Sunday 31 May 2020

লাল পোকার গল্প

প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিশুদের জন্য গল্পপাঠ। 



Friday 29 May 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৩২

32<<<<<<<<<<<<<<<<<

এভাবে তো চলতে পারে না। আপনারা এতগুলি টিচার যদি একসাথে অ্যাবসেন্ট থাকেন, তাহলে আমি কলেজ চালাবো কীভাবে?

ভাইস প্রিন্সিপাল (এডুকেশান) ম্যাডামের টকটকে ফর্সা মুখ রাগে থমথম করছে। রাগারাগিটা কার সাথে হয়েছে আমি জানি না, কিন্তু তিনি রাগটা ঝাড়ছেন আমার উপর। বাংলায় যে প্রবচন আছে ঝি-কে মেরে বউকে শেখানো সেটা এখানে প্রযোজ্য কি না ঠিক বুঝতে পারছি না। নিজেকে ঝি ভাবতে একটু আত্মসম্মানে লাগছে। এই সাত সকালে কী হয়েছে সেটা এখনো বুঝতে পারছি না। বাস থেকে নেমে টিচার্স রুমে ব্যাগটা রেখেই ভাইস-প্রিন্সিপালের রুমে এসেছি হাজিরা খাতায় সাইন করতে।

এই ছোট্ট রুমটাতে এখন দু-জন ভাইস প্রিন্সিপাল বসেন। নাসির স্যার ভাইস-প্রিন্সিপাল (অ্যাডমিন)। তাঁকে তাঁর চেয়ারে দেখা যাচ্ছে না। তার মানে তিনি এখন প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে আছেন। শিরিন ম্যাডাম ভাইস-প্রিন্সিপাল (এডুকেশান)। এখন খুব রেগে আছেন তিনি। শিক্ষকদের হাজিরা খাতা থাকে তাঁর টেবিলে। আমি মাথা নিচু করে খোলা খাতায় দস্তখত করতে গিয়ে দেখলাম গতকাল আমাকে লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে ABSENT লিখে দেয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে অক্ষরগুলোর উপর অনেকবার কলম চালানো হয়েছে। সেটা যে খুব একটা স্নেহবশত করা হয়নি তা বুঝতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না।

গতকাল চব্বিশ ঘন্টার হরতাল ছিল। হরতালের মধ্যে শহর থেকে আসা অনেক কষ্টকর। হরতালে অনেকবার নৌকা নিয়েও কলেজে এসেছি। কিন্তু না এলে যে কলেজের লেখাপড়ার বিশাল ক্ষতি হয়ে যায় তা নয়। হরতালে কলেজের ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই আসে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আশা করেন হরতালের সময় আমরা পাখির মত উড়ে চলে আসবো খুশিতে কিচির মিচির করতে করতে। গত পরশু শিক্ষকদের মধ্যে কথা হয়েছিল শহর থেকে আমরা কেউই আসবো না। কারণ একজন দুজন এলে বাকিদের কথা শুনতে হয়। কিন্তু হাজিরা খাতায় দেখলাম আমাকে না আসার জন্য যিনি বিশেষ করে বলে দিয়েছিলেন তিনিই উপস্থিত ছিলেন গতকাল।

সাইন করতে করতে মৃদুকন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “গতকালের জন্য কি ম্যাডাম ছুটির দরখাস্ত দেবো?”

“দরখাস্ত দিয়ে কোন লাভ নেই। অ্যাবসেন্ট মার্ক হয়ে গেছে।“

“গতকাল হরতাল ছিল ম্যাডাম।“

“হরতাল ছিল তো কী হয়েছে? …………ও তো শহরে থাকেন। তিনি যদি আসতে পারেন, আপনি আসতে পারলেন না কেন? এভাবে তো চলতে পারে না। আপনারা এতগুলি টিচার যদি এক সাথে অ্যাবসেন্ট থাকেন, তাহলে আমি কলেজ চালাবো কীভাবে?”

আমরা দুই-তিনজন অনুপস্থিত থাকলে শাহীন কলেজের চলতে কষ্ট হয় শুনে নিজেকে অনেক দরকারি ভেবে আমার খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয়। এই জানুয়ারি মাসে কলেজে ক্লাস তেমন হচ্ছে না। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই রমজান আরম্ভ হচ্ছে। তাই সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে। রোল কল করার পরেই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ষোল কোয়ার্টারের মাঠে। সেখান থেকে ফিরে কলেজের বারান্দায় অস্থায়ী মঞ্চে হচ্ছে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। তাই কলেজের পড়ালেখার ক্ষতি হয়ে গেছে আমি কলেজে না আসাতে – এটা খুব একটা ঠিক কথা নয়।  ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে এটা বলতে গিয়েও বললাম না। কারণ ছোট বড় সব বস্ই বিশ্বাস করেন যে – বস ইজ অলওয়েজ রাইট। তাঁদের সামনে তাঁদের অধীনস্ত কেউ যুক্তিপূর্ণ কথা বললেও তাঁদের ইগোতে লাগে। পদোন্নতির সাথে সাথে মানুষের ইগোও বেড়ে যায়। সেই ইগো আবার খুব অল্পেই আহত হয়।

ভেবেছিলাম টিচার্স রুমে এসে ওই স্যারকে জিজ্ঞেস করবো – কেন তিনি আমাকে আসতে মানা করে নিজে এসেছিলেন গতকাল। কিন্তু কিছুই বললাম না। কারণ এসব ব্যাপারে তাঁর উত্তর রেডি থাকে। তিনি এত সুন্দর করে মোলায়েম ভাষায় বুঝিয়ে দেবেন যে মনে হবে স্বয়ং প্রিন্সিপাল স্যার সকালে তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁকে ডেকে নিয়ে এসেছেন কলেজে।

“প্রদীপ, আগামী কালের প্রোগ্রাম তুমি জানো তো? সকাল আটটার মধ্যে কলেজে চলে আসবে।“ – সাঈদ স্যার ব্যস্তভাবে বললেন।

আগামীকাল তো শুক্রবার। হরতালে আসিনি বলে কি শুক্রবারে এসে তা পূরণ করে দিতে হবে? গতকাল কি এই সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে?

“আগামী কাল তো স্যার শুক্রবার। কেন আসতে হবে?” – ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“তুমি জানো না? কাল তো কলেজের পিকনিক। সবাই জানে, আর তুমি জানো না। ছোলাইমান ভাই, আপনি প্রদীপকে বলেননি কিছু?”

“আমি তো ভেবেছি সে জানে।“

জানা গেলো, আগামীকাল কলেজের পিকনিক। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই এর প্রস্তুতি চলছে। কমিটি করা হয়েছে শিক্ষকদের নিয়ে। সাঈদ স্যার কমিটির হেড। ছোলাইমান স্যার ডেপুটি হেড। সবাই সবকিছু জানেন, আর আমি এসব কিছুর খবরই রাখলাম না?

ছোলাইমান স্যার বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন আমাকে, “আপনি কি কানে খাটো নাকি? এতদিন ধরে পিকনিকের কথা হচ্ছে, আপনি কিছুই শোনেননি? আপনাকে কি বাসায় গিয়ে দাওয়াত দিয়ে আসতে হবে? কোন্‌ জগতে থাকেন আপনি?”

সত্যিই তো – কোন্‌ জগতে থাকি আমি?

প্রতিবছর কলেজের শিক্ষকদের পিকনিক হয়। গতবছর কাপ্তাই গিয়েছিলাম। প্রিন্সিপাল স্যার বায়বীয় চা খাইয়েছিলেন। এবার যাওয়া হচ্ছে মেরিন একাডেমিতে। তাই সকালে কলেজে আসতে হবে। এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে মেরিন একাডেমিতে।

পিকনিক সংক্রান্ত আলোচনা আরো কিছুদূর গড়াবার আগেই শংকর স্যারের হুইসেল বেজে উঠলো। মাঠে যেতে হবে। ছেলেমেয়েদের সাথে সার্জেন্ট মেসের পাশ দিয়ে গিয়ে বড় পুকুরের পাড় ধরে ঝোপ-ঝাড় পার হয়ে ষোল কোয়ার্টারের মাঠ।

শীতের সকাল। রোদের তেজে কিছু আরাম লাগছে। কিন্তু একটু পরেই রোদের তেজ বাড়তে শুরু করেছে। ক্রীড়াবিদ ছাত্র-ছাত্রীদের হাউজভিত্তিক প্রতিযোগিতার কিছু কিছু ইভেন্টের ফাইনাল হয়ে যাচ্ছে। মনযোগ দিয়ে দীর্ঘ লাফ দেখছি। আলী আশরাফ অনেকক্ষণ থেকেই কানের কাছে ফিজিক্সের থিওরি কপচাচ্ছে। দীর্ঘ লাফের সাথে গতিজড়তার সম্পর্ক নিয়ে সে বেশ উত্তেজিত। মনে হচ্ছে নিউটন নয়, সে নিজেই আবিষ্কার করেছে গতি জড়তা, স্থিতি জড়তা এসব।

“স্যার দেখেন, এই ছেলেটা যদি আরেকটু বেশি স্পিডে দৌড়ে এসে লাফটা দিতো – তাহলে আরো কয়েক ফুট বেশি যেতে পারতো। ই ইকুয়েল টু হাফ এম ভি স্কয়ার। এখানে ভি যদি একটু বেশি হতো …” 

ফিজিক্সের প্রতি এরকম উৎসাহ দেখে আমার খুশি হবার কথা। কিন্তু যে ছেলেটার কথা বলছে আলী আশরাফ, তার নাম আবদুর রহিম। তাকে তো নিউটনের সূত্র বুঝানোর কোন উপায় নেই। সে ক্লাস সেভেনকে এতই ভালোবেসে ফেলেছে যে ক্লাস এইটে উঠতে পারেনি। এবছর তার ক্লাস সেভেন সেকেন্ড ইয়ার চলছে। গতি জড়তার বিন্দু-বিসর্গ না জেনেও সে এত লম্বা দূরত্ব লাফ দিয়ে পার হচ্ছে। আর আলী আশরাফ গতি জড়তার সমস্ত সূত্র জানার পরেও লাফ দিয়ে এর অর্ধেকটাও পার হতে পারবে না – সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

দীর্ঘলম্ফ শেষ হলো। আমার বন্ধু আবুল হোসেন খান মাসুদ হাউজের মানুষ। তাদের হাউজ থেকে মনে হয় কেউ ফার্স্ট হচ্ছে। দীর্ঘলম্ফের রেজাল্টে সে যেভাবে উচ্চলম্ফ দিতে শুরু করেছে – বুঝতে পারছি তার উৎসাহ কোন্‌ মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। আমার হামিদ হাউজের ক্যাপ্টেন হলেন সুপাল স্যার। তিনি এসব ব্যাপারে কর্তব্যের বাইরে তেমন কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন না।

এর পরের ইভেন্ট বর্শা নিক্ষেপ। ওটা হবে মাঠের একেবারে দূরপ্রান্তে। ইলেভেনের রেজাউল করিম খুবই দক্ষ ক্রীড়াবিদ। সে বর্শা ছুড়লে মনে হয় – মাঠের এক দিক থেকে অন্য দিকে গিয়ে পড়বে। সে কোত্থেকে দৌড়ে সামনে এসে বললো – স্যার আমার হিটটা একটু দেখবেন।

আমি আলী আশরাফকে বললাম, “আশরাফ, তুমি রেজাউলকে প্রোজেক্টাইল মোশানটা ভালো করে বুঝিয়ে দাও। কীভাবে বর্শা নিক্ষেপ করলে সবচেয়ে বেশি দূরে যাবে – সেই ফিজিক্স তো তুমি জানো। এবার প্র্যাক্টিক্যালি দেখিয়ে দাও।“

“পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে মারতে হবে স্যার।“ – আশরাফ গম্ভীরভাবে বললো।

“তুই গিয়ে মার্‌ না দেখি – কতটুক নিতে পারস। দেখবি নিজের বর্শা নিজের গায়ে বিঁধে আছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে।"

ইকবালের কথায় হো হো করে হেসে উঠলো তার বন্ধুরা। দেখলাম ইকবাল, নোমান, ইরফান, আদেল, মতিন, নাসির – সবাই এসে জুটেছে। খেলাধুলায় এদের খুব দক্ষতা আছে বলে শুনিনি – কিন্তু দুষ্টুমিতে ওস্তাদ সবাই।

“স্যার, স্যার –“

দেখলাম পিয়ন ইদ্রিস ছুটতে ছুটতে আসছেন।

“কী ব্যাপার ইদ্রিস ভাই?”

“আপনাকে প্রিন্সিপাল স্যার ডাকছেন। এখনি যেতে বলেছেন।“

প্রিন্সিপাল স্যার ডাকছেন শুনলেই আমার কেমন যেন ভয় লাগে। কর্তাব্যক্তিদের ব্যাপারে আমার ফোবিয়া আছে। আবার পুকুর-পাড়ের ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে কলেজে ফেরার সময় ভাবছি – কী কারণে প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে ডাকতে পারেন। গতকাল যে আসিনি সে ব্যাপারে কি ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার অভিযোগ করেছেন? আমি তো কোন প্রতিবাদ করিনি। অ্যাবসেন্ট দিয়েছেন হিসেবে এক দিনের বেতন কাটতেই পারেন, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু এখন আবার ডেকে নিয়ে ধমক দিলে তো মুশকিল। আর কী কাজে ডাকতে পারেন? আমি কলেজের প্রশাসনিক কোন কাজের উপযুক্ত নই। তবে কি আবার স্কোয়ার্ডন লিডার সোবহান সাহেবের আগমন ঘটেছে? সোবহান সাহেবের সঙ্গে কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর কোয়ান্টাম মেথড সংক্রান্ত আলোচনার পর আর কোন যোগাযোগ হয়নি।

জোরে জোরে হেঁটে কলেজে আসতে আসতে ঘেমে গিয়েছি। চোখে-মুখে পানি দেয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকতেই গানের শব্দ কানে এলো। আমাদের বাথরুমের সাথে লাগানো প্রিন্সিপাল স্যারের বাথরুম। ভেন্টিলেটার দিয়ে ভেসে আসছে প্রিন্সিপাল স্যারের গান, “ও তোতা পাখি রে – হে হে হে – শিকল খুলে হে হেহে – উড়িয়ে দেবো হে হে হে –।“ এই গান যদি কোন তোতা পাখিকে শোনানো হয়,  শিকল খুলে দিতে হবে না, শিকল ছিঁড়ে পালাবে সে। স্যারের গানের চেয়েও গানের মাঝখানে হে হে হে – শুনে হাসি পেয়ে গেল। জোরে পানি ছেড়ে আমার হাসির শব্দ চাপা দিলাম। এখন এই গানের ব্যাপারটা পুরোটাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে। নইলে প্রিন্সিপাল  স্যারের সামনে যদি মনে পড়ে যায় এবং হাসি চলে আসে – তাহলে চাকরি থাকবে না।

প্রিন্সিপাল স্যারের দরজায় লাল বাতি জ্বলছে। মানে কী? প্রিন্সিপাল স্যার লাল বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে “ও তোতা পাখিরে” গাইছেন? যা খুশি তাই তিনি করতে পারেন তাঁর রুমে। কিন্তু লাল বাতি জ্বলন্ত অবস্থায় আমি তো উঁকি মারতে পারি না। দরজার সামনে সাধারণত টুল নিয়ে বসে থাকেন পিয়ন আবুল হোসেন। এখন তাঁকেও দেখা যাচ্ছে না। কী করি?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডানদিকে তাকালাম। দেখলাম সুচরিত স্যার বসে আছেন ম্যাডামদের কমনরুমে দরজার দিকে মুখ করে। গম্ভীরভাবে হাত নেড়ে কথা বলছেন – সম্ভবত রিফাৎ আরা ম্যাডামের সাথে। আমাকে দেখেই সুচরিত স্যার বললেন, “এই তো তিনি এসে গেছেন।“

সুচরিত স্যার বের হয়ে এলেন। তাঁর পেছনে রিফাৎ আরা ম্যাডাম ও নাসরীন বানু ম্যাডাম।

“চলেন প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে।“– গম্ভীরভাবে বললেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম।

“কী হয়েছে ম্যাডাম?”

“ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয়ের কিছু নেই। বিতর্কের চিঠি এসেছে। প্রিন্সিপাল স্যার কথা বলবেন বিতর্ক কমিটির সাথে।“– রিফাৎ আরা ম্যাডাম বললেন।

টেলিভিশন স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শাহীন কলেজ চট্টগ্রাম ইতোমধ্যে ফার্স্ট রাউন্ড ও সেকেন্ড রাউন্ডে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেছে। বিতর্কের স্ক্রিপ্ট লেখা, তার্কিকদের অনুশীলন করানো ইত্যাদি হাজারো কাজের বেশিরভাগই সামলাচ্ছেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম, নাসরীন বানু ম্যাডাম, আর সুচরিত স্যার। আমাকেও কমিটিতে রাখা হয়েছে, তবে আমি তেমন কোন কাজে আসি না।

রিফাৎ আরা ম্যাডাম প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের লালবাতিকে থোড়াই কেয়ার করে দরজার পর্দা সরিয়ে বললেন, “স্যার আসি?”

“প্লিজ আসেন।“

আমরা রুমে ঢুকলাম। প্রিন্সিপাল স্যারের টেবিলের সামনে মোট তিনটি চেয়ার আছে। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার তাঁর কর্কশ কলিংবেল টিপে অর্ডার দিলেন আরেকটি চেয়ার নিয়ে আসতে।

“আপনারা সবাই আশা করি চিঠিটি পড়েছেন। এবার আমাদের কঠিন পরীক্ষা।“ – প্রিন্সিপাল স্যার বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলছেন।

“আমরা এখন কোয়ার্টার ফাইনালে। বিতর্কের বিষয় – দরিদ্রবিশ্বে শিশুশ্রমের অধিকার দেয়া উচিত। আমাদের বলতে হবে এর পক্ষে। আর বিপক্ষে বলবে ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল। রেকর্ডিং হবে ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ।“

“আমাদের হাতে আছে মাত্র বারো দিন।“ – নাসরীন বানু ম্যাডাম বললেন।

“বিতর্কের বিষয়টা তো স্যার একেবারেই আমাদের বিপক্ষে। শিশুশ্রমের পক্ষে যুক্তি বের করা তো সহজ নয়। তাছাড়া বিপক্ষে আছে ভিকারুন্নেসা। ভয় লাগছে স্যার।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডাম বললেন।

“ভয়কে জয় করতে হবে ম্যাডাম। কী বলেন মিস্টার প্রদীপ?” – প্রিন্সিপাল স্যার প্রশ্ন করলেন।

এরকম সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দিতেই হয়। বললাম, “আমাদের তো চেষ্টা করতে হবে স্যার। অকাট্য যুক্তি প্রয়োগ করতে হবে। প্রচুর রেফারেন্স লাগবে। আর সময় যা আছে তাকে কাজে লাগাতে হবে।“

“ঠিক আছে। আপনাদের চারজনকে ফ্রি করে দিচ্ছি। আমাদের টিমকে নিয়ে এখন থেকে কাজ শুরু করে দেন।“

“রেফারেন্সের জন্য তো লাইব্রেরিতে যেতে হবে।“ – সুচরিত স্যার বললেন।

“অবশ্যই যাবেন। যা করতে হয় করবেন।“ – প্রিন্সিপাল স্যার বললেন।

প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বের হয়ে একটা খালি ক্লাসরুমে গিয়ে বসলাম। আমাদের তিনজন বিতার্কিককে ইতোমধ্যেই খবর দেয়া হয়েছে। তারা এসে গেছে। প্রথম বক্তা সৈয়দ নাজমুল কবীর, দ্বিতীয় বক্তা নাজমুস সেহার অন্তরা, আর দলনেতা তানজীবা সুলতানা রীমা। আগের দুই রাউন্ডেই রীমা শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়েছে। দলের তিনজনই আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কিন্তু এবার বিতর্কের বিষয় এবং প্রতিপক্ষ দুটোই আমাদের প্রতিকুলে। শিশুশ্রমের পক্ষে যুক্তি খুঁজে বের করা অনেক কঠিন হবে। আমাদের জোর দিতে হবে দরিদ্রবিশ্বের দিকে। প্রমাণ করতে হবে – দরিদ্র বিশ্বে শিশুশ্রমের বিকল্প এখনো নেই। তারজন্য আমাদের পরিসংখ্যান দরকার। বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের বেশিরভাগই জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী শিশু। এই শিশুদের উপার্জনে তাদের সংসার চলে।

ঠিক হলো আমি আর সুচরিত স্যার এখনই গিয়ে চট্টগ্রামে যতগুলি লাইব্রেরি আছে সবগুলিতে খোঁজ করে দরকারি তথ্য এবং উপাত্ত সংগ্রহ করবো। এদিকে রিফাৎ আরা ম্যাডাম আর নাসরীন বানু ম্যাডাম বিতার্কিকদের নিয়ে স্ক্রিপ্টের মূল পয়েন্টগুলি লিখে ফেলবেন।

“কালকে আসবেন কীভাবে কলেজে?” – রিফাৎ আরা ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করলাম।

“সকালে বেইজ থেকে গাড়ি যাবে – কথা হয়েছে। প্রতিদিন যেখান থেকে উঠেন সেখানে থাকবেন সকাল সাতটায়।“

এগারোটায় কলেজ থেকে বের হলাম আমি আর সুচরিত স্যার। মেইন গার্ডরুমের দিকে যেতে হলে অনেকবেশি হাঁটতে হবে। তার চেয়ে কাঠগড় দিয়ে গেলে সুবিধা হয়। এদিকে গ্রামের ভেতর দিয়ে কাঠগড় আসার রাস্তাটি খুবই সরু এবং ভাঙাচোরা। শাহীন কলেজের অনেক স্টুডেন্ট এদিকে মেস করেও থাকে। কাঠগড় এসে শহর এলাকার বাসে উঠলাম।

“দেখেন কী অবস্থা। যাচ্ছি কলেজের কাজে। অথচ ট্যাক্সিভাড়া পর্যন্ত দিলো না।“ -সুচরিত স্যার শহর এলাকার বাসের উপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন।

“আপনি চাইলেই তো পারতেন।“

“চাইতে হবে কেন? একটা সিস্টেম থাকবে না?”

তারপর সুচরিত স্যার তাঁর বন্ধুদের গল্প শুরু করলেন। বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানিতে তাঁর বন্ধুরা গাড়ির সুবিধা পাচ্ছে, কত কত বোনাস পাচ্ছে, লভ্যাংশ পাচ্ছে, শেয়ার পাচ্ছে এসব বললেন। টাকা-পয়সার এত যে সূক্ষ্ম মাপজোঁক আছে তা আমি জানতামই না।

নিউমার্কেটের মোড়ে আসতেই সোয়া বারোটা বেজে গেলো। এখানে নেমে মিউনিসিপাল স্কুলের সামনে দিয়ে হেঁটে রাইফেল ক্লাব পার হয়ে শহীদ মিনারের সামনে এসে পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকলাম। এই লাইব্রেরির কোথায় কী আছে আমি মোটামুটি জানি। চারতলায় রেফারেন্স সেকশানে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লেবার ল ইত্যাদি ঘাঁটাঘাঁটি করলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু জুতসই তেমন কিছুই পেলাম না। এবার কী করা যায়? তিন তলায় সমাজবিজ্ঞানের বইপত্রের তাকেও তেমন কিছু পেলাম না।

ক্ষুধা লেগেছে প্রচন্ড। কোন একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, “লাঞ্চ করে নেবেন?”

“চলেন। কোথায় যাবেন?”

“এরপর আমরা যাবো ব্রিটিশ কাউন্সিল আর মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরিতে। দুটোই এক জায়গায় – লালদিঘীর পাড়ে। ওদিকে চলেন, ওখানেই কোন রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেবো।“

“আজ বৃহস্পতিবার। আমার তো নিরামিষ।“

এরকমই কিছু একটা আশংকা করেছিলাম। আমি সর্বভূক। ফুটপাতে ইট বিছানো ইটালিয়ান হোটেল থেকে শুরু করে সামর্থ্য অনুযায়ী যে কোন জায়গায় খেতে পারি। কিন্তু সুচরিত স্যার হাতের আঙুলে গ্রহ-নক্ষত্র বেঁধে রাখা সাত্ত্বিক মানুষ। যে কোন রেস্টুরেন্টে খেতে তাঁর সমস্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। তার উপর আজ আবার বৃহস্পতিবার। শুধুমাত্র নিরামিষ রান্না হয় এমন জায়গা খুঁজতে হলে তো কোন বৈষ্ণবের আখড়ার খোঁজ করতে হয়।

“আমি বাসায় চলে যাই।“ – সুচরিত স্যার বললেন।

হায় হায়। কী বলেন তিনি। যে কাজে এসেছি – তার তো কিছুই করা হয়নি। বললাম, “কাজ শেষ না করে কীভাবে যাবেন? আপনার নিরামিষ খাবারের ভালো ব্যবস্থা আছে একটা জায়গায়। বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণের পাক। চলেন।

কে সি দে রোড লালদিঘীর কাছে গিয়ে মিশেছে সিরাজদৌল্লা রোডের সাথে। আন্দরকিল্লার দিকে যাবার সময় বাম দিকে ছোট্ট একটা গলির ভেতর নবগ্রহ বাড়ি। সেখানেই একটা রেস্টুরেন্টে নিরামিষ পাওয়া যায়। সুচরিত স্যার সারাজীবন বাসায় থেকেছেন, তাই সম্ভবত বাইরে খেতে অভ্যস্ত নন। আর আমি শহরের অলিগলি চষে বেড়াই, যেখানে খুশি খেয়ে নিই। তাই এসব চিপাগলির কোথায় কী আছে – মোটামুটি চিনি।

খাওয়ার পর ব্রিটিশ কাউন্সিলে ঢুকলাম। এখানে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ঘাঁটাঘাঁটি করলাম কিছুক্ষণ। বিতর্কে কয়েক লাইন ইংরেজি উদ্ধৃতি দিতে পারলে বক্তৃতার ওজন বাড়ে। তাই শিশুশ্রম সম্পর্কে ব্রিটিশদের নীতি কী তার কিছু নোট নেয়া হলো।

সেখান থেকে বের হয়ে পাশের গেট দিয়ে মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরিতে ঢুকলাম। এখানে বেশিরভাগ বই এত পুরনো যে হাত দিতে ভয় হয়। মনে হয় ধরলেই বইয়ের পাতাগুলি ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে। যে রুমে সংবাদপত্র আছে – সেখানে প্রচন্ড ভীড়। পাবলিক লাইব্রেরিতেও একই দশা দেখেছি। কি এক দুর্বোধ্য কারণে সংবাদের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ আমাদের জাতির।

এবার? যা চাচ্ছিলাম তার আশানুরূপ কোন তথ্য তো পেলাম না। একবার আমার নিজের বাসার বইপত্র ঘেঁটে দেখবো নাকি? সুচরিত স্যারকে বললাম, “আমার নিজের কিছু বাংলাদেশি ম্যাগাজিন আছে। একবার দেখবেন না কি – যদি কিছু পাওয়া যায়?”

“চলেন যাই।“

লালদীঘির পাড় থেকে রিকশা নিয়ে আমার বাসায় আসতে বেশিক্ষণ লাগলো না। কিন্তু সুচরিত স্যার রিকশায় উঠেই ঝিমাতে শুরু করেছেন। মনে হচ্ছিলো রিকশা থেকে পড়ে যাবেন যে কোন মুহূর্তে। নিরামিষ খাবার কি এতটাই নিদ্রাসহায়ক?

গলির মুখে রিকশা থেকে নামার সময় সুচরিত স্যার চোখ কচলে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় এলাম?”

সরু গলির ভেতর ঢুকে দেখা গেলো সারা পথজুড়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত গরুর তরল গোবর ছড়িয়ে আছে। তীব্র দুর্গন্ধে বাতাস ভারী। ভেবেছিলাম সুচরিত স্যার অ্যাবাউট টার্ন করে চলে যাবেন। কিন্তু না, মনে হচ্ছে গোবরের গন্ধটাকে তিনি গন্ধ বলেই মনে করছেন না। নাকি এখনো চোখে ঘুমের ঘোর লেগে আছে জানি না।

বাসায় এসে পুরনো বিচিত্রা ঘেঁটে বাংলাদেশের শিশুশ্রম সম্পর্কে অনেক তথ্য ও উপাত্ত পাওয়া গেল। মনে হচ্ছে অন্য কোথাও না গিয়ে সরাসরি নিজের বাসায় চলে এলেই হতো। খুশি হয়ে সুচরিত স্যারকে একটা সংখ্যা দেখাতেই তিনি সেটা হাতে নিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তাঁর নাসিকা-গর্জনের শব্দ শোনা গেল।

শিশুশ্রমের পক্ষে বিপক্ষে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেল। এখন এগুলোকে কাজে লাগিয়ে স্ক্রিপ্ট রেডি করতে পারলেই হলো। প্রায় দু’ঘন্টা পর পাঁচটার দিকে মশার কামড় খেয়ে জেগে গেলেন সুচরিত স্যার।

“ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।“

“হ্যাঁ। আরো কিছুক্ষণ ঘুমাবেন নাকি?”

“না। টিউশনিতে যেতে হবে।“

“আমি বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করেছি। এগুলি কি আপনি নিয়ে যাবেন, নাকি আমি নিয়ে যাবো?”

“না, আমাকে দেন। আমি দেখি টিউশনি সেরে রিফাৎ আপার বাসায় গিয়ে স্ক্রিপ্টটা রেডি করতে পারি কি না। আর আপনার হকিং এর বইটা আমাকে দেন। একটু পড়ে দেখি।“

আমার বুকশেল্‌ফ থেকে স্টিফেন হকিং এর ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইটা টেনে নিলেন সুচরিত স্যার।

“এইটা তো ফটোকপি মনে হচ্ছে।“

“মূল বই কেনার সামর্থ্য কোথায় বলুন। মূল বইয়ের দাম আঠারো শ টাকা। আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে মূল বইটা নিয়ে ফটোকপি করিয়েছি দুইশ টাকায়।“

“বাংলা অনুবাদও তো আছে দেখছি। বাংলা ইংরেজি দুটোই নিয়ে যাচ্ছি। পড়া হয়ে গেলে ফেরত দিয়ে দেবো।“

“আপনাকে কি এগিয়ে দিয়ে আসবো?”

“না, দরকার নেই। যেই জায়গায় বাসা নিয়েছেন, খুন করে এসে এখানে লুকিয়ে থাকলেও কেউ খুঁজে পাবে না।“

“একটু চা খেয়ে যাবেন না কি?”

“খেলে মন্দ হয় না। বানাবেন?”

“না, বাসায় চা বানানোর ব্যবস্থা নেই। দোকানে যেতে হবে। গলির মুখেই চায়ের দোকান। ভালো চা বানায়।“

“না, না” – প্রায় আঁৎকে উঠলেন সুচরিত স্যার। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজ বৃহস্পতিবার। তাঁর চা-ও নিশ্চয় খুব সাত্ত্বিক নিরামিষ চা হতে হবে আজ।

সুচরিত স্যার আমার বইদুটো আর সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চলে গেলেন।

>>>>>>>> 

গুলজার সিনেমার সামনে রিকশা থেকে নেমেই দেখলাম ছোলাইমান স্যার, লাইলুন্নাহার ম্যাডাম আর রিফাৎ আরা ম্যাডাম কথা বলছেন। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ম্যাডামের দুই মেয়ে রেহনুমা ও সানজিদা। আমাকে দেখেই রিফাৎ আরা ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “গতকাল কিছু জোগাড় করতে পেরেছিলেন?”

“সব তো সুচরিত স্যারকে দিয়ে দিয়েছি গতকাল। তিনি তো রাতেই আপনার বাসায় গিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখবেন বলেছেন আমাকে।“

“কই তিনি তো বাসায় আসেননি।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডাম কিছুটা অবাক হলেন।

“হয়তো আজ পিকনিকে নিয়ে যাবে।“ – ছোলাইমান স্যার বললেন।

গতবছরও পিকনিকে গিয়ে বিতর্কের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম। এবছরও একই ঘটনা ঘটতে চলেছে।

একটা মিনিবাস এলো কিছুক্ষণ পর। তবুও ভালো – বেইজ থেকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা গেছে। গাড়িতে উঠে সংযুক্তা ম্যাডাম, আইভী ম্যাডাম, বিমল স্যার, সুপাল স্যার – সবাইকে দেখলাম। কিন্তু সুচরিত স্যার নেই। আন্দরকিল্লা থেকেই তাঁর ওঠার কথা।

 রিফাৎ আরা ম্যাডাম বেশ হতাশ হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সুচরিত তো এলেন না। এখন উপায়?”

পরের পর্ব>>>>>>>>> 

<<<<<<<<<< আগের পর্ব

Saturday 23 May 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৩১

31


“প্রদীপ, তোমারে আমি খুচতেছি একটা কতা বলার জইন্য – “
টিচার্স রুমে ঢুকে আমার সামনের চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন নাসির স্যার।
“আরে বস বস। দারাইতে হবে না।” – হাসিমুখে বললেন তিনি। ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে টিচার্স রুম থেকে পাশের ছোট্ট অফিসে চলে যাওয়ার পর নাসির স্যার আমাদের টিচার্স রুমে খুব একটা আসেন না। অবশ্য ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়ার আগেও তাঁকে বেশিক্ষণ টিচার্স রুমে দেখিনি কোনদিন। হয় ক্লাস নিচ্ছেন, নইলে প্রিন্সিপালের রুমে কাজ করছেন। আজ হঠাৎ এই রুমে তাঁকে দেখে একটু অবাক লাগছে।
“তুমি ত এইবারের ফাস্টিয়ারের ক্লাসটিছার।“
“জ্বি স্যার।“
“কোন সেকশান? ইউরেনাস?”
“না স্যার। ইউরেনাসের ক্লাস টিচার রিফাৎ আরা ম্যাডাম।“
“অ, ওই সেকশানে তো মেয়েরা।“
“আমি প্লুটো সেকশানের।“
“নেপচুনের ক্লাস টিচার কে?”
“সুচরিত স্যার।“
“সুচরিত কোথায়?”
“সম্ভবত রিহার্সাল করছেন সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্টদের সাথে।“
“আচ্ছা। তোমারে যেই কতা বলতেছিলাম – আচ ত সেকেনিয়ারের ছেলেমেয়েরা নবীন বরণ করতেচে। তুমি তোমার সেকশানের ছেলেদের নিয়া আর-টি-এস-এ চলি যাইবা ঠিক এগারটা বাযার সাতে সাতে। সুচরিত মনে হয় বিজি তাকবে। তুমি তার সেকশানের ছেলেদেরও নিয়া যাইবা। কেউ যেন কোন গন্ডগোল করার সুযোগ না পায়।“
নাসির স্যার কথা শেষ করতে না করতেই পিয়ন কাশেম এসে বললেন, “স্যারকে প্রিন্সিপাল স্যার ডাকতেছেন।“
নাসির স্যার দ্রুত চলে গেলেন।
ফার্স্ট ইয়ারের নবীন বরণ আজ। এতগুলো ছেলেকে সাথে নিয়ে যেতে হবে আর-টি-এস এর অডিটরিয়ামে। কলেজ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হবে মনে হয় দূরত্ব। সকালে বাসে করে গার্ডরুম দিয়ে আসার সময় হাতের বাম দিকে রিক্রুটমেন্ট ট্রেনিং সেন্টার – বা আর-টি-এস। অনেকগুলি বড় বড় বিল্ডিং দেখা যায় সেখানে। এক বিল্ডিং এর গায়ে লেখা আছে ঈগল, আরেক বিল্ডিং এর গায়ে লেখা ফ্যালকন। নতুন যোগ দেয়া এয়ারম্যানদের ট্রেনিং দেয়া হয় সেখানে। প্রতিদিন সকালে দেখা যায় সবাই দৌড়াচ্ছে সামনের মাঠে। কত রকমের শারীরিক কসরৎ যে করতে হয় তাদের। ওখানে আগে কখনো যাইনি। এতগুলো ছেলেকে এখান থেকে ওখানে আমি কীভাবে নিয়ে যাবো? ওদেরকে স্বাধীনভাবে যেতে বলে দিলে তো ওরা যে যার মতো চলে যাবে।
সাঈদ স্যারকে বলতে হবে ব্যবস্থা করার জন্য। তিনি এসব ব্যাপারে খুবই দক্ষ মানুষ। কিংবা শংকর স্যারকে বললে হবে। জোরালো হুইসেল দিয়ে সব ঠিক করে ফেলবে। তবুও আমার সেকশানের ছেলেদের একটু হুসিয়ার করে দেয়া দরকার – যেন কোন গন্ডগোল না করে। কলেজ থেকে অন্য একটা জায়গায় এতগুলি ছেলে যাবে – গন্ডগোল বাধালে তো আমাকেই অনেক জবাবদিহি করতে হবে। শুনেছি সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেরা নাকি সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়ে মারপিট করেছে। তারজন্য তাদের ক্লাসটিচারের অনেক ভোগান্তি গেছে।
শংকর স্যারের সাথে পরামর্শ করলাম – কী করা যায়। তিনি বললেন, “কোন ব্যাপারই না। সব আমার উপর ছেড়ে দেন। এখান থেকে লাইন করে দেবো। লাইন ধরে সবাই চলে যাবে আর-টি-এস। কেউ লাইন ভাঙলে আমি তাদের হাড্ডি ভেঙে দেবো।“
এ তো দেখি আরেক যন্ত্রণা। লাইন ভাঙলেই যদি হাড্ডি ভেঙে দেন – তাহলে কীভাবে হবে? এত দূর পথ, হেঁটে হেঁটে যাবে – এটা কোন কথা? এত বড় প্রতিষ্ঠান, কয়েকটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারবে না এখান থেকে আর-টি-এস এ যাবার জন্য?
ছোলাইমান স্যারকে বলে দেখা যাক। তিনি তো আর্টসের ক্লাস টিচার।
“সেই আশা কইরেন না এখানে। আপনার ক্লাসে যদি কোন সিনিয়র অফিসারের ছেলে থাকে – তাহলে সে হয়তো তার আব্বাকে বলে কিছু করতে পারবে। নইলে গাড়ি কেন, একটা রিকশাও পাবেন না আপনি। হেঁটে হেঁটেই যাবেন।“ – ছোলাইমান স্যার বেশ বিরক্ত হয়েছেন বুঝা যাচ্ছে।
“আমি তো আমার জন্য বলছি না, স্টুডেন্টদের জন্য বলছি।“
“স্টুডেন্টদের জন্য এত দরদ দেখাইয়েন না। যত বেশি দরদ দেখাইবেন, তত বেশি ঝামেলায় পড়বেন।“
সিনিয়রদের এই ফিলোসফি আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জন্য দরদ না দেখালে কে দেখাবে? শিক্ষকের মূল কাজ কী? শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ সুবিধা-অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখা কি শিক্ষকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?

এগারোটা বাজার সাথে সাথে কলেজের সব ছেলেমেয়েকে গেটের বাইরে জড়ো করা হলো। শংকর স্যার হুইসেল বাজিয়ে লাইন ঠিক করলেন। ফার্স্ট ইয়ারের সব ছেলে-মেয়ে ইউনিফর্ম পরে এসেছে। নবীন বরণ তাদের সবচেয়ে আনন্দের অনুষ্ঠান। আজ তাদের যেমন খুশি তেমন পোশাক পরে আসার স্বাধীনতা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সেই স্বাধীনতা তাদের দিচ্ছে কে?
শংকর স্যার আর সাঈদ স্যারের নেতৃত্বে প্রচুর হুইসেলের শব্দ হলো, হ্যান্ড-মাইকে নির্দেশ দেয়া হলো – কেউ যেন লাইন ভঙ্গ না করে। তারপর লাইন ধরে ছেলেমেয়েরা এগিয়ে চললো।
অঞ্জন স্যার, ছোলাইমান স্যার, আলী হায়দার স্যার, সুপাল স্যার, বিমল স্যার, ফারুকী স্যারের পেছনে আমি আর আবুল হোসেন খান কথা বলতে বলতে যাচ্ছি।
আর-টি-এস ভবনে ঢুকার মুখে আবুল হোসেন বললো, “দোস্ত, আমার একটা কাজ আছে। আমি কিছুক্ষণ পর উধাও হয়ে যাবো।“
আবুল হোসেনের বাসা ঘাঁটির ভেতর। এদিক থেকে কাছেই হবে সম্ভবত। ঘাঁটির ভেতর ইতোমধ্যেই তার যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে উঠেছে। অনেক অফিসারের ছেলে-মেয়েদের সে পড়ায়। আর-টি-এস অডিটরিয়ামে ঢুকার পর তাকে আর দেখলাম না।

বিশাল অডিটরিয়াম। মূল রাস্তা থেকে এদিকের রাস্তার দুপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। কত্তো বড় বড় সাইজের হলুদ গাঁদা ফুটে আছে। বেশ কিছু নারকেল গাছ আছে এদিকে। সবগুলো গাছের গোড়ার দিকটা সাদা চুনকাম করা। এখানকার গাছের চুনকাম করার জন্যও নিশ্চয় অনেক টাকা বরাদ্দ থাকে।
প্রিন্সিপাল স্যার, ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এবং অন্যান্য ম্যাডামরা এখনো এসে পৌঁছাননি। তাঁরা নিশ্চয় হেঁটে আসবেন না। তাঁরা না এলে অনুষ্ঠান শুরু হবে না। ছাত্র-ছাত্রীরা বসে গেছে নিজেদের পছন্দের আসনে। ছাত্রীরা সামনের দিকে বসেছে। শিক্ষকরা বসে থাকতে পারবেন কি না এখনো জানি না। কারণ আমাদের বলা হয়েছে ছাত্রদের সারির মাঝখানে থেকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
দেখলাম আমার সেকশানের বনকুসুমের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন ছেলে একেবারে পেছনের দিকে বসেছে। মনে হচ্ছে ব্যান্ডের গানের তালে তালে নাচবে। শাহীন কলেজের অনুষ্ঠানে নাকি ব্যান্ড আনার অনুমতি পাওয়া অসাধ্য ব্যাপার। এবারের সেকেন্ড ইয়ারের ছেলে-মেয়েরা এই অসাধ্য-সাধন কীভাবে করলো কে জানে। তারা একটা ব্যান্ড নিয়ে এসেছে। ব্যান্ডের নাম কী ঠিক জানি না। স্টেজে ড্রাম গিটার ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র দেখা যাচ্ছে। ড্রামের গায়ে ইংরেজিতে লেখা আছে পার্ল। পার্ল কি কোন ব্যান্ডের নাম, নাকি ড্রামের ব্রান্ডের নাম – জানি না। সেকেন্ড ইয়ারের কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। কিন্তু আয়োজকরা সব নিশ্চয় ভেতরে ব্যস্ত। স্টেজের উপর কয়েকজনকে ব্যস্তভাবে ঘুরাফিরা করতে দেখা যাচ্ছে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো টাই – অদ্ভুত একটা গাম্ভীর্য এনে দিয়েছে তাদের মধ্যে।
খুব সুন্দর করে স্টেজ সাজিয়েছে। পেছনের সাদা পর্দায় সুন্দর নকশা করা কাগজের ফুল-পাখি। মনে হচ্ছে দু-পাশ থেকে দুটো পাখি ঠোঁট দিয়ে ধরে রেখেছে কাগজের ফুলের মালা। তার উপরে লেখা “স্বাগতম হে নবীণ, নবীণ বরণ ‘৯৪”। একটু খটকা লাগছে। নবীনের দুটো ন-ই তো “ন” হবার কথা। এরা “ণ” দিয়ে কেন লিখেছে? বাংলার শিক্ষকদের উপর কি এরা কোন কারণে রেগে আছে? হয়তো বানান ভুল লিখে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। বানান ভুল দেখলে অনেকের গাত্রদাহ হয়। হয়তো রিফাৎ আরা ম্যাডাম বা নাসরীন বানু ম্যাডামকে রাগিয়ে দেয়ার জন্য এরা ‘নবীন’কে ‘নবীণ’ লিখেছে। নাকি এটাই এখন শুদ্ধ বানান?
সাড়ে এগারোটা বাজতে আরো কিছুক্ষণ বাকি আছে। একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা যায়। এখানে আবার কখন আসার সুযোগ হবে জানি না। পাশের দরজা দিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। এদিক দিয়ে স্টেজে ঢোকার একটা দরজা দেখতে পাচ্ছি। বারান্দা থেকে কয়েক ধাপের একটা সিঁড়ি সেই দরজার সাথে লাগানো। সিড়িতে বসে আছে চার-পাঁচজন মেয়ে। সবার পরনে শাড়ি, বেশ সেজেছেও। আরেকজন সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। বারান্দা থেকে সামনের ফুলের বাগান দেখা যাচ্ছে। কত রকমের উজ্জ্বল মৌসুমী ফুল ফুটে আছে ওখানে। আমি ওসব ফুলের নামও জানি না। এত সুন্দর বাগান থাকতে এরা সিঁড়িতে বসে ছবি তুলছে কেন?
“স্যার” –
পরিচিত কন্ঠের ডাক শুনে ফিরে তাকালাম। সিঁড়িতে বসা মেয়েদের একজন উঠে দাঁড়িয়েছে। গুলশান। শাড়ির কারণে কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে।
‘চিঠি পেয়েছেন?” হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো সে।
চিঠি? আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা আমার। কোন্‌ চিঠির কথা বলছে সে? আমি বুঝতে পারছি না বুঝতে পেরেছে সে। তার সঙ্গীরা মুখ টিপে হাসছে।
যথাসম্ভব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “কিসের চিঠি?”
“অনন্যার চিঠি আসেনি?”
“কোন্‌ অনন্যা?”
“অনন্যা, যাকে আপনি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখেছেন।“ – হাসছে সে। সাথে তার সাথীরাও।
বুঝতে পারলাম কিসের কথা বলছে। খাল কেটে কুমির আমিই এনেছি। একটি অত্যন্ত কাঁচা প্রেমের গল্প লিখেছি। যায় যায় দিন ম্যাগাজিন সেই গল্প ছাপিয়েছে কয়েকদিন আগে। উত্তম পুরুষে লেখা সেই গল্পের অনন্যাকে চিঠি লেখার কথা আছে সেখানে। আর এই ফাজিল সেই গল্পটা পড়েছে। এখন সেটা নিয়ে কথা বলছে আহ্লাদে আটখানা হয়ে। কৈ, আমি যে পত্রিকায় মাঝে মাঝে বিজ্ঞান বিষয়েও কিছু লিখি সেগুলি তো তোদের হাতে তুলে দিলেও পড়ে দেখিস না।
প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য জিজ্ঞেস করলাম, “নবীন বানান কি দন্ত্য-ন, না মূর্ধন্য ণ?”
“কেন স্যার?”
“স্টেজে নবীন বানান ভুল লিখেছো। দেখো গিয়ে।“
বলে দ্রূত হলের ভেতর ঢুকে গেলাম।

নবীন বরণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে উঠে কেন এত উপদেশ দেন কে জানে। এধরনের অনুষ্ঠানে কেউই চায় না উপদেশ শুনতে। সবাই চায় গান বাজনা হৈ চৈ আনন্দ। উপদেশ-মূলক বক্তৃতা শেষ হবার পর যে জোরে হাততালি স্টুডেন্টরা দিল – সেটা বক্তৃতা ভালো হয়েছে বলে দেয়নি, দিয়েছে বক্তৃতা শেষ হলো বলে। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা বেশ কিছু ভালো গান গাইলো। সুচরিত স্যার তবলা বাজালেন। কত গুণে যে গুণী এই মানুষটা।

ব্যান্ডের গান শুরু হলো। ব্যান্ডের গান চলবে, আর ছেলে-মেয়েরা চুপচাপ শান্তি-নিকেতনী কায়দায় বসে শুধু মাথা নাড়বে – সেটা তো হবার নয়। তারা নাচবে এটাই স্বাভাবিক। যা ভেবেছিলাম তাই – বনকুসুমের নেতৃত্বে পেছনের সারির দশ বারোজন নাচতে শুরু করলো। ক্রমে সেটা সংক্রমিত হলো পেছন থেকে সামনের দিকে। ছাত্ররা শুধু নিজেরা নেচে সন্তুষ্ট নয়। তাদের সাথে শিক্ষকদেরও যদি নাচাতে পারে – তাহলেই তাদের আনন্দ বেড়ে যায় অনেকগুণ। নাচ হলো অনেকটা ফিজিক্সের ফোর্সড রেজোনেন্সের মত। আশেপাশের মানুষ নাচতে থাকলে নিজের ভেতরও একটা তাল তৈরি হয়। মনটা আগে নেচে উঠে, তারপর শরীর যোগ দেয়।
একটু পরেই দেখা গেলো আমি আর আলী হায়দারও নাচতে শুরু করেছি ছেলেদের সাথে। আমি ভুলেই গিয়েছি যে নাসির স্যার আমাকে বলে দিয়েছেন – ছেলেরা যেন গন্ডগোল না করে। এখন নাসির স্যার সামনের সারি থেকে যদি উঠে আসেন, দেখবেন আমিই গন্ডগোল করছি সবচেয়ে বেশি।
একটা উদ্দাম গান শেষ হবার পর আরেকটার প্রাথমিক সূর বাজছে। সেই সময় সাঈদ স্যার স্টেজে উঠে  মাইকে মুখ লাগিয়ে বললেন, “ছাত্র-ছাত্রীরা শোন, এখন বাজে একটা বিশ মিনিট। আর ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে তোমাদের অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে।“
“না স্যার, না স্যার, না স্যার …” – চিৎকার করে উঠলো হলের সব ছাত্রছাত্রী।
সাঈদ স্যার আর কিছু না বলে স্টেজ থেকে নেমে গেলেন। সেকেন্ড ইয়ারের বিদায় অনুষ্ঠান সাঈদ স্যার দেড়টা বাজার সাথে সাথে মাইক বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এবারেও কি তাই করবেন? এবার তো ফুল ব্যান্ড এসেছে। এত বড় হল। ছেলেমেয়েরা যদি একটা দিন আনন্দ করতে চায় – করুক না। এতটা নিষ্ঠুর তিনি নিশ্চয় হবেন না। কিন্তু না – পরবর্তী দশ মিনিট মনে হলো দশ সেকেন্ডে শেষ হয়ে গেলো। তুমুল একটা গান জমে উঠেছে, ছাত্র-ছাত্রীরা গলা মিলিয়ে প্রাণ খুলে গাইছে গায়কের সাথে, নাচছে সবাই মনের আনন্দে – সেই সময় হঠাৎ স্টেজে উঠে মাইক বন্ধ করে দিলেন সাঈদ স্যার। কয়েক মিনিট পরে গানটা শেষ হলেও এই কাজটা করা যেতো। শৃঙ্খলা আর নিষ্ঠুরতা তো সমার্থক হতে পারে না। এমন চমৎকার একটা আনন্দ-আয়োজন শুধুমাত্র ঠিকভাবে শেষ করতে না দেবার ফলে বিষাদে পরিণত হলো।


>>>>>>>>>>>


“লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান” –
প্রিন্সিপাল স্যারকে আজ অনেক বেশি খুশি খুশি লাগছে। সকালে কলেজে এসেই শুনেছি – আজ বিশেষ মিটিং আছে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে। আমরা সবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি প্রিন্সিপাল স্যারের টেবিলের সামনে। তিনি চেয়ারে আরাম করে বসে লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান বলে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন একে একে। তারপর ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাডাম রিফাৎ আরা আসেননি?”
“না স্যার। তাঁর জ্বর।“ – আইভি ম্যাডাম আর পূর্ণিমা ম্যাডাম প্রায় একসাথে উত্তর দিলেন।
নাসরীন ম্যাডাম বললেন, “তিনি গতকালই বলেছিলেন জ্বরজ্বর লাগছিলো। এখন অনেক জ্বর।“
পূর্ণিমা ম্যাডাম আবার বললেন, “হ্যাঁ, কালকে আমাকেও বলেছিলেন। এখন তো প্রচন্ড জ্বর।“
রিফাৎ আরা ম্যাডামের জ্বর সংক্রান্ত আলোচনার ডালপালা গজাতে শুরু করেছে। কিন্তু এত তথ্য ইনারা কীভাবে পেলেন কে জানে। আজ সকালে বাস স্টপে এসে দেখলাম রেহনুমা দাঁড়িয়ে আছে লাইলুন্নাহার ম্যাডামের সাথে। রিফাৎ আরা ম্যাডাম আসেননি। রেহনুমাকে জিজ্ঞেস করার পর বললো, “আম্মুর জ্বর।“
“তুমি কীভাবে এসেছো?”
“আব্বুর সাথে।“
রেহনুমা বাসে উঠার সময়েই আইভি ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “আম্মু কোথায়?”
“আম্মুর জ্বর ম্যাডাম।“
দেওয়ান হাট থেকে মেহেরুন্নেসা ম্যাডাম উঠে এদিক ওদিক তাকিয়ে আইভি ম্যাডামের পাশে বসেই ঘাড় ফিরিয়ে রেহনুমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আম্মু কোথায়?”
“আম্মুর জ্বর ম্যাডাম।“
আগ্রাবাদ থেকে ইভা উঠলো। বসলো আমার সামনের সারিতে রেহনুমার পাশে। একটু পর সেও জিজ্ঞেস করলো, “রেহনুমা, আজ রিফাৎ আপা কোথায়?”
“আম্মুর জ্বর ম্যাডাম।“
কাস্টমস থেকে উঠলেন নাসরীন বানু ম্যাডাম। তিনি ইভার সামনের সারিতে বসে পেছনে ফিরে রেহনুমার দিকে তাকিয়ে কোন প্রশ্ন করার আগেই রেহনুমা বললো, “আম্মুর জ্বর ম্যাডাম।“
এই হলো মূল তথ্য। সহকর্মীদের কাছে রিফাৎ আরা ম্যাডাম যে কত প্রিয় তা তাঁকে নিয়ে এঁদের উৎকন্ঠা দেখলেই বোঝা যায়।
প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “সো সরি টু হিয়ার দ্যাট। আই উইশ হার এ কুইক রিকভারি। তিনি আজ এখানে থাকলে ভালো হতো। এনিওয়ে। আমি আজ আপনাদের ডেকেছি সুখবর দেয়ার জন্য। আপনারা জানেন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এখনো কোন প্রমোশন হয়নি কারো। আমি অনেকদিন থেকে চেষ্টা করে আসছিলাম। আমার চেষ্টা সফল হয়েছে। আজ আই এম প্রাউড টু সে দ্যাট সিক্স অব আওয়ার লেকচারার্স হ্যাভ বিন প্রমোটেড টু অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরস।“ প্রিন্সিপাল স্যার এত দ্রুত ইংরেজি বলেন যে তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে আমার মস্তিষ্ক তা বাংলায় অনুবাদ করতে হিমসিম খায়।

 প্রিন্সিপাল স্যার মনে হয় বুঝতে পেরেছেন আমার অবস্থা। তিনি আবার বাংলায় বললেন, “আমাদের ছয়জন লেকচারার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।“
সবার ভেতর উৎসুক্য দেখা গেল। এই ছয় জন কে কে জানার জন্য। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের প্রাইভেট কলেজে মোট শিক্ষকদের মধ্যে কতজন সহকারী অধ্যাপক হতে পারবেন, তার সংখ্যা নাকি সীমিত। তাই যোগ্যতা থাকলেও সবাই সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না। শাহীন কলেজে এখনো পর্যন্ত শুধু একজন সহকারী অধ্যাপক আছেন। তিনি ভূগোলের শিরিন ম্যাডাম। আজ ছয় জন সহকারী অধ্যাপক হলেন। প্রিন্সিপাল স্যার তাঁদের নাম বললেন, মিস্টার নাসিরউদ্দিন – ভাইস প্রিন্সিপাল এডমিন, মিস্টার আবু সাঈদ - ইতিহাস, মিস্টার মহিউদ্দিন - আরবি, মিস্টার আবদুস সোবহান ফারুকী - গণিত, মিস্টার বিমল চক্রবর্তী – গণিত, এবং মিসেস রিফাৎ আরা – বাংলা।

সহকর্মীদের পদোন্নতিতে আমার খুবই আনন্দ হলো। আমি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলাম। কিন্তু সবাই যতটা খুশি হবেন বলে ভেবেছিলাম দেখা গেলো – ঠিক সেরকম হলো না। কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটলো। মিটিং শেষ হলো। আমি একে একে সব সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত স্যারদের অভিনন্দন জানালাম।

আমাদের টিচার্স রুমে এখন চারজন সহকারী অধ্যাপক। মহিউদ্দিন স্যারকে অভিনন্দন জানানোর পর তিনি একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।

দেখলাম সুপাল স্যার ভীষণ গম্ভীর হয়ে আছেন। সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্তরা রুম থেকে বের হয়ে সম্ভবত প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে গেলেন। এই ফাঁকে মুখ খুললেন ছোলাইমান স্যার। বললেন, বিষয়ভিত্তিক প্রমোশন হওয়া উচিত ছিল।
সুপাল স্যার বললেন, “ম্যাথম্যাটিক্সে দুজনকেই দেয়া হলো। কোন্‌ ক্রাইটেরিয়াতে এই প্রমোশন হলো কে জানে।“
মনে হচ্ছে কারো কারো ভেতর এই চাপা অসন্তোষ আরো কিছুদিন থাকবে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে যাবার সময় ল্যাবে উঠার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে দিলরুবা ম্যাডাম আর সুপাল স্যার আমাকেই বললেন, “এটা কোন ন্যায্য কাজ হলো? ছয় জনের মধ্যে চার জনই আর্টসের? বায়োলজি, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স এগুলো হলো আসল সাবজেক্ট। সেখান থেকে একজনও নেই?”
এই প্রশ্নটা আমাকে করার উদ্দেশ্য এই নয় যে আমাকেই প্রশ্নটার উত্তর দিতে হবে, কিংবা আদৌ কোন উত্তর আশা করছেন আমার কাছ থেকে। এই প্রশ্ন হলো ক্ষোভের বহিপ্রকাশ। এই ক্ষোভ স্বাভাবিক। নিজেকে বঞ্চিত মনে করলেই মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম হয়।
ছুটির পর জানা গেল – শ্রমিকরা নাকি কোথায় গন্ডগোল করেছে – তাই বাস আসবে না আজ। নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। লাইলুন্নাহার ম্যাডাম এলেন রেহনুমাকে সাথে নিয়ে। বললেন, “আজ বাশ আসবে না। চলেন ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই।“
“চলেন যাই।“
বেরিয়ে পড়লাম। কলেজ থেকে এদিকের গার্ড রুম কাছে। গার্ডরুম পার হয়ে ভেতরের রাস্তা দিয়ে কাঠগড়ে যাওয়া যায়। রাস্তাটা খুব সরু এবং ভাঙাচোরা। রিকশা ছাড়া তেমন কিছু চলে না এদিকে। মাঝে মাঝে বেবিট্যাক্সি দেখা যায়। কিন্তু আজ একটাও নেই। রিকশায় উঠলাম তিনজন। কাঠগড় এসে বেবিট্যাক্সি পেতে সমস্যা হলো না।
পথে কোথাও কোন শ্রমিক অসন্তোষ চোখে পড়লো না। বাস ট্রাক সবই চলছে। তাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। যেন শুধুমাত্র বিমান বাহিনীর গাড়ি দেখলেই শ্রমিকরা ঝাঁপিয়ে পড়বে! যাঁরা ঘাঁটি থেকে নিয়মিত শহরে আসা-যাওয়া করে তাদের সবাইকে আজ অনেক কষ্ট করে আসতে হবে।
“চলেন, রিফাৎ আপার বাসায় যাই।“ – চকবাজার আসার একটু আগে লাইলুন্নাহার ম্যাডাম বললেন। আমি ট্যাক্সি তো রিফাৎ আরা ম্যাডামের বাসা পর্যন্ত ঠিক করেছি। রেহনুমাকে তো বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। বললাম, “চলেন, যাই।“
আমরা দোতলা পর্যন্ত উঠার আগেই রেহনুমা চারতলায় উঠে বাসায় ঢুকে গেছে। আমরা চারতলায় উঠে দেখি দরজা খুলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম।
“আসেন আসেন।“
লাইলুন্নাহার ম্যাডাম রিফাৎ আরা ম্যাডামকে অভিনন্দন জানালেন। দুই ম্যাডাম হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন। আমি তাঁদের অনুসরণ করলাম।
এই বাসাটার মধ্যে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা আছে। কোথাও কোন বাহুল্য নেই, অথচ কত অসাধারণভাবে সম্পূর্ণ।

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৩০

30

“ইস্‌ দুইটা ব্যাজে গেচে। আচকে বাছে ভির হবে।“
ছোলাইমান স্যার তাঁর কবজির সোনালী ঘড়িটার ডায়াল থেকে অদৃশ্য ধূলি ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্ত মুখে বললেন। কলেজের গেটের কাছে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ থেকে। এক বছর ধরে বিমান বাহিনীর এই বাসে আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি ছোলাইমান স্যারের কথা ঠিক। তাঁর অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর পাশে দাঁড়ানো বিমল স্যার, অঞ্জন স্যার ও সুপাল স্যার। সুচরিত স্যার একটু দূরে দাঁড়িয়ে নাসরীন বানু ম্যাডাম আর রিফাৎ আরা ম্যাডামের সাথে কথা বলছেন। রিফাৎ আরা ম্যাডামও এখন এই বাসের যাত্রী। তিনি এখন শহরে বাসা নিয়েছেন।
“অ্যাই অঞ্জনবাবু, এবার কি কলেজে কোন গাড়িওয়ালা ছেলে-মেয়ে ভর্তি হয় নাই?” – বিমল স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
“হয় নাই মনে হয়। হইলে কি আর অঞ্জনবাবু এতক্ষণ এখানে থাকতেন? ছেলেদের গাড়িতে করে কত আগেই চলে যেতেন।” – ছোলাইমান স্যার বললেন।
“না বিমলদা, এখনো কাউকে পাইনি।“ – অঞ্জন স্যার হাসিমুখে বললেন।
অঞ্জন স্যার খুব ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। তাঁকে উত্তেজিত হতে আমি কখনো দেখিনি। ছোলাইমান স্যার অনেকসময় তাঁকে খোঁচাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অঞ্জন স্যার দক্ষ রাজনীতিবিদের মত ঠান্ডা মাথায় তার জবাব দেন। আজও হাসিমুখে বললেন, “ছোলাইমান ভাই, স্টুডেন্টদের গাড়িতে কি আমি একা চড়ি? আমি কি আপনাকে অনেকবার নিয়ে যাইনি গাড়িতে করে?”
“বাইদ্য হয়ে নিয়ে গেচেন আর কি।“
স্যারদের কথোপথন শুনতে বেশ মজা লাগছে। অঞ্জন স্যারের বেশ কয়েকজন মোটা মোটা ছাত্র আছে। তাঁর মুখে শুনেছি প্রিন্সিপাল স্যার নাকি ওদের নাম দিয়েছেন – ‘অঞ্জন স্যারের হাতি’। বড় বড় গাড়ি নিয়ে তারা আসে। ছুটির পর স্যারদের লিফ্‌টও দেয়। স্কুল সেকশানের বার্ষিক পরীক্ষা, রেজাল্ট সব হয়ে গেছে। জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হলে তাদের এবং তাদের গাড়ির আগমন ঘটবে আবার।
সোয়া দুটোর দিকে বাস এলো। যেমন ভেবেছিলাম – প্রচন্ড ভীড় বাসে। শিক্ষকদের জন্য যে কয়টি সিট খালি থাকার কথা সেগুলোতেও বসে গেছেন অনেকে। ম্যাডামদের জন্য জায়গা খালি করে দিলো কয়েকজন। কিন্তু স্যারদের বসতে হলো বিভিন্ন সিটে। আমি সবার পেছনে উঠেছি। একেবারে পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম কোনরকমে। এরকম বসার চেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া অনেক আরামের। কিন্তু এই বাসে দাঁড়িয়ে যাবার নিয়ম নেই। কেউ দাঁড়ালেই সামনের দিক থেকে একজন লিকলিকে সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে দাঁত কটমট করে হুকুম দেন, “অ্যাই এডজাস্ট করে বসেন।“
একেবারে সামনের সারির তিনটি সিটই খালি। গার্ড-রুম থেকে অফিসার উঠে বসবেন সেখানে। একজন অফিসার তিনজনের সিটে আধ-শোয়া হয়ে বসবেন। তবুও নন্‌-অফিসার কেউ সেখানে গিয়ে বসতে পারবেন না।
ঝড়ের বেগে বাস ছুটলো। রাফ ড্রাইভিং-এ জুড়ি নেই এই চালকের। কয়েক সেকেন্ডেই চলে এলো গার্ডরুমে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পরও কোন অফিসার উঠলেন না। নন-অফিসারের সর্দারেরা খুশি হয়ে অফিসারের সিটে গিয়ে বসলেন। গাড়ি এক টানে রাস্তায় উঠে যেতো – কিন্তু হঠাৎ হার্ড ব্রেক কষে থেমে গেলো। গতি জড়তার কারণে আরেকটু হলেই সামনে ছিটকে পড়তাম। প্রভোস্ট হুইসেল বাজিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। রিভার্স গিয়ারে গিয়ে পিছু হটতে শুরু করলো বাস। অনেকের মুখ থেকে বিরক্তি শব্দ বের হয়ে গেল।

ড্রাইভার তাঁর ডানপাশের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রভোস্টের সাথে কী কথা বললেন শুনতে পেলাম না। কিন্তু অফিসারের সিটে যাঁরা বসেছিলেন তাঁরা দ্রুত উঠে গিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেয়া সিট পুনরুদ্ধার করছেন দেখে বুঝতে পারলাম – অফিসারের কাছ থেকে ডাক এসেছে। গাড়ি ইউ-টার্ন নিয়ে ছুটলো আর-টি-এস বিল্ডিং-এর পাশের রাস্তা দিয়ে। অফিসার্স মেসের সামনে এসে বাস থামলো। আমার পাশে জানালার দিকে যিনি বসেছেন – তিনি জানালার কাচে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবুও ভালো যে অফিসার বাসে উঠলে – নন্‌-অফিসারদের উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করতে হয় না। ছোলাইমান স্যার একবার বলেছিলেন – কলেজের টিচাররা নাকি এই অফিসার্স মেসে ঢোকার যোগ্যতা রাখেন। সেই যোগ্যতা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি কোনদিন। তাঁর সঙ্গে একবার সার্জেন্ট মেসে খেতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল – তাতে সার্জেন্ট মেসেই দ্বিতীয়বার যাবার সাহস হয়নি, অফিসার্স মেস তো দূর অস্ত।
এখানে আরো মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর দেখা গেল একজন সতেরো-আঠারো বছরের কিশোর গাড়িতে উঠলো। এত কম বয়সে কি অফিসার হওয়া যায়? ছেলেটি বাসে উঠে সামনের সিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু হঠাৎ সম্ভবত ম্যাডামদের দেখে সামনে না গিয়ে পেছনের দিকে চলে এলো। ড্রাইভার আবার জানালা দিয়ে মুখ বের করে কারো সাথে কথা বললেন। তারপর বাস চলতে শুরু করলো। কোন অফিসার উঠলেন না। অফিসারের সংরক্ষিত আসন আবার নন-অফিসারের দখলে এলো। এই ছেলেটির জন্যই এতদূর থেকে এতগুলো মানুষসহ বাস ফিরিয়ে আনা হয়েছে! অফিসারের আত্মীয়-স্বজন কেউ হবে হয়তো।
ছেলেটি পেছনে এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বসার জায়গা খুঁজছে। তাকে জায়গা দেয়ার মত জায়গা কারো কাছেই নেই। আমার কাছে এসে সে বললো, “একটু চেপে বসো ভাই।“
আমি বেশ অবাক হলাম। আমাকে কি সে তার সমবয়সী মনে করেছে? নাকি অফিসার-ইফেক্ট? যথাসম্ভব সরে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে তার বসার জায়গা করলাম। একেই বলে এডজাস্ট করা।
মেইন রোডে উঠার পর পাগলের মত বাস চালাচ্ছেন ড্রাইভার। দেখলাম এই গতিতে অনেকেই খুব আনন্দ প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে যাঁরা ষোলশহরে নামেন। তাঁরা মনে করছেন এই গতিতে চললে ষোলশহর স্টেশনে গিয়ে দোহাজারি লাইনের ট্রেন ধরতে পারার সম্ভাবনা এখনো আছে।
“তুমি কি কলেজে পড়ো?” – ছেলেটি প্রশ্ন করলো।
আমি ঘাড় ফিরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। তার ঝাঁকড়া লম্বা চুল, চিকন জুলফি কানের অনেক নিচে এসে থেমেছে। মুখে ও কপালে অনেকগুলো ব্রনের দাগ। টাইট জিন্স – টি-শার্টের উপর একটা জ্যাকেট পরনে।
“আমাকে জিজ্ঞেস করছো?” – নিশ্চিত হবার জন্য জানতে চাইলাম। আমাকে তো এত কমবয়সী মনে হবার কোন কারণ নেই। অনেক সময় মানুষের ব্রেন ঠিকমত কাজ করে না। হয়তো এই ছেলেটার মস্তিষ্কও এখন ঠিকমতো কাজ করছে না।
“হ্যাঁ। আমি তো কলেজে ভর্তি হয়েছি।“
“শাহীন কলেজে?”
“হুঁ।“
“সায়েন্সে?”
“হুঁ।“
“ক্লাসে তো দেখিনি।“
“কয়েকদিন আগে ভর্তি হয়েছি। তুমিও কি ফার্স্ট ইয়ারে?”
কী বলবো বুঝতে পারছি না। যেভাবে গা ঘেষে বসে আছে – এখন যদি বলি – আমি তোমার মাস্টার, বেচারা লজ্জা পাবে। তারচেয়ে কথা ঘোরানো যাক। ভর্তি শেষ হয়ে গেছে সেই অক্টোবরে। এখন এই ডিসেম্বরে এসে সে কীভাবে ভর্তি হলো কে জানে। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি অফিসার্স মেস থেকে কীভাবে উঠলে?”
“আমার ভাই অফিসার তো।“
অফিসারের ভাইয়ের কী দাপট। তবুও ভালো যে অন্তত ম্যাডামদের দেখে চিনতে পেরেছে। সামনে গিয়ে বসেনি। ভাবলাম বেশি কথাবার্তা বলা ঠিক হবে না অফিসারের ভাইয়ের সাথে। তাছাড়া ক’দিন পরেই নাসির স্যারের হাতে তার সৌখিন কেশবিন্যাসের যে করুণ দশা হবে তা চিন্তা করেই হাসি পাচ্ছিলো।
“ক্লাসে দেখা হবে” – বলে আগ্রবাদে নেমে গেল সে।
মনে মনে বললাম, ক্লাস করলে তো অবশ্যই দেখা হবে।
চকবাজারে যখন নামলাম তখন প্রায় পৌনে চারটা বেজে গেছে। ছোলাইমান স্যার বাস থেকে নেমেই কীভাবে যেন দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যান। রিফাৎ আরা ম্যাডাম রিকশা নিয়ে চলে গেলেন পাঁচলাইশের দিকে। আমি রাস্তা পার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি – এমন সময় লাইলুন্নাহার ম্যাডাম ডাকলেন – ‘প্রদীপ’।
“জ্বি ম্যাডাম।“
“এটা আপনার জন্য।“ – ম্যাডাম একটা প্লাস্টিকের কৌটো এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ভেতরে হলুদ রঙের পদার্থ দেখা যাচ্ছে।
“গাজরের হালুয়া বানিয়েছিলাম। খাবেন।“
লাইলুন্নাহার ম্যাডাম কলেজের সবার সিনিয়র হবেন বলে আমার ধারণা। বাচ্চাদের কী যে আদর করে পড়ান। এখন দেখছি তাঁর আদর-স্নেহের ভাগ আমিও পাচ্ছি। অথচ তাঁর সাথে আমার কোনদিন ভালো করে কথাই হয়নি। সংসারে কিছু কিছু মানুষ এরকমই থাকেন – যাঁদের কাজ হলো সবাইকে স্নেহ করা।

>>>>>>>>>>>>>>>
বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেয়া হচ্ছে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও কলেজ সেকশানে। জানুয়ারির শুরুতেই নিয়োগ পরীক্ষা। পাঁচ ছয়টি পোস্টের জন্য কয়েক শ প্রার্থী। অনেকগুলো রুমে লিখিত পরীক্ষা হচ্ছে। আমার ডিউটি দেয়া হয়েছে সেকেন্ড ইয়ার সি সেকশানের ক্লাসরুমে। কেজি’র টিচারের জন্য পরীক্ষা দিচ্ছেন এক শ’র উপরে। নেয়া হবে সম্ভবত দুই বা তিন জন। শিক্ষক হবার জন্য পরীক্ষা দিচ্ছেন, কিন্তু সমানে কথা বলছেন একজন আরেকজনের সাথে। খাতা দেখাদেখিও করছেন। আমি শিক্ষকদের সম্মান দেখিয়ে যথাসম্ভব বিনয়ের সাথে বললাম, “প্লিজ এরকম করবেন না।“ কিন্তু কে শোনে কার কথা। কয়েকজনের আচরণ দেখে ইচ্ছে করছে খাতা কেড়ে নিই। আমার স্টুডেন্ট হলে কত আগেই খাতা কেড়ে নিতাম। দু’জনের কাছে গিয়ে মৃদুকন্ঠে হুসিয়ারি দিলাম। কিন্তু তাঁরা আমাকে পাত্তা দিলেন না। আমি ডায়াসে ফিরে আসতে না আসতেই দেখলাম  তারা একজন আরেকজনের খাতার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। মনে হচ্ছে এদের মধ্যে একজন পরীক্ষা দিতে এসেছেন অন্যজনকে সাহায্য করার জন্য। আমি গিয়ে দুজনের খাতাই নিয়ে নিলাম। তাঁরা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন – কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন।
দেখলাম একজন এয়ারফোর্স অফিসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। নিয়োগ পরীক্ষার সময় শাহীনের এডুকেশন উইং থেকে অফিসাররা আসেন। মূলত তাঁদের তত্ত্বাবধানেই সবকিছু হয়ে থাকে। ইউনিফর্ম পরা অফিসারকে সবাই ভয় পায়। তাঁকে দেখেই সমস্ত এতক্ষণ যাঁরা ফিসফিস করছিলেন, তাঁরাও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
অফিসার রুমে ঢুকে আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, “প্রদীপ, দোস্ত তুই এখানে?”
“আরে শফিক, তুই! আমি তো ভয়ে তাকাইনি তোর দিকে।“
পরীক্ষার হল না হলে এতক্ষণে কোলাকুলি লাফালাফি অনেককিছু করে ফেলতাম। কিন্তু আপাতত সব উচ্ছ্বাস চাপা দিতে হলো।
“কতদিন হলো এখানে?” – শফিক জানতে চায়।
“এক বছর হয়ে গেছে।“
“আমারও তো প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে এয়ারফোর্সে।“
পরীক্ষার হলে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না বুঝতে পারলো শফিক। বললো, “পরে কথা বলবো। আমি অন্যরুমগুলোও একটু ঘুরে দেখি।“ – বলে চলে গেল সে।
শফিক আমার ক্লাসমেট। পাস করেই এয়ারফোর্সে ঢুকেছে। এখন তাকে আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারও স্যার ডাকবেন।
যাঁদের খাতা নিয়ে ফেলেছিলাম – তাঁরা খাতা আর ফেরত পেলেন না। যেটুকু লিখেছেন তাতে যদি পাস করেন তবে মৌখিক পরীক্ষায় যাবেন, নইলে নয়।
পরীক্ষা শেষ হলো। খাতাগুলো ভাইস-প্রিন্সিপাল শিরিন ম্যাডামের রুমে রেখে আসার সময় দেখলাম শফিক প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বের হচ্ছে।
“আমি তো জানতাম না তুই শাহীন কলেজে জয়েন করেছিস।“
“আমিও তো জানতাম না যে তুই এয়ারফোর্সে জয়েন করেছিস।“
“বিসিএস দিসনি?”
“দিয়েছি। দেখি কী হয়।“
দুই বন্ধুর অনেকদিন পরে দেখা হলে যা হয় – অনেক কথাবার্তা হলো। কিছুক্ষণ পরেই সে ব্যস্ত হয়ে গেল। তার বস আমজাদ সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন।
“প্রদীপ, তুমি নাকি দুইজন লেডি ক্যান্ডিডেটের খাতা কেড়ে নিয়েছো?” – সাঈদ স্যার বললেন।
“উনারা খুব দেখাদেখি করছিলেন, আর কথা বলছিলেন। আমার নামে কি নালিশ করেছেন উনারা?”
“জানি না। তবে করলে খবর আছে তোমার।“
উনারা কি খুব পাওয়ারফুল কেউ ছিলেন? জানার আগ্রহ হলো না। আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি।
এক সপ্তাহের মধ্যেই কয়েকজন নতুন শিক্ষক জয়েন করলেন। কলেজে এতদিন যুক্তিবিদ্যা পড়ানো হতো না। এবছর থেকে যুক্তিবিদ্যা শুরু হলো। যুক্তিবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা দীর্ঘদেহী জামান সাহেব। কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন মোরশেদ সাহেব। মোরশেদ সাহেবের বাড়ি চকরিয়া। খাস চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন – আহা শুনতে কী যে ভালো লাগে।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>


নতুন রুটিন তৈরি হচ্ছে। মহিউদ্দিন স্যার আর সাঈদ স্যার ভীষণ ব্যস্ত রুটিনের কাজে। শোনা যাচ্ছে ভাইস-প্রিন্সিপাল শিরিন ম্যাডাম ঠিক করে দিচ্ছেন – কাকে কোন্‌ সাবজেক্ট পড়াতে দেয়া হবে। আমি ফিজিক্সের মানুষ – আমাকে তো আর অর্থনীতি পড়াতে দেয়া হবে না। কিন্তু স্কুলে যে ক্লাস দেবে। আমাকে কি আবারও ক্লাস সেভেনের গণিত পড়াতে হবে? গণিতের চেয়ে বিজ্ঞান যদি পড়াতে পারতাম তাহলে মনে হয় অনেক আনন্দ নিয়ে পড়াতে পারতাম। শিরিন ম্যাডামকে একবার বলে দেখবো নাকি? এমনিতেও ভাইস-প্রিন্সিপাল হবার পর তাঁর সাথে একবার হলেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করা উচিত ছিল আমার। সেটা করিনি। অথচ মোরশেদ যোগ দিয়েই সব স্যার-ম্যাডামের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে ফেলেছেন। অনেক সাহস সঞ্চয় করে শিরিন ম্যাডামের অফিসে গেলাম।
“ম্যাডাম আসি?”
“আসেন।“
“ম্যাডাম, আমার নাম প্রদীপ দেব। আমি এই কলেজের…”
“আমি আপনাকে চিনি। পরিচয় দিতে হবে না। কাজের কথা বলেন।“
“ম্যাডাম, আমি গতবছর ক্লাস সেভেনে অংক করিয়েছি। সেই ক্লাসটা এবার এইটে উঠেছে। আমাকে যদি এবার ক্লাস এইটের বিজ্ঞান পড়াতে দেন তাহলে আমি খুব আনন্দ-সহকারে পড়াতে পারবো।“
“তা তো বটেই, তা তো বটেই। আচ্ছা, আমি দেখবো।“
বাহ্‌ এত সহজে হয়ে গেল। খুশি হয়ে চলে এলাম।
দু’দিন পরে রুটিন প্রকাশিত হলো। আমাকে ক্লাস ফাইভের অংকের ক্লাস দেয়া হয়েছে। কলেজে পড়াতে এসে হাইস্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতাও হয়েছে গতবছর। এবছর প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোর সুযোগও হলো। ফারুকী স্যারের মতে  যত নিচের দিকের ক্লাস – ততই পড়াতে আরাম। আমার এবার আরো খুশি হবার কথা। কিন্তু খুশি লাগছে না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমাকে শাস্তি দেয়া হলো। হাই স্কুলের ক্লাসে হয়তো ঠিকমতো পড়াতে পারিনি, তাই প্রাইমারি স্কুলে নামিয়ে দেয়া হলো। দেখি এখানে ঠিকমত পড়াতে পারি কি না।

আগের পর্ব

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ২৯

29


“কী সুন্দর মুরগি দেখেছিস! আল্লা কী সুন্দর!”
দরজা খুলে এদেরকে দেখে যতটা অবাক হয়েছি, তার চেয়ে বেশি অবাক হচ্ছি এদের আচরণ দেখে। পশুপাখি দেখে মুগ্ধ হতে অনেককে দেখেছি, কিন্তু মুরগি দেখে এত আহ্লাদ করতে আর কাউকে দেখিনি। এই মেয়ে কি ফার্মের মুরগি দেখেনি কখনো? সে হাত বাড়িয়ে মুরগি ধরতে যাচ্ছে দেখে আরেকজন তাকে সাবধান করলো, “এই দ্যাখিস, কামড়ে দেবে।“
সে ভয় পেয়ে “ও মাগো” বলে চিৎকার করে উঠতেই হো হো করে হেসে উঠলো তাদের পিছু পিছু আসা সবগুলো বাচ্চা। বাচ্চাগুলো এসময় গলির পথে হৈ চৈ করতে করতে খেলে। আজ এদেরকে ফলো করে আমার বাসা পর্যন্ত কী কারণে এসেছে আমি জানি না। মনে হচ্ছে পথে আসার সময় মুরগি দেখে আহ্লাদ করার মত আরো অনেক কিছু করেছে এরা – যা দেখে বাচ্চারা মজা পেয়ে গেছে।
“স্যার এগুলি কি আপনার মুরগি?”
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আহ্লাদি প্রশ্ন করে।
“আপনি মুরগিও পালেন স্যার?” সম্পূরক প্রশ্ন করে আরেকজন।
“শুধু মুরগি কেন? আসার সময় গরু দেখোনি অনেকগুলো? ওগুলোও আমার কি না জিজ্ঞেস করো।“ – হাসতে হাসতে বললাম।
“তাই তো, গরুগুলিও কি আপনার স্যার?” – বেশ সিরিয়াসলি প্রশ্ন করে আরেকজন।
এরা যে এত সিরিয়াস ফাজিল আমার জানা ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার তোমরা এখানে কেন?”
“স্যার সত্য বলব, না মিথ্যা বলব?”
“সত্য বলবে।”
“আপনাকে রাজি করাতে এসেছি স্যার।“
“কী ব্যাপারে?”                                                                                             
“আমাদের পড়াতে হবে স্যার।“ – চারজন একসাথে বলে উঠলো।
অনেকদিন থেকেই অনেক স্টুডেন্ট প্রাইভেট পড়ার জন্য বিরক্ত করছে। আমি প্রাইভেট পড়ানোর বিপক্ষে। কলেজে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে। ক্লাসে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছি। এর পরেও কেন প্রাইভেট পড়তে হবে? ইন্টারমিডিয়েটে আমি নিজে প্রাইভেট পড়েছিলাম কয়েকজন স্যারের কাছে। ক্লাসে কখনোই সিলেবাস শেষ করানো হতো না। প্রাইভেট পড়তে হয়েছিল। এখন তো তা নয়। আমার ক্লাসে আমি যা বোঝাই – প্রাইভেট পড়লে তো তার চেয়ে বেশি কিছু বোঝাবো না। এখন এরা এত দূর থেকে আমার বাসায় চলে এসেছে!
“তোমরা বাসা কীভাবে খুঁজে পেলে?”
“কত কষ্ট করে আপনার বাসা খুঁজে বের করেছি স্যার। এত্তো দূরে – এত্তো ভিতরে!”
দরজা খোলা পেয়ে মুরগির দল ঘরের ভেতর ঢুকতে চাচ্ছে। ডাক দিলাম, “শান্তা”।
এতক্ষণ জানালার কাছে অন্য বাচ্চাদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল শান্তা। ডাক শুনে দরজার সামনে এসে বললো – জ্বি।
“তোমার খালাকে বলো মুরগিগুলি নিয়ে যেতে। বলো ঘরে ঢুকে যাচ্ছে।“
“জ্বি” – বলে শান্তা দৌড়ে চলে গেল তার খালাকে ডাকতে।
“কী কিউট বাচ্চা! কে স্যার?”
“আমার বাড়িওয়ালার মেয়ে। মুরগিগুলি আমার প্রতিবেশীর। শান্তার খালা আমার প্রতিবেশী।“
একটু পরেই শান্তার খালা আর খালু দুজনই বের হয়ে এসে মুরগিদের তাড়া করে নিয়ে গেলো। দেখলাম একটু আগে মুরগির সৌন্দর্যে যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে এখন মুরগির বিষ্ঠার গন্ধে নাকে ওড়নাচাপা দিচ্ছে।
“আমরা কবে থেকে আসবো স্যার?”
“দেখো, আমি তো তোমাদের বলেছি যে আমি প্রাইভেট পড়াই না। আমার ক্লাস করলে আর প্রাইভেট পড়ার দরকার নেই।“
“আমরা তো প্রাইভেট পড়ার কথা বলছি না স্যার। আমরা যদি ফিজিক্সের কোন কিছু না বুঝি – সেটা তো আপনি আমাদের বুঝিয়ে দেবেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, তা তো দেবোই।“
“সেই টাই তো স্যার। আমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। সেগুলি বুঝার জন্য কখন আসবো?”
এদেরকে যতটা সহজ-সরল ভেবেছিলাম – এরা মোটেও তা নয়। এরা আমার কথার জালে আমাকেই জড়িয়ে ফেলছে। বললাম, “আবার আসতে হবে না, এখনই বলো, কী সমস্যা – বুঝিয়ে দিচ্ছি।“
“আজ না স্যার। আজ তো বাসা চিনে গেলাম। এখন থেকে যখনই সমস্যা হবে চলে আসবো। একটু কষ্ট হবে। পতেঙ্গা থেকে এখানে – এমন কি আর দূরত্ব! ঠিকই চলে আসতে পারবো।“
“না, বাসায় আসতে হবে না। সমস্যা থাকলে কলেজেই দেখিয়ে নিও।“
“তাহলে তো স্যার ছুটির পর আপনাকে সময় দিতে হবে।“
“ঠিক আছে, দেখা যাবে।“
“থ্যাংক ইউ স্যার, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ”
এরা কি পাগল নাকি? এত উচ্ছ্বাস দেখানোর কী আছে! আজ কোথাও বের না হবার প্ল্যান বাতিল করতে হলো।
“তোমরা কি আর কোথাও যাবে? আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে।“
“ঠিক আছে স্যার। আমরা যাই স্যার।“
“দাঁড়াও, আমিও বের হচ্ছি।“
রুমে তালা দিয়ে বের হলাম। সারা পথজুড়ে খড় বিছানো। সালাম সাহেব ধানচাষও করেন। ধান মাড়াই করে এখন খড় শুকাচ্ছেন। তাঁর গরুর খাদ্য। এই শহুরে মেয়েগুলো খড়ের উপর দিয়ে উঁচু জুতা পরে ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না। একটু পরপরই পায়ে খড় লেগে পড়ে যেতে যেতে একজন আরেকজনকে ধরে সামলে নিচ্ছে আর খিলখিল করে হেসে উঠছে। কেমন যেন মায়া লাগছে এদের জন্য।
>>>>>
কলেজের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়ে গেছে। এবার ফার্স্ট ডিভিশন ছাড়া ফর্ম দেয়া হয়নি। ভর্তি পরীক্ষায় যারা টিকেছে তারা ভর্তি হয়ে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই ক্লাস শুরু হবে। সায়েন্সের তিনটি সেকশানকে এ বি সি সেকশানের বদলে এখন নাম দেয়া হয়েছে – ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো। আমাকে প্লুটো সেকশানের ক্লাস-টিচার করা হয়েছে। একই সাথে ক্লাস সেভেনের ক্লাস টিচারের কাজও চালিয়ে যেতে হবে তাদের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। কাজের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।
টিফিন আওয়ারে ক্লাস সেভেনের এইচ-ডাব্লিউ অর্থাৎ হোম-ওয়ার্ক দেখছি যত দ্রুত সম্ভব। বি সেকশানের মনিটর ফেরদৌসী এসে দাঁড়িয়ে আছে তাদের খাতা নিয়ে যাবার জন্য। এখনো দু’তিনটা খাতা দেখার বাকি। ফেরদৌসী উশখুস করছে চলে যাবার জন্য। দেখলাম তার চোখ বারান্দায় - সেখানে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে পার্সা, রেহনুমা আর কানিজ।
“তুমি এক কাজ করো, কিছুক্ষণ তোমার বন্ধুদের সাথে গল্প করে আসো। দশ মিনিট পরে এসে খাতাগুলো নিয়ে যেও।“
“থ্যাংক ইউ স্যার” বলে প্রায় উড়ে চলে গেল ফেরদৌসী। কিন্তু সাথে সাথে আরেকজন এসে দাঁড়ালো টিচার্সরুমের দরজায়।
“স্যার, একটু কথা বলা যাবে?”
“দশ মিনিট পরে বললে কি খুব অসুবিধা হবে সুফিয়ান?”
“না স্যার, দশ মিনিট পরে বলবো।“
সুফিয়ান চলে গেলো। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই খাতা দেখা শেষ করলাম। নিয়তিদির রেখে যাওয়া সিঙাড়া ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা সিঙাড়া গরম করার কোন ব্যবস্থা নেই কলেজে, ঠান্ডাই খেতে হবে। বিমল স্যার সিঙাড়ার ভেতর বিড়ি পাওয়ার পর থেকে সিঙাড়া ভেঙে ভেতরটা দেখে খেতে হচ্ছে। এতে দুই হাতেই তেল লেগে যায়। কাশেম স্যার সেই তেল ছেলেমেয়েদের খাতাতেই মুছে ফেলেন। আমি পারি না। প্রিন্সিপালের রুমে টিস্যুপেপার আছে। আমাদের রুমে টিস্যু-পেপার দেয়া হয় না। তাই আমাদের হাত মোছার ব্যবস্থাটুকু নিজেদের করতে হয়।
বারান্দায় বের হওয়ার সাথে সাথেই ফেরদৌসী দৌড়ে এল।
“স্যার, হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, তোমাদের খাতা নিয়ে যাও। আর আমার ক্লাস তো সিক্স পিরিয়ডে। তখন দেখা হবে।“
ফেরদৌসী হাসতে হাসতে খাতা নিয়ে চলে গেল। এতগুলো খাতা একজনের পক্ষে এখান থেকে হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাওয়া সোজা কথা নয়। অনেক ভারী মোটা মোটা খাতা। কিন্তু এই মেয়েটি হাসিমুখে নিয়ে যাচ্ছে। মনিটর হওয়া যে কত ধরনের শাস্তি তা কি এরা বোঝে না? ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ডকে দিয়ে এই কাজ না করিয়ে এগুলো তো করানো উচিত ক্লাসের লাস্ট এবং সেকেন্ড লাস্টকে দিয়ে।
“স্যার, কথাটা কি এবার বলা যাবে?”
সুফিয়ান এবার সাথে আরো একজনকে নিয়ে এসেছে।
“বলা যাবে। বলো কী কথা।“
“ভয়ে বলবো, না নির্ভয়ে বলবো স্যার?”
সুফিয়ান শিল্পী মানুষ। গান করে। শুনেছি কবিতাও লেখে। ক্লাসের বইয়ের বাইরেও যে পড়াশোনা করে তা তার কথাবার্তায় বোঝা যায়।
“যা বলবে, নির্ভয়ে বলবে। তোমার কথার সাথে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার স্বাধীনতায় আমি বিশ্বাস করি।“
“স্যার আমার ধারণা আপনার মধ্যে জেন্ডার বায়াসনেস আছে।“
সিরিয়াসলি? কিছুটা অবাক হয়ে তাকালাম সুফিয়ানের দিকে। তার মুখ হাসিহাসি। তার মানে সে কথা বলার আর্ট ভালোই জানে। সিরিয়াস কথা সবসময় সিরিয়াসলি বলতে হবে এমন কোন কথা নেই। সে জানে সিরিয়াস অভিযোগ হাসিমুখে করলেও সিরিয়াসনেস হারায় না।
“কোন্‌ জেন্ডারের দিকে আমি বায়াস্‌ড বলে তোমার মনে হচ্ছে?”
“ফেমিনিন জেন্ডারের দিকে স্যার।“
“প্রমাণ?”
“আপনি স্যার মেয়েদেরকে কলেজের পরে ফিজিক্স বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আমরা ছেলেরা সেই সুযোগ পাচ্ছি না।“
তাহলে এই ব্যাপার! সেদিন আমার বাসায় গিয়ে মেয়েরা সম্মতি আদায় করেছিল। তাদের সমস্যাগুলো সপ্তাহে এক বা দুই দিন ক্লাসের পর দেখিয়ে দিই। পাঁচ-ছ’জনের একটা দল। সংখ্যা মাঝে মাঝে কম-বেশি হয়। যেহেতু পরীক্ষা পাসের জন্য সাজেশান দেখে পড়া নয়, নোট মুখস্থ করার ব্যাপার নয়, - পদার্থবিজ্ঞান বুঝার জন্য কেউ আলোচনা করতে আগ্রহী হলে আমার তো কোন আপত্তি নেই। তাছাড়া আমি কোন টাকা নেবো না বলে দিয়েছি। টাকা নিলে একটা দায়বদ্ধতা চলে আসে। আমি সেই দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকতে চাই। কিন্তু সুফিয়ান কি এর সবটুকু জানে?
হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, “তারা যে আমার বাসায় গিয়ে মুরগি দেখে মুগ্ধ হয়ে এসেছে – তা কি তুমি জানো?”
“জানি স্যার। আমাদেরকেও কি স্যার তাই করতে হবে?”
“না না, তা করতে হবে না। এখন তো মনে হচ্ছে জেন্ডার বায়াসনেস কাটানোর জন্য হলেও তোমাদের সময় দিতে হবে।“
“জ্বি স্যার। আমাদেরও খুব বেশি কিছু লাগবে না স্যার। যেগুলো আমরা বুঝতে পারবো না, সেগুলো বুঝিয়ে দিলে হবে।“
“ঠিক আছে।“
“থ্যাংক ইউ স্যার।“
সুফিয়ান, ফারুক এদের কয়েকজনের একটা গ্রুপকে ফিজিক্স বুঝানোর জন্য মাঝে মাঝে যেতাম নৌবাহিনীর কোয়ার্টারে। পড়ালেখায় খুব সিরিয়াস তারা – অন্তত ফিজিক্সে। তাদের কাছেই আমি প্রথম শুনেছিলাম – মিস্টার বিন-এর কথা। টিভিতে নাকি তখন মিস্টার বিন দেখাতো। আমার টিভি ছিল না – তাই সেই সময় একদিনও দেখিনি। সুফিয়ান আমাকে কেন মিস্টার বিনের কথা বলেছিল জানি না। পরে মিস্টার বিন দেখেছি। আমার আচার-আচরণের সাথে কি মিস্টার বিনের কোন মিল সে খুঁজে পেয়েছিল? আমি জানি না।
>>>>>>>>>>>>>
ছুটির পর খাতাপত্র গোছাচ্ছি – দেখি দরজার কাছে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে রেহনুমা। এই মেয়েটাকে সারাক্ষণই হাসিখুশি দেখতে অভ্যস্ত আমি। হঠাৎ মন খারাপ কেন তার?
“কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?”
“আমার ঘড়িটা পাচ্ছি না।“
“তোমার হাতে ছিল?”
“খুলে আমার ডেস্কে রেখেছিলাম। এখন নেই।“
“ভালো করে খুঁজে দেখেছো? চলো আমিও যাচ্ছি – দেখি খুঁজে। আছে কোথাও। ঘড়ি কোথায় যাবে? মন খারাপ করো না।“ - তার সাথে তার ক্লাসের দিকে যেতে যেতে বললাম।
ক্লাস সেভেনের তার ডেস্কের আশেপাশে আমিও খুঁজে দেখলাম। কোথাও নেই।
“ঘড়িটা আম্মুর। আম্মু বকা দেবে।“ – চোখ ছলছল করছে রেহনুমার।
“আম্মু মোটেও বকা দেবে না।“ বলতে বলতে ক্লাসে ঢুকলেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম। তার পেছনে কলেজের আয়া অঞ্জনা। রেহনুমা ঘড়ি হারিয়েছে, কিন্তু রিফাৎ আরা ম্যাডাম এখানে কেন?
“আম্মু, আমার ঘড়িটা পাচ্ছি না।“
আমি একবার রেহনুমার দিকে তাকাই, একবার রিফাৎ আরা ম্যাডামের দিকে। রেহনুমা যে রিফাৎ আরা ম্যাডামের মেয়ে এই কথাটি আমি এতদিন পরে এভাবে জানলাম। রিফাৎ আরা ম্যাডাম একবারও বলেননি যে তাঁর মেয়ে আমার ক্লাসে পড়ে। প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন প্রভাব পড়ুক তা তিনি চান না বলেই কিছু বলেননি। এরকম ইস্পাতের মত ব্যক্তিত্ব মানুষের কীভাবে হয়!
ঘড়িটা সেদিন আর পাওয়া গেল না। পরের দিন টিফিন আওয়ারে রেহনুমা এসে জানিয়ে গেল তার ঘড়িটি পাওয়া গেছে। ওটা ভুল করে ক্লাসের অন্য কারো বাড়িতে চলে গিয়েছিল। এখন ফিরে এসেছে।
>>>>>>>>>>>>
ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। কয়েক শ নতুন মুখ এখন কলেজে। সেকেন্ড ইয়ারের ছেলে-মেয়েদের ভেতর এক দিনের মধ্যেই সিনিয়র সিনিয়র ভাব চলে এসেছে। তারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুটা উচ্চস্বরে ফার্স্ট ইয়ারের মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।

 ক্লাস সেভেনের সাথে প্রতিদিন ফার্স্ট পিরিয়ড থাকে আমার। এখন রুটিন কিছুটা পরিবর্তন করে আমার ফার্স্ট পিরিয়ড দেয়া হয়েছে ফার্স্ট ইয়ারের প্লুটো সেকশানের সাথে। সেই সেকশানের ছেলেদের কলেজের প্রথম ক্লাসটি হলো আমার সাথে। কলেজের নিয়মকানুন ইত্যাদির উপর জোর দেয়ার চেয়েও আমি জোর দিলাম ভালো মানুষ হবার উপর। উপদেশ কেউ শুনতে চায় না। আমি উপদেশ দিতেও চাই না। আমি শুধু আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং দর্শন ভাগাভাগি করতে পারি তাদের সাথে। প্রথম দিন – অনেকেরই ইউনিফরম নেই। বিভিন্ন রকমের পোশাকে দেখতে ভালোই লাগছে সবাইকে। আমার নিজের কলেজের প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছিল।

সেকেন্ড পিরিয়ডে গেলাম ক্লাস সেভেনে। ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে যথানিয়মে সবাই মেরুদন্ড সোজা করে বসলো। কিন্তু সারা ক্লাস এতটাই নিষ্প্রাণ নিস্তব্ধ – মনে হচ্ছে কারো নিশ্বাসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। এত হাসিখুশি একটা ক্লাসের কী হলো আজ? সেকেন্ড পিরিয়ড – তাই রোল কল করার দরকার নেই। পুরো বই কবেই শেষ হয়েছে। এখন রিভিশান চলছে। জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা কী করবো আজ?”
পুরো ক্লাস পাথরের মত মুখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখেমুখে কেমন একটা গাম্ভীর্য – যা এগারো-বারো বছরের ছেলে-মেয়েদের জন্য একটু বেশি ভারী হয়ে যায়। কেউ একটা শব্দও বের করছে না মুখ দিয়ে।
“কী হয়েছে তোমাদের?”
কোন উত্তর নেই। মনে হচ্ছে কোন্‌ এক মন্ত্রবলে রূপকথার সেই ঘুমন্ত পুরীর মানুষের মত পাথর হয়ে গেছে এরা। আমি একটা হাসির গল্প বলার চেষ্টা করলাম, “এক দেশে এক রাজা ছিল, তার একটি বানর ছিল, বানরটি রাজা ঘুমালে মাছি তাড়াতো …” – অন্যদিন হলে এটুকু বলার আগেই অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলতো এরা। রাজার কেন বানর থাকবে? কিংবা রাজার বাড়িতে মাছি আসবে কেন? এরকম অনেক প্রশ্ন। কিংবা – রাজার নাম কী? কোন্‌ দেশ? সেই দেশের রাজধানী কী? এরকম প্রাণোচ্ছল সব প্রশ্ন। কিন্তু আজ কী হলো এদের? এদের মন খারাপ সেটা আমি বুঝতে পারছি। কেন মন খারাপ? অনেক চেষ্টা করেও কারো মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারলাম না।
বই খুলে কিছু বীজগণিত উৎপাদকে বিশ্লেষণ ইত্যাদি করলাম। তারা যন্ত্রের মতো নিঃশব্দে লিখলো। ঘন্টা বাজার পরও কেউ কোন কথা বললো না। আমি চলে এলাম। কিন্তু মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। কী হলো এদের?
>>>>>>
পরের দিনও ক্লাসে ঢুকার পর দেখলাম কেউ কোন কথা বলছে না। বললাম, “কাল থেকে আমার মনটা খুবই খারাপ। তোমাদের মন খারাপ দেখলে আমার ভালো লাগে না। তোমাদের কী হয়েছে আমাকে বলবে? প্লিজ।“
“আপনি আমাদের ছেড়ে অন্য ক্লাসের ক্লাসটিচার হয়ে গেছেন। আমাদের মন খারাপ হতে পারে না?” – কানিজ নাইমা বললো। মনে হচ্ছে যেন কেঁদে ফেলবে সে। এবার অন্যরাও কথা বলতে শুরু করলো। কিন্তু হাসছে না কেউ।
“আপনি কেন এমন করলেন?”
“কেন আপনি ফার্স্ট পিরিয়ডে আমাদের ক্লাসে আসেননি?”
“নতুন ফার্স্ট ইয়ার এসেছে তো। আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালন করতে হবে না? আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। হাহাহা।“ - আমি হাসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একা একা তো হাসা যায় না।
তাদের অনেক বোঝালাম যে আমি তাদের ছেড়ে যাইনি। তাদের ক্লাসটিচার আমিই আছি। তারা পাস করে ক্লাস এইটে উঠলে তবেই আমার ছুটি।
ক্লাস শেষে ডেস্কে ফিরে এলাম। কিসের যেন একটা দলা-পাকানো অনুভূতি বুকের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আমার উপর অভিমান করে সারা ক্লাস চুপ করে ছিল পুরো চল্লিশ মিনিট। আমি তাদের ক্লাসে আগে না গিয়ে কেন অন্য ক্লাসে আগে গেলাম – শুধুমাত্র সেজন্য! এতো ভালবাসা আমার জন্য! চোখের পানি আটকে রাখতে পারছি না কেন?

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ২৮

28

হাহা করে হাসতে পারলে নাকি শরীরের রোগ-ব্যাধি দূর হয়ে যায়। ডিসি হিল পার্কে অনেককে দেখা যায় হাহা করে হাসতে হাসতে রোগ-ব্যাধি দূর করছেন। পার্কে ব্যায়াম করতে করতে হাসা আর সিনেমা হলের সামনের রাস্তায় প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসার মধ্যে অনেক পার্থক্য। রঞ্জনের হাসির শব্দ এতটাই প্রচন্ড আর কর্কশ যে আশেপাশের মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। আমি পাভেলের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে রঞ্জনের এই হাসির সাথে তার পরিচয় আছে। অথচ কয়েক মাস আগে এর চেয়ে কম শব্দের হাসিতে ছুটে পালিয়েছিল সে আমার বাসা থেকে।
“সিনেমা দেখেছি – তাতে এত জোরে হাসার কী হলো?” – রঞ্জনের হাসি থামানোর জন্য প্রশ্ন করি। তাতে কাজ হয়। মুহূর্তেই তার হাসি থেমে যায়।
বেশ গম্ভীরভাবে তর্ক করে, “হাসবো না? আপনি ফিজিক্সের টিচার হয়ে সিনেমা কেন দেখবেন? জামাল স্যার কি সিনেমা দেখেন? প্রামাণিক স্যার কি সিনেমা দেখেন? অরুন স্যার কি সিনেমা দেখেন?”
“আমি প্রামাণিক স্যারও নই, অরুন স্যারও নই। জামাল নজরুল ইসলামও নই। আমি সিনেমা দেখি। তাতে তোমার কোন সমস্যা আছে?”
“আমার সমস্যা আছে। অবশ্যই সমস্যা আছে। আজ বিকেলে আপনার বাসায় গিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে। আপনি সিনেমা না দেখলে আমাকে ফিরে আসতে হতো না।“
“আমি সিনেমা না দেখলেও এই সময় বাসায় থাকতাম না। তোমাকে ফিরে আসতে হতো।“
“এখন কি বাসায় যাবেন, না অন্য কোথাও যাবেন?”
“বাসায় যাবো।“
“চলেন তাহলে আমিও যাই। অ্যাই তোমরা চলে যাও। সোজা বাসায় চলে যাবা। সিনেমা টিনেমা দেখবা না। অ্যাই রিক্সা – চলো। মিয়ার বাপের মসজিদ“ – বলেই সামনের একটা খালি রিকশায় উঠে বসলো রঞ্জন। তার মধ্যে একটা ‘ড্যাম কেয়ার’ ভাব আছে। এই ভাবটা অনেক সময় আরোপিত বলে মনে হয়। কিন্তু তা নিয়ে আমি তাকে কিছু বলিনি কখনো।
রিকশা দ্রুত লালচাঁদ রোডে ঢুকে গেল। বেশ ভীড় এখন এই ছোট্ট রাস্তায়। মিষ্টিমুখ রেস্টুরেন্টের সামনে আসতেই “থামো থামো” বলে চেঁচিয়ে উঠল রঞ্জন। রিকশা থামতেই দ্রুত নেমে গেল সে। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা ভ্যান-গাড়ির উপর পিঁয়াজু বিক্রি হচ্ছে। ছোট ছোট সাইজের পিঁয়াজু – অনেক তেল, অনেক ঝাল, অনেক মজা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুই হাতে দুই ঠোঙা নিয়ে রিকশায় উঠে এলো সে।
“এই নেন্‌, আপনার মজার খাবার।“ – একটি ঠোঙা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো রঞ্জন।
সন্ধ্যার এই সময়টাতে চকবাজারের সামনে প্রচন্ড জ্যাম লেগে যায়। বেশিরভাগই রিকশা। লালচাঁদ রোড থেকে সিরাজদৌল্লা রোড ক্রস করে চকবাজারের সামনে আসতেই জ্যামে পড়ে গেলাম। ধুনি-পুল পার হয়ে রিকশা সোজা বিএড কলেজের দিকে চলে যাচ্ছিলো। রিকশাওয়ালারা এই ভুল প্রায়ই করে। মিয়ার বাপের মসজিদ বললে বড় মিয়ার মসজিদের দিকে চলে যায়। আমি কিছু বলার আগেই রঞ্জন “অ্যাই ডানে যাও” বলে প্রায় ধমক দিলো রিকশাওয়ালাকে।
রঞ্জনের এই ব্যাপারটা আমার মোটেও ভালো লাগে না। সে বিজ্ঞান পছন্দ করে, বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসে – এসব খুব ভালো গুণ তার। কিন্তু তার ভেতর মানুষের পেশাগত শ্রেণিবিভাজন প্রকটভাবে আছে।
“এত জোরে না বললেও পারতে।“
“জোরে না বললে সে তো শুনবে না। চারদিকে এত শব্দে কিছু শোনা যায়?” – রঞ্জন নিজের যুক্তি দেখায়।
“অনামিকা কি আপনার গোল্ডস্টেইনের ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স ফেরত দিয়েছে?” – কাজের কথা শুরু করলো সে।
“দিয়েছে তো।“
“ওটা আমার একটু লাগবে। আর রেজনিক হ্যালিডে সেকেন্ড পার্ট।“
রঞ্জন আমার চার ব্যাচ জুনিয়র। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হবে। সে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতো ফতেয়াবাদের রামকৃষ্ণ মিশনে। সেই সময় মাঝে মাঝে আসতো আমার মেসে। ফিজিক্সের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলতো। আমি কিছু শুনতাম, কিছু শুনতাম না। সে নিজের মনেই বকবক করতো। বেশিরভাগই খুব উচ্চস্তরের দার্শনিক কথাবার্তা। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সম্পর্কে নানারকম মন্তব্য করতো সে। তার মতে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের মধ্যে হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া কেউ কিচ্ছু জানেন না। বই দেখে দেখে বোর্ডে লেখেন, আর গৎবাঁধা বুলি আওড়ান। আমি তার সাথে খুব একটা তর্ক করতাম না শুধুমাত্র এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। কারো কথায় সরাসরি দ্বিমত পোষণ না করার অর্থ এই নয় যে আমি তার কথা মেনে নিচ্ছি। আমি তার সাথে তর্ক করছি না – কারণ আমি তর্ক করে সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না।
সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই সে শহরে চলে আসে। আমি ফতেয়াবাদের পাট চুকিয়ে এখানে বাসা নেয়ার কিছুদিনের ভেতরই সে কীভাবে যেন আমার বাসা খুঁজে বের করে বাসায় এসে হাজির। তারপর থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাসায় আসে। দেখা হলেই অভিযোগ করে যে আমার বাসায় অনেকবার গিয়েও আমার দেখা পায়নি সে।

মিয়ার বাপের মসজিদের সামনে আসতে না আসতেই কারেন্ট চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে রিকশার পেছনে লাগানো হারিকেনের আলোকেও অনেক উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। গলির মুখে রিকশা ছেড়ে দিলাম। নতুন একটি মুদি-দোকান হয়েছে এখানে। দোকানের মালিক আবেদিন – আমার সমবয়সী বা বছর খানেক বড় হতে পারে। টুকটাক জিনিসপত্র তার দোকান থেকেই কিনি। বাসায় রান্না করার কিছু আছে কি না মনে পড়ছে না। মোমবাতি-ম্যাচ আছে। ডিম আর ডাল কিনতে আবেদিনের দোকানে ঢুকলাম।
আমাকে দেখেই আবেদিন বললো, “একটা ছেলে আপনাকে খোঁজ করছিলো, চারটা -  সাড়ে চারটার দিকে।“
“কোন্‌ ছেলে? নাম বলেছে?”
“না, মনে হয় আপনার কোন ছাত্র হবে। সাইকেল নিয়ে এসেছিলো। আপনার বাসা খুঁজছিল।“
কে হতে পারে? যেই হোক – বাসা যখন চিনে গেছে আরেকদিন আসবে নিশ্চয়। দোকান থেকে বের হয়ে দেখলাম রঞ্জন গলির মুখে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকাচ্ছে।
“কী দেখছো?”
“দেখছিলাম – এখানে আপনার একটা সাইনবোর্ড কোথায় লাগানো যায়।“
“সাইনবোর্ড কেন লাগাতে হবে?”
“আপনার বাসা খুঁজতে অনেকে আসে। একটা সাইনবোর্ড থাকলে সুবিধা না?”
“তোমার গলির মুখে যেরকম ঝুলিয়েছ?”
“কেন লজ্জা দিচ্ছেন দাদা? ওটা তো লাগিয়েছি ছাত্র ধরবার জন্য।“
“আমাকে কেন লাগাতে বলছো? আমি তো ছাত্র ধরতে চাই না।“

বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। গলিপথের সমস্ত বাঁক আমার মুখস্থ। অন্ধকারে সমস্যা নেই। কিন্তু রঞ্জন হোঁচট খাচ্ছে একটু পর পর। আর উচ্চস্বরে বলছে, “চট্টগ্রাম শহরে এত জায়গা থাকতে আপনি এরকম অদ্ভুত একটা জায়গায় কেন বাসা নিলেন আমি বুঝতে পারছি না।“
“কেন নিয়েছি বুঝতে পারছো না? ভেবেছিলাম এখানে কেউ আসবে না। সেটা আর হতে দিচ্ছ কোথায়?”
রঞ্জন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে কোন রকমে সামলে নিলো।
দুপাশের ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর থেকে রান্না-বান্নার শব্দ আসছে। বাম পাশে আমার বাড়িওয়ালা সালাম সাহেবের বড় ভাইয়ের গোয়াল। গোবরের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগছে। রঞ্জন উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “ইস্‌ - আপনার নাকে কি গন্ধ-টন্ধ কিচ্ছু লাগে না?”
আমি কোন জবাব দিলাম না। সালাম সাহেবের বাড়িতে হারিকেন জ্বলছে। তাঁর উঠোন পেরোলেই আমার বাসা। আমার ডানদিকের প্রতিবেশীর বালকপুত্র স্বপন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বললো, “আংকেল, একটা ছেলে আপনাকে খোঁজ করছিল।“
“কিছু বলেছে?”
“একটা চিঠি দিয়ে গেছে।“
“কোথায় চিঠি?”
“আমার মায়ের কাছে।“
আমি আশা করেছিলাম স্বপন দ্রুত গিয়ে তার মায়ের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে আসবে। কিন্তু সে কিছুই করলো না। যেন খবরটা দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ।
“চিঠিটা এনে দাও তোমার মায়ের কাছ থেকে।“
“মা তো বাসায় নেই। কোথায় গেছে জানি না।“
“দেখো চিঠিটা কোথায় রেখেছে।“
“আমি তো বাসায় ঢুকতে পারছি না, দরজায় তালা।“
চিঠি কখন পাওয়া যাবে জানি না। নিজের বাসায় ঢুকলাম। সকালে বের হবার সময়ও কারেন্ট ছিল না। দরজার কাছে টেবিলের উপরেই মোমবাতি আর ম্যাচ রেখেছিলাম। মোম জ্বালাতেই এতক্ষণের জমাট অন্ধকারটা কেটে গেল। দেখলাম রঞ্জনের পায়ের স্যান্ডেলে কাচা গোবর লেগে আছে।
“তুমি কি ঘরে ঢুকবে, না দরজা থেকেই বিদায় নেবে? ঢুকলে গোবর-মাখা স্যান্ডেল বাইরে রেখে আসো।“
রঞ্জন স্যান্ডেল খুলে ঘরে ঢুকেই বললো, “আপনার কি ঝাড়ু-টাড়ু নেই? ফ্লোরে এত ধুলোবালি কোত্থেকে আসলো?”
“ধুলোবালি না, ঘুণ পড়ছে চেয়ার থেকে।“
“দেখি, তাই তো। লালদিঘীর পাড়ের চেয়ার, ঘুণ তো পড়বেই। হাহাহা“ – রঞ্জনের হাসির শব্দে আমার বাম পাশের প্রতিবেশীর পোষা মুরগিরা কোঁ কোঁ করে উঠলো।

এই বাসায় যখন উঠেছিলাম তখন আমার আসবাবপত্র ছিল একটি পাঁচ পায়ের চৌকি, একটি টেবিল, একটি চেয়ার আর দুটো বাঁশের বুকশেল্‌ফ। ফতেয়াবাদ থেকে এগুলো এনে দিয়েছিল সাহেব মিয়া আর কুদ্দুস। এর চেয়ে বেশি আসবাবপত্রের দরকার হয় নাকি? কিন্তু দেখা গেল বাসায় একজনের বেশি মানুষের বসার জায়গা নেই। খাটটা বসিয়েছি ভেতরের ঘরে। বাইরের ঘরে চেয়ার-টেবিল। এখন কেউ এলে তাকে তো আর খাটে বসতে বলা যায় না। তাছাড়া ভেতরের ঘরে কোন জানালা নেই, তাই দিনের বেলায়ও লাইট জ্বালাতে হয়। বাইরের ঘরে বসার কিছু ব্যবস্থা করা দরকার। সোফা কেনার টাকা নেই আমার। সবচেয়ে সস্তা দামের আসবাবপত্র পাওয়া যায় লালদিঘীর পাড়ে। স-মিলের ফেলে দেয়া কাঠ থেকে বানানো চেয়ার-টেবিল আলনা সব পাওয়া যায় ওখানে। একদিন সন্ধ্যায় গিয়ে চারশ টাকা দিয়ে একেবারে ফুল-সেট ফার্নিচার কিনে নিয়ে এসেছি। ঠিক ফুল-সেট বলা যাবে না। তবে অনেক ফার্নিচার – চারটি চেয়ার, একটি আলনা আর একটি রান্নাঘরে রাখার তাক। আর লাগে কী? তবে সস্তার যেসব সাইড ইফেক্ট আছে সেগুলো এখানেও দেখা গেল। কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু কেমন যেন বেঁকে যেতে শুরু করলো। তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাদা মিহি ঘুণ পড়তে লাগলো। পড়ুক, তাতে কোন সমস্যা নেই। কাজ তো চলছে।

রঞ্জনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করে দেয়া দরকার। রেজনিক হ্যালিডে আর গোল্ডস্টেইন তার হাতে ধরিয়ে দিতেই সে বললো, “আমার ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের কিছু সমস্যা ছিল। আপনি কি কালকে থাকবেন?”
“কালকে তোমাকে সময় দিতে পারবো না।“
“আপনার চেয়ারের ঘুণপোকা মারার একটা ওষুধ আমার আছে। ঘুণপোকা নির্বংশ হয়ে যাবে।“
“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি এখন যাও।“
“কারেন্ট আসুক। অন্ধকারে কীভাবে যাবো? আসার সময় তো পড়ে যাচ্ছিলাম। স্যান্ডেলে গোবর লেগে গেছে।“
“কারেন্ট আসতে অনেক দেরি আছে। আজ বৃহস্পতিবার, কারেন্ট আসবে অনেক রাতে। তুমি একটা মোমবাতি নিয়ে যাও।“
ছোট একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। সে চলে গেল। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম টেবিলের উপর তার পিঁয়াজুর ঠোঙাটা ফেলে গেছে। তাকে ডাকতে গিয়েও আর ডাকলাম না।
রান্নাঘরের অবস্থা খারাপ। কালকের কিছু ভাত আর সবজি আছে। ভাতের ডেকসির ঢাকনা তুলতেই দেখা গেলো কালো কালো পিঁপড়ায় ভর্তি হয়ে আছে সেটা। তরকারি থেকে পঁচা গন্ধ বের হচ্ছে। ফ্রিজ থাকলে এই সমস্যা হতো না। আমার ফ্রিজ কেনার টাকা নেই, তাই ফ্রিজের অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বেশ কিছু জোরালো যুক্তি আছে – যার মধ্যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বন্ধ করা টাইপের উচ্চস্তরের ব্যাপারও আছে।
এই বাসায় এখনো গ্যাসের লাইন আসেনি। সালাম সাহেব প্রতি মাসেই ভাড়া নেবার সময় বলেন, “এই মাসেই গ্যাস চলে আসবে। আপনাকে আর হিটারে রান্না করতে হবে না। তবে গ্যাস পাবেন এক চুলার।“ সালাম সাহেব আগামী মাসেও একই কথা শোনাবেন। এখন কী করা যায়? আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি। এখন কারেন্ট নেই – রান্না করারও উপায় নেই। একটা একটা করে খেতে খেতে রঞ্জনের ঠোঙাটার শেষ পিয়াজুও ঢুকে গেছে পেটে। কিন্তু ক্ষুধা যায়নি। ঘন্টাখানেকের ভেতর কারেন্ট না এলে হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসতে হবে।

টাইপরাইটারটা টেনে নিলাম। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত পাঠাচ্ছি। কিছু কিছু প্রস্পেকটাস আসতে শুরু করেছে। টোফেল জি-আর-ই দিতে হবে। এদিকে ১৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়ে গেছে গত মাসে। শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস। প্রিলিমিনারিতে টিকলে ভাইবা হবে।  অনার্স মাস্টার্সের আনুপাতিক নম্বর যোগ হবার পর  ভাইবাতে শুধুমাত্র পাস নম্বর পেলেও আমার টিকে যাওয়া উচিত। কিন্তু জানি না কী হয়।

দরজায় কে যেন জোরে জোরে কিল ঘুষি মারছে। এভাবে দরজা নক করতে পারে কে?
“কে?”
“আমি”
মেয়ে কন্ঠের এই আমিকে তো আমি চিনি না। কে হতে পারে? দরজা খুললাম।
পাশের বাসার স্বপনের মা। একটা কাঁসার থালা ডানহাতে ধরে আছেন। তার উপর ভাঁজ করা একটি কাগজ।
“আপনার চিঠি। একটা ছেলে দিয়ে গেছে বিকালে।“
হাতচিঠি দেয়ার এই পদ্ধতিটি আমার কাছে অভিনব মনে হচ্ছে। থালার উপর থেকে চিঠিটি নিয়ে বললাম, “স্বপন বলছিলো সন্ধ্যাবেলা।“
“আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম। এই মাত্র ফিরেছি।“
“আচ্ছা ঠিক আছে।“
দরজা বন্ধ করে কাগজটা খুললাম।
“আমি এসেছিলাম। না পেয়ে ফিরে গেলাম। আবার আসবো। বিকেল ৪টা ২৩ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড।“
কোন মানে হয়? নিজের নামটা লিখতে কী সমস্যা হয়? ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড দিয়ে আমি করবোটা কী যদি কে এসেছিল জানতে না পারি। হাতের লেখা বেশ আর্টিস্টিক। কাগজটা কোন খাতা থেকে ছিঁড়েছে। ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড দেখে মনে হচ্ছে ডিজিটাল ঘড়ি দেখে সময় লিখেছে। আর ওরা তো বললোই একটা ছেলে। আবেদিন বলেছে আমার ছাত্র – সাইকেল নিয়ে এসেছিল। কিন্তু কে এসেছিল? শাহীন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে আমার জানামতে বাসা চেনে বাবর। তার সাথে তো দেখা হয়েছে আজ। সে এলে তো বলতো। রঞ্জন বলেছে সে একবার এসেছিল বিকেলে। এটা রঞ্জনের লেখা নয়। অন্য কেউ হবে। আবার আসবে বলেছে – দেখা যাক কখন আসে।
শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো হৈচৈ-এর শব্দে। দরজার বাইরে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। ঘর অন্ধকার। সুইচ টিপতেই বাতি জ্বললো। কারেন্ট এসেছে। রাত সাড়ে বারোটা। এত রাতে কিসের হৈ চৈ? বাইরের ঘরে আসতেই পরিষ্কার শোনা গেল সালাম সাহেবের স্ত্রীর চড়া গলা – কালিয়া দিনর ভিতর আঁর ঘর খালি গরি দিবি।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলছে, “কালকে দিনের মধ্যে আমার ঘর খালি করে দিবি।“
আমার বাম পাশের প্রতিবেশী সম্পর্কে সালাম সাহেবের স্ত্রীর বড় বোন। অনেকদিন থেকে এখানে আছে। তার স্বামী কিছুই করেন না। কোন ছেলেমেয়েও নেই। ঘরের ভেতর একটা রুমে মুরগির খামার করেছেন, অন্যরুমে নিজেরা থাকেন। অনেকদিন থেকে নাকি ঘরভাড়াও দেন না, ঘরও ছেড়ে দেন না। এই নিয়ে দুই বোনের মধ্যে ঝগড়া। কাল সকালে কী হবে জানি না। কিন্তু এই মধ্যরাতে এরকম চিৎকার চেঁচামেচি হলে মানুষ ঘুমাবে কীভাবে? এই প্রশ্ন এখানে কেউ করে না। চিৎকার চেঁচামেচি ঝগড়া মারামারি এখানকার জীবন-যাপনের অংশ।
ক্ষুধা লেগেছে প্রচন্ড। কিন্তু এত রাতে আর রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। এত রাতে কোন হোটেলও খোলা পাবো না। সুতরাং ঘুম।
শুক্রবার সকালে অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠার মধ্যে এক ধরনের রাজকীয় আনন্দ আছে। কিন্তু আজ রাজকীয় আনন্দে ছেদ পড়লো দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। মাত্র পৌনে আটটা বাজে। এত ভোরে কে এলো? অনেক বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললাম।
“গুড মর্নিং স্যার।“
“আলী আশরাফ, তুমি? এত সকালে?”
“সরি স্যার, আমি ভেবেছিলাম আপনি খুব আর্লি রাইজার। আপনার ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত স্যার। আমি কি পরে আসবো?”
আমার খালি গা, পরনে লুঙ্গি – কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিলো। এই পোশাকে ছাত্রের সামনে অস্বস্তি তো লাগবেই। বললাম, “তুমি ভেতরে এসে বসো। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।“

মুখহাত ধুয়ে জামাকাপড় পালটে যখন বাইরের ঘরে এসে দেখি আলী আশরাফ বুকশেল্‌ফের বইপত্র নেড়েচেড়ে দেখছে।
“তুমি কালকে এসেছিলে সাইকেল নিয়ে?”
“জি স্যার।“
“চিঠি লিখে পাশের বাসায় দিয়ে গেছো?”
“জি স্যার।“
“নিজের নাম লেখোনি কেন?”
“নাম লিখিনি? ভুল হয়ে গেছে স্যার।“
“এত সকালে? বাসা চিনলে কীভাবে?”
“গতকাল খবর নিয়ে গেছি।“
“এই এলাকায় আমার বাসা কে বললো তোমাকে? আমার বাসা কোথায় তা তো কলেজের কারো জানার কথা নয়।“
“কী যে বলেন স্যার? কলেজের অনেক স্টুডেন্টই জানে আপনি এই এলাকায় থাকেন।“
“কোথায় থাকো তুমি?”
“আগ্রাবাদ”
“আগ্রাবাদ থেকে এত সকালে চলে এসেছো?”
“সাইকেল নিয়ে চলে এসেছি স্যার। বেশিক্ষণ লাগেনি। শুক্রবার – রাস্তা ফাঁকা।“
“কেন এসেছ বল।“
“এলাম স্যার একটু কথাবার্তা বলতে। ক্লাসের বাইরে আপনার সাথে কথা বলার তো সুযোগই পাই না স্যার। পড়ার বাইরে ইনফরমাল কথাবার্তা বলার জন্য এসেছি স্যার। আপনার বাসাটাকে স্যার আমার লাইসিয়াম বলে মনে হচ্ছে।“
“কোন্‌ লাইসিয়ামের কথা বলছ তুমি? মিমি সুপারমার্কেটের বইয়ের দোকান লাইসিয়ামের কথা? নাকি অ্যারিস্টটলের লাইসিয়ামের কথা?”
“অ্যারিস্টটলের লাইসিয়ামের কথা স্যার। আমরা তো স্যার এখন শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য পড়ি। জ্ঞান অর্জনের জন্য তো পড়ি না।“
মনে হচ্ছে আলী আশরাফ ভবিষ্যতে দার্শনিক টাইপের কিছু হবে। অনেক ভালো ভালো কথা বের হচ্ছে তার মুখ থেকে। কিন্তু আমার যে ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুড়ি হজম হয়ে যাবার জোগাড়। শিক্ষকের বাড়িতে আসার সময় কিছু খানাপিনা নিয়ে আসা বাধ্যতামূলক করে দেয়া উচিত ছিল। কী করি। তাকে বসিয়ে রেখে দোকানে যাওয়া সম্ভব নয়, আবার তার সামনে রান্না করাও সম্ভব নয়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় দর্শন চর্চাও তো বেশি ভালো লাগার কথা নয়।
ঘন্টা দুয়েক পর আলী আশরাফ বিদায় নিলো। যাবার আগে জানিয়ে গেল, “মাঝে মাঝে আসবো স্যার। বিরক্ত হতে পারবেন না।“
আজ প্ল্যান করে রেখেছিলাম একটুও বের হবো না কোথাও। পাশের বাসা আজ খালি করে দেবার কথা। কিন্তু রাতের গন্ডগোল সম্ভবত রাতেই মিটে গেছে। পাশের বাসার এক ঝাঁক মুরগি এখন এই দুপুরে ঘরের বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে। ফার্মের এই মুরগিগুলো খুব একটা হাঁটাচলা করতে পারে না। তাদেরকে বাইরে কেন ছেড়ে দেয়া হয়েছে জানি না। আমার দরজার সামনে এখন তারা স্বাধীনভাবে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে রেখেছে। বাতাসের সাথে বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে। বাইরে বের হতে গেলেই সেগুলো মাড়াতে হবে। দরজা-জানালা খুলে রাখা সম্ভব নয় আর।
আলী আশরাফ যাওয়ার পর দ্রুত রান্না করে এত বেশি পরিমাণে খেয়েছি যে মনে হচ্ছে খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙার পর ঘড়ি দেখলাম দুপুর আড়াইটা। দরজায় খুব মৃদু শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ আলতো করে টোকা দিচ্ছে। দরজার সামনে মুরগিগুলো ডানা ঝাপটাচ্ছে নাকি? কিন্তু দরজারা হুক নাড়ছে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ এসেছে। কিন্তু এত মৃদুভাবে কড়া নাড়ছে যে ঠিকমতো শোনাও যাচ্ছে না।

উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। দরজার সামনে শ’খানেক মুরগি পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারজন মেয়ে। আর একটু দূরে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের প্রায় সবগুলো বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। এই মেয়ে চারজনকে আমি চিনি। কলেজের ইউনিফর্ম পরেনি বলে একটু অন্যরকম লাগছে তাদের।


ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ২৭


27

শুনেছি স্নেহ জিনিসটা খুব একটা ভালো জিনিস নয়। এই জিনিসটি বেশি হয়ে গেলে হাজারো ঝামেলা তৈরি করে। শরীরে স্নেহ-পদার্থ বেশি হলে সমস্যার শেষ থাকে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় মধ্যপ্রদেশে। সেটা তখন স্ফীত হতে থাকে। বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি ছোলাইমান স্যারের মধ্যপ্রদেশ ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। মহাবিশ্বের স্ফীতির সাথে এর তুলনা যদিও চলে না, কিন্তু স্থান-কালের বক্রতা টের পাওয়া যায় এই স্ফীতির ফলে সৃষ্ট আনুষঙ্গিক পরিবর্তন দেখে। যেমন এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি সেই অঞ্চলে তাঁর শার্টের দুই বোতামের মাঝখানে হা হয়ে আছে জানালার মতো। ভেতরের সাদা গেঞ্জির অংশ-বিশেষ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে সামনের দিকে। এই তো স্থান-কালের বক্রতা। কিন্তু কিসের সাথে কিসের তুলনা করছি! আইনস্টাইনের স্পেস-টাইম কার্ভেচারের তুলনা করছি … – ছোলাইমান স্যার জানতে পারলে আস্ত রাখবেন না আমাকে। একটু আগেই তিনি আমাকে অনেক উপদেশ দিয়েছেন কীভাবে কড়া শিক্ষক হতে হয় সে প্রসঙ্গে। তাঁর মতে শিক্ষকদের মনের ভেতর স্নেহ জাতীয় জিনিস বেশি থাকা উচিত নয়। আমার ভেতর নাকি স্নেহের পরিমাণ খুব বেশি – তাই আমার পক্ষে খুব একটা ভালো শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। কারণ ভালো শিক্ষক হতে গেলে কড়া শিক্ষক হতে হয়। যদিও আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে আমার শরীরে কিংবা মনের কোথাও স্নেহ জাতীয় কোন পদার্থ নেই, আমি ছোলাইমান স্যারের কথা অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিতে পারছি না। কারণ তিনি আমাকে যেসব ব্যাপারে অভিযুক্ত করছেন তার সবগুলোই আমি করেছি।
আপনি সেকেন্ড ইয়ারের ছেলে-মেয়েদের বলেছেন কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে?”
জ্বি, বলেছি। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?”
ছোলাইমান স্যার আমার কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীরমুখে তাঁর গলায় ঝোলানো সংক্ষিপ্ত টাইটি কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন। বুঝতে পারলাম এই গরমেও আজকে তাঁর টাই পরে আসার কারণ। তিনি আজ ডিউটি অফিসার ছিলেন। ছিলেন বলছি – কারণ ছুটি হয়ে যাবার পর ডিউটি অফিসারের ডিউটিও নিশ্চয় শেষ হয়ে যায়। তবে কি আজ কলেজের কোন ছেলে পালিয়ে যাবার সময় ধরা পড়ে আমার নাম বলে দিয়েছে? কে কে ধরা পড়েছে জানতে ইচ্ছে করছে। কারণ এই বেকুবদের চিনে রাখা দরকার। কিন্তু ছোলাইমান স্যার খোলাসা করে বলছেন না ব্যাপারটা।
কীভাবে ধরলেন স্যার? জন পালাচ্ছিল?” – অনেকটা মোলায়েমভাবে জিজ্ঞেস করলাম ছোলাইমান স্যারকে।  
এক জন দুজন হলে তো ধরতে পারতাম না, এক সাথে দশ বারোজন পালাচ্ছিল। ছেলেরা তো আছেই। আপনি মেয়েদেরকেও কলেজ পালাতে উৎসাহ দিচ্ছেন?”
মেয়েরাও ছিল না কি?”
চারজন ছিল। সবগুলা সায়েন্সের। ভালো ভালো স্টুডেন্টগুলাকে আপনি এসব কী শেখাচ্ছেন?”
মনে মনে বললামশেখাতে আর পারলাম কই? ঠিকমতো শিখলে কি আর আপনার হাতে ধরা পড়ে?
আজ ক্লাসে কী যেন প্রসঙ্গে সালমান শাহ কথা উঠলো। বাংলা সিনেমায় ফিজিক্সের কোন সূত্র যে খাটে না এরকম কিছু কথা থেকেই সম্ভবত সিনেমার প্রসঙ্গ চলে এসেছিল। বিশেষ করে মারপিটের সময় হিরো কিংবা ভিলেন যেভাবে মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীতে উড়ে যায় তা দেখলে ফিজিক্সের সব সূত্র পালিয়ে যাবে
স্যার আপনি কি সিনেমা দেখেন?”
দেখি না মানে? সিনেমা না দেখলে আমার ভাত হজম হয় না। চট্টগ্রাম শহরে এমন কোন সিনেমা হল নেই যেখানে আমি সিনেমা দেখিনি।
সালমান শাহ্‌র সিনেমা দেখেন স্যার?” – ইকবাল প্রশ্ন করে
ইকবাল সালমান শাহ্‌ কাট দিছে।“ – কে যেন বললো পেছন থেকে
দেখলাম ইকবালের সাম্প্রতিক চুলের স্টাইল অনেকটা নায়ক সালমান শাহ্‌র মত হয়ে যাচ্ছে। বললাম, “দেখো, সামলে রাখতে পারো কি না। শেষে না নাসির-স্যার কাট দিতে হয়।
সবাই হেসে উঠতেই বললাম, “সালমান শাহ্‌র স্নেহ চলছে। দেখেছো নাকি? তোমাদের গেটের কাছেই কলেজের নামে সিনেমা হলআর সেখানে এখন সালমান শাহর সিনেমা চলছে। সেই সিনেমা তো অবশ্যই দেখা উচিত। তোমাদের এই হলে আমি অনেকবার সিনেমা দেখেছি।
এখন দেখেন না স্যার?”
এই হলে আর দেখি না। ভয়ে দেখি নাযদি তোমাদের কারো সাথে দেখা হয়ে যায়।
আবারো হাসির রোল উঠল ক্লাসে। সিনেমা দেখা কোন দোষের কিছু নয়। ক্লাস পালিয়ে সিনেমা দেখাটাও মারাত্মক কোন দোষের মধ্যে পড়ে বলে আমি মনে করি না। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে এধরনের কাজে যে থ্রিল থাকেঅনার্সের ক্লাসে সে ধরনের থ্রিল থাকে না। ফ্রিডম না থাকলে ফ্রিডম পাবার আনন্দ পাওয়া যায়। তাই এখন যা করলে আনন্দ পাওয়া যাবেতিন চার বছর পর সেই কাজে আর সেরকম আনন্দ পাওয়া যাবে না। আমি সরাসরি কাউকে বলিনি যে ক্লাস পালিয়ে সিনেমা দেখে এসো। তবে আমি যে অনেকবার ক্লাস না করে সিনেমা দেখেছি তা বলেছি। এখন দেখছি তারা দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বি সেকশানে তো আমার কোন ক্লাস ছিল না। তাই মেয়েরা যদি এই দলে জুটে গিয়ে থাকে তার দায় আমার নয়। সম্ভবত দুপুর সাড়ে বারোটার শো দেখতে চেয়েছিল তারা। তাই টিফিন আওয়ারে চলে যাচ্ছিল। ছোলাইমান স্যার দায়িত্ববান ডিউটি অফিসার হিসেবে তাদের ধরেছেন। সম্ভবত পুলিশী কায়দায় জেরা করেছেনএবং মন্ত্রণাদাতা হিসেবে আমার নাম পেয়েছেন। তাই ছোলাইমান স্যার আমাকে জেরা করছেন
আপনি ক্লাসে গান গেয়েছেন কেন?” – ছোলাইমান স্যার আবার প্রশ্ন করলেন। আমার কিছুটা বিরক্তি লাগতে শুরু করেছে। বাস আসতে আজ এত দেরি করছে কেন? বাসের জন্য কলেজের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। আজ টুনিও নেই যে বাস আসার খবর দেবে স্যাররা সবাই চলে গেছেন যে যার মতো। অঞ্জন স্যার চলে গেছেন স্টুডেন্টদের গাড়িতে, বিমল স্যার সুপাল স্যারও গেছেন তাঁর সাথে। সুচরিত স্যার এদিকে কোথাও প্রাইভেট পড়াতে শুরু করেছেন। তিনি সেখানে গেছেন। ডিউটি অফিসার না হলে ছোলাইমান স্যারও এতক্ষণে চলে যেতেন। কিন্তু আজ যেতে পারছেন না বলে আমার উপর রাগ ঝাড়ছেন। সিনেমার প্রসঙ্গ থেকে এবার আবার গানের প্রসঙ্গ চলে এসেছে। গান তো আজ দুই ক্লাসে গেয়েছিকোন্‌ ক্লাসের কথা বলছেন তিনি?
বিরক্তি লুকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, “কোন্‌ ক্লাসে?”
ক্লাস সেভেন বি, হ্যাঙ্গারে।
আপনি শুনেছেন?”
পাশের রুমেই আমার ক্লাস ছিল।
ওরা এত করে ধরলো, তাই গাইতে হলো।
ধরার সুযোগ দিলে তো ওরা ধরবেই। আপনার ভালোর জন্য বলছি। স্টুডেন্টদের এত লাই দেবেন না। তাছাড়া আপনি তো গান গাইতে জানেন না। ওরা যে আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তাও কি আপনি বোঝেন না?”
আহা, ছোলাইমান স্যার আমাকে নিয়ে কত্তো চিন্তা করছেন। স্টুডেন্টরা আমাকে নিয়ে যদি হাসাহাসি করে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, কিন্তু তিনি রেগে যাচ্ছেন
ক্লাসে গান গাওয়ার ব্যাপারটা আজকেই প্রথম ঘটলো। এত আগে বইয়ের সবকিছু শেষ করে ফেলা উচিত হয়নি। এখন তারা আর অংক করতে চাইছে না
আজ আমরা কী করবো” – জিজ্ঞেস করার আগেই সুব্রত বললো, “আপনি আমাদের কবিতা শোনাবেন।
আমি কবিতা শোনাতে জানি না।
আপনি ক্লাস টেনে কবিতা শুনিয়েছেন।
তুমি কীভাবে জানো?”
মৌসুমী বলেছে।
কোন্‌ মৌসুমী?”
ক্লাস টেনের
তাকে তুমি চেন?”
চিনি কি না জানি না। তবে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে সে আমার বোন।
এই পুঁচকে সুব্রত গম্ভীরভাবে এত দার্শনিক কথাবার্তা বলে যে চোখ বন্ধ করে শুনলে মনে হবে স্বয়ং সক্রেটিস বাংলা ভাষায় কথা বলছে
সে যাই হোক, আমি তোমাদের কবিতা শোনাবো না।
ঠিক আছে। কবিতা না, গান শোনাবেন স্যার।“ – রেহনুমা বললো। এই মেয়েটার মধ্যে এক ধরনের সহজাত লিডারশিপ আছে। সে ক্লাসের মনিটর নয়, অথচ তার কথা মনে হয় সবাই শোনে। সে বলেছে গানের কথা, এখন সবাই বলছেগান শোনাতে হবে
কী বিপদ রে বাবা। কবিতায় রাজি হয়ে যাওয়াই তো ভালো ছিল। কবিতা তো বই দেখে পড়ে দেয়া যায়। কিন্তু গান? গাইবো কীভাবে? আমার গলায় যে অসুরের বসবাস। ভাবলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পদ্ধতি প্রয়োগ করা যাক। সুনীল নাকি কোন শিল্পীর কাছ থেকে গান শুনতে ইচ্ছে করলে বেসুরো গলায় নিজেই গান ধরেন। তখন শিল্পী বিরক্ত হয়ে তাঁকে থামিয়ে নিজের গান শুরু করেন। এখন আমাকেও তাই করতে হবে। আমার গলা যে কতটা বেসুরে বাঁধা তা যদি এরা একবার জানে তাহলে আর জীবনে গান গাইতে বলবে না আমাকে। আমাকে গাহিয়া প্রমাণ করিতে হইবে যে আমি গাহিতে জানি না
গ্রাম ছাড়া রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে।…”
রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিজের কানেই আবদুল আলীমের ভাওয়াইয়া গানের মত লাগছিল।  ভেবেছিলাম আমাকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই থামিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু আমার গান শুনে এরা এতটাই নিশ্চুপ হয়ে গেল যে আমি হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলাম। সবাই কি একসাথে জ্ঞান হারালো? গানটির কথা দুই লাইনের বেশি আমি জানি না। দুই লাইনই গাইলাম তিন চার বার করে। কেউ কোন শব্দ করলো না। চুপচাপ সহ্য করলো। ধন্য তাদের সহ্যশক্তি। অবশ্য তাদের ভদ্রতাবোধও প্রবল। গান থামানোর পর গান সম্পর্কে একটা শব্দও বললো না। তারপর যে বর্গমূল ঘনমূলের অংক করার সময় তারাঅসহ্যবলে চিৎকার চেঁচামেচি করতোসেই অংকও নিঃশব্দে করে ফেললো। এখন মনে হচ্ছে আমার গানকে মিউজিক থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কোন ক্লাসকে যদি মুহুর্তে চুপ করাতে হয়এই মিউজিক থেরাপি হবে অব্যর্থ দাওয়াই
ক্লাস সেভেন বি সেকশানের সাথে সেকশানের দূরত্ব অনেক। বি সেকশান হ্যাঙ্গারের দোতলায়। মেইন বিল্ডিং থেকে হেঁটে যেতে প্রায় পাঁচ মিনিট লেগে যায়। কিন্তু সেকশানে আমার ক্লাসে কী কী ঘটে তা তারা কীভাবে যেন জেনে যায়। সম্ভবত টিফিন আওয়ারে তারা জেনে নেয়। বি সেকশানের সাথে আমার ক্লাস থাকে টিফিনের পর। আজ তাদের ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথেই ফেরদৌসী বললোআজ আমরা আপনার গান শুনবো স্যার।গম্ভীরভাবে বলার চেষ্টা করেও গম্ভীর থাকতে পারলো নাহেসে ফেললো। ফেরদৌসীকে আমি কখনো গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখিনি। সারাক্ষণই সে হাসছে। ক্লাসের মনিটর এরকম হাসিখুশি থাকলে সেই ক্লাসে সবাই অনবরত কথা বলবে, গল্পগুজব করবে, গন্ডগোল করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ক্লাসে সেটা হবার জো নেই। কারণ আরেক মনিটর আবদুল আলীম ভীষণ কড়া। তার চালচলন মেজাজ সবই মিলিটারিদের মত
আমি বললাম, “গান শুনতে হবে কেন? অন্য কিছু কেন নয়? গল্প কিংবা কবিতা?”
না স্যার, আমরা গান শুনবো।
কেন?”
সেকশানে আপনি গান শুনিয়েছেন।
তোমরা কীভাবে জানলে?”
ওরা বলেছে স্যার।
গান শুনে তাদের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা বলেনি?”
বলেছে স্যার। আমরা মিস করেছি বলেছে স্যার।
বুঝতে পারছি সেকশানের ছেলেমেয়েরা কী ধরনের শক্‌ড হয়েছে তা বি সেকশানকে বলেনি। বি সেকশানের জন্য মায়া হচ্ছে। না জেনে মিউজিক থেরাপি নিতে চাচ্ছে
দেখো, আমার গান তোমাদের সহ্য নাও হতে পারে।
না, স্যার, আমরা শুনবো স্যার।
কোন্‌ গান গাইবো?”
গ্রাম ছাড়া রাঙামাটির পথ
ওই গানটাই গাইতে হবে? অন্য কোন গান হবে না?”
না স্যার। আগে গ্রাম ছাড়া  - তারপর অন্য কিছু।
মনে মনে বললাম একবার আমার গ্রামছাড়া শুনলে একেবারে গান-ছাড়া হয়ে যাবে। মনোবিজ্ঞানীরা যেমন জানেন যে রোগীকে সম্মোহন করলেই রোগী ঘুমিয়ে পড়বে, আমিও সেরকম জানি যে গান ধরলেই সবাই শক্‌ড হয়ে নিশ্চুপ হয়ে যাবে। খুবই আত্মবিশ্বাস নিয়ে গান শুরু করলাম, “গ্রাম ছাড়া রাঙামাটির পথ
সারা ক্লাস দাঁত বের করে হাসতে শুরু করলো। নির্বাক নিশ্চুপ হওয়াতো দূরের কথা, মনে হচ্ছে অনেকেই গলা মেলাচ্ছে আমার সাথে। কী প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলাম, আর কী প্রতিক্রিয়া হলো। দেখা গেলো এই ক্লাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রতিক্রিয়া হলো। একটু পরে আমার গলা থেকে গান কেড়ে নিয়ে ছেলে-মেয়েরাই গাইতে শুরু করলো। আমার মিউজিক থেরাপি এই ক্লাসে ফেল করলো। ছোলাইমান স্যার পাশের ক্লাসে থেকে এই গান শুনেছেন
বাস এলো অনেক দেরি করেঅনেক বেশি মানুষ নিয়ে। টিচারদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। ম্যাডামরা কোনরকমে বসতে পেরেছেন। আমি আর ছোলাইমান স্যার জায়গা পেলাম অনেকটা পেছনের দিকে। ছোলাইমান স্যারের মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল। এখন আরো খারাপ হয়ে গেল। শাহীন সিনেমা হলের সামনে দিয়ে আসার সময় ভাবলাম ছোলাইমান স্যারকেস্নেহসিনেমার ব্যানার দেখাই। কিন্তু তিনি যেভাবে আমাকে বেশি-স্নেহ-দেখাতে-নেই বলে উপদেশ দিয়েছেনআমার আর সাহস হলো না
গুলজার সিনেমার সামনে বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। ছোলাইমান স্যার দ্রুত মিশে গেছেন মানুষের ভীড়ে। কোন্‌দিকে গেলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। লাইলুন্নাহার ম্যাডাম রিকশায় উঠতেই আমি হাঁটতে শুরু করলাম গুলজারের দিকে। এই হলের নাড়ি-নক্ষত্র আমি চিনি। সালমান শাহ্‌রস্নেহচলছে গত চার সপ্তাহ ধরে। বিশাল পোস্টারে সালমান শাহ, মৌসুমী, আলমগীর আর শাবানাকে দেখা যাচ্ছে। আজ সিনেমাটি দেখে নেয়া যাক। এই সাড়ে তিনটার শোতে আশা করি শাহীন কলেজের কোন স্টুডেন্ট থাকবে না। আচ্ছা টিচার হয়ে গেলেই স্টুডেন্টরা দেখে ফেলবে এরকম মনে হয় কেন সিনেমা দেখতে এলে? আমি মনে করি এটাও এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় সংস্কার। শিক্ষাঙ্গনের বাইরে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সাথে সহজ হতে না পারার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই
সিনেমা হলে ঢুকে বুঝতে পারলাম প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। এক প্যাকেট চানাচুর আর এক বোতল কোকাকোলা হলো দুপুরের খাবার। সিনেমা শেষে দিদির বাসায় যাবার প্ল্যান আছে। কিন্তু হল থেকে বের হয়ে মনে পড়লো আজ দিদিরা থাকবে না বাসায়। সুতরাং নিজের বাসার দিকে যাওয়া যাক। রিকশা নেবো, নাকি হেঁটে যাবো ভাবছিএমন সময় – “অ্যাই প্রদীপদাশুনে ফিরে তাকালাম
দেখলাম রঞ্জন চক্রবর্তী। আমাকে দেখে দৌড়ে এলো। তার পাশে আরো দুজনপাভেল আর বাবর। বাবরকে ইদানীং কলেজের ক্লাসে খুব একটা দেখি না। সেকেন্ড ইয়ার সিন্ড্রোমে ধরেছে হয়তো। কলেজের অনেকেই সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আর নিয়মিত ক্লাস করে না। প্রাইভেট পড়ে। শুনেছি চিটাগং কলেজ বা মহসিন কলেজে অনেকে একটা ক্লাসও করে না। শুধু প্রাইভেট পড়ে। কেরানিদের টাকা দিয়ে ক্লাসের উপস্থিতির হার ঠিক করে নেয়। শাহীন কলেজে তবুও এখনো অনেকেই ক্লাস করে
এখানে কী করছেন?” – রঞ্জন জিজ্ঞেস করলো
সিনেমা দেখে বের হলাম।
কী পাভেল, তোমাকে বলেছিলাম না এই মানুষটা একটা পাগল? হাহাহা। দেখলে তো? একটা কলেজের টিচারসিনেমা হল থেকে বের হচ্ছে সিনেমা দেখে। পাগল না হলে কেউ এই রকম সিনেমা দেখে? সালমান শাহ্‌ - যত্তসব। সিনেমার নাম কী? স্নেহফ্যাট ফ্যাট। হাহাহাহারঞ্জন হাহাহা করে হাসছে। বাবর পাভেল কী করবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে



Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts