Saturday, 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ৮


 
কলকাতা ১৯০৭

বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই রামন ও লোকম কলকাতায় চলে এলেন। তাদের সাথে এসেছেন রামনের মা-বাবা ভাই-বোন সবাই। কেবল সুব্রাহ্মণ্য ও তাঁর স্ত্রী সীতা আসেননি। সুব্রাহ্মণ্যকে কলকাতার ফাইন্যান্স অফিসে যোগ দিতে হবে আগস্টের মাঝামাঝি। রামন যোগ দেবেন আর কয়েকদিন পরেই - জুন মাসের মাঝামাঝি। কলকাতায় রামনদের অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব চাকরি করছিলেন। তাঁদের একজনকে কয়েকটা বাসা দেখে রাখতে অনুরোধ করেছিলেন রামন।             রাজাগোপালন রামনদের হাওড়া স্টেশনে স্বাগত জানিয়ে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর রামন রাজাগোপালনের সাথে বেরিয়ে পড়লেন বাসা দেখার জন্য। সেই সময় কলকাতায় বাসা ভাড়া পেতে কোন সমস্যা হতো না। কয়েকটি বাসা দেখার পর ২৬/৪ স্কট লেনের বাসা পছন্দ হলো। সেদিন বিকেলেই রাজাগোপালনের বাসা থেকে নতুন বাসায় উঠে গেলেন রামন।
            জুনের মাঝামাঝি কলকাতার অফিসে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল হিসেবে প্রথম চাকরিতে যোগ দিলেন মিস্টার সি ভি রামন। ব্রিটিশরা ভারতে যেসব অফিস আদালত তৈরি করেছিল সবগুলোর স্থাপত্যই ছিল ব্রিটিশ আদলে। রামনের খুব পছন্দ হলো তাঁর অফিস। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিশোর বয়সী নতুন বসকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলো। অফিসের কাজ বুঝে নিতে বেশি সময় লাগলো না রামনের। তিনি ঠিক করে রেখেছেন অফিসের যেটুকু সময় দিতে হয়, তার চেয়ে এক মিনিটও বেশি সময় তিনি অফিসকে দেবেন না। দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অফিসের সময়ের আগে ও পরে তিনি যতটা পারেন বিজ্ঞান-গবেষণা করবেন।
            শনিবার বিকেলে একটি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে ছোট ভাইবোন ও স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা শহর দেখতে বের হলেন রামন। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা তখন ভারতের সব শহরের চেয়ে উন্নত। কলকাতার ট্রাম, পোস্ট অফিস, ধর্মতলা স্ট্রিট, মিউনিসিপ্যাল মার্কেট, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল এসব দেখে সবাই খুব মুগ্ধ হয়ে গেলো।
            স্কট লেনে তাদের বাসার কাছেই একটা বড় চার্চ ছিল। প্রথম দিন চার্চের ঘন্টার শব্দ শুনে রামনের মনে শব্দতরঙ্গ নিয়ে গবেষণার অনেক রকম ধারণা এসে ভীড় করতে শুরু করলো। পরের রবিবারে লোকম ও ছোট বোনদের নিয়ে চার্চে গেলেন রামন। ছোট্ট সীতালক্ষ্মী ও মীনার খুব একটা ভালো লাগলো না চার্চ। তারা একটু পরেই বাসায় চলে এলো। কিন্তু লোকম ও রামন অনেকক্ষণ ধরে চার্চের অর্গানের শব্দ শুনলেন। রামন দেখলেন চার্চের ভেতর শব্দতরঙ্গ কীভাবে খেলা করে। তিনি ভাবতে লাগলেন ভারতীয় সুরযন্ত্রগুলোতে কীভাবে শব্দ তরঙ্গ তৈরি হয় এবং তাদের বিজ্ঞানের স্বরূপ কী।
            রামন বাসায় ফিরে আসার পর দেখলেন মাদ্রাজ থেকে যে রাঁধুনি বামুন তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন সেই বামুন রামনদের বাড়িতে আর কাজ করবেন না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। যাবার আগে বলে গেছে রামনরা কেমন ব্রাহ্মণ যে চার্চে যায়? সেই সময় মাদ্রাজে ইওরোপীয় মিশনারিরা বিভিন্ন রকমের জাগতিক সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে অনেককেই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দিচ্ছিলো। রামনদের মাদ্রাজী রাঁধুনিটি ভেবেছিলেন রামনরাও গোপনে খ্রিস্টান হয়ে গেছেন। তাই চার্চে গিয়েছেন। রাঁধুনিটি মাদ্রাজে পালিয়ে গিয়ে প্রচার করে দিয়েছেন যে রামনরা খ্রিস্টান হয়ে গেছেন। রামন মাদ্রাজের অনেকের কাছ থেকে চিঠি পেতে শুরু করলেন। সবাই উপদেশ দিচ্ছেন যেন রামন কিছুতেই খ্রিস্টানদের প্রলোভনে পা না দেন।
            কিছুদিন পর রামনের মা-বাবা ও ভাই-বোনরা বাড়িতে চলে গেলেন। রামনের মা তখন গর্ভবতী ছিলেন। রামনের সবচেয়ে ছোট ভাই রামস্বামীর জন্ম হয় সেবছর ২০ আগস্ট।
            প্রতিদিন সকালে স্যুট-কোট-পাগড়ি পরে অফিসে যান রামন। বাসা থেকে সামান্য হেঁটে বউবাজার স্ট্রিট। সেখান থেকে ট্রামে ডালহৌসি স্কয়ার। সেখানেই অফিসপাড়ায় রামনের অফিস।
            রামনের মা-বাবা চলে যাবার পর বাসায় এখন তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজন মাত্র মানুষ। রামন সংসারের কোন কাজই জানেন না এবং জানতে চানও না। লোকমের বয়স মাত্র তেরো হলেও রামনের দেখাশোনার সব দায়িত্ব তার ওপর। রামনের বাবা তাকে বলে গেছেন, রামনের ঠান্ডা লাগার ধাত আছে। খাবারের একটু অনিয়ম হলেই পেটের সমস্যা হয়। রামন অফিসে দুপুরে কিছু খান না। কারণ ক্যান্টিনের খাবার সহ্য হয় না। আবার বাসা থেকে সাথে করে খাবার নিয়ে যেতেও রাজি নন তিনি।
এদিকে বাঙালি বাড়িওয়ালির সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে লোকমের। দ্রুত বাংলা শিখে নিচ্ছেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই লোকম ভালো বাংলা বলতে শিখে গেছেন। বাড়িওয়ালি লোকমকে একটি কাজের লোক জোগাড় করে দিলেন। সংসারের ফাইফরমাশ খাটা ছাড়াও দুপুরে রামনের জন্য বাসা থেকে খাবার নিয়ে যায় লোকটি।
            অফিসের পর বাসায় ফিরে রামন লোকমকে নিয়ে ময়দানে বেড়াতে যান, ঘুরে ঘুরে শহর দেখেন দুজনে। রামন এর মধ্যেই ভাবতে থাকেন তাঁর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান সম্পর্কে। সাবানের ফেনার বুদবুদের আকার আয়তন নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি করেছিলেন মাদ্রাজে থাকতে। তার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে একটা পেপার লিখে ফেলেছেন। সেটা আরেকটু দেখে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে দিতে হবে প্রকাশ করার জন্য।
            পরের মাসে খবর পাওয়া গেলো তার ছোটভাই সুন্দরম মাত্র দুদিন ডায়রিয়ায় ভুগে মারা গেছে। দশ বছর বয়স হয়েছিল তখন তার। রামন উদাসীন হয়ে যান। ভাবতে থাকেন মানুষের জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই। এর মধ্যেই সব কাজ দ্রুত সেরে ফেলতে হবে। তাঁর কত কিছু পরীক্ষা করে দেখার বাকি এখনো। প্রতিটা সেকেন্ড কাজে লাগানো দরকার। কিন্তু কলকাতায় এখনো কোন লাইব্রেরি বা গবেষণাগারের খোঁজ পাননি তিনি।
            রামন যখন এসব চিন্তায় মগ্ন থাকেন তখন লোকমের কথা তার মনেও থাকে না। স্বামী-স্ত্রী হলেও তারা থাকেন আলাদা রুমে। লোকমের খুব একা লাগতে থাকে। অবশ্য পরের মাসে সুব্রাহ্মণ্য ও তাঁর স্ত্রী সীতা আসার পর লোকমের একজন কথা বলার সঙ্গী হয়।
            সুব্রাহ্মণ্য যোগ দিয়েছেন পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের অ্যাকাউন্টস সেকশানে। প্রতিদিন সকালে দুই ভাই একসাথে অফিসে চলে যান। আর দুই জা সংসারের কাজকর্ম করেন। লোকম খুশি সীতাকে কাছে পেয়ে।
            কলকাতায় নতুন এসেছেন - তাই ট্রাম থেকে যতদূর দেখা যায় রাস্তার পাশের সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে অফিসে পৌঁছে যান রামন। কিন্তু কোন বৈজ্ঞানিক চিন্তা মাথায় এলে সেটা সম্পর্কে ভাবার সময় রামনের চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তাই পথের অনেককিছুই রামনের চোখ এড়িয়ে যায়। আগস্ট মাসের শেষের দিকে একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড যাতে লেখা আছে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স, ২১০ বউবাজার স্ট্রিট, কলকাতা রামনের কোন ধারণা নেই এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে। কিন্তু কৌতূহল সীমাহীন। কাল্টিভেশান অব সায়েন্স - বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধনে ব্রতী হতেই তো চান তিনি। রামন ট্রাম থেকে নেমে গেলেন পরের স্টেশনে। সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে পৌঁছে গেলেন সাইনবোর্ড লাগানো বাড়িটির কাছে।
            তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়িটির দরজা বন্ধ। দেয়ালে লেখা আছে 'ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স - আই.. সি. এস।  কলিংবেল টেপার অনেকক্ষণ পর ধূতি-ফতুয়া পরা মধ্যবয়স্ক একজন লোক এসে দরজা খুলে দিলেন। রামন তখনো জানেন না যিনি দরজা খুলে দিলেন তিনি আশুতোষ দে -  আশুবাবু যিনি পরবর্তী পঁচিশ বছর ধরে তাঁর পাশে থেকে পরীক্ষাগারে কাজ করবেন।
            রামন ভেতরে ঢুকে দেখলেন বেশ বড় বড় রুম। কিন্তু কোন লোকজন নেই। দেখলেন বেশ বড় একটা গবেষণাগার আছে - বিজয়নগর ল্যাবোরেটরি। উঁকি দিয়ে দেখলেন সেখানে অনেক যন্ত্রপাতিও আছে। রামন শিহরিত হয়ে উঠলেন। গবেষণার এত ভালো জায়গা থাকতে এখানে কেউ কাজ করছেন না কেন? আশুবাবু ছাড়া আর একজন মানুষও চোখে পড়ছে না তাঁর। বেশ বড় একটা লেকচার হলও দেখা গেলো। কিন্তু কোথাও কোন মানুষ নেই।
            আশুবাবু রামনকে নিয়ে গেলেন অমৃতলাল সরকারের কাছে। আই-এ-সি-এস এর অবৈতনিক সেক্রেটারি তিনি। অমৃতলাল সরকার বসেছিলেন তাঁর অফিসে। তাঁর বাবা ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বড় স্বপ্ন নিয়ে সারাজীবনের সঞ্চয় ও অনেক পরিশ্রমে এই বিজ্ঞান-গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করেছিলেন এই আশায় যে একদিন এটা হয়ে উঠবে বিজ্ঞান-গবেষণার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও কোন গবেষক এখনো পর্যন্ত আসেননি এখানে গবেষণা করার জন্য। রামনকে দেখে অমৃতলাল প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেননি কী কারণে এই মাদ্রাজি বালক এখানে এসেছে। স্যুট-কোট পাগড়ি পরা থাকলেও সাড়ে আঠারো বছরের তরুণ রামনকে দেখতে এখনো কিশোর বালকের মতোই মনে হয়।
            রামন নিজের পরিচয় দিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় তার উৎসাহের কথা এবং ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রকাশিত পেপারের কথাও বললেন। রামন জানতে চাইলেন এই অ্যাসোসিয়েশানে কাজ করতে হলে তাঁকে কী করতে হবে? তাঁর নিজের অফিসের কথাও বললেন। রামন চান অফিসে যাওয়ার আগের ও পরের সময়টাতে এখানে বসে কাজ করতে।
            অমৃতলাল যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে তাঁর বাবা মহেন্দ্রলাল সরকার মৃত্যুর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা সফল হতে চলেছে। মহেন্দ্রলাল সরকার বলেছিলেন, একদিন এমন কেউ আসবে যে এই অ্যাসোসিয়েশানকে প্রাণবন্ত করে তুলবে।
            রামনের উৎসাহ দেখে ভীষণ খুশি হলেন অমৃতলাল। এতদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠান তো রামনের মতো তরুণ বিজ্ঞানীর পথ চেয়েই ছিল। অমৃতলাল সরকার রামনের হাতে তুলে দিলেন অ্যাসোসিয়েশানে যখন খুশি যতক্ষণ খুশি গবেষণা করার অধিকার।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts