Sunday 17 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ২৬



ব্যক্তি রামন

কিছু কিছু প্রাকৃতিক ব্যাপার আছে যেগুলো শুধু বর্ণনা করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না। মানুষ হিসেবেও স্যার সি ভি রামনকে শুধু বর্ণনা করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না। খুব জটিল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন রামন। সারাজীবন তিনি বিজ্ঞানের গবেষণায় কাটিয়েছেন, তাই তাঁর দর্শনেরও সবকিছু বিজ্ঞানকে ঘিরে।
            তিনি সারাজীবন কাজ করেছেন কিছু মূল নীতির ভিত্তিতে। প্রকৃতি তাঁর কাছে অপরূপ সৌন্দর্যের মূল উৎস। এর সৌন্দর্যকে মূল্য দিতে হবে। এর সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে হলে তাকে জানতে হবে। পৃথিবীর কত অজানা সৌন্দর্যের রহস্য তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন। রঙ দেখলে তিনি শিশুদের মতো খুশি হয়ে যেতেন। ইউক্যালিপ্টাসের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় একটি বর্ণিল ফুল দেখলে তিনি আনন্দে বিহ্বল হয়ে যেতেন। তিনি যেখানেই থেকেছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন সবসময়।
            তার মূল চেতনা ছিল সোজা সাপ্টা। তাঁর কথা হলো যে যত বেশি গ্রহণ করছে তাকে তত বেশি দানও করতে হবে। যত নেবে তত দেবে। তিনি তাই গবেষণা, শিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রসারে কাজ করেছেন নিরলস। রামন বিশ্বাস করতেন যে কোন জাতি বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করতে পারবে তখনই, যখন সেই দেশের অনেক অনেক মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হবে। কেউ কেউ হয়তো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায় নিবেদিতপ্রাণ হবেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ অন্তত এটুকু বুঝবে যে কীভাবে প্রাকৃতিক নিয়মগুলো কাজ করে। দেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী বিজ্ঞানীর দল গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন রামন।
            বিজ্ঞানের ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল পরিষ্কার। বিজ্ঞানই মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারে। বিজ্ঞানের কোন ভৌগোলিক সীমানা নেই। যেমন গ্র্যাভিটি আবিষ্কার করেছিলেন নিউটন। এটাকে কি মেড ইন ইংল্যান্ড বলে আমরা বর্জন করতে পারবো? ভারতবর্ষে এই বিজ্ঞানসংস্কৃতির প্রচলন করার চেষ্টা করেছেন রামন সারাজীবন।
            কঠোর পরিশ্রম রামনের সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। গবেষণা কাজে ফাঁকি চলে না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমান নিষ্ঠা না থাকলে সাফল্য আসে না। রামনের জানতেন প্রতিভার যত্ন করতে হয়, বাড়ার সুযোগ দিতে হয়। সেজন্য ছাত্রদের প্রতি তাঁর উৎসাহের হাত সবসময়েই বাড়ানো থাকতো। একটা উদাহরণ দেয়া যায়: একদিন এক ছাত্র খুব মনমরা হয়ে রামনকে বললেন, "ব্রিটিশরা মনে হয় আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাবে। কারণ তারা পাঁচ কিলোওয়াট ক্ষমতার এক্স-রে ব্যবহার করছে, অথচ আমাদের আছে মাত্র এক কিলোওয়াট ক্ষমতার এক্স-রে।"
রামন সহাস্যে বললেন, "খুব সহজেই এই সমস্যার সমাধান করা যায়। তুমি দশ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মস্তিষ্ক ব্যবহার কর।"
            অনেকে বলেন বিজ্ঞানের গবেষণা ছেলে-খেলা নয়। রামনের কাছে সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য হলো স্পিরিট - উদ্যম। কে কী ভাবলো তাতে কিছু যায় আসে না। অন্যদেশে যে গবেষণা হয় বা নাসা যে গবেষণা করে সেটাই তো একমাত্র গবেষণা নয়। নিজেরা যতটুকু করতে পারি তার কতটুকু আমরা করি?
            তৃতীয় বিশ্বের প্রধান অভিযোগ এই যে আমাদের দামি যন্ত্রপাতি নেই, পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। অথচ রামন দেশে প্রস্তুত যন্ত্রপাতি দিয়ে মৌলিক গবেষণা করে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আসল কথা হলো আমাদের যতগুলো দামী যন্ত্রপাতি আমরা যে দামে কিনি উন্নত দেশেও অনেকসময় তত দামী যন্ত্রপাতি থাকে না। স্বাধীনতার পর পরমুখাপেক্ষিতার জন্য তিনি বিজ্ঞানীদের সমালোচনা করেছেন কড়া ভাষায়। যন্ত্রপাতি কেনার জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করার বিরোধী ছিলেন তিনি। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির জন্য বিদেশ-নির্ভরতা দেখে রামন বলতেন, "We are paying for our ignorance" - আমাদের অজ্ঞতার মূল্য দিচ্ছি আমরা। আমাদের দরকারি যন্ত্রপাতি যেটা আমরা দশ হাজার টাকায় বানাতে পারি সেটা আমরা দশ হাজার ডলারে কিনছি। তিনি বলেন, "The essence of science is independent thinking, hard work and not equipment. When I got my Nobel prize I had hardly spent Rs 200/ on equipment. "
            রামন বেহালার শব্দ থেকে শুরু করেছিলেন গবেষণা - সুরের বিজ্ঞান। এখন আমেরিকা ইওরোপ জাপানে ভায়োলিন ফিজিক্স নামে একটা বিশেষ শাখা আছে ফিজিক্সের।
            অভিযোগ করা হয় যে রামন ফলিত বিজ্ঞানের বিরোধী ছিলেন। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। তিনি বলতেন, অ্যাপ্লাইড রিসার্চ বা ফলিত গবেষণা দরকার আছে, বাণিজ্যিকীকরণও দরকার। কিন্তু মৌলিক গবেষণা বা অ্যাকাডেমিক সাফল্যকে বাদ দিয়ে নয়। তিনি সরকারি বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করেছেন। উপরের কর্মকর্তাদের সমালোচনা করেছেন। দেশীয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির পক্ষে ছিলেন তিনি। রামন জানতেন যে বিজ্ঞান যখন ফলিত বিজ্ঞানে যায় - কিছুদিন পরেই তা টেকনোলজিতে পরিণত হয়। এটাকে শর্ট-সার্কিটে দ্রুত করে ফেলার কোন উপায় নেই। কিন্তু আমলারা সেটাই করতে চাইছেন। তিনি রাজনীতির ভাষা ব্যবহার করতে জানতেন না। সরাসরি কথা বলা ছিল তাঁর অভ্যাস।
            রামনকে অনেকে কারখানা-বিরোধী মানুষ বলে মনে করতেন। কিন্তু তিনি নিজে অনেকগুলো কারখানার বৈজ্ঞানিক পরামর্শক ছিলেন। ইন্ডিয়ান রেলওয়েকে পরামর্শ দিতেন কীভাবে কাঠ সংরক্ষণ করা যায়। তাতে লক্ষ লক্ষ টাকা বেঁচে গেছে রেলওয়ের।
            বিজ্ঞানের গবেষণায় একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় - তা হলো কী কাজে লাগবে এই আবিষ্কার। রসায়নের প্রফেসররা যদি আবিষ্কার করতে থাকেন - বীজ থেকে তেল কীভাবে আরো ভালো করে তৈরি করা যায় - তাহলে ওটা হয়তো খুব কাজে লাগবে। কিন্তু তাতে বুদ্ধিবৃত্তির বৃদ্ধি হবে না। যেমন বলা হয়ে থাকে শুধু হারিকেন তৈরি করতে থাকলে, আরো ভালো মজবুত হারিকেন তৈরি করা হয়তো যাবে, কিন্তু বৈদ্যুতিক বাতি কিছুতেই তৈরি করা যাবে না। বুদ্ধির মুক্তি না ঘটলে কোন ধরনের আবিষ্কারই সম্ভব নয়।
            রামন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানীদের পূর্ণস্বাধীনতা থাকা দরকার। কিন্তু তাদের কোন ধরনের দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় থাকা উচিত নয়। রামনের চিন্তার সাথে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অনেকের চিন্তা মিলছিলো না। ব্যাঙ্গালোরে রামনের সমস্যা ছিল  ভালো আর মাঝারি মাপের বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিরোধ। মাঝারী মেধার লোকজনের সংখ্যাও বেশি এবং তারা বসে আছেন সব উপরের পদে। ফলে বেশি মেধার মানুষদের সাথে তারা তাল মেলাতে পারেন না। তাই নিজেরা যা করতে পারেন না, অন্যকেও তা করতে দিতে চান না। রামন এ ব্যাপারে বলেছিলেন, "Nothing is so detrimental to the growth of science in an institution than the existence of dead wood floating aimlessly which cannot participate in the scientific growth of an institute." বিজ্ঞানের অগ্রগতির স্রোতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইন্সটিটিউটের সেই সব পোড়া মরা কাঠগুলো যেগুলো কোন অবদান রাখতে না পেরে কেবল উদ্দেশ্যবিহীন ভেসে বেড়ায়।
            রামন ভুল থেকে শিক্ষা নিতে জানতেন। তিনি জানতেন যে কেউই অভ্রান্ত নয়। নতুন জ্ঞান পুরনো জ্ঞানকে একেবারে বাতিলও করে দিতে পারে। পুরনো জ্ঞান আঁকড়ে বসে থাকলে নতুন জ্ঞান চলার পথ পাবে না।
            রামন খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন। পোশাক, খাবার, দৈনন্দিন রুটিন সবকিছুই ছিল খুবই সাদামাটা। ছিলেন খুবই আত্মবিশ্বাসী। অনেক সময় তাঁর আত্মবিশ্বাসকে তাঁর অহংকার বলে মনে হতো। তিনি একাধারে সামাজিক প্রথা ভেঙেছেন, নিজে বিয়ে করেছেন ভিন্ন জাতিতে। আবার নিজের কিছুকিছু সংস্কার আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। সারাজীবন নিরামিষ খাবার খেয়েছেন। স্যুট-কোটের সাথে পাগড়ি পরেছেন। আর পাগড়ির নিচে লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর টিকি।
            নিজের মা-বাবা-ভাই-বোন অনেকের মৃত্যুশোক সহ্য করেছেন নিরবে। অথচ ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল আইনস্টাইনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রামন এমন শোকগ্রস্ত হয়েছিলেন যেন তাঁর দ্বিতীয়বার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। তিনি নিজের মাথা কামিয়ে ফেলে আক্ষরিক অর্থেই আইনস্টাইনের শ্রাদ্ধ করেছিলেন। অথচ আইনস্টাইন ছিলেন বয়সে রামনের চেয়ে মাত্র নয় বছর বড়।
            রামন রেখেঢেকে মনরাখা কথা বলতে জানতেন না। ফলে অনেকেই তাঁকে ভুল বুঝেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অদক্ষতার অভিযোগ তোলা হয়েছে কলকাতার অ্যাসোসিয়েশান এবং ব্যাঙ্গালোরের ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সে। তিনি কাউন্সিলের মতামতের অপেক্ষা না করে নিজের সিদ্ধান্তে কাজ করেছেন। অথচ এর চেয়েও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হোমি ভাবা তাঁর টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে। অথচ কেউ হোমি ভাবার বিরুদ্ধে রিভিউ কমিটি করার কথা চিন্তা করারও সাহস পাননি। রামন রাজনীতি জানতেন না বলে রাজনীতির শিকার হয়েছেন বার বার।
             শেষের দিকে রামন হতাশ হয়ে বলেছিলেন, "My life has been an utter failure. I hought I would try to build true science in this country. But all we have a legion of camp followers of the West."


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts