Showing posts with label বাংলাদেশ. Show all posts
Showing posts with label বাংলাদেশ. Show all posts

Sunday, 13 June 2021

দুর্নীতির রীতিনীতি



 "প্রদীপ, তুমি কি আমার একটা কাজ করতে পারবে?"

"জ্বি স্যার, পারবো।"

"কী কাজ না জেনেই কীভাবে বললে যে পারবে?"

"সরি স্যার, চেষ্টা করবো। কী কাজ স্যার?"

"--- এই দোকানে গিয়ে আমার জন্য ছয় ইঞ্চি লম্বা একটি স্ক্রু-ড্রাইভার কিনে নিয়ে আসবে। এই কাগজে স্ক্রু-ড্রাইভারের ডেসক্রিপশান দেয়া আছে। সব মিলিয়ে নেবে।" 

"স্যার ঐ দোকান থেকেই কি কিনতে হবে?"

"হ্যাঁ"

"যদি ঐ দোকানে না থাকে? অন্য দোকান থেকে আনবো স্যার?"

"না। ক্যাশ মেমো নিয়ে আসবে।"

কাগজ আর পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে প্রামাণিক স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। 

যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রামাণিক স্যারকে মন থেকে পছন্দ করতেন এমন মানুষ খুব বেশি ছিল বলে মনে হয় না। স্যারের মত কাঠখোট্টা চাঁছাছোলা সত্যবাদী অধ্যাপক বাংলাদেশে আমি খুব একটা দেখিনি। যারা সবসময় সত্য কথা বলেন তাদেরকে সবসময় পছন্দ করা কঠিন কাজ। আমরা সত্যবাদীদের ততক্ষণ পছন্দ করি, যতক্ষণ সেই সত্যবাদিতা আমাদের পক্ষে যায়। 

তখন সবে অনার্স পাস করেছি। মাথার ভেতর যুক্তিবাদের ভূত বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। তাই "কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কভু করে না বঞ্চনা" - নীতি অবলম্বন করে প্রামাণিক স্যারের কাছে গবেষণার প্রথম পাঠ শুরু করেছি। 

স্যারের নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ইলেকট্রনিক্সের দোকানে গিয়ে নির্দিষ্ট স্ক্রু-ড্রাইভারটা কিনে নিয়ে এলাম। দাম নিলো নয় টাকা। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে স্যারের হাতে স্ক্রু-ড্রাইভার, ক্যাশ মেমো আর ৪১ টাকা ফেরত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "স্ক্রু-ড্রাইভারের রহস্য কী স্যার?"

স্যার খুবই মন খারাপ করে উত্তর দিলেন, "একটা সামান্য ফ্যাক্টচেক করলাম।" আর কিছু জানা গেলো না স্যারের কাছ থেকে। 

কিছুদিন পরে ব্যাপারটা জানলাম অন্য সোর্স থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিগুলোতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার জন্য যে ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি টেন্ডার পেয়েছে তারা একটা ছয় ইঞ্চি স্ক্রু-ড্রাইভারের দাম ধরেছে ৪৫ টাকা। ঐ কোম্পানির দোকান থেকেই যা আমি কিনেছি নয় টাকা দিয়ে। স্যার পারচেজ কমিটিতে ছিলেন বলেই এই ফ্যাক্টচেকের ব্যবস্থা। স্যারের পক্ষে অন্যান্য আইটেমের ফ্যাক্টচেক করা সম্ভব হয়েছিল কি না জানি না। তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন, স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। স্যারকে কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। কয়েক হাজার ৯ টাকার স্ক্রু-ড্রাইভার ৪৫ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে আমাদের বিদ্যাদান করার জন্য। এভাবেই ইংরেজিতে যাকে বলে -  we were screwed. 

আজ এত বছর পরেও দেখি একই অবস্থা। সামিয়ানার রঙ বদলেছে, কিন্তু ভেতরে সব একই জিনিস। এখন সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বই সাড়ে পঁচাশি হাজার টাকায় কেনা হচ্ছে। এত বেশি দাম দিয়ে কেনা বই পড়ে আমরা যে কী পরিমাণ জ্ঞানী হবো! আচ্ছা, এত জ্ঞান আমরা রাখবো কোথায়?

৩১ আগস্ট ২০১৯

কপিরাইট এবং নীতিবোধ

 কপিরাইট এবং নীতিবোধ

আমরা জানতাম মাসুদ রানা সিরিজের সব বই কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা। কুয়াশা সিরিজের লেখকও তিনি। বিদ্যুৎ মিত্র নামে যেসব বই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রকাশনী থেকে - সেই বিদ্যুৎ মিত্রও তাঁর ছদ্মনাম বলে জানতাম। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বই এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের প্রকৃত লেখক শেখ আবদুল হাকিম। একজন পাঠক হিসেবে আমি নিজেকে খুবই প্রতারিত মনে করছি। যে কোন লেখকের একটা আত্মমর্যাদা থাকে। জেনেশুনে কোন লেখকই অন্যের নামে নিজের লেখা প্রকাশ করতে দেন না, এবং অন্যের লেখাও নিজের নামে চালান না বলে বিশ্বাস ছিল। কিন্তু সে বিশ্বাস এখন আর রাখা যাচ্ছে না। 

মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলি প্রকাশিত হচ্ছে প্রায় ৫০ বছর আগে থেকে। কপিরাইট অফিস থেকে জানা যাচ্ছে শেখ আবদুল হাকিম তাঁর লেখা বই কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে প্রকাশ করার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন টাকার বিনিময়ে। একজনের লেখা অন্যজনের নামে প্রকাশিত হওয়াটা যে নীতিগতভাবে ঠিক নয় তিনি সেই পয়েন্ট থেকে অভিযোগ করেননি। তিনি এত বছর পরে অভিযোগ করেছেন চুক্তিমত টাকা-পয়সা পাননি বলেই। 

অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। সামাজিক মাধ্যমে একজনের লেখা অন্যজন কপি পেস্ট করে 'সংগৃহীত' বলে চালাচ্ছেন। বাংলাদেশে কপিরাইটের অবস্থা খুবই নাজুক। অন্যদেশের প্রকাশনা শিল্পে কপিরাইটের যে নীতিগত স্বচ্ছতা এবং দৃঢ়তা দেখা যায়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে আমাদের দেশে তা প্রায়ই অনুপস্থিত। বিদেশে প্রকাশিত বই থেকে অনেককিছুই আমরা কোন ধরনের অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ করে ফেলছি, অনেক সময় কোন ধরনের উৎসও উল্লেখ করছি না।  বিদেশী বইয়ের অনুবাদের ব্যাপারেও আমরা লেখক বা প্রকাশকের কোন অনুমতি নেয়ার তোয়াক্কা করছি না। তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বাংলায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত বইগুলি এখন বাংলাদেশের প্রকাশকেরা যেভাবে খুশি সেভাবে প্রকাশ করছেন। অনেক সময় প্রকাশকরা সেই বইগুলির লেখক হিসেবে বাংলাদেশের অন্য কোন লেখকের নাম বসিয়ে দিচ্ছেন। যার নাম বসাচ্ছেন তিনি হয়তো জানেনই না। ভারতীয় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন যে বাংলাদেশে তাঁদের নাম দিয়ে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে যেগুলি আসলে তাঁরা লিখেননি। কোন দেশের প্রকাশনার মান দেখেই বোঝা যায় - সেই দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের কী অবস্থা। 

আমাদের সতের কোটি মানুষের বিশাল দেশে আমাদের প্রকাশনা জগত নিয়ে আমরা গৌরব করতে পারবো কখন? কখনো পারবো কি?

১৬ জুন ২০২০

খিঁচুড়ি প্রশিক্ষণ

 


এরকম উন্নতির খবর দেখতেও ভালো লাগে। স্কুল-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিস্কুট এবং খিঁচুড়ি কীভাবে বিতরণ করা যায় তা দেখার জন্য ৫০০ সরকারি কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণ করবেন। এর জন্য বাজেট চাওয়া হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু ১ লক্ষ টাকা দিয়ে কি বিদেশ-ভ্রমণ হয়? তাছাড়া এত জটিল একটা ব্যাপার শেখার জন্য কত দীর্ঘ সাধনা এবং প্রশিক্ষণের দরকার হয়। বিস্কুট আর খিঁচুড়ি বিতরণে দক্ষতা অর্জন কি চাট্টিখানি কথা নাকি? তাছাড়া বাংলাদেশ কি অস্ট্রেলিয়ার মত দরিদ্র দেশ নাকি যে সব ধরনের বিদেশ-ভ্রমণ বন্ধ করে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে?

১৬/৯/২০২১





সংবাদ লিংক



Thursday, 6 September 2018

বইয়ের দাম




"বইমেলার ছবি দেখেছো?"

"দেখলাম তো। সেজেগুঁজে একেবারে নতুন সাদা-কালো বর্ণমালা শাড়ি পরে। পার্লারে গিয়েছিলে নাকি মেলায় যাবার আগে?"

"যাবো না? একুশে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় যাবো - ভূতের মতো যাবো নাকি? একুশের ফ্যাশান ফলো করতে হবে না?"

"কী বই কিনলে?"

"কিনবো কীভাবে? তোমার বইগুলোর যা দাম! দুই তিনশ' টাকার নিচে কোন বইই নেই। কেনার উপায় আছে?"

"তবে কী করলে?"

"ঘুরলাম। কিছু সেল্‌ফি তুললাম। আর পিৎজা-হাটে গিয়েছিলাম।"

"বইমেলায় পিৎজা-হাট?"

"আরে না। বেইলি রোডে। বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম।"

"দাম কেমন ওখানে?"

"খুব একটা বেশি না, চলে। আমরা চারজনে খেয়েছি তো - তেইশ শ পঞ্চাশ টাকায় হয়ে গেছে।"

"দুই হাজার তিন শ পঞ্চাশ টাকা!"

"আসলে দুই হাজার তিন শ টাকা। পঞ্চাশ টাকা টিপ্‌স দিয়েছি। ওয়েটারটা খুব কিউট ছিল। হা হা হা।"

সে হাসে। এরকম হাসিখুশি তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে এতে আমার খুশি হবার কথা। কিন্তু পারছি না। কোথাও একটা যন্ত্রণা হচ্ছে।

সৈয়দ মুজতবা আলী আজ থেকে ৬৫ বছর আগে 'বই কেনা' প্রবন্ধটিতে লিখেছিলেন:

বাঙালির "মুখে ঐ এক কথা 'অত কাঁচা পয়হা কোথায়, বাওয়া, যে বই কিনব?'
কথাটার মধ্যে একটুখানি সত্য - কনিষ্ঠাপরিমাণ - লুকনো রয়েছে। সেইটুকু এই যে, বই কিনতে পয়সা লাগে - ব্যস্‌। এর বেশি আর কিছু নয়।
            বইয়ের দাম যদি আরো কমানো যায়, তবে আরো অনেক বেশি বই বিক্রি হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই যদি প্রকাশককে বলা হয়, 'বইয়ের দাম কমাও', তবে সে বলে 'বই যথেষ্ট পরিমাণে বিক্রি না হলে বইয়ের দাম কমাবো কি করে?'
            'কেন মশাই, সংখ্যার দিক দিয়ে দেখতে গেলে বাঙলা পৃথিবীর ছয় অথবা সাত নম্বরের ভাষা। এই ধরুন ফরাসি ভাষা। এ ভাষায় বাঙলার তুলনায় ঢের কম লোক কথা কয়। অথচ যুদ্ধের পূর্বে বারো আনা, চৌদ্দ আনা, জোর পাঁচ সিকে দিয়ে যে-কোন ভাল বই কেনা যেত। আপনারা পারেন না কেন?'
            'আজ্ঞে, ফরাসি প্রকাশক নির্ভয়ে যে-কোন ভালো বই এক ঝটকায় বিশ হাজার ছাপাতে পারে। আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে দু'হাজার ছাপাতে গেলেই, বেশি ছাপিয়ে দেউলে হব নাকি?'
            তাই এই অচ্ছেদ্য চক্র। বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না।
............
বাঙালির মতো "এরকম অদ্ভুত সংমিশ্রণ আমি ভূ-ভারতের কোথাও দেখিনি। জ্ঞানতৃষ্ণা তার প্রবল, কিন্তু কেনার বেলা সে অবলা। আবার কোনো কোনো বেশরম বলে, 'বাঙালির পয়সার অভাব' বটে? কোথায় দাঁড়িয়ে বলছে লোকটা এ-কথা? ফুটবল মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে, না সিনেমার টিকিট কাটার 'কিউ' থেকে?"
......

৬৫ বছরে একটুও কি বদলেছে আমাদের বই কেনার অভ্যাস? বদলেছে নিশ্চয়। এখন আমরা ফুটবল খেলি না, খেলা দেখিও না। আর সিনেমা হলগুলোর বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমরা ক্রিকেট দেখি। আর ফাস্ট ফুড খাই আর সোশাল মিডিয়া করি।

এই ৬৫ বছরে সবকিছুর দাম বেড়েছে, মানুষের বেতনও বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছেসোনার দাম বেড়েছে, জমির দাম বেড়েছে। এখন অবশ্য সেগুলো সবাই কিনতে পারেন না। কিন্তু সবাই যেগুলো কিনতে পারেন, যেমন চাল - দাম বেড়েছে প্রায় তিরিশ গুণ, মাছের দাম বেড়েছে প্রায় দুইশ' গুণ। সেই তুলনায় বইয়ের দাম বেড়েছে খুব বেশি হলে বিশ গুণ। কিন্তু সবাই দোষ দেয় শুধু বইয়ের দামের। 

বাংলাদেশে যে বড় পিৎজা তিন হাজার টাকা দাম দিয়ে কিনে খাবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ, সেই পিৎজা অস্ট্রেলিয়ায় দশ ডলার মানে ছয় শ টাকায় পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ায় একটি দুইশ' পৃষ্ঠার বইয়ের দাম কমপক্ষে বিশ ডলার অর্থাৎ বারো শ টাকাআর বাংলাদেশে একটা দুই শ পৃষ্টার বইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি হলে তিন শ টাকা। অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ গুণ দাম দিয়ে পিৎজা খাবার মানুষ আছে বাংলাদেশে অথচ চার ভাগের এক ভাগ দাম দিয়ে বই কেনার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।


এর মাঝেও অনেক ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন যারা বই কেনেন। মূলত তাঁদের জন্যই বই-প্রকাশকেরা এখনো বইয়ের মেলা করতে সাহস পান।

"ভেবে-চিন্তে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে বই কেনে সংসারী লোক। পাঁড় পাঠক বই কেনে প্রথমটায় দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, তারপর চেখে চেখে সুখ করে করে, এবং সর্বশেষে সে কেনে ক্ষ্যাপার মত, এবং চুর হয়ে থাকে তার মধ্যিখানে। এই একমাত্র ব্যসন, একমাত্র নেশা যার দরুন সকালবেলা চোখের সামনে সারে সার গোলাপী হাতি দেখতে হয় না, লিভার পচে পটল তুলতে হয় না।"

Sunday, 19 August 2018

যেন ভুলে না যাই: মৌলবাদীদের হুমকি



বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর নাম আইনস্টাইনের নামের সাথে সমান সম্মানে উচ্চারিত হয় পৃথিবীজুড়ে বোস-আইনস্টাইন থিওরি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে পৃথিবীর সবগুলি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থের মৌলিক কণা 'বোসন' পরিচিত হয়েছে সত্যেন বোসের নামে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন সত্যেন বসু এই সত্যেন বসুর নামে অ্যাকাডেমিক ভবনের নাম রাখতে পেরে আমরা নিজেরাই গৌরবান্বিত হয়েছি  অথচ মৌলবাদীদের চোখে সত্যেন বসু অস্পৃশ্য হিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয় সুতরাং তাদের দাবি হলো সত্যেন বসুর নাম রাখা চলবে না এখানে


সিলেটের শাহজালাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের হলের নাম জাহানারা ইমামের নামে রাখার সিদ্ধান্ত হবার পরে মৌলবাদীরা সেখানে পরিকল্পিতভাবে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে লিখেছিলাম সে প্রসঙ্গে। 


















Friday, 13 July 2018

এ আঁধার কাটবেই


২০০২ সালের ২৩ জুলাই গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে ভিসি আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরির আদেশে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বে পুলিশ ঢুকে বেধড়ক পিটিয়েছে ছাত্রীদের। পরের দিন ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হলে তাদের উপর আবার হামলা করা হয়। শিক্ষকরাও বাদ যাননি। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই সময়ের প্রতিক্রিয়া। 





ভিসি আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরি








Monday, 9 July 2018

প্রাপক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস




শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের সন্তান সুমন জাহিদ মারা গেছেন ১৪ জুন ২০১৮। আমরা এখনো নিশ্চিত নই তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে। তিনি কি আত্মহত্যা করেছেন, না কি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে আমরা জানি না। চির-প্রতিবাদী সুমন জাহিদ জীবনে প্রতিবাদ করেছেন, লড়াই করেছেন কত ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে ডক্টর ইউনূস যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন - সেই সময়ের কিছু ঘটনা ধরা রয়েছে এই পুরনো লেখায় - যেখানে আছে সুমন জাহিদের প্রসঙ্গ।



প্রাপক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
প্রদীপ দেব



স্যার,

বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি দুটো খোলা চিঠি লিখে আপনি নাগরিক শক্তি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির খোলনলচে পালটে দিয়ে একটি সম্পুর্ণ নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের লক্ষ্যেই আপনার এই প্রয়াস। আপনার এই মহান প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।

আপনার নোবেল পুরস্কার পাবার সাথে সাথে সারা বাংলাদেশ একাত্ম হয়ে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, আনন্দে গর্বে এভারেস্ট শৃঙ্গে উঠে গেছে, সমস্ত রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক বিভেদ ভুলে গিয়ে নোবেল জয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। কিন্তু আপনি নিশ্চয় খেয়াল করেছেন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সে উচ্ছ্বাস বিভক্ত হয়ে গেছে। কারণ নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনূস সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য হলেও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ডঃ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে সমান নয়।

১১/০২/২০০৭ তারিখে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি আপনি চিঠি লিখে আপনার রাজনৈতিক দল গঠন করার পক্ষে বিপক্ষে মতামত চেয়েছেন। আপনি লিখেছেন, আপনার কাছে আমি এই চিঠিটি লিখছি এর জবাবে আপনার কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে একটি চিঠি পাওয়ার আশায়। আপনার মতো মানুষকে ব্যক্তিগত চিঠি লেখার সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কয়েক লক্ষ মানুষ সে মহান সু্যোগ গ্রহণ করে আপনাকে চিঠি লিখেছেন, ইমেইল করেছেন ও এসএমএস পাঠিয়েছেন। এর সবগুলো আপনি নিজেই পড়েছেন এরকম অবাস্তব চিন্তা করা উচিত নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় হলে তা আপনার কর্মীরা নিশ্চয় আপনাকে দেখিয়ে থাকবেন।

১৪/০২/২০০৭ তারিখের দৈনিক সংবাদে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের সন্তান সুমন জাহিদের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। আপনাকে লেখা এ খোলা চিঠিটি আমার কাছে মনে হয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে আপনার যোগাযোগের ঠিকানাকে মারাত্মক ভুল বলা হয়েছে। 

সুমন জাহিদ লিখেছেন, আপনার পাঠানো খোলা চিঠি যা ১১-২-২০০৭ইং সব দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করেছে, সেখানে ঠিকানায় মারাত্মক ভুল আছে। আপনারা প্রচার করেছেন যোগাযোগের ঠিকানা:

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
হাল মারস
৬/ডি, ৬৬ আউটার সার্কুলার রোড
মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।

অথচ আউটার সার্কুলার রোড নামে ঢাকা সিটি করপোরেশন-এর নথিতে এখন আর কোন সড় কের নাম উল্লেখ নেই (এই নামে কোন রোড নেই)। পুরনোটা ছিল ৬৬, বড় মগবাজার। গত ২০-৩-২০০২ইং তারিখে সিটি করপোরেশনের এক আদেশ (২১১১/প্রঃবিঃ/৪০০) বলে মৌচাক মোড় হতে মগবাজার পর্যন্ত রাস্তাটিতে এবং এর উভয় পার্শ্ব শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক নামে নামকরণ করা হয় এবং সেই সঙ্গে উভয় পাশের সব হোল্ডিং নম্বরও পরিবর্তন হয়। আপনাদের বর্তমান হোল্ডিং নং- ৫, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক। এই ভুলটা সম্ভবত অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকতে পারে। তবে এর সংশোধনটা অতি জরুরি। ১৩-১২-২০০৬ইং দৈনিক প্রথম আলো নারীমঞ্চ পাতা পড়লেই এ ব্যাপারে আপনার সব তথ্য পাবেন। আশা করি স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শহীদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করবেন। 

আশা করেছিলাম এ ব্যাপারটি আপনার নজরে আসবে। কিন্তু আপনার পরের চিঠিতেও (২২/২/২০০৭) যখন আপনি আপনার পুরনো ঠিকানাই ব্যবহার করেছেন বুঝতে পেরেছি সুমন জাহিদ সহ আমরা যে ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি আপনার কাছে তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে কি সুমন জাহিদের দেয়া তথ্য সঠিক নয়?

২২/২/২০০৭ তারিখে নাগরিকের প্রতি আপনি আপনার রাজনৈতিক দল গঠন করার ঘোষণা দিয়ে যে চিঠিটি লিখেছেন সে প্রসঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। যাঁরা আপনাকে রাজনীতিতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন তাঁদের আপনি বলেছেন, আল্লাহই মানুষকে সম্মান দেন। সম্মান নিতে হলে তাঁকেই নিতে হবে। আপনার এরকম যুক্তি মুক্তচিন্তার পরিপন্থি। যে কলুষিত রাজনীতিকে বিশুদ্ধ করার ইচ্ছায় আপনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করছেন সে কলুষিত রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগ দূষিত নেতাই কথায় কথায় আল্লাহর নাম নেন। নিজেদের ব্যর্থতার দায় অলৌকিক সৃষ্টিকর্তার ওপর চাপিয়ে দেয়া অতি পুরনো পদ্ধতি। সে পদ্ধতি আপনাকে মানায় না।

প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে আপনি লিখেছেন, আপনারা যে যে দেশে আছেন সেখানে সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তুলুন। আপনাদের কর্মস্থলে কিংবা বাড়িতে কার্যালয় স্থাপন করুন। যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করুন। ইন্টারনেটে যোগাযোগ, মতবিনিময়ের এবং মত প্রচারের যত ব্যবস্থা আছে তার সদ্ব্যাবহার করুন। দেশে আপনার নিজের গ্রামে বা শহরে সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ নিন। সম্ভব হলে একবার সপ্তাহ বা দুসপ্তাহের জন্য দেশে এসে ঘুরে যান। নিজের এলাকায় গিয়ে সংগঠন সৃষ্টি করে দিয়ে আসুন। তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার নিশ্চয়তা দিন। নিজের এলাকার সৎ ও যোগ্য প্রার্থী চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের নাগরিক শক্তিতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করুন। আমাদের সঙ্গে ই-মেইলে ক্রমাগত যোগাযোগ রাখুন এবং আপনাদের কাজের বর্ণনা দিন। আমাদের প্রতি পদে পদে পরামর্শ দিন। সম্ভব হলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পর্যন্ত চাকরি কিংবা ব্যবসা যে কাজেই থাকুন না কেন, ছুটি নিয়ে দেশে চলে আসুন। আপনার নিজের হাতেই দেশের নতুন রাজনীতি গড়ার গৌরব অর্জন করার এখনই সুযোগ। বোঝা যাচ্ছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মত আপনিও প্রবাসীদের কাজে লাগাতে চাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তাদের ভোটাধিকার প্রশ্নে আপনারও মাথাব্যথা নেই। ভোট দিতে হলে প্রবাসীদের দেশে গিয়ে ভোটার হতে হবে, ভোট দিতে হবে। আপনি লিখেছেন কর্মস্থলে আপনার রাজনৈতিক দলের কার্যালয় স্থাপন করার জন্য। কাজটি কতটুকু সমর্থনযোগ্য?

আপনার দলের হয়ে কাজ করার জন্য দীর্ঘ ছুটি নিয়ে দেশে চলে যেতে আহবান করেছেন প্রবাসী কর্মজীবীদের। রাজনীতি করার জন্য ছুটি চাইলেই কি দিয়ে দেবেন কর্তৃপক্ষ? যাঁরা দেশের ভেতরেও এলাকার বাইরে কর্মরত আছেন তাঁদের উদ্দেশ্যেও আপনি লিখেছেন, সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্র থেকে কয়েক মাস দীর্ঘ বিরতি নিয়ে বাড়ি চলে যান। দেশে বা বিদেশে কোথাও কি সম্ভব এটা? আজ গ্রামীণ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা যদি বলেন যে রাজনৈতিক কাজের জন্য দীর্ঘ ছূটি চাই দেয়া হবে তাঁকে? নাগরিক শক্তির কাজে হয়তো দেয়া হতে পারে। কিন্তু তিনি যদি হয়ে থাকেন আওয়ামি লিগের বা বিএনপির সমর্থক?

এখানেই নোবেল বিজয়ী আর রাজনীতিবিদের পার্থক্য। রাজনীতি করতে গেলে যে অনেক ওজনহীন কথা বলতে হয়, বলা হয়ে যায় তা তো আমরা আপনার দল গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই দেখতে পাচ্ছি। আমরা এখনো জানিনা আপনার আদর্শের সাথে অন্যান্য দলের আদর্শের পার্থক্য কোথায়। সব দলেই ভালো ভালো আদর্শের কথা থাকে। সে কথা কেউ রাখেনা। আপনি আপনার কথা রাখবেন এ আশা আমাদের।

একটা ছোট্ট প্রশ্ন আমাদের মনে জেগেছে। তা হলো ২১শে ফেব্রুয়ারি দেশে থেকেও আপনি শহীদ মিনারে যাননি। কেন? 


০২ মার্চ, ২০০৭।
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।

Saturday, 7 July 2018

সংস্কার! সংস্কার!!


বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা এখন চমৎকার সব সাফল্য দেখাচ্ছেন আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে। আবার একই সাথে আমাদের পুরুষ ক্রিকেট দল খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছেন না। যে কোন খেলাতেই এরকম হতে পারে। কিন্তু আমাদের উচ্ছ্বাস সবকিছুতেই বেশি। আমরা খুব আড়ম্বর করে বাড়াবাড়ি করতে পছন্দ করি। সেটা আমরা দশ বছর আগেও করেছি, এখনও করছি। এগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে এ লেখাটি লিখেছিলাম ২০০৭ সালে।











Sunday, 1 July 2018

পঞ্চমবার চ্যাম্পিয়ন



২০০১ সালে যখন বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান দখল করলো, তখন সারাদেশে ভূমিকম্পের মতো অবস্থা হয়ে গেলো। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, সুতরাং দায়িত্ব এড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু নেতারা দায়িত্বহীনের মতো মন্তব্য করলেন ইচ্ছেমতো। দুর্নীতি কমানোর কোন ব্যবস্থা নিলেন না। বিএনপিসহ সব বিরোধী দল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টকে তুরুপের তাসের মতো ব্যবহার করলো সরকারের বিরুদ্ধে।

এরপর নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলো। ২০০২ সালের দুর্নীতির রিপোর্টে বাংলাদেশ আবারো শীর্ষস্থান দখল করলো। এবার বিএনপি ক্ষমতায়। তবুও দোষ গেলো আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। কারণ ২০০১ সালের অর্ধেকেরও বেশি সময় তারা ক্ষমতায় ছিলো। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার কড়া কড়া কথা বললেন, যতটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে, তার চেয়ে অনেক বেশি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। অনেক অনেক সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয় লেখা হলো সংবাদপত্রগুলিতে। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের গায়ে আঁচড়ও লাগলো না।

২০০৩ সালে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ আবারো চ্যাম্পিয়ন হলো। এবারও আওয়ামী লীগ দায়ী? অবিশ্বাস্য হলেও সেরকমই বলা হলো। এমন সব মন্তব্য বের হলো রাষ্ট্রের উঁচু পর্যায়ের নেতাদের মুখ থেকে, শুনে মনে হলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ঘুষ খেয়েই দুর্নীতির রিপোর্ট তৈরি করেছে। আরো মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের মন্ত্রীরা ইওরোপ আমেরিকার দুর্নীতি নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে গলা ফাটিয়ে ফেললেন। সাথে অবশ্য আওয়ামী লীগের কান মলে দিতে ভুলে গেলেন না। দুর্নীতিবাজদের এবারো কিছু করা হলো না। অনেক বুদ্ধিজীবীই লিখলেন – বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, তারা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না ইত্যাদি। রিপোর্টে কিন্তু বলা আছে ঠিক কোন্‌ কোন্‌ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানে কিন্তু কোনভাবেই সাধারণ মানুষকে ঢালাওভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোন বাস্তব পদক্ষেপ না নিয়ে আবেগাক্রান্ত করে ছেড়ে দেয়া হলো ব্যাপারটা।

২০০৪ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে দেখা গেলো বাংলাদেশ আবারো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। টানা চতুর্থবারের মতো দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান দখল করেছে আমার প্রিয় বাংলাদেশ। আমরা কি তবে দুর্নীতির সেরা আসনটি পাকাপাকি ভাবেই পেয়ে গেলাম?

বাংলাদেশে মূলত দুইটি রাজনৈতিক দল আছে। একটা আওয়ামী লীগ, অন্যটি হলো অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের পান থেকে চুন খসলেও যেরকম ঝড় ওঠে, সারাদেশ  দুর্নীতি আর  সন্ত্রাসের দায়ের কোপে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরেও সেরকম কোন ঝড়ের চিহ্ন নেই। কারণটা কি ভয়? নাকি আসলেই খুব সুখে আছে বাংলাদেশের মানুষ??

২০০৫ সালের রিপোর্টেও বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এবার অবশ্য আফ্রিকান দেশ চাদও সঙ্গী হয়েছে। 


Friday, 22 June 2018

প্রসঙ্গ: বাংলাদেশের শিক্ষা



বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু শিক্ষা-ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ সন্তুষ্ট আছেন বলে আমার মনে হয় না। স্বাধীনতার আগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল আমি জানি না। তবে মনে হয় গুণগত মান আজকের তুলনায় খুব একটা খারাপ ছিল না। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের প্রায় সবাই তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফসল। অনেককেই বলতে শুনি - স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতীয় পরীক্ষায় গণ-নকলের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষায় দুর্নীতির বীজ রোপিত হয়। তারপর আমরা পড়ছি তো পড়ছিই। এই পড়া মানে পড়াশোনা নয়, এই পড়া হলো পতন। আমি জানি এতটা জেনারালাইজড করে ফেলা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু শিক্ষার সামগ্রিক পতনের কাছে আমাদের অর্জন এতটাই সামান্য যে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করলে নিজেকেই ফাঁকি দেয়া হয়।
           
স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে নানারকম ব্যবস্থা-অব্যবস্থার কমিটি গঠিত হয়েছে। একটা গঠনমূলক পরিপূর্ণ শিক্ষানীতির লক্ষ্যে অনেকগুলো কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ এখনো কিছু হয়নি। শিক্ষায় আমাদের প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী, শিক্ষক সবকিছুরই সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু কমে গেছে গুণগত মান। একসময় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে পরিচিত ছিল - সে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান আজ বিশ্বের প্রথম পাঁচহাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একেবারে শেষের দিকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাদের বেশির ভাগেরই যেন তাতে কিছুই যায় আসে না।
           
সত্যি বলতে কী - বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ শুধুমাত্র সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামেই এত  ব্যস্ত যে তাঁদের ওপর যখন যা চাপিয়ে দেয়া হয় তারা তা মেনে নিতে বাধ্য হন। যখন যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে তখন তারা তাদের মত করে একটা কিছু পরিবর্তন করে - আর জনগণ তা বাধ্য হয়ে মেনে নেয়।   

১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১ম শ্রেণী থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। এই বিশ বছরের আমার বাংলাদেশী ছাত্রজীবনে নানারকম প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আন্দোলন দেখেছি - কিন্তু একবারও অতি প্রয়োজনীয় শিক্ষা-আন্দোলন ঘটতে দেখিনি। ছাত্র-ইউনিয়ন সহ কয়েকটি বাম সংগঠন মাঝে মাঝে শিক্ষা-আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে - কিন্তু তাও সীমাবদ্ধ থেকেছে শিক্ষা-উপকরণের দাম কমানো, টিউশন ফি কমানোর স্লোগানে। শিক্ষকরাও নানারকম আন্দোলন করেছেন - তাদের বেশির ভাগই হলো রাজনৈতিক কারণে কিংবা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। সুতরাং আমাদের সবার চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের শিক্ষাকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে।
           
যে সিস্টেমের ভেতর দিয়ে লেখাপড়া করে এসেছি তার বাইরেও কোন সিস্টেম - বা অন্যরকম ভালো কোন সিস্টেম থাকতে পারে তা আমি জানতামই না দেশের বাইরের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার আগে।

দেশের বাইরে এসে আমরা যারা অন্যদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে কিছুটা পরিচিত হই - তখন মনে হয় - আহা যদি আমাদের দেশেও এরকম হতো! সে তাড়না থেকেই আমরা আমাদের মনের কথা লিখে জানাই। জানি আমাদের কথায় কেউ কান দেবে না। দেশের কোন পরিবর্তন আমরা করতে পারবো না। তবুও নিজের কাছে একটা সান্ত্বনা থাকবে - আমরা যেটুকু জানি বা জেনেছি তা জানাতে চেয়েছিলাম। ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন - দেশের বাইরে থাকতে তিনি একবারও দেশের কোন ব্যবস্থার সমালোচনা করে কিছু লেখেননি। তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে দেশে ফিরে গিয়ে একটা শক্তিশালী অবস্থানে আসা। যেটা আমাদের অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসার প্রকাশ হলো দেশের জন্য উদ্বেগ। তাই আমাদের লেখায় দেশের অনেক ব্যবস্থার সমালোচনা থাকে। সেটা দেশকে ছোট করার জন্য নয় - বরং দেশের উন্নতিতে যদি সামান্যও কোন কাজে আসি সে আশায়।


আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার পুরোটাই এখন পরীক্ষার ফলাফল নির্ভর। লেখাপড়া করার মূল উদ্দেশ্য এখন পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা, কোন কিছু শেখা নয়। এই ফলাফলের জন্য আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের দিনরাত মুখস্ত করা ছাড়া আর কোন কাজ তেমন নেই। অভিভাবকরা বাকি সব কাজ নিজেরাই করে দেন; অন্তঃত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগ-পর্যন্ত। একটু খেয়াল করলেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে:

  • স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা খুব খারাপ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা এখনো নেয়া হচ্ছে না। শহর পর্যায়ে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনো হতাশাজনক না হলেও গ্রাম-পর্যায়ের স্কুল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। তার মানে আগামী দশ বছর পরে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকেরও অভাব দেখা দেবে। ইউনিভার্সিটি পর্যায়েও এখন মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ের কোন কদর নেই। 
  • শহরের নামী স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য কত কোটি টাকার ব্যবসা চলছে তার যদি সঠিক পরিসংখ্যান থাকতো - আমরা দেখতে পেতাম - ভর্তি বাণিজ্যে এখন কত লাভ! অভিভাবকরা ভর্তি-বণিকদের হাতে জিম্মি। ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে পারলে ছেলে-মেয়ে ভাল পড়াশোনা শিখবে - এটাই যে প্রধান লক্ষ্য তা বলা যাবে না। তথাকথিত ভালো স্কুলগুলো ঠিক কোন মাপকাঠিতে ভাল তার কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম আমাদের জানা নেই। হয়তো বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন আর প্রচারের কল্যাণে।
  • বছর দশেক আগেও দেখা যেতো একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল কলেজ থেকেও কোন না কোন শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ের মেধাতালিকায় স্থান পাচ্ছে। এখন সে সংখ্যা কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে পৌছেছে। এখন গ্রামের স্কুল-কলেজগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। গ্রামেও যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সামান্য ভালো - তারা তাদের ছেলেমেয়েদের শহরের স্কুলে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেন। আর শহরের অলিতে গলিতে এখন ইংরেজি বাংলা মেশানো নানারকম নামের নানারকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি সেন্টার, সেলুন, সুপারমার্কেট সব একসাথে দেখা যায়। প্রচুর উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে এখন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হচ্ছেন - কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মান একটুও বাড়ছে না। 
  • বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পেছনে যত সময় ব্যয় করে তা উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষার্থীর চেয়ে অনেক বেশি। একবার স্কুল-কলেজের ক্লাস করে প্রায় প্রত্যেকেই আবার কোচিং সেন্টারে যায়। 
  • বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন খুব কম। গ্রামের শিক্ষকদের অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। কিন্তু শহরের নামী কোন স্কুল-কলেজের শিক্ষক হতে পারলে এবং নীতি বিসর্জন দিয়ে সুযোগের সদ্‌ব্যাবহার করতে জানলে শিক্ষকদের পক্ষে মাসে লাখ টাকা উপার্জন করা এখন কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তারপরও শিক্ষকতা পেশায় কেউ আসতে চান না। সে কারণেই দেখা যায় - বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষকতার অপশানের চেয়ে পুলিশের বা কাস্টমসের চাহিদা কয়েকশ গুণ বেশি। এর কারণ কী তা  বাংলাদেশের নিরিখে আমরা সবাই জানি। 
  • স্কুলে এখন ধরতে গেলে ক্লাস ওয়ান থেকেই ধর্মশিক্ষা পড়ানো হয়। আর ধর্ম মানেই বিভাজনের শিক্ষা দেয়া। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান এই আলাদা পরিচয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় শিশুদের মনে। যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক সেদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হবে এটাই স্বাভাবিক। ধর্ম শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদি নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে গত ৩৫ বছর ধরে যে দেশের স্কুলে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক - সেদেশে তো কোন দুর্নীতি থাকার কথা নয়।  
  • ব্যবসায়ীরা যখন স্কুল-কলেজ খোলেন তখন তা তাদের অন্য ব্যবসার মত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে আমরা তাদের গালাগালি করি ঠিকই- আবার আমরাই টাকার লোভে ছুটে যাই সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিছু দাক্ষিণ্য পেতে। বাংলাদেশে এখন অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সেখানে সরকারী মেডিকেল কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ঘন্টায়  দশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে ক্লাস নিতে যান। তো এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তো তৈরি হয়েই যায়। এখন বেসরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে শুরু করে কী নেই! কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তো টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি বেচে। 
  • আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতি এবং দুর্নীতি এত বেশি ভূমিকা রাখে যে 'সবার জন্য শিক্ষা'র ব্যাপারটা কার্যকর করা খুবই কঠিন।


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা-পরিকল্পনা থাকে। দেশের জনসম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য এবং দক্ষ জনশক্তির নিয়মিত জোগান দেয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে। শিক্ষা গবেষণা যে কোন দেশের জন্যই খুবই দরকারি একটি বিষয়। আমাদের দেশের শিক্ষা নিয়ে কতটুকু গবেষণা হয় আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু দেখি মন্ত্রণালয়ে কিছু ক্ষমতাশালী মানুষ টুকটাক সভা করেই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এভাবে কাজের কাজ কী হচ্ছে তা তো আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি।

Thursday, 21 June 2018

যুক্তি হোক মুক্তির সোপান



২০০৭ এর বইমেলায় প্রকাশিত যুক্তি পত্রিকাটি দুরন্ত সাহসের প্রতিচ্ছবি। সম্পাদক অনন্ত দাস দুঃসাধ্য একটি কাজ করেছেন যুক্তি প্রকাশের মাধ্যমে। মুক্তমনায় ইলেকট্রনিক বই আকারে যুক্তি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৭ এর এপ্রিলে। সে সময়েই যুক্তি আমার হাতে এসেছে। তখন দ্রুত চোখ বুলিয়ে গিয়েছি। কিছু কিছু লেখা মুক্তমনার ওয়েব সাইটে আগেই প্রকাশিত হয়েছিলো। তার সাথে বেশ কিছু নতুন লেখা নিয়ে সমৃদ্ধ যুক্তি। নানারকম কাজের মাঝে কয়েকবার চেষ্টা করেছি দ্রুত পড়ে ফেলতে। কিন্তু যুক্তির লেখাগুলো দ্রুত পঠনের জন্য নয়। এগুলো পড়ে আত্মস্থ করাটা খুব জরুরি। এ বোধ থেকে যুক্তি পড়েছি অনেক সময় নিয়ে। এখন এক ধরনের তাড়না অনুভব করছি এ সম্পর্কে দুটো কথা বলার।



ষোল জন যুক্তিবাদী মানুষের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে যুক্তির প্রচ্ছদে। এই অসাধারণ মানুষগুলো আমাদের হাজার বছরের ক্রমাগত চিন্তার অন্ধ অনুকরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নতুন ভাবে নতুন দৃষ্টিকোণে ভাবনার নতুন যুক্তির খোরাক যুগিয়েছেন। যুক্তির প্রচ্ছদে এঁদের স্থান দেয়ায় যুক্তি সমৃদ্ধ হয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে ভেতরের কোন পাতায় প্রচ্ছদের ছবিগুলোর পরিচিতি থাকলে অনেকের জন্য সুবিধে হতো। বিশেষ করে যাঁরা এঁদের নামের সাথে পরিচিত হলেও হয়তো ছবির সাথে নন।

যুক্তির সম্পাদকীয়তে চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যুক্তির প্রয়োজনীয়তা। তবে একটা ব্যাপারে সম্পাদকের সাথে আমার একটু মতদ্বৈততা আছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, এই সংখ্যায় প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকগণের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, অভিমত এবং তথ্য সংকলন; এর সাথে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল কোনোভাবেই (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে) সম্পৃক্ত নয়। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল যুক্তির প্রকাশক। যুক্তিতে প্রকাশিত লেখাগুলো নিশ্চয়ই বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের মানসিকতার সাথে মিলে যায়। যুক্তিবাদী কাউন্সিলের নিজস্ব মতবাদ আছে বলেই যুক্তি তাদের মুখপত্র। একান্ত ব্যক্তিগত লেখা যুক্তিতে হয়তো চিঠি আকারে প্রকাশিত হতে পারে, কিন্তু পূর্ণ রচনা প্রকাশিত হলে প্রকাশকের উপর কিছুটা দায়িত্ব এসেই পড়ে যা এড়ানোর চেষ্টা করা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।

যুক্তির প্রত্যেকটি লেখাই আমাদের চিন্তার জগতে বিরাট সংযোজন হিসেবে কাজ করবে। প্রফেসর অজয় রায়ের বিজ্ঞান ভাবনা ব্রুনো থেকে আরজ আলী মাতুব্বর-এ যে সাহসী উচচারণে প্রশ্ন করা হয়েছে, ডঃ হুমায়ূন আজাদের খুনিরা কিংবা সাংবাদিক ও বিচারকদের হত্যাকারীরা যদি বলে যে আমাদের ইচ্ছে শক্তি নেই - আমরা তো কলের পুতুল আল্লাহ্‌র ইচ্ছেতেই চলি, কাজ করি, আল্লাহ্‌ই আমাদেরকে দিয়ে হুমায়ূন আজাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন, সাংবাদিক ও বিচারকদের হত্যা করিয়েছেন। সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে যদি কোরানের এসব বাণী উপস্থাপন করা হয়, তাহলে মাননীয় আদালত কী করে কোরানের বাণীর বিপরীতে কাজ করবেন! সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার জানা। নিজেদের স্বার্থে নিজেদের পছন্দমত সৃষ্টিকর্তাকে ব্যবহার করার জন্যই মানুষ সৃষ্টিকর্তার ধারণা তৈরি করে নিয়েছে এবং তাকে সুবিধে মত ব্যবহার করে চলেছে। সে কারণেই সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত বেশির ভাগ যুক্তিই স্ববিরোধিতায় ভরা।

অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদ, জাহেদ আহমদ তাঁদের রচনায় স্বমহিমায় ভাস্বর। ফরিদ আহমদ এর মোহনীয় মোনালিসা ভিন্ন স্বাদের গবেষণাধর্মী রচনা। লিওনার্দো দা ভিন্‌চির মোনালিসা নামের মোহময়ী ছবিটির কতরকম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এখন সম্ভব হচ্ছে তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। একটি ছবি - অথচ কতমাত্রিক তার বিশ্লেষণ। মিহির কান্তি চৌধুরীর ড্যান বার্কারের রচনা থেকে অনুবাদটি সুখপাঠ্য। তবে মূল লেখকের পরিচিতি থাকলে ভালো হতো।

যুক্তির এই সংখ্যায় একটি মাত্র কবিতা স্থান পেয়েছে - মৌ মধুবন্তীডঃ ইউনূস - শান্তি পুরষ্কার। সত্যি বলতে কী - আমার মনে হচ্ছে যুক্তির এই সংখ্যার সবচেয়ে দুর্বল অংশ হলো এ কবিতাটির সংযোজন। কবিতায় কবি আসলে কী বলতে চেয়েছেন এবং কেন তা যুক্তির দৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য হলো তা বুঝতে পারছি না। কবিতার কয়েকটি লাইন এরকম,

কোলে নিয়ে নাচো অমর্ত্য সেনে
এখনো হয়ে আছো গোবেচারা
বাঙালি
হওনি এখনো অহংকারী বাংলাদেশী
তোমাদের নেই কোন বাদ্যযন্ত্রী
নেকাব ছাড়া বাংলার মন্ত্রী

কী বোঝাতে চেয়েছেন কবি এখানে? অমর্ত্য সেন আর ডঃ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমাদের স্পষ্ট বিভাজন থাকা দরকার? আমাদের বাঙালি হওয়ার চেয়েও বাংলাদেশী হওয়া বেশি জরুরি? আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ বাদ্যযন্ত্রী নেই? বাংলার মন্ত্রীর নেকাব থাকা জরুরি? অযৌক্তিক কথামালা দিয়ে অনেক কবিতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু তা যুক্তিতে স্থান পাবে কেন? আসলে মৌ মধুবন্তীর কবিতাটি মোটেও কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। যা হয়েছে তা যুক্তির মূল বৈশিষ্টের পরিপন্থী।

যুক্তির মুক্তমনা ই-বুকের ভূমিকায় অভিজিৎ রায় বলেছেন, অনন্ত বিষবৃক্ষের পাতায় পাতায় কাঁচি চালায়নি, বরং কুঠারের কোপ বসিয়েছে একদম গভীরে, বিষবৃক্ষের গোড়াতেই। অভিজিৎ রায়ের সাথে একমত হয়ে এটুকু বলতে চাই যে - বিষবৃক্ষের গোড়ায় কোপ মেরে থেমে থাকার কোন সুযোগ নেই। কারণ বিষবৃক্ষের প্রতিটি শাখা থেকে জন্ম নেয় নতুন নতুন বিষবৃক্ষ। তাই যুক্তির অস্ত্রে নিয়মিত শান দেয়ার জন্য অযৌক্তিক কুযুক্তির বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য যুক্তি নিয়মিত প্রকাশিত হবে এটাই কাম্য। যুক্তি হয়ে উঠুক মুক্তির সোপান। অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি, কুসংস্কার থেকে মুক্তি, উপাসনা ধর্মের অন্ধ শিকল থেকে মুক্তি।


ফেব্রুয়ারি ৯, ২০০৮
তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া।
******

অনন্তবিজয় দাস যুক্তির যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত। ২০১৫ সালের ১২ মে অনন্তকে হত্যা করে মৌলবাদী জঙ্গিরা। 

২০ জুন ২০১৮
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts