Sunday 31 March 2019

ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন - পঞ্চম পর্ব




১১ জুলাই ১৯৯৮ শনিবার

আজ নিয়ে তিনদিন কাটলো মেলবোর্নে। তুমি এখন কী করছো? আমি সারাদিন সারাসন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে এখন তোমাকে লিখতে বসলাম। অবশ্য সারাদিন বলা ঠিক হচ্ছে না, বলা উচিত অর্ধেক দিন। কারণ আজ রুম থেকে বেরিয়েছি এগারোটার পর।
            আজ সকালেও ঘুম ভেঙেছে টেলিফোনের শব্দে। মনে হচ্ছে এদেশে টেলিফোনগুলো এলার্মের কাজও করে দেয়। ধড়ফড় করে উঠে মাথার কাছে রাখা রিসিভারের দিকে হাত বাড়াতেই প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম। শুধু হাতে নয়- হাঁটুতেও প্রচন্ড ব্যথা। মাথা ঝিমঝিম করছে। আবার শুয়ে পড়লাম। দুটো রিং হয়েই ফোন অফ হয়ে গেছে। কে করেছিল কে জানে।
            কাল রাতে জ্বর এসেছিল। দুটো প্যারাসিটামল খেয়েছি। কনুই আর হাঁটুতে সেভলন লাগিয়ে দিয়েছি। আর নিজেকে কষে ধমকে দিয়েছি- পৃথিবীজুড়ে কত মানুষ কত রকমের কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে টিকে থাকছে- আর আমার সামান্য এক ধাক্কাতেই গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে গেলো? এত পুঁতুপুঁতু হলে চলবে না। কঠিনেরে ভালোবেসেছি, সুতরাং  কঠিন হতে হবে আমাকে।
            ডিমলাইটের আলোয় আবছা আলোছায়া রুমের ভেতর। মনে হচ্ছে- সকাল হয়নি এখনো। বালিশের নিচে রাখা হাতঘড়িটা চোখের সামনে ধরে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি! বাংলাদেশে এখনো সাড়ে ছটা বাজে। সে হিসেবে খুব একটা বেশি নয়। জেটল্যাগ এখনো কাটেনি। জেটল্যাগের নাকি একটা নিয়ম আছে। প্রতি ঘন্টা সময়ের পার্থক্য এডজাস্টের জন্য একদিন সময় লাগে। সে অনুযায়ী কালকের মধ্যেই আমার জেটল্যাগ কেটে যাবে। সোমবার থেকে মেলবোর্নের সময় অনুযায়ীই ঘুম ভাঙবে।
                এতক্ষণ ঘুমিয়েছি ভেবে অস্বস্তি লাগছে। আবার ব্যথার জন্য উঠতেও পারছি না। রুম-হিটারের কারণে রুমের ভেতর আরামদায়ক উষ্ণতা। লেপের নিচে কুন্ডুলি পাকিয়ে আছি। কিন্তু না, শরীরকে এতবেশি প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হচ্ছে না। জোর করে উঠে গেলাম। নিজেকে একপ্রকার ঠেলে নিয়ে গেলাম বাথরুমে। রুমের বেসিনে হাতমুখ ধোয়া যায়, দাঁতব্রাশ করা যায়। কিন্তু টয়লেট আর শাওয়ারের জন্য বাথরুমে যেতেই হয়। করিডোরেও হিটার আছে। কিন্তু বাথরুমে কনকনে ঠান্ডা। টয়লেট পেপারে এখনো অভ্যস্ত হইনি। প্রায় আধরোল শেষ করার পরও অস্বস্তি যায় না। গরম পানির শাওয়ার নিয়ে তবে স্বস্তি। রুমে এসে ঝটপট বেরিয়ে পড়লাম। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা।
            সোয়ান্সটন স্ট্রিটে বেশ ভীড় আজ। শনি রবি ছুটির দিন। তাই ছুটির আমেজে আছে সবাই। বেশ কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি চলছে রাস্তায়। অনেক ট্যুরিস্ট মজা করে চড়ছে ওখানে। সোয়ান্সটন স্ট্রিটের বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট ফুটপাতের উপর ঘেরা দিয়ে চেয়ার টেবিল বসিয়ে রেস্টুরেন্টের জায়গা বাড়িয়ে নিয়েছে। এর জন্য এদের কাউকে চাঁদা দিতে হয় কিনা জানি না। মনে হয় এদের পারমিশান আছে এরকম করার। অনেক ছোট ছোট নিউজ এজেন্ট দেখলাম ফুটপাতে। নানারকম ফলের দোকানও আছে কয়েকটা।
                একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে মেনু দেখছি। ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা মেনু। ব্রেকফাস্ট মেনু, আরেকটা আছে ব্রাঞ্চ মেনু। ব্রাঞ্চ বস্তুটা কী ঠিক বুঝতে পারছি না। ব্রাঞ্চ মানে তো শাখা। খাবার দাবারেরও শাখা-প্রশাখা আছে নাকি এখানে?
                ডু ইউ লাইক টু অর্ডার সামথিং?
                মেয়েটিকে দেখে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্নটি এলো তা হলো- এদের কি ঠান্ডা লাগে না? এই হাড়-কাঁপানো শীতে সোনালী চুলের মেয়েটি শুধুমাত্র একটা টি-শার্ট পরে আছে। আর কালো ট্রাউজারের উপর কোমরে বাঁধা একটি কালো এপ্রোন। ভয়ানক মোটা বলেই হয়তো তার ঠান্ডা লাগছে না। কিন্তু ঠান্ডায় আমি রীতিমত কাঁপছি। মেয়েটি হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার অবস্থা। বললো, ইউ ক্যান সিট ইনসাইড
                রেস্টুরেন্টের কাউন্টারের পেছনেও ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা মেনু। ইচ্ছেমত আপডেট করার জন্য ব্যবস্থাটা ভালোই। “Breakfast Special for only $3.50”- সাড়ে তিন ডলার এদের কাছে মাত্র হলেও আমার কাছে একশ পাঁচ টাকা। এরচেয়ে কমে এখানে আর কিছুই পাওয়া যায় না। স্পেশাল ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে দাম মিটিয়ে দেবার পর নম্বর লেখা ছোট্ট স্ট্যান্ডের মত একটা জিনিস দেয়া হলো। ওটা নিয়ে ভেতরের একটা টেবিলে বসলাম। বাইরে ফুটপাতের চেয়ার টেবিলে ভেতরের চেয়ে বেশি ভীড়। এত ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বসে খেতে কারো কষ্ট হচ্ছে বলে মনেই হচ্ছে না। পাশের টেবিলে চার-পাঁচজন চায়নিজ ছেলেমেয়ে উচ্চস্বরে গল্প করছে। তাদের একজনের কথা কানে এলো- ব্রেকফাস্ট প্লাস লাঞ্চ ইজ ব্রাঞ্চ। এতক্ষণে বোঝা গেল ব্রাঞ্চ মানে কী।
                হিয়ার ইউ গো। ব্রেকফাস্ট স্পেশাল। বেশ বড় একটা প্লেট টেবিলে রেখে গেল বিশালদেহী মেয়েটি। প্লেটের একদিকে কাঁচা টমেটো আর শাকপাতার সাথে একটা ডিম পোজ। অন্যদিকে দুপিস পাউরুটি আর দুই ফালি তেল জবজবে মাংস। কিসের মাংস জানি না। জানার দরকারও নেই। ডিমটা আধাকাঁচা, মাংসের অবস্থাও তথৈবচ। দেখেই গা গুলোচ্ছে আমার। কিন্তু খাবার নিয়ে এত বাছবিচার করার কোন মানে হয় না। গপ গপ করে খেয়ে নিলাম সব। এবার পেটের ভেতর যুদ্ধ শুরু না হলেই বাঁচি।
                অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়ি আজ সোয়ান্সটন স্ট্রিটে। ফুটপাতে নানা দেশের নানারকম মানুষ। শীতের পোশাকের কত রকম বৈচিত্র্য। পায়ে চাকা লাগানো জুতো পরে ফুটপাত দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে অনেকে। একটা টু-ডলার শপে ঢুকেছিলাম। সেখানে বেশির ভাগ আইটেমের দাম দুই ডলার। গত মঙ্গলবার সারাদিন রেয়াজুদ্দিন বাজারের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে দাদা আমার জন্য বিদেশীমোজা, টুথপেস্ট ইত্যাদি সব দরকারি জিনিস জোগাড় করেছে। এখানে দেখলাম সবগুলো জিনিসই পাওয়া যাচ্ছে- বাংলাদেশের চেয়েও কম দামে।
                সোয়ান্সটন স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে। ছুটির দিনেও ক্যাম্পাসে অনেক ছেলে-মেয়ে। ইতস্তত ঘুরলাম অনেকক্ষণ। এই বিশাল ক্যাম্পাসের পুরোটা কি কখনো দেখা হবে আমার?
            গ্রাটান স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে লাইগন স্ট্রিট- রেস্টুরেন্ট পাড়া। রাস্তার দুপাশের ফুটপাত রেস্টুরেন্টের দখলে চলে গেছে। সারি সারি চেয়ার টেবিল পাতা। প্রচন্ড ভীড় শনিবারের দুপুরে। বাইরে ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচার জন্য প্লাস্টিকের তাবুর মত করা হয়েছে। বড় বড় গ্যাস-হিটারের ব্যবস্থাও আছে। মনে হচ্ছে বেশির ভাগই ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট এখানে। মাসুদ সাহেব বলেছিলেন এদিকে কোথাও সুপারমার্কেট আছে। একজন বয়স্ক চায়নিজ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলেন।
            লাইগন কোর্ট কার্লটন সাবার্বের শপিং সেন্টার। এর আন্ডারগ্রাউন্ডে সেফওয়ে সুপারমার্কেট।  এমন বিশাল সুপার মার্কেট আগে দেখিনি কখনো।  কয়েক শ মানুষ শপিং বাস্কেট হাতে নিয়ে বা  শপিং ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বাজার করছে। যার যা লাগে শেল্‌ফ থেকে নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে দাম মিটিয়ে চলে যাচ্ছে। আমিও একটা বাস্কেট নিয়ে ইংলিশ মাফিন আর আপেল কিনলাম। দেখলাম ফুটপাতের দোকানের চেয়ে এখানে জিনিসপত্রের দাম অনেক কম।
            কাউন্টারে দাম দিতে গিয়ে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার দেখে অবাক হলাম। এর আগে বড় দোকান বলতে রেয়াজুদ্দিন বাজারের পাইকারি দোকান দেখেছি। সেখানে ক্যাশিয়ার লম্বা কাগজে জিনিসের নাম লেখেন, দাম লেখেন আর ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসেব করেন। এসব দেখেই আমার মনে হতো- ওরে বাবা কত্তো কাজ! আর এখানে কাউন্টারে কম্পিউটারই সব করে দিচ্ছে। স্ক্যানারে জিনিস-পত্র স্ক্যান করতেই কম্পিউটারে তার হিসেব লেখা হয়ে যাচ্ছে। আর দাম মিটিয়ে দিলে প্রিন্টার থেকে ছাপানো রসিদ বেরিয়ে আসছে। অনেকেই দেখলাম নগদ ডলারের বদলে ব্যাংক কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। মনে হচ্ছে আসল টাকা-পয়সার ব্যবহার আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। হাত থেকে হাতে ঘুরে বেড়ায় যে মুদ্রা- তা এখন সরাসরি একাউন্ট থেকে একাউন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  
            হোটেল রুমে চা, কফি, দুধ আর চিনি ফ্রি। চা, কফি আর চিনির অনেকগুলো ছোট ছোট প্যাকেট প্রতিদিন রেখে যায়। কেবল দুধটা নিয়ে আসতে হয় কাউন্টার থেকে। দুধ আনতে গিয়ে আজকেও দেখা হলো মাসুদ সাহেবের সাথে। কিছুক্ষণ কথা হলো। আমার একটা বাসা দরকার, পার্ট-টাইম চাকরি দরকার। কিন্তু কীভাবে পাওয়া যায় বা কীভাবে খুঁজতে হয়- কিছুই জানি না। মাসুদ সাহেব বললেন, শনিবার আর বুধবারের এজপত্রিকায় পার্ট-টাইম জব আর বাড়িভাড়ার অনেক বিজ্ঞাপন থাকে। আজ শনিবার। আজকের পেপারটা দেখতে হবে।
            বাংলাদেশে পত্রিকা না কিনেও পড়া যায়। ফুটপাতে বসে যারা পেপার বিক্রি করে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে নিলেই হলো। এখানে সেরকম কোন ব্যবস্থা নেই। নিউজ এজেন্টে ঢুকে ম্যাগাজিনগুলো না কিনেই পড়ে ফেলা যায় আগাগোড়া। কিন্তু পেপার ওভাবে পড়ার সুযোগ নেই।
            আজকের দি এজ পত্রিকার দাম দেড় ডলার। একশ পঞ্চাশ পৃষ্ঠার শনিবারের কাগজ। খবর বলতে কিছুই নেই। প্রথম পৃষ্ঠায় বিরাট করে খেলার খবর। ভেতরের সবগুলো পাতাই নানারকম বিজ্ঞাপনে ভর্তি। এমপ্লয়মেন্ট, একোমোডেশান, ড্রাইভিং ইত্যাদি সব আলাদা আলাদা সেকশান। একোমোডেশান সেকশানে শত শত ঘরভাড়ার বিজ্ঞাপন। সপ্তাহে একশ ডলারের নিচে কিছুই নেই। তদুপরি আমি তো কোন জায়গাই চিনি না এখনো। ঠিকানা দেখে বুঝতে পারছি না জায়গাটা কোথায়। সুতরাং এভাবে হবে না। আর পার্ট-টাইম চাকরির বিজ্ঞাপন যেগুলো আছে তার কোনটাই আমার জন্য নয় মনে হচ্ছে। যে সব যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে তার কিছুই তো আমার নেই। খুব একটা আশাবাদী হতে পারছি না।
            আবার জ্বর আসছে। অসহ্য মাথাব্যথা। প্যারাসিটামল কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে নাকি? এখানের মেডিকেল সার্ভিস কীভাবে কাজ করে জানি না এখনো। আসার আগেই ওভারসিজ স্টুডেন্টস হেল্‌থ ইন্সুরেন্স বাবত ২৭৪ ডলার দিতে হয়েছে। ওটা কী কাজে লাগবে তাও জানি না। কিছুই তো জানি না আমি। বুঝতে পারছি- জ্বরের প্রভাব মাথার ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে। কনফিডেন্স লেভেল কমে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। আত্মবিশ্বাস না থাকলে আমার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আত্মবিশ্বাস হারালে চলবে না।
            বাবার কথা মনে পড়ছে- মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে নিজের শরীর- যখন সুস্থ-সবল থাকে। আবার এই শরীরই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় শত্রু- যখন অসুস্থ হয়ে যায়। শরীরের তাপমাত্রা ক্রমশঃ বাড়ছে। একটা লম্বা ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করলেই স্মৃতির গর্ত থেকে উঠে আসছে এলোমেলো টুকরো টুকরো স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের দিনগুলো।
            স্বপ্নের পরিধি আমার কখনোই খুব বেশি ছিল না। ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট ভালো হবার পর স্বপ্ন দেখেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর। কোন অন্যায্য স্বপ্ন ছিলো না সেটা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমার অযোগ্যতা অনেক- ভুল সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া, কোন ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ না থাকা, এবং সর্বোপরি কোদালকে কোদাল বলার স্বভাব। এই অমার্জনীয় অযোগ্যতা নিয়ে আমি অনেকগুলো ইউনিভার্সিটির অনেকগুলো সিলেকশান কমিটির মুখোমুখি হয়েছি। কমনওয়েল্‌থ স্কলারশিপ সিলেকশান কমিটির স্বরূপ দেখেছি, দেখেছি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের শিক্ষাবৃত্তিগুলো পাওয়ার পরও কীভাবে হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে যায়। বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রসঙ্গে অপমান সইতে হয়েছে আমাকে। স্বপ্ন ভেঙেছে, কিন্তু পিছু ছাড়েনি। আবার স্বপ্ন দেখেছি-  উচ্চতর শিক্ষার স্বপ্ন, নিজেকে যোগ্য করে তোলার স্বপ্ন।
            কিন্তু স্বপ্নপূরণের যে রসদ লাগে তার জোগাড় যে কীভাবে হয়েছে তা কি তুমি জানো? তবুও ভালো যে চট্টগ্রাম শাহীন কলেজে চাকরিটি পেয়েছিলাম। ওটা না থাকলে দেশের বাইরের ইউনিভার্সিটিগুলোতে দরখাস্ত করার টাকা জোগাড় করতেও কষ্ট হতো আমার। টোফেল, জি-আর-ই, আই-ই-এল-টি-এস এসবের ফি-ও তো অনেক। দেশের বাইরে পড়ার খরচ যে কত বেশি তা বুঝতে শুরু করলাম- আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ভর্তির অফার লেটারগুলো আসতে শুরু করার পর। তারা স্কলারশিপের আশ্বাস দেয়, কিন্তু অফার দেয় না। ফুল ফি পেয়িং স্টুডেন্ট হিসেবে ভর্তি হতে গেলে যা খরচ হবে তা জোগাড় করতে হলে আমার বাবার যা কিছু আছে সব বিক্রি করতে হবে। তাছাড়া ভিসা পেতে হলে নাকি পুরো কোর্সের টিউশন  ফির চেয়ে বেশি টাকা ব্যাংকে থাকতে হয়। সুতরাং স্কলারশিপ ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।।    আমার চারপাশে এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে সঠিক পরামর্শ পেতে পারি। একেক জনের কাছ থেকে একেক ধরনের কথা শুনি। আমার ইউনিভার্সিটির টিচাররাও তেমন কোন তথ্য দেন না। অনেকটা অন্ধের পথ চলার মত হাতড়ে হাতড়ে এগোতে হয়েছে আমাকে। অবশেষে চার বছর চেষ্টার পর মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির রিসার্চ স্কলারশিপটি পেলাম।
            স্কলারশিপের চিঠিটি পেয়ে খুশির প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাবার পর বাস্তবতা আমাকে চুপসে দিলো আবার। এই স্কলারশিপ মানেই আমার সব সমস্যার সমাধান নয়। এই স্কলারশিপ টিউশন ফি কভার করে না। তবে এটা দিয়ে টিউশন ফি দেয়া যাবে। কিন্তু থাকা খাওয়ার খরচ পার্ট-টাইম কাজ করে জোগাড় করতে হবে। সেটা তেমন বড় সমস্যা নয়। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো ভিসা পাওয়া।
            অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনে যোগাযোগ করলাম। স্কলারশিপ থাকাতে অনেকটা পজিটিভলি দেখা হবে আমার ভিসার দরখাস্ত। তবে তিন বছরের টিউশন ফির সম-পরিমাণ টাকা আমার নিজের বা আমার অভিভাবকের ব্যাংক একাউন্টে থাকতে হবে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। টাকা লাগবে না- অথচ টাকা থাকতে হবে ব্যাংকে। ব্যাংকের স্টেটমেন্ট জমা দিতে হবে ভিসার দরখাস্তের সাথে।
            হাই কমিশনের বাইরে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আসা অনেকের কথোপকথন শুনে একেবারে দমে গেলাম। ব্যাংকে নাকি তিরিশ লাখ টাকার কম থাকলে ভিসা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই- শুধু শুধু দরখাস্ত করার টাকাটাই নষ্ট হবে। ওটাও কম নয়- নয় হাজার একশ টাকা। শুধু তাই নয়- ভর্তির আগেই এক সেমিস্টারের টিউশন ফি জমা দিতে হবে ৮৭৫০ ডলার, মেডিকেল ফি ২৭৪ ডলার, প্লেন ভাড়া সব মিলিয়ে নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা লাগবে কয়েক দিনের মধ্যেই। আমার নিজের একাউন্টে আছে মাত্র আঠারো শ তিন টাকা। টাকা-পয়সাকে খুব বেশি  গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি কখনো। কিন্তু মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এই বস্তুটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
            দিন নিজেকে একেবারে আড়াল করে ফেললাম। কলেজ থেকে ফিরে সোজা বাসায়। আর কোথাও যাই না, কারো সাথে দেখা করি না। একা থাকার একটা বড় সুবিধে হলো কেউ কোন প্রশ্ন করে না। আমি সেই সুবিধাটুকু নিলাম কয়েকদিন। নিজেকে নিজে বললাম, তুই নিজেকে যতটুকু বাস্তববাদী মনে করিস, আসলে তুই তা নোস। বাইরে গিয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখছিস- কিন্তু সে সামর্থ্য তোর নেই। খুব বেশী ভালো ছাত্রও তুই নোস। হলে একটা ফুল স্কলারশিপ তুই পেতি। পেয়েছিস একটা হাফ স্কলারশিপ- যেটা তোর টিউশন ফি কভার করে না। সুতরাং সে চিন্তা বাদ দে
                বাদ দিলাম। কিন্তু দুদিন পরেই দিদি এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেল তার বাসায়। কোন চিন্তা করবি না। তুই ভিসার দরখাস্ত রেডি কর। বাকিটা আমরা দেখছি। দাদা-দিদি-উদয়দা-দিদিভাই সবাই মিলে আমার সমস্যার সমাধান করে ফেললো। দাদা তার সব সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেললো। বৌদি তার সামান্য যে কটা গয়না ছিল সব বিক্রি করে দিল। দিদি আর উদয়দা তাদের নিজেদের সব সঞ্চয় ব্যাংকে জড়ো করলো, সহকর্মীদের কাছ থেকে টাকা ধার করলো, ব্যাংক থেকে চড়াসুদে ঋণ নিলো। দিদিভাই তার ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে তুলে দিল আমার হাতে। আমার বন্ধু অজিত সবে চাকরি শুরু করেছে, নিজের একাউন্টে যা ছিল সব দিয়ে দিলো আমাকে। ভিসার দরখাস্ত করলাম। প্রি-ভিসা হবার পর মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে এডমিশানের টাকা পাঠিয়ে দিলাম। এডমিশান কনফার্ম হলো। অজিত মেলবোর্নে ফোন করে নিজের অফিসের ফ্যাক্সে আমার এডমিশানের কাগজপত্র আনিয়ে নিলো। আমি ভিসা পেয়ে গেলাম।
                সবার ভালোবাসা আর বিশ্বাসে ভর করে আমি অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি। এখন এখানে ভালো করার দায়িত্ব আমার। ছোটখাট ব্যাপারে মন খারাপ করে, শরীর খারাপ করে পালাই পালাই করা মানে আমার আপনজনদের অপমান করা। আমি তা কিছুতেই করতে পারি না।          
                আসার আগে দিদি বলেছে, মেলবোর্নে তোর অবস্থা হবে গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা ছাত্রদের মত, শুরুতে যাদের কোথাও কেউ থাকে না। নানা জায়গায় ঠোক্কর খেতে খেতে একদিন যারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। ঠোক্কর খেতে খেতে উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ পর্যন্ত যখন আসতে পেরেছি- তখন আর সব ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। দুদিন আগে অথবা দুদিন পরে। তুমি কী বলো? হবে না?

____________________


Thursday 28 March 2019

ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন - চতুর্থ পর্ব




১০ জুলাই ১৯৯৮ শুক্রবার

এ মুহূর্তে আমার কেমন লাগছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। একটু আগে দিদিভাইর বাসায় ফোন করেছিলাম। দিদিও এসেছিল সেখানে সবাইকে নিয়ে। বিশ ডলারের টেলেস্ট্রা ফোন কার্ডে মাত্র পনের মিনিট কথা বলা যায় বাংলাদেশে। কাল অজিতের সাথে কথা বলেছি এক মিনিটেরও কম। অথচ আজ বললো ব্যালেন্স আছে আঠারো ডলার, কথা বলতে পারবো বারো মিনিট। সবার সাথে একটু হ্যালো বলতেই শেষ হয়ে গেল আমার ফোন কার্ড। ভালো লাগছে না কিছুই। ইচ্ছে করছে এখনি ফিরে যাই বাংলাদেশে- যেখানে আমার সবকিছু। তুমি হয়তো ভাবছো টেলিফোনে ভাল করে কথা বলতে পারিনি বলেই এরকম ইচ্ছে করছে। পুরো ব্যাপারটা শুনলে কিছুটা বুঝতে পারবে কেন এমন উড়নচন্ডি ইচ্ছে আমার। গোড়া থেকে বলছি- শোন।
            মেলবোর্নে প্রথম পুরো একটা দিন কাটলো আজ- সকাল থেকে রাত। সকালে ঘুম ভেঙেছে টেলিফোনের শব্দে। টেলিফোন নামক যন্ত্রটির সাথে আমার পরিচয় খুব সামান্য। দেশে থাকতে হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র ব্যবহার করেছি এই যন্ত্র। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে যন্ত্রটাকে এড়িয়ে চলার কোন উপায় নেই।
            হ্যালো
            হ্যালো স্যার, ইট্‌স মার্গারেট ফ্রম .”
            মার্গারেট আবার কে? তীব্র ঝাঁঝালো একটা কন্ঠ এই মহিলার। খুব মনযোগ দিয়ে শোনার পরও পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না তিনি কী বললেন। আন্দাজ করলাম- কেউ একজন আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। একটু পরেই ওপাশে পিটারের গলা। তার সাথে দুপুরে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে দেখা হবার কথা। কিন্তু সে বলছে- সরি ম্যান, আই ক্যান নত্‌ দু ইত্‌ তুদে। ইজ ইত্‌ ওকে ইফ আই দু ইত্‌ মান্‌দে?
            ইয়েস, ইয়েস
            ও-কে। সি ইউ মান্‌দে এত্‌ তুয়াল্‌ভ, ইন ফ্রন্ট অব ইন্তারন্যাশনাল অফিস
            পিটারের ইংরেজি বুঝতে আমার একটুও অসুবিধে হলো না। বুঝতে পারছি আমার ইংরেজির দৌড় ওই ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। পিটার সোমবারে আমাকে ক্যাম্পাস দেখাবে। আমি কি তার জন্য বসে থাকবো সোমবার পর্যন্ত? মনে হয় না। আমি আজকেই যাচ্ছি ইউনিভার্সিটিতে।   
            হোটেলের লবি থেকে দেখা যাচ্ছে- রোদে ঝলমল করছে সামনের রাস্তা। কিন্তু রাস্তায় পা দিতেই প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস- মনে হলো হাড় ভেদ করে চলে গেলো। সোয়েটার পরেছি, তার উপর একটা জ্যাকেট পরেছি, গলায় মাফলার জড়িয়েছি- তাতেও এত ঠান্ডা! এদেশের রোদে কি একটুও তাপ থাকতে নেই!
            হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে কোন্‌ দিকে যাবো বুঝতে পারছিলাম না। পেটে কিছু দেয়া দরকার। এই হোটেলের গা ঘেঁষেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। রেস্টুরেন্টের দরজায় মেনু টাঙানো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। খাদ্যতালিকা দেখার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মূল্যতালিকা দেখা। সবচেয়ে কমদামী যা আছে তা হলো ইংলিশ মাফিন- তিন ডলার। অস্ট্রেলিয়ান ডলার মাথার মধ্যে বাংলাদেশী টাকায় কনভার্ট হয়ে যাচ্ছে  মুহূর্তেই। এক টুকরো কেকের দাম নব্বই টাকা! দিদি তার কষ্টার্জিত সঞ্চয় ভেঙে কিছু ডলার কিনে দিয়েছিলো আমাকে। তার বেশির ভাগই চলে গেছে হোটেল ভাড়ায়। এখন হাতে আছে অতি সামান্য।  স্কলারশিপের টাকা কখন পাবো জানি না। এখন হিসেব করে না চললে অসুবিধায় পড়তে হবে। সুতরাং সস্তা কিছু খুঁজে বের করতে হবে। দেখছো- একদিনের মধ্যেই আমি কত হিসেবী হয়ে উঠেছি!
            বাম দিকে একটু হাঁটলেই সোয়ান্সটন স্ট্রিট। ফুটপাতের পাথরের উপর বিশাল এক দাবা বোর্ড। একেকটা ঘুটি প্রায় দুফুট উঁচু। সোয়ান্সটন স্ট্রিটে ট্রাম দেখে থমকে দাঁড়ালাম। শহরের রাস্তায় ট্রাম-লাইন। ট্রামের ছাদের সাথে বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ আছে। বিদ্যুৎই ট্রামের জ্বালানি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। পেটের ক্ষুধা আর সহ্য হচ্ছে না দেখে ফুটপাতে সাজানো একটি খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। খাবারের সাথে দাম লেখা আছে। আমি দাম দেখছি আর তা বাংলাদেশের টাকায় কত হিসেব করছি। একটা ছোট রুটি কিনলাম- এক ডলার দাম। বাংলাদেশে এর দ্বিগুণ আয়তনের একটি রুটির দাম বড়জোর ছয় টাকা- আর এখানে তা ত্রিশ টাকা। রুটি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। রুমে চা চিনি দুধ আছে। ইলেকট্রিক কেটলি আছে। চা বানালাম আর রুটি ডুবিয়ে খেলাম। এর চেয়ে ভালো ব্রেকফাস্ট হয় নাকি?  
            এবার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া দরকার। কীভাবে যাবো জানার জন্য ইনফরমেশান সেন্টারে ঢুকলাম। সোয়ান্সটন ও লিটল কলিন স্ট্রিটের কোণায় বেশ বড় ইনফরমেশান সেন্টার। যারা কাজ করছেন বেশির ভাগই প্রবীণা। সুন্দর করে হেসে জানতে চাইলেন আমি কোথায় যেতে চাচ্ছি। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে যাবো শুনে মেলবোর্ন সিটির ম্যাপের উপর পেন্সিল দিয়ে এঁকে দিলেন ইউনিভার্সিটির রাস্তা। তিনি যা বললেন তার কয়েকটি শব্দ ছাড়া বেশির ভাগই আমি না বুঝে মাথা নাড়ালাম। ইংরেজি পড়ে তবু কিছুটা বুঝতে পারি, কিন্তু অস্ট্রেলিয় উচ্চারণে কথ্য ইংরেজি বুঝতেই পারছি না।
            ইউনিভার্সিটিতে যেতে হলে ট্রামে চড়ে যেতে হবে- এটুকু বুঝতে পেরেছি। সামনেই ট্রাম স্টপ। ট্রাম আসার সাথে সাথে উঠে পড়লাম। খুব বেশি ভিড় নেই। ঝকঝকে পরিষ্কার সিট। টিকেট কীভাবে করতে হয় জানি না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি পেছনের দিকে দেখিয়ে দিলেন। কোন কন্ডাক্টর বা টিকেট চেকার চোখে পড়লো না। পরের স্টেশনে কয়েকজন নেমে যাবার পর নতুন যারা উঠলেন তাদের অনুসরণ  করলাম। একজন পকেট থেকে টিকেট বের করে একটা মেশিনে ঢুকালেন। এরকম মেশিন বেশ কয়েকটি আছে। লেখা আছে- প্লিজ ভ্যালিডেট ইওর টিকেট হিয়ার। আরেকটি বড় মেশিন চোখে পড়ল। টিকেট কাটার মেশিন। একজন লম্বা চুলের তরুণ মেশিনে কয়েন ঢুকিয়ে টিকেট বের করে আনলো। ব্যাপারটি খুব সোজা হবার কথা। ট্রামে যারা ভ্রমণ করেন তারা সবাই নিশ্চয় সায়েন্টিস্ট নন। টিকেট ভেন্ডিং মেশিন থেকে টিকেট কেনা শিখে নিলাম কয়েক মিনিটে।
            এখানে টিকেট বিক্রি হয় সময়ের হিসেবে- দূরত্বের হিসেবে নয়। শর্ট ট্রিপের ভাড়া সবচেয়ে কম। মাত্র কয়েকটা স্টপ পরে নেমে গেলে ওই টিকেট। তারপর দুঘন্টার টিকেট ও সারাদিনের টিকেট। এক ডলার আশি সেন্ট দিয়ে একটা শর্ট ট্রিপের টিকেট কিনলাম। দুই ডলারের একটি সোনালী কয়েন মেশিনে ঢোকালাম, একদিকে টিকেট বেরিয়ে এলো- অন্যদিকে বিশ সেন্টের একটা কয়েন বেরিয়ে এলো। কত স্মার্ট মেশিন! এই মেশিনের অপারেশান শিখতে পেরে নিজেকেও স্মার্ট মনে হচ্ছে।                 ইনফরমেশান ডেস্কের মহিলা বলেছিলেন ইউনিভার্সিটি বেশি দূরে নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে ট্রাম অনেক দূর চলে এসেছে। ঠিক পথে যাচ্ছি তো? ড্রাইভারকে কোনরকমে জিজ্ঞেস করলাম- এই ট্রাম মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি যাবে কি না। গায়ের রঙ আর ইংরেজি উচ্চারণ- দুটোই বলে দিচ্ছে ড্রাইভারটি ইন্ডিয়ান অথবা শ্রীলংকান। খুব আন্তরিক ভাবে বললেন-  ট্রাম যাচ্ছে উল্টো দিকে। কথা ঠিকমত না বুঝলে যা হয়। ট্রাম শুনেই উঠে পড়েছি, কোন দিকের ট্রাম তা বুঝিনি। ড্রাইভারের কথা মত পরের স্টপে নেমে গিয়ে রাস্তা পেরিয়ে অন্যদিকের ট্রামে উঠলাম।
                মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ম্যাপ দেখে একটা ধারণা করে নিয়েছিলাম যে ক্যাম্পাসটি অনেক বড় হবে। কিন্তু সেটা যে এত বড় হবে ভাবিনি। রাস্তা থেকেই দেখা যাচ্ছে বিশাল বিশাল বিল্ডিং, বিল্ডিং এর গায়ে ইউনিভার্সিটির মনোগ্রাম। ট্রাম ইউনিভার্সিটির সামনে এসে থেমে গেলো। এখানেই টার্মিনাল।
                কী কী করতে হবে তা মনে মনে ঠিক করে এসেছিলাম। প্রথমে যেতে হবে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। সোয়ান্সটন স্ট্রিটের উপর ইউনিভার্সিটির ছয় নম্বর গেটের কাছে একটা লাল বিল্ডিং ঘেঁষে কাচের দেয়াল ঘেরা অফিস। সামনে যেতেই নিজে নিজে খুলে গেল কাচের দরজা। রিসেপশান ডেস্কে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ মোটা একজন মহিলা। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
                ইংরেজি বাক্য তৈরি করতে অনেক সময় লাগছে আমার। ইংরেজি কথা শোনার পরে তা আমার মাথায় বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে। তারপর তার উত্তরে আমার বাংলা বাক্য তৈরি হচ্ছে। পরে সেই বাংলাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে মুখ দিয়ে বের করে আনতে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে অন্যপক্ষ অনেক কিছু বলে ফেলছে। এই কারণেই স্কুলে পড়ার সময় আমার ইংরেজি শিক্ষক রমণীবাবু বলতেন, ইংরেজিতে চিন্তা করবি। কিন্তু বাংলা থাকতে বাঙালি ইংরেজিতে চিন্তা করবে কী কারণে?             মহিলাটিকে বললাম, আমি ভর্তি হয়েছি প্রফেসর ক্যানেথ আমোসের আন্ডারে পিএইচডি করার জন্য। প্রফেসরের সাথে দেখা করা যায় কীভাবে। মহিলা কম্পিউটারে কিছু একটা দেখে নিয়ে টেলিফোন করলেন কোথাও। টেলিফোনে এত দ্রুত কথা বললেন যে আমি একটা বাক্যও ঠিকমত বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তিনি আমার সাথে যখন কথা বলেছেন তখন তার কথা আমি মোটামুটি বুঝতে পেরেছি। হয়তো ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে কাজের সুবাদে তারা আমাদের বোঝার মত করেই আস্তে আস্তে ইংরেজি বলেন। মহিলা বললেন, প্রফেসর আমোস এখন লাঞ্চে গেছেন। লাঞ্চের পর দেখা হতে পারে। ফিজিক্স বিল্ডিং এর ছয় তলায় ৬০৯ নম্বর রুমে তিনি বসেন
            ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার থেকে বেরিয়ে আর্টস বিল্ডিং। তার পাশেই 1888 বিল্ডিং- মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট বিল্ডিং। গেরুয়া রঙের বিল্ডিংটি কারুকার্যময়। পিলার আর ছাদের নকশা দেখে ছবিতে দেখা ভারতের মন্দিরের মত লাগছে। একশ দশ বছরের পুরানা এই বিল্ডিং-এ ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের রিসার্চ স্টুডেন্টদের সেন্টার। সাথে আছে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা সংগঠন। এখানেও কি স্টুডেন্ট পলিটিক্স আছে? জানি না এখনো। ইউনিভার্সিটির কোথাও কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপ দেখলাম না। বিল্ডিংগুলোর দেয়াল ঝকঝকে পরিষ্কার। এত বড় ক্যাম্পাসে এতগুলো বিল্ডিং- অথচ কোন ধরণের রাজনৈতিক মতবাদ দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে না এটাই আশ্চর্যের।
            এত বড় ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছি- একটু ভয় তো লাগছেই। ম্যাপ দেখে দেখে ফিজিক্স বিল্ডিং এ এলাম। বিশাল সাত তলা বিল্ডিং এর দেয়ালে তামার অক্ষরে লেখা স্কুল অফ ফিজিক্স নিচের তলায় রিসেপশানে জিজ্ঞেস করলাম প্রফেসর আমোস অফিসে আছেন কি না। মেয়েটি টেলিফোন করল প্রফেসরের অফিসে। কেউ ধরছে না। তার মানে তিনি লাঞ্চ থেকে ফিরে আসেন নি এখনো। রিসেপশানে বসা এই মেয়েটিও খুব মোটা। মনে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায় মোটা মানুষের সংখ্যা বেশি। মোটা মানুষ হাসিখুশি হয় বলে শুনেছি। কিন্তু এই মেয়েটি গম্ভীর। আমার দিকে খুব একটা তাকানোর দরকার আছে বলেও মনে করছেন না। অনেকটা আপন মনেই বললেন, কেন্‌ বসেন ছয় তলায়। ৬০৯ নম্বর রুমে। অস্ট্রেলিয়ানরা সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকে। তাই প্রফেসর ক্যানেথ আমোস এদের কাছে শুধুই কেন্‌
            পাশাপাশি দুটো লিফ্‌ট। তার পাশেই সিঁড়ি। লিফ্‌টের বোতাম টেপার আগেই লিফ্‌ট খুলে গেলো। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলেন চার-পাঁচজন মানুষ। হা হা করে হাসছে তারা। লিফ্‌টে উঠে ছয়তলার বোতাম টিপে দিলাম। এখানেও কোন লিফ্‌ট-ম্যান নেই। এদেশে মনে হয় কোন লিফ্‌টেই চালক থাকে না।
            ছয়তলায় লিফ্‌ট থেকে বেরিয়ে সামনেই ফিজিক্স রিসার্চ লাইব্রেরি। লেখা আছে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের লাইব্রেরি এটা। আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট ফিজিক্সের বইয়ের দরকার হলে যেতে হবে বিলিউ লাইব্রেরিতে, স্কুল পর্যায়ের ফিজিক্সের বই আছে ই-আর-সি লাইব্রেরিতে। কয়টা লাইব্রেরি আছে এখানে?
            বামে করিডোর দিয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম ৬০৯ নম্বর রুমের সামনে। নেমপ্লেটে লেখা আছে- ডঃ কে.. আমোস। দরজা বন্ধ। সামনের রুম ৬১২। তার দরজা খোলা। আমি প্রফেসর আমোসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি দেখে ৬১২ নম্বর রুম থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এলো। ছেলেটার চোখে চশমা, লম্বা চুল পিঠ ছুঁয়েছে। ছেলেদের লম্বা চুল রাখা মনে হচ্ছে খুবই কমন এখানে। বললো, কেন্‌ এখন লাঞ্চে গেছে। মিনিট দশেক পরে আসবে। কোন ম্যাসেজ আছে?আমি হ্যাঁ হুঁ করে কী বললাম নিজেই জানি না। ছেলেটি আমার কথা শুনে কিছু বুঝলো বলে মনে হচ্ছে না। বার দুয়েক - পারডন মি” “পারডন মি বললো। আমার ইংরেজি এতই দুর্বোধ্য যে এই ব্যাটা অস্ট্রেলিয়ান মাফ চাচ্ছে আমার কাছে!  আমি আবার আসবো বলে দ্রুত চলে এলাম।
            ফিজিক্স বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সামনে আরেকটি বিশাল বিল্ডিং- পনের ষোল তলা হবে। তার পাশে একটি পুরানা বিল্ডিং- স্টুডেন্টস্‌ সাপোর্ট সেন্টার। সেখানে ঢুকে দেখি- দেয়ালে সুন্দর করে টাঙানো আছে নানারকম বিজ্ঞপ্তি, বিজ্ঞাপন। পার্ট-টাইম চাকরির বিজ্ঞাপন, ঘরভাড়ার বিজ্ঞাপন। আমার খুব দরকারে লাগবে এসব। থাকার একটা ঘর- আর খন্ডকালীন একটা চাকরি তো এখুনি দরকার। কিন্তু চাকরির বিজ্ঞাপন গুলোতে যে সব যোগ্যতার কথা উল্লেখ আছে তার কোনটাই আমার নেই। কয়েকটাতে বলা হচ্ছে নিজের গাড়ি থাকতে হবে। কয়েকটাতে বলা হচ্ছে শিশুদের তদারক করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আমি করতে পারবো এরকম চাকরি একটাও চোখে পড়লো না। মনে হচ্ছে আমি কোন কাজের যোগ্য নই।
            ঘরভাড়ার বিজ্ঞাপনগুলো দেখলাম। বেশির ভাগই শেয়ার একোমোডেশান। অনেকগুলো টার্ম আমি বুঝতে পারছি না। ভাড়ার অঙ্কটা চোখে পড়ে আগে। সবগুলো ভাড়াই সাপ্তাহিক। এখানে মনে হচ্ছে ঘরভাড়া হিসেব করা হয় সপ্তাহ অনুসারে। সপ্তাহে আশি ডলারের নিচে কোন রুম নেই। তাও ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক দূরে। বুঝতে পারছি না কী করবো।
            ফিরে আসার পথে আবার ফিজিক্স বিল্ডিংএর ছয় তলায় উঠলাম। প্রফেসর আমোসের অফিস খোলা। সামনে যেতেই ভদ্রলোকের চোখে চোখ পড়লো। চোখে মোটা লেন্সের চশমা। খুবই হাসিখুশি প্রায় সাড়ে ছফুট দীর্ঘ স্বাস্থ্যবান অস্ট্রেলিয়ান। বয়স পঞ্চাশের ওদিকে। মাথার চুল বেশির ভাগই সাদা হয়ে গেছে। মুখভর্তি হাসি। আমাকে দেখেই ডেস্ক ছেড়ে উঠে এলেন। হ্যান্ড শেক করতে করতে বললেন, ইউ আর প্রাডিব - রাইট?
            প্রদীপ দেব, স্যার
            নো স্যার। প্লিজ কল মি কেন্‌
            দুমিনিটেই ভালো লেগে গেল মানুষটিকে। মনে হচ্ছে এই মানুষের সবকিছুই শিক্ষণীয়। বললেন আজ শুক্রবার বলে ডিপার্টমেন্টে তেমন কাউকে পাওয়া যাবে না। সোমবার সকাল দশটায় এসে যেন দেখা করি। সেদিন তিনি আমার সব অফিসিয়াল ফর্মালিটি শেষ করবেন। উইক-এন্ড ভালোভাবে কাটাতে বললেন। মনে একটা ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে চলে এলাম।
            ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে হাঁটলাম অনেকক্ষণ। বিল্ডিংয়ের পর বিল্ডিং। কত রকমের ডিপার্টমেন্ট। মনে হচ্ছে ইউনিভার্সিটি নিজেই একটা গোটা শহর। এত বড় ইউনিভার্সিটিতে আমি পড়তে এসেছি, গবেষণা করতে এসেছি- মনে মনে একধরণের আনন্দ, উদ্দীপনা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম হোটেলে। না হাঁটলে পথ চেনা যায় না। পথ চলতে চলতে পথ চেনা হলো কিছুদুর।
            আরেকটা রুটি আর চা। কিন্তু এটাই তো প্রধান খাবার হতে পারে না। এখানে ভাত কোথায় পাওয়া যায় জানি না। সন্ধ্যায় হোটেলের রিসেপশান থেকে দুধ নিতে গিয়ে দেখি গতকালকের মেয়েটির বদলে একজন ফর্সামতোন স্যুট-টাই পরা যুবক কাজ করছেন। আমি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কোন রকমে বললাম, ক্যান আই হ্যাভ এ প্যাক অব মিল্ক প্লিজ!
            কাউন্টারের ড্রয়ার থেকে দুধের একটা প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে যুবকটি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি বাংলাদেশী না?
            তাঁর মুখে বাংলা শুনে আমি কী যে খুশি হয়েছি! মনে হলো জেল থেকে মুক্তি পেলাম আমি।
            আমার নাম মাসুদ। আমি এখানে সপ্তাহে তিনদিন কাজ করি। রাতের শিফ্‌টে
            মাসুদ সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পরই জানতে চাইলাম এখানে ভাত কোথায় পাওয়া যায়। তিনি বললেন সোয়ান্সটন স্ট্রিটে গোপাল্‌স নামে একটা ইন্ডিয়ান নিরামিষ দোকান আছে। বেশ সস্তায় ভাত পাওয়া যায়। ভাত পাওয়া যায় শুনেই পেটের মধ্যে যেন আগুন জ্বলে উঠল। মনে হলো- কতদিন ভাত খাইনি! ছুটলাম গোপাল্‌স এর সন্ধানে।
            লিটল কলিন্স স্ট্রিট যেখানে সোয়ান্সটন স্ট্রিটকে ক্রস করেছে- সেখান থেকে সামান্য উত্তরদিকে গিয়েই পেয়ে গেলাম গোপাল্‌স। ছোট একটা সিঁড়ির মুখে ইংরেজিতে লেখা হরি কৃষ্ণ, হরি কৃষ্ণ। দোতলায় মাঝারি সাইজের একটা রেস্টুরেন্ট। দেয়াল জুড়ে ছোটবড় অনেকগুলো কৃষ্ণের ছবি। একটি কাচের কাউন্টারে ভাত তরকারি সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন ভক্ত। তিনজনেরই মুন্ডিত মস্তকে লম্বা টিকি, কপালে মস্তবড় সাদা ফোঁটা- সম্ভবত চন্দনের, গলায় পুঁতির মালা টাইপের কিছু। তিনজনই শ্বেতাঙ্গ। হলুদ ফতুয়া আর সাদা ধুতিতে বেশ মানিয়েছে তাদের। পেছনের দেয়াল জুড়ে  ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর একটা বড় ছবি। এই ভদ্রলোকতো দেখি তাঁর আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্য মেলবোর্ন পর্যন্ত বিস্তৃত করে ফেলেছেন।
            কাচের শোকেসের ভেতর ভাত- ভাতের মধ্যে মটরশুটি মেশানো। দাম লেখা আছে প্রতি প্লেট চার ডলার। শুধু ভাত নাকি সাথে আর কিছু দেবে জানি না। জিজ্ঞেস করার জন্য ইংরেজি বাক্য তৈরি করছি মনে মনে। এসময় তিনজনের একজন জানতে চাইলো-
            হোয়াট ডু ইউ লাইক?
            আঙুল দিয়ে ভাত দেখাতেই ঝটপট এক প্লেট ভাত বেড়ে দিল।
            এনিথিং এল্‌স?
            শুধু ভাত খাবো কীভাবে? তরকারির দিকে চোখ দিলাম। নানারকম শাক-পাতা, ডাল, সব্‌জি আছে শোকেসের ভেতর। আমার চোখ তরকারির চেয়েও তরকারির দামের দিকে। সবচেয়ে কমদামী যেটা চোখে পড়লো সেটা ডাল। এক বাটি তিন ডলার। সাত ডলার মানে দুশ টাকার ডাল-ভাত। খুব যে তৃপ্তি করে খেলাম তা নয়। ডালে মনে হয় লবণের বদলে চিনি দিয়েছে। গোপাল্‌সে আর কোনদিন ঢুকছি না।
            হোটেলে এসে আলী সাহেবের কথা মনে হলো। হুমায়রা আপা ঠিকানা দিয়েছিলেন। কিন্তু ফোন নম্বরটা দিতে পারেন নি। টেলিফোন ডাইরেক্টরি দেখে নম্বর বের করতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। পারিবারিক নাম অনুসারে সাজানো ঢাউস টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে অনেকগুলো আলী। আলী ডি আছেন বেশ কয়েকজন। ঠিকানা মিলিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে ফোন করলাম।
                গুড ইভনিং
                ইংরেজি শুনে একটু নার্ভাস হয়ে গেলাম। এমনিতেই আমি অপরিচিত মানুষের সাথে সহজে কথা বলতে পারি না। সেখানে ইংরেজি বলছেন। আমারও কি ইংরেজি বলা উচিত? কাঁপা কাঁপা গলায় কোন রকমে জানতে চাইলগ- ক্যান আই স্পিক টু মিস্টার আলী প্লিজ!
                স্পিকিং। হু ইজ দিস?
                স্লামাইকুম, আমার নাম প্রদীপ। বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আপনার ঠিকানা পেয়েছি আমার একজন কলিগের কাছ থেকে
                আপনি কোথায় আছেন এখন?
                হোটেলের নাম ঠিকানা বললাম। আলী সাহেব বললেন টেলিফোন নম্বরটা দিতে। হোটেলের রসিদ থেকে টেলিফোন নম্বরটা দিতেই লাইন কেটে গেল। কী করবো বুঝতে পারছি না। আমার কি উচিত আবার টেলিফোন করা? কথার মাঝখানে লাইন কেটে গেলে কী করতে হয়? দেশে থাকতে তো টেলিফোন ব্যবহার করিনি তেমন একটা। টেলিফোন-কার্টিসি নামে কিছু যদি থাকে তা আমার জানা নেই। আলী সাহেবের মনে আমার ভদ্রতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগার আগেই আমার উচিত আবার ফোন করা। ভাবতে ভাবতে রিসিভারের দিকে হাত বাড়াতেই টেলিফোন বেজে উঠলো। ওপাশে আলী সাহেব।
                আপনি হোটেলের টেলিফোন নম্বর না দিয়ে ফ্যাক্স নম্বর দিয়েছেন
            এবার বোঝ আমার অবস্থা। আমি যে একটা খ্যাৎ - তা কিছুতেই গোপন রাখা গেল না। আলী সাহেব বর্ণনা দিচ্ছেন কীভাবে তাঁকে ইয়েলো পেইজ থেকে হোটেলের ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করতে হয়েছে। শুনতে শুনতে আমি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছি। ইয়েলো পেইজ বস্তুটা কী তা জানি না। আলী সাহেব দ্রুত বলে যাচ্ছেন অনেককিছু-
            আপনি কি একা এসেছেন, নাকি পরিবার নিয়ে এসেছেন?
            আমি একা
            কোন্‌ ইউনিতে?
            ইউনিট মানে?
            আই মিন হুইচ ইউনিভার্সিটি?
            ইউনিভার্সিটিকে যে এখানে ইউনি বলে তাও তো জানতাম না। বললাম মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি
            মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি মানে- দি ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন?
            জ্বি স্যার
            গুড, ভেরি গুড। খুব ভাল, খুব ভাল। কিন্তু খরচ তো অনেক ওখানে। এনিওয়ে- ভেরি গুড, ভেরি গুড। খুব ভাল লাগলো। হোটেলে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?
            জ্বি না স্যার
            আপনি আমার মোবাইল নম্বরটা লিখে রাখেন। দিনের বেলা যদি দরকার হয় ওটাতে ফোন করবেন
            ঠিক আছে স্যার। আমি নম্বরটা লিখে নিলাম।
            ওকে। আই উইল মিট ইউ অন মানডে। আই উইল কল ইউ বিফোর দ্যাট। ওকে? গুড নাইট
            গুড নাইট স্যার
            মিশ্র একটা অনুভূতি হচ্ছে। আলী সাহেবকে বিরক্ত করা কি ঠিক হয়েছে? বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে বেশ রাশভারী মানুষ। সোমবার তাঁর সাথে দেখা হলে কী বলবো ভেবে এখনি টেনশান হচ্ছে। উট্‌কো ঝামেলা মনে করবেন না তো আবার! জানি না। সোমবারেরটা সোমবারে দেখা যাবে। জ্যাকেটটা আবার গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম।  
            শুক্রবারের সন্ধ্যা বলেই রাস্তায় খুব ভীড়। গুঁটি গুঁটি বৃষ্টি হচ্ছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস। বাংলাদেশে একটা সোয়েটার পরেই পুরো শীতকাল কাটিয়ে দিয়েছি। অথচ এখানে উদয়দার দেয়া কাশ্মিরী সোয়েটারের উপর হকার্স মার্কেট থেকে কেনা জ্যাকেট পরেছি। গলায় মাফলার জড়িয়েছি- তারপরও ঠান্ডায় কাবু হয়ে যাচ্ছি।
                লিটল কলিন্স স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাসেল স্ট্রিটে এলাম। এদিকে মানুষের ভীড় আরো বেশি। রাস্তার দুপাশে সারি সারি রেস্টুরেন্ট আর মদের দোকান। এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও অনেক মেয়েকে দেখা যাচ্ছে নাম-মাত্র পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, টিপটিপ বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। একটু সামনে গেলেই গ্রেটার ইউনিয়ন সিনেমা হলের বারান্দার সিঁড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। বেশ কয়েকজোড়া ছেলেমেয়েকে দেখলাম খুব ঘনিষ্ঠভাবে চুমুখাচ্ছে। ছেলে-মেয়েদের এত বেশি ঘনিষ্ঠতা অস্ট্রেলিয়ানদের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম অনেক চায়নিজ ছেলেমেয়েও অস্ট্রেলিয়ান কায়দা রপ্ত করে ফেলেছে। বৃষ্টির ফোঁটা বড় হচ্ছে ক্রমশ। একটা বড় নিউজ এজেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম।
                হাজার রকমের সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিনে ভর্তি এই নিউজ-এজেন্ট। অফিস স্টেশনারি, নানারকম বইপত্র, ফোনকার্ড, শুকনো খাবার- সব আছে এখানে। এক পাশে ফ্রিজভর্তি নানারকম পানীয়ও দেখা যাচ্ছে। জিনিসপত্রের যা দাম- তাতে মনে হচ্ছে এ কোন দেশে এলাম! একটি ছোট পাউরুটির দাম এক ডলার- মানে ত্রিশ টাকা!
                দোকানের শেষের সারির দেয়ালে ছোট আরেকটি দরজা। প্রবেশ পথে লেখা আছে 18+ মানে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। কৌতূহল হল। ঢুকে দেখি সামনের অংশের চেয়ে অন্তঃত দশগুণ বড় জায়গা নিয়ে বিশাল সমারোহ। সারি সারি তাকভর্তি হাজার রকমের পর্ণোগ্রাফিক ম্যাগাজিন। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে সবাই দেখছে আমাকে। প্রচুর ভীড়, অসংখ্য নারী-পুরুষ নির্বিকার ভাবে ম্যাগাজিন উল্টাচ্ছে। ম্যাগাজিন ছাড়াও নানারকম অ্যাডাল্ট জিনিসপত্রে ঠাসা কাউন্টার। ক্রেতাদের ভীড় সামলাচ্ছে দুজন তরুণী। নানা বয়সের নারী-পুরুষ তাদের নানারকম গোপন আগ্রহের রসদ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এদের এই ব্যবস্থাটিকে ঠিক কী বলবো বুঝতে পারছি না- বিকৃতি, নাকি জাস্ট ভিন্নতা? যাই হোক- আমার নিজস্ব রুচিবোধ কিংবা সংস্কার আমাকে ঠেলে নিয়ে এলো বাইরে।
                বৃষ্টি কমে গেছে, ফুটপাতে ভীড় বেড়েছে আরো। সিনেমা হলের সামনে বীয়ারের বোতল হাতে নানারকম উল্কি আঁকা তরুণদের দেখে কেমন যেন একটু ভয় ভয় লাগছে। কোন রকমে তাদের পাশ দিয়ে চলে আসছি- হঠাৎ প্রচন্ড ধাক্কা। ছিটকে পড়ে গেলাম ফুটপাত থেকে রাস্তায়। অগভীর নালার পানিতে ডুবে গেছে আমার বাম হাঁটু। চশমা ছিটকে পড়েছে একটু দূরে। না, ভাঙেনি। চোখ তুলে তাকালাম। দুতিনজন অস্ট্রেলিয়ান তরুণ বিয়ারের বোতল হাতে মারমুখী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কানে দুল, বাহুতে উল্কি, মাথার চুল সজারুর কাঁটার মত খাড়া খাড়া। একজন বাম হাতের মধ্যমা উঁচু করে হো হো করে হাসছে। বড় অশ্লীল সে হাসি।
            আর ইউ ওকে? বলতে বলতে আমার হাত ধরে টেনে তুললো একজন প্রায়-বস্ত্রহীন তরুণী। তাকে কোনরকমে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম হোটেলের দিকে। কেমন যেন লাগছে। মেলবোর্নে আসার দুদিনের মধ্যেই এরকম একটা ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। যারা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে তাদের চোখেমুখে ঘৃণা স্পষ্ট। এটা কি আমার গায়ের রঙের কারণে? আবার যে মেয়েটি আমাকে টেনে তুললো- সেও শ্বেতাঙ্গিনী। তার চোখে তো ঘৃণা ছিল না এক ফোঁটাও, ছিল এক ধরণের মমতা। বুঝতে পারছি না- মেলবোর্ন শহর কি আমার আপন হবে কখনো? বাম হাঁটু আর দুই কনুই থেকে রক্ত বের হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কেমন লাগছে?

____________


Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts