Showing posts with label আলফ্রেড নোবেল. Show all posts
Showing posts with label আলফ্রেড নোবেল. Show all posts

Thursday, 21 October 2021

আলফ্রেড নোবেল - একজন নিসঙ্গ মানুষ

 



মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন আলফ্রেড নোবেল? যিনি একাধারে একের পর এক বিস্ফোরক ও যুদ্ধাস্ত্রের উপাদান আবিষ্কার করেছেন, সারা ইউরোপে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে তুলে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করেছেন, কিন্তু জীবন-যাপন করেছেন একাকী নিরাসক্ত। জীবনে কোনদিন ধূমপান করেননি, মদ পান করেননি, এমন কি বিয়েও করেননি। তেমন কোন বন্ধুবান্ধবও ছিল না আলফ্রেড নোবেলের। প্রথম জীবনে কবি হতে চেয়েছিলেন - অনেক কবিতাও লিখেছিলেন। প্রেম ছিল সেসব কবিতায়, ক্ষোভও ছিল। কিন্তু তাঁর কোন রচনাই তিনি প্রকাশ করেননি। অন্তর্মুখী এই মানুষটি একদিকে শক্তহাতে ইন্ডাস্ট্রি আর ব্যবসা সামলেছেন, অন্যদিকে নিরলস গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন একের পর এক নতুন বিস্ফোরক। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিলেন - যে দেয়াল ভেদ করে তাঁর মনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব ছিল না কারোরই। হাতে গোনা যে ক’জন মানুষের কাছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লিখেছিলেন তাও তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গোপন করে রেখেছিল নোবেল ফাউন্ডেশান। 

আলফ্রেড নোবেল তাঁর প্রত্যেকটি চিঠির কপি রাখতেন, একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিরও। নোবেল ফাউন্ডেশানের আর্কাইভে আছে তাঁর হাতে লেখা অনেক চিঠি। প্রত্যেকটি চিঠিতে তাঁর নিজের হাতে ক্রমিক নম্বর দেয়া। ১৯৫০ সালে তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো প্রকাশ্যে আসার পর আলফ্রেড নোবেলের ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তাগুলোর কিছু কিছু দিক উন্মোচিত হয়। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো আলফ্রেড নোবেলের নাম দিয়েছিলেন ‘দি ওয়েলদিয়েস্ট ভ্যাগাবন্ড ইন ইউরোপ’। নোবেলের চিঠিগুলো থেকে কিছুটা হলেও দেখা যায় তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী এই চিরকুমার ‘ভবঘুরে’র ব্যক্তিগত জীবনের কিছু দিক।  

নোবেলদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন নোবেলিয়াস পদবীভুক্ত দরিদ্র কৃষক। আলফ্রেডের ঠাকুরদা নিজের চেষ্টায় নাপিতের কাজ শিখেছিলেন। ক্ষৌরকর্মের পাশাপাশি তিনি ছোটখাট অস্ত্রোপচারও করতেন। ১৭৭৫ সালে তিনি নিজের পদবী নোবেলিয়াসের অর্ধেক ছেঁটে ফেলে ‘নোবেল’ করে নিলেন। তাঁর বড় ছেলে ইমানুয়েল - আলফ্রেড নোবেলের বাবা।  

১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমে ইমানুয়েল ও ক্যারোলিন নোবেলের চতুর্থ সন্তান আলফ্রেড নোবেলের জন্ম। আলফ্রেডের বড় তিন জনের মধ্যে এক জন জন্মের পরেই মারা যায়। বাকি দুই ভাই রবার্ট ও লুডভিগ।  ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এবং তাঁর নিজের কনস্ট্রাকশান ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম ছিল। কনস্ট্রাকশানের কাজে ইমানুয়েল নানারকম বিস্ফোরক নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে নতুন নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করছিলেন। তাঁর ব্যবসায় মাঝে মাঝে খুবই সাফল্য আসছিল, আবার মাঝে মাঝে তিনি সর্বস্ব হারাচ্ছিলেন। আলফ্রেডের যখন জন্ম হয় তখন ইমানুয়েল নোবেলের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর কনস্ট্রাকশান ফার্ম দেউলিয়া হয়ে গেছে। তিনি সুইডেনের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। 

এদিকে জন্ম থেকেই ভীষণ রুগ্ন আলফ্রেড। পেটের পীড়া লেগেই আছে, আর হৃদপিন্ডের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সারাজীবনই শরীর নিয়ে ভুগেছেন আলফ্রেড নোবেল। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে মা-কে আঁকড়ে ধরেই আলফ্রেডের বেড়ে ওঠা। সারাক্ষণ শারীরিক কষ্টে ভুগতে ভুগতে আলফ্রেড ছোটবেলা থেকেই কোন ধরনের খেলাধূলা করার প্রতি উৎসাহ পায়নি। তাই কোন খেলার সাথীও ছিল না। শৈশবে মা ছাড়া আর কারো সাথেই তার কোন আত্মিক গড়ে ওঠেনি। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে আলফ্রেড কখনোই হাসিখুশি উচ্ছল ছিল না। তাকে কেউ কখনো প্রাণখুলে হাসতে দেখেননি। 

ইমানুয়েল নোবেল আর্থিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তির জন্য নানারকমের ব্যবসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিলেন না। আলফ্রেডের বয়স যখন চার, তখন তিনি তিন ছেলে ও স্ত্রীকে সুইডেনে রেখে ফিনল্যান্ড চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু করতে পারলেন না। সেখান থেকে চলে গেলেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে। সেই সময় রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের পাঁয়তারা চলছে। ইমানুয়েল দেখলেন সম্ভাব্য যুদ্ধের বাজারে গোলাবারুদ মাইন আর যন্ত্রাংশ তৈরি ও সরবরাহের বিপুল সম্ভাবনা। তিনি কাজ শুরু করে দিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। দ্রুত সাফল্য অর্জন করলেন তিনি, আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেলো। ১৮৪২ সালে পুরো পরিবারকে নিয়ে এলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। 

আলফ্রেড যখন সেন্ট পিটার্সবুর্গে এলো তখন তার বয়স নয় বছর। চার বছর বয়স থেকে বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু হয়েছে। ইমানুয়েল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই কোন ছেলেকেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে পাঠাননি। বাড়িতে টিউটর রেখে ব্যবহারিক শিক্ষা দিয়েছেন ছেলেদের পছন্দ, মেধা ও আগ্রহের দিকে খেয়াল রেখে। সেন্ট পিটার্সবুর্গের বাড়িতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষা, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ের জন্য শিক্ষক রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো ছেলেদের জন্য। 

আলফ্রেড নোবেল জীবনে কখনো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেননি। বাড়িতেই তার লেখাপড়া। অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময় পড়াশোনাতেই কাটে আলফ্রেডের। রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আলফ্রেডের। বাবার কারখানায় নানারকম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নিজেরও অনেক নতুন নতুন আইডিয়া দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাল লাগে সাহিত্য। সতের বছর বয়স হবার আগেই সুইডিশ, রাশিয়ান, জার্মান, ইংলিশ ও ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও লিখতে শিখে গেল আলফ্রেড। লিখতে শুরু করলো কবিতা। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে লেখকই হবে সে। 

আলফ্রেডের কাব্যচর্চার কথা জেনে গেলেন তার বাবা ইমানুয়েল। তিনি জানেন কাব্যচর্চা করে অর্থোপার্জন করা যায় না। তাই তিনি চাচ্ছিলেন ছেলে এমন কিছু করুক যা দিয়ে অর্থ উপার্জন করা সহজ হবে। নিজের কারখানায় আলফ্রেডকে সম্পৃক্ত করার আগে সঠিক প্রশিক্ষণ দরকার। ১৮৫০ সালে আলফ্রেডকে রাসায়নিক প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দিলেন ইমানুয়েল নোবেল। 

পরবর্তী তিন বছর আলফ্রেড জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও আমেরিকায় কয়েকজন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ও রসায়নবিদের অধীনে কাজ শিখলো। আমেরিকায় আলফ্রেড কাজ করলো সুইডিশ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী জন এরিকসনের সাথে যিনি ‘মনিটর’ নামে একটা আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের ডিজাইন করেছিলেন। ফ্রান্সে গিয়ে আলফ্রেড কাজ শিখলেন রসায়নবিদ আস্ক্যানিও সবরেরোর কাছে। আস্ক্যানিও সবরেরো নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার করেছিলেন। ভয়ংকর বিস্ফোরক এই নাইট্রোগ্লিসারিন এতটাই বিপজ্জনক যে সামান্য নাড়াচাড়াতেই প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে যায়। তাই এটাকে তখন কোন ব্যবহারিক কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। আলফ্রেড ভাবতে শুরু করলেন নাইট্রোগ্লিসারিনকে কীভাবে বশে আনা যায়। 

১৮৫২ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরে এসে বাবার কারখানায় যোগ দিলেন উনিশ বছর বয়সী আলফ্রেড। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার নৌবাহিনী বিপুল পরিমাণ নেভাল মাইন কিনছিলো - আর তা সরবরাহ করছিল তাদের ‘ফাউন্ড্রিজ এন্ড মেশিন শপ্‌স অব নোবেল এন্ড সন্স’। যুদ্ধ যতদিন চললো নোবেল পরিবারের উপার্জন ততই ফুলে ফেঁপে উঠলো। বিপুল উৎসাহে ইমানুয়েল বেশ কয়েক বছরের জন্য মাইন তৈরি করে মজুদ করে ফেললেন। কিন্তু ১৮৫৬ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। ইমানুয়েলের গুদামভর্তি নেভাল মাইন অলস পড়ে রইল। দু’বছরের মধ্যে কারখানা আবার দেউলিয়া হয়ে গেল। 

এদিকে তরুণ আলফ্রেড নিজের পড়াশোনা, কারখানার ল্যাবরেটরিতে নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চেষ্টা করেন। কবিতায় প্রেম আর স্বপ্নের মাখামাখি। অন্তর্মুখী আলফ্রেড ভালোবেসে ফেলেছেন একজন ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রাশিয়ান তরুণীকে। কিন্তু ভালোবাসার কথা কবিতায় প্রকাশ পেলেও মুখ ফুটে বলতে পারে না ভালোবাসার মানুষকে। দুর্বল স্বাস্থ্য, মাঝারি উচ্চতার আলফ্রেডের দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে ভালোবাসা বোঝা সহজ নয়। আলফ্রেডের ভালোবাসা ঠিকমত গতি পাবার আগেই এক দুঃখজনক পরিণতিতে পৌঁছে যায়। যক্ষারোগে ভুগে মেয়েটি মারা যায়। গভীর অবসাদে ডুবে যান তেইশ বছর বয়সী আলফ্রেড নোবেল। 

প্রথম প্রেমের মৃত্যুর পর বিষন্ন আলফ্রেড বেপরোয়ার মত নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। এ যেন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া। কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্য পাওয়া গেল। ১৮৬০ সালে ২৭ বছর বয়সে নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হলেন। 

এদিকে রাশিয়ায় বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ইমানুয়েল নোবেল তাঁর পরিবারসহ রাশিয়া ছেড়ে ফিরে এলেন সুইডেনের হেলেনেবর্গে ১৮৬৩ সালে। আলফ্রেড ও তার ছোটভাই এমিল মা-বাবার সাথে সুইডেনে ফিরে এলেন। বড় দুইভাই রবার্ট ও লুডভিগ তাঁদের নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রয়ে গেলেন রাশিয়ায়। পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে তাঁরা রাশিয়ায় বিপুল তেলসম্পদের মালিক হন। লুডভিগ নোবেলকে রাশিয়ার তৈলসাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট বলা হতো।

সুইডেনে ফিরে এসে স্টকহোমে ল্যাবোরেটরি স্থাপন করলেন ইমানুয়েল ও আলফ্রেড নোবেল। নাইট্রোগ্লিসারিনের পরীক্ষা চলছিলই। ১৮৬৩ সালের অক্টোবরের ১৪ তারিখে ৩০ বছর বয়সী নোবেল প্রথম প্যাটেন্ট পেলেন “মেথড অব প্রিপেয়ারিং গানপাউডার ফর বোথ ব্লাস্টিং এন্ড শুটিং”। ব্যাপক গবেষণায় মেতে উঠলেন আলফ্রেড। 

ল্যাবোরেটরিতে তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে ছোটভাই এমিল নোবেল। কিন্তু নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তেই বিপদের সম্ভাবনা। ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ বিরাট বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় আলফ্রেডের ল্যাবোরেটরি। আলফ্রেডের ছোটভাই এমিলসহ পাঁচজন মারা যান এই দুর্ঘটনায়। ভীষণভাবে আহত হবার পরেও অল্পের জন্য বেঁচে যান আলফ্রেড নোবেল। 

একটু সুস্থ হবার পর আবার কাজে লেগে গেলেন আলফ্রেড। কিন্তু ছেলে এমিলের মৃত্যুশোক সামলাতে পারলেন না বাবা ইমানুয়েল। স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি। পারিবারিক ব্যবসার পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল আলফ্রেড নোবেলের হাতে। 

দুর্ঘটনার পর স্টকহোমের কোথাও ল্যাবোরেটরি স্থাপন করার অনুমতি পাচ্ছেন না আলফ্রেড। কিন্তু তাঁর ব্লাস্টিং অয়েলের ব্যাপক চাহিদা। হ্রদের ওপর ভাসমান বার্জে অস্থায়ী ল্যাবোরেটরি স্থাপন করে ব্লাস্টিং অয়েল তৈরি চলছে। অবশেষে ১৮৬৫’র নভেম্বরে জার্মানির হামবুর্গের কাছে নাইট্রোগ্লিসারিন ফ্যাক্টরি তৈরির অনুমতি লাভ করে। সেখানেও অনেক সাবধানে কাজ করা হচ্ছিলো। দুর্ঘটনা ঘটলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে এক একটা শেডে দু’জনের বেশি কাজ করতেন না কখনোই। ১৮৬৬ সালে আবার দুর্ঘটনা ঘটলো। 

ল্যাবোরেটরির ধ্বংসস্তূপ সরাবার সময় আলফ্রেড আবিষ্কার করলেন তরল নাইট্রোগ্লিসারিন মিহি বালি ও মাটির সাথে মিশে এক ধরনের পেস্টের মত তৈরি হয়েছে। ওই পেস্টগুলো জোরে নিক্ষেপ করলে বিস্ফোরিত হয়, আগুনে পোড়ালেও বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু স্বাভাবিক তাপে ও চাপে কোন ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে না। আলফ্রেড পেয়ে গেলেন তাঁর স্বপ্নলোকের চাবি। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি উদ্ভাবন করলেন ডায়নামাইট। তারপর সাফল্যের ইতিহাস গড়লো ডায়নামাইট। ডায়নামাইট আবিষ্কারের ব্রিটিশ প্যাটেন্ট পেয়ে গেলেন মে মাসে। ছুটে গেলেন আমেরিকায় - ডায়নামাইটের আমেরিকান প্যাটেন্ট পাবার জন্য। দু’বছর পরে আমেরিকান প্যাটেন্ট পেলেন তিনি। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর ডায়নামাইট ও অন্যান্য বিস্ফোরকের ব্যবসা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর কারখানা তৈরি হলো ফ্রান্সে ও স্কটল্যান্ডে। পরে পৃথিবীর বিশটি দেশের নব্বইটি শহরে আলফ্রেড নোবেলের কারখানা স্থাপিত হয়। নোবেল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে। বাড়তে থাকে তাঁর নতুন নতুন আবিষ্কার। ৩৫৫টি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট পেয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল। 

সবচেয়ে বড় কারখানা ফ্রান্সে থাকায় ১৮৭৩ সাল থেকে প্যারিসের মালাকফ এভিনিউতে বসবাস করতে শুরু করেন আলফ্রেড নোবেল। বিরাট বাড়ি। থাকার লোক মাত্র তিন জন, তিনি এবং কাজের লোক আর ড্রাইভার। প্রচন্ড ব্যস্ত আলফ্রেড। ব্যবসার সমস্ত কাগজপত্র নিজেই দেখাশোনা করেন। নিজের হাতে সব ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক চিঠিপত্রের উত্তর দেন। আবার তাদের কপিও রাখেন। টাকা-পয়সার নিখুঁত হিসেব রাখেন নিজেই। এর মধ্যেও যখন সময় পান নিজের লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করেন।

ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুষ্ঠান বলতে কিছুই নেই আলফ্রেডের। যা আছে সবই ব্যবসায়িক। এত কাজ করেন কাজের তাগিদেই। যেমন ব্যবসার কাজে উকিলের সাথে কথা বলতে হয়। কিন্তু উকিল সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা শূন্যের কোঠায়। তিনি মনে করেন উকিলরা তাঁদের পেশার খাতিরে পৃথিবীর সবাইকেই অসৎ ভাবেন। 

প্যারিসে বাস করলেও ফ্রান্সকে নিজের দেশ ভাবতে পারেন না আলফ্রেড। কোন নির্দিষ্ট দেশকেই তাঁর নিজের দেশ বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই তাঁর বাড়ি থাকলেও কোন বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করতে পারেন না। তিনি মনে করেন, “আমার বাড়ি হলো সেখানেই যেখানে বসে আমি কাজ করি। আর আমি সবখানেই কাজ করি।”

কাজের সাফল্যে আলফ্রেড নোবেলকে উচ্ছসিত হতে যেমন কেউ কখনো দেখেননি, ব্যর্থতায় ভেঙে পড়তেও কখনো দেখা যায়নি। এ যেন কাজের জন্যই কাজ করা। বন্ধুহীন সঙ্গীহীন একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত আলফ্রেড পুরো পৃথিবীর প্রতিই একধরনের বিতৃষ্ণভাব পোষণ করতেন। রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি সামান্য সমর্থন থাকলেও নিজের ধনবাদী অবস্থান থেকে নড়তে রাজি ছিলেন না কখনোই। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিও বিশ্বাস ছিল না আলফ্রেডের। জনগণ সমষ্টিগতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করতেন না আলফ্রেড। নিজের পড়াশোনা ও ভাবনা-চিন্তার গভীরতার ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল আলফ্রেডের। তিনি যে প্রচুর সম্পদের মালিক এবং এ সম্পদ যে তাঁকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান করে তুলেছে তা তিনি ভালো করেই জানতেন। জানতেন বলেই সাধারণ মানুষের সাথে একটা দূরত্ব তিনি বরাবরই রক্ষা করে চলতেন। 

শরীর তাঁর কোনদিনই খুব ভাল ছিল না। সারাক্ষণই কোন না কোন শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে। নিজের ভেতর একধরনের হীনমন্যতা বাসা বেঁধেছে। নিজেকে খুবই অনাকর্ষণীয় মনে করেন তিনি। ভালোবাসাহীন শারীরিক সম্পর্কের প্রতিও কোন আকর্ষণ নেই তাঁর। সেই প্রথম যৌবন থেকে অপেক্ষা করছেন কখন তাঁর ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা হবে।

যে রাশিয়ান মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন সেই প্রেম বিকশিত হবার আগেই মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। তারপর কেটে গেছে তেইশ বছর। আলফ্রেড সেরকম আর কোন মেয়ের প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করেননি এতগুলো বছরে। অবশ্য ভালোবাসা পাবার জন্য যেটুকু সময় সামাজিক মেলামেশায় কাটানো দরকার তার কিছুই করেননি তিনি। মনের মধ্যে তিনি একটা ধারণা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন তা হলো তাঁকে কোন মেয়ে ভালবাসবে না, কারণ মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতো কোনকিছুই নেই তাঁর মধ্যে।  

১৮৭৬ সালে আলফ্রেড ভিয়েনায় গিয়েছিলেন কাজে। শহরটাকে বেশ ভালোই লাগে তাঁর। ভিয়েনার হোটেলে বসেই কিছুদিন কাজকর্ম চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কাজ করতে করতে নিজেকে বড় একাকী বড় বুড়ো মনে হচ্ছে তাঁর। নিজের কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন লোক রেখেছেন কিছুদিন হলো। কিন্তু তাকে দিয়ে সবকিছু সামলানো যাচ্ছে না। মনে হলো এই ভিয়েনায় থেকে এমন একজন কাউকে খুঁজে নেয়া যায় যে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী থেকে বন্ধুও হয়ে যেতে পারে কোন এক সময়।

অনেক ভেবেচিন্তে সংবাদপত্রের ‘আবশ্যক’ পাতায় একটা বিজ্ঞাপন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভিয়েনার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো সেই বিজ্ঞাপন -  “প্যারিসে বসবাসরত ধনী, উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, বয়স্ক ভদ্রলোকের প্যারিসের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এবং ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য একাধিক ভাষায় পারদর্শী বয়স্কা মহিলা আবশ্যক।” 

প্যারিসে ফিরে এসে দেখলেন তাঁর বিজ্ঞাপনের সুবাদে অনেকগুলো দরখাস্ত এসে জমা হয়েছে। আলফ্রেড বাছাই করতে শুরু করলেন। সবার ইন্টারভিউ নেবার সময় তাঁর নেই। যা করার দরখাস্তের ভাষা, তথ্য এবং ছবি দেখে ঠিক করতে হবে। তিনি জানেন তিনি কী চাইছেন। তিনি চাইছেন এমন কাউকে নিয়োগ দিতে যিনি তাঁর চিঠিপত্র লিখতে পারবেন পাঁচটি ভাষায়, যিনি ইতিহাস সচেতন হবেন, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থাকলে তো খুবই ভালো। 

দরখাস্ত বাছাই করতে করতে তিনি পেয়ে গেলেন যা চাইছিলেন তার চেয়েও বেশি। চমৎকার হাতের লেখা, চমৎকার শব্দচয়ন - পাঁচটি না হলেও ইংরেজি, ফরাসি আর ইতালিয়ান এই তিনটি ভাষায় পারদর্শী - কাউন্টেস বার্থা সোফিয়া ফেলিটাস কিনস্কি ফন কিনিক - সংক্ষেপে বার্থা ফন কিনস্কি।  

বার্থার সাথে কাজের কথা বলতে বলতে নোবেল বিস্তারিতভাবে বললেন তিনি কী কী জিনিস নিয়ে গবেষণা করছেন, কী কী বিস্ফোরক তৈরি হচ্ছে তার কারখানায়, কীভাবে সারা পৃথিবীতে রাস্তাঘাট ট্রেন লাইন তৈরি করার জন্য পাহাড়-পর্বত সমতল করার কাজে ডায়নামাইটের ব্যবহার বাড়ছে। বলতে বলতে আলফ্রেড খেয়াল করলেন - খুব আনন্দ পাচ্ছেন তিনি বার্থার সাথে কথা বলতে। মনে হচ্ছে এতদিন ধরে তিনি যাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁকে পেয়ে গেছেন। বার্থাই হতে পারেন তাঁর জীবনের সুখদুঃখের অংশীদার।

বার্থাকে কাছ থেকে দেখে, কয়েকদিন মিশে বার্থার প্রতি একধরনের দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করেছেন আলফ্রেড। বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় তিনি ভালোবাসার কথা ভাবেননি একবারও। চেয়েছিলেন বয়স্কা কেউ এসে তার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তার ঘরবাড়ির দেখাশোনাও করবেন। একজন কথা বলার লোক হবে তাঁর। সংসারে কারো সাথেই তো মন খুলে কথা বলতে পারেন না। সবার সাথেই কেমন যেন বৈষয়িক দেয়ানেয়ার সম্পর্ক। বিশ বছর আগে যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন তাকে ভুলতে পারেননি। বার্থা স্মার্ট সুন্দরী শিক্ষিতা একাধিক ভাষায় পারদর্শী - তাঁর তো এরকমই কাউকে দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে বার্থার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন আলফ্রেড নোবেল। 

কিন্তু বার্থা ছিলেন অন্যের বাগদত্তা। কিছুদিন পরেই তিনি আলফ্রেডের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। ক’দিন পর বার্থার চিঠি এলো ককেশাস থেকে। আর্থারকে বিয়ে করে তিনি সুখে আছেন। সুন্দর করে চিঠির উত্তর দেন আলফ্রেড। বার্থার সাথে সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে যায় আলফ্রেডের। আমৃত্যু অটুট ছিল এ সম্পর্ক। পত্রযোগাযোগ ছিল আলফ্রেডের মৃত্যু পর্যন্ত। 

১৮৭৬ সালে বার্থার হৃদয়ে জায়গা পেতে ব্যর্থ হয়ে আলফ্রেড মনে মনে বেশ জেদী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর হৃদয়ের দরজা জোর করে বন্ধ করতে চাইলেও কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। সময় পেলেই তিনি ভিয়েনায় চলে যান, হেলথ রিসর্টে থাকেন। একটু অবসর পেলেই ঘুরে বেড়ান। একদিন এক ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন আলফ্রেড। দোকানে কাজ করছে অষ্টাদশী এক অস্ট্রিয়ান সুন্দরী - মিষ্টি একটা মেয়ে। মেয়েটির নাম সোফি হেস। 

কয়েক দিনের মধ্যেই আলফ্রেড ফুল কেনার মত করে ফুলের দোকানের কর্মচারী সোফি হেসকে একপ্রকার কিনেই নিলেন। অনেক বছর সোফিকে তিনি নিজের কাছে রেখেছিলেন। কিন্তু কোন সামাজিক স্বীকৃতি দেননি। 

আলফ্রেডের ব্যবসা আরো বাড়ছে। ১৮৭৯ সালে রাশিয়ায় আরেকটি কোম্পানি খুলে নাম দিয়েছেন ‘ব্রাদার্স নোবেল’ বা  ব্রানোবেল। রাশিয়াতে বড়ভাই রবার্ট ও লুডভিগ তার দেখাশোনা করছেন। ১৮৮৪ সালে আবিষ্কার করেছেন ধোঁয়াহীন গানপাউডার - ব্যালিসাইট। ব্যাপক চাহিদা এই ব্যালিসাইটের। ১৮৮৬ সালে ফরাসি অংশীদার পল বার্বির সাথে মিলে নোবেল তাঁর সব ডায়নামাইট ফ্যাক্টরিকে একটা ট্রাস্টের অধীনে নিয়ে আসেন। 

১৮৮৮ সালে আলফ্রেডের বড়ভাই লুডভিগ নোবেল মারা যান। প্যারিসের সাংবাদিকেরা মনে করলেন বিখ্যাত আলফ্রেড নোবেলই মারা গেছেন। সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো - “মৃত্যুর কারবারির মৃত্যু”। প্যারিসের প্রায় সবগুলো সংবাদপত্রই বিস্তারিতভাবে নোবেলের বিস্ফোরক ও অস্ত্র-ব্যবসার বিবরণ দিয়ে এভাবে সংবাদ রচনা করেছে যে পড়ার পরে আলফ্রেড নোবেল বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যুর পর ঠিক কীরকমের প্রতিক্রিয়া হবে। তাঁর মনে হলো পুরো ইউরোপে যেন খুশির বান ডেকেছে তাঁর মৃত্যুতে। এত ঘৃণা করে তাঁকে মানুষ? তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর এমন কিছু করা দরকার যাতে তাঁর মৃত্যুর পর মানুষ তাঁকে ‘মৃত্যুর কারবারি’ দানব হিসেবে মনে না রেখে অন্য কোন কাজের জন্য মনে রাখবে। তিনি তাঁর উইল নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। 

পরের বছর ১৮৮৯ সালে বার্থা ফন শাটনারের যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘লে ডাউন ইওর আর্মস’ প্রকাশিত হলো। অনেকগুলো ভাষায় অনুদিত হয় এ উপন্যাস। এই বইয়ের মাধ্যমে বার্থাও জড়িয়ে পড়েন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে। আলফ্রেড নোবেলও বইটি পড়েন। তিনিও যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে, কিন্তু এরকম আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনায় পুরোপুরি বিশ্বাসী নন। তিনি বার্থাদের আন্দোলনে অর্থসাহায্য করেন - কিন্তু তার পরিমাণ তাঁর সামর্থ্যের তুলনায় খুবই নগণ্য। 

বার্থাকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমার কারখানায় তৈরি মারণাস্ত্রই হয়তো একদিন পৃথিবীর সব যুদ্ধ থামিয়ে দেবে। আমি এমন মারণাস্ত্র তৈরি করতে চাই যা দিয়ে যুদ্ধ করে সব যুদ্ধ একদিন শেষ হয়ে যাবে - কারণ তখন যুদ্ধ করার মতো আর কেউ বেঁচে থাকবে না।” 

আলফ্রেড নোবেলের এই কথায় আর যাই হোক - যুদ্ধ বন্ধের জন্য তাঁর কারখানা বন্ধ করে দেয়ার কোন ইঙ্গিত ছিল না। মারণাস্ত্র তৈরি করাই যে উচিত নয় - তা তিনি উপলব্ধি করেননি কখনো। তাইতো তিনি ব্যবসা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮৯৩ সালে ৬০ বছর বয়সে সুইডেনের বোফোর্স অস্ত্র কারখানা কিনে নেন। রেগনার সলম্যান নামে এক ইঞ্জিনিয়ারকে দায়িত্ব দেন তিনি এই অস্ত্র কারখানার তত্ত্বাবধান করার জন্য। এই রেগনার সলম্যানই ছিলেন নোবেলের মৃত্যুর পর তাঁর উইলের নির্বাহী ব্যবস্থাপক। 

১৮৮৯ সালে আলফ্রেডের মা মারা যান। আলফ্রেড মানসিকভাবে একেবারেই একা হয়ে গেলেন। ফরাসি সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কারণ তিনি ইতালিয়ান সরকারের সাথে তাঁর ধোঁয়াহীন গানপাউডার সরবরাহের জন্য চুক্তি করছেন। ফ্রান্সের সাথে ইতালির সম্পর্ক খারাপ। ফ্রান্সে বাস করে ইতালির কাছে গানপাউডার বিক্রি করা দেশদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু আলফ্রেড যেখানে টাকা পাচ্ছেন সেখানেই বিক্রি করছেন। গান পাউডার কোথায় কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে তাঁর কোনরকম মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। 

১৮৯০ সালে ইতালিয়ান সরকারের সাথে তাঁর চুক্তি হওয়ার সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিলেন ফ্রান্স সরকার। নোবেলের ফ্রান্সের ল্যাবোরেটরি বন্ধ করে দেয়া হলো। নোবেলকে যেকোনো সময় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার করা হতে পারে। নোবেল বুঝতে পারলেন ফ্রান্সের দিন শেষ। তিনি দ্রুত ফ্রান্স থেকে সবকিছু গুটিয়ে ইতালিতে চলে গেলেন। ইতালির সান রেমোতে বাড়ি কিনলেন তিনি।  

এদিকে তাঁর ফরাসি পার্টনার পল বার্বি আত্মহত্যা করেন। নোবেল জানতে পারেন যে পল নোবেলকে না জানিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো নাইট্রোগ্লিসারিনের ব্যবসা করছিলেন। অথচ নোবেল পল বার্বিকে বিশ্বাস করে তাঁর সবগুলো ডায়নামাইটের কারখানাকে একটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একের পর এক ধাক্কায় খুবই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলেন আলফ্রেড নোবেল। 

১৮৯৫ সালে আলফ্রেড ব্রিটিশ আদালতে দায়ের করা মামলায় হেরে যান। তাঁর ধোঁয়াহীন গানপাউডারের ব্রিটিশ রাইট চলে যায়। তাঁর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুচিন্তা ঘিরে ধরতে শুরু করেছে তাঁকে। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে তাও ভাবছেন তিনি। ধর্মের প্রতি কোনরকম বিশ্বাস তাঁর নেই। সুতরাং মৃত্যুর পর কোনরকমের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় তাঁর শরীর সমাহিত হোক তা তিনি চান না। তিনি ভাবতে লাগলেন - যদি তাঁর শরীরকে ঘন সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে গলিয়ে ফেলে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় - অন্তঃত মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ানোর কাজে লাগবে। 

নোবেলের অনুশোচনা হচ্ছে সারাজীবন এত ধনসম্পদ অর্জন করেছেন বিস্ফোরক আর গোলাবারুদ আবিষ্কার ও বিক্রি করে। তাঁর তৈরি মাইন আর ডায়নামাইটে কত শত মানুষ প্রাণ দিয়েছে যুদ্ধের নামে। ভবিষ্যতে আরো কত যুদ্ধ যে হবে। বিশ্বশান্তির জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। সারাজীবন রোগে ভুগেছেন - চিকিৎসার উন্নতির জন্য কিছু করা দরকার। আর সাহিত্য তাঁর মনের খোরাক। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা না জানালে কীভাবে হয়? তিনি উইল তৈরি করলেন। কোন উকিলের সাহায্য ছাড়াই উইল তৈরি করলেন। স্বাক্ষর করে রেখে দিলেন নিজের কাজের ডেস্কে।

১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ইতালির সান রেমোতে ৬৩ বছর বয়সে মারা যান আলফ্রেড নোবেল। মৃত্যুর পর তাঁর উইলে দেখা যায় তাঁর সম্পদের প্রায় চুরানব্বই শতাংশ দিয়ে গেছেন নোবেল ফাউন্ডেশান গড়ার জন্য। যার আর্থিক মূল্য সেইসময় ছিল ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার - যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫ মিলিয়ন ডলারে। নোবেল ফাউন্ডেশানের দায়িত্বও লেখা আছে উইলে। প্রতিবছর চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান যাঁরা রাখবেন তাঁদেরকে। উইল কার্যকর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নোবেলের বোফোর্স অস্ত্রকারখানার ব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার রাগনার সোহল্‌ম্যানকে। 

নোবেল ফাউন্ডেশান গঠিত হলো। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরষ্কার চালু হলো। নোবেল ফাউন্ডেশান সোফি হেসের কাছ থেকে অনেক টাকার বিনিময়ে নোবেলের লেখা চিঠিগুলো কিনে নিল। তারপরেও যেন নোবেলের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কোনরকমের সমস্যা তৈরি না হতে পারে - সোফির সব চিঠি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত গোপন করে রাখা হয়েছিল নোবেল ফাউন্ডেশানের আর্কাইভে। নোবেলের বন্ধু বার্থা ফন শাটনার নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯০৫ সালে।

নোবেল পুরষ্কার চালু হবার পর কেটে গেছে একশ’ বছরেরও বেশি। এই একশ’ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বেশি অর্থমূল্যের আরো অনেক পুরষ্কার চালু হয়েছে পৃথিবীতে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে নোবেল পুরষ্কারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি এখনো আর কোন পুরষ্কার। নোবেল পুরষ্কার এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদারও প্রতীক। আলফ্রেড নোবেলকে কেউ আর ‘মৃত্যুর কারবারি’ মনে করেন না। যে নোবেল নিজেকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করতেন - নোবেল পুরষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি সবার ভালোবাসা পেয়েই চলেছেন। 


তথ্যসূত্র:

১। Irwin Abrams, Alfred Nobel, Bertha von Suttner and the Nobel peace prize, Scanorama, Vol 23 (11), 1993. 

২। www.nobel.se

৩। Kenne Fant, Alfred Nobel: A Biography, Arcade Publishing, London, 2006.

৪। প্রদীপ দেব, কোয়ান্টাম ভালোবাসা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪।


Saturday, 25 May 2019

আলফ্রেড নোবেলের বিস্ফোরক ভালোবাসা - পর্ব-৩ (শেষ)


সোফির কথা রাশিয়ায় আলফ্রেডের বড়ভাই লুডভিগের কানেও গেছে। তিনি দেখলেন সোফির কারণে আলফ্রেড শুধু নয় পুরো নোবেল পরিবারেরই সামাজিক মর্যাদায় ধ্বস নামতে পারে। তিনি আলফ্রেডের অজান্তে সোফির সাথে দেখা করলেন। দেখলেন সোফির উচ্চাকাঙ্খা। সোফিকে তিনি কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে আলফ্রেডের জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু সোফি ততদিনে ভালো করেই জেনে গেছেন যে আলফ্রেডের সাথে থেকে তিনি একদিন পুরো নোবেল সাম্রাজ্যের মালিক হতে পারবেন। তাঁর শুধু দরকার আলফ্রেডের ভালোবাসার স্বীকৃতি।

লুডভিগ সোফির পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কে খবর নিলেন। সোফির আরো কয়েকটা বোন আছে - এবং তারাও সবাই সুন্দরী এবং সৌন্দর্যকে পুঁজি করে বাড়তে জানেন। লুডভিগ আলফ্রেডকে বোঝাতে চাইলেন যে সোফি এবং তার পরিবার আলফ্রেডকে ফাঁসাতে চাইবে। আলফ্রেড যদি কোনভাবে সোফিকে বিয়ে করে তাহলে ভীষণ বিপদে পড়বে। সোফির মত নিচুশ্রেণির মেয়েরা আলফ্রেডের মত মানুষের জীবনের অংশ হবার উপযুক্ত নয় কিছুতেই। আলফ্রেড এ ব্যাপারে কিছুই বললেন না তার বড়ভাইকে।

আলফ্রেড সোফিকে তাঁর মানসিক অবলম্বন ভাবতে চাইলেন। তিনি তাঁর কাজ, গবেষণা, কারখানা, ব্যবসা সবকিছু সম্পর্কেই সোফিকে বিস্তারিত লিখে জানান। কিন্তু সোফির সেসব প্রসঙ্গে কোন কিছু বলার মত যেটুকু পড়াশোনা দরকার বা বোঝার মত যেটুকু মানসিক ক্ষমতা দরকার তা নেই।

কয়েক বছরের মধ্যেই আলফ্রেড বুঝতে পারলেন - কোথায় যেন ভুল হয়ে গেছে। শারীরিক উত্তেজনার একটা জোয়ার তাঁর এসেছিল - কিন্তু তা চলে গেছে কয়েক বছরের মধ্যেই। সোফির লেখাপড়া খুবই সীমিত। একাধিক ভাষা জানা তো দূরের কথা, নিজের ভাষাতেও ঠিকমতো লিখতে পারে না। আলফ্রেড প্রায় প্রতিদিনই চিঠি লিখেন সোফিকে, কিন্তু সোফি চিঠি লিখেন শুধুমাত্র টাকাপয়সার দরকার হলে। আলফ্রেড চান সোফি লেখাপড়া করে নিজেকে তাঁর যোগ্য করে গড়ে তুলবেন। কিন্তু সোফির সেরকম কোন ইচ্ছেই নেই। তিনি আলফ্রেডের টাকা-পয়সা ঘরবাড়ি যখন যা দরকার তা তো এমনিতেই পাচ্ছেন।

সোফির খরচের নমুনা দেখলে বোঝা যায় তিনি কতটা বদলেছেন নিজেকে। আলফ্রেড নিজের হাতে তাঁর জমা-খরচের হিসেব রাখেন। সেখান থেকে দেখা যায় - যেখানে নোবেল নিজের জন্য একজোড়া হাতমোজা কিনছেন মাত্র ৩.৭৫ ফ্রাঙ্কে, সেখানে সোফির হ্যাটের দাম তিনশ’ ফ্রাঙ্ক। যেখানে নোবেল বেয়ারাকে টিপ্‌স দিচ্ছেন মাত্র ০.২৫ ফ্রাঙ্ক, সেখানে সোফির জন্য এক বোতল মদ কিনছেন ছয়শ’ ফ্রাঙ্ক দিয়ে।

আলফ্রেডের ব্যবসা আরো বাড়ছে। ১৮৭৯ সালে রাশিয়ায় আরেকটি কোম্পানি খুলে নাম দিয়েছেন ‘ব্রাদার্স নোবেল’ বা  ব্রানোবেল। রাশিয়াতে বড়ভাই রবার্ট ও লুডভিগ তার দেখাশোনা করছেন। ১৮৮৪ সালে আবিষ্কার করেছেন ধোঁয়াহীন গানপাউডার - ব্যালিসাইট। ব্যাপক চাহিদা এই ব্যালিসাইটের। ১৮৮৬ সালে ফরাসি অংশীদার পল বার্বির সাথে মিলে নোবেল তাঁর সব ডায়নামাইট ফ্যাক্টরিকে একটা ট্রাস্টের অধীনে নিয়ে আসেন।

ব্যবসা যত বাড়ছে গন্ডগোলও দেখা দিচ্ছে তত। নানারকম ব্যবসায়িক মামলা-মোকদ্দমাও হচ্ছে। সোফিকে নিয়েও মনের ভেতর নানারকম দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু করেছে। আলফ্রেডের চিঠিতে বিরক্তি ঝরে পড়তে শুরু করেছে। সোফি নিজের শিক্ষা ও সংস্কৃতি উন্নত করার দিকে একটুও মনযোগ দিচ্ছে না তাতে ভীষণ বিরক্ত আলফ্রেড। তাঁর মনে হতে শুরু করেছে সোফি তাঁকে ভালোবাসেন না মোটেও, শুধু ভালবাসেন তাঁর টাকা-পয়সাকে।

নোবেল এই সন্দেহও করতে শুরু করেছেন যে সোফি তাঁকে ফাঁকি দিয়ে অন্য পুরুষের সাথে সময় কাটাচ্ছেন। সোফি যখন চিঠিতে নোবেলকে ‘ডার্লিং’ বলে সম্বোধন করেন - নোবেলের মনে হয় এই ইংরেজি শব্দ ‘ডার্লিং’ - কোত্থেকে শিখল সোফি? চিঠিতে তিনি বেশ কর্কশ ভাষাতেই জানতে চান সোফির কাছে। অনেকটা সরাসরিই বলে ফেলেন যে সোফিকেই হয়তো কেউ ‘ডার্লিং’ বলে ডাকতে শুরু করেছে ভিয়েনার বাংলোতে।

আলফ্রেডকে মুগ্ধ করার জন্য একবার ফরাসি ভাষায় একটা টেলিগ্রাম করেন সোফি। টেলিগ্রাম পেয়ে খুশি হওয়াতো দূরের কথা, আলফ্রেড সন্দেহ করেন যে কোন ফরাসি যুবকের সাথে সোফির অন্তরঙ্গতা শুরু হয়েছে। তিনি চিঠিতে সরাসরি সোফিকে আক্রমণ করেন এ ব্যাপারে। সোফি পরের চিঠিতে ব্যাখ্যা করে বলেন যে যিনি টেলিগ্রামটি লিখেছিলেন তিনি পুরুষ ছিলেন না। তিনি একজন বয়স্কা রমণী। কিন্তু আলফ্রেড বিশ্বাস করেন নি সোফির কথা।

আলফ্রেড তাঁর মনের কথাগুলো যখন কাউকে বলতে পারেন না তখন কাল্পনিক চরিত্রের আশ্রয় নিয়ে তাদের মুখে সংলাপগুলো বসিয়ে দেন। ‘নেমেসিস’ নামে একটি নাটক তিনি অনেকদিন থেকেই লিখছিলেন। সেখানে একটা সংলাপে তিনি সোফির উদ্দেশ্যে লেখেন, “ওরে মূঢ় মেয়ে, তুই ভাবছিস শুধুমাত্র যৌবনই সব? যুবাপুরুষই প্রেমের উপযুক্ত পাত্র? যুবক হৃদয় তো আবেগ দিয়ে চলে, বাস্তব প্রেমের কিছুই বোঝে না। বুদ্ধিমতী বাস্তববাদী মেয়েদের উচিত প্রৌঢ়দের ভালোবাসা। কারণ প্রৌঢ়রাই জানে সত্যিকারের ভালোবাসা কী।”

১৮৮০ সালে সোফিকে প্যারিসে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন আলফ্রেড। অস্ট্রিয়া বা সুইডেনে সোফির সাথে এক বাড়িতে রাত কাটানো সম্ভব হলেও প্যারিসে সোফিকে নিজের বাড়িতে এনে তোলার সৎ সাহস বা ইচ্ছে নোবেলের নেই। তিনি এখনো একটা ক্লিন সামাজিক ইমেজ ধরে রাখতে চান। তাই সোফির জন্য একটা বাড়ি ভাড়া করলেন প্যারিসে নিজের বাড়ির কাছেই। একজন ফরাসি রাঁধুনি নিয়োগ করলেন সোফির জন্য। মনের ভেতর এখনো তাঁর ইচ্ছে - সোফি ফরাসি শিখবেন এই রাঁধুনির কাছে। আলফ্রেডের ইচ্ছে সোফি নিজেকে শিক্ষায়-দীক্ষায় একজন সম্ভ্রান্ত সমাজের নারীতে পরিণত করে নেবে।

সোফিকে প্যারিসের বাসায় অনেকটা গৃহবন্দী করে রাখলেন আলফ্রেড। দারোয়ানকে বলে রেখেছেন সোফির কাছে কারা কারা আসে যেন তাঁকে জানানো হয়। আর সোফিকে বলে দিয়েছেন নিজের বোনদের ছাড়া আর কারো সাথে দেখা করতে পারবেন না।

সোফি নিজেকে মিসেস নোবেল বলে যে পরিচয় দেন তাও এখন আর পছন্দ হচ্ছে না নোবেলের। সোফি যতই বোঝাতে চান যে তাঁর জীবনে আলফ্রেড ছাড়া আর কোন পুরুষ নেই - আলফ্রেড ততই অবিশ্বাস করেন তাঁকে। আলফ্রেডের হীনমন্যতা থেকে জন্ম নেয় প্রচন্ড ঈর্ষা। সোফিকে তিনি সহ্যও করতে পারেন না, আবার ত্যাগও করতে পারেন না। প্যারিসের বাইরে কোথাও গেলে প্রায় প্রতিদিনই সোফির কাছে ফুল পাঠান, চিঠি লিখেন। শুরুতে কিছু ভালোবাসার কথাও থাকে। কিন্তু তারপরই শুরু হয়ে যায় রুঢ় সন্দেহের বাক্যবাণ।

এদিকে সোফিরও আর ভালো লাগছে না এই সোনার কারাগার। তাঁরও বয়স বাড়ছে। তিরিশ পেরিয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। সেই আঠারো থেকে সম্পর্ক আলফ্রেডের সাথে। এত বছরেও তাঁদের সম্পর্কের কোনরূপ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। আলফ্রেডের মনের নাগাল তিনি পাননি, অবশ্য চেষ্টাও করেন নি কখনো। আলফ্রেডের সাথে এখন আর কোন শারীরিক সম্পর্কও নেই।

শুরুতে বিলাসী জীবনের যে স্বপ্ন ছিল সে স্বপ্নের রঙ বদলাতে শুরু করেছে। তিনি বুঝতে পারছেন শুধুমাত্র টাকা-পয়সা প্রাচুর্যই জীবনের সবকিছু নয়। যে জীবনের সত্যিকারের কোন পরিচয় নেই - সে জীবনের মূল্য কী? নিজের দুঃখের কথা তিনি আলফ্রেডকেও জানান - “আমি তো বিবাহিতও নই, অবিবাহিতও নই। আমার অবস্থানটা ঠিক কোথায়?”

ব্যারোনেস বার্থা ফন শাটনারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ পত্রযোগাযোগ আছে নোবেলের। বার্থার চিঠি পেলে তিনি বার্থার সাথে সোফির তুলনা করে ভীষণ ঈর্ষায় ভোগেন। মনে হয় কেন তিনি বার্থার মত কাউকে পেলেন না জীবনে? আবার সোফির সাথে যেরকম অকপট হতে পারেন - বার্থার সাথে পারেন না। সেখানে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকতে হয়।

একদিন বার্থা অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখলেন নোবেলকে। চিঠি পড়ে বেশ অবাক হয়ে গেলেন আলফ্রেড। বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেননি বলে কিছুটা ছদ্ম-অভিযোগও জানিয়েছেন বার্থা। বার্থা লিখেছেন তিনি ভিয়েনার এক ফুলের দোকানীর কাছে জানতে পেরেছেন যে সেই দোকান থেকে নিয়মিত ফুল পাঠানো হয় প্যারিসে মিসেস নোবেলের কাছে। মিসেস নোবেল ইন প্যারিস? আলফ্রেড নোবেল ছাড়া আর কোন নোবেল তো প্যারিসে থাকেন না। ভাবলেন বন্ধু আলফ্রেড তাঁকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলেছেন।

আলফ্রেড বুঝতে পারলেন ভুলটা কোথায় হয়েছে। প্যারিসের কোন দোকান থেকে সোফির কাছে ফুল পাঠানো সম্ভব নয় আলফ্রেডের। কারণ প্যারিসে সবাই চেনে তাঁকে। তাই তিনি ভিয়েনা থেকে ফুল পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন সোফির কাছে। আর সোফিকে চিঠির ঠিকানায় ‘মিসেস নোবেল’ বলেই চালান তিনি। এখন বার্থার কাছে তো সোফির কথা বলা যায় না। যে আলফ্রেড নোবেল মনে করতেন যেকোন পরিস্থিতিতেই সত্যকথা বলা দরকার, তিনিই বার্থার কাছে অনেক ধানাই পানাই করে মিথ্যাকথা লিখলেন একঝুড়ি। জানালেন, যে মিসেস নোবেলকে ফুল পাঠানো হয়েছে - তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের স্ত্রী মিসেস লুডভিগ নোবেল।

১৮৮৮ সালে আলফ্রেডের বড়ভাই লুডভিগ নোবেল মারা যান। প্যারিসের সাংবাদিকেরা মনে করলেন বিখ্যাত আলফ্রেড নোবেলই মারা গেছেন। সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো - “মৃত্যুর কারবারির মৃত্যু”। প্যারিসের প্রায় সবগুলো সংবাদপত্রই বিস্তারিতভাবে নোবেলের বিস্ফোরক ও অস্ত্র-ব্যবসার বিবরণ দিয়ে এভাবে সংবাদ রচনা করেছে যে পড়ার পরে আলফ্রেড নোবেল বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যুর পর ঠিক কীরকমের প্রতিক্রিয়া হবে। তাঁর মনে হলো পুরো ইউরোপে যেন খুশির বান ডেকেছে তাঁর মৃত্যুতে। এত ঘৃণা করে তাঁকে মানুষ? তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর এমন কিছু করা দরকার যাতে তাঁর মৃত্যুর পর মানুষ তাঁকে ‘মৃত্যুর কারবারি’ দানব হিসেবে মনে না রেখে অন্য কোন কাজের জন্য মনে রাখবে। তিনি তাঁর উইল নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন।

পরের বছর ১৮৮৯ সালে বার্থা ফন শাটনারের যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘লে ডাউন ইওর আর্মস’ প্রকাশিত হলো। অনেকগুলো ভাষায় অনুদিত হয় এ উপন্যাস। এই বইয়ের মাধ্যমে বার্থাও জড়িয়ে পড়েন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে। আলফ্রেড নোবেলও বইটি পড়েন। তিনিও যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে, কিন্তু এরকম আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনায় পুরোপুরি বিশ্বাসী নন। তিনি বার্থাদের আন্দোলনে অর্থসাহায্য করেন - কিন্তু তার পরিমাণ তাঁর সামর্থ্যের তুলনায় খুবই নগণ্য।

বার্থাকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমার কারখানায় তৈরি মারণাস্ত্রই হয়তো একদিন পৃথিবীর সব যুদ্ধ থামিয়ে দেবে। আমি এমন মারণাস্ত্র তৈরি করতে চাই যা দিয়ে যুদ্ধ করে সব যুদ্ধ একদিন শেষ হয়ে যাবে - কারণ তখন যুদ্ধ করার মতো আর কেউ বেঁচে থাকবে না।”

আলফ্রেড নোবেলের এই কথায় আর যাই হোক - যুদ্ধ বন্ধের জন্য তাঁর কারখানা বন্ধ করে দেয়ার কোন ইঙ্গিত ছিল না। মারণাস্ত্র তৈরি করাই যে উচিত নয় - তা তিনি উপলব্ধি করেননি কখনো। তাইতো তিনি ব্যবসা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮৯৩ সালে ৬০ বছর বয়সে সুইডেনের বোফোর্স অস্ত্র কারখানা কিনে নেন। রেগনার সলম্যান নামে এক ইঞ্জিনিয়ারকে দায়িত্ব দেন তিনি এই অস্ত্র কারখানার তত্ত্বাবধান করার জন্য। এই রেগনার সলম্যানই ছিলেন নোবেলের মৃত্যুর পর তাঁর উইলের নির্বাহী ব্যবস্থাপক।

১৮৮৯ সালে আলফ্রেডের মা মারা যান। আলফ্রেড মানসিকভাবে একেবারেই একা হয়ে গেলেন। ফরাসি সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কারণ তিনি ইতালিয়ান সরকারের সাথে তাঁর ধোঁয়াহীন  গানপাউডার সরবরাহের জন্য চুক্তি করছেন। ফ্রান্সের সাথে ইতালির সম্পর্ক খারাপ। ফ্রান্সে বাস করে ইতালির কাছে গানপাউডার বিক্রি করা দেশদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু আলফ্রেড যেখানে টাকা পাচ্ছেন সেখানেই বিক্রি করছেন। গান পাউডার কোথায় কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে তাঁর কোনরকম মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

১৮৯০ সালে ইতালিয়ান সরকারের সাথে তাঁর চুক্তি হওয়ার সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিলেন ফ্রান্স সরকার। নোবেলের ফ্রান্সের ল্যাবোরেটরি বন্ধ করে দেয়া হলো। নোবেলকে যে কোন সময় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার করা হতে পারে। নোবেল বুঝতে পারলেন ফ্রান্সের দিন শেষ। তিনি দ্রুত ফ্রান্স থেকে সবকিছু গুটিয়ে ইতালিতে চলে গেলেন। ইতালির সান রেমোতে বাড়ি কিনলেন তিনি।

এদিকে তাঁর ফরাসি পার্টনার পল বার্বি আত্মহত্যা করেন। নোবেল জানতে পারেন যে পল নোবেলকে না জানিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো নাইট্রোগ্লিসারিনের ব্যবসা করছিলেন। অথচ নোবেল পল বার্বিকে বিশ্বাস করে তাঁর সবগুলো ডায়নামাইটের কারখানাকে একটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একের পর এক ধাক্কায় খুবই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলেন আলফ্রেড নোবেল।

প্যারিস থেকে ইতালিতে চলে যাবার অনেক আগেই সোফিকে ভিয়েনার ভিলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আলফ্রেড। অনেকদিন পর প্যারিসের বাড়ি নামক কারাগার থেকে ভিয়েনায় ফিরতে পেরে নিজেকে খুবই স্বাধীন মনে করলেন সোফি। অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর একজন যুবক অফিসারের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো সোফির। কিন্তু তা নোবেলকে জানাতে চান না তিনি। কারণ নোবেল তা জানতে পারলে সোফির সব যাবে। সোফির ভালোবাসা যেমন দরকার - তেমনি ভালো বাড়ি, গাড়ি প্রাচুর্যও দরকার। অস্ট্রিয়ান যুবক ভালোবাসা দিতে পারছে - কিন্তু তার সম্পদ নেই তেমন। সুতরাং নোবেলকে ছাড়া চলবে না সোফির।

কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একটা সমস্যা হয়ে গেলো। সোফি গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। তিনি চিঠি লিখলেন নোবেলকে। লিখলেন “এই সন্তান ঠিক তোমার মতই হবে।” আলফ্রেড বুঝতে পারেন না - যে সন্তান তাঁর নয় সে কীভাবে তাঁর মত হবে? নিজের এতদিনের সন্দেহ এভাবেই সত্যি হয়েছে দেখে আলফ্রেড যেন কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। সোফির সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করতে চাচ্ছিলেন অনেক বছর থেকে। কিন্তু কিছুতেই পারছিলেন না। এবার আর নয়। সোফির সাথে সব সম্পর্ক শেষ বলে জানিয়ে দিলেন আলফ্রেড। কিন্তু সোফি সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নন। ভিয়েনায় যে বাড়িটি সোফির নামে কেনা হয়েছিল তা সোফিরই রইল। ভরণপোষণের জন্য প্রচুর টাকা নোবেলের কাছ থেকে আদায় করলেন তিনি।

১৮৯৫ সালে আলফ্রেড ব্রিটিশ আদালতে দায়ের করা মামলায় হেরে যান। তাঁর ধোঁয়াহীন গানপাউডারের ব্রিটিশ রাইট চলে যায়। তাঁর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুচিন্তা ঘিরে ধরতে শুরু করেছে তাঁকে। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে তাও ভাবছেন তিনি। ধর্মের প্রতি কোনরকম বিশ্বাস তাঁর নেই। সুতরাং মৃত্যুর পর কোনরকমের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় তাঁর শরীর সমাহিত হোক তা তিনি চান না। তিনি ভাবতে লাগলেন - যদি তাঁর শরীরকে ঘন সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে গলিয়ে ফেলে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় - অন্তঃত মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ানোর কাজে লাগবে।

নোবেলের অনুশোচনা হচ্ছে সারাজীবন এত ধনসম্পদ অর্জন করেছেন বিস্ফোরক আর গোলাবারুদ আবিষ্কার ও বিক্রি করে। তাঁর তৈরি মাইন আর ডায়নামাইটে কত শত মানুষ প্রাণ দিয়েছে যুদ্ধের নামে। ভবিষ্যতে আরো কত যুদ্ধ যে হবে। বিশ্বশান্তির জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। সারাজীবন রোগে ভুগেছেন - চিকিৎসার উন্নতির জন্য কিছু করা দরকার। আর সাহিত্য তাঁর মনের খোরাক। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা না জানালে কীভাবে হয়? তিনি উইল তৈরি করলেন। কোন উকিলের সাহায্য ছাড়াই উইল তৈরি করলেন। স্বাক্ষর করে রেখে দিলেন নিজের কাজের ডেস্কে।

১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ইতালির সান রেমোতে ৬৩ বছর বয়সে মারা যান আলফ্রেড নোবেল। মৃত্যুর পর তাঁর উইলে দেখা যায় তাঁর সম্পদের প্রায় চুরানব্বই শতাংশ দিয়ে গেছেন নোবেল ফাউন্ডেশান গড়ার জন্য। যার আর্থিক মূল্য সেইসময় ছিল ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার - যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫ মিলিয়ন ডলারে। নোবেল ফাউন্ডেশানের দায়িত্বও লেখা আছে উইলে। প্রতিবছর চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান যাঁরা রাখবেন তাঁদেরকে। উইল কার্যকর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নোবেলের বোফোর্স অস্ত্রকারখানার ব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার রাগনার সোহল্‌ম্যানকে।

নোবেল ফাউন্ডেশান গঠিত হলো। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরষ্কার চালু হলো। নোবেল ফাউন্ডেশান সোফি হেসের কাছ থেকে অনেক টাকার বিনিময়ে নোবেলের লেখা চিঠিগুলো কিনে নিল। তারপরেও যেন নোবেলের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কোনরকমের সমস্যা তৈরি না হতে পারে - সোফির সব চিঠি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত গোপন করে রাখা হয়েছিল নোবেল ফাউন্ডেশানের আর্কাইভে। নোবেলের বন্ধু বার্থা ফন শাটনার নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯০৫ সালে।

নোবেল পুরষ্কার চালু হবার পর কেটে গেছে একশ’ বছরেরও বেশি। এই একশ’ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বেশি অর্থমূল্যের আরো অনেক পুরষ্কার চালু হয়েছে পৃথিবীতে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে নোবেল পুরষ্কারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি এখনো আর কোন পুরষ্কার। নোবেল পুরষ্কার এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদারও প্রতীক। আলফ্রেড নোবেলকে কেউ আর ‘মৃত্যুর কারবারি’ মনে করেন না। যে নোবেল নিজেকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করতেন - নোবেল পুরষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি সবার ভালোবাসা পেয়েই চলেছেন। ব্যক্তিগত ভালোবাসার চেয়ে এই ভালোবাসার মূল্য কি কোন অংশে কম?

আলফ্রেড নোবেলের বিস্ফোরক ভালোবাসা - পর্ব-২


১৮৭৬ সালে আলফ্রেড ভিয়েনায় গিয়েছিলেন কাজে। শহরটাকে বেশ ভালোই লাগে তাঁর। ভিয়েনার হোটেলে বসেই কিছুদিন কাজকর্ম চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কাজ করতে করতে নিজেকে বড় একাকী বড় বুড়ো মনে হচ্ছে তাঁর। নিজের কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন লোক রেখেছেন কিছুদিন হলো। কিন্তু তাকে দিয়ে সবকিছু সামলানো যাচ্ছে না। মনে হলো এই ভিয়েনায় থেকে এমন একজন কাউকে খুঁজে নেয়া যায় যে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী থেকে বন্ধুও হয়ে যেতে পারে কোন এক সময়। অনেক ভেবেচিন্তে সংবাদপত্রের ‘আবশ্যক’ পাতায় একটা বিজ্ঞাপন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভিয়েনার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো সেই বিজ্ঞাপন -  “প্যারিসে বসবাসরত ধনী, উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, বয়স্ক ভদ্রলোকের প্যারিসের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এবং ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য একাধিক ভাষায় পারদর্শী বয়স্কা মহিলা আবশ্যক।”

প্যারিসে ফিরে এসে দেখলেন তাঁর বিজ্ঞাপনের সুবাদে অনেকগুলো দরখাস্ত এসে জমা হয়েছে। আলফ্রেড বাছাই করতে শুরু করলেন। সবার ইন্টারভিউ নেবার সময় তাঁর নেই। যা করার দরখাস্তের ভাষা, তথ্য এবং ছবি দেখে ঠিক করতে হবে। তিনি জানেন তিনি কী চাইছেন। তিনি চাইছেন এমন কাউকে নিয়োগ দিতে যিনি তাঁর চিঠিপত্র লিখতে পারবেন পাঁচটি ভাষায়, যিনি ইতিহাস সচেতন হবেন, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থাকলে তো খুবই ভালো।

দরখাস্ত বাছাই করতে করতে তিনি পেয়ে গেলেন যা চাইছিলেন তার চেয়েও বেশি। চমৎকার হাতের লেখা, চমৎকার শব্দচয়ন - পাঁচটি না হলেও ইংরেজি, ফরাসি আর ইতালিয়ান এই তিনটি ভাষায় পারদর্শী - কাউন্টেস বার্থা সোফিয়া ফেলিটাস কিনস্কি ফন কিনিক - সংক্ষেপে বার্থা ফন কিনস্কি। দরখাস্তের সাথে পাঠানো ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন আলফ্রেড। আশ্চর্য সুন্দর আর ব্যক্তিত্বময়ী তেত্রিশ বছর বয়স্কা কুমারী বার্থা। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল।

আলফ্রেড বার্থাকে নিয়োগপত্র পাঠালেন। অনেক বেশি বেতন অফার করলেন যেন বার্থা মত পরিবর্তন না করতে পারেন। নির্দিষ্ট দিনে প্যারিসের ট্রেন স্টেশনে বার্থাকে রিসিভ করতে নিজেই গেলেন আলফ্রেড নোবেল। ছবি দেখে যতটুকু ধারণা করেছিলেন তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী ও ব্যক্তিত্বময়ী বার্থা।

“ওয়েলকাম টু প্যারিস কাউন্টেস ফন কিনস্কি। আমি আলফ্রেড নোবেল।”
“থ্যাংক ইউ মিস্টার নোবেল। ইউ আর সো কাইন্ড।”

বার্থাও আলফ্রেড নোবেলকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছেন। তাঁর চাকরিদাতাকে যতটা বুড়ো মনে করেছিলেন - মোটেও বুড়ো নন তিনি। বার্থার চেয়ে খুব বেশি হলে দশ বছরের বড় হবেন।

গাড়িতে উঠার সময় নোবেল বললেন, “আমার বাড়িতে আপনার থাকার জন্য যে রুম ঠিক করা হয়েছে তা নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। রেডি হতে কয়েকদিন দেরি হবে। আমি আপনার জন্য গ্রান্ড হোটেলে একটি সুইট ঠিক করে রেখেছি। এ ক’দিন আপনি সেখানেই থাকবেন।”

গ্রান্ড হোটেলের রুমে সুটকেস রেখে হোটেলের ডায়নিং রুমে বসে ব্রেকফাস্ট সারলেন বার্থা ও নোবেল। নোবেল বার্থাকে সংক্ষেপে বললেন তিনি কী করেন এবং বার্থার কাজ কী হবে। বার্থা বেশ অবাক হলেন। স্বাভাবিক ইউরোপিয়ানদের তুলনায় যথেষ্ট খাটো মৃদুভাষী সাদামাটা কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা এই ভদ্রলোক মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই বিশ্বজুড়ে ডায়নামাইটের কারখানার একচ্ছত্র মালিক। দুটো নীল চোখে কেমন যেন বিষন্নতা। কথাবার্তা খুবই মার্জিত, কিন্তু কোথাও যেন প্রচন্ড হতাশার সুর, প্রচন্ড শূন্যতা।

হোটেল থেকে বার্থাকে বাড়ি দেখাতে এবং কাজকর্ম বুঝিয়ে দিতে নিয়ে এলেন নোবেল। বাড়ি দেখে ভালো লাগলো বার্থার। নোবেলের কাজের অফিস এবং ব্যক্তিগত লাইব্রেরি দেখে ভীষণ খুশি হলেন বার্থা। লেখাপড়ার প্রতি তাঁরও আগ্রহ অনেক। বাড়িতে কাজের লোক ছাড়া আর কেউ থাকেন না দেখে সহজেই বুঝে নিলেন নোবেলের একাকীত্ব আর শূন্যতা কোথায়।

বার্থার সাথে কাজের কথা বলতে বলতে নোবেল বিস্তারিতভাবে বললেন তিনি কী কী জিনিস নিয়ে গবেষণা করছেন, কী কী বিস্ফোরক তৈরি হচ্ছে তার কারখানায়, কীভাবে সারা পৃথিবীতে রাস্তাঘাট ট্রেন লাইন তৈরি করার জন্য পাহাড়-পর্বত সমতল করার কাজে ডায়নামাইটের ব্যবহার বাড়ছে। বলতে বলতে আলফ্রেড খেয়াল করলেন - খুব আনন্দ পাচ্ছেন তিনি বার্থার সাথে কথা বলতে। মনে হচ্ছে এতদিন ধরে তিনি যাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁকে পেয়ে গেছেন। বার্থাই হতে পারেন তাঁর জীবনের সুখদুঃখের অংশীদার।

বার্থাও একধরনের মমতা অনুভব করছেন নোবেলের প্রতি। মানুষটা কত ধনী, কত সৃষ্টিশীল, কত বৈষয়িক; আবার একই সাথে কোথাও যেন এক গহীন মননে মগ্ন কবি।
দু’দিন পর গ্রান্ড হোটেলে ডিনার করার সময় বার্থার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন নোবেল।
“কী এটা?”
“পড়ে দেখুন”
“কবিতা বলে মনে হচ্ছে!”
“একজন নিঃসঙ্গ মানুষের গোপন শখ।”

বার্থার ধারণাই ঠিক। এই আপাত কঠিন মানুষটা একজন কবি। কবিতার ছত্রে ছত্রে জাল বুনেছে গভীর কষ্ট। মানুষটা এত হতাশাবাদী কেন? ভেবে পান না বার্থা। কিন্তু বুঝতে পারেন এই মানুষটার একজন অবলম্বন দরকার। শুধুমাত্র সেক্রেটারির পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। নোবেলের দরকার বেতনভুক্ত সেক্রেটারির চেয়েও বেশি কাউকে। বার্থার ভয় হতে থাকে - তিনি কি তা হতে পারবেন নোবেলের যা দরকার?

বার্থাকে কাছ থেকে দেখে, কয়েকদিন মিশে বার্থার প্রতি একধরনের দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করেছেন আলফ্রেড। বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় তিনি ভালোবাসার কথা ভাবেননি একবারও। চেয়েছিলেন বয়স্কা কেউ এসে তার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তার ঘরবাড়ির দেখাশোনাও করবেন। একজন কথা বলার লোক হবে তাঁর। সংসারে কারো সাথেই তো মন খুলে কথা বলতে পারেন না। সবার সাথেই কেমন যেন বৈষয়িক দেয়ানেয়ার সম্পর্ক। বিশ বছর আগে যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন তাকে ভুলতে পারেন নি। বার্থা স্মার্ট সুন্দরী শিক্ষিতা একাধিক ভাষায় পারদর্শী - তাঁর তো এরকমই কাউকে দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে বার্থার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন আলফ্রেড নোবেল।
পরদিন ডিনারের পর বার্থাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন আলফ্রেড, “তোমার হৃদয়ে কি আমার জন্য একটু জায়গা হবে?”
কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না বার্থা। আলফ্রেডকে দেখেই ভালো লেগে গেছে বলা যাবে না। ক’দিন কাছ থেকে দেখে যতটুকু বুঝেছেন মানুষটা ভাবুক, কবি, দয়ালু কিন্তু বিষন্ন। খুবই অসুখী, কিছুটা সন্দেহপরায়ণ। মানুষের ভাবনাচিন্তার সবকিছুই বুঝতে পারেন, কিন্তু ভীষণ নৈরাশ্যবাদী। সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, কিন্তু মানুষটা মনে হয় হাসতে জানেন না। বার্থা এক ধরনের মমতা অনুভব করেন আলফ্রেডের প্রতি - কিন্তু তা প্রেম নয়। তার হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে যে অন্য একজন বসে আছেন তা কীভাবে বলবেন বার্থা। কিন্তু না বললে যে আরো অবিচার করা হবে নোবেলের প্রতি। বার্থা নোবেলকে খুলে বললেন তাঁর হৃদয়ের কথা। 
ভিয়েনার খুব বনেদি পরিবারে জন্ম বার্থার। পারিবারিক সূত্রেই কাউন্টেস তিনি। বার্থার বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর অফিসার। বার্থার জন্মের আগেই তিনি মারা যান। প্রচন্ড শোক ও হতাশা থেকে বার্থার মা মদ-জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন। ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে শিক্ষাদীক্ষা সহবতে বড় হতে হতে বার্থা দেখলেন তার মা স্বামীর অর্থসম্পদ যা ছিল সব জুয়া খেলতে খেলতেই শেষ করে ফেলেছেন। প্রচন্ড অর্থকষ্টে পড়তে হয় তাদের। বার্থাকে জীবিকার প্রয়োজনে গভর্নেসের কাজ নিতে হয়। 
সুন্দরী শিক্ষিতা দরিদ্র বার্থা ভিয়েনার খুব বনেদি ফন শাটনার পরিবারের চারজন মেয়েকে দেখাশোনার জন্য গভর্নেস হিসেবে কাজ করতে শুরু করলেন। শাটনার পরিবারের ছোটছেলে আর্থার বার্থার চেয়ে সাত বছরের ছোট। কিন্তু আর্থার বার্থার প্রেমে পড়ে গেলেন। বার্থাও ভালোবেসে ফেলেছেন আর্থারকে। আর্থার ঠিক করে ফেলেছেন বার্থাকে বিয়ে করবেন। 

আর্থারের মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এ সিদ্ধান্ত। বার্থা বড়ঘরের মেয়ে এটা ঠিক। কিন্তু বিত্তহীন কাউন্টেসের কোন দাম নেই আর্থারের মায়ের কাছে। তিনি ভাবছিলেন কীভাবে বার্থাকে দূর করে দেয়া যায়। ঠিক সেই সময়েই তাঁর চোখে পড়েছিলো নোবেলের বিজ্ঞাপন। 
আর্থারের মা ভেবেছিলেন - এই তো সুযোগ। কোনভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বার্থাকে প্যারিসে পাঠিয়ে দিতে পারলে আর্থারকে সামলানো কঠিন হবে না। তিনি বিজ্ঞাপনটি বার্থাকে দেখিয়ে বুঝিয়েছেন যে প্যারিসে তার যাওয়া উচিত। বিজ্ঞাপনে বয়স্কা মহিলা চাওয়া হয়েছে। তেত্রিশ বছর নিশ্চয় অনেক বয়স। তাছাড়া বার্থা ইংরেজি, ফরাসি আর ইতালিয়ান তো ভালোই জানেন। বার্থা আর্থারের মায়ের মনোভাব জানেন। এটাও জানেন যে আর্থারের সাথে তার সম্পর্ক খুবই অসম সম্পর্ক। আর্থারের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়াই সব দিক থেকে ভালো। তাই বার্থা বিজ্ঞাপনের চাকরির দরখাস্ত করেছিলেন। 
বার্থা বলেন, “বিদায়বেলায় আর্থার আমার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে বলেছে ‘বার্থা, আমি তোমাকে ভুলব না’। আমিও যে আর্থারকে ভুলতে পারছি না কিছুতেই।” 
সবশুনে আলফ্রেড পরামর্শ দিলেন, “ভুলে যাও সব। আর্থারের সাথে আর কোন যোগাযোগ রেখো না।”
বার্থা ভাবলেন তাই হবে। 
ক’দিন পরেই আলফ্রেডকে দরকারি কাজে যেতে হলো স্টকহোমে। বার্থা রয়ে গেলেন প্যারিসের হোটেলে। পরদিনই দুটো টেলিগ্রাম পেলেন বার্থা হোটেলের ঠিকানায়। একটা পাঠিয়েছেন আলফ্রেড - স্টকহোমে পৌঁছেছেন ঠিকমত। দ্বিতীয়টা টেলিগ্রামটা এসেছে আর্থারের কাছ থেকে। আর্থার লিখেছেন - “তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না বার্থা।” 
উথাল-পাথাল সুখে উদ্বেল হয়ে উঠলেন বার্থা। দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। আলফ্রেডের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি লিখলেন। যেহেতু আলফ্রেডের চাকরিটি তিনি আর করছেন না, মনে হলো হোটেলের বিলটা তাঁরই  দিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু টাকা-পয়সা নেই তাঁর। পারিবারিকসূত্রে একটা হিরের পিন পেয়েছিলেন তিনি। সেটা বিক্রি করে হোটেলের বিলটা চুকিয়ে ট্রেনের টিকেট কেটে ফিরে গেলেন ভিয়েনায়। সেখানে আর্থার অপেক্ষা করছিলেন বার্থার জন্য। দু’জনে ভিয়েনা থেকে পালিয়ে চলে গেলেন ককেশাস (বর্তমান জর্জিয়া)। আর্থারকে বিয়ে করে বার্থা ফন কিনস্কি হলেন ব্যারোনেস বার্থা ফন শাটনার। 
এদিকে স্টকহোম থেকে প্যারিসে ফিরে এসে বার্থার চিঠি পেয়ে খুব হতাশ হয়ে গেলেন আলফ্রেড। তাঁর মনে হলো কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা তার নেই। তিনি কি বার্থার যোগ্য ছিলেন না? ৪৩ বছর বয়স কি প্রেমের জন্য খুবই বেশি? তিনি কি বার্থার কাছে এমন কিছু চেয়ে বসেছিলেন যে বার্থা এভাবে চলে গেল? এতবছর পর মনে প্রেম অনুভব করেছিলেন তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল এভাবে? 
ক’দিন পর বার্থার চিঠি এলো ককেশাস থেকে। আর্থারকে বিয়ে করে তিনি সুখে আছেন। সুন্দর করে চিঠির উত্তর দেন আলফ্রেড। বার্থার সাথে সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে যায় আলফ্রেডের। আমৃত্যু অটুট ছিল এ সম্পর্ক। 
বিয়ের পর প্রায় আট বছর পর্যন্ত ককেশাসে ছিলেন আর্থার ও বার্থা। সেসময় বার্থা লিখতে শুরু করেন। গল্প উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর। যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্রবিরোধী বই পড়তে পড়তে নিজেও যুদ্ধবিরোধী হয়ে গেছেন বার্থা। আট বছর পর আর্থারের মা তাঁদের সম্পর্ক মেনে নিলে তাঁরা ভিয়েনায় ফিরে আসেন। সেখান থেকে স্বামীকে সাথে নিয়ে প্যারিসে এসে দেখা করে যান আলফ্রেড নোবেলের সাথে। বিয়ের পর সেই একবারই দেখা হয়েছিল বার্থার সাথে আলফ্রেডের। তবে পত্রযোগাযোগ ছিল আলফ্রেডের মৃত্যু পর্যন্ত। 
১৮৭৬ সালে বার্থার হৃদয়ে জায়গা পেতে ব্যর্থ হয়ে আলফ্রেড মনে মনে বেশ জেদী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর হৃদয়ের দরজা জোর করে বন্ধ করতে চাইলেও কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। সময় পেলেই তিনি ভিয়েনায় চলে যান, হেলথ রিসর্টে থাকেন। একটু অবসর পেলেই ঘুরে বেড়ান। 
একদিন এক ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন আলফ্রেড। দোকানে কাজ করছে অষ্টাদশী এক অস্ট্রিয়ান সুন্দরী - মিষ্টি একটা মেয়ে। পায়ে পায়ে দোকানে ঢুকলেন আলফ্রেড। তাঁর চোখের মুগ্ধতা চোখ এড়ালো না মেয়েটির। আরো বেশি উচ্ছল হয়ে উঠলো সে। এগিয়ে এসে নানারকম ফুলের তোড়া দেখাতে লাগলো আলফ্রেডকে। আলফ্রেডের মনে হচ্ছে দোকানের সবগুলো ফুলের চেয়েও সুন্দর এই মেয়েটি। নোবেলের এতদিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত তাঁর এই চিত্তচাঞ্চল্য। 

মেয়েটি খুবই চঞ্চল, অনবরত কথা বলছে, বর্ণিল প্রজাপতির মত যেন উড়ে বেড়াচ্ছে দোকানজুড়ে। হঠাৎ একটা টিউলিপের কলি নিয়ে এসে আলফ্রেডের কোটে পরিয়ে দিলো। মেয়েটির সুন্দর আঙুল ছুঁয়ে গেল আলফ্রেডের কাঁধ, গলার একপাশ আর দাড়িতে। আলফ্রেড এতদিন সীমাহীন কাঠিন্যে এড়িয়ে চলেছেন এরকম সব কমনীয় স্পর্শ। কিন্তু এখন কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”
আলফ্রেডের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনেকটা ফিস ফিস করে বললো মেয়েটি - “সোফি”। আলফ্রেডের মনে হলো তাঁর কানে চুমু খেলো মেয়েটি। কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল তাঁর শরীর আর মনে। 
সোফি হেস। দরিদ্র ঘরের মেয়ে সোফি জানে এইসব ধনী টাকার কুমিরেরা তাদের মত গরীব সুন্দরী মেয়েদের কী চোখে দেখেন। সোফি জানে কীভাবে তাদের চোখে পড়তে হয়। আলফ্রেড নোবেলের মত মানুষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়ানোর মত কোন যোগ্যতাই নেই সোফির। অথচ আলফ্রেড সোফির প্রতি আকৃষ্ট হলেন। অদ্ভূত জটিল এই আকর্ষণ। তাঁর চেয়ে বয়সে তেইশ বছরের ছোট এই মেয়েটির প্রতি আদর মায়া-মমতা অনুভব করছেন তিনি। আবার একই সাথে মেয়েটির যৌবন তাঁকে টানছে। তিনি কামনা অনুভব করছেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি বদলে যাচ্ছে। পুরুষের চোখের এ দৃষ্টি খুবই চেনা সোফি হেসের। 
আলফ্রেডের এতদিনের সংযমের বাঁধ যেন হঠাৎ ভেঙে গেলো। তিনি সোফির সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুললেন - যে সম্পর্কের সামাজিক কোন স্বীকৃতি নেই। আবার নোবেলের মত ধনীদের জন্য এরকম সম্পর্কে তেমন কোন সামাজিক বাধাও নেই। কয়েক দিনের মধ্যেই আলফ্রেড ফুল কেনার মত করে ফুলের দোকানের কর্মচারী সোফি হেসকে একপ্রকার কিনেই নিলেন। 
দামি পোশাক, গয়না, আর দামি বাড়ি পেয়ে সোফির জীবন-পদ্ধতি পাল্টে যেতে সময় লাগলো না। আলফ্রেড সোফির জন্য বাড়ি কিনলেন ভিয়েনাতে। অভিজাত বাংলো ভাড়া করলেন সুইডেনে। আলফ্রেড যখন সুইডেনে বা ভিয়েনায় যান সোফিকে জানিয়ে দেন। সোফি আগে থেকেই সেখানকার বাংলোয় বা বাড়িতে চলে যান। আলফ্রেড দাপ্তরিক কাজ সেরে চলে যান সোফির কাছে। সোফির লাইফস্টাইল দ্রুত বদলে যেতে থাকে। তাঁর অর্থনৈতিক চাহিদাও বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে।
যদিও আলফ্রেড কখনোই সোফিকে নিয়ে সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে যাননি, কারো সাথে সোফির পরিচয়ও করিয়ে দেননি - সোফির সাথে আলফ্রেডের সম্পর্কের কথা গোপন থাকলো না। নোবেল কোম্পানির প্রধান যে একজন রক্ষিতা রেখেছেন তা নিয়ে সামাজিক গুঞ্জন বাড়ছে। কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে লাগলেন আলফ্রেড। কাজের প্রয়োজনে সোফির কাছ থেকে দূরেই থাকতে হয় তাঁকে বেশিরভাগ সময়। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই তিনি চিঠি লিখেন সোফিকে। চিঠির ঠিকানায় লিখেন - ‘মিসেস নোবেল’ বা ‘মিসেস সোফি নোবেল’। তাঁর পক্ষ থেকে এটা হলো গুঞ্জন এড়াবার উপায়। কিন্তু সোফির কাছে এটা হলো তাঁর সামাজিক স্বীকৃতি। তিনি নিজেকে ‘মিসেস আলফ্রেড নোবেল’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করলেন। 

আলফ্রেড নোবেলের বিস্ফোরক ভালোবাসা - পর্ব-১


বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কারের নাম নোবেল পুরষ্কার। ১৯০১ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে অবদানের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। ১৯৬৮ সাল থেকে নোবেলের সম্মানে অর্থনীতিতেও পুরষ্কার দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ও রসায়নের গবেষণায় সাফল্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার। সাহিত্যে যিনি নোবেল পুরষ্কার পান - তাঁর পাঠকপ্রিয়তা অনেক সময় হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান - নোবেল পুরষ্কার পাবার সাথে সাথে সেই ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়ে যায় অনেকগুণ। অবশ্য সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার যাঁরা পান তাঁদের নিয়ে অনেক সময় নানারকম বিতর্কও তৈরি হয়। তবে সেই বিতর্কে নোবেল পুরষ্কারের মর্যাদা একটুও কমে না, বরং বেড়ে যায়। এমন মর্যাদাকর পুরষ্কার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ও সম্পদে - তিনি আলফ্রেড নোবেল। ডায়নামাইটের আবিষ্কারক হিসেবে তাঁকে আমরা কিছুটা চিনি, নোবেল পুরষ্কারের মত মহান পুরষ্কার যাঁর নামে তাঁকেও বিরাট মহানুভব হিসেবে আমরা কল্পনা করে নিই ঠিক, কিন্তু ব্যক্তি আলফ্রেড নোবেল আমাদের কাছে অনেকটাই অচেনা। 
মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন আলফ্রেড নোবেল? যিনি একাধারে একের পর এক বিস্ফোরক ও যুদ্ধাস্ত্রের উপাদান আবিষ্কার করেছেন, সারা ইউরোপে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে তুলে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করেছেন, কিন্তু জীবন-যাপন করেছেন একাকী নিরাসক্ত। জীবনে কোনদিন ধূমপান করেন নি, মদ পান করেন নি, এমন কি বিয়েও করেন নি। তেমন কোন বন্ধুবান্ধবও ছিল না আলফ্রেড নোবেলের। প্রথম জীবনে কবি হতে চেয়েছিলেন - অনেক কবিতাও লিখেছিলেন। প্রেম ছিল সেসব কবিতায়, ক্ষোভও ছিল। কিন্তু সেরকম ভাবে তাঁর কোন রচনাই তিনি প্রকাশ করেন নি। অন্তর্মুখী এই মানুষটি একদিকে শক্তহাতে ইন্ডাস্ট্রি আর ব্যবসা সামলেছেন, অন্যদিকে নিরলস গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন একের পর এক নতুন বিস্ফোরক। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিলেন - যে দেয়াল ভেদ করে তাঁর মনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব ছিল না কারোরই। হাতে গোনা যে ক’জন মানুষের কাছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লিখেছিলেন তাও তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গোপন করে রেখেছিল নোবেল ফাউন্ডেশান। 

আলফ্রেড নোবেল তাঁর প্রত্যেকটি চিঠির কপি রাখতেন, একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিরও। নোবেল ফাউন্ডেশানের আর্কাইভে আছে তাঁর হাতে লেখা অনেক চিঠি। প্রত্যেকটি চিঠিতে তাঁর নিজের হাতে ক্রমিক নম্বর দেয়া। ১৯৫০ সালে তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো প্রকাশ্যে আসার পর আলফ্রেড নোবেলের ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তাগুলোর কিছু কিছু দিক উন্মোচিত হয়; পাওয়া যায় তাঁর ব্যক্তিগত ভালোবাসার অন্য একটা জগতের সন্ধান। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো আলফ্রেড নোবেলের নাম দিয়েছিলেন ‘দি ওয়েলদিয়েস্ট ভ্যাগাবন্ড ইন ইউরোপ’। নোবেলের চিঠিগুলো থেকে কিছুটা হলেও দেখা যায় তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী এই চিরকুমার ‘ভবঘুরে’র বিস্ফোরক ভালোবাসার কয়েক ঝলক।
নোবেলদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন নোবেলিয়াস পদবীভুক্ত দরিদ্র কৃষক। আলফ্রেডের ঠাকুরদা নিজের চেষ্টায় নাপিতের কাজ শিখেছিলেন। ক্ষৌরকর্মের পাশাপাশি তিনি ছোটখাট অস্ত্রোপচারও করতেন। ১৭৭৫ সালে তিনি নিজের পদবী নোবেলিয়াসের অর্ধেক ছেঁটে ফেলে ‘নোবেল’ করে নিলেন। তাঁর বড় ছেলে ইমানুয়েল - আলফ্রেড নোবেলের বাবা।  
১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমে ইমানুয়েল ও ক্যারোলিন নোবেলের চতুর্থ সন্তান আলফ্রেড নোবেলের জন্ম। আলফ্রেডের বড় তিন জনের মধ্যে এক জন জন্মের পরেই মারা যায়। বাকি দুই ভাই রবার্ট ও লুডভিগ।  ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এবং তাঁর নিজের কনস্ট্রাকশান ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম ছিল। কনস্ট্রাকশানের কাজে ইমানুয়েল নানারকম বিস্ফোরক নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে নতুন নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করছিলেন। তাঁর ব্যবসায় মাঝে মাঝে খুবই সাফল্য আসছিল, আবার মাঝে মাঝে তিনি সর্বস্ব হারাচ্ছিলেন। আলফ্রেডের যখন জন্ম হয় তখন ইমানুয়েল নোবেলের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর কনস্ট্রাকশান ফার্ম দেউলিয়া হয়ে গেছে। তিনি সুইডেনের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। 
এদিকে জন্ম থেকেই ভীষণ রুগ্ন আলফ্রেড। পেটের পীড়া লেগেই আছে, আর হৃদপিন্ডের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সারাজীবনই শরীর নিয়ে ভুগেছেন আলফ্রেড নোবেল। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে মা-কে আঁকড়ে ধরেই আলফ্রেডের বেড়ে ওঠা। সারাক্ষণ শারীরিক কষ্টে ভুগতে ভুগতে আলফ্রেড ছোটবেলা থেকেই কোন ধরনের খেলাধূলা করার প্রতি উৎসাহ পায়নি। তাই কোন খেলার সাথীও ছিল না। শৈশবে মা ছাড়া আর কারো সাথেই তার কোন আত্মিক গড়ে ওঠেনি। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে আলফ্রেড কখনোই হাসিখুশি উচ্ছল ছিল না। তাকে কেউ কখনো প্রাণখুলে হাসতে দেখেন নি। 
ইমানুয়েল নোবেল আর্থিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তির জন্য নানারকমের ব্যবসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিলেন না। আলফ্রেডের বয়স যখন চার, তখন তিনি তিন ছেলে ও স্ত্রীকে সুইডেনে রেখে ফিনল্যান্ড চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু করতে পারলেন না। সেখান থেকে চলে গেলেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে। সেই সময় রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের পাঁয়তারা চলছে। ইমানুয়েল দেখলেন সম্ভাব্য যুদ্ধের বাজারে গোলাবারুদ মাইন আর যন্ত্রাংশ তৈরি ও সরবরাহের বিপুল সম্ভাবনা। তিনি কাজ শুরু করে দিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। দ্রুত সাফল্য অর্জন করলেন তিনি, আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেলো। ১৮৪২ সালে পুরো পরিবারকে নিয়ে এলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। 
আলফ্রেড যখন সেন্ট পিটার্সবুর্গে এলো তখন তার বয়স নয় বছর। চার বছর বয়স থেকে বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু হয়েছে। ইমানুয়েল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই কোন ছেলেকেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে পাঠাননি। বাড়িতে টিউটর রেখে ব্যবহারিক শিক্ষা দিয়েছেন ছেলেদের পছন্দ, মেধা ও আগ্রহের দিকে খেয়াল রেখে। সেন্ট পিটার্সবুর্গের বাড়িতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষা, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ের জন্য শিক্ষক রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো ছেলেদের জন্য। 
আলফ্রেড নোবেল জীবনে কখনো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেননি। অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময় পড়াশোনাতেই কাটে আলফ্রেডের। রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আলফ্রেডের। বাবার কারখানায় নানারকম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নিজেরও অনেক নতুন নতুন আইডিয়া দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাল লাগে সাহিত্য। সতের বছর বয়স হবার আগেই সুইডিশ, রাশিয়ান, জার্মান, ইংলিশ ও ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও লিখতে শিখে গেল আলফ্রেড। লিখতে শুরু করলো কবিতা। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে লেখকই হবে সে। 
আলফ্রেডের কাব্যচর্চার কথা জেনে গেলেন তার বাবা ইমানুয়েল। তিনি জানেন কাব্যচর্চা করে অর্থোপার্জন করা যায় না। তাই তিনি চাচ্ছিলেন ছেলে এমন কিছু করুক যা দিয়ে অর্থ উপার্জন করা সহজ হবে। নিজের কারখানায় আলফ্রেডকে সম্পৃক্ত করার আগে সঠিক প্রশিক্ষণ দরকার। ১৮৫০ সালে আলফ্রেডকে রাসায়নিক প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়ার বাইরে  পাঠিয়ে দিলেন ইমানুয়েল নোবেল। 
পরবর্তী তিন বছর আলফ্রেড জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও আমেরিকায় কয়েকজন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ও রসায়নবিদের অধীনে কাজ শিখলো। আমেরিকায় আলফ্রেড কাজ করলো সুইডিশ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী জন এরিকসনের সাথে যিনি ‘মনিটর’ নামে একটা আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের ডিজাইন করেছিলেন। ফ্রান্সে গিয়ে আলফ্রেড কাজ শিখলেন রসায়নবিদ আস্ক্যানিও সবরেরোর কাছে। আস্ক্যানিও সবরেরো নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার করেছিলেন। ভয়ংকর বিস্ফোরক এই নাইট্রোগ্লিসারিন এতটাই বিপজ্জনক যে সামান্য নাড়াচাড়াতেই প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে যায়। তাই এটাকে তখন কোন ব্যবহারিক কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। আলফ্রেড ভাবতে শুরু করলেন নাইট্রোগ্লিসারিনকে কীভাবে বশে আনা যায়। 
১৮৫২ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরে এসে বাবার কারখানায় যোগ দিলেন উনিশ বছর বয়সী আলফ্রেড। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার নৌবাহিনী বিপুল পরিমাণ নেভাল মাইন কিনছিলো - আর তা সরবরাহ করছিল তাদের ‘ফাউন্ড্রিজ এন্ড মেশিন শপ্‌স অব নোবেল এন্ড সন্স’। যুদ্ধ যতদিন চললো নোবেল পরিবারের উপার্জন ততই ফুলে ফেঁপে উঠলো। বিপুল উৎসাহে ইমানুয়েল বেশ কয়েক বছরের জন্য মাইন তৈরি করে মজুদ করে ফেললেন। কিন্তু ১৮৫৬ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। ইমানুয়েলের গুদামভর্তি নেভাল মাইন অলস পড়ে রইল। দু’বছরের মধ্যে কারখানা আবার দেউলিয়া হয়ে গেল। 
এদিকে তরুণ আলফ্রেড নিজের পড়াশোনা, কারখানার ল্যাবরেটরিতে নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চেষ্টা করেন। কবিতায় প্রেম আর স্বপ্নের মাখামাখি। অন্তর্মুখী আলফ্রেড ভালোবেসে ফেলেছেন একজন ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রাশিয়ান তরুণীকে। কিন্তু ভালোবাসার কথা কবিতায় প্রকাশ পেলেও মুখ ফুটে বলতে পারে না ভালোবাসার মানুষকে। দুর্বল স্বাস্থ্য, মাঝারি উচ্চতার আলফ্রেডের দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে ভালোবাসা বোঝা সহজ নয়। আলফ্রেডের ভালোবাসা ঠিকমত গতি পাবার আগেই এক দুঃখজনক পরিণতিতে পৌঁছে যায়। যক্ষারোগে ভুগে মেয়েটি মারা যায়। গভীর অবসাদে ডুবে যান তেইশ বছর বয়সী আলফ্রেড নোবেল। 
প্রথম প্রেমের মৃত্যুর পর বিষন্ন আলফ্রেড বেপরোয়ার মত নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। এ যেন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া। কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্য পাওয়া গেল। ১৮৬০  সালে ২৭ বছর বয়সে নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হলেন। 
এদিকে রাশিয়ায় বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ইমানুয়েল নোবেল তাঁর পরিবারসহ রাশিয়া ছেড়ে ফিরে এলেন সুইডেনের হেলেনেবর্গে ১৮৬৩ সালে। আলফ্রেড ও তার ছোটভাই এমিল মা-বাবার সাথে সুইডেনে ফিরে এলেন। বড় দুইভাই রবার্ট ও লুডভিগ তাঁদের নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রয়ে গেলেন রাশিয়ায়। পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে তাঁরা রাশিয়ায় বিপুল তেলসম্পদের মালিক হন। লুডভিগ নোবেলকে রাশিয়ার তৈলসাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট বলা হতো।
সুইডেনে ফিরে এসে স্টকহোমে ল্যাবোরেটরি স্থাপন করলেন ইমানুয়েল ও আলফ্রেড নোবেল। নাইট্রোগ্লিসারিনের পরীক্ষা চলছিলই। ১৮৬৩ সালের অক্টোবরের ১৪ তারিখে ৩০ বছর বয়সী নোবেল প্রথম প্যাটেন্ট পেলেন “মেথড অব প্রিপেয়ারিং গানপাউডার ফর বোথ ব্লাস্টিং এন্ড শুটিং”। ব্যাপক গবেষণায় মেতে উঠলেন আলফ্রেড। 
ল্যাবোরেটরিতে তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে ছোটভাই এমিল নোবেল। কিন্তু নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তেই বিপদের সম্ভাবনা। ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ বিরাট বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় আলফ্রেডের ল্যাবোরেটরি। আলফ্রেডের ছোটভাই এমিল সহ পাঁচজন মারা যান এই দুর্ঘটনায়। ভীষণভাবে আহত হবার পরেও অল্পের জন্য বেঁচে যান আলফ্রেড নোবেল। 
একটু সুস্থ হবার পর আবার কাজে লেগে গেলেন আলফ্রেড। কিন্তু ছেলে এমিলের মৃত্যুশোক সামলাতে পারলেন না বাবা ইমানুয়েল। স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি। পারিবারিক ব্যবসার পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল আলফ্রেড নোবেলের হাতে। 
দুর্ঘটনার পর স্টকহোমের কোথাও ল্যাবোরেটরি স্থাপন করার অনুমতি পাচ্ছেন না আলফ্রেড। কিন্তু তাঁর ব্লাস্টিং অয়েলের ব্যাপক চাহিদা। হ্রদের ওপর ভাসমান বার্জে অস্থায়ী ল্যাবোরেটরি স্থাপন করে ব্লাস্টিং অয়েল তৈরি চলছে। অবশেষে ১৮৬৫’র নভেম্বরে জার্মানির হামবুর্গের কাছে নাইট্রোগ্লিসারিন ফ্যাক্টরি তৈরির অনুমতি লাভ করে। সেখানেও অনেক সাবধানে কাজ করা হচ্ছিলো। দুর্ঘটনা ঘটলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে এক একটা শেডে দু’জনের বেশি কাজ করতেন না কখনোই। ১৮৬৬ সালে আবার দুর্ঘটনা ঘটলো। 
ল্যাবোরেটরির ধ্বংসস্তূপ সরাবার সময় আলফ্রেড আবিষ্কার করলেন তরল নাইট্রোগ্লিসারিন মিহি বালি ও মাটির সাথে মিশে এক ধরনের পেস্টের মত তৈরি হয়েছে। ওই পেস্টগুলো জোরে নিক্ষেপ করলে বিস্ফোরিত হয়, আগুনে পোড়ালেও বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু স্বাভাবিক তাপে ও চাপে কোন ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে না। আলফ্রেড পেয়ে গেলেন তাঁর স্বপ্নলোকের চাবি।

কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি উদ্ভাবন করলেন ডায়নামাইট। তারপর সাফল্যের ইতিহাস গড়লো ডায়নামাইট। ডায়নামাইট আবিষ্কারের ব্রিটিশ প্যাটেন্ট পেয়ে গেলেন মে মাসে। ছুটে গেলেন আমেরিকায় - ডায়নামাইটের আমেরিকান প্যাটেন্ট পাবার জন্য। দু’বছর পরে আমেরিকান প্যাটেন্ট পেলেন তিনি। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর ডায়নামাইট ও অন্যান্য বিস্ফোরকের ব্যবসা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর কারখানা তৈরি হলো ফ্রান্সে ও স্কটল্যান্ডে। পরে পৃথিবীর বিশটি দেশের নব্বইটি শহরে আলফ্রেড নোবেলের কারখানা স্থাপিত হয়। নোবেল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে। বাড়তে থাকে তাঁর নতুন নতুন আবিষ্কার। ৩৫৫টি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট পেয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল। 
সবচেয়ে বড় কারখানা ফ্রান্সে থাকায় ১৮৭৩ সাল থেকে প্যারিসের মালাকফ এভিনিউতে বসবাস করতে শুরু করেন আলফ্রেড নোবেল। বিরাট বাড়ি। থাকার লোক মাত্র তিন জন, তিনি এবং কাজের লোক আর ড্রাইভার। প্রচন্ড ব্যস্ত আলফ্রেড। ব্যবসার সমস্ত কাগজপত্র নিজেই দেখাশোনা করেন। নিজের হাতে সব ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক চিঠিপত্রের উত্তর দেন। আবার তাদের কপিও রাখেন। টাকা-পয়সার নিখুঁত হিসেব রাখেন নিজেই। এর মধ্যেও যখন সময় পান নিজের লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুষ্ঠান বলতে কিছুই নেই আলফ্রেডের। যা আছে সবই ব্যবসায়িক। এত কাজ করেন কাজের তাগিদেই। যেমন ব্যবসার কাজে উকিলের সাথে কথা বলতে হয়। কিন্তু উকিল সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা শূন্যের কোঠায়। তিনি মনে করেন উকিলরা তাঁদের পেশার খাতিরে পৃথিবীর সবাইকেই অসৎ ভাবেন। 
প্যারিসে বাস করলেও ফ্রান্সকে নিজের দেশ ভাবতে পারেন না আলফ্রেড। কোন নির্দিষ্ট দেশকেই তাঁর নিজের দেশ বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই তাঁর বাড়ি থাকলেও কোন বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করতে পারেন না। তিনি মনে করেন, “আমার বাড়ি হলো সেখানেই যেখানে বসে আমি কাজ করি। আর আমি সবখানেই কাজ করি।”
কাজের সাফল্যে আলফ্রেড নোবেলকে উচ্ছসিত হতে যেমন কেউ কখনো দেখেননি, ব্যর্থতায় ভেঙে পড়তেও কখনো দেখা যায়নি। এ যেন কাজের জন্যই কাজ করা। বন্ধুহীন সঙ্গীহীন একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত আলফ্রেড পুরো পৃথিবীর প্রতিই একধরনের বিতৃষ্ণভাব পোষণ করতেন। রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি সামান্য সমর্থন থাকলেও নিজের ধনবাদী অবস্থান থেকে নড়তে রাজি ছিলেন না কখনোই। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিও বিশ্বাস ছিল না আলফ্রেডের। জনগণ সমষ্টিগতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করতেন না আলফ্রেড। নিজের পড়াশোনা ও ভাবনা-চিন্তার গভীরতার ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল আলফ্রেডের। তিনি যে প্রচুর সম্পদের মালিক এবং এ সম্পদ যে তাঁকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান করে তুলেছে তা তিনি ভালো করেই জানতেন। জানতেন বলেই সাধারণ মানুষের সাথে একটা দূরত্ব তিনি বরাবরই রক্ষা করে চলতেন। 
শরীর তাঁর কোনদিনই খুব ভাল ছিল না। সারাক্ষণই কোন না কোন শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে। নিজের ভেতর একধরনের হীনমন্যতা বাসা বেঁধেছে। নিজেকে খুবই অনাকর্ষণীয় মনে করেন তিনি। ভালোবাসাহীন শারীরিক সম্পর্কের প্রতিও কোন আকর্ষণ নেই তাঁর। সেই প্রথম যৌবন থেকে অপেক্ষা করছেন কখন তাঁর ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা হবে। যে রাশিয়ান মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন সেই প্রেম বিকশিত হবার আগেই মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। তারপর কেটে গেছে তেইশ বছর। আলফ্রেড সেরকম আর কোন মেয়ের প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করেননি এতগুলো বছরে। অবশ্য ভালোবাসা পাবার জন্য যেটুকু সময় সামাজিক মেলামেশায় কাটানো দরকার তার কিছুই করেননি তিনি। মনের মধ্যে তিনি একটা ধারণা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন তা হলো তাঁকে কোন মেয়ে ভালবাসবে না, কারণ মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতো কোনকিছুই নেই তাঁর মধ্যে।  


Wednesday, 17 October 2018

আলফ্রেড নোবেলের উইল এবং নোবেল পুরষ্কার



পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক এবং শক্তিশালী পুরষ্কারের নাম জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগ মানুষ নোবেল পুরষ্কারের কথাই বলেন। ১৯০১ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে অবদানের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ও রসায়নের গবেষণায় সাফল্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার। সাহিত্যে যিনি নোবেল পুরষ্কার পান - তাঁর পাঠকপ্রিয়তা অনেক সময় হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান - নোবেল পুরষ্কার পাবার সাথে সাথে সেই ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়ে যায় অনেকগুণ; অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও বেড়ে যায়। অবশ্য সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার যাঁরা পান তাঁদের নিয়ে অনেক সময় নানারকম বিতর্কও তৈরি হয়। তবে সেই বিতর্কে নোবেল পুরষ্কারের মর্যাদা একটুও কমে না, বরং বেড়ে যায়। এমন মর্যাদাকর পুরষ্কার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ও সম্পদে - তিনি আলফ্রেড নোবেল। ১৯৬৮ সাল থেকে আলফ্রেড নোবেলের সম্মানে অর্থনীতিতেও পুরষ্কার দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির পুরষ্কার মূল নোবেল পুরষ্কার নয়। নোবেলের উইলে অর্থনীতিতে পুরষ্কার দেয়ার কোন কথা ছিল না এবং নোবেলের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদ থেকেও অর্থনীতির পুরষ্কারের অর্থ দেয়া হয় না। 

১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর তারিখে আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল তাঁর উইলে স্বাক্ষর করেছিলেন। সুইডিশ ভাষায় হাতে লেখা চার পৃষ্ঠার উইলে নোবেলের সারাজীবনের সঞ্চিত ধন-সম্পদের বিলিবন্টনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ আছে। দেখা যাক আলফ্রেড নোবেলের উইলে ঠিক কী কী লেখা আছে। মূল সুইডিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে নোবেল কমিটি। আমি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করলাম। 







উইলের পূর্ণ-বিবরণ:

আমি, নিম্নস্বাক্ষরকারী, আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল, এই মর্মে সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ঘোষণা করছি যে আমার মৃত্যুর পর আমার অর্জিত সম্পদের বিলি-বন্টন সম্পর্কে এখানে বর্ণিত বিবরণই হবে আমার অন্তিম ইচ্ছা।  আমার মৃত্যুর পর:

আমার ভাই রবার্ট নোবেলের দুই ছেলে হালমার নোবেল ও লুডভিগ নোবেল - তাদের প্রত্যেককে আমি দুই লক্ষ ক্রাউন করে দিয়ে যাচ্ছি। 

আমার ভাতিজা ইমানুয়েল নোবেলকে দেয়া হবে তিন লক্ষ ক্রাউন, এবং আমার ভাইঝি মিনা নোবেলকে দেয়া হবে এক লক্ষ ক্রাউন। 

আমার ভাই রবার্ট নোবেলের মেয়ে - ইনগিবোর্গ ও টায়রা - দুজনের প্রত্যেককে এক লক্ষ ক্রাউন করে দেয়া হবে। 

বর্তমানে প্যারিসের সেন্ট ফ্লোরেন্টিন রোডের ১০ নম্বর বাড়িতে মিসেস ব্র্যান্ডের সাথে অবস্থানরত মিসেস ওলগা বোয়েতগারকে দেয়া হবে এক লক্ষ ফ্রাংক। 

মিসেস সোফি ক্যাপি ভন ক্যাপিভার যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন তাঁকে বছরে ছয় হাজার হাঙ্গেরিয়ান ফ্লোরিন দেয়া হবে। তাঁর ঠিকানা ভিয়েনার অ্যাংলো-ওয়েস্টেরেইসিসে ব্যাংকে দেয়া আছে। ঐ ব্যাংকই তাঁর কাছে তাঁর বাৎসরিক বরাদ্দ পাঠিয়ে দেবেন। সেজন্য আমি হাঙ্গেরিয়ান স্টেট বন্ডের মাধ্যমে ঐ ব্যাংকে দেড় লক্ষ ফ্লোরিন জমা রেখেছি।

বর্তমান স্টকহোমের ২৬ নম্বর স্টুরগ্যাটেন নিবাসী মিস্টার আলারিক লিয়েদবেককে দেয়া হবে এক লক্ষ ক্রাউন। 

বর্তমানে প্যারিসের দ্য লুবেক রোডের ৩২ নম্বর বাড়িতে অবস্থানরত মিস এলিস অ্যান্টুন যতদিন বেঁচে থাকবেন বছরে আড়াই হাজার ফ্রাংক করে পাবেন। তাছাড়া তাঁর নিজের যে আটচল্লিশ হাজার ফ্রাংক বর্তমানে আমার কাছে জমা আছে তাও তাঁকে ফেরত দেয়া হবে। 

আমেরিকার টেক্সাসের ওয়াটারফোর্ড নিবাসী মিস্টার আলফ্রেড হ্যামন্ডকে দেয়া হবে দশ হাজার আমেরিকান ডলার। 

মিস এমি উইংকেলমান ও মিস মেরি উইংকেলমান, ঠিকানা: ৫১ পটসড্যামারেস্ট্রেসে, বার্লিন। এই দুজনকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাংক করে দেয়া হবে। 

মিসেস গাউসের, ঠিকানা: ২ বিস বুলেভার্ড দু ভিয়াদুক, নিমস, ফ্রান্স; পাবেন এক লক্ষ ফ্রাংক। 

আমার  স্যান রেমোর ল্যাবোরেটরিতে কর্মরত আমার কর্মচারী অগাস্তে অসওয়ার্ল্ড ও তার স্ত্রী আলফন্সে টুরন্যান্ড - দুজনের প্রত্যেকে আজীবন বছরে এক হাজার ফ্রাংক করে পাবেন। 

আমার প্রাক্তন কর্মচারী জোসেফ গিরারডট, ঠিকানা: ৫ প্লেস স্ট্রিট, লরেন্ট, সালোন্‌স স্যু সাওন যতদিন বেঁচে থাকবে বছরে পাঁচ শত ফ্রাংক করে পাবে। 

আমার প্রাক্তন মালী জাঁ লেকফ, বর্তমান ঠিকানা: মিসেস ডেসোট্টার, রিসেভ্যুর কুরালিস্তে, মেসনিল, অউব্রি পাওর ইকোওয়েন, এস এন্ড ও, ফ্রান্স; যতদিন বেঁচে থাকবে বছরে তিন শত ফ্রাংক করে পাবে। 

মিস্টার জর্জেস ফারেনবাখ, ঠিকানা: ২, রু কম্পিয়েঁজ, প্যারিস; ১লা জানুয়ারি ১৮৯৬ থেকে ১লা জানুয়ারি ১৮৯৯ পর্যন্ত বছরে পাঁচ হাজার ফ্রাঙ্ক করে অবসরভাতা পাবেন। 

আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়ে হালমার, লুডভিগ, ইনগিবার্গ ও টায়রা - তাদের প্রত্যেকের জন্য বিশ হাজার ক্রাউন করে আমার কাছে জমা আছে। তাদের প্রত্যেককে এই অর্থ ফেরত দেয়া হবে। 

আমার বাকি সব সম্পদের বিলিবন্টন করা হবে এভাবে:

আমার মূলধন যা আমার নির্বাহী কর্মকর্তারা নিরাপদে বিনিয়োগ করেছেন তা দিয়ে একটা তহবিল গঠন করা হবে। এই তহবিল থেকে বার্ষিক যে সুদ পাওয়া যাবে তা প্রতি বছর পুরষ্কার হিসেবে ভাগ করে দেয়া হবে তাদেরকে যাঁরা আগের বছর মানুষের কল্যাণে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। বার্ষিক অর্জিত মোট সুদকে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে: এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করবেন; এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক আবিষ্কার বা উন্নয়ন করবেন; এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি শরীরতত্ত্ব কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করবেন; এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি কোন আদর্শ স্থাপনের লক্ষ্যে সাহিত্যে সবচেয়ে ভালো কাজ করবেন; এবং এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে, সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি বা সৈন্যসংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে, শান্তি সম্মেলনের আয়োজন ও প্রচারের লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি কিংবা সবচেয়ে ভালো কাজ করবেন। 

পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের পুরষ্কার দেবে সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস; শরীরতত্ত্ব কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরষ্কার দেবে স্টকহোমের ক্যারোলিন ইন্সটিটিউট; সাহিত্যের পুরষ্কার দেবে অ্যাকাডেমি ইন স্টকহোম; এবং শান্তি পুরষ্কার দেবে নরওয়ের পার্লামেন্ট (স্টরটিং) কর্তৃক নিয়োজিত পাঁচ সদস্যের এক কমিটি। 

এই পুরষ্কার দেয়ার জন্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে কোন ধরনের জাতীয়তার প্রতিবন্ধকতা থাকবে না; স্ক্যানডিন্যাভিয়ান হোক বা না হোক, যোগ্যতম ব্যক্তিই এই পুরষ্কার পাবে এটাই আমার ইচ্ছা। 

আমার উইল কার্যকর করার জন্য আমি দু'জন নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করছি: মিস্টার র্যা গনার শোলম্যান, ঠিকানা: বফর্স, ভার্মল্যান্ড; এবং মিস্টার রুডল্‌ফ লিজেকুইস্ট, ঠিকানা: ৩১ মাল্মস্কিলন্যাডসগ্যাটান, স্টকহোম ও বেংগটস্ফোরে উড্ডেভেলার কাছে। এই কাজের জন্য তাঁরা যে কষ্ট করবেন তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে মিস্টার র্যাগগনার শোলম্যানকে এক লক্ষ ক্রাউন দিচ্ছি কারণ তাঁকেই এই কাজে বেশি সময় দিতে হবে; এবং মিস্টার রুডল্‌ফ লিজেকুইস্টকে পঞ্চাশ হাজার ক্রাউন দিচ্ছি। 

বর্তমানে আমার সম্পদের মধ্যে আছে কিছু অংশ আছে প্যারিস এবং সেন্ট রেমোতে রিয়েল এস্টেট হিসেবে; আর আমানত হিসেবে জমা আছে: ইউনিয়ন ব্যাংক অব স্টকল্যান্ডের গ্লাসগো এবং লন্ডন শাখায়; প্যারিসের কম্পটয়ের ন্যাশনাল ডি-স্কম্পটি, এবং আলফেন মেসিন অ্যান্ড কোম্পানিতে; প্যারিসের স্টকব্রোকার এম ভি পিটার অব ব্যাংক ট্রান্স-আটলান্টিকে; বার্লিনের ডিরেকশান ডার ডিসকনটো গেশেলস্ক্রাফ্‌ট  এবং জোসেফ গোল্ডস্মিডট অ্যান্ড কোম্পানিতে; রাশিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকে এবং পিটারসবুর্গে মিস্টার ইমানুয়েল নোবেলের কাছে; গুটেনবার্গ ও স্টকহোমে স্ক্যানডিনাভিস্কা ক্রেডিট আক্টিয়েবোলাগেটে; এবং প্যারিসের ৫৯ নম্বর মালাকফ অ্যাভিনিউতে রক্ষিত আমার স্ট্রং-বক্সে। এগুলো ছাড়াও আছে প্যাটেন্ট, প্যাটেন্ট ফি বা রয়্যালটি থেকে আয়। আমার নির্বাহীরা এই  হিসেবের পূর্ণ বিবরণ আমার দলিলপত্র থেকে খুঁজে বের করবেন। 

আমার এই উইলটিই হলো একমাত্র বৈধ উইল। আমার মৃত্যুর পর যদি এর আগে করা কোন উইল খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সেগুলো বৈধ বলে গণ্য হবে না। 

সবশেষে আমার বিশেষ ইচ্ছা এই যে আমার মৃত্যুর পর কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমার শিরা কেটে দেখবেন এবং আমার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। তারপর আমার দেহ কোন শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে। 

স্বাক্ষর
প্যারিস, ২৭ নভেম্বর, ১৮৯৫
আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল
_____________
আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ এই মর্মে ঘোষণা করছি যে মিস্টার আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল সুস্থ মস্তিষ্কে, স্বেচ্ছায় ঘোষণা করেছেন যে উপরে বর্ণিত উইলটি তাঁর শেষ উইল। তিনি আমাদের সবার সামনে উইলে স্বাক্ষর করেছেন, এবং আমরাও সবাই সবার সামনে উইলে স্বাক্ষর করলাম। 

সিগার্ড এরেনবোর্গ
অবসরপ্রাপ্ত ল্যাফটেন্যান্ট
প্যারিস: ৮৪ বুলেভার্ড হাউসম্যান

আর ডাব্লিউ স্ট্রেলেনার্ট
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার
৪, প্যাসেজ ক্যারোলিন

থস নরডেনফেল্ট
কনস্ট্রাক্টর
৮, রু অবার, প্যারিস

লিওনার্ড হাওয়াস
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার
৪, প্যাসেজ ক্যারোলিন

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts