Sunday 28 February 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৯

 



০৯

তুমি চোখের আড়াল হও, কাছে কিবা দূরে রও

মনে রেখো আমিও ছিলাম।

এই মন তোমাকে দিলাম …

সোহরাওয়ার্দী হলের গেটের কাছে রিকশায় বাঁধা মাইকে অনবরত বাজছেন সাবিনা ইয়াসমিন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ষষ্ঠ বারের মতো শুনছি এই গান। সম্ভবত এই একটা ক্যাসেটই আছে মাইকওয়ালার কাছে। শুধু আজ নয়, গত এক সপ্তাহ ধরে  এই অবস্থা চলছে ক্যাম্পাসজুড়ে। জাতীয় ছাত্রসমাজ নবীনবরণ করবে – তার প্রচারণা চলছে। সাবিনা ইয়াসমিনকে নিয়ে আসবে ক্যাম্পাসে নবীনদের গান শোনানোর জন্য। নবীনবরণ নভেম্বরের ২৭ তারিখ। আরো এক সপ্তাহ বাকি। তার মানে আরো সাতদিন ধরে বাজতে থাকবে সাবিনা ইয়াসমিনের শ্রেষ্ঠ সংগীতের ক্যাসেট। তবুও ভালো যে এরশাদের ভাষণ বাজাচ্ছে না।

 

‘বকুলের মালা শুকাবে, রেখে দেবো তার সুরভি

দিন গিয়ে রাতে লুকাবে, মোছো না কো আমারি ছবি …

 

সাবিনা ইয়াসমিনের সুরেলা গলা ছাপিয়ে আরেকটি বেসুরো গলা ভেসে আসছে রুমের ভেতর থেকে। ধুনকরের তুলা ধুনার শব্দে শুরুতে খেয়াল করিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জবাই করার জন্য চেপে ধরলে ছাগল যেরকম চিৎকার করে সেরকম চিৎকার - অ্যাঅ্যামি মিন্নন্ননঅঅঅঅঅতি কঅঅঅরেএএএ গ্যালআম। বাইরে মাইকের আওয়াজ, বারান্দায় তুলা ধুনার শব্দ না থাকলে রুমের ভেতর থেকে আসা শব্দে আশেপাশের রুম থেকে ছুটে আসতো সবাই। ছাত্রসমাজের হল শাখার ‘ডেপুটি এসিস্টেন সেকেটারি’ টিপু ভাইয়ের গলা কর্কশ তা জানি, কিন্তু গান গাইলে যে এমন যন্ত্রনাদায়ক হয়ে ওঠে তা জানা ছিল না।

 

রুমের সামনে বারান্দায় বসে তোষক বানাচ্ছেন মাঝবয়সী ধুনকর। দুপুরে হলের সামনে তাকে দেখে তিনটায় আসতে বলেছিলাম। তিনি পৌনে তিনটায় এসে কাজ শুরু করেছেন। জুলাই থেকে নভেম্বর - আমার হলজীবনের প্রায় তিন মাস কাটিয়ে দিলাম তোষক ছাড়াই। খাটের উপর পাতলা চাদর বিছিয়ে ঘুমাতে এতদিন তেমন কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন শীত পড়তে শুরু করেছে। তোষক নেই শুনে দিদি কড়া নির্দেশ দিয়েছে তোষকের ব্যবস্থা করে নিতে। এখন তোষকের ব্যবস্থা হচ্ছে। অবশ্য এ ব্যাপারে তার নিজেরও কিছু অবদান আছে, যাকে বলা যায় তোষকাবদান। শামসুন্নাহার হলে থাকার সময় তার যে তোষকটি ছিল, সেটি সে দিয়ে গিয়েছিল তার জুনিয়র স্মৃতিকে। স্মৃতি আমাদের গ্রামের মেয়ে, গ্রামতুতো পিসী। স্মৃতিপিসী হল থেকে যাবার সময় তোষকটি দিয়ে গেছে তার আরেকজন জুনিয়রকে। আমাকে বলা হয়েছে তোষকটি তার রুমে ভালোভাবে প্যাকেটবন্দী করে সংরক্ষণ করা আছে। আমি শামসুন্নাহার হলে গেলেই তোষকের প্যাকেটটি আমাকে দিয়ে দেবে।

 

শুনেছি শামসুন্নহার হলে যাওয়াটা অনেকের কাছে খুবই আনন্দের ব্যাপার। কোন উপলক্ষ ছাড়াই নাকি ঐ হলে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো হলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। হলের  কলাপসিপল গেট খুব ছোট করে খোলা। খাকি পোশাক পরা এক পক্কশ্মশ্রু দারোয়ান গেটের কাছে একটি লম্বা টুলে বসে আছেন। দুপুরবেলা তেমন কেউ নেই রাস্তায়। আজ শিক্ষকদের ধর্মঘটের কারণে কোন ক্লাস হয়নি। ক্যাম্পাস ফাঁকা বলেই হয়তো এদিকেও কেমন যেন সুনশান। রুম থেকে কেয়া আপাকে ডেকে দিতে বলার পর দারোয়ান  উধাও হয়ে গেলেন। কাকে দিয়ে রুমে খবর পাঠানো হয় আমি জানি না। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ কাউকে সাথে নিয়ে গেলে সুবিধা হতো। রঘুনাথ থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সে চলে গেছে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার বন্ধু প্রদীপ নাথ থাকে আমাদের হলে। আমাদের ব্যাচে মনে হয় প্রদীপের ছড়াছড়ি। এই প্রদীপ নাথ কেমিস্ট্রির। হলে যাবার কথা শুনেই সে রাজি হয়ে গিয়েছিল। সুন্দর জামাকাপড় পরে গায়ে খুশবু মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের ইয়ারে পড়ে?’

“কে?”

“যার কাছে যাচ্ছিস?”

“কেয়া আপা, মাস্টার্সে পড়েন।“

“তুই যা, আমি যাবো না।“

তাকে কিছুতেই আর রাজি করানো গেল না। একাই যেতে হলো আমাকে। আমি কেয়া আপাকে কোনদিন দেখিনি। চিনবো কীভাবে বুঝতে পারছিলাম না। গেট দিয়ে কাউকে বের হতে দেখলেই মনে হচ্ছিল – ইনিই কেয়া আপা। অনেকক্ষণ পর গেটের কাছে এসে একজন ডাকলেন - “প্রদীপ?” 

লম্বা পাতলা কেয়া আপাকে দেখে অনেকটা আমার নিজের দিদির মতোই লাগছে। একটু পরে কেয়া আপা পুরনো খবরের কাগজ মোড়ানো যে প্যাকেটটা দিলেন – তার সাইজ বড়জোর দেড় ফুট বাই এক ফুট বাই এক ফুট। এর ভেতর আস্ত একটা তোষক কীভাবে থাকবে বুঝতে পারছি না। ওজনও খুব একটা বেশি নয়।

 

“দাঁড়াও তোমাকে রিকশা ঠিক করে দিই।“

“লাগবে না আপা, আমি পারবো।“

“রিকশাওয়ালারা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের প্রেফারেন্স বেশি দেয়। তুমি জিজ্ঞেস করলে বলবে ভাড়া আছে।“

এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে। ইচ্ছে করছিলো আজকে আবার পরীক্ষা করে দেখি। কিন্তু পরীক্ষা করতে গিয়ে আজকেও যদি সেদিনের মতো এই তোষক মাথায় করে হলে নিয়ে যেতে হয় – ঝামেলা হবে। তাই পরীক্ষা করার ইচ্ছে বাদ দিলাম। হলের সামনে রাস্তায় একটা রিকশা আছে। কেয়া আপা হাত তুলে রিকশাওয়ালাকে ইশারা করতেই তিনি রিকশা নিয়ে চলে এলেন গেটের কাছে। আমি দ্রুত রিকশায় উঠে বসলাম।

 

পৌনে তিনটায় হলে ঢুকার সময় দেখি ধুনকরও ঢুকছেন। তাঁর কাঁধে বিরাট বস্তা, হাতে লম্বা একতারার মতো তুলো ধুনার যন্ত্র। রুমের সামনে বারান্দায় কাপড় বিছিয়ে তৈরি হয়ে বসলেন ধুনকর। আমার প্যাকেটটার দড়ি খুলে যা পাওয়া গেল তাকে কিছুতেই তোষক বলা যাবে না। তার দলা পাকানো তুলা আর ছিন্নভিন্ন জীর্ণ কাপড় দেখে বড়জোর বলা যায় তোষকাশ্ম। জীবের যেমন জীবাশ্ম হয়, সেরকম তোষকেরও যে তোষকাশ্ম হয় তা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। স্মৃতিপিসী কী কারণে এই বস্তু দিদির উত্তরসুরীর হাতে তুলে দেবার জন্য কেয়া আপার কাছে গচ্ছিত রেখে গিয়েছিল? কেয়া আপা কি জানতেন এর ভেতরে কী আছে?

 

শার্লক হোমসের মতো মনযোগ দিয়ে প্যাকেটের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে ধুনকর রায় দিলেন,  “এইগুলা ভাল তুলা ছার। পরিমাণে কম আছে। তোষক হইবে না, একখানা বালিশ হইবে।“

একখানা বালিশ তো আমার আছে। আরেকখানা বালিশ দিয়ে আমি কী করবো? দিদির তোষকাশ্ম থেকে আমার আরেকটি তোষকই তৈরি করাতে হবে। ধুনকরের কাছে সব উপাদান আছে। টাকা দিলেই হলো। কাজে লেগে পড়লেন তিনি। গুঁটিপোকার মতো গুটিয়ে যাওয়া তুলা সশব্দে ধুনতে শুরু করলেন।

 

আমি রুমে ঢুকে দেখলাম টিপুভাই তার খাটে লুঙ্গিপরে এলোমেলোভাবে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর মাথায় ও ডানচোখে এখনো মোটা ব্যান্ডেজ। বারান্দায় দাঁড়ালে সাবিনা ইয়াসমিনের গানের শব্দ যতটা শোনা যায়, রুমের ভেতর শোনা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি। শব্দ তরঙ্গের বেগ ঘন মাধ্যমে বেশি। কিন্তু ডপলারের সমীকরণ অনুসারে রুমের ভেতর তো কম্পাঙ্ক কিছুটা কম হওয়ার কথা। ক্লাসে ক’দিন আগেই সাউন্ড পড়ানো শুরু করেছেন সদ্য কানাডাফেরৎ নুরুল মোস্তফা স্যার। শব্দের বাস্তব অনুভবের সাথে আমার তত্ত্বগত জ্ঞান ঠিকমতো মিলছে না। গন্ডগোলটা কোথায় হচ্ছে পরে ভেবে দেখতে হবে। আমি আমার চেয়ারটা নিয়ে যথাসম্ভব নিঃশব্দে বারান্দায় চলে এলাম। কিন্তু একটু পরেই কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন টিপুভাই, “অ্যাই, বাইরে এত আওয়াজ করছে কে?”

 

বলতে যাচ্ছিলাম – সাবিনা ইয়াসমিন টিপুভাই। কিন্তু বললাম না। আহত বাঘকে যেমন ঘাটাতে নেই, তেমনি আহত টিপুভাইকেও রাগাতে নেই। ঢাকা থেকে আহত হয়ে ফিরে আসার পর থেকে টিপুভাইয়ের মেজাজ খুব খারাপ। দরজা খুলে উগ্রমূর্তিতে বারান্দায় বের হয়ে এলেন টিপুভাই।

“অ্যাই কী হচ্ছে এসব?”

“একটা তোষক বানাতে দিলাম টিপুভাই।“

“অ। অ্যাই, তোষক হয়ে গেলে তুমি আমার বালিশটাতে আরো কিছু তুলা ভরে ঠিক করে দিও তো –“ বলে নিজের চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ময়লা বালিশটা নিয়ে এসে ছুড়ে মারলেন ধুনকরের দিকে। ধুনকর অভিজ্ঞ মানুষ। আচরণ দেখেই বুঝে নিয়েছেন টিপুভাই রাজার দলের মানুষ। আমি দরজার খোলা অংশ দিয়ে দেখতে পেলাম টিপুভাই আমার বিছানা থেকে আমার বালিশটা টেনে নিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লেন আবার। এই তিন মাসে বালিশ বিছানা লুঙ্গি স্যান্ডেল টুথপেস্ট সাবান ইত্যাদি জিনিস যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি তা প্রায় ভুলতে বসেছি। মাঝে মাঝে টুথব্রাশটাকেও সন্দেহের চোখে দেখি।

 

দরজাটা টেনে দিয়ে আবার চেয়ারে বসে পড়েছি। তখনই শুনতে পেয়েছি ছাগনিনাদ – টিপুভাইয়ের গান। সাবিনা ইয়াসমিনের গানের সাথে টিপুভাই  যেভাবে গর্জন করে গলা মেলাচ্ছেন তাতে গার্জরিত অর্থাৎ গানে গানে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছি। এই শব্দদূষণ কখন থামবে জানি না। নবীনবরণ করতে হলে এভাবে চেঁচামেচি করে করতে হয়? আসলে এখানে হলের রাজনীতিতে তো কোলাহলই সার। যারা যত কোলাহল করতে পারে, পেশীর দাপট দেখাতে পারে – তারাই তত শক্তিমান।

 

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশতম ব্যাচ। আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছে মাত্র চার মাস হলো।  আমরা এখনো নতুন শিক্ষার্থী।  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন শিক্ষার্থীদের কোন ধরনের অভ্যর্থনার আয়োজন করেনি। আমাদের ভালোমন্দে কর্তৃপক্ষের কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। আমরা এখানে নিজ দায়িত্বে ভর্তি হয়েছি, সব কিছু নিজ দায়িত্বেই করে যেতে হবে। প্রামাণিক স্যার ক্লাসে যেভাবে বলেন, “না জানলে জেনে নেবে, না বুঝলে বুঝে নেবে” – সেটা মনে হয় সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

 

এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের যে আয়তন – বাংলাদেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের এত জায়গা নেই। সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার লক্ষ্যেই শহর থেকে এত দূরে এই ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষকদের জন্য আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পাশে। ছাত্রছাত্রীদের সবার জন্য আবাসিক হল তৈরি হবার কথা। সে কারণেই সব শিক্ষার্থীকে ভর্তি হবার সময়ে কোন না কোন হলের সাথে সংযুক্ত থাকতে হয়। অথচ এখন এই হলগুলি রাজনৈতিক পান্ডাদের আড্ডাখানা। সবগুলি হল কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলদ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের সাথে সাথে এই হলগুলিতে ক্ষমতাসীন দলের দলদাস ছাত্রশাখার বাহুবলীদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়।

 

ছাত্রইউনিয়ন প্রগতিশীল রাজনীতি করে। আমাদের ক্যাম্পাসে তারা হারমোনিয়াম পার্টি নামে পরিচিত হলেও বৈরি সময়ে টিকে থাকার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে তাদের। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই থাকুক – ছাত্রইউনিয়নের কিছু নেতা-কর্মী অনবরত সংগ্রাম করে হলেও প্রত্যেক হলে টিকে থাকে। অনেক সময় ছদ্মবেশেও থাকে তারা। এই হলেই আমার পরিচিত কয়েকজন আছেন যারা ছাত্রইউনিয়নের প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু হলে থাকার জন্য ছাত্রসমাজের সাথে সহাবস্থান করছেন। ক্যাম্পাসে এই ছাত্রইউনিয়নই প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান করেছে আমাদের জন্য। রেলস্টেশনের বাইরের চত্বরে হারমোনিয়াম তবলা বাজিয়ে গান গেয়েছে ‘আমরা করবো জয় একদিন।“ অনেকদিন থেকেই শুনছি একদিন জয় করার আশাবাদ – কিন্তু সেইদিন কোন্‌দিন আসবে কেউ জানে না। তবুও আশায় বাঁচে মানুষ, আশায় বাঁচে আদর্শ। আবার মাঝে মাঝে  এমনও দেখা যায় যে প্রগতিশীল নেতাদের কথায় আর কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আশরাফ ভাই আমাকে বলেছিলেন তাঁর মাস্টার্স পরীক্ষা হয়ে যাবার পর তাঁর সিটে গিয়ে উঠতে। আশরাফ ভাই যেদিন যেতে বলেছিলেন সেদিন তাঁর রুমে গিয়ে দেখি তাঁর সিটে ছাত্রশিবিরের এক কর্মী উঠে গেছেন। আশরাফ ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন তিনি আড়াইশো টাকা দিয়ে এই সিট কিনেছেন আশরাফ ভাইয়ের কাছ থেকে। আমার ভেতরটা কেমন যেন ছোট হয়ে গেল। অন্যকে ছোট করার জন্য অনেকে মিথ্যা অপবাদ দেন। ইনিও কি আশরাফ ভাই সম্পর্কে মিথ্যা বলছেন? কিন্তু আশরাফ ভাই যে আমার কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন।

 

হলে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলও মাঝে মাঝে ছোটখাট মিটিং মিছিল করে। কিন্তু ছাত্রশিবিরের তেমন জোরালো কোন কার্যক্রম এখনো সেভাবে দেখা যায় না। কিন্তু হলের নেতাদের কাছে যেসব খবর শুনি – তাতে বোঝা যায় – ছাত্রসমাজের সবচেয়ে বড় ভয় ছাত্রশিবিরকে নিয়ে। তাই তারা ক্যাম্পাসে ছাত্রদল কিংবা ছাত্রলীগকে যতটুকু ছাড় দেয়, ছাত্রশিবিরকে ততটুকু দেয় না।

 

দিন চলে যায়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ধর্মঘট শুরু করলেন। তাতে সরকারের কিছু এলো গেলো বলে মনে হয় না, যা ক্ষতি হবার আমাদেরই হচ্ছে। আমাদের কোন ক্লাস হলো না সেপ্টেম্বর মাসে। এরশাদ সরকার তাঁর গায়ের সামরিক পোশাক বদলে গণতান্ত্রিক পোশাক পরার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিলেন। যে পার্টি তিনি নিজে তৈরি করেছেন সেই পার্টিতে এতদিন যোগ দেননি – কারণ তিনি সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। আহা, কী আদর্শবান! আমার রুমের এরশাদের শিষ্যদের মুখে তাদের গুরুর গুণগান শুনতে শুনতে মনে হয় এরা গুণগান আর স্টেনগানকে সমার্থক মনে করে। দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। সামরিকজান্তারা সবাই জনতার দলে মিশে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতকেউই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। শোনা যায় এরশাদ টাকাপয়সা দিয়ে আরো পনেরজন প্রেসিডেন্টপ্রার্থী জোগাড় করেছেন নির্বাচনকে বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করার জন্য। এরশাদের বিপরীতে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়িয়েছেন কর্নেল ফারুক – যিনি বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছেন। এর চেয়ে অপমানের আর কী থাকতে পারে।

 

দুর্গাপূজা, শরৎকালীন ছুটি ইত্যাদি উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলো অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত। ১৫ অক্টোবর এরশাদ সাহেব প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। নির্বাচনের পর তাঁর সভায় যোগদান করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন রিজার্ভ করে ঢাকায় গিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। আমাদের হলের পাতিনেতা সিকিনেতারাও গিয়েছিলেন। যাবার পথে কোন এক স্টেশনে ট্রেন থামার পর ছাত্রসমাজের এসব নেতারা স্টেশনে নেমে একটু বেশী জোশ দেখিয়ে ফেলেছিল। স্থানীয়দের সাথে মারপিট লেগে গেল। স্থানীয় লোকজন ট্রেন আক্রমণ করলো। সেই আক্রমণে আহত হয়েছেন টিপুভাই। তার মাথায় আর চোখে আঘাত লেগেছে। এখনো ব্যান্ডেজ আছে। এর মধ্যেই ইউনিভার্সিটিতে তাদের ক্ষমতা আরো বেশি দেখানোর উদ্দেশ্যে নবীনবরণের আয়োজন। সাবিনা ইয়াসমিনের গান বাজছে প্রত্যেকটি হলের সামনে রাখা রিকশায়। দিনের বেলা অনেকগুলি মাইক ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাসজুড়ে। জাতীয় ছাত্রসমাজের ইউনিভার্সিটি শাখার প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদকে নিয়ে অনেকগুলি মটরসাইকেল সহযোগে শোভাযাত্রা হচ্ছে। তবুও ভালো যে এই মটরসাইকেল শোভাযাত্রায় আমাদের যেতে হচ্ছে না।

 

তোষক তৈরি হয়ে গেছে। বিছানায় বিছিয়ে দিলাম। ধুনকর টিপুভাইয়ের চ্যাপ্টা বালিশে নতুন তুলো ভরে নাদুসনুদুস করে দিয়েছেন। সেই বালিশের টাকাটাও আমার কাছ থেকে নিয়ে তিনি বিদায় হয়েছেন। নতুন তোষকে বিছানাটা অন্যরকম লাগছে।

 

এরপর একটা সপ্তাহ দ্রুত কেটে গেল। ইতোমধ্যে এরশাদের ছবিযুক্ত পোস্টারে ক্যাম্পাস ছেয়ে গেছে। হলগুলির দেয়ালে দেয়ালে, ক্যাম্পাসের দেয়ালগুলিতে যতদূর পারা যায় – পোস্টার দিয়ে ছেয়ে ফেলা হয়েছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রফেসর আবদুল আজিজ খান যখন ভিসি ছিলেন, তখন ক্যাম্পাসে প্রচুর গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। গত চার-পাঁচ বছরে সেই গাছগুলির কান্ড এখন অনেকটাই পুষ্ট হয়েছে। নরম সবুজ পাতার সেসব গাছের গায়ে গায়েও রাতারাতি সেঁটে গেছেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তিনি নাকি এখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। মনে হচ্ছে গণতন্ত্র অনেকটা পানির মতো হয়ে গেছে – যখন যে পাত্রে রাখা হচ্ছে, সেই পাত্রের আকার ধারণ করছে। এখন রেডিও টেলিভিশনের সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেষণ দেখলে মনে হয় এরশাদের মতো প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সারাপৃথিবীতে আর একটিও নেই।

 

শিক্ষকরা ধর্মঘট আংশিক প্রত্যাহার করেছেন। তাঁরা সকাল দশটা পর্যন্ত কোন ক্লাস নেন না। এরপর ক্লাস নেন। আমাদের প্র্যাকটিক্যাল হচ্ছে নিয়মিত। সাহা স্যার প্র্যাকটিক্যাল করান। প্র্যাকটিক্যালের রাফ খাতায় ডাটা নিয়ে তাঁর দস্তখত নিয়ে হয়। তিনি এক সেট ডাটা নিলে স্বাক্ষর করেন না, কমপক্ষে তিন সেট ডাটা নিতে বলেন। জান বের হয়ে যাবার অবস্থা আমাদের। প্রদীপ নাথ এই অবস্থার নাম দিয়েছে – ফানা হয়ে যাওয়া। সাহা স্যার আমাদের ফানা করে দিচ্ছেন প্রত্যেকটা প্র্যাকটিক্যালে।

 

নভেম্বরের ২৬ তারিখ  সকাল থেকে ক্যাম্পাসে আমরা।  বিকেলে  প্র্যাকটিক্যাল ছিল।  বিকেল পাঁচটায় প্র্যাকটিক্যাল শেষ করে বের হয়ে দেখি পুরো ক্যাম্পাস নিস্তব্ধ। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই কোথাও। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছি। ক্যাম্পাসের সব বাস উধাও। পরদিন নবীনবরণ হবার কথা ছিল। আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনে সামিয়ানা টাঙানো হচ্ছিলো। সেগুলির কোন চিহ্নও নেই এখন। চাকসু ভবনের সামনে ছোট ছোট জটলা। এর ওর মুখ থেকে জানা গেলো একটা সশস্ত্র বিপ্লব ঘটে গেছে সবগুলি হলে। ক্যাম্পাস এখন পুরোটাই ছাত্রশিবিরের দখলে। জাতীয় ছাত্রসমাজের যাকে যেখানে পাওয়া গেছে তলোয়ার দিয়ে কোপানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কাল সকাল ন’টার মধ্যে হল ছাড়তে হবে সবাইকে।

 

ছাত্রসমাজের ব্লকে থাকি আমি। তখনো জানি না হলে আমার রুমের কী অবস্থা। কাটাপাহাড় দিয়ে বন্ধুরা সবাই হেঁটে হেঁটে ট্রেন স্টেশনে এলাম। যারা হলে থাকে – তারা সেদিক দিয়ে হলের দিকে চলে গেলো। হাফিজ, ইকবাল, প্রেমাঙ্কর, আনন্দ, কবীর, জামাল – সবাই। যীশু বললো, ‘তুই শহরে চল আমাদের সাথে।‘ প্রদীপ নাথ বললো, “তুই আমার সাথে চল আমাদের বাড়ি।“ কিন্তু আমি যাই কীভাবে? আমার সব জিনিসপত্র রয়ে গেছে হলে। আমার বইপত্র যা সাথে ছিল তা যীশুকে দিয়ে দিলাম। সাড়ে পাঁচটার ট্রেন দেরি করছে আজ। অপেক্ষা করছে – কেউ যদি আজকেই হল ছেড়ে চলে যেতে চায় তাদের জন্য। ঘটনা ঘটেছে দুপুরে। মেয়েদের অনেকেই হল ছেড়ে চলে গেছে ইতোমধ্যে। আমরাই প্র্যাকটিক্যাল রুমে ছিলাম বলে কিছুই জানতে পারিনি।

 

হলের দিকে এগোলাম। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। পথে যাদের দেখছি মনে হচ্ছে তাদের আগে কখনো দেখিনি এই ক্যাম্পাসে। সোহরাওয়ার্দীর সামনে তিন রাস্তার  মাঝখানে একটা বড় জায়গা এলোমেলোভাবে ইট ফেলে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। এখানেই কয়েক ঘন্টা আগে জাতীয় ছাত্রসমাজের প্রেসিডেন্ট হামিদকে ইটের উপর ফেলে তলোয়ারের এক কোপে কেটে নেয়া হয়েছে তার ডান হাত, কেটে ফেলা হয়েছে বাম হাতের সবগুলি আঙুল।


Wednesday 24 February 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৮

 


০৮

“লুক মাই ফ্রেন্ড, স্মোকিং ইজ ডাইরেক্টলি রিলেটেড টু ফিজিক্স” – কথাগুলি বলার সময় মুখ থেকে অদ্ভুত কায়দায় সিগারেটের ধোঁয়া বের করছে হাফিজ। তার ডান হাতের তর্জনি আর মধ্যমার আগায় আলতো করে লেগে আছে সোনালী ফিল্টার। একটু আগেই সে একটা লম্বা টান দিয়েছে সিগারেটে। এখন কথা বলতে বলতে ধোঁয়া বের করছে। ধোঁয়াগুলি মুখ থেকে বের হতেই সাদা বৃত্তাকার রিং তৈরি করে আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটছে বুঝতে পারছি না। হাফিজের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে প্রদীপ, স্বপন, ইকবাল আর দিলীপ। ইকবাল আর প্রদীপও ধোঁয়ার রিং তৈরি করছে। মনে হয় ধূমপায়ীরা সবাই এধরনের ধুম্রবৃত্ত তৈরি করতে ওস্তাদ। সিগারেটে কে কীভাবে টান দিচ্ছে তা যদি আভিজাত্য মাপার মাপকাঠি হতো তাহলে বলা যেতো দিলীপের সিগারেট টানার মধ্যে কোন আভিজাত্য নেই। তার মধ্যে কেমন যেন একটা তাড়াহুড়ো আছে। এক এক টানে তার সিগারেটের দৈর্ঘ্য প্রায় এক সেন্টিমিটার করে কমে যাচ্ছে, নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে ইটভাটার চিমনির মতো গলগল করে। মুখ দিয়ে সিগারেট টেনে নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করার কৌশলটাও সহজে আয়ত্বে আসার কথা নয়।

 

“নাকেও আউটলেট?” - আমি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছি দেখে স্বপন বললো – “আরে এটা কোন ব্যাপার না। ঠিকমতো বের করতে জানলে শরীরের সব ছিদ্র দিয়েই ধোঁয়া বের করা যায়। এমনকি **** দিয়েও।“ স্বপনের মুখে কোন ধরনের ফিল্টার নেই। উচ্চারণ-অযোগ্য যেসব ছিদ্রের কথা সে বললো, তার সেগুলি দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া বের হলে তো বিপদের কথা।

 

ধূমপায়ীদের এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে প্যাসিভ স্মোকিং হয়ে যায়। ধোঁয়া থেকে দূরে থাকা দরকার।  কিন্তু হাফিজের কথা বলার স্টাইল এত আকর্ষণীয়, ইংরেজিতে যাকে বলে মেসমেরিক, যে পুরোটা না শুনে ক্লাসে ঢুকতে পারছি না। হাফিজ দাবি করছে ফিজিক্সের সাথে ধূমপান সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু কীভাবে? এখানে যারা ধূমপান করছে – সবাই ফিজিক্সের ছাত্র। শুধু এটুকুর ভিত্তিতে তো বলা যায় না যে ফিজিক্স আর ধূমপান ক্লোজলি রিলেটেড। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুমের সাথে লাগানো খোলা বেলকনিতে তো ফিজিক্সের স্টুডেন্টরাই আসবে। ওল্ড ফার্স্ট ইয়ার অর্থাৎ আমাদের সিনিয়র ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমাদের ক্লাস এখন নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং থেকে মেইন বিল্ডিং-এ চলে এসেছে। চেয়ারম্যানের রুমের সামনে করিডোরের বাম পাশে পরপর ক্লাসরুমের সবচেয়ে দূরের রুমটা ফার্স্ট ইয়ারের, আর সবচেয়ে কাছেরটা মাস্টার্সের। ক্লাসরুমের ভেতর ভারী কাঠের তৈরি বেঢপ বেঞ্চ।  সামনের দেয়ালজুড়ে ব্ল্যাকবোর্ড। পাশের ছোট্ট দরজা খুলে ব্যালকনিতে যাওয়া যায়। ধূমপায়ীদের খুব পছন্দের জায়গা এই ব্যালকনি। আজ নুরুল ইসলাম স্যারের ম্যাথম্যাটিক্যাল ফিজিক্স ক্লাস হচ্ছে না। তাই আড্ডা জমেছে ব্যালকনিতে।

 

“লুক, এই যে সিগারেটের ধোঁয়া – এগুলি কী? গ্যাস তো? মুখের ভেতর গিয়ে খাদ্যনালীতে না ঢুকে শ্বাসনালী দিয়ে বের হয়ে আসছে। কেন? সিম্পল ফিজিক্স – কাইনেটিক থিওরি অব গ্যাস।“ – হাফিজ যেগুলি বলছে তা হিট ও থার্মোডায়নামিক্সের কোন্‌ বইতে লেখা আছে জানি না। কিন্তু সেগুলি অস্বীকার করার উপায় নেই। সে খুব সিরিয়াস টোনে বলছে, “ফেমাস ফিজিসিস্টদের সবাই স্মোক করে। আইনস্টাইন, রাদারফোর্ড, নিউটন, গ্যালিলিও, মাদাম কুরি সবাই স্মোক করতেন।“

আইনস্টাইন পাইপ টানতেন তা ছবিতে দেখেছি। কিন্তু বাকিরা স্মোক করতেন কি না জানি না।

“মাদাম কুরি ধূমপান করতেন – এই তথ্য তুই কোথায় পেলি?” – হাফিজকে জিজ্ঞেস করলাম।

“মাদাম কুরি ফ্রান্সের না? ফ্রান্সের মেয়েরা স্মোক করবে – এটাই তো নরমাল।“

 

ফ্রান্সের হোক, কিংবা ক্যাম্পাসের -  মেয়েদের সম্পর্কে হাফিজের জ্ঞান আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তাই সে যখন বলছে মেরি কুরি ধূমপান করতেন, তাহলে নিশ্চয় করতেন।

 

হাফিজ আরেকটা ধুম্রচক্র বাতাসে ছড়িয়ে সিগারেট ও পদার্থবিজ্ঞানের গভীর সম্পর্ক সম্পর্কিত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো – সেই সময় মিজান এসে খবর দিলো স্যারদের মিটিং আছে, পরের ক্লাসও হবে না। মিজান আমাদের ক্লাসের আন-অফিসিয়াল নিউজ-সোর্স। কখন কী হবে, কী হবে না সেই খবর সে কীভাবে যেন নিয়ে আসে।

 

ক্লাস হবে না শুনে ক্লাসের মেয়েদের কয়েকজন ব্যালকনিতে চলে এলো। হাফিজের মনযোগ ঘুরে গেল তাদের দিকে। যখন ক্লাস চলে তখন বোঝা যায় না ক্লাসের কার আচরণ কেমন। কিন্তু কোন নির্ধারিত ক্লাস যখন হয় না, তখন একেক জনের একেক রকমের প্রতিক্রিয়া হয়। যেমন এখন সুমন আর আনিস বসে আছে চুপচাপ। ফারুক, মঈন, স্বপন, আর মামুন চলে গেছে ক্লাসের বাইরে করিডোরে। মৃণাল কথা বলছে ইলোরার সাথে। প্রেমাংকর, জামাল, আজিজ, ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা আলোচনা করছে। আনন্দ গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কাছে। আনন্দের নামের সাথে আচরণ খুব একটা মেলে না। সে সারাক্ষণই গম্ভীর থাকে। শাহাবুদ্দিন, তাজুল, আর দুই দুলাল - দৌলতুজ্জামান দুলাল আর দেলোয়ার হোসেন দুলাল ব্যালকনির এক কোণায় চলে গেল। মৃণাল আর দৌলতুজ্জামান দুলালকে দেখতে প্রায় একই রকম লাগে – খুবই সুদর্শন – হিন্দি সিনেমার নায়ক গোবিন্দ’র মতো। শাকিল কবীরকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। শাকিল পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। হলে একদিন তার রুমে গিয়েছিলাম। ইতোমধ্যেই তার সব পেপারের নোট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কবীরের মধ্যে এখনই বুদ্ধিজীবীর ভাব স্পষ্ট। এত হৈ চৈ-এর মধ্যেও রুমা বই পড়ছে, মনে হচ্ছে গল্পের বই। রাখী, ইলা, রিনা, পারুল – চার মাথা এক করে ছবির  অ্যালবাম দেখছে। যীশু, প্রদীপ আর অর্পণ কথা বলছে শীলার সাথে। মেয়েদের মধ্যে কেউই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না। কিন্তু শীলা ব্যতিক্রম। সে আমাদের সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলে।

 

একটু পরে মিজান আর দীপক রুমে ঢুকলো। মিজান অনেক খবর নিয়ে এলেও আহসান হাবীব দীপকের মধ্যে সাংবাদিকভাবটা মিজানের চেয়েও প্রবল। দীপক সংবাদপত্রে নিউজ রিপোর্ট এখনো করেনি বটে, কিন্তু সংবাদপত্রে চিঠি লিখেছে অনেকগুলি। এলাকায় নলকূপ চাই, মশার উপদ্রব থেকে বাঁচান, ছিন্নমূলরা কোথায় যাবে, ইভটিজিং ইত্যাদি অনেক বিষয়ে সুন্দর গুছিয়ে চিঠি লিখেছে সে। দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছে। বিশাল এক অ্যালবামে তার প্রকাশিত সব চিঠি সংগ্রহ করে রেখেছে সে। একদিন দেখিয়েছিল আমাকে। দীপক খবর দিল শিক্ষক সমিতির জরুরি মিটিং চলছে। বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। দাবি পূরণ না হলে শিক্ষকরা ধর্মঘটে যাবেন। আজ আর কোন ক্লাস হবে না।

 

ক্লাসে আর বসে থাকার মানে হয় না। ওল্ড ফার্স্ট ইয়ারের থিওরি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তারা  প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্য ল্যাব প্র্যাকটিস করছে। তাই আমাদের প্র্যাকটিক্যালও হবে না আজ। ক্লাস থেকে বের হয়ে এলাম।

 

লাইব্রেরি কার্ডটা এতদিনে চলে আসার কথা। যীশু আর প্রদীপসহ গেলাম লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরি কার্ড হাতে পেলাম। নামেই লাইব্রেরি কার্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে কোন বই ধার নেয়ার সুযোগ নেই শিক্ষার্থীদের। বই পড়তে হলে লাইব্রেরিতে বসে পড়তে হবে। কিন্তু পড়ার জন্য যে বই – সে বই নিজে বেছে নেয়ার সুযোগও নেই। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির ব্যবস্থাপনা যে এতটা অগোছালো এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল হতে পারে তা কোনদিন চিন্তাও করিনি। এখানে একটা বই পড়তে হলে প্রথমে বইয়ের কল নাম্বার খুঁজে বের করতে হবে। তারজন্য বইয়ের কার্ডগুলি সব দেখতে হবে একটা একটা করে। তারপর সেখান থেকে কাগজে কল নাম্বার লিখে সেটা দিতে হবে লাইব্রেরির কোন কর্মচারীকে। তিনি গিয়ে ভেতরে বুকশেল্‌ফে খুঁজে দেখবেন। পাঁচ-দশ-পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর বইটি পেলে তিনি নিয়ে আসবেন, অথবা এসে বলবেন বইটি নেই। আর্থার বাইজারের মডার্ন ফিজিক্স বইটার কলনাম্বার খুঁজে স্লিপ লিখে দিয়ে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর জানা গেলো বইটি নেই। বুকশেল্‌ফ থেকে নিজেরা বই বাছাই করে নিয়ে পড়তে না পারলে লাইব্রেরি বলা যায় একে? খুবই হতাশ হয়ে চলে এলাম লাইব্রেরি থেকে।

 

হলে থাকলে কোন কিছুতেই তাড়াহুড়ো করতে হয় না। ট্রেন ধরার তাড়া থাকে না বলে ভীড়বাসে না উঠলেও চলে। প্র্যাকটিক্যাল না থাকলে রুমে গিয়ে খেয়েদেয়ে দিবানিদ্রাও দেয়া যায়। প্রদীপ আর যীশু চলে গেল বাসে উঠে। আমি ক্যাম্পাসে আরো কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে চাকসু ক্যাফেটরিয়াতে খেয়ে হলে এলাম। হলের অফিসের সামনের জানালার কাচে লাগানো সিটবন্টনের তালিকা আবার দেখলাম – যেন বারবার দেখলে সেখানে আমার নাম দেখা যাবে। সিটের দরখাস্ত করেছিলাম। কোন কাজ হয়নি। পুরো সায়েন্স ফ্যাকাল্টি থেকে ফার্স্ট ইয়ারে মাত্র চারজনকে সিট দেয়া হয়েছে। আমার ক্লাসমেটদের অনেকেই এই হলে থাকে। তারা কেউই সিট পায়নি। কিন্তু কোন না কোনভাবে সিট ম্যানেজ করে থাকছে। আমিও তাদের মতোই। কিন্তু মনের ভেতর কেমন যেন খচখচ করতে থাকে সারাক্ষণ।

 

আকাশে মেঘ জমেছে। তুমুল বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। এরকম দুপুর – দিবানিদ্রার জন্য প্রকৃষ্ট সময়। কিন্তু রুমে ঢুকে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমার বিছানায় আমার লুঙ্গি পরে যে লোকটা ঘুমাচ্ছে তাকে আমি চেনা তো দূরের কথা, এর আগে কোনদিন দেখিওনি। অন্য দুটো বিছানাও খালি নেই। সুসেনভাই আর টিপুভাই ঘুমাচ্ছেন যে যার বিছানায়। সুসেনভাই সেই রাতে আমার উপর হুকুমজারি করার পর কয়েকদিন ধরে এত বেশি সালাম দিয়েছি আর যখন তখন এত পারমিশান নিয়েছি যে বিরক্ত হয়ে গেছে। অনেকদিন সুসেনভাইয়ের ঘুম ভাঙিয়ে বাইরে যাবার পারমিশান নিয়েছি। দরজায় জোরে জোরে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করেছি – মে আই কাম ইন স্যার? অযোগ্য লোক হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে গেলে বিদ্রুপ আর ভক্তির পার্থক্য বুঝতে পারে না। জাতীয় ছাত্রসমাজের এসব ভুঁইফোঁড় নেতাদেরও একই অবস্থা। আমার ‘ভক্তি’তে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নিজের মতো থাকার দীর্ঘমেয়াদি পারমিশান দিয়ে দিয়েছেন। ক’দিন বেশ আরামেই ছিলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ এ কী উপদ্রব! আমার বিছানায় অন্যজন ঘুমাচ্ছে। তবে কি আমাকে বিতাড়িত করা হলো?

 

টেবিলে বইখাতা রাখার সময় যতটুকু শব্দ হওয়া উচিত তার চেয়েও কিছুটা বেশি শব্দ হলো। শব্দের বাহুল্যটা ইচ্ছাকৃত। শব্দে কাজ হলো কিছুটা। বিছানা থেকে মাথা তুলে তাকালেন লোকটা। গোলগাল থলথলে মুখটা বাংলা সিনেমার অভিনেতা হাসমতের মতো।

“আপনার বিছানায় ঘুমাইছি? আপনি ঘুমাইবেন এখন? ঘুমাইলে ঘুমান, আমার পাশে ঘুমান।“ বলে তিনি ইঞ্চিখানেক সরে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। অসহ্য। রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। রঘুনাথ আছে কিনা দেখা যাক।

 

রঘুনাথ থাকে ১৪৩-এ দেবাশিসদার সিটে। দেবাশিসদা আমাদের দু’ব্যাচ সিনিয়র। ফার্স্ট ইয়ারে ফার্স্ট হয়েছেন। এখন সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষার্থী। রঘুনাথকে আমি চিটাগং কলেজ থেকেই চিনি। সে ভর্তি হয়েছে কেমিস্ট্রিতে। দেবাশিসদার সাথে ডাবলিং করছে বলে দিনরাত পড়াশোনা করছে। কিন্তু আজ তাকে পাওয়া গেল না। রুমে তালা ঝুলছে। ফিরে আসছিলাম, পথে দেখা হয়ে গেল আশরাফভাইয়ের সাথে। আশরাফভাই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল চিটাগং কলেজের হোস্টেলে। তিনি মাঝে মাঝে সেখানে যেতেন সাংগঠনিক কাজে।

“তুমি কি হলে উঠেছো?” – আশরাফভাই জানতে চাইলেন।

“ডাবলিং করছি ভাইয়া। জাতীয় পার্টির সিটে। আমার জন্য আপনাদের ব্লকে একটা সিটের ব্যবস্থা করেন।“

“কোন সমস্যা নেই। আর এক মাস কোন রকমে কষ্ট করো। তারপর আমার সিটটা খালি হবে। তুমি সেখানে চলে এসো। দুই সপ্তাহ পরে আমার সাথে দেখা করবে।“

বাহ্‌, ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমার সিটে ঘুমন্ত হাসমতমুখি মানুষটা আমার উপকার করেছেন বলা চলে। তিনি ঘুমাচ্ছেন বলেই তো আমার সাথে আশরাফ ভাইয়ের দেখা হলো।

 

হলের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করার অনেক জায়গা আছে। আলাওল হলের দিকে গিয়েছিলাম। সুন্দর ফুলের বাগান আছে সেদিকে। এ এফ রহমান হলের সামনের রাস্তায় বড় বড় চাঁপাফুলের গাছ আছে। ওদিকে আসার পথে ইউনিভার্সিটির অডিটরিয়ামের সামনে দিয়ে এলাম। বাইরে থেকেই মনে হচ্ছে বিশাল হল। এত বড় ক্যাম্পাসে যে ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলা উচিত তার কিছুই চোখে পড়লো না। সব জায়গায় কেমন যেন দমবন্ধ করা একটা অনুভূতি। বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় বসে আছে মিলিটারি। ক্যান্টনমেন্ট থেকেই হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দল। কিছু সুবিধাবাদী ছাত্রের হাতে টাকাপয়সা আর আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়ে রাতারাতি দখল করে নিয়েছে ইউনিভার্সিটিগুলি। এভাবে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ থাকে?

 

সন্ধ্যাবেলা কাটলো টিভি রুমে। মামুনুর রশীদের ধারাবাহিক নাটক ‘সময়-অসময়’ দেখলাম। খুব সিরিয়াস নাটক। ডাইনিং-এ ভাত খেয়ে রুমে এসে বিছানা খালি দেখে শান্তি পেলাম। এলোমেলো বিছানার উপর আমার লুঙ্গিটা ফেলে গেছেন। আবার ধুতে হবে ওটা। বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে শুকাবে না। মানুষটা কে ছিলেন, রাতে আবার আসবেন কি না কিছুই জানি না। শ্যামলদা আজকেও নেই। তিনি কোথায় ঘুমান আমি জানি না। আমি আসার পর থেকে ধরতে গেলে তিনি আমাকে সিটটা ছেড়েই দিয়েছেন। এবার একটা তোষকের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় সুসেনভাই আর সাজ্জাদভাই এলেন। সাজ্জাদভাই জাতীয় ছাত্রসমাজের সিকিনেতা। সুসেনভাইও তাকে সালাম দেন।

“সালাম ভাই।“

“অ্যাই, কাল সকালে ক্যাম্পাসে থাকবা। মিছিল আছে। যদি মিছিলে না যাও, তাইলে আর এই রুমে আসতে অইব না। জিনিসপত্র সব নিচে ফেইলা দেবো, সেখান থেইকা কুড়াই লইয়া বিদায় হইবা। কথা কিলিয়ার?”

“কিলিয়ার ভাই, সালাম ভাই।“

সিকিনেতা পাশের রুমের দিকে চলে গেলেন। পাতিনেতা গেলেন তার পিছুপিছু।

কাল জাতীয় পার্টির মিছিল করতে হবে? প্রেসিডেন্ট এরশাদ – জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বলতে হবে? শ্যামলদাও কি কাল এই পার্টির মিছিল করবেন? তিনি তো ছাত্রলীগের নিষ্ঠাবান কর্মী। তিনি যদি মিছিলে না যান, তাঁর জিনিসও কি নিচে ফেলে দেয়া হবে? অবশ্য আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম শ্যামলদার তেমন কিছু নেই এই রুমে। যা যাবার আমার উপর দিয়েই যাবে।

পরদিন সকাল দশটা থেকে ক্যাম্পাসে মিছিল। চাকসু ভবনের সামনে সবাই জড়ো হচ্ছে। নেতাদের অনেকেই চলে এসেছেন। আমার মতো অনেককেই মিছিলে আসা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কবীরের সাথে দেখা হয়ে গেল। সেও যে জাতীয় পার্টির সিটে থাকে জানতাম না। সিকিনেতা সাজ্জাদভাইকে খুঁজে বের করে দর্শন দিতে হবে। লম্বা সালাম দিতে হবে – যেন আমার চেহারা মনে থাকে। তাঁর স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করছে আমার জিনিসপত্রসহ আমি রুমে থাকবো, নাকি জিনিসপত্র নিচের রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে হল ত্যাগ করবো।

“স্লামালাইকুম সাজ্জাদভাই। আমি ২৫২। মিছিলে এসেছি।“

“ঠিক আছে, ঠিক আছে, লাইনে দাঁড়াও।“

লাইনের সামনে দাঁড়ানো নেতাদের আশেপাশে থাকার জন্য হুড়োহুড়ি করছে অনেকেই। আমি আর কবীর যথাসম্ভব লাইনের পেছনে সরতে শুরু করেছি। মিছিল শুরু হলো। আর্টস ফ্যাকাল্টির ভেতর ঢুকলো লাইন ধরে। ভেতরে ঢুকেই মিছিল অনেকটা এলোমেলো হয়ে গেল। স্লোগানের ভাষা শুরুতে কী ছিল জানি না। একটু পরে দেখা গেল – ক্ষীণকন্ঠে কেউ বলছে – বাঘের বাচ্চা – সাথে সাথে আশেপাশের সবাই চিৎকার করে বলছে – এরশাদ। বাঘের বাচ্চা – এরশাদ, সিংহের বাচ্চা – এরশাদ, ঘোড়ার বাচ্চা – এরশাদ, নেকড়ের বাচ্চা – এরশাদ, মুরগির বাচ্চা – এরশাদ। এভাবে বিভিন্ন প্রাণীর বাচ্চার সাথে এরশাদের তুলনা করে গলার জোর দেখাতে দেখাতে শেষপর্যন্ত সবচেয়ে প্রভুভক্ত প্রাণীর বাচ্চাতে এসে স্থিত হলো স্লোগান। এত লম্বা মিছিল দেখে মিছিলের সামনের নেতারা হয়তো খুশি হয়েছেন। কিন্তু মিছিলের পেছনে স্লোগানের ভাষাটা যদি তারা শুনতেন কী করতেন জানি না।

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>>>>>>

<<<<<<<<<<<< আগের পর্ব

Monday 15 February 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৭

 


০৭

“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে, সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া” – রবিঠাকুরের কাব্যিক সন্ধ্যা যেরকম মন্দ মন্থর রাবীন্দ্রিক গতিতে ধীরে ধীরে নামে – এখানে সেরকম কোন আয়োজন ছাড়াই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে রাত হয়ে গেল। সব সঙ্গীত এখনো থামেনি, অবশ্য পাশের রুমে যা হচ্ছে তাকে যদি আদৌ সঙ্গীত বলা যায়। পাশের রুমে কেউ একজন গত দশ মিনিট ধরে “তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে হিদয়ের কুঠুরিতে রাখবো“ বলে যেভাবে চেঁচাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে  রেললাইনের ফাঁকে পা আটকে যাবার মতো গানের লাইনের ফাঁকে তার গলা আটকে গেছে। ইচ্ছে করলেই বারান্দায় বের হয়ে গলা বাড়িয়ে দেখে আসা যায় এই ভয়াবহ গান কার গলা দিয়ে বের হচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না।

 

আগস্টের শেষে শহরে যেরকম ভ্যাপসা একটা গরম থাকে – এখানে সেই অস্বস্তিকর ভাবটা নেই। পাহাড়ী এলাকা বলেই হয়তো। ঝিরঝিরে আরামদায়ক বাতাস আসছে জানালা দিয়ে। আমার পড়ার টেবিলটা জানালার কাছে। দরজা বন্ধ করে বসে আছি চেয়ারে। রেসনিক হ্যালিডের বই, আর মোবাশ্বের স্যারের ক্লাসে যে নোট নিয়েছি – তা খুলে বসে আছি। স্যার বাড়ির কাজ দিয়েছেন। স্যার বলেছেন – হোম-ওয়ার্ক। আজ থেকে তো এটাই আমার হোম, সোহরাওয়ার্দী হলের ২৫২ নম্বর রুম। রুমে তিনটি সিঙ্গেল খাট – তিন দিকের দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে আছে। পড়ার টেবিলগুলি সুন্দর, মনে হচ্ছে নতুন বানানো হয়েছে। টেবিলের সাথে লাগানো বইয়ের তাক। তিনটি টেবিলের কোনটাতেই তেমন কোন বইপত্র দেখা যাচ্ছে না। আমার বইপত্র কিছু আছে শহরে, আস্তে আস্তে নিয়ে আসতে হবে। সামনের দেয়ালে জেনারেল এরশাদের একটি হাস্যমুখ ছবিযুক্ত পোস্টার লাগানো আছে। তার পাশেই একটি শ্রীদেবীর পোস্টার। পোস্টার দুটো যে লাগিয়েছে তার রসবোধ ভালোই। মনে হচ্ছে বঙ্গদেশের মিলিটারি শাসকের দৃষ্টি শ্রীদেবীর বক্ষদেশে স্থির হয়ে আছে। এতগুলি হলের এতগুলি রুম থাকতে কি না আমি এসে উঠলাম এখানে?

 

হলে ওঠার সঠিক নিয়মকানুন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এখানে রাজনৈতিক দখলদারিত্ব চলছে। এই হলের এই ব্লকটা জাতীয় পার্টির দখলে। আলাওল হল নাকি জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। সব বড় নেতা ওখানে থাকে। বিভিন্ন হলেই কিছু কিছু রুম ছাত্রলীগের, ছাত্রদলের কিংবা ছাত্রশিবিরের। ছাত্র ইউনিয়নেরও কিছু রুম আছে বিভিন্ন হলে। যারা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নয়, তাদের কী উপায়? তারা যে নিরুপায় – তা নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছি কিছুটা।

 

আজ দুপুরে শাহীন যখন বললো ২৫২ জাতীয় পার্টির রুম, আমি আঁৎকে উঠেছিলাম। তার একটু আগেই জাতীয় পার্টির সশস্ত্র ক্যাডার দেখেছি। আমি সেই পার্টির সিটে উঠার জন্য এসেছি হলে? কিন্তু আমি তো জানতাম শ্যামলদা – যার সাথে ডাবলিং করার কথা হয়েছে – তিনি  ছাত্রলীগ করেন। কোন্‌ রুমে উঠছি সে ব্যাপারে শাহীন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সোহরাওয়ার্দীর কোন্‌ রুম কোন্‌ দিকে সে ভালোভাবেই চেনে। সে আমাকে চারটা বিল্ডিং পার হয়ে পঞ্চম বিল্ডিং-এর দোতলায় নিয়ে এলো। সিঁড়ি থেকে ডানদিকে ঘুরে বেশ কিছুদূর আসার পর রুম পাওয়া গেল – ২৫২। শ্যামলদা রুমে অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য।

 

শাহীন আমার বাক্সটা নামিয়ে রেখেই গিটার দুলিয়ে দ্রুত চলে গেলো। শ্যামলদা বললেন, “এসো প্রদীপ, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এইটাই সিট। ট্রাংকটা খাটের নিচে রাখো। আর এই চেয়ার-টেবিল। ওদিকের দেয়ালে আলমিরা আছে।“

 

“না, আলমিরা ইউজ করা যাবে না। ওখানে আমাদের জিনিসপত্র আছে। খবরদার, আলমিরায় হাত দিবা না।“ – কথাগুলি যিনি বললেন তাঁর গলা ফ্যাঁসফ্যাঁসে। দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে খাটে বসে আছেন। লুঙ্গি উঠে আছে হাঁটুর উপরে, স্যান্ডো গেঞ্জির অনেকটাই গুটানো। মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের শরীরে গরম বেশি, তাই ফুলস্পিড ফ্যানের নিচে বসেও জামা-কাপড় গুটিয়ে রেখেছেন।

 

“ওহ্‌, ঠিক আছে। সুসেন যখন বলছে তখন আলমারিতে হাত দেয়া যাবে না। আলমিরা লাগবে না তোমার।“ শ্যামলদা কথা বলেন নিচুস্বরে, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। কিন্তু শুনেছি তিনি নাকি ছাত্রলীগের অনেক বড় নেতা। বড় নেতারা সম্ভবত গলা উঁচিয়ে কথা বলেন না। সেই হিসেবে মনে হচ্ছে সুসেন সাহেব কিংবা সুসেন ভাই খুব বেশি বড় নেতা এখনো হয়ে ওঠেননি। একটু পরে আরেকজন মাঝারি নেতা রুমে ঢুকতেই শ্যামলদা “এই নাও চাবি” বলে আমাকে চাবি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। মাঝারি নেতা আমার দিকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এরশাদ-শ্রীদেবীর পোস্টারের নিচে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে খাটে বসে গেলেন। পা টেনে খাটে বসা কি এই রুমে বাধ্যতামূলক? আমি দ্রুত বের হয়ে গেলাম মোবাশ্বের স্যারের ক্লাস ধরার জন্য।

 

চাকসু ভবনের সামনে বাস থেকে নেমে নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং পর্যন্ত অনেকদূর হাঁটা। রোদের মধ্যে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছি। আমার সামনে রঙিন ছাতা মাথায় একজন মেয়ে। সেও বেশ জোরেই হাঁটছে। সে সায়েন্স ফ্যাকাল্টির দিকে মোড নিতেই আমি তাকে ক্রস করে সোজা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি। সে পেছন থেকে ডাক দিলো, “অ্যাই, অ্যাই, ওদিকে যাচ্ছো কেন?”

আমি ফিরে তাকাতেই চিনতে পারলাম। তার চোখে কালো চশমা। সে কয়েক পা এগিয়ে এলো আমার দিকে।

“তুমি ক্লাসে যাচ্ছো না? ওদিকে গেলে তো অনেক বেশি হাঁটতে হবে, আর অনেক রোদ। ফ্যাকাল্টির ভেতর দিয়ে গেলে তো রাস্তাও কম, রোদও নেই।“ গম্ভীর মাস্টারের মতো বললো সে।

“হ্যাঁ, তাই তো।“

“আমার নাম আইরিন। আমি তোমার ক্লাসে পড়ি। আমি তোমাকে চিনি, কিন্তু নাম ভুলে গেছি।"

"আমার নাম প্রদীপ।“

“হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুমি মোবাশ্বের স্যারের ক্লাসে পড়া পারোনি সেদিন। স্যার যে ক্লাসের কোণায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। আর তুমি কীরকম ফানি ফেইস করে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকলে। আমার খুব হাসি পেয়েছিল। আবার স্যারের ভয়ে হাসতেও পারছিলাম না। তুমি এত আস্তে হাঁটছো কেন? আমি কিন্তু অনেক জোরে হাঁটি। মিলিটারির বউ তো, মিলিটারির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে অভ্যাস হয়ে গেছে।“

 

সায়েন্স ফ্যাকাল্টির  এক মাথা থেকে অন্য মাথায় করিডোর দিয়ে হেঁটে নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং-এ আসতে বেশিক্ষণ লাগলো না। আইরিনকে খুব সহজ-সরল সোজাসাপ্টা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আমি যে ক্লাসে পড়া পারি না, সেটা মনে হচ্ছে ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে।

 

মোবাশ্বের স্যার ক্লাসে এত পড়া ধরেন – মনে হয় আমরা ইউনিভার্সিটিতে নয়, প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। আজকের ক্লাসে অবশ্য খুব বেশি কিছু জিজ্ঞেস করেননি মোবাশ্বের স্যার। কিছু হোমটাস্ক দিয়েছেন। থার্মোডায়নামিক্সের কিছু সমীকরণ প্রমাণ করতে হবে। পদার্থবিজ্ঞান কেমন যেন গণিতপ্রবল হয়ে যাচ্ছে। পদার্থবিজ্ঞানের মূল বিজ্ঞান বুঝার বদলে গাণিতিক সমীকরণগুলি কীভাবে হচ্ছে তা বুঝতেই সময় চলে যাচ্ছে। পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিকের কথা তেমন আলোচনা করেন না কোন প্রফেসর। নতুন আবিষ্কার সম্পর্কেও কেউ কোনদিন কিছু বলেন না। এই যে গত মাসের ২৬ তারিখ সাভারে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক চুল্লি স্থাপিত হলো, আমি আশা করেছিলাম স্যাররা এ সম্পর্কে কিছু না কিছু বলবেন। কিন্তু আজ এক মাস চলে গেলো, কোন স্যার এ ব্যাপারে টু শব্দটি করলেন না। হয়তো সিনিয়রদের ক্লাসে বলেছেন। কিন্তু আমার তো মনে হয় এসব ব্যাপারে জুনিয়র স্টুডেন্টদেরকেই তো বেশি করে বলা দরকার, যেন আমরা উৎসাহ পাই।

 

মোবাশ্বের স্যার সিয়ার্সের বইয়ের রেফারেন্স দিলেন। এই বই থেকেই মনে হচ্ছে হোমটাস্ক দিয়েছেন। সিয়ার্সের বইয়ের খোঁজে ডিপার্টমেন্টের সেমিনার লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলাম আজ। সেমিনারের প্রথম দিন – স্মরণ থাকবে চিরদিন। সেমিনার লাইব্রেরি ফ্যাকাল্টির দোতলায়। চেয়ারম্যানের অফিসের পর ক্লাসরুম পার হয়ে করিডোর দিয়ে আরো কিছুদূর গিয়ে বামপাশে হামিদা বানু ম্যাডামের অফিসের পাশের বড় রুমটাই সেমিনার। সাদার উপর নীল ডোরাকাটা পর্দা দিয়ে ঘেরা এই রুম। দরজার পর্দা সরিয়ে দেখলাম একটা বড় ডেস্কের সামনে বড় একটা চেয়ারে গম্ভীরভাবে বসে ‘দৈনিক আজাদী’ পড়ছেন হ্রস্বদেহী একজন মানুষ। সম্ভবত ইনিই লাইব্রেরিয়ান।

“কী চাই?” – পত্রিকার পাতার আড়াল থেকে মুখ বের করে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেন।

“একটা বইয়ের খোঁজে এসেছি।“

“কোন্‌ ইয়ার? ফার্স্ট ইয়ার?”

“হ্যাঁ।“

“ফার্স্ট ইয়ারেই সেমিনারে ঢুকে পড়েছেন? ফাইনাল ইয়ারে উঠেন, তারপর আসবেন।“  - বলেই পত্রিকায় মন দিলেন। রুমের চারদিকে একবার চোখ বুলালাম। জানালায় পর্দা টেনে দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে রাখার কী কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কি বিদ্যুৎ-বিল দিতে হয় না? কয়েকটা বড় বড় টেবিলের পাশে বেঞ্চ পাতা। একজন পাঠকও নেই পদার্থবিজ্ঞানের পাঠকক্ষে। ফার্স্ট ইয়ারের শিক্ষার্থীরা সেমিনারে ঢুকতে পারবে না – এই আইন কোথায় আছে, কেন আছে জানি না। বের হয়ে এলাম। এরপর গেলাম লাইব্রেরিতে।

 

আজ প্র্যাকটিক্যাল ছিল না। যীশুরা সবাই চলে গেছে শহরে। হলে থাকলে অনেক সময় বেঁচে যায়। আর্টস ফ্যাকাল্টির বাম পাশ দিয়ে ঢুকলাম। এদিকে ফ্যাকাল্টির বাইরে মাটির নিচে বেশ বড় একটা রুম আছে। ফাইন আর্টসের ওয়ার্কশপ। ফ্যাকাল্টির গেট দিয়ে ঢুকেই নাট্যকলা বিভাগ। নাটকের প্রতি এক ধরনের আগ্রহ আছে আমার। কিন্তু ফিজিক্স আর সিরিয়াস নাটক- একসাথে চলে না। আর্টস ফ্যাকাল্টি ফাঁকা হয়ে গেছে দেড়টা বাজার আগেই। এতগুলি ক্লাসরুম খালি পড়ে থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়। করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে একদম অন্যপ্রান্ত দিয়ে বের হলাম। এখানে অগ্রণী ব্যাংক। বিল্ডিং থেকে বের হবার মুখে বিশাল এক বটগাছ। দুপুর-রোদে ঝিম মেরে আছে তার বড় বড় গাঢ় সবুজ পাতা। এর সামনে চারতলা সাদা বিল্ডিং- ছাদে অনেকগুলি পিলার লোহার ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি এখনো। এই বিল্ডিং-এর চার তলায় লাইব্রেরি। সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। আরো দু’বার এসেছিলাম এখানে। একবার এসেছিলাম লাইব্রেরি কার্ড করার জন্য ফরম নিতে। যাকেই জিজ্ঞেস করি, আরেকজনকে দেখিয়ে দেন। এভাবে তিন-চারজন ঘুরে জানা গিয়েছিল ফরম তখনো আসেনি। দু’সপ্তাহ আগে আরেকবার এসে তাও কয়েকজনের কাছে ঘুরে ফরম নিতে পেরেছিলাম। তারপর লাইব্রেরি কার্ডের জন্য দরখাস্ত জমা দিয়েছি। একটা লাইব্রেরি কার্ড করার জন্যও দরখাস্তের সাথে কত কিছু জমা দিতে হলো। ভর্তি হবার সময় লাইব্রেরির জন্য যে টাকা দিয়েছি – সেই রশিদও দিতে হলো। এই ব্যাপারগুলি কি একবারে একসাথে করে ফেলা যায় না? একজন শিক্ষার্থীর একটা পরিচয় পত্রের সাথেই সবকিছু যোগ করে দেয়া যায় না?

 

লাইব্রেরি কার্ড আজ আসার কথা ছিল। চারতলায় উঠে লাইব্রেরির প্রধান দরজায় ঢুকলাম। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। একপাশে দেয়াল ঘেঁষে ছোট ছোট কাঠের খোপে এ বি সি ডি এভাবে বই খোঁজার কার্ড। কিন্তু লাইব্রেরি কার্ড ছাড়া কোন কিছুতে হাত দেয়াও সম্ভবত নিষেধ। লাইব্রেরি তো সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা। এখানে বইগুলি কোথায় আছে দেখার কোন সুযোগ নেই। ডেস্কে বইয়ের নাম আর পরিচিতি নম্বর লিখে দিলে লাইব্রেরির সহকারীরা বই খুঁজে এনে দেন। কিন্তু সবকিছুর আগে দরকার হবে লাইব্রেরি কার্ড। ফ্লোরে স্যান্ডেলের ঘর্ষণে কিছু শব্দ হলো। ভেতর থেকে খুব ধীরপায়ে একজনকে আসতে দেখা গেল।

 

“আমার লাইব্রেরি কার্ডটা কি এসেছে?”

“কোন্‌ ইয়ার? ফার্স্ট ইয়ার?” এরা কি ফার্স্ট ইয়ারদের দেখেই চিনে ফেলতে পারে? নতুনত্বের কি কোন চিহ্ন আছে যা দূর থেকে দেখা যায়?

“ফার্স্ট ইয়ারের কার্ড এখনো আসেনি।“ – বলে আমার দিকে আর না তাকিয়েই তিনি চলে গেলেন তাঁর ডেস্কে। সেখানে চেয়ারে বসে ড্রয়ার খুলে একটা গোল আয়না বের করে নিজের চেহারা দেখতে লাগলেন। মনে হচ্ছে তাঁর মুখের ব্রণ নিয়ে তিনি খুব বিরক্ত। নখ দিয়ে টিপে ব্রণনাশ করতে চাইছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত প্রেমিক পুরুষ ক্যাসানোভা নাকি শেষ জীবনে লাইব্রেরিয়ান হয়েছিলেন। এখন চোখের সামনে যাকে দেখতে পাচ্ছি – তিনি কতটুকু ক্যাসানোভা জানি না, তবে যে  অনেকটুকু নার্সিসাস তা বুঝতে পারছি। সিয়ার্সের বই কখন পাওয়া যাবে জানি না। মোবাশ্বের স্যারের হোম-টাস্ক আগামী সপ্তাহের মধ্যে করতে হবে।

 

সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা হলগুলির সামনে কাটিয়েছি। এখানে বিকেল হলেই হলের সামনের রাস্তা কেমন যেন বাজার-বাজার হয়ে ওঠে। অনেকে আখ, জাম্বুরা ইত্যাদি বিক্রি করতে আসে। ছাত্ররা এসব কিনে খায়। রেস্টুরেন্টগুলি জমে উঠে। পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান আছে অসংখ্য। নতুন জায়গায় এলে শুরুতে কিছুদিন একটা অতিথি-ভাব থাকে। নিজেই নিজের অতিথি, নতুন জায়গার অতিথি। আমি তো আসলে শ্যামলদার অতিথি।

 

শ্যামলদা পড়ে কেমিস্ট্রিতে। আমার এক বছরের সিনিয়র। এখন তো তাঁর ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল দেয়ার কথা। পরীক্ষা কেমন হয়েছে বা হচ্ছে কিছুই তো জিজ্ঞেস করলাম না। সুসান এবং অন্য নেতার সঙ্গে এখনো তেমন পরিচয় হয়নি। সন্ধ্যায় রাস্তায় দেখেছিলাম একটু করে, কিন্তু কোন কথা হয়নি। শ্যামলদাও যে সেই গেছেন, আর দেখা নেই। রাতে আসবেন কি না জানি না। খাটের যে সাইজ, তাতে এই গরমে ডাবলিং কীভাবে করবো জানি না।

 

হঠাৎ ঠাস্‌ ঠাস্‌ করে গুলির শব্দ শোনা গেল। পাশের রুমের “পুতুলের মতো সাজিয়ে” বন্ধ হয়ে গেল। নিচের তলা থেকে চিৎকার শোনা গেল, “আমানতে, আমানতে লাগছে। শিবিরের সাথে।“

কয়েক সেকেন্ড পরেই পূর্ব দিক থেকে শুরু হয়ে গেল প্রচন্ড গোলাগুলি। সম্ভবত আলাওল হল থেকে। হঠাৎ সব আলো নিভে গেল। লোডশেডিং, কিংবা কেউ মেইন সুইচ অফ করে দিয়েছে। নাকি গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলে যুদ্ধাবস্থার মতো ব্ল্যাক-আউট হয়ে যেতে হয়? ভয়ে আতঙ্কে বুঝতে পারছি না কী করা উচিত। বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়া যায়। কিন্তু দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেলে অন্যরা কীভাবে ঢুকবে? দরজার হুক না লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম।

 

ছোট্ট খাটের উপর কোন তোষক নেই। একটা পাতলা চাদর বিছানো ছিল। আমি তার উপরে আমার নিজের বিছানার একটা চাদর বিছিয়ে নিয়েছি। নিজের বালিশ এনেছিলাম। মশারিটা যে ময়লা হয়েছে তা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে। নিজের মশারি বের করে টাঙানো সম্ভব নয় এই অন্ধকারে। বাইরে গোলাগুলি চলছে। এটা কি শুধুই গোলাগুলি, নাকি সরাসরি আক্রমণ? আমার বাবা এই কারণেই আমাকে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে দিতে চাননি। বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলে এসেছি। প্রথম রাতেই গোলাগুলি! এখন অবশ্য গুলির শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। রুমে লাইটের সুইচ অফ করে দিয়েছি। ফ্যানের সুইচ অন আছে। কারেন্ট এখনো আসেনি। মশারির ভেতর দমবন্ধ হয়ে আসা গরম। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তির কারণে ঘুম চলে এলো।

 

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। ঘুম ভেঙে গেল বারান্দায় উচ্চস্বরে কথাবার্তা শুনে। সুসান ভাইয়ের ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা শোনা যাচ্ছে – “আমি এখনি উঠাই দিচ্ছি। বেয়াদবির শিক্ষা প্রথমরাতেই দিতে হবে। নইলে শেষে সামলানো যাবে না।“

“ঠিক আছে, তুমি তারে নিয়ম-কানুন সব বুঝাই দাও। আমি একটু হামিদ ভাইয়ের ওখান থেকে ঘুরে আসি। দেখলা তো শিবিরের পোলাপাইন কী শুরু করছে।“ – এটা মনে হচ্ছে মাঝারি নেতার গলা।

 

কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা খুলে গেল, লাইট জ্বলে উঠলো। সুসান ভাই আমার খাটের কাছে এসে এক টানে মশারির এক কোণা উঠিয়ে ফেললেন – “অ্যাই উঠ। কথা আছে তোমার সাথে।“ 

একটু আগের গোলাগুলির শব্দে যতটা ভয় পেয়েছিলাম, এখন ভয় লাগছে তার চেয়ে বেশি। কোন রকমে বিছানায় উঠে বসলাম।

“শোন, শ্যামল মনে হয় এখানকার নিয়ম-কানুন কিছুই তোমাকে বলেনি। শ্যামল তোমার কেমন আত্মীয়?”

“আমার মায়ের খালাতো বোনের ফুফাতো বোনের ছেলে। সেই হিসেবে আমার খালাতো ভাই।“

“ওহ্‌, আমার নিজের আত্মীয়কে সিট না দিয়ে আমি শ্যামলকে সিট দিয়েছি এখানে। কথাটা মনে রাখবা। আর এখানে সিনিয়রদের সালাম দিতে হয়। আমাকে তুমি সালাম দাও নাই, তাতে আমি তেমন কিছু মনে করি নাই। কিন্তু সবাই তো আমার মতো না। এই যে তুমি টিপু ভাইরে সালাম দাও নাই, টিপু ভাই অনেক মাইন্ড করছে।“

“টিপু ভাই কে?”

“এই টাই তো সমইস্যা তোমার। এখানে আসছ, কে কী তা জেনে নিবা না? টিপু ভাই এই হলের ছাত্রসমাজের ডেপুটি এসিস্টেন সেকেটারি। এই রুমে থাকে। তুমি দুপুরে তাকে দেখছ, সালাম দাও নাই। সন্ধ্যাবেলা হলের সামনে রাস্তায় তার সামনে দিয়া হেঁটে গেচ, সালাম দাও নাই। খুব মাইন্ড করছে টিপু ভাই। আমারে তো বলছিল তোমারে বাইর করে দিতে। এই রাতের বেলা তোমারে বাইর করি দিলে তুমি কোথায় যাবা? আমি অনেক বলে কয়ে টিপুভাইরে বুঝাইছি। একটু পরে টিপুভাই আসবে। তুমি সালাম দিবা, আর মাফ চাইবা। বলবা, টিপু ভাই, এবারের মত মাফ করি দেন। তোমার ভালা চাই বলি এসব বলতেছি। আর কেউ হইলে এতক্ষণে বাইর করি দিতাম। কথা শুনবা, পারমিশান নিয়া কাজ করবা, কোন সমস্যা হলে আমরা দেখব।“

সুসান ভাইয়ের কথা শুনে তাকে ফেরেশতা বলে মনে হওয়া উচিত। কিন্তু আমার সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। শুরুতে যে ভয়টা ছিল সেটাও আর নেই। মনে হচ্ছে এরা বাগাড়ম্বর করে চলে এখানে। বললাম, “সরি সুসান ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনাদের পাওয়ার বুঝতে পারি নাই। আপনারে সালাম দিই নাই। এখন দিতেছি, সালাম ভাই। আমি একটু বাথরুমে যাবার পারমিশান চাই। যেতে পারি?”

“বাথরুমে যাবা? যাও।“

“জি ভাই। সালাম ভাই।“

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>>>>>>>

<<<<<<<<<<<< আগের পর্ব

Sunday 7 February 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬

 


০৬

“লেডিস ফাঁস মামা”

নিচু হয়ে মাটিতে রাখা টিনের বাক্সটা রিকশায় তুলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু রিকশাওয়ালার কথায় থমকে দাঁড়িয়ে তাকালাম তাঁর দিকে। তাঁর এক পা প্যাডেলে, অন্য পা সামনের চাকায় লাগানো। সম্ভবত রিকশার ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না, তাই দ্রুত থামাতে গিয়ে স্যান্ডেল পরা পা লাগিয়ে দিয়েছেন সামনের চাকায়। চাকার সাথে স্যান্ডেলের রাবারের ফ্রিকশান বা ঘর্ষণের ফলে বিপরীত ত্বরণ বা মন্দন সৃষ্টি হয়েছে, এবং রিকশা থেমে গেছে ট্রেন স্টেশনের সামনে রাস্তায়। নিউটনের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সূত্রের সরাসরি প্রয়োগ। কিন্তু রিকশাওয়ালা কি এই ফিজিক্স বোঝেন? তিনি লেডিজ প্রসঙ্গে কী বললেন ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলাম, “কী বললেন?”

“লেডিস ফাঁস মামা।“  - মাঝবয়সী রিকশাওয়ালার কন্ঠে দার্শনিকের উদাসীনতা আর বিরক্তি একসাথে মিশে আছে। তিনি বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছেন প্লাটফরমের দিকে। তার মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, কপালের এক পাশে বসন্তের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

রাস্তায় যেখানে দাঁড়িয়ে আছি – সেখান থেকে প্লাটফরমের দূরত্ব কমপক্ষে তিরিশ মিটার। রাস্তা থেকে অনেক নিচে প্লাটফরম। রাস্তা থেকে পাকা বাঁধানো প্রশস্ত সিঁড়ি নেমে গেছে প্লাটফরমে। সিঁড়ি দিয়ে খুব আস্তে আস্তে কথা বলতে বলতে উঠে আসছেন দু’জন ছাত্রী। রিকশাওয়ালার দৃষ্টি সেদিকে। এতক্ষণে “লেডিস ফাঁস”-এর অর্থ পরিষ্কার হলো। লেডিজ ফার্স্ট – অর্থাৎ তিনি আমাকে রিকশায় তুলবেন না। যে দু’জন উঠে আসছেন সিঁড়ি বেয়ে, তাঁদের আসতে আরো মিনিট দশেক লাগলেও তিনি তাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। কারণ তিনি “লেডিজ ফার্স্ট” নামক ভদ্রতায় বিশ্বাসী। ক্যাম্পাসের রিকশাওয়ালাদের মধ্যে এই ব্যাপারটা মাঝে মাঝেই দেখা যায়, বিশেষ করে যখন রিকশার সংখ্যা খুব কম থাকে। অনেকগুলি রিকশা যখন থাকে, তখন রিকশাওয়ালারা নিজেদের মধ্যে সিরিয়াল মেনে চলেন। কার পর কে যাবে্ন – তা তারা নিজেরাই ঠিক করে নেন। কিন্তু যখন একটা বা দুটো রিকশা থাকে – তখন তারা ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের প্রাধান্য দেন। এর পেছনে হয়তো একটা যুক্তি আছে।  ছাত্ররা দরকার হলে অনেকদূর হাঁটতে পারে, ছাত্রীরা তো পারে না। এই যুক্তি ছাত্রীদের জন্য কিছুটা অপমানজনক হলেও রিকশাওয়ালাদের দেয়া প্রাধান্য অস্বীকার করতে  তাদের দেখা যায় না খুব একটা। রিকশাওয়ালার সাথে এখনই একটা ঝগড়া লাগিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু রুচিতে বাধলো।

সিঁড়ি ধরে অগ্রসরমান ছাত্রীদ্বয় রিকশার কাছাকাছি এসে গেছেন। সেদিকে তাকিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য রিকশাওয়ালা বেল বাজালেন। পরবর্তী ষাট-সত্তর সেকেন্ডের মধ্যেই তাদেরকে নিয়ে রিকশা চলে গেলো। যতদূর চোখ যায়, কোথাও কোন রিকশার দেখা নেই। প্রায় এগারোটা বাজে। সেকেন্ড ট্রেনে আসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে সবগুলি বাস চলে গেছে ক্যাম্পাসে। সেগুলি একটা একটা করে ফিরে আসবে। আমার সাথে ভারী বাক্স না থাকলে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে হতো না।

 

কোরবান উপলক্ষে সতেরো দিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ ছিল। রাস্তার দুপাশে নিমের মতো নাম-না-জানা গাছগুলির ডালপালা এই ক’দিনের ছুটিতে মনে হচ্ছে আরো পুষ্ট হয়েছে, পাতাগুলির সবুজ হয়েছে আরো গাঢ়। রাস্তার অন্যপাশে সবুজ ঘাস, গর্তে জমা বৃষ্টির পানির ওপারে সারি সারি দোকানের বেশিরভাগই বন্ধ। বাম কোণার রেস্টুরেন্ট ‘মামুর দোকান’-এ তেমন কোন ভীড় নেই এখনো। এই সময়ে এদিকের অবস্থা কী রকম থাকে তা আগে কখনো দেখা হয়নি। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীরা ফার্স্ট ট্রেনে আসে, লাস্ট ট্রেনে যায়। মাঝখানের সময়টাতে ক্লাসরুমের বাইরে কী কী হয় তা দেখার সুযোগ তাদের খুব একটা থাকে না।

 

রাস্তার পাশে গাছের নিচে বালির উপর রাখা বাক্সটার দিকে তাকালাম। টিনের বাক্সের গায়ে সাধারণত বিভিন্ন রঙের নকশা, ফুল ইত্যাদি অনেক কিছু আঁকা থাকে। এইটাতে সেরকম কিছু নেই। টিনের উপর কোন রঙই লাগানো হয়নি। ছোটবেলায় এরকম বাক্স দেখতাম যাত্রাদলের লোকজনের সাথে। সেসব বাক্সে বড় বড় অক্ষরে যাত্রাদলের নাম লেখা থাকতো। এই বাক্সের কোনদিকে কোন কিছু লেখা নেই। ৩০ ইঞ্চি বাই ১৮ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি মাপের টিনের এই বাক্সটি আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি আমার বড়ভাইয়ের কাছ থেকে। এই বাক্স সে কিনেছিল ১৯৮০ সালে পটিয়া কলেজে হোস্টেলে থাকার সময়। তারপর  আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে এসে উঠলাম – তখন থেকে এটা আমার হোস্টেলের সাথী। আজ এটা আমার সাথে এসেছে ইউনিভার্সিটির হলে উঠার জন্য। কিন্তু সকাল আটটায় শহর থেকে রওনা দিয়ে তিন ঘন্টা পার হয়ে গেলেও এখনো হলে পৌঁছাতে পারলাম না।

 

আজ সকাল থেকে কোন কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না। ফার্স্ট ট্রেনের ভীড় এড়ানোর জন্য সেকেন্ড ট্রেনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেল থেকে সকাল আটটায় রওনা দিয়ে বটতলি স্টেশন থেকে ৮টা ৪৫-এর ট্রেন ধরা কোন কঠিন কাজ নয়। রেডবিল্ডিং-এর তিন তলা থেকে বাক্সটা নিয়ে নড়বড়ে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে যখন নিচে নামছিলাম, কেমন যেন একটা মায়া-ছেঁড়া অনুভূতি হচ্ছিল। এই হোস্টেলের সাথে আমার প্রায় সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক।

 

কলেজ রোডে চট্টগ্রাম কলেজের মেইন গেটের ডান পাশে যে উঁচু পুরনো ব্রিটিশ আমলের তিনতলা লাল দালানটি আছে, যেটাকে সবাই রেড বিল্ডিং বলে – সেটার তৃতীয় তলায় বর্তমানে অমুসলিম ছাত্রদের হোস্টেল। চট্টগ্রাম কলেজের প্যারেড মাঠের দক্ষিণ দিকে পরপর তিনটি হোস্টেল। পশ্চিম দিকে কলেজ রোডের পাশে শেরে বাংলা হোস্টেল। তার পূর্ব পাশে সোহরাওয়ার্দী হোস্টেল, এবং সোহরাওয়ার্দীর পূর্বপাশে সিরাজদৌল্লা রোডের সাথে লাগানো ছোট্ট জরাজীর্ণ একটি দোতলা পুরনো বাড়িতে শেরেবাংলা বি-ব্লক। এই বি-ব্লকটাই ছিলো অমুসলিম ছাত্রদের জন্য। চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য ভর্তি হয়ে সেই হোস্টেলে উঠেছিলাম। আমার উচ্চমাধ্যমিকের সময়েই আমার বড়ভাই অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। ফার্স্ট ইয়ারের পর সে অনার্স পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেও হোস্টেলের সিটটি এখনো আছে। আমি পাস করার পর তার সিটেই ছিলাম এতদিন। গতবছর ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ধ্বসে পড়ে ছাত্র, কর্মী, এবং অতিথিসহ মোট ৩৯ জন মানুষ প্রাণ হারান। তারপর এরশাদ সরকার সারা দেশের পুরনো ভবনগুলিতে জরিপ চালিয়ে অনেক ভবনকে বাস-অযোগ্য ঘোষণা করে। শেরে বাংলা বি-ব্লকের ভবনটিও বসবাসের জন্য অযোগ্য ঘোষিত হয়। সেই হোস্টেলের সব ছাত্রকে কয়েক ঘন্টার নোটিসে নিয়ে আসা হয় রেড বিল্ডিং-এর তৃতীয় তলায়। অথচ এই বিল্ডিং-টি পরিত্যক্ত ভবনের চেয়েও নড়বড়ে। কিন্তু এটাকে কীভাবে যেন জরিপের বাইরে রাখা হয়েছিল। এখানে এনে এক এক রুমে ছয়-সাতজন করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কোন বাথরুম নেই, কোন ডায়নিং নেই, কিচেন নেই, কোন তত্ত্বাবধায়কও নেই – সুতরাং ‘নেই নেই’ শোনার জন্যও কেউ নেই। উদ্বাস্তুরা যেভাবে নিরুপায় হয়ে সব কিছুর সাথে খাপ-খাইয়ে নেয়, এই হোস্টেলের ছাত্রদেরও একই অবস্থা হলো। বিল্ডিং-এর নিচের তলার এক কোণায় ছোট্ট একটি টয়লেট। এটাই ব্যবহার করে হোস্টেলের তিরিশ জন ছাত্র। বিল্ডিং-এর বাইরে রাস্তার উপর একটা পানির ট্যাপ আছে – যেখানে ওয়াসার পানি আসে। সেখানেই তিরিশ জনের গোসল। রেড বিল্ডিং-এর দোতলায় কলেজের ভূগোল বিভাগ, নিচের তলায় বিএনসিসি অফিস। প্রায়ই দেখা যায় – নিচের তলায় যখন বিএনসিসির ক্যাডেটদের অনুশীলন চলছে তখন হয়তো কেউ লুঙ্গি পরে বদনা হাতে টয়লেট থেকে বের হচ্ছে, কিংবা খোলা জায়গায় ট্যাপের নিচে বালতি বসিয়ে গোসল করছে। দোতলায় ক্লাস করার জন্য ছাত্রীরা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, সেই সময় কেউ তিন তলা থেকে বালতি হাতে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে নিচে নামছে গোসল করার জন্য। ছাত্রদের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে আবেদন করা হয়েছে তাদের জন্য যথোপযুক্ত হোস্টেলের ব্যবস্থা করার জন্য, অথবা অন্য দু’টি হোস্টেলে অমুসলিম ছাত্রদের জন্যও সিট বরাদ্দ দিতে। কিন্তু এসব অভিযোগ শোনার সময় বা ইচ্ছা কর্তৃপক্ষের নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অন্তত সেরকম ধর্মীয় বিভাজন নেই। শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগন্নাথ হল - অমুসলিমদের জন্য আলাদা হল। সে কারণে অন্য হলগুলিতে অমুসলিম ছাত্রদের সিট বরাদ্দ দেয়া হয় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরকম কোন নিয়ম নেই সত্য, কিন্তু অলিখিত রাজনৈতিক নিয়ম যেগুলি আছে সেগুলি তো আরো ভয়ংকর।

 

বটতলি স্টেশনে ২নং প্লাটফরম থেকে ছাড়ে ইউনিভার্সিটির ট্রেন। বাক্সের ভেতর বইপত্র তেমন নিইনি ভারী হয়ে যাবার আশংকায়। বইপত্রগুলি পরে আস্তে আস্তে নিয়ে যেতে পারবো। জামাকাপড়সহ অন্যান্য টুকটাক জিনিসপত্রে বাক্স বোঝাই। কিন্তু খুব বেশি ভারী না হলেও টিনের সরু হাতল ধরে এই বাক্স আলগে নিয়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে ঘেমে গেলাম। জায়গা পেতে সমস্যা হলো না। কিন্তু ছাড়ার মুহূর্তে সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। হঠাৎ শোনা গেল প্লাটফরমে প্রচন্ড হৈচৈ। বগি থেকে অনেকেই ছুটে নেমে গেল। অনেকে প্লাটফরমে নেমে খন্ড খন্ড ধারাবিবরণী দিতে শুরু করলো – কোন একজন রেলওয়ে অফিসারের সাথে ছাত্রদের ঝগড়া লেগে গেছে। ছাত্রদের সাথে ঝগড়া লাগা মানেই ভাঙচুরের সম্ভাবনা প্রবল। কোন যুক্তি ছাড়াই হয়তো দেখা যাবে ট্রেনের জানালার কাচ ভাঙা শুরু হবে, স্টেশন মাস্টারের অফিস তছনছ করা হবে। এসব হবার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে ট্রেন ছাড়লো দেড় ঘন্টা দেরিতে – সোয়া দশটায়। দেরিতে ছাড়ার কারণেই হয়তো – অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা বেশি গতিতে ট্রেন চলেছে আজ। চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে গিয়েছি ইউনিভার্সিটিতে।

 

সেকেন্ড ট্রেন আসার পর সেটা দেড়টা পর্যন্ত স্টেশনেই থাকে। দেড়টায় ফিরে যায় শহরে। এখন ট্রেনটির ইঞ্জিন ঘুরে গিয়ে অন্যদিকে গিয়ে লেগেছে। এখন দেড়টায় যাবার জন্য রেডি। প্লাটফরমে এখন কোন যাত্রী নেই। কিন্তু সেকেন্ড ট্রেন থেকে নামার সময় অনেকেই সিটের উপর ইটের টুকরো দিয়ে জায়গা রেখে গেছে। দেড়টার ট্রেনে ফিরে যাবার সময় বসে যাবে। দেরি না করলে সেকেন্ড ট্রেন আসে সাড়ে ন’টায়। সাড়ে ন’টায় এসে দেড়টায় ফিরে যেতে পারে অনেকেই। এত কম সময়ে তাদের ক্লাস করা হয়ে যায় – ভাবতেও কেমন যেন লাগে। আমাদের ক্লাস শুরু হয় ন’টা পয়ত্রিশে, আর শেষ হয় পাঁচটায়। বিজ্ঞান পড়ার মজা।

 

এতক্ষণে একটা রিকশা ফিরে এলো ক্যাম্পাস থেকে। দেড়টার ট্রেনে যাবার জন্য সোয়া এগারোটায় এসে গেছে একটা যুগল। রিকশা থামতেই আমি হাত দেখালাম। আশেপাশে রিকশায় যাবার মতো আর কেউ নেই। এবার আশা করি আমি যেতে পারবো। বাক্সের এক কোণা রিকশায় তুলে ঠেলে দিচ্ছি, এমন সময় রাস্তার অন্যদিক থেকে “হই, ইক্যা আয়” বলে কর্কশ স্বরে চিৎকার করলো কেউ।

“আইয়ির বদ্দা” – বলে তরুণ রিকশাওয়ালা সেদিকে চলে যেতে চাইলেন। আমি যতটা পারি গরম চোখে তাকিয়ে দাপট দেখানোর চেষ্টা করলাম, “আমাকে না নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”

“বদ্দায় ডাকের দে।“ রিকশা ঘুরানোর সময় আমার দিকে তাকিয়ে অনেকটা সাবধান করার ভঙ্গিতে বললো,  “জাতীয় পার্টির ক্যাডার। মারি ফেলাইব।“

 

আমার চোখের সামনে দিয়ে রিকশায় পায়ের উপর পা তুলে সিগারেট টানতে টানতে চলে গেলেন জাতীয় পার্টির ক্যাডার। তার পাশে তার বডিগার্ড। বডিগার্ডের চোখে কালো চশমা, হাতে কালো চকচকে ধাতব এক বস্তু – যেই অস্ত্রের নাম আমি জানি না।

 

রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকার আর কোন মানে হয় না। রেল স্টেশন থেকে সোহরাওয়ার্দী হল এমন কিছু দূরে নয়। বাক্সটাতে চাকা লাগানো থাকলে এত সমস্যা হতো না। বাক্সে চাকা লাগানোর আইডিয়া কি কারো মাথায় এখনো আসেনি? এখনো সেরকম কিছু তো চোখে পড়েনি। এ ধরনের বাক্স বহন করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো মাথায় তুলে নেয়া। তাতে আরো একটা সুবিধা হলো। প্রচন্ড রোদে ছায়াও পাওয়া যাচ্ছে।

 

হন হন করে হেঁটে চলে যাচ্ছি শাহজালাল হলের সামনে দিয়ে। হঠাৎ রাস্তার পাশের দোকান থেকে কেউ একজন বের হয়ে আমার পাশাপাশি কয়েক পা হাঁটলো। সাদা প্যান্ট আর নীল টি-শার্ট দেখা যাচ্ছে। হাতে ধরা গিটারের কিছু অংশ দেখতে পাচ্ছি। কোন রকমে চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম তাকে।

“শাহীন, তুই কই যাস?”

“তোর নিজের বাক্স, নাকি অন্যের বাক্স টানা শুরু করেছিস? গাধা। নামা বাক্স নামা মাথা থেকে।“

শাহীন ফিজিক্সে আমার ক্লাসমেট। ক্লাস খুব একটা করে না। কারণ সে জিডি পাইলট হবার জন্য পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার মাথা থেকে জোর করে বাক্স নামিয়ে বাক্সের একদিকে ধরলো। দু’জনে ধরাধরি করে সোহরাওয়ার্দীতে ঢুকলাম।

“কয় নাম্বারে উঠবি?”

“২৫২”

“ওটা তো জাতীয় পার্টির রুম।“

“অ্যাঁ?” – আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটু আগে রিকশায় দেখা ক্যাডারের মুখ – যার চোখে চশমা, হাতে নাম-না-জানা ভয়ংকর অস্ত্র।

Wednesday 3 February 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৫

 



০৫

“সেক্সপিয়ার বলেছেন – হোয়াট ইজ ইওর নেইম? অর্থাৎ নামে কী আসে যায়?”

 

এক নম্বর গ্যালারির ঠিক মাঝখানের বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বেশ উচ্চস্বরে বিদ্যা জাহির করছে ছেলেটা। এতক্ষণ একটা কাগজ দেখে দেখে পড়ছিল “তুমি বোললে প্রেম হবে, প্রেমের ভুবন যদি আসে, বুকের কুসুম থেকে দেবে শব্দাবলী, কবিতার বিমূর্ত চন্দন…” উচ্চারণের যা অবস্থা – তাতে কবিতার যে বারোটা বেজে যাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। এখন আবার শেকসপিয়ারকে ধরে টানাটানি শুরু করেছে। তার আশেপাশে যারা আছে, বোঝা যাচ্ছে সবাই তাকে চেনে। তারা তার দিকে খুব একটা মনোযোগ না দিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। কিন্তু তার দৃষ্টি গ্যালারির সামনের দিকের ডান কোণায়, যেখানে দশ বারোজন মেয়ে জটলা করে গল্প করছে। গ্যালারির পেছনের দিকের বেঞ্চে বসে আমরাও যে সেদিকে তাকাচ্ছি না, তা নয়। তবে তার মতো এতটা গলা উঁচিয়ে আত্মপ্রচার করার মতো দুরাবস্থা আমাদের এখনো হয়নি। তার মুখে ‘সেক্সপিয়ার’ শুনে সামনের কয়েকজন ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। তাতে সে দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করলো, ‘অ্যা রোছ  ইছ অ্যা রোছ ইছ অ্যা রোছ…”, সামনের দিকের ডান কোণায় হাসির হুল্লোড় উঠলো।

 

ছেলেটার নির্লজ্জতার তারিফ করতেই হয়। অবশ্য আমি যেটাকে নির্লজ্জতা বলছি – সেটাকেই হয়তো সে ভাবছে সাহস। ‘শেক্‌সপিয়ার’কে অনেকেই ‘সেক্সপিয়ার’ উচ্চারণ করে। অনেকে ধরতেই পারে না এই দুটো উচ্চারণের মধ্যে কী তফাৎ। শেক্‌সপিয়ারের ‘হোয়াট্‌স ইন আ নেম’ যখন ‘হোয়াট ইজ ইওর নেম’ হয়ে যায় – কেমন যেন ধাক্কা লাগে। এমন জোরে এমন নির্দ্বিধায় এমন ভুল বকতে পারা তো রাজনৈতিক নেতার গুণাবলি। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো দেখা যাবে এই ছেলে ক্যাম্পাসে মিছিলের নেতৃত্ব দেবে। ভবিষ্যৎ-নেতার নাম-পরিচয় জেনে নিতে হবে। যতই বলা হোক না কেন – নামে কী এসে যায় - ঠিকমতো নাম নিতে জানলে অনেক কিছুই আসে, আবার ভুল নাম জপ করলে অনেক কিছুই চলে যায়।

 

ম্যাথস সাবসিডিয়ারি ক্লাস করতে এসেছি এই গ্যালারিতে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, আর স্ট্যাটিসটিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবারই ম্যাথস সাবসিডিয়ারি আছে। বিশাল গ্যালারি - প্রায় তিন শ স্টুডেন্ট একসাথে বসতে পারে এই গ্যালারিতে। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির নিচের তলার মাঝামাঝি জায়গায় এই গ্যালারি। খাড়া উঁচু সিঁড়ি পার হয়ে মেইন কলাপসিবল গেট দিয়ে ঢুকে ডানে ঘুরলেই ডিন অফিস। করিডোর ধরে এগোবার সময়  ডানদিকে তাকালে খাড়া পাহাড়ের নিচের অংশ দেখা যায়। লম্বা প্রশস্ত করিডোরে আগস্টের ভ্যাপসা গরমেও এক ধরনের শান্ত ঠান্ডা ভাব। কিছুদূর আসার পর বামদিকে প্রশস্ত র‍্যাম্প উঠে গেছে দোতলায়। ইচ্ছে করলে যে কেউ সাইকেল বা মটরসাইকেল চালিয়ে দোতলায় উঠে যেতে পারবে এই পথে। র‍্যাম্পের নিচে ফটোস্ট্যাট মেশিনের দোকান।

 

র‍্যাম্পের সামনে করিডোরের ডানদিকে পাশাপাশি দুটো গ্যালারি। সামনে দু’পাশে দুটি দরজা, পেছনে অনেকগুলি সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠে আরো দুটি দরজা। আমরা কয়েকজন বসেছি পেছনের দিকের সারিতে পেছনের দরজার কাছাকাছি। মূল উদ্দেশ্য বোরিং লাগলে ক্লাস থেকে চুপচাপ বের হয়ে যাওয়া। সাবসিডিয়ারি ক্লাসের পুরোটা করার দরকার আছে কি নেই তা বোঝা যাবে ক্লাসে রোল কল করা হয় কি না, এবং হলে তা ক্লাসের শুরুতে, নাকি শেষে করা হয় তার ওপর।

গ্যালারি ভরে গেছে ইতোমধ্যে। সাবসিডিয়ারি ক্লাসে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছেলে-মেয়েরা একসাথে ক্লাস করলেও প্রত্যেকেই ছোট ছোট কিছু অদৃশ্য গ্রুপ বা সাব-গ্রুপে ঢুকে গেছে। প্রত্যেকেই আমরা পরস্পরের সমান সহপাঠী, বন্ধু, আবার এর মধ্যেই কেউ কেউ একটু বেশি বন্ধু। কীভাবে এই গ্রুপিং, সাব-গ্রুপিং হয় তার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। কীভাবে যেন পারস্পরিক একটা বোঝাপড়া হয়ে যায়। বড় ক্লাসে কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব বেশিরভাগ সময়েই এই গ্রুপভিত্তিক হয়ে থাকে। আজও হচ্ছে। ক্লাসের মাঝখানে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে যে শেক্‌সপিয়ার আওড়াচ্ছে তার দিকে শুরুতে কিছুক্ষণ মনযোগ থাকলেও, এখন আর নেই। কিন্তু সে এখনো বকবক করেই চলেছে, কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ টেবিলের উপর ডাস্টার ঠোকার প্রচন্ড শব্দ হলো। বেঞ্চের উপর থেকে দ্রুত নেমে গেলো আমাদের ‘সেক্সপিয়ার’।

 

“সাইলেন্স, সাইলেন্স। প্লিজ কিপ কোয়ায়েট।“

“আমার নাম গণেশ চন্দ্র রায়”

স্যারের নাম শুনে মনে হলো আসলেই নামে কিছু যায় আসে না। গণেশ বললে যে ধরনের হাতির মাথাযুক্ত পেটমোটা অবয়বের কথা মনে হয়, গণেশস্যারের সাথে তার কোন মিল নেই। এমন ধবধবে উত্তমকুমারের মত সুবেশ সুপুরুষের নাম যে গণেশ হতে পারে তা ভাবাই যায় না।

“আমি আপনাদেরকে ডিফারেন্সিয়েল ক্যালকুলাস পড়াব।“

গণেশস্যার আমাদের আপনি করে বলছেন! আশ্চর্য লাগছে, তবে খুব একটা ভালো লাগছে না। শিক্ষকরা তুমি করে বললে যেরকম একটা স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়, আপনিতে সেই অনুভূতিটা আসে না। স্যার রোল কল করলেন না। তার মানে ক্লাস করা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু এত পেছনদিকে বসা উচিত হয়নি আমার। ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছি না। স্যারের পড়ানোর স্টাইল গতানুগতিক। বই থেকে একটার পর একটা অংক বোর্ডে করাচ্ছেন। মাছিমারা কেরানির মতো তা বোর্ড থেকে যে খাতায় তুলবো তার উপায় নেই। আমি বোর্ডের লেখা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছি না। নিজে নিজে করারও কোন উপায় নেই। উচ্চমাধ্যমিকে অঙ্কে যে ফাঁকি দিয়েছি, তার ফলে অংকের ভিত শক্ত হয়নি। এখানে অনেক সহজ ব্যাপারও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। গণিত নাকি ফিজিক্সের ভাষা। এই ভাষাটাই যদি ঠিকমতো শিখতে না পারি, ফিজিক্স শিখবো কীভাবে! প্রামাণিক স্যারের ক্লাস যে কিছুই বুঝতে পারি না, তার প্রধান কারণ উচ্চতর গণিতের উপর দক্ষতা না থাকা। ক্লাস পালানোর সুযোগটাকে মনে হচ্ছে খুব একটা কাজে লাগানো যাবে না। যীশুর খাতার দিকে তাকালাম। সে খসখস করে লাইনের পর লাইন লিখে ফেলছে। মনে হচ্ছে গণিতের মূল সুর সে ধরে ফেলেছে। আমার অবস্থা এখন অনেকটা ক্রিকেট খেলার সেই দর্শকের মতো যে খেলার নিয়মকানুন কিছুই জানে না। গ্যালারির সবাই উঠে যাচ্ছে দেখে বুঝতে পারলাম খেলা শেষ – মানে ক্লাস শেষ।

 

“হেই প্রদীপ, হলে ফরম দিতেছে। গিয়া নিয়ে আসিস।“ – গ্যালারি থেকে বের হবার সময় শাকিল বললো। শাকিল, প্রেমাঙ্কর, আনন্দ, জামাল, কবীর – সবাই সোহরাওয়ার্দী হলে থাকে। ফার্স্ট ইয়ারে এখনো সিট দেয়নি কাউকে, কিন্তু এরা সবাই কারো না কারো সাথে ডাবলিং করে থাকছে। আমারও হলে ওঠা দরকার, কিন্তু পরিচিত কেউ নেই যার রুমে গিয়ে উঠা যায়। তাই সিটের জন্য নিয়ম মাফিক দরখাস্ত করতে হবে। বিকেলে প্র্যাকটিক্যাল আছে। তাই এখনই হলে গিয়ে ফরমটা নিয়ে আসা দরকার। জমা দেয়ার সময় আবার অনেক কাগজপত্রও দিতে হবে দরখাস্তের সাথে।

 

সোহরাওয়ার্দী হলের সেকশান অফিসারের রুম থেকে সিটের দরখাস্তের ফরম নিয়ে বের হবার সময় দেখলাম আজকের ক্লাসের সেই ‘সেক্সপিয়ার’ অফিসে ঢুকছে। তার অঙ্গভঙ্গি আর গলার জোর দেখে নিশ্চিত বলা যায় – সে এই হলের ছোটখাট কোন নেতা। আমার অনুমানের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি প্রমাণ পাওয়া যাবে চিন্তাও করিনি। প্রেমাঙ্কর তাকে নাম ধরে ডাকলো। তার আসল নাম উহ্য থাক। ধরা যাক তার নাম ওয়াসিম। ওয়াসিম জাতীয় ছাত্রসমাজের একজন পাতিনেতা। এরশাদের মতোই ডান্ডা হাতে কবিতার সেবা করে।

 

*****

‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ কথাটা যতটা সত্য, ‘যত বর্ষে তত গর্জে না’ কথাটাও ততটা সত্য। দুপুরের পর থেকে কোন ধরনের মেঘগর্জন ছাড়াই এত বেশি বর্ষণ শুরু হয়েছে যে তা এখনো থামেনি। সোহরাওয়ার্দীর মোড় থেকে বাসে উঠতে গিয়ে ভিজে গিয়েছি। ক্যাফেটরিয়ার সামনে বাস থেকে নেমে ফ্যাকাল্টি পর্যন্ত আসতে আসতে আবার ভিজেছি। এখন ভেজা শার্ট-প্যান্টে কেমন যেন শীত শীত লাগছে।

 

তিন তলায় প্র্যাকটিক্যাল রুমের সামনে সবাই এসে জড়ো হচ্ছে একে একে। রুম এখনো খোলেনি। সেদিন আদম শফিউল্লাহ স্যারের ধমক খাবার পর প্র্যাকটিক্যাল রুমের আশেপাশেও আমরা আর জোরে শব্দ করি না। কিন্তু স্যারের ধমকের ব্যাপারেও ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ কথাটা খাটে। সেদিন ধমক খাবার ঘন্টাখানেক পরেই প্রদীপ চুপি চুপি বলেছিল, স্যার কিন্তু ভালোমানুষ।

“কীভাবে বুঝলি?”

“ঐ দ্যাখ, বারান্দায়।“

জানালা দিয়ে দেখেছিলাম আদম শফিউল্লাহ স্যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। যারা সিগারেট টানে, তারা নাকি রাগী হলেও মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ হয় না। এটা প্রদীপের থিওরি। এই থিওরির অকুন্ঠ সমর্থক হাফিজ। এর কারণ সহজেই অনুমেয়। আজও দেখছি বারান্দার রেলিং-এ এক পা তুলে দিয়ে হাঁটুতে কনুই রেখে নায়কোচিত ভঙ্গিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে হাফিজ আর প্রদীপ। একটু পরেই তাদের সাথে যোগ দিলো স্বপন আর ইকবাল।

 

সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য হয় না বলে আমরা দূরে দাঁড়িয়ে আছি। অর্পণ সিগারেটের ব্যাপারে ভীষণ অসহিষ্ণু। সে প্রায়ই বাসের ভেতর ধুমপানরত যাত্রীর মুখ থেকে বিড়ি-সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দেয়। এখানে সে ততটা কট্টর হতে পারছে না বলে ছটফট করতে করতে বললো, “তোরা নিজেদের লাংসতো ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিস, আমাদেরও বারোটা বাজাচ্ছিস।“

 

প্রদীপ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো, “শেক্‌সপিয়ার সারাজীবনে যা কিছু লিখেছেন সবই লিখেছেন ইংরেজিতে।“ শেক্‌সপিয়ার আজ কিছুতেই পিছু ছাড়ছেন না। প্রদীপ বেশ সিরিয়াসলি বলছে, “কিন্তু একটিমাত্র গান লিখেছিলেন বাংলায়। কোন্‌ গানটা জানিস?” শেক্‌সপিয়ার বাংলায় গান লিখেছিলেন! গুল মারারও একটা সীমা থাকে। কিন্তু অর্পণ সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করলো, “কোন্‌টা?”

“এক টানেতে যেমন তেমন, দু’টানেতে রোগী, তিন টানেতে রাজা-উজির, চার টানেতে সুখি। - বুঝলি?”

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>>>>>>

<<<<<<<<<<<<< আগের পর্ব

Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts