Wednesday 29 December 2021

মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ

 



বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের দিক বিবেচনা করলে মানুষ এখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে। মহাবিশ্বের কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোন গ্যালাক্সির নক্ষত্রের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে। পৃথিবীতে বসে মঙ্গলগ্রহে পাঠিয়ে দিয়েছে স্বয়ংক্রিয় রোবট – ভবিষ্যতের মানুষদের জন্য বাসযোগ্য নতুন পৃথিবী খুঁজতে। মহাবিশ্বের বিস্ময়কর রহস্যের আবরণ সরাতে শুরু করেছে মানুষ কয়েক শ’ বছর আগে থেকেই। অথচ মানুষ এখনো নিজের শরীরের সবগুলি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজকর্ম কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তার পূঙ্খানুপুঙ্খ হদিস পায়নি। যে মহাবিশ্বে আমাদের বাস, সেই জটিল মহাবিশ্বের মতো জটিলতা রয়েছে আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কে। সেই কারণেই আমাদের মস্তিষ্ককে বলা হয় থ্রি পাউন্ড ইউনিভার্স বা চৌদ্দ শ গ্রাম ভরের মহাবিশ্ব।

আমাদের শরীর ও মনের সমস্ত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্কের গড় ভর এক কেজি চার শ গ্রামের মতো। ছোট্ট একটা ফুলকপির সাইজের মস্তিষ্ক আমাদের। তবে ফুলকপির মতো অত শক্ত নয়। আমাদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত নরম। তার ভরের শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ হলো পানি, আর বাকিটা চর্বি ও প্রোটিন। কী আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের সমস্ত অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মস্তিষ্কের নিজের কোন অনুভূতি নেই। মাথাব্যথা বলতে আমরা যা বুঝি – তা মস্তিষ্কের ভেতরের ব্যথা নয়।

মস্তিষ্ক আমাদের শরীরের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অঙ্গ। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির মারাত্মক ক্ষতি হবার পরেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু মস্তিষ্কের কার্যাবলি যদি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় – তখন শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মস্তিষ্ক তাই প্রাকৃতিকভাবেই খুবই সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে। চুল আর ত্বকের পরেই আছে অত্যন্ত শক্ত মাথার খুলি। শরীরের সবচেয়ে শক্ত হাড়্গুলির একটি হলো মাথার খুলি। এটা আমাদের প্রাকৃতিক হেলমেট। মাথার খুলির নিচে আছে আরো তিনটি পাতলা অথচ অত্যন্ত শক্ত স্তরের সুরক্ষা ব্যবস্থা – মেনিঞ্জিস। মেনিঞ্জিসের নিচে আছে বিশেষ এক ধরনের তরল – সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড। এই তরল নরম মস্তিষ্ককে মাথার খুলির ভেতর নির্দিষ্ট জায়গায় ঠিকমতো বসিয়ে রাখে, শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাথে মস্তিষ্কের সংযোগ স্থাপন করে, রক্ত থেকে মস্তিষ্কের জন্য দরকারি পুষ্টি জোগায়, এবং মস্তিষ্কের ভেতর কোন বর্জ্য জমলে তা বের করে দেয়।

আমাদের মস্তিষ্কের কাজকর্ম যেভাবে চলে, তাকে মোটামুটিভাবে একটি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সুপার কম্পিউটারের সাথে তুলনা করা যায়। আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা কত বেশি তা একটি ছোট্ট উদাহরণ থেকেই আন্দাজ করা যায়। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ গত তিরিশ বছর ধরে যত উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে পেরেছে – আমাদের মস্তিষ্ক তিরিশ সেকেন্ড সময়ের ভেতর এর চেয়ে অনেক বেশি উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। আমাদের মস্তিষ্কের উপরিভাগের পাতলা কর্টেক্সের ছোট্ট একটা বালুকণার সমান আয়তনে প্রায় দুই হাজার টেরাবাইট তথ্য ধারণ করতে পারে। তার মানে এপর্যন্ত পৃথিবীতে যে পরিমাণ ডিজিটাল ডাটা তৈরি হয়েছে তার সবকিছুই আমাদের একটি মস্তিষ্কে ধরে যাবে।

আমাদের মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের সাথে তুলনা করা যায়। স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে যত তথ্য এবং উপাত্ত আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায় তার প্রসেসিং চলে মস্তিষ্কে। প্রায় দশ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) নিউরন আছে সেখানে। এই নিউরনগুলি একে অপরের সাথে এত বেশি জটিল সংযোগ তৈরি করে কাজ করে যে এই সংযোগের সংখ্যা প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন বা এক কোটি কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।

এই নিউরনের সংযোগগুলিতে অত্যন্ত কম মাত্রায় জৈববিদ্যুৎ-প্রবাহ চালিত হয়। শরীরের জৈব যৌগের ইলেকট্রন ও আয়ন পর্যায়ের জটিল বিক্রিয়ায় এই তড়িৎপ্রবাহ তৈরি হয়। এর পরিমাণ অত্যন্ত কম ( সর্বমোট মাত্র কয়েক মিলি-অ্যাম্পিয়ার)। আমাদের সারা শরীরের উৎপাদিত মোট  ক্ষমতা মাত্র ১০০ ওয়াটের মতো। কিন্তু এই এক শ ওয়াটের মধ্যে বিশ ওয়াটই খরচ হয় মস্তিষ্কের কাজে।

আমাদের মস্তিষ্কের ভর শরীরের মোট ভরের মাত্র দুই শতাংশ, অথচ শরীরের মোট শক্তির বিশ শতাংশই তা খরচ করে ফেলে। শিশুদের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি। সদ্যোজাত শিশুরা শরীরের মোট শক্তির শতকরা ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ খরচ করে মস্তিষ্কের কাজে। তাই তারা প্রায় সারাক্ষণই ঘুমাতে থাকে।

মস্তিষ্কের নিউরনের সংযোগগুলির প্রতিটি জৈব-বৈদ্যুতিক তরঙ্গপ্রবাহের স্পন্দনের স্থায়ীত্ব মাত্র এক থেকে দুই মিলিসেকেন্ড, কিন্তু এদের গতি অনেক বেশি – ঘন্টায় প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার।

বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের জৈব-বৈদ্যুতিক তরঙ্গের প্রবাহ মাপার চেষ্টা করছিলেন অনেক বছর আগে থেকে। ১৮৭৫ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী রিচার্ড ক্যাটন খরগোশ ও বানরের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ মাপার চেষ্টা করেছিলেন গ্যালভানোমিটারে সাহায্যে। মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গের রেখাচিত্র – ইলেকট্রোএনসিফ্যালোগ্রাফি বা ইইজি’র উৎপত্তি হয়েছে তখন থেকেই। এনসিফেলন শব্দের অর্থ ব্রেইন বা মস্তিষ্ক।

অত্যন্ত সংবেদী গ্যালভানোমিটার ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্কের প্রথম ইইজি করেন জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী হ্যান্স বার্গার ১৯২৪ সালে। তিনিই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন যে মানুষ যখন ঘুমায় তখন তাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক, জাগ্রত অবস্থার তরঙ্গের কম্পাঙ্কের চেয়ে ভিন্ন। এরপর মানুষের বিভিন্ন ধরনের কাজের সাথে মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্কের কী ধরনের পরিবর্তন হয় তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং পদার্থবিজ্ঞানীরা।

 

মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ

 

কম্পাঙ্ক অনুসারে মস্তিষ্কের তরঙ্গকে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। আমরা যখন গভীর মনযোগ দিয়ে কোন কাজ করতে থাকি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক অনেক বেড়ে যায়। কম্পাঙ্ক ৩৫ হার্টজের বেশি হলে তাদেরকে বলা হয় গামা তরঙ্গ। গামা তরঙ্গ হলো মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ক্ষমতার নির্দেশক। এই সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ থেকে অনেক ধরনের তরঙ্গের আদান-প্রদান ঘটে।

আমরা যখন স্বাভাবিক কাজে ব্যস্ত থাকি তখন আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক থাকে ১২ থেকে ৩৫ হার্টজের মধ্যে। এই কম্পাঙ্কের তরঙ্গকে বলা হয় বিটা তরঙ্গ। আমরা যখন কথাবার্তা বলি, কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিই, সমস্যার সমাধান করি, লেখাপড়া শিখি – তখন আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গ – বিটা তরঙ্গ।

বিশ্রামের সময় আমাদের মস্তিষ্কের কম্পাঙ্ক আরো কমে যায়। তখন কম্পাঙ্ক থাকে ৮ থেকে ১২ হার্টজের মধ্যে। এই তরঙ্গগুলিকে আলফা তরঙ্গ বলা হয়। মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক আরো কমে গেলে আমাদের তন্দ্রা আসে।

মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ৪ থেকে ৮ হার্টজের মধ্যে হলে তাদের থেটা তরঙ্গ বলা হয়। আমাদের দৈনন্দিন কাজ যেগুলি আমরা অভ্যাসবশত করি – যেমন দাঁত ব্রাশ করা, গোসল করা, নিজের ঘরের মধ্যে হাঁটা ইত্যাদির সময় আমাদের মস্তিষ্ক থেটা তরঙ্গে কাজ করে।

আর সবচেয়ে কম কম্পাঙ্কের তরঙ্গকে বলা হয় ডেল্টা তরঙ্গ। ডেল্টা তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ০.৫ থেকে ৪ হার্টজ। এই তরঙ্গে আমাদের মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য মস্তিষ্কের এই বিশ্রাম দরকার হয়। ডেল্টা তরঙ্গ হলো মস্তিষ্কের বিশ্রামের তরঙ্গ।

স্নায়ুর চিকিৎসায় ইইজি প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৩৭ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে। তারপর থেকে ইইজি সিস্টেমের অনেক উন্নতি হয়েছে। কম্পিউটার টেকনোলজি এবং ইলেকট্রনিক্সের উন্নতির সাথে সাথে ইইজি’র ব্যবহারিক ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। মস্তিষ্কের অনেক জটিল রোগ নির্ণয়ে এবং অন্যান্য চিকিৎসায় রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণে এই ইইজি’র সাহায্যে মস্তিষ্কের তরঙ্গের পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়। রোগী যদি কোমায় চলে যায়, তখন রোগীর মস্তিষ্কের কাজকর্মের কোন উন্নতি হচ্ছে কি না দেখা হয় মস্তিষ্কের তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে। মাথায় আঘাত পেলে, কিংবা স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কের তরঙ্গের পরিবর্তন হতে পারে। অনিদ্রা, মৃগীরোগসহ অন্যান্য স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় ভূমিকা রাখছে মস্তিষ্কের তরঙ্গের বিন্যাস।

মস্তিষ্কের তরঙ্গকে পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হলেও – প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ কিন্তু স্বতন্ত্র। এখানেই মানুষের সাথে রোবটের পার্থক্য। প্রত্যেক মানুষের মৌলিক শারীরিক গঠন একই রকম হলেও, প্রত্যেকটি মানুষ আলাদা। তাদের চিন্তার ধরন আলাদা, একই ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ব্যাপারটা মস্তিষ্কের তরঙ্গের মাধ্যমে আলাদা করা যায়, কিন্তু এর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। এখানেই মস্তিষ্কের বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।

_____________________

তথ্যসূত্র: বিল ব্রাইসনের ‘দি বডি এ গাইড ফর অকুপ্যান্টস’, ব্রায়ান ক্লেগের ‘দি ইউনিভার্স ইনসাইড ইউ’, অনিল শেঠ সম্পাদিত ‘থার্টি সেকেন্ড ব্রেইন’, ক্লিফোর্ড পিকোভারের ‘দি মেডিকেল বুক’।

______________

বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত



Tuesday 28 December 2021

Convocation Speech 2021 - Presidency International School

 



I was invited by the Presidency International School in the Graduation Ceremony of the Graduating Batch 2021. I delivered this convocation speech on 05/08/2021. 

Convocation Speech –  By Dr Pradip Deb
Presidency International School and College
5 August 2021


Thank you very much for your kind introduction.

Respected teachers, parents and my dear friends who are graduating today. It is my great pleasure and opportunity to be with you on your graduation day. This is one of the most important days in your academic journey. Let’s celebrate it. 

Dear graduates, I must congratulate you for your hard work and achievement. You know very well – that your journey was not always as smooth as it seems today. You tried your best to achieve the best possible outcome. And you did it right. My heartiest congratulations on your achievement. 

Dear Parents, I know you are proud of your children’s achievement. Without your constant supports, your children could not have been here today. You have given them unconditional love and support in all aspects – what they required, and sometimes more than they required. In many occasions you deprived yourself from many things to support your children. You did it selflessly. I believe your children will understand your sacrifice for them. The achievement of your children is not just theirs; it is your achievement too. So, I congratulate you. You deserve to be proud. 

My respected teachers, you are the nation builders. You are the real architects of all achievement that we are celebrating today. Your continuous guidance and encouragement not only illuminate the road to achievement – but also design, create and build the systematic steps of knowledge. You are the unsung heroes in the education sector. Each and every achievement of your students – reflects your contribution to it. I salute you for what you do to make our children educated. 

My friends who are graduating today, you are so happy today because – of course you are graduate, that is not the only reason you are happy, –you are also becoming independent! This is your Independence Day!! In the modern world – when you turn 18, you are independent. Now you are ready to enter the university – which is eventually the gateway to the universe. I know in many occasions you were impatient to be independent – specially when you wanted to do something but your parents or teachers did not allow you to do that. So, you must be very happy today. 

But my friends, independence not only bring joys, but also bring responsibilities. From now on, you are responsible for your own actions. In developed countries – when you turn 18, enter university, you are liable for your own economy as well. That means, you will be responsible to pay your educational cost, living cost and all other personal costs. But I think you are lucky in Bangladesh that your parents are taking that responsibility on their own shoulder without imposing any hard conditions on you. 

I know many of you are planning to study abroad. Since you have been following the international curricula, you are aware of many things that have been covered in your subject contents. But there are many things cannot be achieved by only reading the text books. The lessons of life can only be acquired by living the life. 

I have been teaching in an Australian university for more than a decade. Every year, I witness the journey of hundreds of students – both local and international in Australia.  The journey of the local and international students is not different in academic point of view, but very different in terms of lifestyle. Local students know the culture and whereabouts – so they are a bit ahead of your journey from where you are starting. But in terms of academic activities – there is no difference between national or international students. 

No matter which university you are going to get your studies, Australia, America, Canada, Europe, New Zealand – campus life is almost similar everywhere. Let me share my own experience with you. 

I started my postgraduate studies in Australia 23 years ago. Besides homesickness and many other problems, one of the major problems was my poor communication skills. My English vocabulary was limited. My thought process of communication was slow. When I would need to say anything to anyone, I would need to translate that from Bangla to English, then deliver it. As my pronunciation was not good, I had a very heavy accent. Very often, the person I would talk to, would not understand what I was saying. It was frustrating. It was even worst while someone would say anything to me. I would translate that into Bangla to understand what was said, then I prepare my answer in Bangla, then translate it into English, then deliver it – but by that time the person or the topic has already gone or changed. It was really frustrating. Sometimes, funny things happened too. In one occasion, there was a discussion about something. One of my fellow researchers said – “it’s a piece of cake.” I thought he was talking about a piece of cake somewhere. Perhaps I was hungry! I said – where is the cake? You know how stupid statement it was! 

None of you will have this type of problem ever, as you are almost native in English. With time, If I can become an academic in an Australian university, you can be anything you want - anywhere in this universe. 

The scenario at that time was much different to what you have today. Today the world is fully connected through your mobile and internet networks. So, missing your dear ones is not much as serious as then. Homesickness will still be there. But you can be with your family and friends virtually whenever you want. 

But there is something you must prepare yourself for. I don’t know how many of you capable of preparing your own food at home. If you can, congratulations. If you can’t – please learn. You must know how to do your personal work, such as washing your clothes, cleaning your dishes, cleaning and tidying up your room etc. If someone has to wake you up in the morning for school, please change that habit. Please stop asking other people to find your own belongings at home. These responsibilities are attached with your independence. 

Remember, when you are healthy, your own body is your best friend. But while you are sick, your own body can be your worst enemy. You need to bear the pain. In foreign land, you need to take care of your own health. So, while choosing your university overseas, please consider the weather there if it would suit you. 

No matter where you live in this planet or space, no matter how many passports from other countries you collect, you will represent Bangladesh. Your good work will make your country proud. 
Not everyone needs to go abroad for higher studies. There are plenty of opportunities in our own universities too. 

So far, in your studies – you have had only few options. But in your universities, here or overseas – you will have plenty of options to chose from. Choosing a pathway of career is not easy. Please try to find out what you like most. If you do something that you really love to do, it will never be a burden to you. There are career advisers in all universities. Before you choose a program of studies, please check the opportunities and graduate attributes of the program. 

And also, remember, don’t be pushed by peer pressure or any other external pressures. If you have done physics or other sciences, you know what pressure is – it is applied force per unit area. If your area is large enough, your effective pressure will be small. If you cannot avoid the applied force, try to increase your area of interest. 

In higher education, originality matters. You will be using lots of learning materials – but you will reflect your own original ideas and words. Please do not fool yourself. The easiest task is to fool oneself. If you do not understand something – please do not pretend to yourself that you understood it. 

No matter how the world changes itself every second, one thing never changes – that is honesty. Honesty is still the best policy. It is always rewarded in the end. Please never lose it. 

Another thing you need to remember – life is not all about success. There is failure too. Please do not afraid to be failed, do not be stopped if you are not successful in any particular attempt. Only one kind of people never fail in anything – those who never try anything. Only those people do not do any mistakes – who never do any work. Please learn to accept the failure, because every failure will make you more experienced. 

Before I finish, I wish you all the best for your future endeavour. You have world full of opportunities. World is yours, go and grab it, not by force, by your own merit, by your own credit.  Knowledge does not have any geographical boarder. Acquire and spread the knowledge. 

Cheers and thank you for listening. 


Saturday 25 December 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৫২

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫২

সত্যজিৎ রায় আর নেই! রাত সাড়ে আটটায় রেডিওতে খবরটি শোনার পর থেকে কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে সবকিছু। বেশ কিছুদিন থেকে তিনি অসুস্থ তা জানতাম। গতমাসের শেষে তাঁকে অস্কার পুরষ্কার দেয়া হয়েছে। অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে তিনি যেতে পারেননি। আশা করেছিলাম তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাঁর জীবনাবসান হবে চিন্তাও করিনি। ১৯২১ সালের ২ মে থেকে ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল; একাত্তর পূর্ণ হবার আগেই! আমার ১৫ বছর বয়স থেকে এই পঁচিশ পর্যন্ত কতভাবে যে তিনি আমাকে প্রভাবিত করেছেন। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিতে মুগ্ধ হয়েছি। প্রফেসর শঙ্কু পড়েছি একটার পর একটা। ভারতীয় বই এখানে তিনগুণ দাম দিয়ে কিনতে হয়। তাই অমর বইঘর থেকে অনেক পুরনো বইও কিনে পড়েছি। দেশ পত্রিকার পূজাবার্ষিকী হাতে পেলেই পড়ে ফেলেছি ফেলুদার নতুন গল্প। তাঁর সিনেমাগুলি দেখার সুযোগ পেয়েছি মাত্র কয়েক বছর আগে – ভিডিও-ক্যাসেট সহজলভ্য হবার পর। মাত্র কিছুদিন আগে দেখেছি তাঁর সর্বশেষ সিনেমা – আগন্তুক। এই সিনেমা দেখার পর থেকে আমার কেবলই মনে হচ্ছে – ভবিষ্যতে আমার পেশা কী হবে আমি জানি না, কিন্তু আমি কেমন মানুষ হতে চাই তা আমি জেনে গেছি। আমি আগন্তুকের মনমোহন মিত্র হতে চাই – যে মনমোহন মিত্র মানুষকে বিশ্বাস করে, যার কাছে আনুষ্ঠানিক ধর্মের চেয়েও মনুষ্যত্বের মূল্য অনেক বেশি। 

দু’দিন পর সত্যজিৎ রায় স্মরণে টিভিতে ‘পথের পাঁচালী’ দেখালো। বাংলাদেশের টেলিভিশনে এই প্রথম সত্যজিৎ রায়ের কোন সিনেমা দেখানো হলো। এমনিতে আমাদের রেডিও-টেলিভিশনে ভারতীয় কোন গান, নাটক, কবিতা কিছুই প্রচারিত হয় না। সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে ভারতীয় সিনেমা প্রচারিত হয়েছিল কয়েকটা – সেখানেও সত্যজিৎ রায়ের কোন সিনেমা দেখানো হয়নি। এখন সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর ‘পথের পাঁচালী’ দেখানো হলো এটা নিশ্চয় বিটিভির অনেক উদারতা! 

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আমাদের মাস্টার্স পরীক্ষার একটা তারিখ দেয়া হয়েছে – যেই তারিখে পরীক্ষা হবার কোন সম্ভাবনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়মগুলি আমার মাথায় এখনো ঢোকে না। যে তারিখে পরীক্ষা নেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই – সেই তারিখ ঘোষণা করা হয় কেন? শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করবে তাই? কিন্তু এবার কোন আন্দোলন হলো না। তারপরও পরীক্ষার ডেট পিছিয়ে দেয়া হলো – কারণ অনেক ডিপার্টমেন্টেই আমাদের আগের ব্যাচের রেজাল্ট এখনো দেয়া হয়নি। 

দেশের রাজনৈতিক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের উপর হামলা হচ্ছে। বিশেষ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মীদের উপর। গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়েছে। শিবির আর ছাত্রদলের চোখ এড়িয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে এই অভিযান চালানো যাচ্ছে না। 

বলা হয়ে থাকে আইন নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু এই নিজস্ব গতিটা কী তা বোঝা কঠিন। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পেটোয়া বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল ডাক্তার মিলনকে। ১৩ মে ডাক্তার মিলন হত্যা মামলার রায় দেয়া হয়েছে। চৌদ্দজন আসামীর সবাইকে খালাস দেয়া হয়েছে। তার মানে কী দাঁড়ালো? ডাক্তার মিলনকে কেউ হত্যা করেনি? 

এদিকে গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় হয়রানি শুরু হয়ে গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবার পর থেকে তাঁদেরকে অনেকটা নিজের দেশেই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়ার অপরাধে। এসব হয়রানির বিরুদ্ধে ঢাকায় হরতাল পালন করা হয়েছে ১৮ মে। আর সেদিন রাতে আমরা শিক্ষাসফরে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। 

শিক্ষাসফরের প্রস্তুতি চলছিল মে মাসের শুরু থেকে। ১৫ জনের ছাত্র-প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। মাথাপিছু চাঁদা ধরা হলো ৩৫০ টাকা। ১৮ তারিখ রাত পৌনে দশটার দিকে যীশু আর প্রদীপ নাথের সাথে বটতলী রেলস্টেশনে পৌঁছে দেখি অনেকেই চলে এসেছে ইতোমধ্যে। মেইল ট্রেনের একটি বগি রিজার্ভ করা হয়েছিল। আরেকটি বগির পুরোটাই দখল করে ফেলা হলো। একটাতে ছাত্রী এবং শিক্ষকরা, অন্যটিতে ছাত্ররা। আমাদের সাথে শংকরস্যার আর রশীদুন্নবীস্যার যাচ্ছেন। হামিদাবানু ম্যাডাম আগেই ঢাকায় চলে গেছেন আমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে। 

রাত সাড়ে এগারোটার ট্রেন। ঢাকা মেইল, সবগুলি স্টেশনে থেমে থেমে ঢাকায় পৌঁছাতে সকাল আটটা বেজে যাবে। আমরা ছাড়া অন্যান্য যাত্রীদের ভীড় খুব একটা নেই। ইদানীং অনেকগুলি আন্তনগর ট্রেন চালু হওয়াতে এই মেইল ট্রেনে খুব একটা চড়তে চায় না কেউ। 

ক্লাসের বাইরে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে একসাথে হলে একটা অন্য ধরনের আনন্দ হয়। কোন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই সবাই এক সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। অন্য সময়ে যেসব ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলে না, এখন সবাই একসাথে মন্তব্য করতে থাকে। অতি তুচ্ছ কারণেও হো হো করে হেসে উঠে। আমাদের অঞ্জন খুব মিতভাষী এবং মৃদুভাষী মানুষ। দেখা গেলো সেও হঠাৎ হাহাহা করে হেসে উঠলো। কারণ কী? সে খোলা জানালা দিয়ে মাথা বাইরে দিয়েছিল। প্রচন্ড বাতাসে তার টুপি উড়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে সে এই ঘটনাকে কিছুতেই হাসির ঘটনা বলে বিবেচনা করতো না। সাদা রঙের এই টুপি আমাদের শিক্ষাসফর উপলক্ষে বানানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামের নিচে ছাপানো আছে ‘শিক্ষাসফর ১৯৯২ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ’। 

আশীষ দাশগুপ্ত কোন একসময় আমাদের সিনিয়র ছিলেন, এখন আমাদের ব্যাচে এসে স্থিত হয়েছেন। আমরা সবাই তাকে আশীষদা বলেই ডাকি। তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় আমরা আগে কোনদিন পাইনি। কিন্তু ট্রেনের গতি বাড়ার সাথে সাথে তার মুখ থেকে অবিরাম যেসব ছন্দোবদ্ধ শব্দ নির্গত হতে শুরু করলো তা লিপিবদ্ধহলে বড় বড় অক্ষরে লিখে দিতে হবে – অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। 

মানুষের স্মৃতি কতভাবেই না ফিরে আসে। এই মেইলট্রেনের সাথে আমার প্রথম স্মৃতি আজ থেকে বারো বছর আগের। বাবার সাথে প্রথমবার ঢাকা গিয়েছিলাম এই ট্রেনে চড়ে। অনেক যাত্রীর ভীড়ে গুটিশুটিমেরে বসেছিলাম ভীরু অনুসন্ধিৎসু চোখে। যেকোনো স্টেশনে থামলেই সেই স্টেশনের নাম পড়ে মনে রাখার চেষ্টা করতাম। সেইসব স্টেশন থেকে কত বিচিত্র রকমের মানুষ উঠতো। ট্রেনের হকারদের জিনিস বিক্রি করার নানারকম ডাক এখনো কানে ভাসে। কত স্টেশনে অ্যালুমিনিয়ামের জগভর্তি পানি আর গ্লাস নিয়ে পানি বিক্রি করতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। এই বারো বছরে বাইরের পৃথিবী হয়তো খুব বেশি বদলায়নি, কিন্তু আমরা বদলে গেছি। শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণের সেই অনুসন্ধিৎসা এখন আর সেভাবে নেই। এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। 

এতগুলি ছেলেমেয়ে একসাথে যাচ্ছে, সেখানে শুধু হাসি-ঠাট্টা গান-বাজনা হবে, ঝগড়া-ঝাটি হবে না তা তো হতে পারে না। ঝগড়া লেগে যেতে দেরি হলো না। একটু পরেই আমরা ঝগড়ার খবর পেয়ে গেলাম। অমল এসে জানালো হারুন তাকে ঘুষি মেরেছে। খটকা লাগলো। হারুন তো এই কম্পার্টমেন্টে নেই। ছেলেদের অনেকেই মেয়েদের কাছাকাছি বসার জন্য অন্য কম্পার্টমেন্টে গিয়ে উঠেছে। হাফিজ, হারুন, দুলাল, কবীর, আমান, প্রেমাঙ্করসহ অনেকেই সেখানে। অমলতো আমাদের কম্পার্টমেন্টে ছিল। হারুন তাকে ঘুষি মারার জন্য পেলো কোথায়? 

জানা গেলো অমল আমাদের কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠতে গিয়েছিল। এই কম্পার্টমেন্টগুলি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা, একটা থেকে না নেমে অন্যটাতে ওঠা সম্ভব নয়। আগের স্টেশনে অমল এখান থেকে নেমে ওখানে উঠতে গিয়েছিল। হারুন নাকি সেই কম্পার্টমেন্টের দরজায় দাঁড়িয়েছিল। অমলকে সে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না সেই কম্পার্টমেন্টে। এদিকে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। অমল পড়ে যাচ্ছিলো, কোনরকমে হারুনকে জড়িয়ে ধরে সে। হারুন আর অমলের মধ্যে অনেকদিন থেকেই গায়ে হাত দেয়া বন্ধুত্ব। সুতরাং জড়িয়ে ধরাটা তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক রইলো না, যখন হারুন অমলকে টেনে নিয়ে দুটো ঘুষি চালিয়ে দিলো। অমল হতভম্ব। কারণ ক্লাসের সব মেয়ে তার মার খাওয়া দেখেছে। 

ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেতে পারতো। কিন্তু মিটলো না। কারণ হারুন ঘুষি মারার পরে অমলকে মালাউন বলে গালি দিয়েছে। 

ক্লাসমেটদের মধ্যে এরকম সাম্প্রদায়িক শব্দবিনিময় অসহ্য দুঃখজনক। হারুন বিএনপি করে। অমল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মী। আদর্শগত বিভাজন যে বন্ধুত্বেও ফাটল ধরায় তা আবারো দেখতে হলো। 

জামাল নজরুল ইসলামের মহাবিশ্ব

 



২০১২ সালের জুন মাসে সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে হিগ্‌স বোসন আবিষ্কারের সময় সারা পৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রচন্ড উত্তেজনা চলছিল। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ১৯৬৪ সালে যে অনন্য বোসন কণার অস্তিত্বের কথা তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেছিলেন ব্রিটিশ  পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগ্‌স এবং আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী – যা পরবর্তীতে ‘হিগ্‌স বোসন’ নামে পরিচিতি পেয়েছে – তা বাস্তবে পাওয়া যাবে কি না দেখার জন্য। কিন্তু সেই সময় এই উত্তেজনার পাশাপাশি অপবিজ্ঞানীরা আরো একটি উত্তেজনা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য সব প্রচার মাধ্যমে – যা ছিল খুব মারাত্মক। প্রচার করা হচ্ছিল লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে কৃত্রিমভাবে বিগ-ব্যাং সংঘটনের কাজ চলছে, এবং তার ফলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এরকম পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার কাল্পনিক ঘটনাকে বিজ্ঞানের মোড়ক দিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে, সিনেমাও তৈরি হয়েছে অনেকগুলি। অনেক মানুষ বিজ্ঞান ও কল্পনার মাঝখানের সীমানা বুঝতে না পেরে এসব কাল্পনিক কাহিনি বিশ্বাস করে ফেলেন। ২০১২ সালে এরকম অনেকের ভেতর একটা ভয় ও উৎকন্ঠা তৈরি হয়ে গেল – পৃথিবী কি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও এই পৃথিবী-ধ্বংসের তত্ত্ব প্রচারিত হচ্ছিল। তখন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই এগিয়ে এলেন মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যাঁর কথায় সবচেয়ে বেশি আশ্বস্ত হলেন – তিনি ছিলেন প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। এর আগেও অনেকবার এরকম হয়েছে। ১৯৮৮ সালে হঠাৎ বাংলাদেশে গুজব ছড়িয়ে পড়লো ঢোল কলমি গাছের পাতা ছুঁলেই নাকি মানুষ মারা যাচ্ছে। গুজবের ডালপালা গজাতে শুরু করলো। অনেকে বলতে লাগলো পাতা নয়, পাতায় যেসব পোকা হয় সেসব পোকা মানুষের গায়ে বসলেই মানুষ মারা যাচ্ছে। তখনো বাংলাদেশে ডিজিটাল যুগ শুরু হয়নি। মানুষ খবরের কাগজ পড়ে এবং রেডিও-টেলিভিশন থেকে খবর সংগ্রহ করতো। অনেক সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হতে লাগলো দেশের কোথায় কতজন মারা গেছে ঢোলকলমীর সংক্রমণে। হুজুগে মানুষ এসব আরো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে। লোকে দূর থেকে কেরোসিন ছিটিয়ে, বাঁশের আগায় করে আগুন দিয়ে ঢোলকলমী গাছ পোড়াতে শুরু করলো। এর মধ্যেই একদিন টেলিভিশনে সরাসরি অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম নিজের হাতে ঢোলকলমী গাছের পাতা মেখে, পাতার পোকা নিজের হাতে ধরে দেখালেন এসবে মানুষের কোন ক্ষতি হয় না। গুজব থেমে গেলো। অপবিজ্ঞানের সামনে বিজ্ঞানের সরাসরি প্রয়োগ – সাধারণ মানুষের বোধগম্য আকারে প্রকাশ যে কত কার্যকরী তা প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম – আমাদের জামালস্যার অনেকবারই দেখিয়েছেন।

এব্যাপারে আরেকজন পৃথিবীবিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের খুব মিল আছে – তিনি ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। কাছাকাছি সময়েই রিচার্ড ফাইনম্যান আমেরিকান জনগণের সামনে উন্মোচন করেছিলেন ১৯৮৬ সালের নভোযান চ্যালেঞ্জার-এর বিস্ফোরণের প্রধান বৈজ্ঞানিক কারণ। ফাইনম্যান সরাসরি প্রচারিত টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এক গ্লাস বরফের ভেতর এক টুকরা রাবার রেখে দেখিয়েছিলেন প্রচন্ড ঠান্ডায় কীভাবে রাবারের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে যায় – এবং যার ফলে চ্যালেঞ্জারের ও-রিং এর রাবার ঠিকমতো কাজ করেনি। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে আমেরিকান প্রফেসর রিচার্ড ফাইনম্যান এবং বাংলাদেশের প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম পরস্পর সহকর্মী এবং বন্ধু ছিলেন। ক্যালটেকে তাঁরা একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন, থাকতেনও কাছাকাছি বাসায়। ফাইনম্যানের স্ত্রীর সাথে জামালস্যারের স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ফাইনম্যানের ছেলে কার্ল ও মেয়ে মিশেল ছোটবেলায় অনেকসময় জামালস্যারের বাসাতেই থাকতো। ফাইনম্যান জামালস্যারের বাসার বাঙালি রান্না খেয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন – বিশেষ করে বাঙালি পদ্ধতিতে রান্না করা মাছের তরকারি।

পৃথিবীর প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন আমাদের জামালস্যার। কেমব্রিজ, ক্যালট্যাকের মতো পৃথিবীবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পরেও যিনি বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন মাটির টানে, বাংলার সংস্কৃতির টানে। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের বিজ্ঞান, প্রকৌশল, অর্থনীতিসহ প্রায় সব বিষয়েই তাঁর গভীর বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রমাণ যেমন রেখেছেন, তেমনি সরাসরি জড়িয়ে ছিলেন সঙ্গীতসহ শিল্পকলার অন্যান্য অনেক শাখার সাথে। নিজে খুব ভালো পিয়ানো বাজাতেন, আইনস্টাইনের মতো বেহালা বাজাতেন, সত্যেন বসুর মতো এস্রাজ বাজাতেন। চমৎকার গান করতেন। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে জামালস্যারের সংগীতানুষ্ঠানও হয়েছে। আর বিজ্ঞান – জামাল স্যারের হাতে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট।

জামালস্যারের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ঝিনাইদহে। তাঁর বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন তখনকার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সাব-জজ। বাবার কর্মসূত্রে তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা হয়েছে কলকাতায়। সেখান থেকে চট্টগ্রামে আসার পর কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেছেন ক্লাস নাইন পর্যন্ত। তারপর চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মারির লরেন্স কলেজে। সেখান থেকে পাস করলেন সিনিয়র কেম্ব্রিজ (যা এখন ও-লেভেল নামে পরিচিত) এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ (এ-লেভেল) পরীক্ষা। তারপর চলে গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিএসসি পাস করলেন। তারপর সোজা ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএসসি পাস করলেন, পরের বছর এমএসসি। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে তিনি যোগ দিলেন সেখানকার ইন্সটিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। এইসময় তাঁর গবেষণা-বন্ধু ছিলেন স্টিফেন হকিং। এরপর যোগ দিলেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি – ক্যালটেকে। রিচার্ড ফাইনম্যানের সাথে বন্ধুত্ব তখন সেখানেই। ক্যালটেকের পর তিনি কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে। ১৯৭৩ সালে ফিরে এলেন লন্ডনে। যোগ দিলেন কিংস কলেজে। নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম খুব ভালোবাসতেন জামালস্যারকে। আবদুল সালামের প্রতিষ্ঠিত ইতালির ইন্টারন্যাশনাল  থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স সেন্টারের ফেলো ছিলেন জামালস্যার। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত জামালস্যার ছিলেন লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে এলেন একেবারে। যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। ১৯৮৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুললেন আন্তর্জাতিক গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। প্রফেসর আবদুস সালাম এই গবেষণাকেন্দ্রের উদ্বোধনী সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। ২০০৪ পর্যন্ত এই গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন জামালস্যার। এরপর ২০০৬ পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পরেও তিনি ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে।

বাংলাদেশে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসা; পেয়েছেন বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের স্বর্ণপদক,  রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরষ্কার ইত্যাদি। কিন্তু এসব পুরষ্কারের চেয়েও সত্যিকারের বিজ্ঞানীদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরষ্কার হলো – তাঁদের আবিষ্কৃত জ্ঞানের প্রয়োগে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি। সে হিসেবে জামালস্যারের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তাঁর তিনটি মৌলিক বই –  ‘দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’, ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ এবং ‘এন ইন্ট্রোডাকশান টু ম্যাথম্যাটিক্যাল কসমোলজি’ - যেগুলি মহাবিশ্বের প্রতি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করেছে। সারাবিশ্বের কসমোলজির সিরিয়াস শিক্ষার্থীদের জন্য এই বইগুলি অবশ্যপাঠ্য।

১৯৭৭ সালে রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির কোয়ার্টারলি জার্নালে একটি ছোট্ট টেকনিক্যাল পেপার – ‘পসিবল আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’ প্রকাশ করেছিলেন জামালস্যার। এরপর নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ, ফ্রিম্যান ডাইসন, স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত নারলিকার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা জামালস্যারকে অনুরোধ করলেন এই টেকনিক্যাল পেপারের একটি জনপ্রিয় ভার্সান রচনা করতে – যা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হবে। এর আগে এরকম বিষয়ে হাতেগোণা কয়েকটি মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে। স্টিভেন ওয়েইবার্গের ‘ফার্স্ট থ্রি মিনিটস’ প্রকাশিত হয়েছে মাত্র এক বছর আগে। জামালস্যার সবার অনুরোধে রচনা করলেন ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে এই বই প্রকাশিত হবার পর মহাবিশ্বের ভবিষ্যত পরিণতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তো বটেই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। পরে জামালস্যারকে অনুসরণ করে এরকম বই আরো অনেকেই লিখেছেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্টিফেন হকিং-এর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’-এর আইডিয়া জামালস্যারের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’ থেকে উৎসৃত। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস ১৯৯৪ সালে প্রকাশ করলেন তাঁর জনপ্রিয় বই - ‘দি লাস্ট থ্রি মিনিটস’ – যা জামালস্যারের বইটির পরের অধ্যায় বলা চলে। পল ডেভিস তাঁর বইয়ের সাব-টাইটেলে উল্লেখ করেছেন ‘কনজেকসার্স অ্যাবাউট দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’।

আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে রোটেটিং ফিল্ড বা ঘূর্ণায়মান ক্ষেত্রের গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন জামালস্যার। তাঁর গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে তিনি রচনা করেছেন তাঁর আরেকটি মাইলফলক গবেষণা-বই ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’। ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বইটি মূলত গবেষক এবং শিক্ষার্থী-গবেষকদের জন্য লেখা। এই গাণিতিক ভিত্তি প্রয়োগ করেই পরবর্তীতে স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোলের ‘হকিং রেডিয়েশান’-এর আলো দেখতে পেয়েছেন।

জনপ্রিয় বিজ্ঞান মানুষের কৌতূহল মিটায়, হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহও কিছুটা তৈরি করে। কিন্তু সত্যিকারের বিজ্ঞান-শিক্ষার জন্য দরকার বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ। জামালস্যারের ‘আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’-এ মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে গণিত ব্যাবহার না করে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভাষা হলো গণিত। মহাবিশ্বের উৎস, গঠন, বিবর্তন এবং পরিণতির গণিত বুঝতে হলে একটা নির্ভরযোগ্য বইয়ের দরকার ছিল। সেই দরকার মিটিয়েছেন জামালস্যার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে তিনি রচনা করেছেন ‘এন ইন্ট্রোডাকশান টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’। ১৯৯২ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হবার পর থেকে পৃথিবীর সব সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজির শিক্ষার্থীদের জন্য এই বইটি প্রধান বইতে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে এর অনলাইন সংস্করণ।

জামালস্যার বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন ‘কৃষ্ণ বিবর’। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এই বই ব্ল্যাকহোলের উপর বাংলায় লেখা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি বই। সেই বইয়ের শুরুর দিকে জামালস্যার লিখেছেন – অনাগত ভবিষ্যতে বিশ্বের কী অবস্থা হবে এবং কী ঘটনা ঘটবে এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে কৃষ্ণ বিবরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এই ভূমিকার ব্যাপারটা তো আমরা সবাই দেখেছি। ব্ল্যাকহোল এখন আবিষ্কৃত হয়েছে, এর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদের পেছনে যে বিজ্ঞানীদের অবদান – তাঁদের কেউ কেউ নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। শুরুর দিকে এই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যাঁরা তৈরি করে দিয়েছেন – আমাদের জামালস্যার তাঁদেরই একজন।

আমাদের খুব কাছের – একেবারে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেই হয়তো – আমরা জামালস্যারের মেধাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারিনি। যে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকেন্দ্র তিনি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন – সেই গবেষণাকেন্দ্রে আমরা সেরকম আন্তর্জাতিক মানের ফসল ফলাতে পারিনি। অবসর গ্রহণের পরেও জামালস্যার আমাদের মাঝে ছিলেন। তিনি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে অনেক গবেষণা করেছেন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়েও। সম্ভবত জামালস্যারই বাংলাদেশের একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি সরাসরি দৃঢ়ভাবে বলেছেন – আমাদের দেশে বিদেশী সাহায্যের কোন দরকার নেই। বিদেশী সাহায্য বন্ধ হলেই আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে শিখবো, বাধ্য হয়েই শিখবো। জামালস্যারের এই কথায় নীতিনির্ধারকদের কেউই কোন গুরুত্ব দেননি সেই সময়।

২০১৩ সালের ১৬ মার্চ জামালস্যারের জীবনাবসান হয়। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তাঁর সৃষ্ট জ্ঞানের মধ্যে, তাঁর গবেষণা ও গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে। তাঁর স্মরণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গবেষণাকেন্দ্রের নাম দেয়া হয়েছে – ‘জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’। জামালস্যারের বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকার বহন করতে হলে যথাযথ যোগ্যতা অর্জন করতে হবে আমাদের।

সূত্র: কৃষ্ণবিবর, আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স, রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি, ম্যাথম্যাথিক্যাল কসমোলজি – জামাল নজরুল ইসলাম। দি লাস্ট থ্রি মিনিটস – পল ডেভিস।

______________

বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত





Friday 24 December 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৫১

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫১

প্রচন্ড গতিশীল এই মহাবিশ্বে স্থবিরতার কোন স্থান নেই। ক্ষুদ্র পরমাণু থেকে শুরু করে বিশাল গ্যালাক্সি – সবকিছু ছুটছে তো ছুটছেই। এই চিরকালীন প্রচন্ড গতির কিছুই টের পাই না। কেন পাই না তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বে আছে। থার্ড ইয়ারে সেই তত্ত্ব পড়েছিলাম, পড়ে পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। তারপর সব ভুলে গেছি। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে অনার্স পাস করে বসে আছি। ধরতে গেলে ১৯৯১ সালের পুরোটাই চলে গেছে স্থবিরতার মধ্য দিয়ে। 

প্রচন্ড ঝড়ের পরেও মানুষ নতুন করে বেঁচে ওঠার স্বপ্ন দেখে। বিএনপি সরকার জামায়াত শিবিরের মন রক্ষা করার জন্য তাদের পছন্দের ভিসি নিয়োগ দিয়েছে গত ডিসেম্বরে। ভেবেছিলাম নতুন ভিসি জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই সবকিছু ঠিক করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গতি ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু পুরো জানুয়ারি চলে গেল – নতুন স্থবিরতায়। এখন জামায়াত-শিবির চুপ। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো – সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যও চুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যকলাপে এখন অদ্ভুত স্থবিরতা। নিউটনের গতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী সেই স্থবিরতা ছড়িয়ে পড়েছে শরীরে, মনে, বোধে, এমনকি স্বপ্নেও। 
অতি সামান্য পরিমাণে হলেও মস্তিষ্কের কোষে কোষে স্বপ্ন জমতে শুরু করেছিল। মধ্যবিত্ত মানসিকতার মধ্যম-মানের স্বপ্ন - একটু ভালো রকমের পাস, একটু ভালো রকমের কর্মসংস্থান, একটুখানি স্বপ্নপূরণের স্বপ্ন। 

কিন্তু দিনের পর দিন বসে থাকতে থাকতে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো মনে হয় -  
“স্বপ্নের ধ্বনিরা এসে বলে যায় – স্থবিরতা সবচেয়ে ভালো;
নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে
অথবা নিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে
স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলো।“ 

মাঝে মাঝে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে গিয়ে ঘুরে আসি। কেমন যেন নিষ্প্রাণ সবই। কী হচ্ছে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। নতুন কোন ঝড়ের পূর্বাভাসও নেই। হলগুলির সবগুলি যারা দখল করে আছে – তাদের আমীর গোলাম আযম প্রকাশ্যে আসার পর থেকে তাদের উল্লাস এখন আকাশছোঁয়া। 

বাংলাদেশের রাজনীতি কোন্‌দিকে মোড় নিচ্ছে তা বোঝার জন্য খুব বেশি বিচক্ষণ না হলেও চলে। বর্তমান সরকারের প্রতি আমেরিকান সরকারের বিশেষ স্নেহ আছে। তাদের আর লাগে কী!

বিশ্বরাজনীতির দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে ঠান্ডাযুদ্ধ চলছিল – তা আর কিছু না হোক, এক ধরনের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রেখে আসছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। কিন্তু সেই ঠান্ডাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন হেরে গেছে আমেরিকার কাছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার বর্ষপূর্তিও হলো। এবছর ফেব্রুয়ারির এক তারিখ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন আমেরিকায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সাথে দেখা করে গদগদ হয়ে বলে এসেছেন – ঠান্ডাযুদ্ধ শেষ। তার মানে এখন আমেরিকাই পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি!

বিল্ডিং-এ আমি এখন অনেকটাই একা। অজিত চলে গেছে তার পরীক্ষার পর। কোরবানিগঞ্জের একটা মেসে গিয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে তার ওখানে ঘুরে আসি। কিন্তু তাকে রাত দশটার আগে খুব একটা পাওয়া যায় না। তার সারাদিন কাটে টিউশনি আর চাকরির সন্ধানে। 

মুকিতভাই সিলেট থেকে বছরখানেক পরে একবার এসে আবার চলে গেছেন। নতুন অনেকে এসেছে – তাদের সাথে খুব একটা ভাব হয়নি। পড়াশোনা একদম কিছুই হচ্ছে না তা বলবো না, তবে যে গতিতে হচ্ছে তা খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কেমন যেন লক্ষ্যহীন, স্বপ্নহীন স্থবির সময় যাচ্ছে। 

এর মধ্যেই কিছু আশা-জাগানিয়া ঘটনা ঘটে। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম ও তার সহযোগীদের বিচারের ডাক দিয়েছেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। তাঁর নেতৃত্বে.১৫ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আমাদের ক্যাম্পাস স্থবির হয়ে থাকলেও সারাদেশের জেলাশহরগুলিতে মানুষ জাগতে শুরু করেছে। স্থবিরতা কাটিয়ে পড়ার বই ঠেলে রেখে ছুটলাম এই জাগরণের অংশ হতে। 

মিউনিসিপ্যালটি স্কুলের সামনের রাস্তার ঐপাড়ে যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস, সেই বিল্ডিং-এই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম অফিস খোলা হয়েছে। একটা অন্যরকম উদ্দীপনায় কাজ শুরু হলো। সেখানে দেখা হয় সমমনা বন্ধুবান্ধবদের সাথে। বিশুর সাথে প্রায়ই দেখা হয়। মেশিনের মতো কাজ করতে পারে সে। ক’দিন আগে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেছে তার জীবনে। সে হাসতে হাসতে বলছিলো, “আমি এবার পরীক্ষা দেয়ার আগেই পাস করে ফেলেছি।“ 

গতবছর সে ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছে। পেপারে তার রোলনম্বর না দেখে শুরুতে প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়েছিল। তারপর প্রকৃত বিপ্লবীর মতো আবার নতুন করে প্রস্তুতি নিয়ে এবছর আবার পরীক্ষা দেয়ার জন্য ফরম ফিল আপ করেছে। পরীক্ষার আগে কলেজে গিয়ে প্রবেশপত্র নিয়েছে। তারপর কৌতূহল বশত গতবারের মার্কশিটটা তুলে দেখলো সে গতবারই পাস করেছে। পত্রিকাওয়ালারা ভুল করে তার রোলনম্বর ছাপায়নি। গত দেড় বছর ধরে সে জানতোই না যে সে বিএ পাস। 

জামায়াত-বিএনপি শুরুতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বকে মোটেও পাত্তা দেয়নি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছে ইচ্ছেমতো। কিন্তু যখন দেখলো অতিদ্রুত সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধা-পরিবার এবং প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলি একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে একতাবদ্ধ হচ্ছে – তারা নড়েচড়ে বসলো। 

মার্চের শুরু থেকেই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মসূচি শুরু হয়ে গেছে। মার্চের এক তারিখ ঢাকার সমাবেশে জাহানারা ইমাম বলেছেন, “গোলাম আযমের বিচার করা আমাদের জন্য ফরজ কাজ।“ মার্চের তিন তারিখ বায়তুল মোকাররমের সামনে বিশাল জনসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, “বাংলার মাটিতে গোলাম আযমসহ একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার হবেই।“ 
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে। সারাদেশে একটা অন্যধরনের উদ্দীপনা জেগে উঠেছে। যে রাজাকার-আলবদররা রাষ্ট্রীয় মদদে এতদিন বুক-ফুলিয়ে হাঁটছিলো – তাদের ফোলানো বুক যে চুপসে গেছে তা নয় – তবে মনে হচ্ছে তারা এবার কিছুটা হলেও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। 

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে শেখ হাসিনাসহ শতাধিক সংসদসদস্য গোলাম আযমের বিচারের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। 

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলিতে ছাত্রদল ছাত্রলীগের উপর চড়াও হতে শুরু করেছে। যদিও আমাদের ক্যাম্পাসে সেরকম কিছু হয়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল গুলি করে ছাত্রলীগের একজনকে মেরে ফেলেছে। ছাত্রশিবির এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তান্ডব চালাচ্ছে। সেখানে ছাত্রঐক্যের মিছিলে পুলিশ আর শিবির একজোট হয়ে হামলা করে একজন ছাত্রকে মেরে ফেলেছে। ছাত্রশিবির কমপক্ষে ১৫ জন ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। 

প্রায়ই শহরের মিছিল-সমাবেশে যাই। অনেক রাতে মেসে ফেরার সময় একটু ভয় ভয় করে, কিন্তু খুব একটা পাত্তা দিই না। মাঝে মাঝে অনেক বেশি রাত হয়ে গেলে অজিতের মেসে চলে যাই। 
মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে রমজান শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু রমজানের মধ্যেও গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে সমাবেশগুলিতে মানুষের স্বতস্ফূর্ত উপস্থিতি দেখলে মনে হয় – একাত্তরে এরকম মানুষগুলি জেগেছিল বলেই স্বাধীনতা এসেছে। আজ স্বাধীনতার একুশ বছর পর আবার জেগেছে মানুষ। এবার কিছু একটা হবেই। 

কিন্তু বিএনপি সরকার এবং জামায়াতে ইসলামীর সাঙ্গপাঙ্গরা অর্থাৎ একাত্তরের ঘাতক-দালালেরা বসে নেই। গণ-আদালত সফল করার জন্য প্রকাশ্যে কর্মসুচী চলছে, সমাবেশ চলছে। আর গণ-আদালত বাঞ্চাল করার জন্য গোপনে ষড়যন্ত্র করছে সরকার এবং জামায়াত-শিবির। 

সরকার এখানে রাজনৈতিক কূটনীতি শুরু করেছে। মন্ত্রীপরিষদের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে কারণ-দর্শাও নোটিশ জারি করেছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হবার এত বছর পরেও কেন তিনি তাঁর নিজের দেশ পাকিস্তানে ফিরে যাননি এবং পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও কীভাবে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর আমীর হলেন ইত্যাদি প্রশ্ন আছে নোটিশে। কিন্তু ওটা করার আসল উদ্দেশ্য হলো গণ-আদালত বাঞ্চাল করা। মন্ত্রীপরিষদ গণ-আদালতের উদ্যোক্তাদের প্রতিও শোকজ নোটিশ জারি করেছে। 

চব্বিশে মার্চ গোলাম আযমকে লোকদেখানো গ্রেফতার করে সরকারি নিরাপত্তায় নিয়ে যাওয়া হলো। সবাই বুঝে গেল সরকারের উদ্দেশ্য। পঁচিশে মার্চ রাতে আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ছিলাম। আমাদেরকে বলা হলো খুবই সাবধানে থাকতে। যে কোনো সময় পুলিশের ট্রাক এসে তুলে নিয়ে যেতে পারে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষদের উপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। বিরানব্বইর পঁচিশে মার্চে বাংলাদেশের পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হবে গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে যারা শহীদমিনারের সমাবেশে এসেছে তাদের! না, শেষপর্যন্ত পুলিশ কিছু করেনি। 

কিন্তু ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালতের জন্য কোন মঞ্চ তৈরি করতে দেয়নি। ২৬শে মার্চ সকাল থেকে সেখানে কী হচ্ছে জানার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে বসেছিলাম। টিভিতে সারাদিন স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান দেখিয়েছে। কিন্তু একবারও গণ-আদালতের কোন খবর বলেনি। অদ্ভুত যন্ত্র এই বাংলাদেশ টেলিভিশন – আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের মতো যখন যেই সরকার ক্ষমতায় থাকে – তারই আজ্ঞা বহন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় অথচ বঙ্গবন্ধুর নাম একবারও উচ্চারিত হয় না। টেলিভিশনে স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ নাটক প্রচারিত হয় – সেই নাটকের মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয় না। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নাম নেয়া হয় না। কী ভয়ানক জ্ঞানপাপীরা এসব অনুষ্ঠান বানান – হয়তো বানাতে বাধ্য হন। 

অবশ্য বাধ্য হয়েই করছে এটাও বা কীভাবে বলি? পাকিস্তানপ্রীতি এখনো বাংলাদেশের অনেকের ভেতর আছে। এই তো ২৫শে মার্চ তারিখেই বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে পাকিস্তান ইংল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এতে খুশি হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে আনন্দ মিছিল বের করেছে বাংলাদেশের অনেক জায়গায়। 

সরকারি প্রচারমাধ্যমের কোথাও গণ-আদালতের খবর প্রচার করা হয়নি। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ছুটি। তাই ২৭ মার্চ সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় না। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটলো। সংবাদপত্রের মালিক এবং সম্পাদকেরা চমৎকার একটি কাজ করলেন। সাতাশে মার্চ সংবাদপত্র প্রকাশ করলেন। 

২৭ মার্চ সকালেই পেপারের হেডলাইন – গণ-আদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির রায়। ২৬শে মার্চ সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ কোন মঞ্চ তৈরি করতে দেয়নি। তাদের উপর আদেশ ছিল যেকোনো ভাবে গণ-আদালত বাঞ্চাল করতে হবে। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। একাত্তরের সাতই মার্চের স্মৃতিস্তম্ভের পাশে চারটি ট্রাক পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তৈরি করা হয় এজলাস মঞ্চ। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশ গণ-আদালত-১ এর চেয়ারম্যান হিসেবে জাহানারা ইমাম একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় পড়ে শোনান। বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এই রায়কে জনতার বিজয় বলে অভিহিত করেন। 

প্রচন্ড উৎসাহ-উত্তেজনা নিয়ে গণ-আদালত সংক্রান্ত সব খবর পড়ে ফেললাম। গণ-আদালতের বিচার – প্রতীকী বিচার, রায় প্রতীকী রায়। এতে মনের জোর হয়তো বাড়ে, মানসিক সান্ত্বনা হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে কি গোলাম আযমের বিচার সম্ভব হবে কোনদিন? এই বাংলায় কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব? চারপাশে জামায়াত-শিবিররা যেভাবে আস্ফালন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে দেশের রেডিও-টেলিভিশনে এখনো বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয় না, যেখানে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা মন্ত্রী হয়, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে? আমাদের সম্ভবত এই গণ-আদালত করেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। 

কিন্তু বিএনপি সরকার সেটাও করতে দেবে না। দু’দিন পরেই জাহানারা ইমামসহ গণ-আদালতের উদ্যোক্তাদের প্রধান চব্বিশ জনের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলো। তাঁদের অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতা। 

হায় রে আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র – যারা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা চায়নি তারা আজ দেশপ্রেমিক, আর যাদের ত্যাগের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা এসেছে – তাদেরকে আজ বলা হচ্ছে দেশদ্রোহী!

Thursday 16 December 2021

বিস্ময়কর পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যান

 



পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান কাজ হলো প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি কীভাবে ঘটে তার সঠিক কারণ খুঁজে বের করা। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন বেড়েছে – এবং তার সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্ব। বিংশ শতাব্দীতে এসে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক পুরনো ধারণার যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। নিউটনের চিরায়ত গতিবিদ্যার একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করেছে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার নতুন জগত। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের অনেক সূক্ষ্ম পরিমাপ – কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে করলে দেখা যাচ্ছে অনেক অনিশ্চয়তা এসে ভর করছে সেসব পরিমাপে। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে আমরা বস্তুর ভরের যে হিসেব পাচ্ছি – সেই একই ভরের হিসেব আমরা পেতে পারছি আইনস্টাইনের ভর ও শক্তির সমীকরণ থেকে। এই দুই ভরের মধ্যে সূক্ষ্ম তারতম্য দেখা যাচ্ছে – যেটার ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে। কোন তত্ত্বের প্রয়োগ করে তত্ত্বীয়ভাবে যে ফলাফল পাওয়া যায় – তার অনিশ্চয়তা যত কম হয়,  অর্থাৎ পরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যায় তার সাথে তত্ত্বীয় ফলাফলের পার্থক্য যত কম হয়, সেই তত্ত্বটি ততই সঠিক বলে ধরে নেয়া হয়। পদার্থের সাথে পদার্থের মিথস্ক্রিয়া কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হবার পর পদার্থবিজ্ঞানী  পল ডিরাক, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং উলফ্‌গং পাউলি - তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের উপর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগ করার জন্য আবিষ্কার করলেন – কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স। এপর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের যত তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে কম অনিশ্চয়তাসম্পন্ন তত্ত্ব হলো কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স। আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়ান সুইংগার এবং জাপানি পদার্থবিজ্ঞানী শিনিতিরো তোমোনাগা আলাদা আলাদা ভাবে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সমস্যার সমাধানের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু সেই একই সময়ে  কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের জটিল সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যে বিজ্ঞানী তাঁর নাম রিচার্ড ফাইনম্যান। এই আবিষ্কারের জন্য ফাইনম্যান, সুইংগার এবং তোমোনাগা – তিনজনই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৬৫ সালে। 

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং ব্যতিক্রমী পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। আইনস্টাইন যতই বলুন তাঁর নিজের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে প্রতিভার অবদান মাত্র ১০%, বাকি ৯০%-ই তাঁর অধ্যবসায় এবং অনুশীলন, আমরা সবাই জানি যে  বিজ্ঞানীরা ভীষণ প্রতিভাবান। প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদেরকে দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় – এক শ্রেণি হলেন স্বাভাবিক প্রতিভাবান, অন্য শ্রেণির বিজ্ঞানীরা হলেন জাদুকরী প্রতিভাবান। ঠিকমতো চেষ্টা, উদ্যম, অধ্যবসায় এবং সুযোগ থাকলে অনেকেরই প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে পারে। তাঁরা কী করছেন, কীভাবে করছেন তা জানা খুব সহজ বলে তাঁদের চিন্তা ও কাজের মধ্যে তেমন কোন রহস্য থাকে না। তাঁদের কাজ দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে যে এই কাজ তাদের পক্ষেও করা সম্ভব। কিন্তু জাদুকরী প্রতিভাবানদের কাজের ধরন সম্পূর্ন আলাদা। তাঁদের কাজের ফলাফল দেখা যায়। কিন্তু কাজটা কীভাবে হলো তা দেখার পরেও, সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েও সাধারণের পক্ষে সম্ভব হয় না সেই কাজটা করা। রিচার্ড ফাইনম্যান ছিলেন বিজ্ঞানের উচ্চতম পর্যায়ের জাদুকরী প্রতিভাবান – বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর পদার্থবিজ্ঞানী।  

১৯১৮ সালের ১১ মে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের ফার রকএওয়ে সাবার্বে জন্ম রিচার্ড ফাইনম্যানের। তাঁর বাবা মেলভিল ফাইনম্যান ও মা লুসিল ফিলিপ্‌স ইওরোপ থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। তিনি কাজ করতেন একটি পোশাক তৈরির কারখানায় সেল্‌স ম্যানেজার হিসেবে। তাঁদের প্রথম সন্তান রিচার্ডের জন্মের পাঁচ বছর পর দ্বিতীয় সন্তান হেনরির জন্ম হয়। কিন্তু বেশিদিন বাঁচেনি হেনরি। রিচার্ডের যখন নয় বছর বয়স, তখন তাঁদের কন্যা জোয়ানের জন্ম হয়। সীমিত আয়ের সংসার হলেও মেলভিল ছিলেন জ্ঞানপিপাসী মানুষ। তিনি তাঁর ছেলে-মেয়ে রিচার্ড ও জোয়ানের ভেতর বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার বীজ রোপন করে দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বড় হয়েছেন রিচার্ড। তাঁর স্কুল, বাড়ি সবখানেই নানারকম পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে শিখতে শিখতে মুক্ত চিন্তার স্বাধীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন রিচার্ড ফাইনম্যান। স্কুলের নিচের ক্লাসে থাকতেই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসে নিজে নিজে শিখে ফেলেছেন বীজগণিত, ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি। ফার রকএওয়ে স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি বাড়িতে বসেই নানারকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। যে কোন বিষয়ই তিনি বুঝতে চেষ্টা করতেন প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে। ক্যালকুলাস, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতির একই সমস্যার সমাধান করতেন বিভিন্ন পদ্ধতিতে। যদি দেখতেন প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে তাঁর নিজের পদ্ধতি বেশি কার্যকর, তিনি সেটাই গ্রহণ করতেন। কিন্তু যদি দেখা যেতো তাঁর নিজের পদ্ধতির চেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি ভালো, তখন নির্দ্বিধায় নিজের পদ্ধতি বর্জন করতেন। বিজ্ঞান শিখতে হলে যে কোন ধরণের আত্ম-অহংকার থাকতে নেই – তা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন একেবারে ছোটবেলা থেকেই। 

একুশ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে ম্যাচাচুসেস্ট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এম-আই-টি) থেকে গণিতে বিএসসি পাস করার পর ফাইনম্যান প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে গেলেন পিএইচডি করার জন্য। সেখানে তরুণ প্রফেসর জন হুইলারের গবেষণা-সহকারী হিসেবে গবেষণা শুরু করলেন। পল ডিরাক ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়ায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রয়োগ করে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ফাইনম্যান এধরনের মিথস্ক্রিয়ায় নতুন কোন পদ্ধতিতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রয়োগ করা যায় কি না সে ব্যাপারে গবেষণা শুরু করলেন। অন্যান্য প্রচলিত জটিল দীর্ঘ গাণিতিক পদ্ধতির পরিবর্তে সহজে প্রয়োগযোগ্য কার্যকরী বিকল্প পদ্ধতির উদ্ভাবন করলেন ফাইনম্যান। তাঁর পিএইচডি থিসিস ‘দ্য প্রিন্সিপাল অব লিস্ট অ্যাকশান ইন কোয়ান্টাম মেকানিক্স’-এর মাধ্যমে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের এক নতুন মাইলফলক স্থাপিত হলো। ফাইনম্যানের বয়স তখন মাত্র ২৩ বছর।  প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন ১৯৪২ সালে। 

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমেরিকা পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। অত্যন্ত গোপনীয় মিশন – ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এর কাজ চলছে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের গোপন ল্যাবরেটরিতে। বোমা তৈরির মিশনের বৈজ্ঞানিক ইউনিটের প্রধান রবার্ট ওপেনহেইমার জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আমেরিকার সবচেয়ে মেধাবী বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করে টিম গঠন করছেন। তরুণ ফাইনম্যানের ডাক পড়লো সেখানে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ফাইনম্যান কাজ করেছেন পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক প্রকল্প ম্যানহাটান প্রজেক্টে হিউম্যান কম্পিউটার হিসেবে। সেই সময় তিনি কাজ করেছেন বিজ্ঞানী নিল্‌স বোর, এনরিকো ফার্মির সাথে। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই আমেরিকা আরিজোনার মরুভূমিতে পারমাণবিক বোমার প্রথম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা সেই বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করেন পুরু কালোচশমায় চোখ ঢেকে। ফাইনম্যান বসেছিলেন বিস্ফোরণস্থলের কাছেই একটি মিলিটারি ট্রাকে। তিনি হিসেব করে দেখেছিলেন ট্রাকের সামনের কাচের ভেতর দিয়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের যে আলো আসবে – তাতে তার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে না। তিনি তাই চোখের কালো চশমা খুলে সরাসরিই প্রত্যক্ষ করেছিলেন প্রথম পারমাণবিক বোমার প্রলয়ংকরী বিস্ফোরণ। তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি খালিচোখে সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ফাইনম্যান প্রথম কাজ নিলেন নিউইয়র্কের জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে। বেল ল্যাবোরেটরিতে কাজ করেছেন তিনি সেই সময়। এই বিখ্যাত বেল ল্যাবরেটরি থেকেই উদ্ভাবিত হয়েছে ট্রানজিস্টার – যা পরবর্তীতে সারা পৃথিবীকেই বদলে দিয়েছে ডিজিটাল পৃথিবীতে। এখানে কয়েক মাস কাজ করার পরেই তিনি কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে  ছিলেন ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত। এখানেই তিনি কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সমস্যার সমাধান করার জন্য উদ্ভাবন করলেন কিছু সহজ রেখাচিত্র – যা পরবর্তীতে ‘ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম’ নামে খ্যাতিলাভ করে। তিনি দেখিয়েছেন কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের যেকোনো মিথস্ক্রিয়ার প্রধান ক্রিয়া মাত্র তিন ধরনের – (১) একটি ইলেকট্রন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, (২) একটি ফোটন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, এবং (৩) একটি ইলেকট্রন একটি ফোটনকে হয় শোষণ করে কিংবা বর্জন করে। এই তিন ধরনের ঘটনার মাধ্যমে চার্জ ও তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সমস্ত রকমের ঘটনার নিখুঁত হিসেব করা যায়। ফাইনম্যান এই তিন ধরনের কাজের জন্য তিনটা সহজ চিত্র ব্যবহার করলেন। ইলেকট্রনের জন্য ব্যবহার করলেন সরলরেখা। সরলরেখার মধ্যে তীরচিহ্ন দিয়ে দেখানো হয় ইলেকট্রনের দিক। ফোটনের জন্য ব্যবহার করলেন তরঙ্গের মতো বক্ররেখা। সেই রেখায় তীরচিহ্নের দিক নির্দেশ করে ফোটন শোষিত হচ্ছে – কিংবা বর্জিত হচ্ছে। এভাবে মাত্র তিনটি চিহ্নের সমন্বয়ে পুরো ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সঠিক ব্যাখ্যা দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেললেন ফাইনম্যান। 


 

ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের প্রধান চিহ্ন


১৯৪৯ সালে ফাইনম্যান তাঁর ডায়াগ্রাম প্রকাশ করেন ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে। ১৯৬৫ সালে এই কাজের জন্যই তিনি বিজ্ঞানী সুইঙ্গার ও তোমোনাগার সাথে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান। 

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময়েই তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) থেকে অফার পান সেখানে যোগ দেয়ার জন্য। ক্যালটেকে যোগ দেয়ার আগে ফাইনম্যান প্রায় এক বছর ব্রাজিলে কাটান। সেখানে গিয়ে তিনি নিজের চোখে দেখেন তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানচর্চার স্বরূপ। তিনি দেখেছেন তৃতীয় বিশ্বের লক্ষ-লক্ষ ছেলেমেয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ছে। কিন্তু তেমন কিছু না বুঝেই শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাস করার জন্য পদার্থবিজ্ঞান মুখস্থ করছে। তাই তৃতীয় বিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী এত ছাত্র এবং শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে ধরতে গেলে কোনো পদার্থবিজ্ঞানীই তৈরি হচ্ছে না।

ব্রাজিল থেকে ফিরে এসে তিনি ক্যালটেকে যোগ দেন।  ১৯৫১  থেকে জীবনের শেষ দিন  (১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত তিনি অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন ক্যালটেক-এ। যে ন্যানো-টেকনোলজির প্রয়োগ এখন ওষুধ থেকে শুরু করে জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে সেই ন্যানো-টেকনোলজির প্রাথমিক ধারণার উৎপত্তি ফাইনম্যানের হাতে। তরল হিলিয়ামের ক্ল্যাসিক্যাল থিওরি দিয়েছিলেন রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী লেভ ল্যানডাউ। ফাইনম্যান তার কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে ফাইনম্যান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেননি। কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক যে ফাইনম্যান জ্যোতির্বিজ্ঞানে কোন গবেষণা করেননি কেন? নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর ফাইনম্যান যখন বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে গেছেন তখন একবার আলাস্কায় গিয়েছিলেন একটা কনফারেন্সে অতিথি হয়ে। আলাস্কা থেকে সূর্যের অরোরা খুব ভালো দেখা যায়। সেখানে একটা অরোরা অবজারভেটরি আছে। অবজারভেটরির পরিচালক ফাইনম্যানকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখানোর সময় ফাইনম্যান স্বাভাবিকভাবেই খুব আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন অরোরার বৈজ্ঞানিক উপাত্তের ব্যাপারে। পরিচালক তখন ফাইনম্যানকে অনুরোধ করলেন, “আপনি অরোরা নিয়ে কিছু গবেষণা করুন।“ 

ফাইনম্যান উত্তর দিলেন, “আমি তো করতে চাই, কিন্তু করতে পারবো না। কারণ অরোরা নিয়ে গবেষণা করতে হলে আমাকে আমার ছোটবোনের অনুমতি নিতে হবে।“ 

পরিচালক ভাবলেন ফাইনম্যান মজা করছেন। কিন্তু ফাইনম্যান মজা করেননি। ফাইনম্যান তাঁর নয় বছরের ছোট বোন জোয়ানাকে পদার্থবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই ছোটবেলা থেকে। ছোটবেলায় এক গভীর রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে জোয়ানাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন খোলা মাঠে অরোরা দেখাতে। জোয়ানার বয়স তখন মাত্র চার, আর ফাইনম্যান তেরো। ক্রমাগত ভাইয়ের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের খেলা খেলতে খেলতে পদার্থবিজ্ঞানকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন জোয়ানাও। সলিড স্টেট ফিজিক্সে পিএইচডি শেষ করার পর জোয়ানা অরোরা সংক্রান্ত গবেষণায় উৎসাহী হয়েছেন। তিনি জানেন তার ভাই যেখানেই হাত দেবে সেখানেই সোনা ফলবে। কিন্তু তিনি নিজে এমন একটা ক্ষেত্রে কাজ করতে চান – যেখানে তার ভাই হাত দেবেন না। একদিন তিনি ফাইনম্যানকে বললেন, “তুমি পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছু নিয়ে নাও, কেবল মহাকাশটা আমার জন্য ছেড়ে দাও।“ ফাইনম্যান রাজি হয়ে গেলেন। 

ফাইনম্যান মহাকাশ গবেষণা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও মৃত্যুর দু’বছর আগে তাঁকে আমেরিকার মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে স্মার্ট বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় মহাকাশ সংক্রান্ত একটি ঘটনা। ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি  আমেরিকান মহাকাশযান চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিস্ফোরিত হয়ে সাতজন মহাকাশচারীর সবাই মারা যান। প্রেসিডেন্ট রিগান তেরো সদস্যের এক বৈজ্ঞানিক কমিশন গঠন করেন এই ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য। ফাইনম্যান সেই কমিটির মেম্বার ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থল, গবেষণাগার সবকিছু খুঁটিনাটি নিজের চোখে দেখে, সেখানকার সংশ্লিষ্ট সবার সাথে নিজে কথা বলে ঘটনার মূল কারণ শনাক্ত করেন। চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের আগের রাতে প্রচন্ড তুষারপাত হয়েছিল। রকেটের ও-রিং-এর রাবার প্রচন্ড ঠান্ডায় কার্যকারিতা হারিয়েছিল। উৎক্ষেপণের আগে সবকিছু পরীক্ষা করা হলেও বিজ্ঞানীরা এই আপাত ছোট্ট ব্যাপারটার দিকে নজর দেননি। ফাইনম্যান টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে ছোট্ট একটা পরীক্ষার সাহায্যে দেখালেন কী সমস্যা হয়েছিল চ্যালেঞ্জারের রকেটে। তিনি বরফভর্তি কাচের গ্লাসে এক টুকরা রাবার রেখে দেখালেন কীভাবে রাবারের ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে যায়। বিজ্ঞানের জগতে আগে থেকেই বিখ্যাত ছিলেন ফাইনম্যান। কিন্তু  এই ঘটনার পর রাতারাতি সবার চোখে বিখ্যাত হয়ে যান ফাইনম্যান। 

পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ফাইনম্যানের মত এমন ভালো শিক্ষক আর কখনো পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ক্লাসিক টেক্সট বইয়ের নাম ‘ফাইনম্যান লেকচার অন ফিজিক্স’ যা রচিত হয়েছে তাঁর ক্যালটেকের ক্লাসরুমে দেয়া লেকচারগুলো থেকে। আইনস্টাইনের পরে ফাইনম্যানই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সৃষ্টিশীল বহুমাত্রিক পদার্থবিজ্ঞানী। 

অনেকদিন থেকেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন ফাইনম্যান। দুইবার অপারেশনের পর সেরেও উঠেছিলেন। কিন্তু তৃতীয়বার অপারেশানের পর ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান ফাইনম্যান। 


তথ্যসূত্র

১) প্রদীপ দেব – কোয়ান্টাম ভালোবাসা।

২) ক্রিস্টোফার সাইকিস – নো অর্ডিনারি জিনিয়াস।

৩) জেমস গ্লেইক – জিনিয়াস।

_______________

বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত




Saturday 11 December 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৫০

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫০

“অন্যায়ের ছুরির কোন বাঁট থাকে না; যে মারে সেও রক্তাক্ত হয়।“ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই দার্শনিক উক্তির পক্ষে অনেক ঘোরানো-প্যাঁচানো শৈল্পিক যুক্তি দেখানো যায়। কিন্তু বাস্তবে সেরকম প্রমাণ আমি খুব একটা দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-শিবির গত পাঁচ বছর ধরে যেসব অন্যায় অনবরত করে চলেছে – তাতে আমরাই শরীরে-মনে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি, কিন্তু তাদের ভেতরে-বাইরে কোথাও রক্তক্ষরণের চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তারা এমনভাবে সবকিছু করছে – অনেকে বুঝতেই পারছে না কোন্‌টা ন্যায়, কোন্‌টা অন্যায়। আমার সাথে সরাসরি যে অন্যায়টা তারা করেছে, আলাওল হলের ব্যাপারটা – আমি বন্ধুদের কাউকে বলিনি। শিবিরের হাতে মার খাওয়াটা এখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ধরে নেয় সবাই। অন্যায় সহ্য করতে করতে অন্যায়টাই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়। ছিয়াশির নভেম্বরের আগে এরশাদের বলে বলীয়ান হয়ে এরকম যখন যাকে খুশি ধরে মারতো ছাত্রসমাজের ক্যাডাররা। এখন শিবিরের ক্যাডাররা একই ঘটনা ঘটাচ্ছে। শিবিরের রাজত্ব যদি কখনো শেষ হয় – তখন অন্য কোন দলের ক্যাডাররা ঘটাবে। আমাদের মতো নিরীহ সাতে-পাঁচে না থাকতে চাওয়া শিক্ষার্থীরা মার খেতেই থাকবে। 

 যীশু সেদিন আমার সাথে ছিল, সে কাউকে বলেছে কি না জানি না। কিন্তু ক্লাসের অনেকেই জেনে গেছে ব্যাপারটা। হলের বারান্দায় সেই সময় যারা ছিল তারা দেখেছে। তাদের মধ্যে আমাদের ক্লাসেরও কেউ কেউ হয়তো ছিল। ঘটনার পরেরদিন হাফিজ জানতে চাইলো, “কী করবি ভাবছিস?”
“কী আর করবো, কিছু করার উপায় কি আছে?”
“সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম। এবার তো অল্পের উপর দিয়ে গেছে। এরপর হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়ে রেললাইনে ফেলে রাখবে।“ 

আমি বুঝতে পারছি হাফিজ কী বলতে চাচ্ছে। যীশু আর প্রদীপ নাথের সাথে এব্যাপারে সব সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছি। হলে যেসব ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে তার তুলনায় আমার ঘটনাটা নিতান্তই তুচ্ছ। আমাকে যদি এখন হলে সিট একটা দেয়াও হয়, আমি কি হলে থাকতে পারবো? কুমিরের সাথে ঝগড়া করে পানিতে বাস করতে হলে সারাক্ষণ যে পরিমাণ উৎকন্ঠার ভেতর থাকতে হবে তাতে পড়াশোনা হবে? 

কিন্তু অন্যায় একেবারে চুপচাপ সহ্য করাও কি সম্ভব? আবার সহ্য না করেও উপায় কী? ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’ জাতীয় আপ্তবাক্য নিরাপদ দূরত্বে বসে বলা অনেক সহজ। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে অন্যায়কে মেনে নেয়ার যে কী কষ্ট – তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে, এবং তাদের সংখ্যা অনেক। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে স্বয়ং ভিসি পর্যন্ত আজ তাদের কাছে অসহায়। 

১৮ নভেম্বর থেকে ভাইস-চ্যান্সেলরের অফিস-বাসা অবরোধ করে রেখেছে শিবিরের ক্যাডাররা। বাসার বাইরে মাইক লাগিয়ে অনবরত হুমকি দেয়া হচ্ছে তাঁকে পদত্যাগ করার জন্য। ক্যাম্পাসে পুলিশ-ক্যাম্প আছে, সেখানে গায়ে-হাওয়া-লাগানো পুলিশ আছে অনেক। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখা ছাড়া আর কিছুই করছে না। কারণ আর কিছু করার হুকুম তাদের দেয়া হচ্ছে না উপরের মহল থেকে। উপরের মহল অর্থাৎ সরকার এখন জামায়াত-শিবিরের পক্ষে। 

শিবিরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সর্বদলীয় ছাত্র-ঐক্য গঠিত হয়েছিল। চাকসু নির্বাচনে জেতার পর এই ঐক্য শিবির-প্রতিরোধের চেয়েও ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগির দিকেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছে বলে আমার ধারণা। নইলে শিবিরের বিরুদ্ধে তাদের অবরোধ কয়েকদিনের মধ্যেই একটা হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো না। 

সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য নামে সর্বদলীয় হলেও এখন রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কারণে ছাত্রদল ছাত্রশিবিরের বিপক্ষে একটা শব্দও উচ্চারণ করছে না। চাকসুর ভিপি অচিরেই বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন বলে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। তারপরও ছাত্রঐক্যের ডাকে একদিন আধাবেলা হরতাল পালিত হয়েছে, আর অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ডাকা হয়েছে শিবিরের অবরোধের বিরুদ্ধে। ছাত্রঐক্য শহর থেকে শাটল ট্রেন আসতে দিচ্ছে না। আর ক্যাম্পাসে যেসব বাস চলতো সেগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু টিচার্স-বাস, স্টাফ-বাস ঠিকই চলছে এবং ক্লাসও চলছে। 

আমার ধারণা শিক্ষকরা আন্তরিকভাবে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বাধাহীনভাবে চলতো। শিক্ষকরা যদি রাজনৈতিক সুবিধা না নিতেন, ছাত্ররাজনীতিকে নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধালাভের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার না করতেন, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এই অবস্থা হতো না। ছাত্রদের রাজনীতি থেকে তাঁরা নিজেদের লাভ ঠিকই খুঁজে বের করে নেন। নইলে গতবছরের ডিসেম্বরে ছাত্র-শিক্ষকদের উপর শিবিরের আক্রমণের পর, একজন ছাত্র নিহত এবং অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হবার পর আবার শিবিরই যখন বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধ করে রেখেছিল মাসের পর মাস, তখন কোন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ক্লাস নেননি। এমইএস কলেজে বিকল্প প্রতীকী ক্লাস চালু হবার পর প্রামাণিকস্যার ছাড়া আমাদের ডিপার্টমেন্টের আর কোন শিক্ষক ক্লাস নিতে যাননি। অথচ এখন যখন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলি ভিসিস্যারকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে শিবিরের বিরুদ্ধে অবরোধ ডেকেছে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের স্যাররা ক্লাস নিচ্ছেন। ক্লাস নেয়া শিক্ষকদের দায়িত্ব। এজন্য অবশ্যই তাঁদের সাধুবাদ দেয়া উচিত। কিন্তু সেই দায়িত্ব শিবিরের অবরোধের সময় দেখা যায় না কেন? অবশ্য প্রামাণিকস্যার এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। তিনি তখনো ক্লাস নিয়েছেন, এখনো ক্লাস নিচ্ছেন। দায়িত্বে অবহেলা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। তিনি তো সরাসরি বলেন, “ক্লাস বন্ধ করলে তোমাদেরই ক্ষতি, তোমরাই পিছিয়ে যাবে, তোমাদেরই শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর বন্ধ থাকলেও শিক্ষকদের কোন অসুবিধা হবে না।“  

অবরোধের সমর্থনে শুরুতে আমরা কয়েকজন কিছুদিন ক্লাস করিনি। কিন্তু তাতে আমাদেরই ক্ষতি হয়েছে। সোবহানস্যার একটা টিউটোরিয়েল পরীক্ষা নিয়ে ফেলেছেন। অর্ধেক শিক্ষার্থী টিউটোরিয়েল পরীক্ষার কথা না জানলেও পরীক্ষা নিতে স্যারের কোন অসুবিধা হয়নি। শিবিরের অবরোধের সময় প্রামাণিকস্যার যে ক্লাস নিয়েছিলেন সেটাকে অবৈধ বলেছিল যারা, তারা এখন চুপ করে আছে। আমরা যারা পরীক্ষা দিতে পারিনি, সোবহানস্যারের কাছে গিয়েছিলাম। স্যার খুবই বিরক্তভাবে বলেছিলেন, “তোমরা ক্লাসে না এলে তোমাদেরকে কি বাসায় বাসায় গিয়ে ডেকে নিয়ে আসবো?” 

বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টেই আমাদের মতো অবস্থা। প্রগতিশীলদের অবরোধ অচিরেই একটা হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। অথচ ভিসিস্যারের বাসা আর অফিসের সামনে শিবিরের ননস্টপ অবরোধ চলছে।

ভিসিস্যার অবরুদ্ধ অবস্থায় কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন জানি না, কিন্তু কোনকিছুই থেমে নেই। অজিতদের মাস্টার্সের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হয়ে গেলো। আমাদের অনার্সের রেজাল্টের ভিত্তিতে স্কলারশিপ দেয়া হয়েছে। সেই স্কলারশিপের টাকা তোলার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। নোটিশ মোতাবেক গেলাম প্রশাসনিক ভবনে। 

লাল-ফিতার দৌরাত্ম্য সম্পর্কে আগে কিছুটা শুনেছিলাম, এবার দেখলাম। নতুন গ্রন্থাগার ভবন হবার আগে যেখানে লাইব্রেরি ছিল – এখন সেই বিল্ডিংটার পুরোটাই প্রশাসনিক ভবন। নিচের তলায় একটা রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম বৃত্তির টাকা তুলতে কোথায় যেতে হবে। যাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি আকারে ছোটখাট হলে কী হবে – আশ্চর্য রকমের বজ্রকন্ঠ। খুবই বিরক্ত হয়ে তর্জনী উঁচিয়ে গমগমে গলায় বললেন, “দোতলায় গিয়ে দ্যাখেন।“

দোতলায় উঠলাম। সারি সারি রুম, লোকজনের ভীড় নেই কোথাও। এতগুলি রুমে এতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কী কাজ তা জানি না। বারান্দা থেকে রুমের ভেতর যতটুকু দেখা যায় – দেখতে পাচ্ছি প্রত্যেক রুমেই তিন-চারজন মানুষ মিলে গল্পগুজব করছেন। সকাল এগারোটা সম্ভবত গল্পগুজব করার সময়। রুমের সামনে কাঠের নাম-ফলকে লেখা আছে সেকশান অফিসার-১, সেকশান অফিসার-২, সেকশান অফিসার-৩, … কতজন সেকশান অফিসার আছেন এখানে? এদিকে কয়েকটা রুমে আবার পর্দা ঝুলছে। আমি পর্দাবিরোধী মানুষ। পর্দা ঠেলে ঢোকার সাহস হলো না, পর্দাহীন একটা রুমে গলা বাড়ালাম। 

“কী চান এখানে?” ধমকে উঠলেন একজন সোয়েটার-মাফলার পরা ভদ্রলোক। তাঁর টেবিলে অনেকগুলি ফাইলপত্র স্তূপ করা আছে। কিন্তু তিনি ফাইলের উপর পত্রিকা বিছিয়ে পাশের টেবিলের টাইপিস্টের সাথে কথা বলছিলেন এতক্ষণ। 

এই বিল্ডিং-এর সবারই সম্ভবত মেজাজ গরম। প্রশাসনিক দপ্তরে যারা কাজ করেন তারা সবাই কোন না কোনভাবে নিজেকে শাসনকর্তা ভাবেন; সে রাষ্ট্রই হোক, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ আমাদের কাজ করার জন্যই তাঁদেরকে রাখা হয়েছে। কিন্তু সেটা আমরা জানলেও কিছুই করার নেই। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ বলে বন্দুকের নল যখন জনগণের দিকে তাক করা হয়, তখন জনগণের জানতে বাকি থাকে না কার ক্ষমতা কতটুকু। 

ধমক খেয়ে আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। মিনমিন করে বললাম, ‘বৃত্তির টাকা তোলার জন্য কোথায় যেতে হবে?’
“টাকা তোলার জন্য কোথায় যায় মানুষ? ব্যাংকে যেতে হবে।“
“না, মানে বৃত্তির টাকা –“
“বৃত্তির টাকা ব্যাংকে জমা হবে। ব্যাংক থেকে তুলতে পারবেন।“

টুকটাক বৃত্তি আগে যেগুলি পেয়েছিলাম সেগুলির কোনটাই ব্যাংক থেকে তুলতে হয়নি। স্কুল-কলেজ থেকে নগদ দিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি কি তবে ব্যাংকে যায়? কীভাবে কী হয় এই তথ্যগুলি আমাদের সরাসরি জানিয়ে দিলে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের কী অসুবিধা হয় আমি জানি না। 
“কীভাবে জমা হবে কিছুই তো জানি না।“

এবার টাইপিস্ট মহোদয়ের দয়া হলো। তিনি কিছুটা মোলায়েমভাবে বললেন, “আপনি তিন তলায় অ্যাকাউন্টস সেকশানে গিয়ে খবর নেন।“ 

তিন তলায় অনেক ভীড়। টাকা-পয়সার ব্যাপার যেখানে, ভীড় সেখানে বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন স্যারকেও দেখলাম এখানে হাঁটাহাঁটি করছেন। খুবই হাই-পাওয়ার সেকশান বুঝতে পারছি। কিন্তু এখানে কাকে জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছি না। এক কোণায় একটা কাউন্টারের মতো দেখা যাচ্ছে। গেলাম সেখানে। 

“কী দরকারে আইছেন?” বিশাল একটা খাতায় দ্রুত কলম চালাতে চালাতে প্রশ্ন করলেন টুপি-পরা বৃদ্ধ ভদ্রলোক। লম্বা দাড়ি ধবধবে সাদা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেয়ার বয়স সম্ভবত সরকারি চাকরির অবসরের বয়স থেকে বেশি। নইলে এই ভদ্রলোকের বয়স অনুযায়ী এতদিনে অবসরে চলে যাওয়ার কথা। 
“স্কলারশিপের টাকার ব্যাপারে।“
“ফরম ফিল আপ করছেন?”
“জি না।“
“পাঁচ টাকা দেন” বলে পেছনের টেবিলে রাখা ফাইলের স্তূপ থেকে টেনে একটা হলদেটে কাগজ কাউন্টারের লোহার শিকের ভেতর দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন “ফরমের দাম।“
আমি পকেট থেকে টাকা বের করে দেখলাম পাঁচ টাকার কোন নোট নেই। দশ টাকার একটি নোট এগিয়ে দিলাম। তিনি টাকাটা টেনে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলেন। আমি ফরমটার দিকে তাকালাম। সাইক্লোস্টাইল করা ঝাপসা একটি ফরম। 

“ওইটা পূরণ কইরা চেয়ারম্যানের সাইন লইয়া আইসা এইখানে জমা দিবেন।“
“জি।“
আমি দাঁড়িয়ে আছি পাঁচ টাকা ফেরত নেয়ার জন্য। তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন। মনে করিয়ে দেবো কি না ভাবতে ভাবতে ফরমে চোখ বুলাচ্ছি।
“আর কিছু কইবেন?”
“পাঁচ টাকা বললেন, দশ টাকা দিয়েছি তো।“
“পাঁচ টাকা ভাঙতি নাই। আরেকটা ফরম নিয়া যান।“ – বলে আরেকটা ফরম এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
“দুটো ফরম নিয়ে আমি কী করবো?”
“সেইটা আমি কী জানি। পাঁচ টাকার লাইগা যেইভাবে খারাই আছেন!” – তাঁর কন্ঠে শ্লেষ। মনে হচ্ছে পাঁচ টাকা ফেরত চেয়ে আমি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি। 

ফরমের জন্য যে পাঁচ টাকা করে নিচ্ছেন সেটার কোন রশিদ দিচ্ছেন না। আমি রশিদ চাইলে কী করবেন কে জানে! এগুলি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা হবে না তা যে আমি বুঝতে পেরেছি তা তিনিও বুঝতে পেরেছেন। সে কারণেই হয়তো এবার আরেকটু তথ্য দিলেন। বললেন, “ব্যাংকে একাউন্ট খুলছেন? অগ্রণী ব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় একটা একাউন্ট খোলেন। সেই একাউন্ট নম্বর এই ফরমে লিখে জমা দিবেন। আপনার বিত্তির টাকা অই একাউন্টেই জমা হইব।“

ব্যাংকের একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে যে এত ঝামেলা করতে হয় তা জানা ছিল না। চারপাতার একটা ছাপানো ফরম পূরণ করতে হলো। আমি যে বাংলাদেশের নাগরিক তা প্রমাণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জাতীয়তা সনদপত্র এনে জমা দিতে হলো ফরমের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সময় দুনিয়ার সব কাগজপত্র জমা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে একটা পরিচয়পত্র দিয়েছে। সেটা দেখালেই তো বোঝা উচিত যে আমার সব কাগজপত্র ঠিক আছে। না, তা হবে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আমাদেরকে প্রতিবছর একবার করে ভর্তি হতে হবে, ভর্তির সময় সমস্ত কাগজপত্র জমা দিতে হবে। আবার পরীক্ষার আগে ফরম পূরণ করতে হবে। এগুলি করার জন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে হল, হল থেকে ব্যাংক সব জায়গায় কয়েকবার করে দৌড়াতে হবে। একজন ছাত্রকে এতবার করে কেন একই জিনিস প্রমাণ করতে হবে? এই গোলমেলে সিস্টেম চলছে বছরের পর বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন যে শিক্ষকরা তাঁরাও হয়তো ছাত্রাবস্থায় এই সিস্টেমের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু নিজেরা যখন শিক্ষক হয়েছেন – এই সিস্টেম বদলানোর কথা ভুলে গেছেন। 

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার পর বৃত্তির ফরম পূরণ করে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের সাইন-টাইন যা লাগে সব নিয়ে আবার গেলাম প্রশাসনিক ভবনের সেই কাউন্টারে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক ফরমটা টেনে নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, বিশ টাকা দেন।

আমি কিছু বলার আগেই তিনি আবার বললেন, “রেভিনিউ লাগবে। সরকারি ট্যাক্স।“ 
আমি দশ টাকার দুটো নোট এগিয়ে দিলাম। তিনি টাকা টেনে নিতে নিতে বললেন, “এইখানে সাইন করেন।“

বিশাল একটা খাতার যেখানে আমাকে সাইন করতে বললেন সেখানে পৌঁছানোর জন্য কাউন্টারের শিক দিয়ে হাত ঢুকাতে হলো। তিনি আরেকটি মোটা খাতার ভেতর থেকে ডাকটিকেটের মতো একটা টিকেট বের করে বিশাল খাতায় আমার দস্তখতের পাশে লাগিয়ে দিলেন। দেখলাম চার টাকার রাজস্ব টিকেট লাগানো হয়েছে। চার টাকার বদলে আমার কাছ থেকে বিশ টাকা নিলেন!

“দুই সপ্তাহ পরে ব্যাংকে খবর নিবেন। আপনার একাউন্টে চব্বিশ শ টাকা জমা হয়ে যাবে। এক মাসে দুইশ টাকা করে এক বছরের বিত্তি।“ 
“কত টাকার রেভিনিউ লাগলো?” 

আমার প্রশ্ন শুনে তিনি গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “মনটারে বড় কইরেন বুইঝলেন। দুই-চাইর টাকার হিসাব কইরতে থাকলে বড় হইতে পাইরবেন না। আল্লার ইচ্ছায় বিত্তি পাইছেন, শোকর কইরেন।“ 

আমি ভদ্রলোকের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিনি মিথ্যা বলে আমার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন, আমি সেটা জিজ্ঞেস করতেই ছোটমনের মানুষ হয়ে গেলাম! তিনি অন্যায় করার পরেও মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।  আর আমি মাথা নিচু করে চলে এলাম। 

এরকমই জগতের নিয়ম কিনা আমি জানি না, তবে আমাদের চারপাশে এটাই নিয়ম। এখানে অন্যায়কারীই শক্তিমান। সেই শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া গেল ২৯ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান শত্রুদের একজন – গোলাম আযম জামায়াতের আমীর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। সেই ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি পাকিস্তান থেকে এসে এদেশে বহাল তবিয়তে আছেন। এতবছর গোপনে জামায়াতের প্রধান হিসেবে কাজ চালালেও আমীর হিসেবে প্রকাশ্যে আসেননি। এখন খালেদা জিয়ার আমলে তিনি প্রকাশ্যে এলেন। ডিসেম্বর মাস – আমাদের স্বাধীনতার মাস। আমাদের স্বাধীনতার ঠিক বিশ বছর পর এরকম একটা অপমান আমাদের সইতে হচ্ছে। 

শুধু সেখানেই শেষ নয়। এই একই দিনে খালেদা জিয়া সরকার আমাদের ভিসি আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনকে মেয়াদ শেষ হবার আগেই ভাইস-চ্যান্সেলরের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এতদিন ধরে জামায়াত-শিবিরের অনবরত চাপের কাছে একটুর জন্যও মাথা নোয়াননি যে প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন, তাঁকে রাষ্ট্রের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরিয়ে দেয়া হলো। ৩০ ডিসেম্বর থেকে ভিসির দায়িত্ব নিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর রফিকুল ইসলাম চৌধুরি। 

Saturday 4 December 2021

প্রাণের কোয়ান্টাম

 

সূত্র: Nature Vol. 474, 16 June 2011

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর মানুষ যুদ্ধ করছে করোনা ভাইরাসের সাথে। এই ভাইরাস এত ছোট যে খালি চোখে তো দূরের কথা সাধারণ লাইট মাইক্রোস্কোপ বা আলোক-অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও এদের দেখা যায় না। কিন্তু সুযোগ পেলেই এরা আমাদের শরীরে ঢুকে যাচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে। ঢুকেই অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, আক্রমণ করছে আমাদের ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। শরীরের প্রতিটি কোষের কার্যক্রম এমনভাবে ব্যহত করছে যে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হচ্ছে। কীভাবে কাজ করছে এরা? আমাদের নাক-মুখ-চোখ দিয়ে ঢোকার সময় আমরা কোন ব্যথা পাচ্ছি না। বাতাসের উপাদানের সাথে এরা কীভাবে মিশছে? এই যে মিশে যাওয়া – বা ফিউশান ঘটা, আবার শরীরের কোষের ভেতর ঢুকে যাওয়া – এরজন্য যে শক্তির দরকার হয়, তা তারা কোথায় পায়? এই ভাইরাসগুলি শরীরে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এত দ্রুত কীভাবে বাড়ে এবং বিবর্তন ঘটায়? এত ক্ষুদ্র প্রাণসত্ত্বায় একইসাথে এত জটিল কাজ কীভাবে হয়? এসব রহস্য বের করতে বিজ্ঞানীরা হিমসিম খাচ্ছেন। আমরা প্রাণীকোষের গঠন এবং কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। কিন্তু এখনো অনেক কিছুই অজানা। আমাদের ধ্রুপদী বলবিজ্ঞান বা ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স দিয়ে জীবকোষের কার্য-প্রণালী পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীদের এখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আশ্রয় নিতে হচ্ছে – জীবনের মৌলিক উপাদান জীবকোষের মূল রহস্য বোঝার জন্য। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের আকার ও গতিপ্রকৃতি দেখার জন্য আমরা ইতোমধ্যেই ব্যবহার করছি যেসব যন্ত্র – যেমন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, কিংবা পদ্ধতি – যেমন এক্স-রে ডিফ্রাকশান, এসবের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। 

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগত – এক অত্যাশ্চর্য জগত। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এসে এর আগের কয়েক শ বছরের চিরায়ত বিজ্ঞানের অনেক প্রচলিত ধারণা বদলে দেয়। এরপর থেকে বিজ্ঞানীরা অনেক আবিষ্কৃত ব্যাপারও নতুন ভাবে আবিষ্কার করেন, নতুন ভাবে বুঝতে শুরু করেন। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিছু কিছু ব্যাপার এখনো এতটাই আশ্চর্যের যে – কোয়ান্টাম মেকানিক্স কীভাবে কাজ করে তা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো গলদঘর্ম হচ্ছেন। যেমন আলো – কণা রূপেও থাকতে পারে, আবার তরঙ্গ রূপেও থাকতে পারে। 

কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের বয়স এখন ১২০ বছর।  এপর্যন্ত কোয়ান্টাম জগতের যতটুকু পরীক্ষাগারে সরাসরি প্রমাণ করা গেছে, সেটুকু খুবই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, খুবই ছোট ন্যানোমিটার স্কেলে এবং অন্ত্যন্ত কম তাপমাত্রায়। কিন্তু  জীবন্ত জীবকোষের পরিবেশ মোটেও সেরকম নয়। জীবন্ত জীবকোষের নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আছে এবং পরীক্ষাগারের আরোপিত শৃঙ্খলা সেখানে নেই। সেকারণে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব, জীববিজ্ঞানে সেভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যতই উন্নতি ঘটছে, বিজ্ঞানীদের সেই ধারণা বদলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন প্রকৃতিতে জীবকোষের ভেতর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়েই সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। 

একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আমরা সূর্যের শক্তি নিয়ে বেঁচে আছি। পৃথিবী টিকে আছে সূর্যের শক্তির উপর। সূর্যের ভেতর এই শক্তি কীভাবে উৎপন্ন হচ্ছে? সূর্যে আছে প্রচুর হাইড্রোজেন। যা নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়ামে পরিণত হচ্ছে এবং এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটির পুরোটাই কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া। কীভাবে? একটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন আছে। তার সাথে নিউক্লিয়ার ফিউশান হতে হলে আরেকটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস এসে মিশে যেতে হবে। এখন আরেকটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসও তো একটি ধনাত্মক প্রোটন। একটি প্রোটন তো অন্য আরেকটি প্রোটনকে আকর্ষণ করবে না। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স অনুযায়ী একটি ধনাত্মক চার্জ অন্য একটি ধনাত্মক চার্জকে বিকর্ষণ করবে। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স মেনে চললে তো সূর্য থেকে কোন শক্তিই উৎপন্ন হতো না, সৌরজগতও হতো না, মহাবিশ্বও হতো না।  তাহলে এখানে একটি নিউক্লিয়াস আরেকটি নিউক্লিয়াসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে কীভাবে? কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে, যা শুধু কোয়ান্টাম মেকানিক্সই ব্যাখ্যা করতে পারে। অনবরত কোয়ান্টাম টানেলিং-এর ফলে যে শক্তি বিকির্ণ হয়, সেই শক্তিই আমাদের পৃথিবীসহ সৌরজগতের সব গ্রহকে শক্তি জোগায়। 

এই কোয়ান্টাম টানেলিং আমাদের শরীরের কোষে কোষে অনবরত চলছে। আমরা এনজাইম বা উৎসেচকের কথা জানি। এগুলো মূলত প্রোটিন। জীবকোষের ভেতর যত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে সেগুলোকে ত্বরাণ্বিত করতে সাহায্য করে এনজাইম। কিন্তু কীভাবে এই কাজ করে এরা? কোষের মেমব্রেন বা কোষের আবরণ ভেদ করে কীভাবে এরা ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটায়? 'কোয়ান্টাম টানেলিং' এর মাধ্যমে। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের সূত্র মেনে কোন একটি বাধা পার হয়ে যেখানে ইলেকট্রনের যাওয়ার কোন উপায় নেই, সেখানেও দেখা যায় কিছু ইলেকট্রন সেই বাধা অতিক্রম করে ফেলেছে। জীবকোষের কোটি কোটি কোষের ভেতর অনবরত চলছে কোয়ান্টাম টানেলিং। 

পৃথিবীতে যে প্রাণের উৎপত্তি এবং প্রাণ-বিকাশের পরিবেশ তৈরি হয়েছে – তা কীভাবে হয়েছে? ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স তার পুরোটা ব্যাখ্যা করতে পারে না। আমাদের পৃথিবীর খাদ্যভাণ্ডার তৈরি হয় প্রধানত জৈব-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ব্যাকটেরিয়া, গাছপালা ইত্যাদি কীভাবে সূর্যালোক, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, পানি থেকে জৈব-খাদ্য তৈরি করে – তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে। 

পৃথিবীর সবচেয়ে দরকারি এবং জটিল জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া সালোক সংশ্লেষণ। এর ভেতর মূল কাজ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। উদ্ভিদের পাতায় যে ক্লোরোফিল আছে তার সাথে সূর্যালোকের বিক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ আছে। আমাদের পরিবেশে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প বা পানির কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতার ক্লোরোফিল সূর্যের আলোর সাথে বিক্রিয়া করে অর্থাৎ সূর্যের আলোর ফোটন কণার শক্তি কাজে লাগিয়ে পানি থেকে ইলেকট্রন বের করে নিয়ে আসে। সেই ইলেকট্রন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে যুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বোহাইড্রেড বা গ্লুকোজ। ইলেকট্রনের আদান-প্রদানের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমতে থাকে এবং অক্সিজেন তৈরি হতে থাকে। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ তৈরির রাসায়নিক সমীকরণ: 6CO2 + 12H2O + ফোটন (সূর্যের আলো) = C6H12O6 + 6O2 + 6H2O. সব সালোকসংশ্লেষণেই যে অক্সিজেন উৎপন্ন হবে এমন কোন কথা নেই। সাধারণত উদ্ভিদ, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া (সায়ানোব্যাকটেরিয়া) সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। আবার কিছু বেগুনি ও সবুজ ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমায় ঠিকই, কিন্তু অক্সিজেন তৈরি করে না। সেখানে পানির বদলে অন্য পদার্থ ব্যবহৃত হয়। সেধরনের সালোকসংশ্লেষণের রাসায়নিক সমীকরণ লেখা যায় এভাবে: CO2 + 2H2A + ফোটন (আলো) = [CH2O] + 2A + 2H2O. এখানে A হলো এমন একটি যৌগ যেটা থেকে ফোটনের বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন বের হয়ে আসবে। আলোর ফোটন কী প্রক্রিয়ায় পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের হয়ে আসতে সাহায্য করে সেই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া চলবে না। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে প্রত্যেকটি ধাপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে এই ধাপগুলো ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন ফোটনগুলো শোষিত হবার পর কোষের ভেতর একটি কেন্দ্রে গিয়ে মিলিত হচ্ছে - যাকে রিঅ্যাকশান সেন্টার বলা হয়। এই কেন্দ্রেই সালোক সংশ্লেষণ ঘটে। ফোটনগুলো এই কেন্দ্রে সরাসরি যায় না। একই সাথে অনেকগুলো পথে এই ফোটনগুলো রিঅ্যাকশান সেন্টারে যায় - যা কোয়ান্টাম সুপারপজিশান, অর্থাৎ একই সাথে একাধিক অবস্থায় থাকা। 

শীতপ্রধান দেশের যেসব অঞ্চলে খুব বেশি শীত পড়ে সেখান থেকে শীতকালে হাজার হাজার পাখি হাজার হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে উড়ে চলে যায় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ কোন অঞ্চলে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর নিজের দেশে শীত কমে গিয়ে বসন্ত আসতে শুরু করলে সেই পাখিগুলি আবার একই পথে উড়তে উড়তে নিজের দেশে একই জায়গায় ফিরে আসে। কীভাবে পথ দেখে তারা? তাদের কি কোন জিপিএস আছে? বিজ্ঞানীরা আজ প্রমাণ পেয়েছেন এসব পাখি পৃথিবীর চুম্বকত্ব কাজে লাগিয়ে পথ দেখে। সব পাখির কিন্তু এই ক্ষমতা নেই, শুধুমাত্র পরিযায়ী পাখিদের আছে। এদের চোখের রেটিনায় আলো পড়ে প্রতিটি ফোটন থেকে দুটো ফ্রি রেডিক্যাল তৈরি হয়। এই ফ্রি রেডিক্যালগুলির নিজস্ব কৌণিক ঘূর্ণনবেগ আছে, নিজের অক্ষে একে অপরের সাথে অনুরণনে তারা ঘুরতে থাকে।  পৃথিবীর চৌম্বকত্বের প্রভাবে এই ফ্রি রেডিক্যালের ঘূর্ণনবেগ প্রভাবিত হয়। উড়ে চলার সময় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তনের কারণে পাখির রেটিনার ফ্রি রেডিক্যাল দুটির একটির সাথে অন্যটির রেজোনেন্স পরিবর্তিত হলে তাদের শরীরে প্রতিক্রিয়া হয় এবং এই পরিবর্তন শরীর মনে রাখে। ফিরে যাওয়ার সময়ও একই ধরনের চৌম্বকীয় পরিবর্তন তৈরি করতে করতে তারা ফিরে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই চৌম্বকীয় ব্যাখ্যা আরো অনেক কীট-পতঙ্গের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। 

আমরা কীভাবে গন্ধ পাই – তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স লাগবে। আমাদের ঘ্রাণ-ইন্দ্রীয় বা অলফ্যাক্টরি নার্ভ অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ বুঝতে পারে। কিন্তু কীভাবে কাজ করে এই ঘ্রাণ ইন্দ্রীয়? জীববিজ্ঞানের সাধারণ ব্যাখ্যা হলো গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতির উপর নির্ভর করে আমরা কী ধরনের গন্ধ পাবো। আমাদের নাকের মধ্যে আছে গন্ধ চেনার সেন্সর বা সংবেদী কোষ যাদের বলা হয় স্মেল রিসেপ্টর। এই কোষগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির সেন্সর। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতি যে সেন্সরের আকার ও আকৃতির সাথে মিলে যাবে সেই গন্ধের সিগনাল চলে যাবে মস্তিষ্কে। তখন মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি নার্ভ সেই সিগনাল প্রসেস করে আমাদের গন্ধের অনুভূতি দেয়। কিন্তু আমাদের নাকের মধ্যে আছে মাত্র চারশ রকমের স্মেল রিসেপ্টর। অথচ আমরা কয়েক হাজার রকমের গন্ধ পাই। যদি একেক গন্ধের জন্য একেক রকমের রিসেপ্টর নির্দিষ্ট থাকতো তাহলে আমরা চারশ রকমের চেয়ে বেশি গন্ধ পেতাম না কোনভাবেই। অথচ কয়েক লক্ষ রকমের গন্ধ আমরা বুঝতে পারি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই গন্ধরহস্য ভেদ করতে পেরেছে। কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান এই গন্ধতত্ত্বের নাম দিয়েছে ভাইব্রেশান থিওরি অব অলফেকশান। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুর পারমাণবিক বন্ধন বা অ্যাটমিক বন্ড তরঙ্গের মত কাজ করে। আর আমাদের নাকের সেন্সর এই তরঙ্গের কম্পন শনাক্ত করে। গন্ধের তীব্রতা ও প্রকৃতিভেদে অসংখ্য কম্পাঙ্কের গন্ধ-তরঙ্গ তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকে। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুযায়ী আমরা অসংখ্য ধরনের গন্ধ পেতে পারি। 

আমাদের রোগনির্ণয় ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক অত্যাধুনিক যন্ত্র এবং পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে – যাদের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ভাইরাস দেখতে পাওয়া যায় -  যেমন গুটিবসন্তের ভাইরাস ভ্যারিওলা। কিন্তু যেসব ভাইরাসের আকার আরো ছোট, অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সেগুলি দেখা যায় না। সেগুলো দেখার জন্য ব্যবহার করা হয় এক্স-রে। ১৮৯৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানী রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করার পর পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞানেও অনেক নতুন পথ খুলে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং বোরের পারমাণবিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ১৯১২ সালে পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স ফন লাউ আবিষ্কার করেন যে এক্স-রে'র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কোন ক্রিস্টালের ভেতরের পরমাণুগুলোর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্যের সাথে তুলনীয়। অর্থাৎ কোন ক্রিস্টালে এক্স-রে প্রয়োগ করলে সেই এক্স-রে বিচ্ছুরিত হয়। শুরু হলো এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি। পরের বছর এক্স-রে ডিফ্রাকশান ব্যবহার করে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ ও তাঁর ছেলে লরেন্স ব্র্যাগ । এক্স-রের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করা যায় যে পদ্ধতিতে সেই পদ্ধতিতে জীববিজ্ঞানের অনেককিছুর গাঠনিক বিশ্লেষণ ও আকার-আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৩৪ সালে আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন বার্নেল এবং তাঁর ছাত্রী ডরোথি হজকিন মলিকিউলার বায়োলজিতে এক্স-রে ডিফ্রাকশান প্রয়োগ করে পেপসিনের গঠন বিশ্লেষণ করেন। বার্নেল ও হজকিনের এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি স্ট্রাকচারাল বায়োলজি-র বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে। এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতিতে সরাসরি প্রোটিন বা অন্য কোন জৈব পদার্থের অভ্যন্তরীণ ছবি তোলা হয় না, কিন্তু জৈব পদার্থের আণবিক বিন্যাস থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আসা এক্স-রে সিগনালগুলোকে একত্রিত করে পুরো বিন্যাসটি পুনর্গঠন করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জৈব যৌগ বিশ্লেষণ খুব সহজ হয়ে গেছে। 

১৯৩৩ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নস্ট রুশকা এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ম্যাক্স নল (Max Knoll) ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবন করেন। সাধারণ মাইক্রোস্কোপে আলোর মাধ্যমে বিবর্ধন ঘটানো হয়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে আলোর কণা ফোটনের পরিবর্তে ইলেকট্রন ব্যবহার করা হয়। ইলেকট্রনও আলোর মত কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্মই প্রদর্শন করে। ইলেকট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ ছোট। তার মানে হলো স্বাভাবিক মাইক্রোস্কোপে যত ছোট বস্তু দেখা সম্ভব, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে তার চেয়েও এক হাজার গুণ ছোট বস্তু দেখা সম্ভব। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবিত হবার পর থেকে জীববিজ্ঞানে অণুজীব, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির গঠন নির্ণয় করা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে লেজারের ব্যবহার হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। লেজার উৎপাদনের মূলনীতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মে এগুলি কক্ষপথে বিন্যস্ত থাকে – প্রথম কক্ষপথে ২টি, ২য় কক্ষপথে ৮টি, ৩য় কক্ষপথে ১৮টি ইত্যাদি। ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলি হলো তাদের শক্তিস্তর। একটি কক্ষপথে যতগুলি ইলেকট্রন থাকে সবগুলি ইলেকট্রনের শক্তি সমান। নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের যে কক্ষপথ (১ম কক্ষপথ) – সেই কক্ষপথে যেসব ইলেকট্রন থাকে তাদের শক্তি সবচেয়ে কম। এই শক্তিস্তরকে গ্রাউন্ড স্টেট বলা হয়। ইলেকট্রনগুলি যদি কোনভাবে শক্তি শোষণ করে তখন তারা উত্তেজিত হয়ে নিজেদের শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু একটু পরেই সেই অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে। স্বতস্ফূর্তভাবে শক্তি নির্গমনের এই প্রক্রিয়াকে স্পনটেনিয়াস এমিশান (spontaneous emission) বলা হয়। পরমাণুর ইলেকট্রনগুলিকে যদি নির্দিষ্ট শক্তির ফোটনের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটানো যায়, তাহলে ফোটনের শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনগুলি উত্তেজিত হয়ে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর যখন নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে তখন যে শক্তি শোষণ করেছিল তা ফোটনের মাধ্যমে বের করে দেয়। এই নির্গত ফোটনের শক্তি শোষিত ফোটনের শক্তির সমান। ফোটনের প্রবাহ যদি অনবরত চলতে থাকে – তাহলে একটি ফোটন থেকে একই শক্তির ২টি ফোটন, ২টি থেকে ৪টি, ৪টি থেকে ৮টি ফোটন – এভাবে সেকেন্ডের মধ্যে কোটি কোটি ফোটনের প্রবাহ পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ফোটনের শক্তি সমান এবং প্রত্যেকেই একই সাথে একই দিকে যায়। তীব্র প্রাবল্যের এই ফোটনপ্রবাহই লেজার। চিকিৎসাব্যবস্থায় অনেক রকমের ও শক্তির লেজার ব্যবহার করা হয়। কসমেটিক সার্জারি, ত্বকের চিকিৎসায়, ক্ষতস্থান নিরাময়ে, অসাড় স্নায়ুর উদ্দীপনা জোগাতে, দাঁতের চিকিৎসায়, চোখের চিকিৎসায় – ভিন্ন ভিন্ন রকমের লেজার রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। কী ধরনের লেজার প্রয়োগ করা হবে তা নির্ভর করে শরীরের সাথে লেজারের কী ধরনের ইন্টার অ্যাকশান বা মিথস্ক্রিয়া ঘটানো দরকার তার উপর।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা হলো এম আর আই বা ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং। মানুষের শরীরের হাইড্রোজেন পরমাণুকে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের মাধ্যমে অনুরণন ঘটিয়ে শরীরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গণিত দিয়ে শরীরের ভেতরের চিত্র তৈরি করা হয়। এম-আর-আই এক্স-রে’র চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে। জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে শরীরে ওষুধ প্রয়োগেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ভূমিকা রাখবে। 

একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার – কোয়ান্টাম মেকানিক্সের রহস্যময়তার সুবিধা নিয়ে অনেকে কোয়ান্টাম নাম দিয়ে অনেক রকমের অপবিজ্ঞান ও অপচিকিৎসা চালু করেছে। বিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের পার্থক্য বুঝতে পারাটা অত্যন্ত জরুরি। অপবিজ্ঞান প্রতিহত করাও বিজ্ঞানপ্রেমীদের দায়িত্ব। 


তথ্যসূত্র

১। ফিলিপ বল, ন্যাচার, সংখ্যা ৪৭৪, ২০১১।

২। আড্রিয়ানা ম্যারিস প্রমুখ, ইন্টারফেস, সংখ্যা ১৫, ২০১৮।

৩। জনজো ম্যাকফ্যাডেন ও জিম আল-খলিলি, লাইফ অন দি এজ, ক্রাউন পাবলিশার্স, নিউইয়র্ক, ২০১৪।

৪। মাসানারি আসানো প্রমুখ, কোয়ান্টাম অ্যাডপ্টিভিটি ইন বায়োলজি: ফ্রম জেনেটিক্স টু কগনিশান, স্প্রিঙ্গার, ২০১৫। 

_______________
বিজ্ঞানচিন্তা এপ্রিল ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত






Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts