Saturday, 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ১৮



নোবেল পুরষ্কার

১৯৩০ সাল পৃথিবীর বিজ্ঞানের ইতিহাসে এশিয়ার জন্য একটি স্মরণীয় বছর। এই বছর প্রথম কোন এশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান। আর সেই প্রথম এশিয়ান হলেন স্যার সি ভি রামন। এর আগে স্যার রোনাল্ড রস চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯০২ সালে, ম্যালেরিয়ার জীবাণুর ওপর গবেষণার জন্য। রোনাল্ড রস জন্মেছিলেন ভারতে। কিন্তু ভারতে জন্মালেই কেউ ভারতীয় হয়ে যায় না। আবার সেই সময় ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-বার্মা সবই ছিল ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে। কিন্তু তবুও নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ বা রামনকে আমরা ব্রিটিশ বলে মনে করি না। যদিও আইনগতভাবে নোবেল পুরষ্কারের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ও রামনের জন্য ব্রিটিশ পতাকাই তোলা হয়েছিল।
            সাধারণত বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কারের পর অনেক বছর লেগে যায় তার স্বীকৃতি পেতে। বিশেষ করে নোবেল পুরষ্কারের মত পুরষ্কার পাবার ক্ষেত্রে। কিন্তু রামনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটে গেলো মাত্র দুবছরের মধ্যেই। ১৯৩০ সালেই রামন ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য নোবেল-পুরষ্কার পেয়ে গেলেন স্যার সি ভি রামন।
            ১৯৩০ সালের ১৩ নভেম্বর স্টকহোমে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হলো: The Nobel Prize in Physics 1930 was awarded to Sir Chandrasekhara Venkata Raman "for his work on the scattering of light and for the discovery of the effect named after him". আলোর বিক্ষেপণ সংক্রান্ত গবেষণা এবং রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য স্যার সি ভি রামনকে ১৯৩০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হলো। শুধুমাত্র রামন-ইফেক্ট নয়, রামনের আলোক-সংক্রান্ত সামগ্রিক গবেষণার জন্যই এই পুরষ্কার। রামন পরে অনেকবার বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, শুধুমাত্র ১৯২৮ সালের গবেষণার ওপর নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলে রামনের সাথে কৃষ্ণানকেও নোবেল পুরষ্কার দেয়া হতো।
            ১৯৩০ সালের ১৪ নভেম্বর সকালে টেলিগ্রাম পেলেন রামন। সুইডেনের নোবেল কমিটি তাঁকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দিয়েছে। দু'বছর ধরে যে নিঃশ্বাসটা গলার কাছে আটকে ছিল, অবশেষে সেটা থেকে মুক্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলেন রামন। তিনি যেন জানতেন এরকমই হবে। তাঁর ব্যাগ গোছানো ছিল। জাহাজের টিকেট কাটা ছিল, জাহাজে কেবিন রিজার্ভ করা ছিল।
টেলিগ্রাম পাবার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ছেলেদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রামন ও লোকম। প্রথমে কলকাতা থেকে ট্রেনে মাদ্রাজ। সেখানে লোকমের বোনের কাছে ছেলেদের রেখে চলে গেলেন ব্যাঙ্গালোর। সেখান থেকে বোম্বে। বোম্বে থেকে ইওরোপগামী জাহাজ এস এস ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়লো ২০ নভেম্বর।
            জাহাজের ডেকে বসে রামন নোবেল বক্তৃতা রেডি করতে শুরু করলেন। তাঁর বক্তৃতাও রেডি ছিলো - কেবল কিছু বাদ গেলো কিনা দেখে নিতে শুরু করলেন। রামন জাহাজের টিকেট কেটে রেখেছিলেন জুলাই মাসে। অথচ সেই সময় নোবেল কমিটির মিটিং-ও হয়নি।
            রামন যেন অনেক দিন আগে থেকেই জানতেন যে তিনি নোবেল পুরষ্কার পাবেন। এ ব্যাপারে কিছু কিছু ঘটনা খুবই আশ্চর্যজনক মনে হয়।
            ১৯২৪ সালের শেষে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাবার পর রামনকে যখন সম্বর্ধনা দেয়া হয় - রামন বলেছিলেন আশা করছি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমি ভারতের জন্য নোবেল পুরষ্কার নিয়ে আসতে পারব।[1] ঠিক পাঁচ বছর পরেই তিনি নোবেল পুরষ্কার পেলেন। শুধু তাই নয়, ১৯২৫ সালে শিল্পপতি জি ডি বিড়লার কাছে স্পেক্ট্রোগ্রাফ কেনার জন্য টাকা চেয়ে লেখা এক চিঠিতে লেখেন - আমি যদি এই যন্ত্রটা পাই, তাহলে ভারতের জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিতে পারবো।
            নোবেল পুরষ্কারের অদ্ভুত একটা মোহ ছিল রামনের কাছে। সেই ছোটবেলা থেকে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন একদিন নোবেল পুরষ্কার পাবেন। তিনি দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কার পাবার পর কীভাবে বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। বিজ্ঞানের জগতে দেখেছেন নোবেল পুরষ্কারের কতটা সম্মান। তিনি দেখেছেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞান - এই তিন শাখায় এশিয়ার কেউই নোবেল পুরষ্কার পাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন ইওরোপিয়ানদের যে মেধা, এশিয়ানদের মেধা তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তবে সমস্যা কোথায়? সমস্যা যোগাযোগে, প্রচারে।
            রামন তাই প্রথম থেকেই প্রচারের ব্যাপারে এক সেকেন্ডও দেরি করেন না। কোন আবিষ্কার পুরোটা সম্পন্ন হবার আগে থেকেই তিনি তার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে থাকেন। অনেক সময় ফলাফল পাবার আগেই যদি কোন আইডিয়া থাকে সেটাও প্রকাশ করেন। তাই রামনের পেপারের অনেকগুলোই খুবই সংক্ষিপ্ত আকারের।
            নোবেল পুরষ্কারের পুরো প্রক্রিয়াটি ভালোভাবে খেয়াল করেছেন রামন। নোবেল কমিটি আগের বছরগুলোর নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী ও সারা পৃথিবীর প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার জন্য সুপারিশপত্র আহ্বান করে। কাউকে না চিনলে বা কারো কাজ সম্পর্কে না জানলে এবং কাজের সপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকলে তো সুপারিশ কেউ করবে না। রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হওয়ার পর পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের কাছে রামনের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়েছে। অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীই তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তাঁরা যদি ভুলে যান নোবেল পুরষ্কারের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করতে? রামন তাই অনেক বিজ্ঞানীর কাছে ব্যক্তিগত চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যেন তাঁর নাম নোবেল কমিটির কাছে সুপারিশ করা হয়।
            কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম স্থপতি নিল্‌স বোর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯২২ সালে। তারপর থেকে নিল্‌স বোর নোবেল পুরষ্কারের জন্য সুপারিশ করতে পারেন। রামনের কাজ পছন্দ করতেন নিল্‌স বোর। ১৯২৩ সালে রামন নিল্‌স বোরের সাথে কিছুদিন কাজ করতে পাঠান তাঁর ছাত্র বিধুভূষণ রায়কে। সেই থেকে বোরের সাথে রামনের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। ১৯২৪ সালে রামন নিল্‌স বোরের সাথে দেখা করেছেন। ১৯২৯ সালে নোবেল পুরষ্কার পেতে ব্যর্থ হয়ে রামন একটুও দেরি না করে চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কাছে যেন ১৯৩০ সালের জন্য কোন চেষ্টা বাকি না থাকে।
১৯২৯ সালের ৬ ডিসেম্বর রামন নিল্‌স বোরকে লিখেছিলেন: "আপনি আমাকে আগে যে দয়া দেখিয়েছেন সেটা মনে রেখে একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ করছি। আপনি তো জানেন, আমার আবিষ্কৃত নতুন ধরনের বিকিরণ-প্রভাব বৈজ্ঞানিক মহলে খুবই সমাদৃত হয়েছে। যদি আপনার মতো প্রভাবশালী বিজ্ঞানীর সমর্থন আমার প্রতি থাকে আমি নিশ্চিত পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল কমিটি ১৯৩০ সালে প্রথম বারের মতো ভারতের কোন বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার ব্যাপারে একমত হবে। ... ...[2]
           

রামন ও নিল্‌স বোর



পদার্থের সাথে আলোর মিথষ্ক্রিয়ায় (interaction) রামন যে প্রভাবটা আবিষ্কার করেছেন সেই একই প্রভাব আবিষ্কার করেছিলেন দু'জন রাশিয়ান বিজ্ঞানী রামনেরও দুই সপ্তাহ আগে। রামন সেটা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন।
            মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর লিওনিদ ইজাকোভিচ ম্যান্ডেলস্ট্যাম (১৮৭৯-১৯৪৪) আইস্টাইন ও ডিবাই-এর আপেক্ষিক তাপের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার সময় তত্ত্বীয়ভাবে হিসেব করে দেখেন যে ক্রিস্টালের ভেতর দিয়ে আলো যাবার সময় বিক্ষিপ্ত আলোর কম্পাঙ্কের পরিবর্তন হবে। তিনি তরুণ অধ্যাপক গ্রিগরি স্যামুইলোভিচ ল্যান্ডসবার্গের (১৮৯০-১৯৫৭) সাহায্যে এই তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পান ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমদিকে। সময়ের দিক থেকে তা রামনের আবিষ্কারের প্রায় পনের দিন আগে। ঠিক এই ব্যাপারটাই আবিষ্কার করেন রামন পনেরো দিন পর ১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি।
            কিন্তু রামন যেরকম দ্রুত গবেষণাপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন, রাশিয়ানরা তা করেননি। ল্যান্ডসবার্গ ও ম্যান্ডেলস্ট্যাম পেপার লিখে অনেকদিন রেখে দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রথম পেপার প্রকাশিত হয় জুন মাসে। ততদিনে রামনের অনেকগুলো পেপার প্রকাশিত হয়ে গেছে। তাই শেষপর্যন্ত এই আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্ব রামনের নামেই হয়ে গেছে। তবে রাশিয়ানরা এখনো রামন-ইফেক্টকে 'রামন-ইফেক্ট' বলেন না, তাঁরা বলেন 'সেকেন্ডারি স্ক্যাটারিং'।

ল্যান্ডসবার্গ ও ম্যান্ডেলস্ট্যাম

           
রামনের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে ১৯৮০ সালে। ১৯৮১ সালে নোবেল ফাউন্ডেশান ১৯৩০ সালের নোবেল পুরষ্কারের সব তথ্য প্রকাশ করেছে। সেই তথ্য বিশ্লেষণ রে রামনের নোবেল পুরষ্কার পাবার পেছনের অনেক ঘটনা জানা যায়।[3]
            ১৯২৯ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের জন্য ৪৮ জন বিজ্ঞানী ২৯ জন বিজ্ঞানীর পক্ষে ৯৭টি প্রস্তাব পাঠান। দুজন বিজ্ঞানী রামনের পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন। প্যারিসের প্রফেসর ফ্যাবরি প্রস্তাব করেছিলেন প্যারিসের ক্যাবানিস ও ভারতের রামনকে যৌথভাবে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার জন্য। নিল্‌স বোর প্রস্তাব করেছিলেন পুরষ্কারের পুরোটাই হয় প্রফেসর উডকে দেয়া হোক, অথবা যৌথভাবে রামন ও উডকে দেয়া হোক। যাই হোক, ১৯২৯ সালে রামনকে পুরষ্কার দেয়া হয়নি। নোবেল কমিটি লুই ডি ব্রগলিকে নোবেল পুরষ্কার দিয়েছেন। একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার পুরষ্কারের জন্য সুপারিশের দরকার আছে ঠিকই, কিন্তু সবচেয়ে বেশি সুপারিশ যার পক্ষে যাবে সে-ই পুরষ্কার পাবেন এমন কোন কথা নেই। ১৯২৯ সালে লুই ডি ব্রগলি কিন্তু মাত্র ১২% সুপারিশ পেয়েছিলেন।
            ১৯০১ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত নোবেল কমিটি কোন ভারতীয় বিজ্ঞানীকে সুপারিশ পাঠানোর সুযোগই দেননি। ১৯৩০ সালে তাঁরা ভারতের দুজন বিজ্ঞানীর কাছে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাবার উপযুক্ত ব্যক্তির নাম সুপারিশ করার জন্য আহ্বান জানান। এই দু'জন বিজ্ঞানী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র।
            ১৯৩০ সালে দু'জন ভারতীয় অধ্যাপকসহ বিশ্বের মোট ৩৯ জনকে প্রস্তাব পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়। তার মধ্যে ৩৭ জন প্রস্তাব পাঠান। তার মধ্যে ২১টি সুপারিশ বিবেচনাযোগ্য হয়। ২১টি প্রস্তাবের মধ্যে দশটিতে এককভাবে অথবা যৌথভাবে রামনের নাম সুপারিশ করা হয়। রামনের পক্ষে যাঁরা সুপারিশ করেছিলেন তাঁরা হলেন: আর্নেস্ট ব্লক, জাঁ পেরিন, লুই ডি ব্রগলি, এইচ এম ডি ব্রগলি, নিল্‌স বোর, ওরেস্ট খোবল্‌সন, রুডল্‌ফ ফেইফার, জোহানেস স্টার্ক, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, ও চার্লস উইলসন।
            অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র তাঁদের সহকর্মী রামনকে নোবেল পুরষ্কার দেবার জন্য সুপারিশ করেননি। তাঁরা সুপারিশ করেছিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার নাম। মেঘনাদ সাহা শুধু এই দুইটি সুপারিশই পেয়েছিলেন।
            ডিসেম্বরের দশ তারিখে আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুদিনে  স্টকহোমে সুইডেনের রাজা আনুষ্ঠানিক ভাবে নোবেল পুরষ্কার তুলে দেন নোবেলবিজয়ীদের হাতে। স্যার সি ভি রামনকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরষ্কার গ্রহণ করতে আহ্বান জানান রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের ফিজিক্স নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর প্লিজেল। তিনি রামন ইফেক্ট সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেন। প্রফেসর প্লিজেল রামন ইফেক্ট আবিষ্কারের ভিত্তি ও তার প্রভাব সম্পর্কে সেদিন যা বলেছিলেন তার বাংলা রূপান্তর নিচে দেয়া হলো।[4]
            ইওর ম্যাজেস্টি, ইওর রয়েল হাইনেস, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ১৯৩০ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হবে স্যার ভেঙ্কট রামনকে; আলোর বিক্ষেপণ (scattering) সংক্রান্ত তাঁর গবেষণা ও রামন ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য। আলোর ডিফিউশান (diffusion) বা ব্যাপন যে একটি আলোকীয় ঘটনা তা আমরা অনেকদিন থেকেই জানি। আলোকরশ্মি সরাসরি চোখে এসে না পড়লে আমরা তা দেখতে পাই না। কিন্তু যদি একগুচ্ছ আলোকরশ্মি কোন ধুলিপূর্ণ মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যায় তবে আলোকরশ্মি সেই মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত হয় এবং এক পাশ থেকে আলোকের গতিপথ দেখা যায়। ব্যাপারটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: ক্ষুদ্র ধুলিকণা আলোকরশ্মির বৈদ্যুতিক প্রভাবে দুলতে থাকে এবং নিজেদের মধ্যে একটা কেন্দ্র তৈরি করে সেখান থেকে আলো ছড়াতে থাকে। কিন্তু আলোর ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কারণে বিদ্যুতিক প্রভাবের মান ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হলে এই প্রভাব কম, এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলে এই প্রভাব বেশি হয়। ফলে বর্ণালীর লাল রঙের চেয়ে নীল রঙের মধ্যে এই প্রভাব বেশি। তাই আলোকরশ্মির মধ্যে বর্ণালির সবগুলো রঙ থাকলে মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যাবার সময় আলোর লাল ও হলুদ অংশ খুব সামান্য বিক্ষিপ্ত হবে, কিন্তু বেশিরভাগ লাল ও হলুদ রশ্মি সোজা চলে যাবে। কিন্তু নীল রঙের আলো বেশি বিক্ষিপ্ত হবে। এই ইফেক্টকে আমরা টাইনড্যাল[5] (Tyndall) ইফেক্ট নামে জানি।

 
নোবেল পুরষ্কার অনুষ্ঠানে মঞ্চে নোবেলবিজয়ী রামন


লর্ড র‍্যালে এই ইফেক্ট নিয়ে গবেষণা করে এই মতবাদ দেন যে আকাশের রঙ যে নীল এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় লালচে দেখায় তার কারণ হলো বায়ুমন্ডলে সূক্ষ্ম ধূলিকণা ও ভাসমান পানির অণুতে আলোর ব্যাপনের জন্য। আকাশে নীল রঙের আলোর পাশের দিকে বিক্ষেপণ আর লালচে আলো বায়ুমন্ডলের নিচের দিকে সোজা চলে আসায় সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমাকাশ এবং সূর্যোদয়ের সময় পূর্বাকাশ লালচে দেখায়। ১৮৯৯ সালে লর্ড র‍্যালে এ বিষয়ে আরো একটি মতবাদ দেন যে শুধু ধুলিকণা নয়, বাতাসের অন্যান্য গ্যাসের অণু থেকেও আলোর বিক্ষেপণ হতে পারে।
            ১৯১৪ সালে ক্যাবানিস[6] পরীক্ষা করে দেখান যে বিশুদ্ধ ধুলাবালিমুক্ত গ্যাসেও আলোর বিক্ষেপণ ঘটে। বিভিন্ন কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থে বিক্ষেপণের পরীক্ষায় দেখা গেছে টাইনড্যাল ইফেক্টের হিসেব অনুযায়ী যে ফলাফল পাওয়া উচিত বিক্ষিপ্ত আলোর অনেক ক্ষেত্রেই সেই ফলাফল পাওয়া যায় না। টাইনড্যাল ইফেক্টের মূল কথা হলো বিক্ষিপ্ত আলোর পোলারাইজেশান (polarization) বা সমবর্তন ঘটবে। কিন্তু পরীক্ষায় সেরকম ফল পাওয়া গেলো না।
            এখান থেকেই শুরু হয় আলোর বিক্ষেপণের আরো সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ। এই পর্যবেক্ষণে যারা সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন রামন তাঁদের অন্যতম। অণুর অপ্রতিসাম্যে (asymmetry) যে অসঙ্গতি দেখা যায় রামন তার ব্যাখ্যা খুঁজছিলেন। বিক্ষেপণ নিয়ে তাঁর এই গবেষণায় ১৯২৮ সালে রামন অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যান এই আশ্চর্য ইফেক্ট। বিক্ষিপ্ত আলো মূল আলো থেকে আলোকীয় বিকিরণ শুধু দেয় না, ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোও দেয় যার সাথে মূল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কোন মিল নেই।
            এই নতুন আলোকরশ্মির ধর্ম আরো সূক্ষ্মভাবে জানার জন্য শক্তিশালী মার্কারি ল্যাম্প থেকে মূল আলো ব্যবহার করা হয়। মার্কারি ল্যাম্পের সামনে বিভিন্ন ফিল্টার দিয়ে মূল আলোকে একবর্ণের (monochromatic) আলোতে পরিণত করা হয়। সেই একবর্ণী আলো মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যাবার সময় যে বিক্ষেপণ সৃষ্টি করে তা বর্ণালীমাপক (spectrometer) যন্ত্রের সাহায্যে মেপে দেখা হয়। বর্ণালীচিত্রে (spectrograph) প্রত্যেকটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা কম্পাঙ্কের জন্য একটি করে বর্ণালী রেখা (spectral line) দেখা যায়। রামন দেখতে পান যে মার্কারি লাইটের জন্য নির্দিষ্ট বর্ণালী রেখা ছাড়াও আরো কয়েকটি স্পষ্ট রেখা বর্ণালীচিত্রে দেখা যাচ্ছে। মার্কারির জন্য নির্দিষ্ট রেখার দুই পাশেই আছে এই রেখাগুলো। তারপর মূল আলো সরিয়ে নিলেও দেখা যায় যে নতুন বর্ণালী বিন্যাস এমন হয় যে মূল বর্ণালী রেখা ও নতুন বর্ণালী রেখার মধ্যকার দূরত্ব সমান থাকে।


নোবেল অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দ



ঘটনাটি সব মাধ্যমেই ঘটে কিনা দেখার জন্য রামন বহু রকমের আলোক-মাধ্যম ব্যবহার করেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেন।
            আবিষ্কারকের নাম অনুসারে এই নতুন আবিষ্কৃত ইফেক্টের নাম হয়েছে রামন ইফেক্ট। রামন এই ইফেক্টের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন আলোর ধর্ম বিষয়ে আধুনিক ধারণার ভিত্তিতে। এই নতুন ধারণা অনুযায়ী কোন বস্তু দ্বারা আলোর নিঃসরণ বা শোষণ হতে পারে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট শক্তি-গুচ্ছে। এই শক্তি-গুচ্ছ এখানে আলোর কোয়ান্টাম। সুতরাং আলোর শক্তি এক ধরনের পারমাণবিক পরিচিতি বহন করে। আলোর কোয়ান্টাম আলোকরশ্মির কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। সুতরাং কোন ক্ষেত্রে যদি আলোর কম্পাঙ্ক দ্বিগুণ হয়, আলোর কোয়ান্টামও দ্বিগুণ হবে।
            আলোর শক্তি নিঃসরণ বা শোষণের সময় পরমাণুর অবস্থা বোঝার জন্য আমরা বোরের পারমাণবিক মডেল চিন্তা করতে পারি। পরমাণুর কেন্দ্রে ধনাত্মক চার্জের নিউক্লিয়াসের চারপাশে বিভিন্ন বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন। প্রত্যেকটি ইলেকট্রনের গতিপথের নির্দিষ্ট শক্তি থাকে এবং তা নির্ভর করে পরমাণুর কেন্দ্র থেকে ইলেকট্রনের দূরত্বের ওপর।
            পরমাণুতে শুধুমাত্র কয়েকটি গতিপথই সুস্থির থাকে। এই পথে ইলেকট্রন ঘোরার সময় কোন শক্তি নিঃসৃত হয় না। কিন্তু যদি এই পথগুলো ছাড়া কোন ইলেকট্রন উচ্চশক্তির পথ থেকে নিম্নশক্তির পথে আসে অর্থাৎ বাইরের দিকের বৃত্তাকার পথ থেকে ভেতরের দিকের বৃত্তাকার পথে আসে তখন আলোর নিঃসরণ ঘটে। এই আলোর কম্পাঙ্ক সংশ্লিষ্ট দুটো পথের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। আর বিকিরণ শক্তি থাকে আলোর কোয়ান্টামে। সুতরাং পরমাণুতে বিভিন্ন সুস্থির গতিপথের মধ্যে ইলেকট্রনের আসা-যাওয়ায় অনেক রকম কম্পাঙ্কের আলোর নিঃসরণ ঘটতে পারে। প্রতিটি কম্পাঙ্কের জন্য একটি করে বর্ণালী-রেখা তৈরি হয়।
            যখন বিকিরণ শক্তি এসে পরমাণুতে পড়ে তখন তার থেকে শক্তি কখনই শোষিত হতে পারে না যদি ঐ পরমাণু সমপরিমাণ আলোর কোয়ান্টাম নিঃসরণ করতে না পারে।

 
১৯৩০ সালের অন্যান্য নোবেল লরিয়েটদের সাথে রামন
           
কিন্তু রামন ইফেক্ট এই নিয়ম মেনে চলছে না। দেখা যাচ্ছে বর্ণালীতে রামন-রেখার (Raman-line) স্থান পরমাণুর নিজের কম্পাঙ্কের সাথে মিলছে না এবং শক্তিপ্রদানকারী বিকিরণ থেকে সরে যাচ্ছে। এই আপাত বৈষম্য রামন ব্যাখ্যা করেছেন এবং বাইরে থেকে আসা আলোর কোয়ান্টামের সাথে পরমাণু থেকে মুক্ত বা পরমাণুর সঙ্গে আবদ্ধ আলোর কোয়ান্টামের মিলনের প্রভাবই এই রেখাগুলির উৎপত্তির কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। যখন বাইরে থেকে আসা আলোর কোয়ান্টাম একটি পরমাণুতে পড়ে ঠিক সেই সময় যদি পরমাণু নিজেই একটি ভিন্ন মাত্রার আলোর কোয়ান্টাম নিঃসরণ করে এবং দুটি আলোর কোয়ান্টামের পার্থক্য মুক্ত বা বদ্ধ ইলেকট্রনের গতিপথগুলির মধ্যে ওঠানামাজনিত আলোর কোয়ান্টামের সমতুল্য হয় কেবলমাত্র তখনই বাইরে থেকে আসা আলোর কোয়ান্টাম শোষিত হবে। সেই ক্ষেত্রে পরমাণু একটি বাড়তি কম্পাঙ্কের আলো নিঃসরণ করবে যার মান হবে শক্তিপ্রদানকারী বিকিরণের কম্পাঙ্ক এবং পরমাণুর নিজের কম্পাঙ্কের যোগফল বা বিয়োগফলের সমান। এসব ক্ষেত্রে নতুন বর্ণালী-রেখাগুলি মূল কম্পাঙ্কের উভয় দিকে দলবদ্ধভাবে থাকবে এবং মূল কম্পাঙ্ক ও নিকটতম রামন-রেখার দূরত্ব পরমাণুর সর্বনিম্ন দোদুল কম্পাঙ্ক (oscillating frequency) কিংবা অতিলোহিত (ultrared) বর্ণালী-রেখার দূরত্বের সমান হবে। এক্ষেত্রে পরমাণুর জন্য যা সত্য অণুর বেলাতেও তা প্রযোজ্য।
            এভাবে আমরা শক্তিপ্রদানকারী আলোর বর্ণালী রেখার পাশে অতিলোহিত বর্ণালীকে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারি। অণুর গঠন জানার জন্য রামন-রেখার আবিষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
            এতদিন পর্যন্ত অতিলোহিত তরঙ্গের দোলন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পথে কঠিন বাধা ছিল। কারণ বর্ণালীর এই অংশটা এত দূরে পড়ে যে সেখানে ফটোগ্রাফিক প্লেট কাজ করে না। রামনের আবিষ্কারে সেই বাধা দূর হলো এবং পরমাণুর নিউক্লিয়াসের দোলন অনুসন্ধানের জন্য নতুন পথ আবিষ্কৃত হলো। যে সব কম্পাঙ্ক ফটোগ্রাফিক প্লেটের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে সেই অনুযায়ী মূল রশ্মি বেছে নেয়া যায়। রামন-রেখার আকারে অতিলোহিত বর্ণালী ফটোগ্রাফিক প্লেটের কাছে সরে আসবে এবং ফলে রেখাগুলির নির্ভুল মাপ নেয়া সম্ভব হবে।
এভাবে রামন ইফেক্টের সাহায্যে অতিবেগুনি বর্ণালীও অনুসন্ধান করা যাবে। সুতরাং বলা যায় আমরা অণুর দোলনের সার্বিক অনুসন্ধানের জন্য একটি সহজ ও নির্ভুল পদ্ধতি পেলাম।
            রামন-ইফেক্ট আবিষ্কৃত হবার পর থেকে এই কবছর রামন ও তাঁর সহযোগীরা কঠিন, তরল, ও গ্যাসীয় অবস্থার বহু মাধ্যমে কম্পাঙ্কের অনুসন্ধান চালিয়েছেন। বিভিন্ন অবস্থায় একত্রিত হবার জন্য অণু পরমাণুর ওপর কোন প্রভাব আছে কিনা, তড়িৎ-বিশ্লেষণে আণবিক অবস্থা, ক্রিস্টালে অতিলোহিত রশ্মির শোষণ বর্ণালী প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা চালানো হয়েছে।
            পদার্থের রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে রামন-ইফেক্ট ইতোমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এনে দিয়েছে। এখন রামন-ইফেক্ট নামে যে অত্যন্ত মূল্যবান আবিষ্কার আমাদের হাতে এলো তার সাহায্যে পদার্থের গঠন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অদূর ভবিষ্যতে আর কতদূর প্রসারিত হয় এটাই দেখার অপেক্ষা।
            স্যার ভেঙ্কট রামন, গ্যাসের ব্যাপনে আপনার ব্যাপক গবেষণা এবং আপনার নাম অনুসারে রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য রয়েল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস আপনাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দিচ্ছে। পদার্থের গঠন বিন্যাস বিষয়ে জ্ঞানের নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে রামন-ইফেক্ট এবং ইতোমধ্যেই অনেক নতুন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। এবার আমি আপনাকে অনুরোধ করছি হিজ ম্যাজেস্টির হাত থেকে নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ করার জন্য।
            স্যার রামন সুইডেনের রাজার কাছ থেকে নোবেল পুরষ্কারের মেডেল ও সার্টিফিকেট নিয়ে মঞ্চের ওপর নিজের আসনে বসার পর কান্নায় ভেঙে পড়লেন।             পরে তিনি এই আবেগঘন ঘটনার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: "নোবেল পুরষ্কার যখন ঘোষণা করা হয়, আমি শুরুতে ভেবেছিলাম এটা আমার ব্যক্তিগত অর্জন, আমার সহযোগীদের অর্জন। গত সাত বছর ধরে আমি যে কঠোর বিজ্ঞান-সাধনা করেছি এটা তার পুরষ্কার। কিন্তু যখন আমি নোবেল পুরষ্কারের মঞ্চে বসলাম, চারপাশে চেয়ে দেখলাম হাজার হাজার পশ্চিমা মানুষের মধ্যে আমি একমাত্র ইন্ডিয়ান, মাথায় পাগড়ি পরে বসে আছি। আমার মনে হলো আমি সারা ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করতে এখানে এসেছি। রাজা গুস্তভের কাছ থেকে পুরষ্কার নেয়ার পর আমার খুবই গর্ব হলো। পুরষ্কার নিয়ে যেই আমার আসনের দিকে তাকালাম, দেখলাম আমি এতক্ষণ বসেছিলাম ব্রিটিশ পতাকার নিচে। কষ্টে আমার বুক ভেঙে গেলো। আমার দুঃখিনী দেশ ভারতবর্ষ, যার নিজের একটা পতাকা পর্যন্ত নেই। আমি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারিনি।"[7]
       
লোকম ও প্রিন্সেস ইনগ্রিড

স্বামীর জন্য গর্বে বুক ভরে যাচ্ছিলো লোকমের। ভোজসভায় লোকমের পাশে বসেছিলেন প্রিন্সেস ইনগ্রিড। তিনি লোকমকে অভিনন্দন জানালেন তাঁর নোবেলবিজয়ী স্বামীর জন্য।
            নোবেল অনুষ্ঠানের রাজকীয় ভোজসভায় স্যার রামনের স্বতস্ফূর্ত বক্তৃতায় সবাই এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে একটু পর পরই হাততালিতে ভরে উঠছিলো হলঘর। রামনের সেন্স অব হিউমারেও মুগ্ধ সবাই। ডিনার টেবিলে রামনকে যখন শ্যাম্পেন পান করার জন্য অনুরোধ করছিলেন পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা, রামন তখন হাসিমুখে বলেছিলেন, "আপনারা অ্যালকোহলের ওপর রামন-ইফেক্ট দেখেছেন। দয়া করে রামনের ওপর অ্যালকোহল-ইফেক্ট দেখার চেষ্টা করবেন না।"
            পুরষ্কার নেবার পরের দিন (১১ ডিসেম্বর ১৯৩০) স্যার রামন তাঁর নোবেল বক্তৃতা দেন।[8] বক্তৃতায় রামন তাঁর প্রত্যেক সহযোগী ছাত্র ও গবেষকের অবদান স্বীকার করলেন। কামেশ্বর রাও, শ্রীবাস্তব, রামদাস, সোগানি, কৃষ্ণান, রামকৃষ্ণ রাও, ভেঙ্কটেশ্বরন, রামচন্দ্র রাও, কৃষ্ণমূর্তি - প্রত্যেকে কে কোন্‌ পরীক্ষণ সম্পন্ন করেছিলেন সবকিছু বলেন। রামন কোনদিনই কারও অবদানকে অস্বীকার করেননি। অনেক বছর পর কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন রামনের বিরুদ্ধে যে তিনি কৃষ্ণানকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেননি। কিন্তু কথাটা সত্য নয়। রামন ইফেক্ট আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্ব রামনের কারণ কৃষ্ণান শুধু রামনের নির্দেশমতো কাজ করেছিলেন। কৃষ্ণানের বদলে কাজটি অন্য কেউ করলেও একই ফল পাওয়া যেতো।
            নোবেল পুরষ্কার পাবার পর স্বাভাবিক নিয়মেই সারা পৃথিবী থেকে আরো অনেক পুরষ্কার ও সম্মানের অধিকারী হলেন স্যার রামন।



[1] S. Ramaseshan, C. Ramachandra. C. V. Raman A Pictorial Biography. Bangalore: The Indian Academy of Sciences, 1988.
[2] Rajinder Singh and Falk Riess, C. V. Raman, M. N. Saha and the Nobel Prize for the year 1930, Indian Journal of History of Science,  34 (1), 1999.
[3] Rajinder Singh and Falk Riess, The 1930 Nobel Prize for Physics: A Close Decision? Notes and Records of the Royal Society of London, Vol 55 (2), 2001.
[4] মূল ইংরেজি ভার্সান পাওয়া যাবে নোবেল পুরষ্কারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে http://www.nobelprize.org/nobel_prizes/physics/laureates/1930/press.html
[5] আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন টাইনড্যালের নাম অনুসারে এই ইফেক্টের নামকরণ করা হয়েছে।
[6] ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জাঁ ক্যাবানিস (Jean Cabannes)
[7] S Ramsheshan and C Ramchandra Rao, C. V. Raman, A Pictorial Biography, Indian Academy of  Sciences, Bangalore, 1988.
[8] মূল ইংরেজি বক্তৃতা পাওয়া যাবে নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/physics/laureates/1930/raman-lecture.html

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts