Showing posts with label কুরি পরিবার. Show all posts
Showing posts with label কুরি পরিবার. Show all posts

Thursday, 15 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ১০ম পর্ব



এদিকে সেন্ট্রাল প্যারিসে গুস্তাভ টেরির প্রতিবেদনটি চোখে পড়েছে জাঁ পেরির। তিনি দ্রুত ছুটে গেলেন এমিল ও মার্গারিট বোরেলের কাছে। তারপর সবাই মিলে ছুটলেন মেরির বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাঁরা যখন স্‌সোতে গিয়ে পৌঁছালেন - দেখলেন শত শত ‘প্যারিস-বীর’ ‘প্যারিসের সম্মান রক্ষার্থে’ মেরি কুরিকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে মেরির বাড়ির জানালার কাচ ভাঙছে। 

মার্গারিট দ্রুত বাড়ির ভেতরে গিয়ে ভয়ার্ত অপমানিত মেরি, ইভ ও গৃহকর্মীকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। গাড়িতে চেপে ছুটলেন আইরিনের স্কুলের দিকে। স্কুলে আইরিনের এক বান্ধবী সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় মেরি ও লাঁজেভির ছবি দেখে তাঁরা আবার নতুন কিছু আবিষ্কার করেছেন ভেবে আইরিনকে দিয়েছে পেপারটি। চতুর্দশী আইরিন প্রতিবেদনের কিছুটা অংশ পড়েই অপমানে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। মার্গারিটরা যখন আইরিনের স্কুলে পৌঁছালেন আইরিন কিছুটা সুস্থ হয়ে চুপচাপ বসে ছিল ক্লাসে। গাড়িতে উঠে আইরিন মা ও বোনকে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলো। 

এমিল ও মার্গারিট বোরেলের ইকোল নরমালে সুপেরিয়রের সরকারি কোয়ার্টারে সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন মেরি। প্রফেসর এমিল বোরেল তাঁর সরকারি বাসায় ‘বিদেশিনী’ মেরিকে আশ্রয় দিয়েছেন বলে শোরগোল তুললো ডানপন্থী সরকারের আমলারা। শিক্ষামন্ত্রী থিওডর স্টিগ তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন বোরেলকে।

“প্রফেসর বোরেল, আপনি ইকোল নরমাল সুপেরিয়রের ভাইস প্রেসিডেন্ট। আপনার এমন কিছু করা উচিত নয় যা সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে যায়। সরকারি বাসায় আপনি মাদাম কুরিকে এসময় আশ্রয় দিতে পারেন না যেখানে তাঁর নামে এরকম অভিযোগ উঠেছে।”

“মাদাম কুরি আমাদের পারিবারিক বন্ধু। তাঁর বিপদে আমরা তাঁর পাশে দাঁড়াবোই।”

“তাহলে কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধে আপনার চাকরি চলে যাবে। চাকরি চলে গেলে বাসাও আপনার থাকবে না। ঠান্ডা মাথায় আপনার স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেন কী করবেন। আপনাকে একদিন সময় দেয়া হলো।”

“আচ্ছা তাই হবে।”

এদিকে মার্গারিটকে ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁর বাবা সরবোন ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন প্রফেসর পল আপ্পেল। মার্গারিট ভাবলেন তাঁর বাবা মেরিকে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন তা আলোচনা করার জন্যই ডেকেছেন। দ্রুত গেলেন বাবার বাসায়। কিন্তু বাবার গম্ভীর থমথমে মুখ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মার্গারিট। 

“মার্গারিট, তুই মেরিকে নিজের বাসায় নিয়ে এলি কোন আক্কেলে?”
“এসব তুমি কী বলছো বাবা? সবাই মিলে মেরিকে মেরে ফেলতে বলছো? এত বড় বিজ্ঞানী, দু দুটো নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন মেরি।”
“থাম্‌ মেরির জন্য যা করা উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি করেছি আমরা। এখন তার জন্য সরবোনের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। মেরিকে আমরা আর সরবোনে রাখতে পারবো না। তুই তাকে বল রিজাইন করতে। নয়তো বরখাস্ত করতে হবে তাকে।”
“মেরির প্রতি এমন অবিচার তুমি করতে পারবে না বাবা।”
“আমি কোন অবিচার করছি না। ফ্রান্সে থেকে মেরি আর কিছুই করতে পারবে না। তাকে পোল্যান্ডে ফিরে যেতে বল। আমি সেখানে তার জন্য চাকরি আর ল্যাবের ব্যবস্থা করে দেবো।”
“মেরির সম্পর্কে এরকম মিথ্যা বানোয়াট কথাগুলো তুমি বিশ্বাস করছো বাবা? এগুলো যে সব ধর্মান্ধদের অপপ্রচার তা কি তুমি বুঝতে পারছো না?”
“বুঝতে পারলেও আমার করার কিছু নেই। আমাকেও তো আমার চাকরি বাঁচাতে হবে।”
“তাহলে আমার কথাও তুমি শুনে রাখো বাবা। মেরির বিরুদ্ধে তুমি যদি কোন ব্যবস্থা নাও - মনে করবে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ। তুমি জীবনে আর আমার মুখ দেখতে পাবে না।”
“এমন কথা বলিস না মা। আমার ক্ষমতা খুব সীমাবদ্ধ। আমার ওপর চাপ আছে।”
“চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে বাবা? তুমি আমাকে যে আদর্শের শিক্ষা দিয়েছো তা তুমি নিজেই ভাঙবে? আমি যে তা সহ্য করতে পারবো না বাবা। প্লিজ বাবা, দরকার হলে তুমি চাকরি ছেড়ে দাও। বাবা প্লিজ।”

মেয়ের কান্না কোন বাবাই সহ্য করতে পারেন না। প্রফেসর আপ্পেলও পারলেন না। তিনি মার্গারিটকে আশ্বস্ত করলেন, “ঠিক আছে। দেখি কী করতে পারি। আর যাই হোক - আমার হাত দিয়ে মেরির কোন ক্ষতি হবে না। তুই বাড়ি যা।”

প্যারিসের প্রগতিশীল সাংবাদিকেরা গুস্তাভ টেরির বিষাক্ত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় কলামে। প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে কলমযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু যুদ্ধ শুধু কলমে সীমাবদ্ধ থাকলো না। ব্রিটিশ কায়দায় তলোয়ার-যুদ্ধও হলো কারো কারো মধ্যে। 

গুস্তাভ টেরি তাঁর লেখার সমালোচনা করার কারণে ‘গিল ব্লাস’ পত্রিকার চিফ এডিটর পিয়ের মর্টিয়েরকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করলেন। স্থানীয় স্টেডিয়ামে তাঁদের তলোয়ার যুদ্ধ হলো। গুস্তাভ টেরি কয়েকবার আহত করলেন পিয়ের মর্টিয়েরকে। 

এদিকে টেরির ওপর ভীষণ রেগে আছেন পল লাঁজেভি। তিনি দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করলেন টেরিকে। নির্দিষ্ট দিনে স্টেডিয়ামে হাজির হলেন টেরি ও লাঁজেভি। তলোয়ারের বদলে পিস্তল নিয়ে যুদ্ধ করবেন বললেন লাঁজেভি। পিস্তল হাতে টেরি ও লাঁজেভি মুখোমুখি দাঁড়ালেন পরস্পর থেকে পঁচিশ ফুট দূরত্বে। লাঁজেভি পিস্তল তাঁক করলেন টেরির দিকে - কিন্তু টেরি পিস্তল উঠালেন না। টেরির সেকেন্ড ম্যান হয়ে গিয়েছিলেন লাঁজেভির শ্যালিকার স্বামী হেনরি বোর্গেস, আর লাঁজেভির সেকেন্ড ম্যান হয়ে গিয়েছিলেন গণিতবিদ পল পয়েনলেভি। [পল পয়েনলেভি কয়েক বছর পরে ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন]। টেরি বা লাঁজেভির কেউই যখন গুলি ছুঁড়লেন না, তাঁদের সেকেন্ডম্যান বোর্গেস ও পয়েনলেভি পিস্তল হাতে নিয়ে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষ করলেন। 

পরের দিন গুস্তাভ টেরি তাঁর পেপারে লিখলেন যে তিনি চাইলেই লাঁজেভিকে পিস্তলের গুলিতে শেষ করে দিতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি - কারণ তাতে ফ্রান্স লাঁজেভির মত একজন মেধাবী বিজ্ঞানীকে হারাতো। টেরি এটাও বললেন যে ফ্রান্সের সোনার ছেলেদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই তাঁর, তিনি কেবল মাদাম কুরির মত ‘স্বামী ছিনতাইকারি’র হাত থেকে প্যারিসের মেয়েদের ঘর বাঁচাতে চান। 

পল লাঁজেভি আর পারছেন না। তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে আইনগতভাবে আলাদা হবার জন্য আদালতে মামলা করলেন। প্রতিদিন নানারকম গুজব কুৎসা প্রকাশিত হতে থাকলো বিভিন্ন সংবাদপত্রে। বেশিরভাগই বিষাক্ত তীর ছুঁড়ছে মেরির দিকে। 

প্যারিসে মেরি কুরিকে জড়িয়ে এতকিছু ঘটনার খবর সুইডেনের নোবেল একাডেমির কাছে পৌঁছাচ্ছে। কমিটির সদস্যরা বুঝতে পারছেন না এ অবস্থায় মাদাম কুরির নোবেল পুরষ্কার নিতে স্টকহোমে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা। নোবেল কমিটি চিঠি লিখে পরামর্শ দিলো মেরি যেন প্যারিসের ‘ঘটনা-প্রবাহ’ থামার আগে নোবেল পুরষ্কার নিতে স্টকহোমে না যান। 

চিঠি পেয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন মেরি। প্রথমবার নোবেল পাওয়ার পর অসুস্থতার জন্য যেতে পারেন নি পিয়ের বা মেরি কেউই। যদিও ১৯০৫ সালে তাঁরা স্টকহোমে গিয়ে নোবেল কমিটির সংবর্ধনা নিয়ে এসেছিলেন, নোবেল-বক্তৃতাও দিয়েছিলেন পিয়ের। কিন্তু এবার কেন যাবেন না মেরি? তিনি তো কোন অন্যায় করেননি। প্রেসের ভয়ে ঘরে বসে থাকবেন? মেরি নোবেল কমিটিকে জানিয়ে দিলেন - তিনি ডিসেম্বরে স্টকহোমে যাচ্ছেন নোবেল পুরষ্কার নিতে। 

ডিসেম্বরের আট তারিখ বড় মেয়ে আইরিন ও বড় বোন ব্রোনিয়াকে সাথে নিয়ে স্টকহোমে পৌঁছালেন মেরি। দশ তারিখ নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ করলেন সুইডেনের রাজা গুস্তাভের হাত থেকে। এগারো তারিখ স্টকহোম কনসার্ট হলে নোবেল বক্তৃতা দিলেন মেরি কুরি। পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কারে তাঁর পাশাপাশি যে পিয়েরও সারাক্ষণ ছিলেন তা বলতে ভুললেন না তিনি। 

সাফল্যের মুকুটে নতুন পালক গুঁজে প্যারিসে ফিরলেন মেরি। আদালতের রায়ে পল লাঁজেভি ও তাঁর স্ত্রী জেনির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়েরা জেনির দায়িত্বে থাকবে। তার জন্য খোরপোশ দিতে হলো লাঁজেভিকে। মেরির সাথে আমৃত্যু বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল লাঁজেভির। লাঁজেভি আর বিয়ে করেননি - তবে ইলি মন্টেল নামে তাঁর একজন প্রাক্তন ছাত্রীর সাথে তাঁর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ইলির গর্ভে লাঁজেভির একটা সন্তানও জন্মেছিল। সেই সন্তানের নামও রাখা হল পল। [প্যারিসের রক্ষণশীল সমাজ এব্যাপারে কিন্তু কোন হৈ চৈ করেনি।] বড় হলে লাঁজেভির অনুরোধে মেরি তাঁর রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে পল লাঁজেভি-মন্টেলকে একটা চাকরিও দিয়েছিলেন। সে অনেক পরের ঘটনা। 

১৯১১ সালের ডিসেম্বরে স্টকহোম থেকে ফিরে মেরি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। দিনরাত তেজষ্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে মেরির শরীরের অনেকগুলো কোষ মারা গেছে। তাঁর লিভার মারাত্মক রকমের ক্ষতিগ্রস্ত।

১৯১২ সালে তাঁর অপারেশান করাতে হলো। প্রেস মিডিয়া এড়ানোর জন্য হাসপাতালে নিজের নাম ব্যবহার না করে স্ক্লোদভস্কা নামে কেবিন বুক করেছেন। সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত গোপন রাখা হলো মেরির অবস্থান। কিন্তু সাংবাদিকরা দিনকে রাত করতে পারেন। মেরি সিক-লিভ নিয়েছেন শুনে এবং প্যারিসের কোন হাসপাতালে মেরির হদিস না পেয়ে ডানপন্থি সাংবাদিকরা লিখলেন - মেরি লাঁজেভি’র অবৈধ সন্তানের মা হতে যাচ্ছিলেন - তাই গোপনে গর্ভপাত করাতে গেছেন। 

এত ঝড়ঝঞ্ঝার পরেও মাথা উঁচু করেই কাজে ফিরলেন মেরি। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ভবন তৈরি হতে শুরু করলো। ১৯১৩ সালে দ্বিতীয় সল্‌ভে কনফারেন্সে যোগ দিতে গেলেন ব্রাসেল্‌সে। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ শেষ হলো। মাদাম কুরি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর নিযুক্ত হলেন। 

১৯১৪ সালে জার্মানি ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। দেশের প্রতি ভালোবাসার কর্তব্য করতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন মেরি। তাঁর অস্ত্র এক্স-রে মেশিন ও রেডিয়াম। তাঁর লক্ষ্য অগণিত যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দেয়া। সতেরো বছরের মেয়ে আইরিনকে সাথে নিয়ে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রায় দশ-লক্ষাধিক যুদ্ধাহত মানুষের চিকিৎসায় সহায়তা করেছেন মেরি। নিজের চেষ্টায় প্রাথমিক পর্যায়ের এক্স-রে মেশিন তৈরি করান মেরি। যুদ্ধাহতদের সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহে পিয়ের ও তাঁর পাওয়া তিনটি নোবেল স্বর্ণপদকই তিনি দান করে দেন। 

যুদ্ধশেষে আবার ইনস্টিটিউটের গবেষণাকাজে ফিরে এলেন মেরি। কিন্তু শরীর ভেঙে পড়ছে তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাবে। বড়মেয়ে আইরিন মায়ের ইনস্টিটিউটেই গবেষণা করতে শুরু করেছে। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গবেষণা করার মত যথেষ্ট রেডিয়াম নেই। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে মোট রেডিয়াম আছে মাত্র এক গ্রাম। রেডিয়াম আবিষ্কারের স্বত্ব সংরক্ষণ করেননি পিয়ের ও মেরি। পিয়ের নিজেই রেডিয়াম সংগ্রহের পদ্ধতি জানিয়ে দিয়েছিলেন আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারদের। এখন সেই আমেরিকা বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে রেডিয়াম সংগ্রহ করে ফেলেছে প্রায় পঞ্চাশ গ্রামেরও বেশি। ১৯২১ সালে প্রতি গ্রাম রেডিয়ামের বাজার দর ছিল এক লক্ষ ডলার। 

১৯১৯ সালে আমেরিকার বিখ্যাত সাংবাদিক ও নারী আন্দোলনের নেত্রী মেসি মেলোনি ফ্রান্সে আসেন ইউরোপের প্রগতিশীল নারীর রোল-মডেল মেরি কুরির সাথে দেখা করার জন্য। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের প্রধান মাদাম কুরির অসাধারণ সাধারণত্বে মুগ্ধ হয়ে যান মেলোনি। তিনি মেরিকে আমেরিকা নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দেয়ার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিলেন। 




যে কুরিদের কল্যাণে আজ সারাবিশ্ব রেডিয়াম সংগ্রহ করে ব্যবহার করছে, উপার্জন করছে প্রচুর ডলার - সেখানে মেরির ইনস্টিটিউটে মাত্র এক গ্রাম রেডিয়াম থাকবে! মাদাম কুরিকে এক গ্রাম রেডিয়াম আমেরিকান জনগণের পক্ষ থেকে উপহার দেয়ার উদ্দেশ্যে ফান্ড সংগ্রহ করতে শুরু করলেন মেলোনি। ১৯২০ সালে মেলোনির ফান্ড রাইজিং কমিটি প্রয়োজনীয় এক লক্ষ ডলার সংগ্রহ করে ফেললো। 




১৯২১ সালের মে মাসে আইরিন ও ইভকে সাথে নিয়ে আমেরিকা গেলেন মাদাম কুরি। বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হলো মেরিকে। হোয়াইট হাউজের সংবর্ধনায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিং আমেরিকান জনগণের পক্ষ থেকে উপহার স্বরূপ এক গ্রাম রেডিয়াম তুলে দেন মাদাম কুরির হাতে।


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হার্ডিং ও মেরি কুরি

আমেরিকান সংবর্ধনা নিয়ে দেশে ফেরার পর মেরি কুরিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার সাহস হয়নি আর কারো। নিরুপদ্রবে কাজ করেছেন পরবর্তী তেরো বছর। তাঁর গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হয়েছে শত শত গবেষক। তাঁর গবেষণাগারেই সৃষ্টি হয়েছে কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তা, তাঁর মেয়ে আইরিন ও জামাতা ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরির হাতে। 




শরীরে অতিরিক্ত তেজষ্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়ায় শেষজীবনে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন মেরি। রেডিয়াম জননী মেরি রেডিয়ামের কারণেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। ১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই ছেষট্টি বছর বয়সে মৃত্যু হয় মেরি কুরির। 

তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মৃতদেহ কফিনে ভরে কবর দেয়া হয় পিয়েরে কবরের ওপর। পোল্যান্ড থেকে কিছু মাটি নিয়ে এসেছিলেন ব্রোনিয়া। বোনের কবরের ওপর তিনি পরম মমতায় ছড়িয়ে দিলেন পোল্যান্ডের মাটি - যে মাটির টানে ফিরতে চেয়েছিলেন মেরি কিন্তু পিয়েরের ভালোবাসার টানে ফিরতে পারেননি। মৃত্যুর পর এভাবেই মেরি পোল্যান্ডের মাটি মেখে বিলীন হয়ে গেলেন পিয়েরের বুকের ওপর। 
______________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।



Wednesday, 14 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৯ম পর্ব



১৯১১ সালের ২৩ জানুয়ারি একাডেমির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ব্র্যানলি পেয়েছেন ২৯ ভোট, মেরি ২৮ ভোট আর ব্রিলোইন পেয়েছেন ১ ভোট। মাত্র এক ভোটে মেরি হেরে গেলেন। কিন্তু একাডেমির নিয়ম অনুযায়ী জিতলে হলে কমপক্ষে দুই ভোটের ব্যবধানে জিততে হয়। আবার ভোট হলো। এবার ব্র্যানলি ৩০ ভোট আর মেরি ২৮ ভোট। উল্লাসে নেচে উঠলো রক্ষণশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। কিন্তু তাদের ভয় মেরি যদি ভবিষ্যতে আরো শক্তিশালী হয়ে আবার নির্বাচন করেন? মেয়েদের একাডেমিতে প্রবেশের সুযোগ চিরতরে বন্ধ করার জন্য ভোটের ব্যবস্থা হলো। ৯০ জন বিজ্ঞানী ভোট দিলেন মেয়েদের একাডেমিতে প্রবেশাধিকার চিরতরে বন্ধ করার পক্ষে, ৫২ জন ভোট দিলেন বিপক্ষে। [পরবর্তী ৬৮ বছর ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সে কোন মহিলা সদস্যপদ লাভ করতে পারেননি। ১৯৭৯ সালে এ প্রথা রহিত হয়।]

মেরি কুরি নীরবে তাঁর অধ্যাপনা ও  গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেজষ্ক্রিয়তা সংক্রান্ত মেরির গবেষণার ফল ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মেরি সেসব নিয়ে কাজ করছেন। 

সরবোনে রেডিয়াম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মেরি। পল লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। লাঁজেভির সাথে তাঁর একাডেমিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিকই আছে, তবে দেখাশোনা হচ্ছে না। 

মেরির মনে হচ্ছে সামাজিক সংকট হয়তো কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণ করতে তাঁর অফিসে দেখা করতে এলেন লাঁজেভির স্ত্রীর ভগ্নিপতি সাংবাদিক হেনরি বোর্গেস। 

“মাদাম, আপনার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে।”
“বলুন”
“আপনার আর মঁসিও লাঁজেভির কিছু একান্ত ব্যক্তিগত চিঠি আমাদের হাতে এসেছে।”
মেরির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে দেখেই হেনরি বুঝতে পারলেন কাজ হয়ে গেছে।
“মসিও লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কেউ একজন আপনাদের চিঠিগুলো নিয়ে এসেছে আমাদের কাছে। এগুলো প্রকাশিত হলে আপনার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনাকে হয়তো দেশত্যাগ করতেও হতে পারে। সুতরাং একটু সাবধানে থাকবেন মাদাম।” 

হেনরি বোর্গেস যে মেরিকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছেন তা বুঝতে পারছেন মেরি। তিনি কোন ধরনের আলোচনা ছাড়াই হেনরিকে বিদায় করে দিলেন। কিন্তু খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন তিনি। পরামর্শ চাইতে গেলেন জাঁ পেরির কাছে। পেরি লাঁজেভির বাসায় গিয়ে সব জানতে পারলেন। 

লাঁজেভি অসুস্থ হয়ে যখন বাড়িতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী জেনি লাঁজেভির চাবি নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে যান। সেখান থেকে লাঁজেভিকে লেখা মেরির চিঠিগুলো সব নিয়ে আসেন। চিঠিগুলো পড়ে ভীষণ রেগে যান জেনি। 
“ঐ শয়তানীকে আমি খুন করে ফেলবো।”
জেনির বোন ও মা জেনিকে কোন রকমে শান্ত করে পরামর্শ দেন চিঠিগুলো বোনের স্বামী হেনরির হাতে তুলে দিতে। হেনরি দেখলেন এই তো সুযোগ মেরিকে ব্ল্যাকমেইল করার।

সব শুনে জাঁ পেরিও বিচলিত হয়ে উঠলেন। জেনি একবার সরাসরি আক্রমণ করেছিল মেরিকে। তার পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। মেরি যদি কিছুদিন প্যারিস থেকে দূরে কোথাও চলে যান ভালো হয়। 

একটা সুযোগ এসে গেলো ইতালিতে একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যাবার। ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইকোল নরমাল সুপেরিয়র’ - যেখানে ফ্রান্সের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হবার শিক্ষা নেয়। ইকোল নরমাল সুপেরিয়রের ভাইস প্রেসিডেন্ট এমিল বোরেল ও তাঁর স্ত্রী প্রতিভাবান লেখিকা মার্গারিট বোরেল মেরিকে খুব পছন্দ করেন। মার্গারিট সরবোন ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন পল আপ্পেলের মেয়ে। এমিল ও মার্গারিটের সাথে মেরিও আইরিন ও ইভকে নিয়ে চলে গেলেন ইতালি। 

ইতালিতে কনফারেন্স চলাকালীন একদিন সন্ধ্যায় মার্গারিটের সাথে একান্তে কথা বললেন মেরি। পল লাঁজেভির ব্যক্তিগত সুখ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত মেরি।

“মার্গারিট, তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে বলতে আমার দ্বিধা নেই - পলের মত এমন মেধাবী বিজ্ঞানী, এমন ভালো মনের মানুষ আর হয় না। অথচ তার স্ত্রী তাকে এত কষ্ট দেয়। পলের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। পল খুব নরম মানুষ। কিন্তু তুমি আর আমি তো শক্ত। আমাদের কি উচিত নয় পলকে জেনির হাত থেকে রক্ষা করা?”

মার্গারিট মেরির চোখে দেখতে পান লাঁজেভির জন্য ভালোবাসা।
ইতালি থেকে প্যারিসে ফিরে মেরি শুনলেন লাঁজেভির সাথে জেনির সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে গেছে। লাঁজেভি নিজের বাসা ছেড়ে জাঁ পেরির বাসায় গিয়ে উঠেছেন। 

মেরি ভাবলেন এসময় প্যারিসে থাকলে আরো সমস্যা হতে পারে। তিনি মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন হল্যান্ডের লিডেনে। সেখানে গিয়ে তিনি অতি নিম্নমাত্রায় তেজস্ক্রিয় পদার্থের ধর্মের পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণা করলেন ক্যামেলিন ওনিসের সাথে। [ওনিস দু’বছর পর (১৯১৩) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।]

বেশ কিছুদিন লিডেনে কাটানোর পরেও প্যারিসে ফেরার ইচ্ছে হলো না মেরির। তিনি তাঁর মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন পোল্যান্ডে। ইভ ও আইরিন প্রথমবারের মত তাদের মায়ের জন্মভূমিতে এলো। মেরির সব আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা হলো অনেক বছর পর। মেরির বড়বোন ডাক্তার ব্রোনিয়া ও তাঁর স্বামী ডাক্তার কাজিমির ইতোমধ্যে পোল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একটা যক্ষ্মা হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন তাঁরা। মেরি তাঁর নোবেল পুরষ্কারের টাকা থেকে একটা অংশ দান করেছেন এই হাসপাতালের জন্য। মেরি ও তাঁর মেয়েদের কাছে পেয়ে সবাই খুব খুশি হলেন। আইরিন ও ইভের সময়ও বেশ আনন্দে কাটলো পোল্যান্ডে। 

১৯১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে ফিরলেন মেরি। প্যারিসে লাঁজেভির পারিবারিক অশান্তি আরো ঘনীভূত হয়েছে। মেরি এসময় ব্রাসেল্‌সের সল্‌ভে কনফারেন্সে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। অক্টোবরের ৩০ তারিখে শুরু হলো কনফারেন্স। সেই সম্মেলনে মেরি কুরি ছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত সব পদার্থবিজ্ঞানী যোগ দিয়েছেন - আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্ল্যাংক, রাদারফোর্ড, পয়েনকেয়ার প্রমুখ। প্যারিস থেকে পল লাঁজেভিও যোগ দিয়েছেন সম্মেলনে। মেরির সাথে পলের দেখা হলো অনেকদিন পর। 


১৯১১ সালের সল্‌ভে কনফারেন্সে মেরি কুরি। পেছনের সারিতে দাঁড়ানো আইনস্টাইনের ডান পাশে লাঁজেভি।

মেরি ও পল লাঁজেভি যখন ব্রাসেলসে জরুরি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ব্যস্ত প্যারিসে শুরু হয়েছে মেরি ও লাঁজেভিকে জড়িয়ে সংবাদপত্রের তান্ডব। নভেম্বরের ৪ তারিখ ‘লা জার্নাল’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্টায় দুই কলাম জুড়ে প্রকাশিত হলো ‘মাদাম কুরি ও প্রফেসর লাঁজেভির প্রেম কাহিনি’। লাঁজেভির শাশুড়ির সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এ প্রতিবেদনে রগরগে ভাষায় মেরি ও লাঁজেভির সম্পর্ককে সস্তা অবৈধ প্রেম-কাহিনিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এমনও বলা হয়েছে যে মেরি লাঁজেভির সাথে প্যারিস থেকে পালিয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন কেউ জানেন না।

ব্রাসেল্‌সে প্যারিসের সব পত্রিকা পৌঁছায়। সল্‌ভে কনফারেন্সের সব বিজ্ঞানীর চোখেই পড়েছে মেরি ও লাঁজেভি সংক্রান্ত প্রতিবেদন। তাঁদের কেউই বিশ্বাস করলেন না এসব। 

মেরি প্যারিসের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘লা টেম্প্‌স’-এ একটা প্রতিবাদলিপি পাঠালেন এই বলে যে তিনি ও লাঁজেভির প্যারিস থেকে পালিয়ে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। একটা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাঁরা এখন ব্রাসেল্‌সে আছেন। 

মেরির প্রতিবাদলিপি প্রকাশিত হলো। কিন্তু প্যারিসের বেশিরভাগ মানুষ রগরগে গল্পই পছন্দ করে। দু’দিন পরই তারা গোগ্রাসে পড়তে শুরু করলো ‘লা পেটিট’ পত্রিকায় প্রকাশিত জেনি লাঁজেভির সাক্ষাৎকার। বলাবাহুল্য এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জেনির ভগ্নিপতি হেনরি বোর্গেস।

সাক্ষাৎকারে জেনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলছেন কীভাবে মেরি কুরি নামক এক বিদেশিনী তাঁর কাছ থেকে তাঁর স্বামী প্রফেসর লাঁজেভিকে ছিনিয়ে নিচ্ছেন। জেনি কাঁদতে কাঁদতে বর্ণনা করছেন কীভাবে পল লাঁজেভি তাঁকে যখন তখন মারধর করেন। ঘর ছেড়ে বাইরে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে মেরির সাথে সময় কাটান। এতদিন তবুও প্যারিসে ছিল। এখন মেরি কুরি তাঁর স্বামীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। 

প্যারিসের তথাকথিত ভদ্র নারীসমাজ নিজ নিজ স্বামীকে মেরি কুরির মত মহিলার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য প্যারিস থেকে মেরি কুরিকে তাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রায় একমত হয়ে গেলো। 

ব্রাসেল্‌সে মেরির হোটেলে প্রতিদিন পৌঁছে যেতে লাগলো প্যারিসের পত্রিকা। আমেরিকার সংবাদপত্রেও ফলাও করে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী মেরি কুরির ‘প্রেম-কাহিনি’। মেরির মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে এরকম প্রতিবেদন পেতে পেতে। এসময় একদিন সকালে তাঁর হাতে এসে পৌঁছালো একটা টেলিগ্রাম, স্টকহোম থেকে। 

মেরি ভাবলেন সুইডেনেও হয়তো প্রকাশিত হয়েছে মেরিকে নিয়ে কোন কুৎসা। কিন্তু না, মেরি টেলিগ্রামটা পড়ে দেখলেন - এত দুর্নামের মাঝেও একটা সুখবর। মেরিকে ১৯১১ সালের রসায়নের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে। মেরি কুরি আরো একটা ইতিহাস স্থাপন করলেন - তিনি হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেলেন। 

দ্বিতীয়বার নোবেল পুরষ্কার পাওয়াতে মেরি কুরিকে নিয়ে সারাপৃথিবীর বিজ্ঞান সমাজ ধন্য ধন্য করে উঠলো। অভিনন্দন ও প্রশংসার ঝড় বয়ে গেল ওয়ার্ল্ড মিডিয়ায়। কিন্তু প্যারিসের মিডিয়ায় তেমন কোন গুরুত্বই পেলো না মেরির দ্বিতীয়বার নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির খবর। তারা মেরির ‘প্রেম-কাহিনি’ নিয়ে মশগুল।

প্যারিসে ফিরে মেরি প্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন পল লাঁজেভির সাথে তাঁকে জড়িয়ে আর কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। তাঁদের ব্যক্তিগত চিঠি যদি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা হবে বে-আইনি এবং তার দায়ভার নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সম্পাদকদের। 

মেরিকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেন পিয়েরের বড়ভাই জাকো কুরি। তাঁদের প্রভাবশালী বন্ধুরাও এগিয়ে এলেন। মেরিকে আইনগত সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এলেন রেমন্ড পয়েনকেয়ার। রেমন্ড পয়েনকেয়ার রাজনৈতিকভাবে এতই প্রভাবশালী ছিলেন যে এক বছর পর তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। পয়েনকেয়ারের প্রভাবে প্যারিস প্রেস সিন্ডিকেট এই মর্মে সম্মত হলো যে মেরি ও লাঁজেভির ব্যক্তিগত চিঠি আর কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে না। 

মেরির ব্যক্তিগত প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কিছু না লিখলেও ‘লা লিব্‌রে প্রেস’-এর মতো কট্টর ডানপন্থি পত্রিকা প্রশ্ন তুললো “মাদাম কুরির কি সরবোনের প্রফেসর পদে থাকার নৈতিক অধিকার আছে?” তারা এটাও উল্লেখ করলো যে মাদাম কুরি ও প্রফেসর লাঁজেভির চিঠিগুলো প্রকাশিত হলে সরবোনের প্রফেসররা লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবেন না সমাজে। প্যারিসের সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিষ্ঠানের প্রফেসরদেরও নিশ্চয় প্রতিষ্ঠানের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিত - যা করতে মাদাম কুরি ব্যর্থ হয়েছেন। মাদাম কুরি যে দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেয়ে সরবোন ইউনিভার্সিটির মর্যাদা আকাশে তুলে দিয়েছেন তা নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না এসব পত্রিকা।

সরবোন ইউনিভার্সিটির ডানপন্থি প্রফেসররা মাদাম কুরির ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন। এমনিতেই মাদামের বৈজ্ঞানিক সাফল্যে তাঁরা ঈর্ষান্বিত। এত কিছুর মধ্যেও মাদাম দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যেও অনেকের মনে হতে থাকে মাদাম কুরিকে সরবোন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। নভেম্বরের ২৩ তারিখ ডানপন্থিদের হাতে আরেকটি ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দেয় ‘লা’উভ্‌র’ পত্রিকার সম্পাদক। 

‘লা’উভ্‌র’ পত্রিকাটি সংবাদপত্রের ন্যূনতম নিয়ম-নীতিও মেনে চলে না। এর সম্পাদক গুস্তাভ টেরি ভীষণ সাম্প্রদায়িক, উগ্র জাতীয়তাবাদী, ইহুদি-বিদ্বেষী। টেরি ছাত্রজীবনে লাঁজেভির সহপাঠী ছিলেন। মতাদর্শের কারণে এখন তিনি লাঁজেভিকে শত্রু  বলে মনে করেন। 

‘লাঁজেভি-কুরি ঘটনার প্রকৃত রহস্য’ শিরোনামে বারো পৃষ্ঠার এক রগরগে মিথ্যা অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন টেরি। প্রতিবেদনে টেরি বিভিন্ন মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ‘ধূর্ত’ মাদাম কুরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে আস্তে আস্তে পল লাঁজেভিকে হাত করে ফেলেছেন। প্রেমের ফাঁদে ফেলে জেনির মত পতিব্রতা স্ত্রীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাঁর স্বামীকে, পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছেন তাদের চার ছেলে-মেয়েকে। 

টেরি তাঁর প্রতিবেদনে লাঁজেভিকেও ছেড়ে দেন না। টেরি বর্ণনা করেন - লাঁজেভি মেরির রূপে মুগ্ধ হয়ে ভেড়া বনে গেছেন এবং মেরির স্কার্টের নিচে ঢুকে বসে আছেন। প্রতিবেদনের শেষ পৃষ্ঠায় টেরি তাঁর ঘৃণ্যতম অভিযোগ তোলেন মেরির প্রতি - “মাদাম কুরি ‘কুরি’ পরিবারের মর্যাদা ধুলোয় মিটিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সন্দেহ পিয়ের কুরির মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই মেরি ও লাঁজেভির ‘ঘর ভাঙানিয়া’ প্রেম চলছিল। নিজের স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে প্রেম করছেন এটা সহ্য করতে না পেরে পিয়ের কুরি ঘোড়ার গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে নিজের সম্মান বাঁচিয়েছেন। এখন সম্মানিত প্যারিসবাসীর উচিত মাদাম কুরির হাত থেকে প্যারিসের সম্মান বাঁচানো।”

গুস্তাভ টেরির বিষাক্ত প্রতিবেদন পড়ে প্যারিসের ‘বীর জনতা’ ক্ষেপে উঠলো। টেরি সমর্থক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী স্‌সোতে মেরির বাসার সামনে জড়ো হয়ে অশ্লীল স্লোগান দিতে শুরু করলো। কেউ কেউ গালাগালি করতে করতে মেরির বাড়ির দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করলো। বাড়ির ভেতর ভয়ে কাঁপছেন মেরি ও সাত বছর বয়সী ছোট্ট ইভ। আইরিন তখন স্কুলে। তাঁদের পোলিশ গৃহকর্মী বুঝতে পারছেন না তাঁর কী করা উচিত।
[১০ম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]
__________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে। 


Tuesday, 13 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৮ম পর্ব



কুরি পরিবারে আরেকটি মৃত্যুতে আবার শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে বারো বছরের কিশোরী আইরিন। দাদুই ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। মেরি আইরিনকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। এবার মেরিকেই সবদিক সামলাতে হচ্ছে। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন সরবোনে পড়ানো, গবেষণা ইত্যাদি নানা কাজে। রেডিওঅ্যাক্টিভিটি বিষয়ক ৯৭১ পৃষ্ঠার একটি বিশাল বই লিখেছেন মেরি এই ক’বছরে।

এত কাজের মধ্যে থেকে আস্তে আস্তে শোক এবং হতাশা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন মেরি। শোকের পোশাক ছেড়ে কিছুটা উজ্জ্বল পোশাক পরতেও শুরু করেছেন। মেরির শারীরিক কমনীয়তা ও সৌন্দর্য আবার নতুন করে চোখে পড়তে শুরু করেছে সবার। অনেকেই বলছেন - “শোকের আগুনে পুড়ে সোনা হয়ে গেছেন মেরি।” সহকর্মী ও বন্ধু পল লাঁজেভি’র সাথে একটা সহমর্মিতার অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়েছে মেরির। পিয়েরের মৃত্যুর পর সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন লাঁজেভি। এখন লাঁজেভির ব্যক্তিগত দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছেন মেরি। 

পল লাঁজেভি ছিলেন পিয়েরের ছাত্র এবং পরে ইপিসিআই-এ সহকর্মী এবং ব্যক্তিগত বন্ধু। পিয়েরের চেয়ে বয়সে ১৩ বছর এবং মেরির চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট লাঁজেভি কুরি পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছেন। প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানী লাঁজেভির সাথে বন্ধুত্ব ছিল আইনস্টাইনেরও। আইনস্টাইন মনে করতেন - লাঁজেভিই একমাত্র ফরাসি যিনি তাঁকে ঠিকমত বুঝতে পারেন। চৌম্বকত্বের ওপর ইলেকট্রনের তত্ত্ব সফলভাবে প্রয়োগ করতে সমর্থ হয়েছিলেন লাঁজেভি। ১৯০৭ সাল থেকেই মেরি আঁচ করতে পারছিলেন পারিবারিক জীবনে ভীষণ সংকটে পড়েছেন লাঁজেভি। 

লাঁজেভি বিয়ে করেছিলেন ছাব্বিশ বছর বয়সে - বাইশ বছরের তরুণী জেনিকে। জেনি ভীষণ উচ্চাভিলাসী। অর্থ-সম্পদের প্রতি খুবই লালায়িত ছিলেন তিনি। পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে স্বামীর সুনামে তিনি খুশি ঠিকই - কিন্তু সেই সুনামে যখন কোন অর্থপ্রাপ্তির চিহ্নও দেখা যায় না - তাঁর ভালো লাগে না। তিনি স্বামীকে বোঝান ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোন ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিলে অনেক বেশি অর্থোপার্জন হয়। 

লাঁজেভি যে পড়াতে এবং গবেষণা করতে ভালোবাসেন তাতে জেনির কিছুই যায় আসে না। জেনির সাথে যোগ দেন জেনির বোন ও মা। জেনির মা লাঁজেভির বাসাতেই থাকতেন। তাঁরা সবাই মিলে লাঁজেভিকে দিনরাত খোঁচাতে থাকেন।

লাঁজেভি তাঁদেরকে খুশি করার জন্য ইপিসিআই-এর চাকরির পাশাপাশি একটা মেয়েদের স্কুলে পার্ট-টাইম শিক্ষকতার কাজ নেন। ঐ স্কুলে মেরিও পড়াচ্ছেন অনেক বছর থেকে। ইতোমধ্যে লাঁজেভি দুটো ছেলে ও দুটো মেয়ের বাবা হয়েছেন।

পল ও জেনি লাঁজেভি

ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে - তাদের জন্য আরো অনেক বেশি টাকা দরকার এই অজুহাতে সারাক্ষণ খিটিমিটি করতে থাকেন জেনি। লাঁজেভির সহ্য হয় না তা। ফলে কথা কাটাকাটি হয়। বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর কথার মধ্যে জেনির পক্ষ নিয়ে কথা বলেন জেনির বোন ও মা। লাঁজেভি আরো রেগে যান। 

পিয়েরের মৃত্যুর পর লাঁজেভি যখন মেরির পরিবারে কিছুটা বেশি সময় দিলেন কয়েকদিন, জেনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন যে তাঁর স্বামীর সাথে মেরির সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। 

একদিন মেরি দেখলেন লাঁজেভির মাথায় মুখে হাতে আঘাতের চিহ্ন। অনেক জোর করার পর লাঁজেভি যা বললেন তা শুনে আঁৎকে উঠলেন মেরি। লাঁভেজিকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়েছেন তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা ও শাশুড়ি। শুধু তাই নয় - লাঁজেভির মাথার ওপর আস্ত মদের বোতল ভেঙেছেন জেনি।

লাঁজেভির প্রতি মায়া হয় মেরির। এরকম একটা প্রাণবন্ত মায়াময় মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানীর মূল্য বুঝতে পারছেন না তার স্ত্রী এটা দুঃখজনক। মেরির সহমর্মিতা পেয়ে লাঁজেভি তাঁর দুঃখের কথা বলতে শুরু করলেন মেরিকে। 

“আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করি।”
“না” - লাঁজেভির কথা শুনে প্রায় চিৎকার করে ওঠেন মেরি -“খবরদার, ওরকম চিন্তা ভুলেও মাথায় আনবে না। তোমার ছেলে-মেয়েদের কথা তো তোমাকে ভাবতে হবে।”

১৯১০ সালের জুলাই মাসে পল লাঁজেভি নিজের নাম গোপন করে সরবোন ইউনিভার্সিটির কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করলেন। ইপিসিআই ও স্কুলের কাজ শেষে যেটুকু সময় পান এই অ্যাপার্টমেন্টেই কাটান লাঁজেভি। বাসায় ফেরেন অনেক রাতে এবং মাঝে মাঝে ফেরেনও না। 

মেরির বাসা যেহেতু সরবোন থেকে অনেক দূরে - লাঞ্চটাইমে তিনি লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করেন। মাঝে মাঝে হাতে সময় থাকলে মেরি রান্নাও করেন কিছু কিছু। লাজেঁভি অ্যাপার্টমেন্টের একটা চাবি মেরিকে দিয়েছেন যেন মেরি ইচ্ছেমত আসা-যাওয়া করতে পারেন। 

লাঁজেভির সাথে এরকম একান্তে সময় কাটানোতে যে সামাজিক সমস্যা তৈরি হতে পারে সে ব্যাপারে একটুও খেয়াল নেই মেরির। কারণ তাঁর বয়স তখন ৪৩, লাঁজেভির ৩৮, দু’জনই দায়িত্বশীল অধ্যাপক। তাঁদের ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বোঝার এবং সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে অন্য কেউ নাক গলাতে পারে তা মেরি বা লাঁজেভি কেউই ভাবেননি। শুরুতে প্যারিসের একাডেমিক জগতের কেউই কিছু মনে করেন নি তাঁদের মেলামেশায়। কিন্তু ক্রমেই অবস্থা বদলাতে শুরু করলো। 

১৯১০ সালের মধ্য-সেপ্টেম্বরে ব্রাসেলস-এ অনুষ্ঠিতব্য ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন রেডিওলজি অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি’র কাজে ব্যস্ত মেরি। গবেষণাপত্র তৈরি করার জন্য এবং মেয়েদের নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য তিনি চলে গেলেন প্যারিসের বাইরে। সেখান থেকে তিনি পল লাঁজেভিকে একটা চিঠি লিখলেন। চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানায়। 

প্যারিসে ফিরে মেরি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখেন পল নেই সেখানে। তাঁর চিঠিটাও নেই। বিল্ডিং-এর কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জানতে পারলেন - লাঁজেভি কিছুদিন থেকে অসুস্থ, চিঠিপত্রগুলো তাই মেইলম্যানকে বলে লাঁজেভির বাসায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন মেরি। 

লাঁজেভির অসুস্থতার কথা শুনে যতটা উদ্বিগ্ন তিনি, তারচেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হলেন চিঠিটার জন্য। চিঠিটা লাঁজেভি ছাড়া আর কারো হাতে পড়লে তো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। চিঠিতে তিনি কিছু আবেগের কথা লিখেছেন। লাঁজেভিকে মিস করার কথা লিখেছেন, লাজেঁভির মায়াবী চোখের কথা লিখেছেন, এবং লাঁজেভিকে ‘ডার্লিং’ বলে সম্বোধন করেছেন। মেরি ভয় পাচ্ছেন যদি এ চিঠি লাঁজেভির স্ত্রী ও শাশুড়ির হাতে পড়ে - কী অবস্থা হবে? জানাজানি হয়ে গেলে অন্যরাও তো ভুল বুঝতে পারে। 

উৎকন্ঠিত হয়ে মেরি গেলেন বন্ধু অধ্যাপক জাঁ পেরির কাছে। পেরি লাঁজেভিরও বন্ধু। মেরির কাছে সবকিছু শুনে পেরি গেলেন লাঁজেভির বাড়িতে। গিয়ে দেখলেন পরিস্থিতি যতটুকু আন্দাজ করেছিলেন তারচেয়েও খারাপ। মেরির চিঠি পড়েছে জেনির হাতে। 

চিঠি পড়ে জেনির বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে তাঁর স্বামী পল এখন অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে ‘বিদেশি ডাইনি’ মেরির সাথে থাকতে শুরু করেছেন। জেনি হুমকি দিচ্ছেন, “সব কেচ্ছা আমি ফাঁস করে দেবো। আমার ভগ্নিপতি পত্রিকার সাংবাদিক। ওই বুড়ি মেরি ডাইনিকে আমি দেশছাড়া করবো। আমার সুখের সংসারে আগুন লাগাচ্ছে শয়তানি।” 

জেনি বেশি হৈ চৈ করছেন দেখে তাঁর এগারো বছর বয়সী ছেলে জাঁ লাঁজেভি মা-কে থামাতে গেলে এক ধমক দিলেন জেনি - “চুপ কর্‌ শয়তানের বাচ্চা। বাপের মত তোরও কি একটা রক্ষিতা দরকার?”

জাঁ পেরি অনেক কষ্টে জেনিকে কিছুটা শান্ত করলেন। বুঝালেন বেশি হৈ চৈ করলে তাঁরই সম্মান নষ্ট হবে।

ক’দিন পর বাড়ি ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল পেরির। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পেরি দেখলেন অন্ধকারে ঝোঁপের আড়াল থেকে কেউ একজন বেরিয়ে ছুটে এলো তাঁর দিকে। কাছে আসতেই চিনতে পারলেন পেরি। মেরি! এ অবস্থায় এত রাতে! আলুথালু বেশ, জামাকাপড়ে ময়লা দাগ, ভয়ার্ত চেহারা, ঠক ঠক করে কাঁপছেন!! 

দ্রুত বাসায় নিয়ে গেলেন মেরিকে। হেনরিয়েট ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মেরিকে। একটু আত্মস্থ হবার পর জানা গেলো ঘটনা।

রাস্তায় মেরিকে দেখে শারীরিকভাবে হেনস্থা করেছেন লাঁজেভির স্ত্রী ও শ্যালিকা। চুল টেনে মাটিতে ফেলে লাথি মারতে মারতে হুমকি দিয়েছেন, “আবার যদি তোকে প্যারিসে দেখি খুন করে ফেলবো কুত্তি।” ভয়ে অপমানে লজ্জায় আর ট্রেন ধরে নিজের বাসায় ফিরতে পারেননি মেরি। অন্ধকারে বসে ছিলেন পেরির ফেরার অপেক্ষায়। 

পরের দিন মেরিকে তাঁর বাসায় দিয়ে এলেন হেনরিয়েট। রাতের মধ্যে মেরি অনেকটা সুস্থির হয়ে উঠেছেন। 

ব্যক্তিগত যত সমস্যাই থাকুক বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে শিথিলতা নেই মেরির। মধ্য-সেপ্টেম্বরে ব্রাসেল্‌স গেলেন তিনি। ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন রেডিওলজি অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি’র সভায় ‘ইন্টারন্যাশনাল রেডিয়াম স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে মেরি কুরির মাপকে গ্রহণ করা হলো। স্ট্যান্ডার্ড একক হিসেবে এই পরিমাপের নাম রাখা হলো ‘কুরি’। তেজষ্ক্রিয়তার আন্তর্জাতিক একক - বেকোয়ারেল (Bq) এবং ব্যবহারিক একক - কুরি (Ci)। [১ কুরি = ৩৭ বিলিয়ন বেকোয়ারেল।]

ফ্রান্সের বিজ্ঞানজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সেস। একাডেমির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোন বিজ্ঞানীর পক্ষেই কিছু করার জো নেই ফ্রান্সে। একাডেমির সদস্যদের ক্ষমতা অনেক। বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে আর্থিক অনুদান দেয়া ছাড়াও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের স্বীকৃতির ব্যাপারেও অনেক প্রভাব রাখে একাডেমি। সায়েন্স একাডেমির সদস্যপদ পাওয়া সহজ নয়। 

১৯১০ সালের ডিসেম্বরে একাডেমির একটা সদস্যপদ খালি হয়। এই পদ লাভের জন্য যে যোগ্যতা দরকার মেরির যোগ্যতা তারচেয়ে অনেক বেশি। মেরি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, মেরির আবিষ্কার বিশ্বজোড়া খ্যাতিলাভ করেছে, মেরির একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু মেরির সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হচ্ছে - মেরি একজন মহিলা। ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সের ইতিহাসে তখনো পর্যন্ত কোন মহিলা সদস্যপদ লাভ করেননি। কিন্তু ইতিহাস গড়াই তো মেরির কাজ। মেরি সদস্যপদের জন্য দরখাস্ত করলেন। 

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানসহ অনেক প্রগতিশীল বিজ্ঞানী মেরির সমর্থনে প্রচার চালাচ্ছেন। প্রভাবশালী প্রগতিশীল পত্রিকা ‘লা ফিগারো’ মেরির সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। একাডেমি অব সায়েন্সের একচেটিয়া পুরুষ-রাজত্বে নারীর অধিকার কি তাহলে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে? 

কিন্তু সকল শুভ সম্ভাবনার গলাটিপে মারার জন্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠলো। মেরির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন দু’জন গোঁড়া ক্যাথলিক বিজ্ঞানী এডোয়ার্ড ব্র্যানলি ও মার্সেল ব্রিলোইন। তাঁদের বৈজ্ঞানিক অর্জন মেরির তুলনায় কিছুই নয়। 

৬৬ বছর বয়সী ব্র্যানলি বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর কিছু কাজ করেছিলেন। কিন্তু আগের বছর (১৯০৯) বেতার যোগাযোগের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে মার্কনিকে। ব্র্যানলি তাতে খুবই অসন্তুষ্ট। এখন ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সে ‘নাস্তিক’ মেরির ‘অনুপ্রবেশের চেষ্টা’ ব্র্যানলিকে রীতিমত রাগিয়ে দিয়েছে। 

তাঁর যোগ্যতা মেরির তুলনায় কম, কিন্তু অনৈতিক যুদ্ধাস্ত্র অনেক। মেরির বিরুদ্ধে নানারকম কুৎসা রটানোর জন্য তাদের হাতে অনেক পত্রিকা। তারা প্রচার করতে শুরু করলো - মেরি ইহুদিদের হয়ে কাজ করছেন। তাঁর স্ক্লোদভস্কা পদবিতে ইহুদির গন্ধ পাওয়া যায়। যখন আরেকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো মেরি জন্মসূত্রে ক্যাথলিক - পরে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে করতে মুক্তমনা হয়েছেন, তাতে ধর্মান্ধরা আরো ক্ষেপে উঠলো - বললো ফ্রান্সে নাস্তিকের স্থান নেই। 

মেরির জাতীয়তাবাদ নিয়েও প্রশ্ন উঠলো। মেরি যে জন্মসূত্রে পোলিশ তাতেও নাকি মেরির অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। জনপ্রিয় লেখিকা মেরি রেগনিয়ের -  যিনি নারীর অধিকার নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন - বিবৃতি দিলেন মেরির বিপক্ষে - বললেন মেরি যে বিজ্ঞানচর্চা করছেন তা ঠিক করছেন না। মেয়েদের আসল কাজ হলো চুলে রঙিন ফিতে বেঁধে প্রেম ভালোবাসার ভেলায় চড়ে কাঁদা হাসা। 

উগ্র জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলো এমনও প্রচার করতে শুরু করলো যে মেরির নোবেল পুরষ্কার পাওয়াটা পিয়েরের করুণাতেই হয়েছে - নয়তো মেরির কোন যোগ্যতাই নেই নিজে কিছু করার। 

মেরি এসব প্রপাগান্ডার কোন উত্তর দেয়ার দরকার আছে বলেও মনে করেন না। কিছুতেই মেরিকে কাবু করতে না পেরে একাডেমির নির্বাচনের বারোদিন আগে ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি শেষ অস্ত্র ছুঁড়লো ট্যাবলয়েড পত্রিকা এক্সেলসিয়র। 

প্রথম পাতায় মেরির বিশাল ছবির সাথে তাঁর হাতে লেখা চিঠির অনুলিপি ছাপিয়ে মেরি ও লাঁজেভিকে জড়িয়ে কুৎসিত প্রতিবেদন প্রকাশ করলো। সমাজের বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে ব্যক্তিগত কুৎসা রটানো হলে কোন ধরনের যুক্তি প্রয়োগ না করেই অনেকে তা বিশ্বাস করে ফেলেন। প্যারিসের তথাকথিত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের অনেকেই মেরির নামে ছি ছি করতে শুরু করলেন। 
________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Monday, 12 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৭ম পর্ব



এত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁরা একটা নিয়মিত সামাজিক আড্ডা দেবার সময় বের করে নিয়েছেন। নিজেদের বাড়ির বাগানে বসে রবিবার বিকেলে সবাই মিলে আড্ডা দেন। সেই আড্ডায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যোগ দেন প্রতিবেশী বন্ধু ও অধ্যাপকেরা। আইরিনের বয়স এখন আট, ইভ মাত্র একবছর। অধ্যাপক জাঁ পেরি কুরিদের পাশেই থাকেন। [জাঁ পেরি ১৯২৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।] পেরির স্ত্রী হেনরিয়েট মেরির বন্ধু। হেনরিয়েটের মেয়ে আলিন আইরিনের বন্ধু। আড্ডায় আরো একজন নিয়মিত যোগ দেন - তিনি হলেন ইপিসিআই এর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পল লাঁজেভি।

শুরুতে সামাজিক হালকা কথাবার্তা হলেও কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় আলাপ আলোচনা সব বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানচর্চা যে কখনোই মানবতাবর্জিত হয়ে পারে না সে ব্যাপারে সবাই একমত। বিজ্ঞানকে টাকা উপার্জনের অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করার ঘোর বিপক্ষে সবাই। তাই তো দেখা যায় ডাক্তারি করে যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারতেন - সেখানে মানুষকে ভালোবেসে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করেননি পিয়েরের বাবা ইউজিন কুরি। 

তাঁর ছেলেরাও হয়েছেন তেমনি। নোবেল পুরষ্কার পাবার পরেও দুটো চাকরি করতে হচ্ছে মেরি কুরিকে। রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম আবিষ্কারের প্যাটেন্ট নিলে কোটি কোটি ফ্রাঙ্ক উপার্জন করা কোন ব্যাপারই ছিল না মেরি ও পিয়েরের জন্য। 

দুর্দান্ত বিজ্ঞানী পল লাঁজেভি। স্বয়ং আইনস্টাইন বলেছেন লাঁজেভি সম্পর্কে - “আমি যদি আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার না করতাম তাহলে লাঁজেভি তা আবিষ্কার করতেন।” লাঁজেভি স্ত্রী ও চার সন্তানের ভরণ-পোষণ মেটাতে ইপিসিআই’র অধ্যাপনা ছাড়াও মেরির স্কুলেও পার্ট-টাইম পড়ান। 

১৯০৬ সাল এসে গেলো। সরবোনে পিয়েরের ল্যাব এখনো তৈরি হয়নি। সরকারের নানা টালবাহানা চলছে তো চলছেই। পিয়ের ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ধনীলোকের কাছে আবেদনও করেছেন। কিন্তু তেমন কোন সাড়া মেলেনি। বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করে সবাই, প্রশংসা করে কেউ কেউ, কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নয়নে গাঁটের পয়সা খরচ করতে রাজি নয় কেউ। নানা কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত পিয়ের। মেরিও সমানে ব্যস্ত। বাড়িতে আইরিন ও ইভকে দেখার জন্য একজন সার্বক্ষণিক আয়া রাখা হয়েছে। পিয়ের দিন দিন ভুলোমনা হয়ে যাচ্ছেন। গবেষণা, ল্যাব, ইউনিভার্সিটির কাজ ছাড়া ব্যক্তিগত সুখদুঃখের কোন ব্যাপারই যেন তাঁর নেই। এক সাথে খেতে বসলেও দেখা যাচ্ছে কেবল কাজের কথাই হচ্ছে। মেরি বিশেষ দিনে হয়তো পিয়েরের জন্য ভালো কোন খাবার তৈরি করলেন। পিয়ের খেতে বসে ঠিকমত খেয়ালই করলেন না কী খেলেন। 

ইস্টারের ছুটিতে সবাই মিলে প্যারিস থেকে এক ঘন্টার দূরত্বে একটা ফার্ম হাউজে কাটিয়ে এলেন কয়েকদিন। মেরি বিশ্বাস করেন খোলামেলা পরিবেশেই ছেলেমেয়েদের মেধার বিকাশ ঘটে। ওখান থেকে প্যারিসে ফিরলেন ১৮ এপ্রিল। এসেই সন্ধ্যাবেলা ছুটলেন ফিজিক্যাল সোসাইটির অ্যানুয়েল ডিনারে। সেখানে গণিতবিদ হেন্‌রি পয়েনকেয়ারের সাথে অনেক কথা হলো কুরিদের। ফেরার পথে ঝুম বৃষ্টি। প্রায় আধভেজা হয়ে ঘরে ফিরলেন মেরি ও পিয়ের। সারা রাত ধরে অঝোরে বৃষ্টি হলো প্যারিসে। 

পরদিন সকালেও বৃষ্টি থামেনি। ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্য ছাতা হাতে রেডি হলেন পিয়ের। মেরি তখন দোতলায় আইরিনকে রেডি করাচ্ছেন। নিচে বেরোবার মুখে পিয়ের ডাকলেন মেরিকে, 
“তুমি কি দুপুরে ইউনিভার্সিটিতে যাবে? আমার সাথে কি দেখা হবে?”
“না, তুমি যাও। আমি কোথায় ব্যস্ত থাকি জানি না। আমার জন্য অপেক্ষা করো না” - দোতলা থেকে জবাব দেন মেরি। ছাতা মাথায় বেরিয়ে যান পিয়ের।

ইউনিভার্সিটিতে অনেক কাজ ছিল তাঁর। লাঞ্চটাইমে প্রফেসর্‌স অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং। পিয়ের অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। প্রফেসরদের অনেকের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও আছে। তাঁদের অনেকের সেই রাতে পিয়ের-মেরির বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ। 

বেলা আড়াইটার দিকে মিটিং শেষ করে বন্ধুদের ডিনারের নিমন্ত্রণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে পিয়ের জাঁ পেরিকে সাথে নিয়ে ছুটলেন গ্রান্ড অগাস্টিনের উদ্দেশ্যে। সেখানে একটি বই প্রকাশকের সাথে তাঁর প্রুফ দেখার কথা। গিয়ে দেখলেন প্রকাশকের অফিস বন্ধ। জাঁ পেরি সেখান থেকে নিজের বাসায় চলে গেলেন। পিয়ের ‘সন্ধ্যায় দেখা হবে’ বলে বিদায় দিলেন পেরিকে। বাসায় ফেরার পথে লাইব্রেরি হয়ে যাবার জন্য ইউনিভার্সিটির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়। বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে রাস্তা। ঘোড়ায় টানা গাড়ি ছুটে চলেছে দু’দিক থেকেই। বড় বড় ওয়াগন টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো ঘোড়া। প্রচন্ড ভীড়ে ঘোড়াগুলোকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে চালক। এমন সময় সেনাবাহিনীর পোশাক-ভর্তি বড় একটা ওয়াগন আসতে দেখা গেল। 

দ্রুত রাস্তা পার হতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেলেন পিয়ের। লোকজন হৈ চৈ করে ঘোড়ার গাড়িটাকে থামতে বললো। চালক ঘোড়াদের থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ঘোড়াগুলো চলতেই থাকলো। চালক কোনরকমে গাড়ির সামনের চাকা থেকে পিয়েরকে বাঁচালেন। কিন্তু পিয়ের উঠে বসার আগেই পেছনের চাকা তাঁর ঠিক মাথার খুলির উপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। রাস্তায় ছিটকে পড়লো পিয়েরের মগজ। সাথে সাথেই মৃত্যু হলো তাঁর। কপালের উপর থেকে মাথার খুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শরীর থেকে। অথচ চোখ নাক মুখ সহ শরীরের বাকি অংশ অক্ষত। 

পিয়েরের পকেট থেকে ইউনিভার্সিটির পরিচয়পত্র দেখে তাঁকে শনাক্ত করলেন স্থানীয় পুলিশ। দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়লো প্যারিসের একাডেমিক জগতে। ইউনিভার্সিটি থেকে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই ছুটে এলেন ঘটনাস্থলে। 

এদিকে পিয়েরের বাড়িতে একের পর এক অফিসার এসে মেরির খোঁজ করছেন। মেরি আর আইরিন তখনো স্কুলে। ষোল মাস বয়সী ইভকে নিয়ে বাসায় আছেন পিয়েরের বাবা। কেউ তাঁকে কিছু বলছেন না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন কিছু একটা হয়েছে। শেষে জাঁ পেরিকে দেখে বুঝলেন পিয়েরের মারাত্মক কিছু হয়েছে। পিয়ের আর নেই। মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই তাঁর ছেলে মরে গেলো! এভাবেই শেষ হয়ে গেল বিপুল সম্ভাবনাময় এক বিজ্ঞানীর জীবন। শোকে বুক ভেঙে যাচ্ছে ডাক্তার ইউজিনের। অবুঝ নাতনিকে বুকে ধরে নিজেকে শক্ত করে রেখে অপেক্ষা করছেন মেরির জন্য। 

সেদিন অন্যান্য দিনের তুলনায় কিছুটা আগেই শেষ হয়ে গেলো মেরির কাজ। আইরিনকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলেন একটু তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যায় প্রফেসরদের ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে বাসায়। কিন্তু বাসার কাছে আসতেই লোকজনের ভীড় দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন তিনি। 

শুরুতে মনে হলো পিয়েরের বাবার কিছু হলো না তো? কিন্তু ঘরে ঢুকতেই দেখলেন ইভকে কোলে নিয়ে ম্লানমুখে বসে আছেন ইউজিন। তবে কি পিয়ের? বুকটা ধক্‌ করে উঠলো মেরির। 

সরবোন ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন পল আপ্পেল মেরিকে জানালেন পিয়েরের দুর্ঘটনার কথা। স্তব্ধ হয়ে সব শুনলেন মেরি। জাঁ পেরির স্ত্রী হেনরিয়েটকে অনুরোধ করলেন আইরিন আর ইভকে নিয়ে যেন তাঁদের বাসায় চলে যান এবং কয়েকদিন তাদের দেখাশোনা করেন। হেনরিয়েট আইরিন আর ইভকে নিয়ে চলে গেলেন নিজের বাসায়। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না ইউজিন। উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন তিনি। মেরি শোকে পাথর হয়ে গেছেন। 

থানা থেকে এক অফিসার এসে পিয়েরের জিনিসপত্র দিয়ে গেলেন। পিয়েরের কলম, চাবি, ওয়ালেট। চশমাটাও অক্ষত আছে। কেবল পিয়েরই নেই। 

রাত আটটায় পিয়েরের মৃতদেহ বাসায় আনা হলো। পিয়েরের শরীর ধরে শক্ত হয়ে বসে রইলেন মেরি। তাঁকে কিছুতেই ছাড়ানো যাচ্ছিল না। শেষে জোর করে সরিয়ে নেয়া হলো মেরিকে। পরদিন সমস্ত আত্মীয়স্বজন শুভাকাঙ্খী সহকর্মী সাংবাদিক রাষ্ট্রনেতাদের উপস্থিতিতে পিয়েরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো। পিয়েরের বাড়ির কাছে স্‌সো’র কবরস্থানে কবর দেয়া হলো পিয়েরকে। 



একাকী মেরি

পৃথিবীর সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে মেরির। স্তব্ধ হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি সারাক্ষণ। ইভ ও আইরিনকে সামলাচ্ছেন জাঁ পেরির স্ত্রী। ইভ কিছুই বুঝতে না পারলেও সাড়ে আট বছর বয়সী আইরিন বুঝতে পারছে তার বাবা আর নেই। মায়ের কাছে আসার জন্য কাঁদছে সে। মেরির বুক ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে। পিয়েরকে ছাড়া বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না তাঁর। কিন্তু তাঁর মেয়েদের কী হবে? পিয়েরের স্বপ্ন ছিল আইরিন তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। মেয়েটা হয়েছেও পিয়েরের মত ধীর স্থির অথচ ভীষণ জেদি। মেরি নিজেকে বোঝান - ভেঙে পড়লে চলবে না। মেয়েদের জন্য তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। বাবার অভাবে মেয়েদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা যেন একটুও নষ্ট না হয়। 

ফরাসি সরকার মেরির জন্য একটা বিধবা-ভাতার ব্যবস্থা করলো। কিন্তু মেরি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়েরের পদে মেরিকে নিয়োগ দেয়ার দাবি তুলছেন অনেকেই। প্রফেসর হবার সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মহিলা হবার কারণে নোবেল বিজয়ী মেরি কুরিকে প্রফেসর পদ দিতে রাজী নয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কারণ সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন মহিলা শিক্ষক নেই। মেরিকে পিয়েরের জায়গায় নিয়োগ করা হলো ঠিকই কিন্তু পিয়েরের ‘প্রফেসর’ পদ দেয়া হলো না। মেরি হলেন পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার প্রধান। 

পিয়েরের ল্যাবে অধিষ্ঠিত হলেন মেরি। ল্যাবে যেদিকেই তাকান পিয়েরের স্মৃতি এসে ঝাঁপটা মারে তাঁকে। সরবোনে মেরির গবেষণার শুরুই হয়েছিল পিয়েরের সহযোগিতায়। পিয়ের জোর না করলে মেরির তো ফ্রান্সেই থাকা হতো না। পিয়েরের কত স্বপ্ন ছিল তাঁর ল্যাবকে ঘিরে। সরবোনে একটা আধুনিক ল্যাব পিয়ের দেখে যেতে পারলেন না। মেরি শপথ নিলেন পিয়েরের স্বপ্ন সফল করে তোলার। কায়মনোবাক্যে গবেষণা শুরু করলেন মেরি। 

মেরির কর্মদক্ষতা সরবোন ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য করলো। ১৯০৬ সালের নভেম্বরে ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোন মহিলা প্রফেসর পদে নিয়োগ পেলেন - এবং তিনি হলেন মেরি কুরি। পিয়েরের পদে পূর্ণমর্যাদায় নিয়োগ পেলেন মেরি। পুরো ইউরোপের একাডেমিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। পিয়েরের ফিজিক্স কোর্স পড়ানোর দায়িত্ব পেলেন মেরি। 



পিতৃহারা দুটো কন্যার মা মেরি


প্রথমদিনের ক্লাসে লেকচার থিয়েটার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলো। সিনিয়র প্রফেসররা সবাই, ডিন, মেরির স্কুলের সিনিয়র ক্লাসের ছাত্রীরাও চলে এসেছে তাদের প্রিয় মাদামের লেকচার শুনতে। সাংবাদিকরা ভিড় করেছে প্রফেসর হিসেবে মাদাম কুরিকে নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য। 

কাঁটায় কাঁটায় দুপুর একটায় ক্লাসে প্রবেশ করলেন মেরি। কালো গাউন, প্রশস্ত কপাল, উজ্জ্বল দুটো চোখ, আর উন্নত শিরে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন মেরি। প্রচন্ড করতালিতে ফেটে পড়লো লেকচার থিয়েটার।

মেরি চুপচাপ অপেক্ষা করছেন কখন করতালি থামবে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর করতালি থামলো। মেরি আগেই ডিনকে অনুরোধ করেছিলেন যেন পরিচিতির আনুষ্ঠানিকতা বাদ দেয়া হয়। ডিন পল আপ্পেল খুবই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় মেরিকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রফেসর হিসেবে স্বাগতম জানালেন। তারপর হলভর্তি দর্শক-শ্রোতা পিনপতন নিস্তব্ধতায় রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন - মেরির কথা শোনার জন্য। কী বলে শুরু করবেন মেরি? পিয়েরের স্মৃতিচারণ করতে করতে কি কেঁদে ফেলবেন সদ্য স্বামীহারা এই ৩৮ বছর বয়স্কা নতুন প্রফেসর? সবাই অপেক্ষা করছেন মেরির দুঃখে কাতর হওয়ার জন্য। 

কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সবাই হতবাক হয়ে গেলেন - যখন দেখলেন মেরি তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছেন ঠিক সেইখান থেকে - যেখানে পিয়ের তাঁর লেকচার শেষ করেছিলেন। ব্যক্তিগত শোকের একটা শব্দও উচ্চারণ না করে মেরি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের লেকচার দিয়ে গেলেন অপূর্ব দক্ষতায়। 

ব্যক্তিগত দুঃখ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে মেরিকে কেউ দেখেনি কখনো। নিজের মেয়েদের সামনেও কখনো কাঁদেননি মেরি। মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে কষ্টের কথাগুলো পিয়েরের সাথে শেয়ার করেছেন ডায়েরির পাতায়। সরবোনে প্রথম ক্লাস নেয়ার পর মেরি পিয়েরকে লিখলেন, “আমাকে সরবোনের প্রফেসর হিসেবে দেখলে তুমি আজ খুবই খুশি হতে। আমি তোমার জন্যই তোমার কাজ করতে রাজি হয়েছি। কিন্তু তোমার জায়গায় নিজেকে দেখতে আমার ভালো লাগছে না একটুও। প্রতি মুহূর্তে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারছি না শুধু আমাদের মেয়েদের জন্য। তাদেরকে আমার মানুষ করতে হবে। যে বিজ্ঞানের পথে তুমি আমাকে রেখে গেছো সেই পথে আমাকে সফল হতে হবে। যদি সফল হই তা হবো তোমার জন্য।”

পিয়েরের কবরের কাছাকাছি থাকার জন্য মেরি স্‌সু’র কাছে বাসা নিলেন। নতুন বাসা থেকে কবরস্থান খুব কাছে - কিন্তু সরবোন ইউনিভার্সিটি অনেক দূরে। মেরি প্রতিদিন সকাল বেলা ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কামরায় উঠে বসেন। আধঘন্টা পর সরবোনের কাছের স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে নিজের অফিসে যান। কতদিন রাস্তায় হাঁটার সময় ঘোড়ার গাড়ি দেখলে মনে মনে কামনা করেছেন কোন একটা গাড়ির চাকা যেন তাঁর মাথাটা থেঁতলে দিয়ে যায় - যেমন ঘটেছিল পিয়েরের বেলায়। কিন্তু দিনে দিনে দিন চলে যায়, সেরকম কিছুই ঘটে না।

আইরিন আর ইভকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন মেরি। তাদের জন্য বিশেষ স্কুলের ব্যবস্থা করেছেন মেরি সহ আরো অনেক বিখ্যাত প্রফেসররা মিলে। ছুটির দিনে একেক জন একেক বিষয়ে ক্লাস নেন। মেয়েদের যথেষ্ট খেলাধূলা ও শরীরচর্চা করার বিশেষ দরকার আছে বলে মনে করেন মেরি। আইরিন ইতোমধ্যেই সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা শিখে ফেলেছে। তাদের সারাক্ষণের সাথী হিসেবে আছেন তাদের দাদু। 

কিন্তু শরীর ভেঙে পড়েছে ৮২ বছর বয়সী ডাক্তার ইউজিন কুরির। বয়সের কারণে যতটুকু - তারচেয়েও বেশি হলো পুত্রশোকে। পুরো এক বছর রোগে ভুগে ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা যান ইউজিন কুরি। স্‌সো কবরস্থান থেকে পিয়েরের কফিন তোলা হলো। সেই জায়গায়  ইউজিনের কফিন রেখে তার উপরে পিয়েরের কফিন রাখা হলো। তারপর মাটিচাপা দেয়া হলো। মৃত্যুর পর ছেলেকে এভাবে বুকে ধরে রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন ডাক্তার ইউজিন। 
_________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।



Sunday, 11 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৬ষ্ঠ পর্ব



শেষ পর্যন্ত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেরি ও পিয়েরকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় যে জায়গাটি কাজ করার জন্য দিতে সম্মত হলো তা একটা পরিত্যক্ত শেড - যা মেডিকেল ফ্যাকাল্টির মর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন তার ছাদ ফুটো, মেঝে ভাঙা। গরমের দিনে উত্তপ্ত চুলা হয়ে ওঠে ঘরটি আর শীতে পানি জমে বরফ হয়ে হয়ে। অনন্যোপায় হয়ে সেখানেই কাজ শুরু করলেন মেরি ও পিয়ের। 

গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে সিদ্ধ হতে হতে, শীতে প্রচন্ড ঠান্ডায় বরফ হতে হতে মেরি আর পিয়ের কাজ করতে লাগলেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। এক খাবলা পিচব্লেন্ড নিয়ে সোডার দ্রবণে মিশিয়ে সিদ্ধ করার পর পানিতে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় অংশ পৃথক করেন। পরে অদ্রবণীয় অংশকে এসিডে দ্রবীভূত করেন। তার সাথে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে অনাকাঙ্খিত বস্তুকে একটার পর একটা আলাদা করে ফেলে দেন। এইভাবে বিরামহীন মিশ্রণ, দ্রবীভূতকরণ, তাপন, ছাঁকন, বিশুদ্ধীকরণ, কেলাসন চলতে থাকলো। যে কোন মৌল আলাদা করার পর পিয়ের তাঁর ইলেকট্রোমিটারে তেজষ্ক্রিয়তার মাত্রা মেপে দেখেন। পরীক্ষণীয় পিচব্লেন্ডের অবশেষ যতই কমতে থাকে তেজষ্ক্রিয়তার পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। বস্তা বস্তা পিচব্লেন্ড ছেঁকে তাঁরা বিন্দু বিন্দু রেডিয়াম সংগ্রহ করতে লাগলেন। 

এদিকে বাসায় আইরিন বড় হচ্ছে তার দাদুর কোলে। সন্ধ্যায় ডিনারের জন্য যখন বাসায় আসেন মেরি ও পিয়ের - আইরিন ছুটে এসে মেরির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেরি তখন কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলে যান তাঁর রেডিয়ামের কথা। কিন্তু পিয়েরের তর সয় না। তিনি ছটফট করতে থাকেন কখন ফিরে যাবেন কাজের শেডে। 

আইরিনকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘুম পাড়ান মেরি। তারপর ঘুমন্ত মেয়েকে শ্বশুরের কোলে দিয়ে স্বামীর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসেন পরিত্যক্ত মর্গে - তাঁদের গবেষণাগারে। কিছুক্ষণ আলো না জ্বালিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখেন - তাঁদের তিল তিল করে জমানো রেডিয়াম থেকে নীলাভ দ্যোতি বেরুচ্ছে।


গবেষণারত পিয়ের ও মেরি কুরি

১৮৯৯ সালে কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। ১৯০২ সালে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ মাস পর কুরি দম্পতি এক ডেসিগ্রাম (এক গ্রামের দশ ভাগের এক ভাগ) পরিমাণ বিশুদ্ধ রেডিয়াম সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন এই অত্যাশ্চর্য শক্তিশালী তেজষ্ক্রিয় মৌলের আবিষ্কারে। রেডিয়ামের উজ্জ্বল নীলাভ আলোর মতই আলোকিত হয়ে উঠলেন মেরি ও পিয়ের কুরি। 

ডক্টরাল থিসিস লেখার কাজ চলছে মেরির। ইতোমধ্যে তাঁরা রেডিয়াম ও রেডিও-অ্যাক্টিভিটি সংক্রান্ত বেশ কিছু যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন পিয়ের ও মেরির যুগল নামে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজ মনে হচ্ছে মেরির চেয়ে পিয়েরকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে পিয়েরকে। 

১৯০৩ সালে মেরির থিসিস যখন প্রায় কমপ্লিট - তখন ইংল্যান্ডে রয়েল সোসাইটিতে রেডিয়াম সংক্রান্ত বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হলেন পিয়ের। মেরিও সাথে গেলেন তাঁর। 

পিয়েরের বক্তৃতা শোনার জন্য লন্ডনের সব বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীই উপস্থিত হলেন। মেরি বসেছেন সামনের সারিতে লর্ড কেলভিনের পাশে। বক্তৃতায় পিয়ের মেরির অবদানের কথা খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করলেন। মেরির চোখ বার বার চলে যাচ্ছিলো বক্তৃতা শুনতে আসা সালংকারা প্রসাধনচর্চিত ব্রিটিশ মহিলাদের গায়ের ভারী ভারী দামী অলংকারের দিকে। মেরি ভাবছিলেন - কী পরিহাস জগতের। এরকম একটা গয়না বিক্রি করলে তাঁদের প্রয়োজনীয় ল্যাবোরেটরি তৈরি করে ফেলা যায়। মেরি অস্বস্তির সাথে এটাও খেয়াল করলেন যে সবাই তাঁর দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছেন যেন ভিন গ্রহের কোন প্রাণী দেখছেন - যিনি মহিলা হলেও বিজ্ঞানচর্চা করেন এবং যিনি এত দরিদ্র যে গায়ে একটাও অলংকার নেই! বক্তৃতাশেষে পিয়ের ও মেরিকে ১৯০৩ সালের ড্যাভি মেডেল প্রদান করা হলো। 

জীবকোষের ওপর রেডিয়ামের প্রভাব চোখে পড়তে শুরু করেছে বিজ্ঞানীদের। পিয়ের নিজের বাহুতে রেডিয়াম চেপে ধরে দেখেছেন তাঁর চামড়া পুড়ে গেছে। ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার কাজে যে রেডিয়াম বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে তা বোঝা যাচ্ছে। 

আমেরিকান ইঞ্জিনিয়াররা রেডিয়াম তৈরির পদ্ধতি জানতে চেয়ে চিঠি লিখেছেন পিয়েরের কাছে। রেডিয়ামের প্যাটেন্টের জন্য বিরাট অংকের টাকা অফার করছেন তারা। মেরির সাথে দীর্ঘ আলোচনা করলেন পিয়ের।

রেডিয়াম আবিষ্কারের স্বত্ব নিজেদের নামে করে নিলে ঘরে বসেই কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারবেন তাঁরা। গবেষণা করার জন্য একটা ল্যাবোরেটরি নেই তাঁদের। রেডিয়ামের টাকাতেই তাঁরা তৈরি করতে পারবেন অত্যাধুনিক গবেষণাগার। আইরিনের ভবিষ্যত অনেক বেশি সুরক্ষিত হবে যদি তাঁদের টাকা থাকে। 

কিন্তু দু’জনের কারোরই মন সাঁয় দিচ্ছে না বিজ্ঞানকে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার করতে। তাঁরা বিশ্বাস করেন - বিজ্ঞান হবে মুক্ত। প্রকৃতিতেই আছে যে পদার্থ - তা খুঁজে পেলেই আমার নিজের বলে রেজিস্ট্রি করে নেবো - তা কীভাবে হয়? অনেক পরিশ্রম করে যে রেডিয়াম তাঁরা আবিষ্কার করেছেন - তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। কোন ধরনের প্যাটেন্ট করালেন না তাঁরা। এর আগে উইলহেল্‌ম রন্টগেনও এক্স-রে আবিষ্কারের কোন প্যাটেন্ট নেন নি। পিয়ের আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারদের জানিয়ে দিলেন কীভাবে রেডিয়াম সংগ্রহ করতে হবে। 

সরবোন ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরাল থিসিস জমা দিলেন মেরি কুরি। ১৯০৩ সালের ১২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলো মেরির থিসিস বক্তৃতা শোনার জন্য। ব্রোনিয়ারা ফ্রান্স ছেড়ে পোল্যান্ডে চলে গেছেন। তাঁরা পোল্যান্ড থেকে এসেছেন মেরির বক্তৃতা শোনার জন্য। পিয়েরের বাবাও এসেছেন, বসেছেন পিয়েরের পাশে। পিয়েরের বন্ধু অধ্যাপক জাঁ পেরি ও পল লাঁজেভি এবং পিয়ের ও মেরির অনেক ছাত্র-ছাত্রীর সাথে সরবোনের অধ্যাপকরা। 

বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর শেষে পরীক্ষকদের সর্বসম্মতিক্রমে প্রফেসর লিপম্যান মেরিকে ডক্টরেট ঘোষণা করলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক স্থাপন করলেন মেরি কুরি - শুধু সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় নয় - পুরো ইউরোপের প্রথম নারী ডক্টরেট হয়ে। 

অতি-পরিশ্রম, খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম ও শরীরের প্রতি অযত্নের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করলো। পিয়ের ও মেরি উভয়েরই শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। ওজন কমে গিয়ে কংকালসার হয়ে গেছেন দু’জনই। বন্ধু ও সহকর্মীরা সবাই খুব চিন্তিত তাঁদের ব্যাপারে। অত্যধিক তেজষ্ক্রিয়তা শরীরের ভেতরটা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে তাঁদের। কিন্তু তাঁরা তা বুঝতে পারছেন না। 

ইতোমধ্যে মেরি দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করেছেন। কিন্তু যেটুকু যত্ন নিজের নেয়া উচিত তা তিনি নিচ্ছেন না। পাঁচ মাসের গর্ভবতী অবস্থায় সাইকেলে চড়তে গিয়ে মারাত্মক রকমের আহত হন মেরি। অতিরিক্ত অন্তঃক্ষরণে তাঁর মিসক্যারেজ হয়ে যায়। খুবই মুষড়ে পড়েন তিনি।

এত কষ্টের মধ্যেও আনন্দের সংবাদ আসে সুইডেনের নোবেল কমিটির কাছ থেকে। ১৯০৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন যৌথভাবে হেনরি বেকোয়ারেল, পিয়ের এবং মেরি কুরি।

পিয়ের অনেক বেশি খুশি হন এই সংবাদে। কারণ এর কিছুদিন আগে নোবেল কমিটির এক সদস্য সুইডেনের গণিতবিদ ম্যাগনাস মিট্যাগ-লেফ্‌লার পিয়েরকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে নোবেল কমিটি নোবেল পুরষ্কারের জন্য বিবেচনা করছে বেকোয়ারেল ও পিয়েরের নাম। মেরি কুরির নাম নেই কোথাও। মিট্যাগ-লেফ্‌লার বিজ্ঞানে মেয়েদের অংশগ্রহণের পক্ষে কাজ করেন। তিনি মেরির যোগ্য পুরষ্কার থেকে মেরিকে বঞ্চিত করার চেষ্টা সহজে মেনে নিতে পারেননি। পিয়ের তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন তেজষ্ক্রিয়তার কাজের জন্য নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্য হলে তা পিয়ের ও মেরি দু’জনেরই প্রাপ্য। নোবেল কমিটি পিয়েরের চিঠিকে গুরুত্ব দিয়েছে। 

১৯০৩ সালের জন্য মেরি কুরির নাম প্রস্তাব করেননি কেউ। অথচ ১৯০১ ও ১৯০২ সালে তাঁর নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল। সেখান থেকে একটি প্রস্তাবকে কাজে লাগিয়ে ১৯০৩ সালে মেরি কুরিকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক স্থাপন করলেন মেরি কুরি। তিনিই হলেন প্রথম নারী নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী। 

নোবেল পুরষ্কার পাবার পর রাতারাতি প্রচার-মাধ্যমের নজরে চলে এলেন মেরি ও পিয়ের। সাক্ষাৎকার নেবার জন্য সাংবাদিকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। পিয়ের ও মেরি ভীষণ বিরক্ত। তাঁদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দিন-রাত নানারকম অনুষ্ঠান সংবর্ধনা ভোজ-সভায় যোগ দিতে হচ্ছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও। 

প্রতিদিন শত শত চিঠি আসছে মেরি আর পিয়েরের ঠিকানায়। ডিনারের পর চিঠির স্তূপ সামনে নিয়ে বসেন মেরি - সবগুলো চিঠি খুলে খুলে পড়েন। যেগুলোর উত্তর দিতে হবে মনে করেন - আলাদা করে রাখেন। তবে সেরকম চিঠির সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ চিঠিই অভিনন্দন বার্তা, প্রশংসা আর কিছু কিছু একেবারেই অর্থহীন বিরক্তিকর। যেমন আমেরিকা থেকে একজন চিঠি লিখে জানাচ্ছেন তিনি তাঁর রেসের ঘোড়ার নাম রেখেছেন ‘কুরি’। পিয়ের বিরক্ত হয়ে উঠছেন - কারণ নোবেল পুরষ্কার পাবার পর থেকে গবেষণা করারই সময় পাচ্ছেন না তাঁরা। কিছুটা বিরক্ত হয়ে তিনি মেরিকে বলেন - “এসব চিঠি পড়ার কি কোন দরকার আছে মেরি?”
“অবশ্যই আছে। ধরো পৃথিবীর কোন এক প্রান্ত থেকে কেউ একজন এমন কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য জানতে চাচ্ছেন যা পেলে তাঁর গবেষণার উন্নতি হবে। বিজ্ঞানের উন্নতি মানে তো সবারই উন্নতি। তার জন্য এতটুকু কষ্টতো আমাদের করতেই হবে পিয়ের।”


মেরি ও পিয়েরের সাথে কন্যা আইরিন

সাংবাদিকরা দিনরাত মেরি আর পিয়েরের খবর পাবার জন্য ঘুরছে। বাসায় এসে তাঁদেরকে না পেয়ে ছয় বছরের শিশু আইরিনকেও নানা-রকম প্রশ্ন করে। ডিনারে তারা কী খায়, মেরি রান্না করেন কিনা, কখন ঘুমান এই জাতীয় সব ব্যক্তিগত তথ্যের প্রতিই বেশি আগ্রহ সাংবাদিকদের। প্যারিসের সংবাদপত্রে নানারকম সংবাদ বেরোতে থাকে মেরি-পিয়েরের সম্পর্কে।

সবগুলো সংবাদপত্রে ফ্রান্সের ‘মেধাবী সন্তান’ পিয়েরের ভূয়সী প্রশংসার পাশে মেরির উল্লেখ এমন যেন মেরি পিয়েরের কাজে সামান্য কিছু সাহায্য করেছেন মাত্র। অনেক কাগজে মেরির কোন উল্লেখই নেই। আবার কয়েকটা কাগজে মেরির কড়া সমালোচনা - মেরি সংসারের প্রতি অমনযোগী। শিশু সন্তানের প্রতিও তাঁর মনযোগ নেই। শিশু সন্তানকে একা একা খাবার খেতে হয়। মেরি যে পোল্যান্ড থেকে আগত বিদেশিনী, ফ্রান্সের কেউ নন - তাও প্রচার করে অনেক রিপোর্টার। 

মেরি অবশ্য এসবে তেমন গুরুত্ব দেন না। তাঁর দুঃখ - এত অর্জনের পরেও পিয়ের বা তাঁর একাডেমিক স্বীকৃতি নেই। পিয়ের নোবেল পুরষ্কার পাবার পরেও ইপিসিআই’র ‘অধ্যাপক’ নন - একজন ল্যাবোরেটরি টেকনিশিয়ান মাত্র। আর মেরি কুরি একটা মেয়েদের হাইস্কুলের ফিজিক্সের শিক্ষক। 

এদিকে সারাপৃথিবীর প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়ে চলেছে মেরি ও পিয়েরের অর্জনের খবর। তার চেয়েও বেশি প্রচারিত হচ্ছে এই যে তাঁরা কীরকম কষ্ট করে একটা ভাঙা শেডের মধ্যে গবেষণাকাজ চালিয়েছেন।

ইপিসিআই কর্তৃপক্ষ পিয়ের কুরিকে দ্রুত প্রফেসর পদে প্রমোশন দিল। ফরাসি সরকার নিজেদের লজ্জা ঢাকার জন্য পিয়েরকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদে নিয়োগের প্রস্তাব দিলেন। পিয়ের সেই প্রস্তাবে রাজি হবার আগে শর্ত দিলেন - তাঁর ল্যাবোরেটরি লাগবে। সরকার শর্ত মেনে নিল। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো পদ তৈরি হলো পিয়ের কুরির জন্য অধ্যাপক পদ আর মেরি কুরির জন্য তাঁর গবেষণা সহকারির পদ। 

সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য নানারকম কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন পিয়ের। মেরি তাঁকে বুঝিয়ে রাজি করালেন ইপিসিআই’র পদটি ছেড়ে দিতে। পিয়ের তাই করলেন। মেরি তাঁর স্কুলের চাকরিটি ছাড়লেন না। সরবোনের গবেষণা সহকারির চাকরি আর স্কুলের চাকরি দুটোই রইলো তাঁর।   

নোবেল পুরষ্কার নিতে মেরি বা পিয়ের কেউই স্টকহোমে যেতে পারেননি শারীরিক অসুস্থতার কারণে।

সরকার কথা দিলেও পিয়েরের ল্যাবোরেটরি তৈরির সরকারী আদেশ আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার ফাঁসে আটকা পড়ে আছে। এরমধ্যে ফরাসি সরকার পিয়েরকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘লিজিয়ন অব অনার’ দিতে চাইলে পিয়ের তা প্রত্যাখান করে বলেন, “আমাদের এখন এরকম অলংকারের চেয়েও বেশি দরকার গবেষণা করার ল্যাবোরেটরি। দয়া করে তার ব্যবস্থা করেন।” 

১৯০৪ সালের ৬ই ডিসেম্বর মেরি ও পিয়েরের দ্বিতীয় কন্যা ইভ কুরির জন্ম হয়। আইরিন ও ইভকে নিয়ে বৃদ্ধ ইউজিন কুরির আনন্দে সময় কাটে। মেরি ও পিয়ের একাডেমিক ও বৈজ্ঞানিক কাজকর্মে ব্যস্ত। নোবেল পুরষ্কারের টাকার একটা অংশ দিয়ে তাঁরা একটা গবেষণা-কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন। সরবোনে তেজষ্ক্রিয়তা সংক্রান্ত নতুন কোর্স তৈরি করছেন পিয়ের। মেরিও চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর রেডিয়ামের ভবিষ্যৎ ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন, গবেষণাপত্র রচনা করছেন। 
____________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Saturday, 10 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৫ম পর্ব



বিকেলে সাইকেলে চেপে হানিমুনে বের হলেন কুরি দম্পতি। নতুন বিয়ের চিহ্ন হিসেবে মেরির সাইকেলে একগোছা বুনোফুল বেঁধে দেন পিয়ের। বাগান মাঠ-ঘাট বন-বাদাড়ে কয়েক মাইল সাইকেলে ভ্রমণ করলেন মেরি ও পিয়ের। পিয়ের সাইকেল চালাতে চালাতে বলছিলেন তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। বলাবাহুল্য সব পরিকল্পনাই গবেষণা সংক্রান্ত। মেরিও গভীর মনযোগে বৈজ্ঞানিক আলোচনায় মেতে উঠলেন তাঁদের বিয়ের প্রথম দিনেই। 


বিয়ের পর সাইকেলে চেপে হানিমুনে পিয়ের ও মেরি

পথে এক জায়গায় সাইকেলদুটো রেখে বুনো পথে পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন নবদম্পতি। পিয়ের বিভিন্ন গাছের নাম বলছেন মেরিকে। ছোটবেলায় এরকম বুনো জঙ্গলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটতো তাঁর। 

একসময় বুনোফুলে ভর্তি এক হ্রদের পাড়ে বসলেন দু’জনে। পিয়ের মেরিকে বললেন, “তোমার হাতটা একটু দেবে?”

মেরি ভাবলেন এতক্ষণে হুঁশ হলো তাঁর স্বামীর। বিয়ের পর এতক্ষণ একবারের জন্যও স্ত্রীর হাত ধরার কথা মনে হয়নি পিয়েরের। মেরি অনুরাগে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে দিলেন স্বামীর দিকে। একটু পরে হাতে ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মেরির। তাঁর হাতের তালুতে বসে আছে একটা ছোট্ট সোনালি  ব্যাঙ। ঘেন্নায় আতঙ্কে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল মেরির। হাত ঝেড়ে ব্যাঙটাকে যে ফেলে দেবেন তাও পারছেন না তিনি। 

“কী সুন্দর না? ব্যাঙটাকে একটু আদর করে দাও।”

এসব কী বলছেন পিয়ের! পিয়েরের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন মেরি - প্র্যাকটিক্যাল জোক্‌ করছেন, নাকি আসলেই? পিয়েরের চোখেমুখে কৌতুকের লেশমাত্র নেই। তিনি সিরিয়াস। প্রকৃতির সাথে সাথে প্রকৃতির প্রাণীদের প্রতিও মায়া-মমতা পিয়েরের। 

একদিনের হানিমুন সেরে প্যারিসে ফিরলেন নবদম্পতি। ডি লা গ্লাসিয়ে রোডের একটা বহুতল ভবনের চারতলার সাদামাটা তিন রুমের অ্যাপার্টমেন্টে শুরু হলো পিয়ের-মেরির সংসার। 

আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। পড়ার ঘরটাতে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার, শোবার ঘরে একটা পুরনো খাট আর কিচেনে একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার। ঘরের সব কাজ মেরি নিজেই করেন। সকালে একজন ঠিকে ঝি আসেন এক ঘন্টার জন্য; ভারী কাজগুলো করে দিয়ে যান। মেরি তখন দোকানে গিয়ে রুটি চিজ কিনে নিয়ে আসেন। 

পিয়েরও হাত লাগান কিচেনে। দু’জনে ব্রেকফাস্ট সেরে লাঞ্চ-প্যাক সাথে নিয়ে বেরিয়ে যান ইপিসিআই’র উদ্দেশ্যে। পিয়ের সারাদিন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মেরি ইস্পাতের চৌম্বকধর্মের পরীক্ষা করেন পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষাগারে। বিকেলে দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফেরেন। আসার পথে বাজার করে নিয়ে আসেন। 

মেরি খেয়াল করে দেখেছেন পিয়ের খাবার দাবারের ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। বাঁচার জন্য খেতে হয় বলেই খাওয়া। এতবছর ধরে নিজের খাবার নিজে রান্না করে খেয়েছেন - কিন্তু কী খেয়েছেন ঠিক জানেনও না। মেরিরও একই অবস্থা। চা আর রুটি খেয়েই তিনি সরবোনের ছাত্রীজীবন কাটিয়েছেন। 

কিন্তু এখন তাঁর ইচ্ছে হচ্ছে স্বামীর জন্য ভালো কিছু রান্না করতে। কিন্তু কিছুই তো রাঁধতে জানেন না তিনি। ব্রোনিয়ার শাশুড়ির কাছ থেকে বেশ কিছু রান্না শিখে নিলেন মেরি। বাড়িতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি রান্নায় বেশ দক্ষ হয়ে উঠলেন। নিজস্ব কিছু রান্নার রেসিপিও আবিষ্কার করে ফেললেন যেগুলো খুব কম সময়ে করে ফেলা যায়। মেরির রান্না খেয়ে পিয়ের প্রশংসা করেন ঠিকই - কিন্তু মেরি বুঝতে পারেন পিয়ের রান্নার স্বাদের ভালোমন্দ কিছুই বোঝেন না বা বোঝার প্রয়োজন মনে করেন না। 

পিয়েরকে যতই দেখছেন অবাক হচ্ছেন মেরি - মানুষটা পারতপক্ষে একটা পিঁপড়াকেও কষ্ট দিতে চান না। কারো সাথে মতানৈক্য হলে খুবই ঠান্ডাভাবে নিজের মতামত জানান। কখনোই গলায় রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশ পায় না। এমন ঠান্ডা মানুষটা আবার ভীষণ জেদি - কোন কিছুর ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললে সেখান থেকে কিছুতেই সরানো যায় না তাঁকে।  

প্রতিরাতে ডিনারের পর পড়ার ঘরের টেবিলের দু’দিকে দু’জন বসে পড়াশোনা করেন। পিয়ের তাঁর নতুন কোর্স রেডি করেন। আর মেরি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হাসি আনন্দ ভালোবাসা আর ব্যস্ততায় সুখের স্রোতে ভাসতে ভাসতে দ্রুত বছর কেটে যায়। 

১৮৯৬ সালের আগস্ট মাসে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফল বেরোয়। মেরি কুরি এখানেও প্রথম হয়েছেন। প্যারিসের মেয়েদের স্কুলে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন মেরি। 

আনন্দের কোন ঘটনা ঘটলে তা উদ্‌যাপনের জন্য মেরি আর পিয়ের সাইকেল ভ্রমণে বের হন। সাইকেলে চেপে কয়েক মাইল ঘুরে এসে আবার নিয়মিত পড়াশোনা। প্রতি সপ্তাহে সাইকেলে চেপে দু’জনে পিয়েরের মা-বাবাকে দেখে আসেন। 

পরের বছর কুরি পরিবারে নতুন সদস্য আসার সম্ভাবনা দেখা দিলো। মা-বাবা হবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন পিয়ের ও মেরি। কিন্তু তাতে তাদের প্রাত্যাহিক পড়াশোনা ও গবেষণার রুটিনে কোন পরিবর্তন হলো না। 

এত আনন্দের মধ্যেও কষ্টের ছায়া পড়লো - পিয়েরের মায়ের স্তন-ক্যান্সার ধরা পড়েছে। একেবারে শেষ সময়। ছোটবেলায় নিজের মাকে হারিয়ে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন মেরি। বিয়ের পর পিয়েরের মা নিজের মেয়ের মতই স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছেন মেরিকে। পিয়ের যতটুকু সময় পাচ্ছেন মায়ের সেবা করছেন। ডাক্তার ইউজিন সারাক্ষণ লেগে আছেন স্ত্রীর সেবায়। কিন্তু ক্যান্সারের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি তখনো। কুরি পরিবারের আবহাওয়ায় একটা দুঃখের ছায়া ঘিরে ধরলো।

আসন্ন সন্তানসম্ভবা মেরি জুলাই মাসে কিছুটা মুক্ত-হাওয়ায় বিশ্রাম নেয়ার জন্য তাঁর বাবার কাছে চলে গেলেন পোর্ট ব্লাঁতে। মেরির বাবা তখন সেখানে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাচ্ছিলেন। বিয়ের পর এতদিন একটা দিনের জন্যও পিয়েরকে ছেড়ে থাকেননি মেরি। এই প্রথম পিয়েরকে ছেড়ে একা কোথাও রাত কাটাচ্ছেন তিনি। পিয়েরকে খুব মিস করছিলেন তিনি। এদিকে মায়ের সেবার জন্য প্যারিসে রয়ে যাওয়া পিয়েরও মেরির জন্য ছটফট করছিলেন। মাসখানেক পর পিয়েরের দাদা জাকো ছুটি নিয়ে মায়ের সেবা করার জন্য বাড়িতে এলে পিয়ের চলে আসেন মেরির কাছে। 

পোর্ট ব্লাঁতে কোন নার্সিং হোম খুঁজে পেলেন না পিয়ের। তড়িঘড়ি প্যারিসে ফিরে এলেন তিনি মেরিকে নিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে মেরির প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেছে। মেরিকে নিয়ে দ্রুত বাবার বাড়িতে চলে এলেন পিয়ের। ডাক্তার ইউজিনের হাতে ১৮৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জন্ম হলো পিয়ের ও মেরি কুরির প্রথম সন্তান। মা-বাবা মেয়ের নাম রাখলেন আইরিন। পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। এর দু’সপ্তাহ পর পিয়েরের মা মারা যান। 

কয়েক সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়েই কাজে ফিরতে চাইলেন মেরি। ব্যক্তিগত কারণে কাজ বন্ধ রাখার পক্ষপাতী তিনি নন। আবার কাজে গিয়েই তাঁর মনে হতে থাকে - আইরিন ঠিক আছে তো? আইরিনের দেখাশোনার জন্য একজন নার্স নিয়োগ দিয়েছেন তাঁরা। তবুও মায়ের মন মানে না। কাজের মাঝে মেয়ের কথা মনে হলে হঠাৎ কাজ থামিয়ে দৌড়ে বাসায় এসে হাজির হন মেরি। আইরিন ঠিক মত ঘুমাচ্ছে দেখে আবার কাজে ফেরেন। 

মেরির মনে হতে থাকে আইরিন তাঁর আরেকটি বিজ্ঞানিক প্রকল্প - যার ঠিকমত বেড়ে ওঠার সব দায়িত্ব তাঁদের। তিনি তাঁর গবেষণার ল্যাব-বই এর মত আইরিনের জন্যও একটা বড় খাতা তৈরি করলেন। সেখানে আইরিনের ক্রম-পরিবর্তনের বিস্তারিত বিবরণ লিখে রাখতে শুরু করলেন। দিনে ক’ঘন্টা ঘুমালো - ক’বার বাহ্যি করলো - কী খেলো - বমি করলো কিনা সবকিছু। 


পিয়ের, মেরি, ইউজিন ও আইরিন

স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা হয়ে গেছেন ডাক্তার ইউজিন। এদিকে বাড়িতে শুধুমাত্র নার্সের হাতে মেয়েকে রেখে কাজে গিয়ে শান্তি পান না পিয়ের ও মেরি। তাঁরা গিয়ে বাবাকে বলতেই সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন ডাক্তার ইউজিন কুরি। তিনি চলে এলেন পিয়ের ও মেরির বাসায়। দায়িত্ব নিলেন আইরিনের। আইরিনের জীবনে প্রথম ফ্রেন্ড, ফিলোসফার ও গাইড - তার দাদু ইউজিন কুরি। নিজের মা-বাবার চেয়েও দাদুর প্রভাব বেশি আইরিনের জীবনে। 

নিশ্চিন্ত মনে কাজ করছেন মেরি ও পিয়ের। পিয়ের কৃস্টালের গঠনের ওপর চৌম্বকত্বের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। মেরি পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করার জন্য উপযুক্ত বিষয় খুঁজছেন। মেরির আগে শুধু ফ্রান্সে নয় - পুরো ইউরোপেই কোন মেয়ে ডক্টরেট করেননি। পিয়ের সমানে উৎসাহ দিচ্ছেন মেরিকে। 

গবেষণা করার জন্য বিষয় নির্বাচন করতে গিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাপত্রগুলো পড়তে পড়তে একটা গবেষণার প্রতি মেরির গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হলো। ফ্রান্সের বিজ্ঞানী হেনরি বেকোয়ারেলের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৯৬ সালে। এর আগের বছর ১৮৯৫ সালে জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেল্‌ম রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছেন। হেনরি বেকোয়ারেল চেষ্টা করছিলেন এক্স-রেকে কাজে লাগানোর। ফটোগ্রাফিক ফিল্ম এর উপর এক্স-রে নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে বেকোয়ারেল দেখলেন ইউরেনিয়াম থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে এক প্রকার রশ্মি নির্গত হয়, যা দৃশ্যমান আলোর চেয়ে শক্তিশালী। এই রশ্মি এক্স-রে’র মতোই শক্ত ধাতব পদার্থ ভেদ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর ছাপ রাখতে পারে। কিন্তু এক্স-রে এবং এই অজানা রশ্মি এক নয়। 

বেকোয়ারেল এই সময় শুধু এইটুকু জানতেন যে অদৃশ্য শক্তিশালী রশ্মিগুলো বের হয়। কিন্তু রশ্মিগুলো কী বা কেন ওগুলো বের হয় তা নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামাননি। এমন কি বেকোয়ারেল নিজেও আর উৎসাহ দেখাননি। মেরি খুবই উৎসাহিত হয়ে উঠলেন এই রশ্মির উৎস সন্ধানে। সমস্ত অজানা প্রশ্ন যেন মেরির জন্যই অপেক্ষা করছিলো।

মেরি যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেই স্কুলের স্টোর রুমটাকে গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি পেলেন। ছোট্ট সেই রুমটা এত স্যাঁতস্যাঁতে এবং ঠান্ডা যে অনেক যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করে না। তারপরও মেরি চেষ্টার ত্রুটি করেননি এতটুকু। 

পিয়ের ও জাকো অনেকদিন আগে একটা সুবেদি ইলেকট্রোমিটার বানিয়েছিলেন। মেরি সেটাকে কাজে লাগালেন। ঐ ইলেকট্রোমিটার দিয়ে তিনি বেকোয়ারেলের আবিষ্কৃত ইউরেনিয়ামের রশ্মিগুলোর শক্তিমাত্রা পরিমাপ করতে লাগলেন। 

দিনের পর দিন বিভিন্ন ধাতুর নমুনা নিয়ে পরীক্ষার পর পরীক্ষা করে মেরি দেখলেন যে রশ্মিগুলোর শক্তিমাত্রা নির্ভর করে নমুনায় ইউরেনিয়ামের পরিমাণের উপর। এই পরিমাণ যত বেশি হবে রশ্মিগুলোর শক্তিমাত্রাও তত বেশি হবে। ইউরেনিয়ামের সাথে কী মেশানো আছে, বা নমুনাটি শুষ্ক কিংবা ভেজা, শক্ত কিংবা দানাদার, ঠান্ডা বা গরম, এই সমস্ত অনুষঙ্গের উপর মোটেও তা নির্ভর করে না, শুধু নির্ভর করে নমুনায় কতটুকু ইউরেনিয়াম আছে তার উপর। 

ইউরেনিয়াম ছাড়া আর কোন মৌল তেজষ্ক্রিয় রশ্মি ছড়ায় কিনা জানার জন্য মেরি সেই সময় পর্যন্ত জানা সবগুলো ধাতুই পরীক্ষা করে দেখলেন। দেখলেন ইউরেনিয়ামের মত থোরিয়াম থেকেও তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বের হয়। উৎসাহিত হয়ে মেরি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। এবার বিভিন্ন ধরনের যৌগ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন যদি তেজষ্ক্রিয়তা পাওয়া যায়। বালি, পাথর, খনিজ কিছুই বাদ গেলো না। একদিন ঘটলো অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। 

পিচব্লেন্ড পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন ইউরেনিয়ামের চেয়ে চারগুণ শক্তিশালী তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বের হচ্ছে। মাপতে ভুল করলেন না তো? আবার পরীক্ষা করলেন। বার বার, দশবার, বিশবার - প্রতিবারই একই ফল পাওয়া গেল। পরীক্ষা নির্ভুল। পিচব্লেন্ডে এমন কোন তেজষ্ক্রিয় মৌল আছে যা থোরিয়াম বা ইউরেনিয়ামের চেয়ে ভিন্ন এবং অধিক তেজষ্ক্রিয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যেসব মৌলের কথা জানেন সেসব মৌলের সবগুলোকেই তো তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন। তবে কি নতুন কোন মৌলের সন্ধান পেতে চলেছেন তিনি? উত্তেজিত হয়ে উঠলেন মেরি। 


পরীক্ষাগারে মেরি ও পিয়ের

উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল পিয়েরের মধ্যেও। তিনি নিজের গবেষণা একপাশে সরিয়ে রেখে এগিয়ে এলেন মেরির গবেষণায় সাহায্য করতে। থোরিয়াম ও ইউরেনিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তা সম্পর্কিত মেরির গবেষণাপত্র ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সে পড়া হয়েছে এবং প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞান জগতে মেরির সার্থক প্রবেশ ঘটে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞান জগতে নতুন কোন কিছুই তর্কাতীত নয়। কোন কোন বিজ্ঞানী সন্দেহ করলেন - মেরি হয়তো কোথাও ভুল করছেন। নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে হলে মেরিকে অবশ্যই অজানা মৌলটি আবিষ্কার করে দেখাতে হবে। পিচব্লেন্ডে যে অজানা মৌলটি আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাহলে পিচব্লেন্ড থেকে জানা মৌলগুলোকে আলাদা করে ফেললেই অজানা পদার্থটি পাওয়া যাবে। 


শুরু হলো দিনরাত্রি পরিশ্রম। ১৮৯৮ সালের ৬ই জুন পাওয়া গেল একটি তেজষ্ক্রিয় নতুন মৌল যার তেজষ্ক্রিয়তা ততটা শক্তিশালী নয়। তাহলে? আরো একটা মৌল নিশ্চয় আছে। আবার কাজ। কাজের অগ্রগতি ল্যাব-বইতে লিখে রাখেন। এদিকে আইরিনের বেড়ে ওঠাও লিখে রাখেন সমান গুরুত্বের সাথে। যেমন ১৮৯৮ সালের ২০ জুলাই মেরি লিখছেন - “দশ মাস বয়সী আইরিন চার হাত-পা দিয়ে বেশ দ্রুত হাঁটতে পারে। কথা বলতেও শিখছে। আজ বললো - ‘গুগলি, গুগলি, গু’।”

১৮৯৮ সালের ডিসেম্বরে পাওয়া গেল সেই অতিশক্তিশালী মৌল - মেরি যার নাম রাখলেন রেডিয়াম। আগে পাওয়া মৌলটির নাম রাখলেন জন্মভূমি পোল্যান্ডের নামানুসারে পোলোনিয়াম। 

মেরি ও পিয়েরের আগে আর কেউ দেখেননি রেডিয়াম। একতাল পিচব্লেন্ডের মধ্যে একটিমাত্র বালুকণার মত রেডিয়াম বর্তমান। তার শক্তিই এতো! কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেখাতে গেলে তো মোটামুটি কিছু পরিমাণ রেডিয়াম আলাদা করা দরকার। তারজন্য তাদের দরকার প্রচুর পরিমাণ পিচব্লেন্ড। পিয়ের ও মেরি খুঁজতে লাগলেন কোথায় পাওয়া যাবে প্রচুর পিচব্লেন্ড।

জানা গেলো অস্ট্রিয়ার একটি কারখানায় বর্জ্য হিসেবে পিচব্লেন্ড পাওয়া যায় এবং তারা তা ফেলে দেয়। কিন্তু তা বলে অন্য একটা দেশে গিয়ে টন টন পিচব্লেন্ড নিয়ে আসা তো সম্ভব নয়। সরকারি দপ্তরে অনেক দেনদরবার করে পিয়ের হাঙ্গেরিয়ান সরকারের অনুমোদন পেলেন কয়েক টন পিচব্লেন্ড নিয়ে আসার। হাঙ্গেরিয়ান কর্মকর্তারা মনে করলেন পিয়ের ও মেরি পাগল হয়ে গেছেন - তাই পয়সা খরচ করে মাটি নিয়ে যাচ্ছেন ফ্রান্সে। 

এদিকে আরেক সমস্যা দেখা দিলো। মেরির স্কুলের যে ভাঙা শেডে এতদিন কাজ করেছেন - তা এত ছোট যে সেখানে কাজ করা তো দূরের কথা পিচব্লেন্ড রাখার জায়গাও হবে না। কাজের জায়গা দরকার মেরি ও পিয়েরের। সমস্ত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সরবোন ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেন পিয়ের ও মেরি। 

সরবোনের এলিট কর্মকর্তারা পিয়ের ও মেরিকে পাগল-দম্পতি হিসেবে নামকরণ করে ফেলেছে। সবাই আড়ালে হাসি-তামাশা করে পিয়ের ও মেরিকে নিয়ে। তাঁরা কোন সাহায্য করলেন না। 

পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের নতুন পরিচালক প্রফেসর গ্যাব্রিয়েল আরো এককাঠি এগিয়ে গিয়ে ডিপার্টমেন্টে নোটিশ জারি করে দিয়েছেন - তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ যেন পিয়ের-মেরির সাথে কথা না বলেন। সরবোনের কোন ল্যাবে জায়গা হলো না মেরি ও পিয়েরের। 

শেষ পর্যন্ত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেরি ও পিয়েরকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় যে জায়গাটি কাজ করার জন্য দিতে সম্মত হলো তা একটা পরিত্যক্ত শেড - যা মেডিকেল ফ্যাকাল্টির মর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন তার ছাদ ফুটো, মেঝে ভাঙা। গরমের দিনে উত্তপ্ত চুলা হয়ে ওঠে ঘরটি আর শীতে পানি জমে বরফ হয়ে হয়ে। অনন্যোপায় হয়ে সেখানেই কাজ শুরু করলেন মেরি ও পিয়ের।

[৬ষ্ঠ পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]

_________
এই কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts