Showing posts with label ছোটগল্প. Show all posts
Showing posts with label ছোটগল্প. Show all posts

Tuesday, 18 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - ইচ্ছাপূরণ


 ________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭

গল্প - ইচ্ছাপূরণ
_______________________________________

ইচ্ছাপূরণ


মহা দুশ্চিন্তায় আছেন সাইফুর রহমান খানপ্রায় দুবছর থেকে একটি কিডনী নষ্টসম্প্রতি সিঙ্গাপুরে ফলোআপে গিয়ে জানতে পেরেছেন অন্যটিও নষ্ট হওয়ার পথে। সুতরাং বাঁচতে হলে এবার তাকে কিডনী ট্রান্সপ্লানটেশন করতেই হবে। অথচ ব্যাপারটা ততো সহজ নয়। কত বয়স তার? মাত্র তেষট্টি। সুস্থ থাকতে পারলে কমপক্ষে আরো বিশবছর বাঁচবেন। যদিও হায়াত-মউত আল্লার হাতে। তবু সবার ওপরে বিশ্বাস করেন, টাকা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব। এমনকি হায়াতও।

          বালক বয়সে মুরুব্বিদের মুখে একটা প্রবাদ প্রায়ই শুনতেন- টাকার নাও পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলে।

     একদিন অবাক হয়ে দাদাকে প্রশ্ন করেছিলেন, "আচ্ছা দাদা, পাহাড়তো অনেক উঁচা তো নাও ভর্তি টাকা ক্যামনে পাহাড়ের উপর দিয়া চলব, নাও তো পানি ছাড়া চলে না।"

          দাদা ডাব্বা হুঁকা টানতে টানতে হেসে উঠেছিলেন নাতির কথা শুনে। তারপর বলেছিলেন, "এইটা হইল, একটা দৃষ্টান্ত। যার মাইনে হচ্ছে ট্যাকা থাকলে অসম্ভবরেও সম্ভব করন যায়।"

          আজ সাইফুল নিজেও এই প্রবচনটি শতভাগ নয় সহস্রভাগ বিশ্বাস করেন। টাকা থাকার কারণেইতো বার বার সিঙ্গাপুর ব্যাংককে চিকিৎসা নিতে পারছেন। কোটি টাকা খরচ করছেন। অথচ পাঁচশ টাকার অভাবে কত মানুষ এক ফাইল ওষুধ খেতে পারছে না। নাহ, এসব সেন্টিমেন্টাল ভাবনা সাইফুর ভাবেন না। তার এখন একটাই ভাবনা মিল মত কিডনি কার কাছে পাবেন। ঠারেঠোরে আত্মীয়স্বজনদের কাছে চেয়েছিলেন। রক্তের সম্পর্ক হলে ভাইবোন বা ছেলেমেয়েরা দিতে পারে। (সরকার আবার আইন করেছে কিডনি কেনাবেচা করা যাবে না। যত্তোসব।) অনেক টাকার অফারও দিয়েছিলেন। কিন্তু গরীব ফুপাতো বোনটিও রাজি হয়নি। ভগ্নিপতিটি আবার গলা ফুলিয়ে বলেছে- গরীব হইছি বইলা কি আমাগো জীবনের মূল্য নাই!

          আরে গাধা। টাকা না থাকলে জীবনের মূল্য কী? একটা কিডনির বদলে আমি যা দিতাম তা তোর চৌদ্দপুরুষও কল্পনা করতে পারত না।

          ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠতেই দ্রুত রিসিভ করলেন।

          -হ্যাঁ, গফুর কি খবর?

          -খবর বেশি ভালও না আবার খারাপও না স্যার।

          -এত প্যাঁচাও কেন মিয়া? সোজাসুজি বল। তিনদিন হল তুমি গেছ কোন           আশার কথাতো শোনাতে পারনি।

          -স্যার, এইটা কি এত সহজ কাজ! একদিকে সরকারের আইন, অন্যদিকে এলাকার মানুষের সন্দেহ হইলে আমারে দিব ফাটকে ঢুকাইয়া। এমনকি আজকাল মানুষ যেভাবে গণপিটুনি দেয়- তখন কি হইব স্যার।

          -কিচ্ছু হবে না। তুমি তাড়াতাড়ি জানাও প্রোগ্রেস কদ্দূর। নাহলে তোমার চাকরি নট হবে।

          ফোনটা কেটে দিলেন। বললেন, চাকরি নট। কিন্তু তার কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। দেশে কিডনী পাচারচক্র সক্রিয়। বহুসংখ্যাক দালাল আর ক্লিনিক এর সাথে জড়িত। কখনও পাশের দেশেও চালান করে দেয়। এদিকে সরকার আইন করে কিডনী কেনাবেচা নিষিদ্ধ করেছে। যত্তোসব ফালতু। একটা সুস্থ কিডনী নিয়ে মানুষ দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে। কারো কারো নাকি জন্মগতভাবে একটা কিডনিও থাকে। সেও দিব্বি বেঁচে থাকে।

          আবার ফোন বেজে ওঠে। এবার রংপুর থেকে হারিছ ফোন করেছে।

          -বলো হারিছ

          -সালামালেকুম স্যার।

          -ওয়ালাইকুম। সময় নষ্ট করোনা আসল কথা বলো।

          -পাওয়া গেছে স্যার।

          -কি মহিলা না পুরুষ?

          -দুইটাই স্যার। একজন পুরুষ একজন মহিলা।

          -বেশ ভাল কথা। কি কথাবার্তা হল তাদের সাথে।

          -আমি এখনও সরাসরি কথা বলি নাই। যে দালালকে লাগাইছি সে কথা চালাইতেছে। স্যার!

          -হ্যাঁ বলো।

          -আমারে তো এইখানে কম করে আরো চারপাঁচদিন থাকতে হবে। টাকা পয়সার একটু টানাটানি হইতেছে।

          -কেন, তোমাকে না যাওয়ার সময় পাঁচহাজার টাকা দিলাম!



          -আমার খরচ আর লোকজনরে চা সিগ্রেট খাওয়াইতে গিয়া টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন সাতশ টাকার মত আছে। চা-দোকানে, হাটে-বাজারে না বসলে একটু গল্পগুজব না করলে তো খবর বাইর করা যায় না।

          -ঠিক আছে, ঠিক আছে। আরো তিনহাজার টাকা বিকাশ করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

          -স্যার আরেকটু বেশি দিয়েন।

          -না, না। আর দিতে পারব না। এভাবে সবাইকে দিতে গেলে আমিতো ফতুর হয়ে যাব। কাজ ঠিকমত কর তাহলে যা চাও পাবে।

          ফোন কেটে দেন সাইফুর রহমান।

          -ব্যাটা না দিয়া যাইব কই! জানের মায়া বড় মায়া। আজকে না দাও কালকে দিবা। আমি হারিছ ভূঞা। কিডনীর দালালী করে দশ বছর কাটাইলাম। তোমাদের মত বড়লোকদের চেনা আছে। গাই দোহানোর মত তোমাদের দিনে দিনে দুইতে হয়।

          সোবহান যোগাযোগ করছে না দুদিন থেকে। অথচ এসব কাজে সেইই সবচেয়ে বিশ্বস্ত। টাকা কিছু বেশি খায় কিন্তু কোন কাজ দিলে সেটা যেভাবেই হোক সে করবেই। হিলি বন্দর থেকে টেকনাফের ইয়াবার চালান সবই সে নিখুঁতভাবে করে।

          কিছুটা চিন্তিত মনে সোবহানের নাম্বারে কল দিলেন। রিং বাজছে ...। কপালে ভাঁজ সাইফুর রহমানের। কী ব্যাপার, কোথাও কি ফেঁসে গেল? তাহলেওতো জানার কথা। প্রশাসন আর পুলিশ-বিজিবির সবখানেইতো তার লোক আছে। কিছু হলে অন্তত খবর তো আসবে।

          অপেক্ষা করে করে তিনবার কল করার পর যখন হতাশ হয়ে পড়লেন তখনই ফোন বেজে উঠল। সোবহানের নম্বর! তাড়াতাড়ি রিসিভ করলেন।      -সোবহান-

          -জী স্যার।

          -কি খবর। তোমার পাত্তা নেই কেন? দুদিন হয়ে গেল।

          -আমার ডায়রিয়া হয়েছে স্যার। গত দুদিন থেকে কেবল পায়খানায় যাচ্ছি আর আসছি। এখনও পায়খানা থেকে এলাম।

          -ডাক্তার দেখিয়েছ? কি খেয়ে এমন অসুখ বাঁধালে?

          -দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছে হাসপাতালে ভর্তি হতে। এখানকার ভাণ্ডারিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

          -তাহলে হচ্ছনা কেন? টাকা-পয়সা যা লাগে বিকাশ করে দেব।

          -না স্যার। যেখানে সেখানে হাসপাতালে ভর্তি হলে বিপদ আছে। চিন্তা করবেন না। স্যালাইন খাচ্ছি। ওষুধ খাচ্ছি। আশা করি আজকের মধ্যে কমে যাবে।

          -কিন্তু তোমার কাজের কদ্দূর? এ অবস্থায় কিভাবে কাজ করবে।

          -অসুবিধা নাই। আমার লোকজনতো খোঁজ খবর করছে আমি অসুস্থ হইলেও তারাতো বসে নাই।

          -আচ্ছা আচ্ছে সবার আগে তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।

          ফোনটা রেখে মাথার চুলগুলো দুহাতে মুঠো করে ধরলেন। ভাবলেন, আর কতদিন আয়ু আছে? নিজের হাতে গড়া এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল মাল্টি বিজনেস কোম্পানির কী হবে?

          একটু দেরিতেই বিয়ে করেছেন সাইফুর। প্রথম দুটো মেয়ে তারপর একমাত্র ছেলে রাইয়ান। তার এশিয়া ইন্টারন্যাশনালের উত্তরাধিকারী। কিন্তু ছেলে মাত্র ও লেভেল শেষ করে এ লেভেল পড়ছে। এসময়ে তার কিছু হলে ব্যবসার হাল ধরবে কে? ছোটমেয়ে ইংল্যান্ডে লেখাপড়া করছে। কবে ফিরে না ফিরে তার ঠিক নেই। বড়মেয়ের জামাইয়ের নিজেরই ব্যবসা আছে তাছাড়া যতই হোক জামাই- পরের ছেলে। কথায় আছে যম-জামাই-ভাগনা এই তিন নয় আপনা। শেষে দেখা যাবে নিজের ছেলেই দেউলিয়া হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে।

          সেলফোন বেজে উঠল- জসীম!

          -জী স্যার।

          -কোন খবর আছে?

          -আছে স্যার। সুখবর।

          -সুখবর?

          -জী স্যার তিনজনরে পাওয়া গেছে। দুইজন পুরুষ একজন মহিলা।

          -তারা রাজি?

          -রাজি স্যার। তবে টাকা বেশি চায়।

          -কত?

          -বার লাখের কমে রাজি হয় না। পুরুষটাতো পনের লাখ চায়।

          -কি বল- এত টাকা? ওদের ধারণা আছে টাকা সম্পর্কে, কিভাবে টাকা রোজগার করতে হয়?

          -স্যার ভুলে যাবেন না, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। সব তথ্য সবাই জানে। টেলিভিশনে দেখে। তো মানুষটা আমারে কইল, বেআইনী কাম করুম, আবার জীবনেরও ঝুঁকি আছে, উনি বাঁইচলে আমিতো মইরা যাইতেও পারি তখন আমার পরিবারের কি অইব।

          -ফালাও এসব সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা। বলে দাও যারটা মিলবে এবং নেয়া হবে তাকে আট লাখ টাকা দেব। এটা ফাইনাল আর বাকিদের ঢাকা আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া খরচ আর জনপ্রতি দশহাজার করে দেব। আর এসব বেকুবদের বুঝাও এই ফাঁকে বিনামূল্যে তাদের একটা চেকআপও হয়ে যাবে।

          -আচ্ছা স্যার।

          -আচ্ছা স্যার না। তাড়াতাড়ি করো। তোমাদেরকেও বোনাস দেব বলেছি, মনে আছে।

          -জ্বী।

          -হ্যাঁ মনে রাখবে। এখন রাখি আমাকে এখন হায়াত রিজেন্সিতে যেতে হবে চায়না থেকে ডেলিগেট আসবে। আজকে আর আমাকে ফোন করবে না। কাল সকাল দশটায় আমি তোমাদের কাছ থেকে ফলো আপ নেব।

          সাইফুর গার্মেন্টসের গেস্ট হাউসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একে একে ওরা দশজন যখন এসে পৌঁছাল তখন কেউ কাউকে চেনে না। ভুরুঙ্গামারীর করিমন বেওয়া তখনও গুনগুন করে কাঁদছে। একমাত্র ছাওয়াল রমজান তারে কুনখানে পাঠাইল? মা, বেড়াই আসো, জেবনেতো কিছুক দেখ নাই এইবার এই উছিলায় ঢাকা শহরখান দেইছে আস না কেনে।

          -ঢাকা শহর কুনঠে বাপ, কত দূরে তোদের ফেলাইয়া এত দূরে যাইতে হামাক মন চায় না

          -কিচ্ছু হইব না মা গিয়া দেখন তোমার লাহান আরও অনেক বেটিছাওয়াল যাবা। কুনো ভয় নাই।

          নতুন জুতা, জামা-কাপড় কিনে দিয়েছে ছেলে। জীবনে এতকিছু একসাথে কখনও পায় নাই। এমনকি সেই এগারো বছর বয়সে যখন বিয়া দিছিল বাপ তখনও খালিপায়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল।

          -এই যে আফা নামেন। তাড়াতাড়ি নামেন। নিজের ইচ্ছায় আইছেন, অহন কান্দেন ক্যা? একজন মহিলা এসে ঝাঁঝালো গলায় করিমনকে বকা দিতে দিতে হাত ধরে টেনে নামাতে চেষ্টা করল।

          -হ আফা, আপনে না নামলে আমিতো নামতে পারতাছি না। সেই কতক্ষণ থেইকা গাড়িতে বইসা আছি। আমার বমি বমি লাগতেছে।

          সামনে পিছনে তাড়া খেয়ে টলতে টলতে গাড়ি থেকে নেমে এল করিমন। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার অবসাদ কাটার আগেই অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল সামনে এক বিশাল রাজবাড়ি।

          -তাইলে হামাক রাজবাড়ি দেখাইতে পাঠাইল সাওয়াল, বাপরে তুই বহুতদিন বাঁচুক। কিন্তুক চক্ষে পানি আহে ক্যান, কান্দন ক্যান আহে- করিমন বুঝতে পারে না।

          গেস্ট হাউজে একে একে দশজন আসার পর তাদের নিজেদের মধ্যে চেনা পরিচয়ের পালা শুরু হল। এদের মাঝে চারজন মহিলা, চারজন মধ্যবয়সী পুরুষ আর দুজন জোয়ান ছোকরা।

          পুরুষ আর নারীদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নারীরা দুদিনের মধ্যেই ওরা পরস্পরের আপন হয়ে গেল। যার যার ভাষার আঞ্চলিকতা সত্ত্বেও তারা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নিবিড় সখ্য গড়ে তুলে। নিজেদের সুখ দুঃখের কাহিনী একে অপরের কাছে বর্ণনা করে সময় কাটাতে শুরু করল।

          করিমন বেওয়া নামাজ পড়ে আর গুনগুন করে কাঁদে। নোয়াখালীর হাসনা বানু তাকে বুঝায়, খালা কান্দেন ক্যান। কান্দি কি অইব? আমরা ব্যাকেই তো ঠ্যাকায় আইছি।

          -হামি কুনো ঠেকায় আসি নাই। হামাক সাওয়াল ট্যাকার লোভে মোকো মরিবার পাঠাইল।

          আবার হু হু করে কান্দে।

          -আরে হুনেন। আপ্নের পোলা চালাক। টেয়া-হইসা অইলে অভাব যাইবো হিয়ার লাই মায়েরে কামে লাগাইল। অসুবিদা কী? একখান কিডনী লইয়াই মানুষ বাঁচে, বহুদিন বাঁচি থাইকতে পারে। তই এইবার আপ্নে কন, টেহাও পাইলেন আবার এক্কেনা সুখের মুকও দেকলেন। আর আসল কতা আন্নের কিডনি ম্যাছ অয় কিনা হেইডাই ব্যাপার। না অইলে যেমন বান্দা তেমন দ্যাশে চলি যাইবেন। কান্দিয়েননা খালা। আইয়েন আন্নের মাতাত ত্যাল দিয়া দিই। আরাম অইব, ঘুম অইব।

          করিমন বেওয়ারে সান্ত্বনা দিলেও হাসনাবানু নিজেরই মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা হয়। কিডনীতো নিজের ইচ্ছায় দিতে এসেছে। নোয়াখালীর সেই সুবর্ণচর থেকে এসেছে, স্বামীর চিকিৎসার টাকার যোগাড় করতে। যেদিন দালাল আবদুল আলীম সকিনারে তার বাড়ি পাঠিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেদিন শুনে প্রথম থ বনে গিয়েছিল, হাসনা বানু।

          দশ লক্ষ টাকা! সে কত টাকা? এত টাকা দিয়ে কী করবে? পরে সকিনা যখন তাকে বুঝালো স্বামী হালিমের সুচিকিৎসা, তার সুস্থতা, মেয়েদের লেখাপড়া, ভিটায় টিনের ঘর তখন নিজের সাথে অনেক লড়াই করে হাসনা বানু কিডনী বিক্রিতে রাজিতে হয়েছে। তারপর একদিন নিজের সাহসে ভর করে রাতের বেলা আব্দুল আলীমের সাথে বাসে চড়েছে। হাসনাবানু জানে এসব নিয়ে গ্রামে অনেক কথা হবে কিন্তু সে এসবের তোয়াক্কা করে না। সবাই টাকার বশ। যদি দশ লাখ টাকা পায় তাহলে মেম্বারকে হাজার দু হাজার দিলে সবার মুখ বন্ধ হবে। শুধু খারাপ লাগে যখন কিশোরী মেয়ে দুটো আর তাদের বাপের কথা মনে পড়ে। কিন্তু জীবনযুদ্ধে যুঝতে যুঝতে এখন অনেক সাহসী হয়েছে হাসনা বানু। তাছাড়া টিকে থাকার সহজাত যুদ্ধ তার বুদ্ধিকেও ধারাল করেছে। এখন একটাই আশা, কিডনীটা সাহেবের সাথে মিলে গেলেই হয়। সবাইকে সান্ত্বনা দিলে সে কায়মনে প্রার্থনা করে তার কিডনীটাই যেন মিলে। হে খোদা, আল্লাহ এই একবার জীবনে একটা সুযোগ দাও।

          হাবীব আর মানিকের দিন কাটছে মহাসুখে। গেস্ট হাউসের বড় রুমটাতে দেয়াল জোড়া টেলিভিশন। সেখানে সারাক্ষণ সিনেমা গান চলছে। হাউজ কিপার সকাল আটটার দিকে টিভি ছেড়ে দেয়। তারপর রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা চলে। প্রথম প্রথম রিমোট ব্যবহার করতে জানত না, এখন শিখে গেছে। সারাদিন দুজনে বসে ইচ্ছে মত সিনেমা দেখে। গ্রামের হাটে-বাজারে যে টেলিভিশন দেখেছে সেগুলোকে এখন একদম ফালতু মনে হয়। দুজনে গল্প করে।

          হাবীব মা-বাবাকে বলে আসেনি। বলে আসেনি তার পরাণপাখি টুনটুনিকেও। কারণ বাবা-মা, টুনটুনি কেউ এ ব্যাপারটা জানলে তাকে আসতে দিত না। আসার সময় বলেছে, দ্যাশে তো তেমন কাম-কাইজ নাই। দেখি ঢাকা গিয়া যদি কোন ভাল কাম জুটাইতে পারি। শুনছি ঢাকা শহরে নাকি ট্যাকা উড়ে।

          টুনটুনি কান্নাকাটি করেছিল, বাপে যদি আমারে বিয়া দিয়া দেয়, তুমি না থাকলে বাধা দিব কে?

          এসব কথায় হাবীব দমেনি, বলেছে, তাইলে সিনেমার নায়িকার মতন জামাইর কাছ থেইকা ছিনাইয়া আইন্যা তোরে আমি বিয়া করুম। একটুও ডরাইস না।

          টুনটুনিকে আশ্বাস দিতে দিতে হাবীবের মাথায় তখন ঘুরছিল সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব কত কত দেশে মানুষ যায়। হাবীবের বন্ধু-বান্ধব, সমবয়সীরা গিয়েছে। তাদের বাপের জায়গা-জমি বিক্রি করে গেছে। আবার টাকা পাঠিয়ে কিনেছেও। কিন্তু তার বাপের ভিটেখানাও নেই। কোনরকমে বেড়িবাঁধের ওপর একটা ছাউনির নিচে বসবাস। তবু ব্র্যাকের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল, মাথাটাও ভাল ছিল। কিন্তু সুযোগ ছিল না। লক্ষ্যহীন অনির্দিষ্ট কাজ আজ এটা কাল ওটা করে বাইশ বছরের জীবন কেটেছে। সন্ধ্যার পর একটাই কাজ ছিল এলাকার হাটে-বাজারে নিয়মিত টেলিভশন দেখত। খবর শুনতে, পত্রিকা পড়তেও ভাল লাগত হাবীবের। তাই নিজে থেকেই অনেক কিছু জেনেছে। তাই এলাকার আলতাফ আলী যখন আড়ালে ডেকে কথাটা বলেছিল। তখন সিঙ্গাপুর নামটা শুনে চমকে উঠেছিল। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, আবুধাবী, সৌদি আরব কত জন যায়! মাথার মধ্যে ঘুরছিল সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর----- একবার যদি যাইতে পারি। সারাদিন একসাথে থাকলেও হাবীব ভুলেও মানিকের সাথে এসব আলাপ করে না। মানিককে একটু হাবাগোবাই মনে হয় হাবীবের। মা বাপ নেই। মামা-মামীর বুদ্ধিতে এসেছে।

          ঢাকার সবচেয়ে নামকরা কিডনী হাসপাতালে প্রতিদিনই ওদের দু-তিনজনকে নিয়ে টেস্ট করা হয়। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যাদের সাথে সবকিছু ম্যাচ করবে তাদের তিনজনকে সাথে নিয়ে সিঙ্গাপুর উড়াল দেবেন আশরাফ উদ্দীন। সঙ্গে যাবে স্ত্রী বড়ছেলে আর কোম্পানীর এডিশনাল ম্যানেজার মাহবুব আলী।

          যেদিন টেস্ট করতে যাওয়ার কথা তার আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই জায়নামাযে বসে থাকেন বশীরুল্লাহ। আল্লার কাছে তার একটাই প্রার্থনা, তার কিডনীটি যেন সাহেবের সাথে মিলে যায়। অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান বশীর। যমুনার ভাঙনে এই মধ্যবয়সে ঘরবাড়ি হারিয়ে সরকারের আশ্রায়ন প্রকল্পে ঠাঁই নিয়েছেন। বড়ো কষ্টের এ জীবন। স্বচ্ছল জীবনে অভ্যস্ত সর্বস্ব হারানো এই মানুষটির একটাই স্বপ্ন সর্বনাশী যমুনার পার থেকে অনেক দূরে গিয়ে পরিবারের জন্য অন্তত একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়বেন, নিজের নতুন ঠিকানা হবে। আল্লাহ তুমি মহান আমাকে এটুকু দয়া করো। এতে যদি মরণও আসে তাতেও কোন আফসোস থাকবে না। টাকাটা পেলে অন্তত তার সন্তানেরা বাঁচবে। বিড়বিড় করে মোনাজাতের সময় তার দুচোখ থেকে অবিরত অশ্রু ঝরে।

          প্রার্থনা শেষ হলে ঝালকাঠির হাশেম জানতে চায়- আফনে এত কান্দেন ক্যান ভাইসাব। মোরা হক্কলেই আইছি ট্যাকা-পয়সার লাগি, জীবনের বিপদও আছে হেইডাও জানি। কিন্তুক কেউতো এমুন কান্দে না।

          -হ, ভাইজান, আমি কান্দি আমার দুঃখে, আমার কষ্টে- বলতে বলতে হু হু করে আরও কাঁদেন।

          তার সঙ্গী বাকি দুজন চেয়ে থাকে। তাদের বুকও চিনচিন করে-খোদা না খাস্তা যদি কোন বিপদ ঘটে যায়!

          -নাহ ডাক্তার সাহেব কইছেন, এহন এসবে কোন বিপদ নাই! বিপদ না থাকলে আর জুইড়া গেলে- অনেক টাকা!

          বাকি দুজন গোপনে প্রাণপণ প্রার্থনা করে হে আল্লাহ তুমি আশার আলো, আমারে নিরাশ কইরো না। দশলাখ টাকা! যদি পাই, যদি পাই! একজন ভাবে যৌতুকের লাইগা মেয়েটারে জামাই এত অইত্যাচার করে হারামজাদারে কিছু ট্যাকা দিয়া যদি মুখ বন্ধ করণ যায়।

          অন্যজন ভাবে, বন্ধকী জমি আর হালের বলদটা ছাড়ান গেলে দুনিয়াতে আর কুন অবাব নাই এত সুখের জেবন কি হাঁছাই ধরা দিব

          শুধু কোন কথা বলে না বিধু চাকমা। নাইক্ষ্যংছড়ির যেখান থেকে সে এসেছে তার সেখানকার ভাষার সঙ্গে এদের ভাষার দূরত্ব অনেক তাই অহর্নিশ তার ভিতরে বোবা কান্না গুমরে মরে। এখানে আসার পর থেকেই তার ভিতরে একটাই প্রশ্ন- ঠিক করলাম না ভুল!

          অবশেষে তিনজনের কিডনি সবদিক থেকে ম্যাচ করল। হাবীব, বশিরুল্লাহ আর কল্পনার। মেয়েদের মধ্যে যে অল্পবয়সী বিধবা মেয়েটি বিষণ্ণ চুপচাপ থাকত সেই জিতে গেল। হাসনাবানুর বুকের ভিতরটা জ্বলে যায়। এতদূর এসেও ভাগ্য তার হাতে ধরা দিল না। সব আশা সব স্বপ্ন মাটি। যেদিন হাসপাতালের ডাক্তারসাহেব এ কথাটা জানালেন, হাসনাবানুর ইচ্ছে করছিল এই ঢাকা শহরেই কোন একটা গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিতে। কিন্তু যে গাড়িতে ফিরেছিল, সেটার দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। কালো কাচে ঢাকা সেই গাড়িতে এসি চললেও তার মাথায় তখন হাবিয়া দোজখের আগুন জ্বলছিল।

          হাবীব বেজায় খুশি। তার ভিতরে একটাই উত্তেজনা একবার সিঙ্গাপুর যেতে পারলেই হল। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে চম্পট দেবে। তারপর কোথাও না কোথাও বাঙালীভাইদের খুঁজে পাবে। কিডনী সে দিতে চায় না। এই জোয়ান বয়সে কিডনী দিয়ে মরবে নাকি! সিঙ্গাপুর যেতে পারলে দশ লাখ টাকাতো কিছুই না। হাবীব নিজেকে যতই জ্ঞানী ভাবুক সে জানে না সিঙ্গাপুরের আইন আর সাইফুর রহমানদের লম্বা হাতের কথা। তাই পাসপোর্ট-ভিসা ইত্যাদির প্রক্রিয়ায় যে কদিন দেরি হয় তাতেই সে অস্থির হয়ে পড়ে।

          করিমন বেওয়া দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে। কোথায় কোন দেশে যে তাকে যেতে হয়নি তার জন্য শোকর গুজরান করে। নীলুবেগম যেমন চুপচাপ এসেছিল তেমনি চুপচাপ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। স্বামীর প্রথম স্ত্রী এবং নিঃসন্তান হয়ে তার জীবনে কোন আশা-আকাঙ্ক্ষা নেই। স্বামীর ইচ্ছায় এসেছিল এখন ফিরে গিয়ে আরো হেনস্থা হতে হবে। যার যা কপাল- ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।

          যারা ফেরত যাচ্ছে তারা একে একে গাড়িতে ওঠে। হাসনা বানুর আবদুল আলীমের কাছে পাওনা দশহাজার টাকা চাইলে সে খেঁকিয়ে ওঠে- আগে বাড়িত যাও। ওরা সাতজন চলে যেতে বিশাল গেস্ট হাউসটা খালি হয়ে যায়। মানিকের জন্য হাবীবের মনটা কেমন করে। বুকের ভেতরটা আকুলি বিকুলি করে টুনটুনি আর বাপ-মায়ের জন্য কিন্তু সিঙ্গাপুর যাবার স্বপ্নে সেসব ভুলতে তার দেরি হয় না।

          দীর্ঘ তিনমাস সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে কাটিয়ে সাইফুর রহমান খান যখন ফিরে আসেন তখন অফিসের লোকদের কাছে তাকে অনেক তরতাজা লাগে। হাবীব আর কল্পনা আগেই ফিরে এসেছে। বশীরুল্লাহও ফিরেছে তাদের কিছুদিন পর। তবে সপ্রাণ নয়। তার নিষ্প্রাণ দেহটা বাংলাদেশ এসেছিল। তার কিডনী দুটি সবচেয়ে সুস্থ ছিল। কিন্তু একটি কিডনী দেয়ার পরই তার অপর কিডনীটি আকস্মিক ফেইলিওর হয়।

          বশীরউল্লাহর ছেলেরা বাপের মৃত্যুতেও সুখী- তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।


রিফাৎ আরার ছোটগল্প - পড়শী

 


______________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭

গল্প - পড়শী
______________________________________

পড়শী


কম্পাউন্ডের গেটের ছোট দরজাটা খুলতেই রান্নাঘরের জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেন আফরোজা। চারতলার ফারহানা ভাবী ঢুকছে। তোয়ালেতে হাত মুছে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালেন। খট খট শব্দে স্যান্ডেলের আওয়াজ তুলে ফারহানা উঠে আসছে। দোতলার ল্যান্ডিং থেকে ওপরের দিকে চোখ তুলতে দুজনার চোখাচোখি হল। ফারহানা হাসল, ক্লান্তির ছাপ হাসিতে। আফরোজাও হাসল। সদ্যস্নাত আফরোজার হাসিতে সজীবতা।

          -ভাবী, এইমাত্র এলেন?

          -জী, ভাবী।

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতেই তাকে বলতে হল।

          -আজ এত দেরি যে।

          -রাস্তায় জ্যাম ছিল।

বলতে বলতে দুজনে মুখোমুখি হয়ে আবার হাসি বিনিময় হল। ফারহানা আসি বলে তিনতলার সিঁড়িতে পা রাখল। আফরোজা দরজায় দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ তার চলে যাওয়া দেখল।

          আফরোজার এটা একটা নেশার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালবেলা যখন ফারহানা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে বাড়ির কম্পাউন্ডটা অতিক্রম করে তখনও রুটি-পরোটা ভাজতে ভাজতে কিংবা আলুভাজিতে খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। একটা নেশার মত হয়ে গেছে আফরোজার। তিনতলার ফারহানার ব্যাগ আর আঁচল যখন বাতাসে দোল খায়, অথবা তার হাঁটার গতিতে দুলে উঠে তখন আফরোজার মনে হয় তার সামনে দিয়ে যেন একটা মুক্তির পতাকা উড়তে উড়তে মিলিয়ে গেল। গোপন একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে আফরোজা। তার মনে হয়, ফারহানার মত এমন মুক্ত স্বাধীন জীবন যদি তারও হত!

          যৌথ পরিবারে রক্ষণশীল মা-বাবা, চাচা-চাচীদের মাঝে বড় হয়েছে আফরোজা। সবসময় শুনতে হয়েছে মেয়েদের এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। এমনকি ওরা সব বোনেরা যখন স্কুলে যেত তখনও আকলিমা ফুপুকে তাদের সঙ্গে দেয়া হত। অথচ এলাকার মধ্যেই গার্লস স্কুল। তারপর কোনমতে ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর লেখাপড়া নেই। বিয়ে দিতে হলে বলতে হয় মেয়ে ম্যাট্রিক পাশ। এটুকু লেখাপড়া না থাকলে বরপক্ষ বিয়েতে রাজি হয় না। আবার বেশি শিক্ষিত শুনলেও পিছিয়ে যায়।

          তাই ম্যাট্রিক পাশের পরই অন্য বোনদের মত আফরোজাকে বিয়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল। মা-চাচীদের কাছ থেকে সাংসারিক কাজ শিখতে হয়েছিল।

          বিয়ের পর স্বামীর কাছে একদিন আবদার করেছিলেন, আমাকে একটু কলেজে ভর্তি করাও না। আমার খুব ইচ্ছে করে পড়াশোনা করতে।

          -তুমি পাগল হয়েছ? বিস্মিত কন্ঠে মনসুর বলেছিল। আব্বা-আম্মা একথা শুনলে রক্ষা আছে!

          -ওনারাতো গ্রামে আছেন। এখানে শহরে আমরা কি করছি না করছি তারা কিভাবে জানবেন।

          -শোন আফরোজা, এসব কথা চাপা থাকে না। তা হঠাৎ লেখাপড়ার ভূত চাপল কেন মাথায়?

          -ভূত চাপবে কেন, আমার আগে থেকেই ইচ্ছে করত কিন্তু আমাদের পরিবারেতো কেউ মেয়েদের বেশি লেখাপড়া পছন্দ করত না।

          -তাহলে বুঝে দ্যাখ, যা তোমাদের পরিবার পছন্দ করেনি আমার পরিবার কেন পছন্দ করবে! তাছাড়া তুমিও লেখাপড়া শিখে চাকরি করলে, সংসার সামলাবে কে?

          -কেন, আমরা দুজনেই সামলাব। তুমি আমাকে একটু সাহায্য সমর্থন দিলে আমি সব পারব।

          -বাহ, এখনই দেখি তোমার মুখে যে স্বাধীনতার বুলি ফুটছে, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়লেতো আমাকেই রান্নাঘরে পাঠিয়ে দেবে- বলতে বলতে হেসে উঠেছিল স্বামী মনসুর আহমেদ।

          সে হাসিতে বিদ্রুপ ছিল। স্বামীকে সেদিন নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল আফরোজার। অথচ মানুষটা তেমন খারাপ নয়। ঝগড়াঝাটি, কিছু গালমন্দ মিলিয়ে মোটামুটি ভালমানুষ। এসব কোন সংসারে নেই? বাপের সংসার, শ্বশুরবাড়ির সংসার সবখানেই এই দেখেছে। এর বাইরের জগৎ তার অজানা।

          কিন্তু কিছুদিন থেকে মাথার ওপরের নতুন প্রতিবেশী তার মনটাতে আবার আলোড়ন তুলেছে। আফরোজার অবদমিত আকাঙ্ক্ষা মনের ভিতর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

          ফারহানা ভাবীর অফিসে যাওয়া আসা, তার চলাফেরা সবকিছুই গোপনে পর্যবেক্ষণ করে সে। আর বিকেল গড়ানো দুপুরে যখন মহিলা ফিরে আসে তখনই সুযোগ পেলে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে স্বাধীন সুখী এই নারীটিকে কিছুটা ঈর্ষাও করে সে।

          সকাল সাড়ে আটটায় গাড়ি আসে। তার আগে সবকিছু দুহাতে যতটা সম্ভব সারতে হয় ফারহানাকে। বাচ্চা দুটোকে স্কুলের জন্য রেডি করা, নাস্তার টেবিলে আশরাফের জন্য নাস্তা রেডি করে রাখা, দুপুরে বাচ্চারা ফিরলে কি খাবে তা কাজের বুয়াকে পই পই করে মনে করিয়ে দেওয়া। তারপর বাচ্চাদের স্কুলের গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে অফিসের জন্য তৈরি হওয়া। অফিসে যাওয়ার আগে গোসল সারতে হয়। একটু ফ্রেশ হয়ে না গেলে সারাদিনই মনটা খুঁতখুঁত করে। চুল আঁচড়ানো, শাড়ি ঠিকঠাক করে পরা, হালকা লিপস্টিক বা একটু কাজল এইটুকু সাজ- তাও কত দৌড়ে ধাবড়ে করতে হয়। অথচ চাকরি করতে গেলে এটুকু না করলে নয়। আজকাল সর্বত্রই স্মার্টনেসের একটা ব্যাপার থাকে। যেনতেনভাবে চললে আয়া-পিয়নরাই পাত্তা দেয় না আর সহকর্মীরাতো----।

          অফিসে নারীকর্মীরা সবাই বেশ সাজগোজ করে আসে। প্রায় প্রতিদিনই কমপক্ষে আধঘন্টা এসব নিয়ে গ্যাঁজানো হয়। সাফিনা ফরিদাকে বলে আপনার শাড়িটাতো নতুন, কবে কিনলেন? অমনি সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে হ্যাঁ সত্যিইতো- কোথা থেকে কিনলেন, কবে কিনলেন আপা। কত দাম নিল। ফরিদা ততক্ষণে ফুলেফেঁপে ফাটার উপক্রম তবু গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলেন- টাঙ্গাইল শাড়িকুটির থেকে। সাড়ে তিনহাজার।

          -একটা সুতি শাড়ি সাড়ে তিনহাজার! মাগো, আপনার সাহস আছে। আমিতো ঐ দোকানের ধারে কাছেও যাই না। একদম গলা কাটে।

          -কিন্তু এক্সসেপশনাল কিছু পেতে হলে তোমাকে তো বেশি পে করতেই হবে তাই না- ফরিদা বলেন।

          এভাবে কোনদিন ঘড়ি, কোনদিন স্যান্ডেল আবার কোনদিন কানের দুল কিংবা হাতের চুড়ি নিয়ে মাতামাতি চলে। এটুকুই তাদের আনন্দ। কারণ তারা জানে অফিসে আসার আগে এতটুকু দম ফেলার সময় পায়নি কেউ। আবার অফিস থেকে ফিরেই বাচ্চাদের পড়াশোনার তদারকি করা, রান্নাবান্না করা, পারলে যাওয়ার সময় বাজার করে যাওয়া।

          উফ কেন যে লেখাপড়া শিখিয়েছিল বাবা-মা। মাথার ভিতর ছোট থেকেই ঘুনপোকা ঢুকিয়ে দিয়েছিল, মেয়ে নয়, মানুষ হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। শিক্ষক বাবার এ বাণীমন্ত্র জপতে জপতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরি পেতেও কি কম কষ্ট করতে হয়েছে! আর আশরাফকে দ্যাখ- ব্যাংকের কর্মকর্তা। আগে নটায় অফিস যেতে হত এখন সরকারের নতুন নিয়মে দশটায় যায়। যানজটের অজুহাতে এগারোটা বাজলেও ক্ষতি নেই। আর ফারহানাকে নারী অধিকার বিষয়ক এন.জি.ওতে নটার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে লালকালি মাসে তিনদিন লেটলতিফ হলে একদিনের বেতন কাটা

          বিরতিহীন দৌড়াতে দৌড়াতে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চাকরিটা ছেড়ে দিতে সংসারের এতসব দায়িত্ব, বাচ্চাদের দেখভাল, তাদের মানুষ করার দায়িত্ব, আবার মাঝে মাঝে গৃহকর্মীর সংকট সব মিলিয়ে হাঁফিয়ে ওঠে ইচ্ছে করে ধ্যাত্তেরি বলে চাকরির পায়ে লাথি মেরে সব ছেড়েছুড়ে সংসার করতে

          এই যে দোতলার আফরোজা ভাবী কি সুন্দর সংসার করেন। অফিস থেকে ফেরার সময় ঝড়োকাকের মত বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে যখন ফারহানা উঠে আসে তখন স্নানস্নিগ্ধ আফরোজা ভাবীকে দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন একটা ঈর্ষা জাগে। মনে হয়, আহারে কত শান্তি। আর আমার ঘরে বাইরে কোথাও শান্তি নেই কেবল কাজ, কাজ আর কাজ। তবু আশরাফ যদি একটু হেল্প করত, বোঝা কিছু কমত। কিন্তু সে তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি নিয়ে ব্যস্ত। ক্লায়েন্ট ধরতে হবে, পারসেন্টেজ কামাতে হবে। গাড়ি বাড়ি করতে হবে। এদেশের মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের যা স্বপ্ন। যদি কখনও ফারহানা বলে, চলো, এবার ছুটিতে কোথাও বেড়িয়ে আসি। বাচ্চারাতো এক দাদার বাড়ি আর নানার বাড়ি ছাড়া কিছুই দেখেনি। তখন ব্যাংকার আয়-ব্যয়ের হিসাব কষে ফারহানাকে বোঝাতে চেষ্টা করে ম্যাক্সিমাম-মিনিমাম কস্ট কত পড়বে। তারচে এভাবে টাকাটা জমলে একটা ফ্ল্যাট বুকিং দেয়া যাবে। তারপর একটা গাড়ি- হ্যাঁ তারপর আমরা বুড়োবুড়ি, হাতে ব্যাথা, গাঁটে ব্যাথা ইত্যাদি ইত্যাদি। কথায় কথা বাড়ে, বাড়ে তিক্ততা- ভাল লাগে না।

          মাঝে মাঝে দাম্পত্য কলহ হলে আশরাফ বলে, চাকরি ছেড়ে দিতে। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে থাকতে পারবে না। তাছাড়া নিজের স্বাধীনভাবে চলা, একটু কেনাকাটা, বাবামায়ের ওষুধের টাকা এসব খরচগুলোতো তাকে সামলাতে হয়। চাকরীজীবী বউ বলে ঈদে চাঁদেও আশরাফ তাকে নতুন কাপড় দেয় না। বাচ্চাদের স্কুলের খরচ ও সমানভাবে দুজনে শেয়ার করে। গেলবার কোরবানী ঈদে নতুন ডিপফ্রিজটা কেনার সময় দুজনকে সমান শেয়ার করতে হয়েছে।

          ফারহানা এসব কথা কাউকে বলতে পারে না। প্রেম করে বিয়ে করেছে। তখন শুধু ভালবাসার বায়বীয় মোহে কোনো কিছু ভাবেনি। বাবা-মা বলেছিলেন-দ্বিতীয়বার ভাবতে। কিন্তু ফারহানা ততদিনে কমিটমেন্টে চলে গেছে। তাই বলেছিল, ভাল হোক, মন্দ হোক কপালে যাই থাক আমি একেই বিয়ে করব। বাইরের দৃষ্টিতে ঠকেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স থেকে পাশ করা সিজিপিএ ভাল। প্রফেশনে ভাল করছে। সবাই প্রশংসা করে, কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয় কিন্তু কষ্টটা শুধু ফারহানার। শ্বশুর শাশুড়ি দুজনই চুড়ান্ত কৃপণ। প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের নিয়ে শাশুড়ির দেমাকের অন্ত নেই। ফারহানার সহজ-সরল বাবা-মায়ের সাথেও মহিলা এমনভাবে কথা বলে যেন ছেলের মা হয়ে উনিই একটা বিশেষ কিছু।

          বিয়ের পর প্রথম শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে নোংরা বাথরুম পায়খানা দেখে বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল সে। মনে হয়েছিল বাবার কথাই ঠিক। একজন মানুষকে দিয়ে তার পরিবেশ চেনা যায় না। তবু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে। তাদের মফস্বলের ছিমছাম ভাড়াবাড়িটার কথা মনে হয়ে অনেক কেঁদেছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আশরাফের জন্য ভালবাসা তাকে বারবার পরাজিত করেছে প্রতিবাদ করতে প্রচন্ড মনঃকষ্টেও সংসার ছেড়ে যেতে পারেনি। এখন তো ছেলে-মেয়ে জীবনযাপনের অভ্যস্ততা সবকিছু নিয়ে এমন আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা যে অন্যকিছু ভাবার প্রশ্নই ওঠে না।

          একেকসময় আশরাফের সঙ্গে খিটিমিটিও করে। সবকিছু যখন দুজনে শেয়ার করছি তখন ঘরের দিকটা তুমিও দ্যাখোনা কেন। এখন থেকে সপ্তায় তিনদিন তুমি রান্না করবে বাকি চারদিন আমি। আশরাফ শুনে হো হো করে হাসে, সে হাসির বিদ্রুপ ফারহানার কানে যেন গরম শীসা ঢালে। বলে, এন.জি.ও তে চাকরি করে খুব নারীবাদী হয়ে উঠেছ দেখি এরপর কি বলবে আমাকে হাতে বালা পরে থাকতে হবে!

          -দ্যাখো, নারী অধিকার আর পুরুষের হাতে বালা পরা এক জিনিস নয়। একটা শিক্ষিত মানুষ হয়ে তুমি এরকম যুক্তিহীন কথা বলছ কেন?

          -তাইতো আমি যুক্তিহীন, আর তুমি যুক্তিবাদী বেশ বেশ তাহলে আমাদের সংসারটাতো একটা বিতর্কের মঞ্চ হয়ে যাবে। ভেবে দেখ কি রকম হবে ব্যাপারটা! ফারহানা হকের যুক্তি শুনতে লোকে ছুটে আসবে।

          এমনসব অদ্ভুত আর বাজে কথা বলে যে, ফারহানার তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আর লুকিয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছু করার থাকে না। ভাবতে পারেনা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে আশরাফকে সে চিনত একি সেই! তখন কত কথা- পায়রার মত বাকম বাকম। ফারহানার যা পছন্দ তারও সেটাই পছন্দ দুশত ভাগ। অথচ ফারহানা বুঝতে পারে সে যে রিটায়ার্ড বাবাকে ওষুধের টাকা দেয়, ছোট ভাইটার টিউশনির খরচ দেয় সেটাও খুব বেশি পছন্দ করে না সে। আবার এটাও বোঝে এই একটা ক্ষেত্রে ফারহানা কখনও আপোষ করবে না। প্রয়োজনে গৃহত্যাগ করবে তাই ফ্ল্যাট বুকিং, গাড়ি কেনার জন্য সুযোগ পেলেই তার কানের কাছে তখন মন্ত্র জপে তখন কোন দুর্বল মুহূর্তেও সামান্য সায় দেয় না সে, শক্তভাবে জানিয়ে দেয়- আমার বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট চাই না।

          ফারহানা যে এন.জি.ও তে চাকরি করে সেখানেও একই সমস্যা নিয়ে কত অসহায় নারীরা আসে। স্বামীর অত্যাচার, দ্বিতীয় বিয়ে, যৌতুক, নির্যাতন, পরকীয়া এমন হাজারো সমস্যা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ভাই-বাবা বা প্রতিবশিনীর হাত ধরে যখন অভিযোগ করতে আসে তখনও অতীতের স্মৃতি আর ভবিষ্যৎ নির্যাতনের ভয়ে ওদের শরীরিটা মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে। একদিন শহর বানু নামে এক যুবতীবধু বলেছিল, আপা আপনাগো মত ভদ্রলোকেরা কত সুখে সংসার করেন আর আমরা লাথি গুঁতা খাইয়া মুখ বুঁইজা পইরা থাকি তাও সংসার করতে পারি না। শহর বানুর কথা শুনে ফারহানা আর তার সহকর্মীরা পরস্পর চোখ চাওয়া চাওয়ি করেছিল। তাদের পরস্পরের চোখে যেন প্রশ্ন ছিল-কথাটা কি সত্যি?

          ফারহানার মনে হয়েছিল ওরা নিরুপায় হয়ে সত্য প্রকাশ করে আর আমরা মিথ্যের মুখোশ পরে সত্যকে যত্ন করে লুকিয়ে রাখি। প্রকৃতপক্ষে ওরা আর আমরা একই সমতলে দাঁড়িয়ে। শুধু শ্রেণী বৈষম্য আর শিক্ষা আমাদের আরও কপট হতে শিখিয়েছে।

          আবার সুখের সংসারও কি নেই? আছে। ফারহানা নিজেই দেখেছে। ব্যাংক কর্মকর্তা বাবা আর তার গৃহিনী মা মিলেমিশে সংসারে যে পরিমন্ডল সৃষ্টি করেছিল তাতে তারা ভাই-বোন, দাদা-দাদী, চাচা-মামা-ফুপু সবাইকে নিয়েইতো সুখী ছিল। দাদা-দাদী যখন বাড়ি থেকে আসতেন ছোট ছোট পুঁটুলি বেঁধে নারকেল নাড়ু, মোরব্বা, গাছের চালতার আচার কতকিছু যে থাকত। সেগুলো আবার বড়বউ হওয়ার কারণে সবাইকে ভাগ করে দিতে হত মাকে। দাদা-দাদী বাসায় এলে বাসায় ফুপু চাচীরা আসত। চাচাতো ফুপাতো ভাইবোনরা মিলে কত মজা হত। আজ এই বাসায়, কাল ঐ বাসায়। আর পরীক্ষা শেষে বাড়ি গেলে সব্বাই মিলে পুকুরে ঝাঁপাঝাপি, উঠানে গোল হয়ে বসে দাদীর হাতের ভাপা পিঠা, পুলিপিঠা, পাটিসাপ্টা, দুধলাউ কতরকম খাবার। সকালে-বিকেলে সবাই মিলে পাড়া বেড়ানো-এখন সবই স্মৃতি সুফিয়া কামালের কবিতার মত কেবলই মনে পড়ে।

          আফরোজার মনটা একটুও ভাল নেই। মেয়ে আসমা এবার এইচ এস সি পাশ করেছে। আর্টস গ্রুপ/মানবিক শাখা থেকে জিপিএ ৪.৭০ পেয়েছে মানবিক শাখায় ভালই ফলাফল। তাই মেয়ের ইচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। অনার্স পড়বে। মেয়ের উৎসাহ দেখে স্বামীকে বলেছিলেন। কিন্তু শুনেই উড়িয়ে দিয়েছেন আরিফ- তুমি কি পাগল হলে আফরোজা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ে, তারপর কোন কান্ড করে নাক-কান কাটে।

          -কি বলছ তুমি। দুনিয়ার এত ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তাদের সবার বাবা-মায়ের কি নাক কান কাটা যাচ্ছে? এখন এরকম চিন্তা কেউ করে।

          -কেউ না করুক, আমি করি, তুমি মেয়ের কথা শুনে নাচতে যেও না।

          -ওর বান্ধবীরা পরীক্ষা দেবে।

          -দিক। সেটা ওদের মা বাবার সিদ্ধান্ত।

          -ঠিক আছে, যতদিন বিয়ে না হচ্ছে ততদিন পড়তে দাও আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলেইতো টিকে যাবে না, তখন মেয়ে নিজেই বুঝ মানবে।

          -এসব ফালতু কথা রাখো। ওকে বলো, আগে যেমন গার্লস স্কুল কলেজে পড়েছে এখনও তেমনি পড়বে। মেয়েদের যত লাই দেবে ততো মাথায় উঠবে।

          হঠাৎ যেন অগ্নিস্ফুরণ ঘটল আফরোজার ভিতরে।নিজের বেলায় যে স্বামীর কথা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মেনে নিয়েছিলেন আজ তা মানতে পারলেন না।

          -এই তোমার মত?

          -হ্যাঁ। এই আমার মত তুমি এবং তোমার মেয়ে জেনে রাখো। এর অন্যথা হবে না হতে পারে না।

          মুহূর্তে স্বামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন আফরোজা।

          -ইতর, ছোটলোক বলতে বলতে মনসুরের বুকের কাছে জামা খিমচে ধরলেন।

          আকস্মিক ঘটনার ধাক্কায় টলে গিয়ে মনসুরও তাকে আচমকা ধাক্কা দিতেই দেয়ালে ধাক্কা খেলেন। কিন্তু থামলেন না। চিৎকার করে বলতে থাকলেন- আমি সারাজীবন তোমার দাসীগিরি করেছি। কিন্তু আমার মেয়েকে তা হতে দেব না। আমি আমার মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবই।

          কয়েকদিন থেকে ওঠা-নামার সময় আফরোজাকে না দেখে একটু অবাক হন ফারহানা। বাসাটা কেমন নির্জন। কিছু হয়েছে কি?

          পাঁচদিন কেটে গেল। ফারহানার মনে হল অনন্তকাল ধরে সে আফরোজাকে দেখে না। সাতদিন পর অফিস থেকে ফেরার পথে দোতলায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর ডোরবেলে চাপ দিল। দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল আফরোজার ছোট মেয়ে সামিনা।

          -আন্টি!

          -হ্যাঁ। আম্মু কি অসুস্থ? কদিন ধরে দেখি না যে।

          -না আন্টি। নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের নখ মেঝেতে ঘষতে ঘষতে জবাব দিল।

          -তাহলে কি বেড়াতে গেছে? তোমরা যাওনি?

          এবার হু হু করে কেঁদে ওঠে কিশোরী সামিনা।

          -আন্টি আম্মু নানাবাড়ি চলে গেছে আপুকে নিয়ে। বলে গেছে আর আসবে না।

          -কেন? তোমাদের ফেলে আম্মু কিভাবে যাবে। ধুর। আচ্ছা আম্মু কি কারো সাথে রাগ করেছে?

          -হ্যাঁ। আব্বু আপুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেবে না বলেছিল তাই আম্মু আপুকে নিয়ে নানারবাড়ি চলে গেছে।

          -আচ্ছা। আচমকা বিস্ময় আর উদ্বেগ ঝরে পড়ল ফারহানার কন্ঠে। তাহলে তোমরা কিভাবে আছ?

          ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, আব্বুকে তাই বললাম। ফাহাদটা কান্নাকাটি করছে। কিন্তু আব্বু বলল নিজেই আসবে। না এসে থাকতে পারবে নাকি। কিন্তু সত্যি যদি না আসে বলতে বলতে সব ভুলে ফারহানাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ফারহানা মেয়েটিকে জড়িয়ে নিয়েই ঘরে ঢুকল। তারপর বলল, মায়ের মোবাইল আছে না?

          -আছে।

          -তাহলে আমাকে একটু দাও। আমি মায়ের সাথে কথা বলব।

          পরদিন সকালে অফিসে বের হওয়ার আগেই ডোরবেল বাজতে ফারহানা অবাক হল। দরজা খুলতেই দেখল সামিনা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ হাসিতে উজ্জ্বল।

          -কি খবর সামিনা?

          -আন্টি আম্মু কালরাতে বাসায় এসেছে। আব্বুই নিয়ে এসেছে আর বলেছে আপুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে দেবে।

          -ও তাই। কথা বলার সময় ফারহানা অনুভব করল তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে বিষাদ খেলা করছে। নিজেকে এই সাধারণ গৃহবধুটির কাছে কেমন যেন পরাজিত মনে হচ্ছে।

          মেয়েটি সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায়। ফারহানা বিষাদ প্রতিমা হয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।


রিফাৎ আরার ছোটগল্প - দহনের কাল


 _______________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭

গল্প - দহনের কাল
_________________________________________________

দহনের কাল

 

গত কদিন ধরে অদ্ভুত এক উত্তেজনার মধ্যে আছেন মনমোহন পালিত আর তার বন্ধু আনোয়ার যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুনাল এবার সাঈদীর বিচারের রায় দেবে রায় কী হয় কী না হয় এ নিয়ে উত্তেজনা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেশের মানুষকে খেপিয়ে তুলেছে দেশের তরুণরা ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ বানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছে টেলিভিশন মোবাইলে এ খবর একজন থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকে তরুণদের আহবানে সবাই সাড়া দিচ্ছে নব্বইয়ের গণ অভ্যুথানের পর আবার এই জাগরণ জনগণ রাজাকারের ফাঁসি চেয়েছে কিন্তু রায়ে যাবজ্জীবন এ রায় মানুষকে বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেখেছে এবং জেনেছে তাদেরকে ক্ষুব্ধ করেছে

          মনমোহন বন্ধুকে প্রশ্ন করেন- তুমি কি মনে করো এবার কিছু একটা হবে?

          -কি জানি,বড় বিচিত্র এই বাংলাদেশ জীবন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে সে ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি নব্বইয়ের অভ্যুথানের পর নতুন আশা জেগেছিল সে আশাও ব্যর্থ হল। এবার কি হবে কে জানে। এখন জামাত-শিবির শক্ত ভিত্তি পেয়ে গেছে। ওরা পারে না এমন কাজ নেই। তৃণমূল পর্যন্ত ওদের কর্মকান্ড পৌঁছে গেছে। আর দেইল্যা রাজাকার দেশের মানুষের কাছে মাওলানা সাইদী হয়ে গেছে।

          -সে তো জানি। কিন্তু নতুন কিছু আশা করতে দোষ কী? আমাদের ছেলে মেয়েরা যেভাবে খেপেছে। দেখো কিছু একটা হবে। কাল তো রায় তাই না?

          -হ্যাঁ। চলো এবার উঠি। সন্ধ্যা হল বলে।

          দিঘির পাড়ে শান বাঁধানো ঘাটে বসে কথা বলছিলেন দুই বন্ধু। ঘাটের হেলান ঘরে লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন আনোয়ার। মনমোহন তাকে সাহায্য করলেন। ছোটবেলা থেকেই হাঁপানি রোগী। যুবা বয়সে কমেছিল। এখন বয়সে ভাটা পড়তেই আবার বেড়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় পায়ে গুলি লাগার পর খুঁড়িয়ে হাঁটত। এখন লাঠি ব্যবহার করে। মনমোহনও কথা বলতে বলতে বন্ধুর সাথে তার বাড়ি পর্যন্ত যান।

          -তোমার বড় ছেলের খবর কী?

          -ভাল আছে। আমেরিকায়  গ্রিনকার্ড পেয়েছে। তো এখন আস্তে আস্তে সবাইকে নাকি ওখানে নিয়ে যাবে।

          -তুমিও যাবে নাকি?

বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন মনমোহন।

          -তুমি কি পাগল হয়েছ মনু? এই বয়সে এই শরীরে আমি সেখানে গিয়ে কী করব? ওদের বোঝা হব? একটা কথা জেনে রাখো মরি যদি এই বাংলার মাটিতেই মরব।

          -আমারও সেই কথা।

         

সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে ভাবতে ভাবতে পথ চলেন। কাল যদি রায় হয় তাহলে জামাত-শিবির কি মেনে নেবে? বিএনপিও তো ওদের পক্ষে। সরকারী দল আওয়ামী লীগও নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলে দাবি করলেও তারাওতো বিশাল জনসর্মথন নিয়ে ক্ষমতায় এসে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারল না। আসলে দুর্নীতি আর লোভের বিষে রাজনীতির শিকড় থেকে মাথা পর্যন্ত পচে গেছে। তবু আশা যদি দেশের তরুণরা জেগে উঠে হয়তো সবকিছু বদলাবে।

          মনে পড়ে আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে বিশ বছরে যুবক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শাস্ত্রে পড়াশোনা করছিলেন। বাল্যবন্ধু আনোয়ার পড়ত ইতিহাসে। সেই উত্তাল সময়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে আন্দোলনে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। আহা কী আগুনঝরা সেই সময়। মিটিং মিটিং মার্চের তিন তারিখ তারপর সাত তারিখ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের কথা মনে হলে আজও শরীরের রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। অথচ এই তুঙ্গস্পর্শী ভাষণটাকে বিটিভিতে যখন তখন বাজিয়ে এর মর্যাদাটাই খেলো করে ফেলল। অনেককেই দেখেন এই অভূতপূর্ব ভাষণটি শুরু হলে টেলিভিশনের চ্যানেল পালটে দেয়। ভাল জিনিসও খুব বেশি হলে সেটার স্বাদও তেতো হয়ে যায়।

          -কি গো কখন সন্ধ্যা হল তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমারতো ভয় ভয় করছিল।

          -কিসের ভয় মোহনপুরে কি বাঘ-ভাল্লুক আছে যে আমাকে তারা গিলে খাবে?

          -কথা বললেই যা খুশী তাই বলো। তুমি যে চোখে কম দেখ সেটা কী বিপদের কারণ হতে পারে না? তাছাড়া- স্ত্রী সুধারানী থেমে গেলেন।

          -তাছাড়া কী?

          -কী আবার- এবার মুখ ঝামটা দিলেন। চারদিকে লোকে কী বলাবলি করছে শুনতে পাও না? চোখে দেখনা কানেও শোন না নাকি?

          -শুনি খুব ভাল শুনতে পাই। এখন বল লোকে কী বলছে।

          -জানি না। যাও। ঘরে গিয়ে কাপড় বদলে চা খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। প্রতিদিন বিকেলের চা খেতে খেতে রাত গড়ায়।

         

রাতে খবর শুনতে গিয়ে খুব উত্তেজনা বোধ করলেন আনোয়ার। আগামিকাল সাইদীর রায়। একে আবার যাবজ্জীবন দেবে না তো? নিজেকে প্রশ্ন করলেন কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে। নাহ এটা দেশের ছেলে-মেয়েরা সহ্য করবে না। গনজাগরণ মঞ্চে যেভাবে ছেলে-মেয়েরা একসাথে প্রতিবাদ করছে তাতে তিনিও উদ্দীপ্ত হন। কিন্তু আবার কোথায় যেন হতাশা মনের ভিতর উঁকি দেয়। এই তরুণদেরই আরেক দল জামাত-শিবিরের পাল্লায় পড়ে জেহাদী জোশে মানুষের হাত-পায়ের রগ কাটে। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আনোয়ারের হাঁপানি ধরা বুকের ভেতর থেকে। হায় কে জানত তাঁর নিজের ছেলেও এই ফাঁদে পা দেবে। অনেক রাতে একথা ভেবে ঘুম আসেনা তাঁর। কথাটা কানে আসার পর থেকে নিজের মনে একদন্ডের হলো শান্তি পাননি। আবার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মনুকেও বলি বলি করে বলতে পারেননি গলার কাছে এসে আটকে যায়। অথচ এই মনুই তাকে ইউনিভার্সিটিতে গণিত নিয়ে পড়তে তোড়জোড় করে পাঠিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকে অঙ্কে মাথা ভাল বলে বন্ধুর এই পুত্রটিকে পুত্রবৎ ভালবাসত মনু। সেই মনুকে কিভাবে বলবেন, বলা যায় না।

          গেলবার বাড়ি আসার পর স্ত্রী সালেহার কাছে শুনে ছেলেকে অসম্ভব গালিগালাজ করেছিলেন। হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা তুই আর কাজ পাসনি রাজাকারের দলে যোগ দিয়েছিস। তুই জানিস না এদেশকে স্বাধীন করার জন্য তোর বাপ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের মাথার দাম ওরা দশ হাজার টাকা ঘোষণা দিয়েছিল। আমারই জন্য আমার বাড়ি, আমার বোনের বাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করেছে। আমার বোনটাকে বিধবা করেছে।

          -জানি, সব জানি। তুমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছ আর আমি ধর্মের জন্য জিহাদ করছি।

          -নিকুচি করছি তোর জিহাদের, এখনও সময় আছে সাব্বির এ রাস্তা থেকে ফিরে আয়। ফিরে আয় বাবা, আমি যে তোর জন্য মরমে মরে যাচ্ছি।

          -তোমাকে মরতে বলেছে কে? তুমি তোমার মত থাক, আমাকে আমার রাস্তায় যেতে দাও বলতে বলতে তাঁর সামনে থেকে চলে গিয়েছিল সেই থেকে বাড়ি এলেও তার সঙ্গে কথা বলেন না আনোয়ার।

          সাইদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একদল মিষ্টি বিতরণ শুরু করল আর অন্যদল শুরু করল ভাঙচুর। আনোয়ার আজ সন্ধ্যায় বন্ধুর বাসাতেই টিভি দেখছেন। প্রচন্ড ভাঙচুর শুরু হয়েছে দেশের সর্বত্র। হরতাল ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গ সংগঠন শিবির। একি তান্ডব। সরকার করছে কী? ওরা পুলিশকেও মারছে। যানবাহনে যেভাবে আগুন ধরাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বহ্নিৎসব চলছে।

          -আবার কি আমরা পিছনে হাঁটা শুরু করলাম মনু?

          -জানিনা রে ভাই তবে খুব ভয় লাগছে।

          -আমারও। দলিত শত্রু মাথাচাড়া দিলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। রাত হয়ে গেছে রামুকে বলনা আমাকে একটু এগিয়ে দিতে।

সে রাতে মনু-আনোয়ার কারো চোখেই ঘুম এলো না। আনোয়ার ভাবছেন দেশের ভবিষ্যৎ কী। কোনদিকে যাচ্ছি আমরা। আর মনু ভাবছেন তাদের নিরাপত্তার কথা। চৌদ্দ পুরুষের বাপ-দাদার ভিটায় তাঁরা আজ সংখ্যালঘু। পাকিস্তান হওয়ার পর ঠাকুরদা যাননি। তাঁর ভাইয়ের বংশধররা বেশিরভাগ এখন ভারতে। চৌষট্টির দাঙ্গার সময় মা চলে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাবা যাননি। বলেছিলেন বাপ-ঠাকুরদার ভিটা ছেড়ে শেয়ালদা স্টেশনে রিফিউজি হব নাকি! দরকার হলে এখানে মরব এটা আমার দেশ। তারপর এল মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই আধা গ্রাম আধা মফস্বলে থেকেই মানুষকে শিক্ষিত করার মানসে সারাজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রথমশ্রেণী নিয়েও শহরে যাননি মনমোহন। তখন একটা আদর্শবোধ কাজ করেছিল। বাবার মৃত্যুতে আনোয়ারও তাদের পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল। ঠাকুরদা নাকি নাম রাখার সময় বলেছিলেন আমার নাতি মোহনপুরের মনমোহন হবে। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে মিথ্যে হয়নি। গণিতের শিক্ষক হিসেবে শুধু মোহনপুর নয় পুরো জাফরগঞ্জে তিনি বিখ্যাত। তাঁর ছাত্ররা দেশেবিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। আজও তারা ঈদ-পরবে বাড়ি এলে তাঁকে দেখে যায়। তাঁর নিজের এক ছেলে ডাক্তার, মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক। হতাশার পাশাপাশি মোহন মাস্টার তাই একধরনের আত্মতৃপ্তিও অনুভব করেন।

ভোর না হতেই এলাকায় মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা আসে- মুসলমান ভাইয়েরা ঘরে বসে থাকবেন না। আল্লামা সাইদীর ফাঁসির ঘোষণা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আসেন সবাই মিলে নাস্তিক আর বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করি। শাহবাগের নাস্তিকদের শেষ করতে নওজোয়ানদের এগিয়ে যেতে হবে। আপনারা কি জানেন কালরাতে চাঁদে আল্লামা সাইদীর ছবি দেখা গেছে।

          যারা ফজরের নামাজ পড়তে গিয়েছিল তাদের অনেকেই বেকুব হয়ে ঘরে ফিরল। নিজেরা বলাবলি করতে লাগল সত্যিই সাইদী আল্লার এত বড় ওলী! যারা কোন খবর রাখেনা সেইসব শ্রমজীবী মানুষের প্রশ্ন এত বড় ওলি আল্লাকে সরকার ফাঁসি দিচ্ছে কেন?

          ভোরে নামাজ পড়তে উঠে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই মনে হল কে যেন টুকটুক করে দরজায় আঘাত করছে।

          -শুনতে পাচ্ছ? সালেহা জানতে চাইলেন।

          -হ্যাঁ, কে দেখব?

          -তুমি একা যেও না আমিও আসি। দুজনে এসে দরজা খুলে প্রায় আর্ত কণ্ঠে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, সাব্বির তুই এত ভোরে কীভাবে এলি? সারাদেশে এভাবে আগুন জ্বলছে রাতের বেলা এভাবে আসতে তোর ভয় করল না?

          -না কিসের ভয়। আর আমি একা আসিনি। আমার বন্ধুরা এসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব নাকি ঘরে ঢুকতে দেবে।

          এতক্ষণে আনোয়ার আর সালেহার মনে হল আসলেই তো ছেলেকে ঘরে ঢুকতে না দিয়ে তারা দরজাতেই জেরা শুরু করেছেন। দরজা থেকে মা-বাবাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সাব্বির বলল- আমি ঘুমাতে যাচ্ছি আর শোন আমি যে এসেছি এটা লোকজনকে বলে বেড়িও না। তোমাদেরতো আবার মালাউনদের জন্য দরদ বেশি।

          -কী বলছিস তুই এসব হারামজাদা।

          -যা বলছি ঠিকই বলছি। চেঁচিও না। এত ভোরে চেঁচালে লোকে শুনতে পাবে।

          আর কোন কথা না বলে নিজের কামরায় ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। স্তব্ধ হয়ে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে থাকলেন আনোয়ার। লাঠির ওপর ভর দেয়া তাঁর খোঁড়া পা-টা ঠকঠক করে কাঁপছে। একি কথা বললো সাব্বির! কেন বলল? যে পরিবেশ যে আদর্শে সে মানুষ হয়েছে সে আদর্শ সে কীভাবে ভুলে গেল। আবার বলল তার আসার কথা কাউকে না বলতে। এর মানে কী? কী উদ্দেশ্য তার এ গোপনীয়তা?

 

কাল সারারাত একফোঁটা ঘুম হয়নি মনমোহন পালিতের। টেলিভিশনে দেখা লেলিহান অগ্নিশিখা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন যেন বাংলাদেশটা একটা শ্মশানের চিতা। এ আগুন কী করে নিভবে? এর শেষ কোথায়?

          ভোরের আযান শুনে বিছানায় উঠে বসলেন। বাথরুম ঘুরে এসে কাপড় বদলে বিছানার ওপর পদ্মাসন হয়ে বসে হাত দুটো বুকের কাছে যুক্ত করে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলেন, শান্তি দাও, শান্তি দাও। প্রভু এ দুঃখিনী বাংলায় প্রতিটি ঘরে শান্তির আবাস হোক।

          যুক্তকরেই কিছুক্ষণ ধ্যান করে বিছানা থেকে নামলেন। প্রথাগত ধর্মীয় আচরণ তিনি তেমন একটা মানেন না। নিজের মত করে নিজেই প্রার্থনা করেন।

          ওঘরে স্ত্রী পূজার ঘন্টাধ্বনি বাজাচ্ছেন। এসময় বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। বাড়ির সামনে সীমানা দেয়া বিশাল আঙিনা। সেখানে পূর্বপুরুষদের লাগানো ঝাঁকড়া পুরনো গাছপালা। পাখ-পাখালির বাসা। পাখিদের কিচিরমিচির শুনতে শুনতেই গাছগুলোকে ছুঁয়ে দেখেন। চুপিচুপি উচ্চারণ করেন, তোমরা ভাল আছ তো ভাই, ভাল থেকো। দেশটা কিন্তু ভাল নেই। সবার বিপদ। রাজাকার আর তাদের অনুসরীরা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে।

          তারপর সূর্য উঠলে সূর্যপ্রণাম করে ঘরে ঢুকেন। ততক্ষণে স্ত্রী রামুকে নিয়ে চা-নাস্তা তৈরি করে টেবিলে দিয়েছে। তাকে একাই খেতে হবে। মা-দিদিমাদের সংস্কার সুধারানী এখনও বহন করে চলেছেন। স্বামীর সঙ্গে একসাথে খেতে বসেন না। তার এঁটো পাতে খান। এ নিয়ে ছেলে-মেয়ে দুটোও কম হাসাহাসি করেনি। আবার বুঝাতেও চেষ্টা করেছে। কিন্তু সংস্কার এত সহজে যায় না।

          বিয়ের পর প্রথম প্রথম আপত্তি করে হাল ছেড়েছেন। তখন মা বেঁচেছিল তার সামনে বেশি জোরাজুরিও করা যেত না।

          খাওয়ার টেবিলে সুধারানী বসে আছেন। রামু একপাশে দাঁড়িয়ে। খাওয়ার মাঝখানে সুধারানী বললেন, রামু বাড়ি যেতে চায়।

          -হঠাৎ? এই কদিন আগে না বাড়ি ঘুরে এলি।

          -ভাল লাগছে না কাকাবাবু। দেশের পরিস্থিতি যেন কেমন। বৌ-বাচ্চারা কেমন আছে দেখে আসি।

          -হু, তুমিতো বলেই খালাস। আমি এতদিক সামলাব কী করে?

          -কেন সতীর মা আছে না?

          -হ্যাহ, সতীর মার তো দশটা হাত, মা দুর্গা আরকি।

          -আরে আমরাওতো দুজন। কোন রকমে চলে যাবে। ওকে ঘুরে আসতে দাও।

          -আর কি? যা যা এক্ষুনি যা। একেবারে চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে।

          রামু হাসতে হাসতে বলে যায় - আমিতো বিকালে যাব কাকীমা।

          এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। মেয়ে ফোন করল- কেমন আছ বাবা, মা কেমন আছে বল।

          -আছে ভাল আছে। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি যে খারাপ।

          -হ্যা, সাবধানে চলাফেরা করিস। কখনও কোথায় বোমা ফুটছে। কোথায় আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে তার ঠিক নেই।

          -তবুতো বাবা ঢাকা শহর অনেক নিরাপদ। কিন্তু মফস্বল এলাকা আর গ্রাম এলাকায় ওরা হিন্দু বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণ করছে। মাকে নিয়ে চলে এসো না বাবা, প্লিজ।

          -পাগল হয়েছিস মা। এই হরতাল, জ্বালাও পোড়াওয়ে পথে বেরিয়ে বুড়ো মানুষেরা বিপদে পড়বে নাকি। আর এখানে আমার ক্ষতি করবে কে? মনমোহন মাষ্টারকে কে না চিনে। বরং আমি থাকলে পাড়ার মানুষ একটু ভরসা পাবে। আচ্ছা তোর মায়ের সাথে কথা বল।

          কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলের ফোন এল। দেশের পরিস্থিতি ভাল নয় বাবা। সাবধানে থেকো।

          -এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? সরকার কি বসে থাকবে! দেখিস পুলিশ বিজিবি নামিয়ে সব ঠিক করে ফেলবে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা থাকনে না এটা কি হয়।

          -তবু সাবধানে থেকো। পাড়ার সবাইকে বলো একটু সাবধান থাকতে।

 

বিকেলে আনোয়ার এলে তাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোলেন মনমোহন। মনে হল আনোয়ার আজ বড় বেশি চুপচাপ। এমনতো সে নয়।

          -তোমার কী হয়েছে বন্ধু? খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে। কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ?

          বুকটা ধক করে উঠল আনোয়ারের। অনেকদিন বলি বলি করেও যে কথাটা লজ্জায় ঘৃণায় বলতে পারেননি সে কথাটা কি বলবেন। বলবেন সাব্বির তার প্রিয় ছাত্র আজ ভোরে বাড়ি এসেছে।

          না এবারও হার হল। পারলেন না। শুধু মিনমিন করে বললেন, দেশের পরিস্থিতিতে মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে পড়েছে। সারাদিনতো টিভি দেখেই কাটালাম। একবার মনে করেছিলাম তোমার কাছে চলে আসি। কিন্তু রোদ এমন কড়া সাহস হল না। ঘামালেইতো হাঁপানি বাড়ে।

          হাঁটতে হাঁটতে দিঘির পাড়ের ঘাটে এসে বসলেন। এটাই তাদের গল্প করার জায়গা।

          মনমোহন বললেন, ছেলে-মেয়ে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে। এটাতো সরকার আর রাজাকারের সমস্যা। যাক এতদিন পরে তবু একটা বিচারে বুকটা কিছুটা হলেও জুড়ালো।

          আনোয়ার চুপ করে থাকেন। অন্যমনস্ক। গল্প জমে না। বিকেল শেষ হবার আগেই উঠে পড়েন দুজনে।

          আনোয়ার বললেন, তোমার ছেলেমেয়ে তো একেবারে মিথ্যে বলেনি। আঘাত কোনদিক থেকে আসে বলা যায় না। আর আমারতো ঘরের শত্রু বিভীষণ- শেষ কথাটা বিড়বিড় করে বললেন।

          -কী বললে ঠিক বুঝতে পারলাম না।

          -নাহ সাবধানে থাকার কথাই বললাম। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপরও তো হামলা হতে পারে।

          ফিরে চললেন দুজনে। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। এতদিনের বন্ধুকে যেন বুঝে উঠতে পারছেন না মনমোহন। মনে হচ্ছে অঙ্কের হিসাবে কোথাও গোলমাল আছে। শুধু এটুকু বুঝতে পারলেন, আনোয়ার কোন কারণে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় আছেন।

 

সন্ধ্যার পর থেকেই টেলিভিশনে খবর আসতে শুরু করেছে জামায়াতপন্থীরা সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধদের ওপর হামলা করছে। রাজশাহীতে, নোয়াখালীতে হিন্দুমন্দিরের মূর্তি ভাঙছে। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। রাত প্রায় একটা পর্যন্ত একটা মানসিক অস্থিরতা নিয়ে মনমোহন ও সুধারানী টিভির সামনে বসে আছেন। বাড়িতে রামুটাও নেই।

          হঠাৎ মানুষের কোলাহল কানে এল। মনমোহন জানালার পাশে দাঁড়াতেই দেখতে পেলেন আগুনের শিখা আকাশের দিকে ধাবমান। মুহূর্তে বুঝতে পারলেন কী ঘটছে। দরজা খুলে বাইরে ছুটে গেলেন, পিছন থেকে সুধারানী চিৎকার করছেন- যেও না ওগো যেও না। মনমোহন ছুটে গেলেন মন্দিরের দিকে। সাহা পাড়া, মল্লিক পাড়া সবদিক থকেই হৈ চৈ ভেসে আসছে। সবাই মন্দিরের দিকে ছুটছে দেবতাকে বাঁচাতে হবে।

          ওরা নারায়ে তকবীর ধ্বনিতে ধারালো খড়গ হাতে ছুটে আসছে। কারো হাতে লাঠি। চিৎকার করছে, ভাঙ ভাঙ শালাদের যত দেব-দেবী। খড়ের মূর্তির পূজা করা দেখাচ্ছি। লাথি মারলেই ভগবান পালাবে।

          মনমোহন মন্দিরে ঢুকলেন। অন্যরাও এল। আজীবন মানবধর্মে বিশ্বাসী মনমোহন দুহাত ছড়িয়ে দেবীকে পিছন করে দাঁড়ালেন।

          ওরা মশাল নিয়ে আসছে। ধর ধর মার মার চিৎকারে মশালের আলোয় প্রথম যাকে দেখলেন মনমোহন সে সাব্বির।

          -সাব্বির!!

চিৎকার করে উঠলেন মনমোহন কিন্তু ততক্ষণে সাব্বিরের খাঁড়ার আঘাতে তার ডান হাতটা মাটিতে গড়াচ্ছে- যে হাতে তিনি প্রিয় শিষ্য অঙ্ক শিখিয়েছিলেন পুত্রস্নেহে।


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts