Sunday, 17 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ২৪



রাষ্ট্রীয় সম্মান

রামনের দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ডিরেক্টর পদ থেকে তাঁকে যখন পদত্যাগ করতে হলো তখন অনেকেই মনে করেছিলেন রামন বিদেশে চলে যাবেন। ইওরোপ আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার ডাক পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি দেশের মাটি ছেড়ে অন্যদেশে গিয়ে কাজ করার কথা ভাবতেই পারেননি। তাঁর দেশপ্রেম প্রকাশ্যে গলা ফুলিয়ে দেশের জন্য ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করে কিংবা ভাষণে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর ভালোবাসা ছিল আরো গভীরে। তিনি দেশের উন্নতির জন্য চিন্তা করতেন তাঁর নিজের মতো করে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর তাঁর খুব একটা আস্থা ছিল না।
            মহাত্মা গান্ধীকে ব্যক্তিগতভাবে খুব শ্রদ্ধা করতেন রামন। মহাত্মা গান্ধীর সাধারণ জীবনযাপন এবং আত্মত্যাগকে তিনি খুবই বড় করে দেখতেন। সেই ছোট বেলায় গৌতম বুদ্ধের জীবনী তাঁকে যেভাবে প্রভাবিত করেছিল, মহাত্মা গান্ধীর আত্মত্যাগও রামনকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু গান্ধীর রাজনীতির পদ্ধতির অনেককিছুই খুব অপছন্দ করতেন রামন। যেমন চরকায় সুতা কাটার ব্যাপারটা। চরকার মতো একটা অনাধুনিক অবৈজ্ঞানিক যন্ত্র দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সুতা কাটা যে সময়ের কতটা অপব্যয় তা রামন প্রকাশ্যেই বলতেন। আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে গান্ধীর খুবই ধীরলয়ে ঢিমেতালে অহিংস আন্দোলনেরও কড়া সমালোচক ছিলেন রামন। মহাত্মা গান্ধীও জানতেন রামনের মনোভাব। কিন্তু তিনি রামনের বৈজ্ঞানিক দক্ষতার খুবই প্রশংসা করতেন।
            ১৯৩০ সালে রামন যখন নোবেল পুরষ্কার পান তখন মহাত্মা গান্ধী ছিলেন জেলখানায়। সেখান থেকে তিনি রামনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে গান্ধী যখন ব্যাঙ্গালোরে এসেছিলেন তখন রামন ও লোকম গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেছিলেন। লোকমকে খুব পছন্দ করতেন মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী কস্তুরভা গান্ধী। রামন মহাত্মা গান্ধীকে আমন্ত্রণ করেছিলেন ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সে। গান্ধী সেই সময় কোন আমন্ত্রণ গ্রহণ করছিলেন না সময়ের অভাবে। কিন্তু রামনের রিসার্চ ইন্সটিটিউট দেখার আমন্ত্রণ তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
            রামনের সাথে সেবার অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর। ঈশ্বর ও বিজ্ঞান প্রসঙ্গে রামন বলেছিলেন, "If there is a God we must look for him in the Universe. If he is not there, he is not worth looking for. I am being looked upon in various quarters as an atheist, but I am not. The growing discoveries in astronomy and physics seem to me further and further revelation of God. Mahatmaji, the religions cannot unite, Science offers the best opportunity for a complete fellowship. All men of science are brothers."[1]
            "যদি ঈশ্বর বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে মহাবিশ্বে আমরা খুঁজে দেখবো তাঁকে পাওয়া যায় কিনা। যদি তাঁকে মহাবিশ্বে পাওয়া না যায়, তাহলে তাঁকে সেখানে খুঁজে কোন লাভ নেই। অনেকেই আমাকে নাস্তিক বলে মনে করেন। কিন্তু আমি নাস্তিক নই। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান আবিষ্কারগুলো আমার কাছে ঈশ্বর খুঁজে পাওয়ার মতোই। মহাত্মাজি, ধর্ম মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারে না, বিজ্ঞানই পারে মানুষকে একতাবদ্ধ করতে। বিজ্ঞানের জগতে সকল মানুষ ভাই ভাই।"
            গান্ধীকে যখন হত্যা করা হলো ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন রামন। ধর্মীয় বিশ্বাস যে মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারে না সেটা তিনি আবারো দেখলেন। বিজ্ঞানে মতদ্বৈততার কারণে কেউ কাউকে খুন করে না। অথচ রাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে মানুষ মানুষকে খুন করে ফেলে। অনেক বছর পরে রামন তাঁর ইন্সটিটিউটে গান্ধীর জন্মদিনে প্রতিবছর ২রা অক্টোবর সাধারণের জন্য 'গান্ধী স্মারক বক্তৃতা' দিতেন। সেখানে বিজ্ঞানের অনেক বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলতেন। ১৯৭০ সালে মৃত্যুর এক মাস আগেও তিনি গান্ধী স্মারক বক্তৃতা দিয়েছেন।
            স্বাধীনতার আগে থেকেই ন্যাশনাল কংগ্রেসের অনেক নেতার সাথে রামনের পরিচয়। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির মেম্বার হবার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন রামন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথে রামনের সম্পর্ক ছিল বেশ নাটকীয়। রামন রাজনৈতিক নেতাদের মতো রেখেঢেকে কথা বলতে জানতেন না। যা বলার সরাসরি বলে দিতেন - সে প্রধানমন্ত্রী হোক কিংবা কোন ছাত্র হোক। জওহরলাল নেহেরুর বিজ্ঞান-নীতি পছন্দ করেননি রামন। দেশে অনেকগুলো সরকারি বিজ্ঞান-কেন্দ্র স্থাপনের বিপক্ষে ছিলেন রামন। তিনি বিজ্ঞান-কেন্দ্রের বিরোধী ছিলেন না, কেন্দ্রের পেছনে সরকারি খরচের বিরোধী ছিলেন। সরকারি টাকার নিশ্চয়তা থাকলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সংগ্রাম থাকবে না। ফলে ভালো কাজ তো দূরের কথা একটা পর্যায়ে কোন কাজই হবে না এসব প্রতিষ্ঠানে - এটাই ছিল রামনের শংকা। সরকারি অনেক উদ্যোগ সম্পর্কেই এই কথা সত্য। রামন ভারতের বৈজ্ঞানিক উন্নতির গতি কমে যাওয়ার জন্য নেহেরুর উদারনীতিকে দায়ী করেন। আর অন্যদিকে দেশের প্রায় সব বিজ্ঞানীই নেহেরুর উদারনীতির সুযোগ নিয়ে সব বড় বড় সরকারি পদে বসে গেছেন।
            স্বাধীনতার পরপর ১৯৪৮ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু রামনকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর রিসার্চ ইন্সটিটিউটের জন্য সরকারি সাহায্য গ্রহণ করতে। এজন্য রামনকে কোন দরখাস্তও করতে হবে না। রামন শুধু সরকারি নিয়ম অনুসারে অনুদানের টাকা কোথায় কীভাবে খরচ হলো ইত্যাদি অডিট অফিসকে জানাবেন আর বার্ষিক রিপোর্ট দেবেন। এগুলো সব প্রতিষ্ঠানেই করতে হয়। রামন সরকারি অর্থ অফিসের কর্মকর্তা ছিলেন, ভালো করেই জানেন কী কী করতে হয়। তিনি এটাও জানেন যে সরকার থেকে টাকা নিলে কাজের স্বাধীনতা অনেকটাই খর্ব হবে। জীবনের ষাট বছর পার করে দিয়েছেন স্বাধীনভাবে, এখন আর তা হারাতে চান না রামন। তিনি জওহরলাল নেহেরুকে বললেন, "দয়া করে আমার এই স্বাধীনতাটুকু কেড়ে নেবেন না মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার।"
জওহরলাল নেহেরু রামনের সরকারি সাহায্য না নেবার সিদ্ধান্তকে সম্মান করেছেন। রামনের আত্মমর্যাদা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, আবার রামনকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় সম্মানও জানানো হয় তার ব্যবস্থা করলেন নেহেরু। স্যার রামনকে ভারতের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হলো সারাজীবনের জন্য। জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মাসিক আড়াই হাজার রুপি সম্মানীর ব্যবস্থা করা হলো। রামন এই সম্মান প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না।
            স্যার রামনকে ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি হবার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। রামন সেই অনুরোধ প্রতাখ্যান করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, "সেটা নিয়ে আমি কী করবো?"
            রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হবার পর একবার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ব্যাঙ্গালোরে এসেছিলেন তাঁর মেয়ে ইন্দিরাকে নিয়ে। ইন্দিরা গান্ধী বিজ্ঞানী রামনকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। একবার জাহাজে করে ইংল্যান্ড যাবার পথে কিশোরী ইন্দিরার সাথে রামনের দেখা হয়েছিল। সেই সময়ই ইন্দিরা রামনকে ভারতের রত্ন বলে সম্বোধন করেছিলেন। ব্যাঙ্গালোরে এসে ইন্দিরা তাঁর কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে রামনের রিসার্চ ইন্সটিটিউটে এসেছিলেন। রামন ইন্দিরাকে তাঁর গবেষণাগার ঘুরিয়ে দেখালেন। তাঁর হীরার সংগ্রহ দেখালেন। যাবার সময় ইন্দিরাকে বললেন, "তোমার বাবাকে বলো সময় করে আমার ইন্সটিটিউট দেখে যেতে।"
সেদিন সন্ধ্যায় রামন ফোন পেলেন প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারির কাছ থেকে, "আগামীকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী আপনার ইন্সটিটিউটে আসবেন।"
            রামন কোন ধরনের আড়ম্বর পছন্দ করতেন না। প্রধানমন্ত্রী আসবেন বলেও তাঁর দৈনন্দিন কাজের কোন ব্যাঘাত ঘটলো না। পরদিন জওহরলাল নেহেরু অত্যন্ত সাধারণভাবে পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে সাথে নিয়ে রামনের সাথে দেখা করতে এলেন। প্রফেসর রামন নেহেরুকেও তাঁর গবেষণাগার ঘুরিয়ে দেখালেন। তাঁর হীরা-মণি-মুক্তার সংগ্রহ এবং জাদুঘর দেখালেন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে কিছু আলোর জাদুও দেখালেন।
 
রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু


জওহরলাল নেহেরুর হাতের তালুর উপর অতিবেগুনি আলো ফেলে সেখানে এক টুকরো সোনা এবং এক টুকরো তামা রেখে রামন জিজ্ঞেস করলেন, "বলুন দেখি এখানে কোন্‌টা সোনা আর কোন্‌টা তামা?"
            নেহেরু তাঁর হাতের দিকে তাকিয়ে যেটা বেশি উজ্জ্বল সেটাকেই সোনা বলে ধরে নিলেন। তখন রামন তাঁর ঘরফাটানো হাসি দিয়ে বললেন, "চকচক করলেই সোনা হয় না মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার।"
            জওহরলাল নেহেরু গুণের কদর এবং গুণীকে সম্মান করতে জানতেন। ১৯৫৪ সালে ভারতের সবচেয়ে সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় উপাধি 'ভারত-রত্ন' প্রবর্তন করে প্রথমেই সেই উপাধিতে সম্মানিত করলেন স্যার রামনকে। রামনের সাথে আরো দু'জন ভারতরত্ন পেয়েছিলেন। তারা হলেন ভারতের সর্বশেষ গভর্নর-জেনারেল  সি রাজাগোপালাচারি এবং ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের সাথে রামনের খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি রামনের ইন্সটিটিউটে এসেছিলেন কয়েকবার।


রামনের বামে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ও ডানে প্রত্ন-উদ্ভিদবিজ্ঞানী বীরবল সাহনি



 ১৯৫৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ রামনকে টেলিগ্রাম পাঠালেন ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে উপস্থিত থেকে ভারত-রত্ন পুরষ্কার গ্রহণ করার জন্য। সেই সময় রামনের একজন পিএইচডি ছাত্রের থিসিস জমা দেয়ার কাজ চলছে। জানুয়ারির মধ্যে থিসিস জমা দিতে হবে। রামন দেখলেন তিনি যদি দিল্লি চলে যান ছাত্রটির ক্ষতি হয়ে যাবে। তিনি প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিলেন যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারছেন না। রাষ্ট্রের এত বড় সম্মান দেয়া হয়েছিল যে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, রামন সেই অনুষ্ঠানে যাননি শুধুমাত্র তাঁর একজন পিএইচডি ছাত্রের থিসিস জমা দিতে দেরি হয়ে যাবে বলে।  



[1] Quoted in Collected works of Mahatma Gandhi, Vol LXVIII, Publications Division, Government of India.


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts