝে নানা রকম গাছ। যেসব কৃত্রিম ফুল দোকানে দেখে মুগ্ধ হয়েছি এখানে দেখি সেগুলোর সবই বাস্তব রূপ। দেখে মন গেয়ে উঠল এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।

          এক জায়গায় হিপোক্রিটাসের বেশ বড় মূর্তি একটি চেয়ারে আসীন। চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলা হয় হিপোক্রিটাসকে। আবার ভন্ডামি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিপোক্রেসি কেন?

          দলের অন্যরা সবাই সিঁড়ি দিয়ে অনেক নিচে নেমে আরো বৃক্ষশোভিত বাগান দেখে এলেন। আমি একটি কৃত্রিম জলাধারের পাশে বসে চারদিক দেখতে লাগলাম। প্রকৃতি এমন এক বিষয় যার শুরু-শেষ নেই। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আজ এই অপার সৌন্দর্য আমার মনকে সোনারঙে রাঙিয়ে দিল। এই তো তোমার রূপ, ওগো হৃদয়-হরণ, এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরণ...

          এবার ফেরার পালা। আমাদের মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে রনিদের সাদেক ভাইয়ের বাসায়। আবার সবাই মিলে চলা শুরু। পথে পথে শুধু মেসিডোন গার্ডেনের গল্প।

 

*****

৩৭

 

আজ বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ দিনগতকাল ১১..২০১৬ তারিখ রাত ১২.১০ মিনিটে যুদ্ধাপরাধী এবং রাজাকারদের নেতা কুখ্যাত মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিলের রিভিউ নিয়ে একটু সংশয় ছিল যদি সাঈদী-গোলাম আজমের মত শাস্তি গুরু থেকে লঘুতর হয়ে যায়। নাহ্‌ হয়নি। স্বস্তি পেলাম। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালোম সময়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়নকারী এ দানব শেষপর্যন্ত চরম শাস্তি পেল। জয় বাংলা।


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts