Sunday 27 November 2022

অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস

 



সেলসিয়াস শব্দটির সাথে আমরা খুব পরিচিত। তাপমাত্রার যে একক পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে ব্যবহৃত হয় – তার নাম সেলসিয়াস। কিন্তু এই শব্দটি কোত্থেকে এসেছে সে ব্যাপারে হয়তো আমরা খুব একটা খোঁজখবর রাখি না। হিট অ্যান্ড টেম্পারেচার – অর্থাৎ তাপ এবং তাপমাত্রা যে এক জিনিস নয় সে জ্ঞান মানুষের হয়েছে হাজার বছর আগে। আজ থেকে প্রায় ১৮৫০বছর আগে গ্রিক বিজ্ঞানী গ্যালেন তাপমাত্রা মাপার জন্য যন্ত্র তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন ১৭০ খ্রিস্টাব্দে। এরপর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি তাপমাত্রা মাপার সেন্টিগ্রেড স্কেল। 

১৭৪২ সালে সুইডেনের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস পানির হিমাঙ্ককে ১০০ ডিগ্রি আর ফুটনাঙ্ককে ০ ডিগ্রি ধরে সেন্টিগ্রেড স্কেলের প্রবর্তন করেন। এর আগে ১৭১৪ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ফারেনহাইট চালু করেছিলেন ফারেনহাইট স্কেল। ফারেনহাইট স্কেলে ৩২ ডিগ্রিকে পানির হিমাঙ্ক এবং ২১২ ডিগ্রিকে পানির ফুটনাঙ্ক ধরে নিয়ে মধ্যবর্তী পার্থক্যকে ১৮০ ভাগে ভাগ করে এক ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার হিসেব করা হয়েছে। এই হিসেবটা বড্ড গোলমেলে হিসেব বলে সেলিসিয়াসের প্রবর্তিত সেন্টিগ্রেড স্কেলটাকে অনেক বেশি সহজ এবং গ্রহণযোগ্য মনে হলো সবার। কিন্তু একটু গোলমাল রয়ে গিয়েছিল গিয়েছিল। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে ডিগ্রির পরিমাণ বাড়া উচিত। সেক্ষেত্রে ১০০ থেকে ০ -তে না গিয়ে ০ থেকে ১০০ ডিগ্রিতে যাওয়া উচিত। কিন্তু প্রস্তাবিত উল্টো স্কেলকে সোজা করার সময় পাননি অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস। ১৭৪৪ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি। 

সেলসিয়াসের মৃত্যুর পর উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস সেলসিয়াস স্কেলকে উল্টে দিয়ে ঠিক করে দেন। নতুন স্কেলে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পানি জমে বরফ হয়ে যায়, আর ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পানি ফুটতে শুরু করে। 

সেলসিয়াসের প্রবর্তিত সেন্টিগ্রেড স্কেল এরপর প্রায় দু’শ বছর ওভাবেই ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে জ্যামিতিক মাপজোকের পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। কোণের পরিমাণও ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হিসেবে মাপা হয় বলে তাপমাত্রা আর কোণের পরিমাপের মাপ আলাদা করতে ঝামেলা হচ্ছিল। তাই ১৯৪৭ সালে তাপমাত্রা মাপার একককে 'ডিগ্রি সেলসিয়াস' হিসেবে প্রচলন করা হয়।

সুইডিশ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স সেলসিয়াসের জন্ম ১৭০১ সালের ২৭ নভেম্বর, সুইডেনের উপসালায়। যে পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল – সেই পরিবারের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য প্রায় দু’শ বছরের। তাঁর পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ সবাই ছিলেন বিজ্ঞানী। তাঁর বাবা নিলস সেলসিয়াস ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় দক্ষতা অর্জন করে অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস উপসালা ইউনিভার্সিটিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৭৩০ সালে। ১৭৪৪ সালের ২৫ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৭৪০ সালে তাঁর তত্ত্বাবধানে উপসালা ইউনিভার্সিটিতে তৈরি হয় মানমন্দির।

সেলসিয়াসের বৈজ্ঞানিক জীবনে সবচেয়ে বেশি অবদান জ্যোতির্বিজ্ঞানে হলেও – তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁর তাপমাত্রা পরিমাপের স্কেলের মধ্যে।


Saturday 19 November 2022

কোয়ান্টামের জটাজাল - পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ২০২২

 




“আচ্ছা, তুমি কি বিশ্বাস করো যে যখন তুমি চাঁদের দিকে তাকাও তখনি শুধু চাঁদের অস্তিত্ব আছে, আর অন্য সময়ে নেই?” এ কেমন প্রশ্ন? আমরা তো জানি যে চাঁদ আছে গত সাড়ে চারশ কোটি বছর থেকে পৃথিবীর আকাশে। থাকবে আরো কয়েক শ কোটি বছর। কিন্তু সেখানে চাঁদের অস্তিত্ব কেন নির্ভর করবে তার দর্শকের উপর? প্রশ্নটাকে এলেবেলে প্রশ্ন বলে উড়িয়ে দেয়ার কোন উপায় নেই যখন স্বয়ং আইনস্টাইন এই প্রশ্ন করেন। আইনস্টাইন তাঁর জীবনীকার পদার্থবিজ্ঞানী আব্রাহাম পেইজকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের রহস্যময়তার প্রতি তাঁর অস্বীকৃতির সমর্থনে। এটা ঠিক যে চাঁদের মতো বড় আকারের বস্তুর প্রসঙ্গে এরকম প্রশ্ন খাটে না। কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার যে ধর্ম কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয় – সেখানে দেখা যায় – কোন একটি কণা কীরকম আচরণ করবে তা নির্ভর করে তার দর্শকের উপর। কোয়ান্টাম মেকানিক্স কণার আচরণের সম্ভাবনার কথা বলতে পারে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কী হবে তা বলতে পারে না। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কণাটিকে দেখতে হবে।

পরমাণুর ভেতর তার উপাদান – ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন – এগুলি কীভাবে বিন্যস্ত হয়ে থাকবে তার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দেয়া যায় কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে। ধরা যাক হাইড্রোজেন পরমাণুর কথা। এর একটিমাত্র ইলেকট্রন। এই ইলেকট্রনের অন্তঃঘূর্ণন বা স্পিন হতে পারে +১/২ কিংবা -১/২। দেখার আগ পর্যন্ত কিছুতেই সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় যে কোন একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রনের স্পিন +১/২ হবে কি -১/২ হবে। হাইড্রোজেন পরমাণুর বদলে যদি হিলিয়াম পরমাণুর কথা বিবেচনা করি – দেখা যাবে ব্যাপারটা আরো রহস্যময়। হিলিয়াম পরমাণুতে দুটো ইলেকট্রন আছে। তারা একই কক্ষপথে থাকে। পাউলির বর্জননীতি মেনে চলতে হয় তাদের। সেই নীতি অনুযায়ী একটি ইলেকট্রনের স্পিন যদি +১/২ হয়, অন্য ইলেকট্রনের স্পিন অবশ্যই -১/২ হবে। কোন ইলেকট্রনের স্পিন কী হবে তা না দেখে সুনির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে একটি ইলেকট্রনের স্পিন যদি জানতে পারি, অন্যটির স্পিন কী হবে তা না দেখেই বলে দেয়া যায়। কিন্তু একটাও না দেখা পর্যন্ত কোনটারই স্পিন কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে ফলাফল নির্ভর করছে দর্শকের উপর? কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে - ঠিক তাই । যতক্ষণ দেখা না হচ্ছে – ততক্ষণ সম্ভাবনার সুপারপজিশান স্টেটেই থাকছে ইলেকট্রনের স্পিন।

এরকম ব্যাপার আমরা কয়েন টস করার সাথেও তুলনা করতে পারি। একটি কয়েন শূন্যে ছুঁড়ে দিলে তা নিচে পড়ার পর হেড অথবা টেল উঠবে তা আমরা জানি। কিন্তু ঠিক কী উঠবে তা দেখার আগপর্যন্ত বলতে পারি না। তাহলে কয়েন যতক্ষণ শূন্যে থাকে – ততক্ষণ কি তার হেড কিংবা টেল কোনোটাই থাকবে না? এই গোলমেলে প্রশ্নের উত্তর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিজ্ঞানীদের দিতে হয়েছে অনেক বছর। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সম্ভাবনার নিয়ম মেনে নিতে পারেননি। তাই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারণার প্রতি তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বার বার। এবং বলা যায় তা থেকেই পথ খুলে গেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিশাল ব্যবহারিক দিকের।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কোয়ান্টাম তথ্যপ্রবাহসহ কোয়ান্টাম প্রযুক্তির অসংখ্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে আজ। এই সম্ভাবনার দরজা যাঁরা খুলে দিয়েছেন, তাঁদেরই তিনজন পদার্থবিজ্ঞানী এবছরের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের যে তিনজন পরীক্ষণ-বিজ্ঞানী ২০২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন – তাঁরা হলেন ফ্রান্সের ইকোল পলিটেকনিকের অধ্যাপক আলান এসপেক্ট (Alan Aspect), ক্যালিফোর্নিয়া জে এফ ক্লাউসার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এর প্রধান বিজ্ঞানী জন এফ ক্লাউসার (John F Clauser), এবং অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্তন সাইলিঙ্গার (Anton Zeilinger)। ২০১০ সালে যখন এই ত্রয়ী পদার্থবিজ্ঞানে উল্‌ফ পুরষ্কার পেয়েছিলেন, তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা আশা করে আসছিলেন যে এই তিনজনকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হবে যেকোনো বছর। তাই এবছর যখন নোবেল কমিটি এই তিনজনের নাম ঘোষণা করলো, তখন পদার্থবিজ্ঞানের সবাই খুব খুশি হয়েছেন, কিন্তু আশ্চর্য হননি। এই তিনজন বিজ্ঞানীরই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরীক্ষণ কাজের প্রতি আগ্রহের মূল কারণ ছিল আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিরোধিতা।

আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে ১৯২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম স্থপতি নীলস বোর। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্থপতিদের মধ্যে ম্যাক্স প্ল্যাংক, নীলস বোর, লুই ডি ব্রগলি, ম্যাক্স বর্ন, পল ডিরাক, ভার্নার হাইজেনবার্গ, উলফগং পাউলি, এরভিন শ্রোডিঙ্গার, রিচার্ড ফাইনম্যান – সবাই নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তার নীতিকে সমর্থন করেননি। কিন্তু তাঁর আপেক্ষিকতার সূত্র প্রয়োগে কোয়ান্টাম মেকানিক্স হয়ে উঠেছে আরো বেশি শক্তিশালী। আইনস্টাইন নিজের অজান্তেই শক্ত ভিত্তি দিয়ে গেছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। বলা চলে আইনস্টাইনের বিরোধিতার কারণেই আবিষ্কৃত হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনেক কিছু।

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এই নীতি অনুসারে কোন কণার শক্তি এবং সময় একই সাথে সঠিকভাবে মাপা যায় না। মাপতে গেলে সেখানে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকবেই। একই ব্যাপার ঘটে কোন কণার অবস্থান এবং ভরবেগ মাপার ক্ষেত্রেও। আমরা যদি কোন কণার সঠিক অবস্থান মাপতে যাই, সেই সময়ে তার ভরবেগ কত তা সঠিকভাবে জানি না। যখন ভরবেগ মাপতে যাই, তখন কণার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। আইনস্টাইন এই ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বলতেন, কোন নিয়মের মধ্যে যদি অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা থাকে তাহলে সেই নিয়ম অসম্পূর্ণ।

১৯৩০ সালের ব্রাসেলস এ অনুষ্ঠিত সলভে কনফারেন্সে আইনস্টাইন নীল্‌স বোরকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিলেন। আইনস্টাইন একটি থট-এক্সপেরিমেন্ট বা মানস-পরীক্ষার বর্ণনা দিলেন। ধরা যাক একটি আলোভর্তি বাক্সের কথা। বাক্সের ভেতর আলোর ফোটন রয়েছে। বাক্সটি ওজন করা হলো। সঠিকভাবে বাক্সের ওজন নেয়া সম্ভব। এরপর বাক্স থেকে সুনির্দিষ্টপদ্ধতিতে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে একটিমাত্র ফোটন বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ফোটনটি ঠিক কোন্‌ সময়ে বের হয়েছে তা বাক্সের ভেতর রাখা ঘড়ির সাহায্যে সঠিকভাবে মাপা সম্ভব। এখন ফোটনটি বের হয়ে যাবার পর বাক্সটির আবার ওজন নেয়া হলো। ফোটন বের হবার আগের এবং পরের ওজনের পার্থক্য থেকে E = mc2 সূত্র প্রয়োগ করে জানা যাবে বের হয়ে যাওয়া ফোটনটির শক্তি। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে একই সময়ে কণার শক্তি এবং সময় দুটোই মাপা যাচ্ছে। তা যদি যায়, তাহলে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র আর খাটছে না।

নীলস বোর বিপদে পড়ে গেলেন। আইনস্টাইনের এই মানস-পরীক্ষায় আপাত কোন ভুল তিনি বের করতে পারলেন না। কিন্তু কোন ভুল যদি সেখানে না থাকে, তাহলে পুরো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে। নীলস বোর ব্রাসেলস এর হোটেলরুমে বসে আইনস্টাইনের মানস-পরীক্ষা নিয়ে ভাবলেন সারা রাত। ভাবতে ভাবতে পেয়ে গেলেন সমাধান। আইনস্টাইনের মানস-পরীক্ষায় আইনস্টাইন নিজের তত্ত্বই প্রয়োগ করতে ভুলে গেছেন!

পরদিন নীলস বোর আইনস্টাইনকে বললেন কোথায় ভুলটা করেছেন আইনস্টাইন। বাক্স থেকে ফোটন যখন বের হচ্ছে তখন ফোটনের স্থান পরিবর্তন হচ্ছে। এই স্থান পরিবর্তনের ফলে ঘড়ির স্থান-কালের (স্পেস-টাইম) পরিবর্তন ঘটবে। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব অনুসারে তখন সময়ের মাপে অনিশ্চয়তা দেখা যাবে – তা যত ছোটই হোক। সুতরাং ফোটনের শক্তি ঠিকমতো মাপা গেলেও সময়ের মাপে অনিশ্চয়তা রয়েই যাবে। আইনস্টাইন মেনে নিতে বাধ্য হলেন।

এরপর কয়েক বছর মোটামুটি চুপ করে থাকলেও আইনস্টাইন মন থেকে মানতে পারছিলেন না যে এত অনিশ্চয়তা নিয়েই কোয়ান্টাম মেকানিক্স এতটা সাফল্য লাভ করছে। ১৯৩৫ সালে তিনি তাঁর দুজন নবীন সহকর্মী রাশিয়ান-আমেরিকান বরিস পডলস্কি এবং ইসরায়েলি-আমেরিকান নাথান রোজেনের সাথে যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন ফিজিক্যাল রিভিউতে। তাঁদের তিনজনের নামানুসারে এই গবেষণাপত্রটি ইপিআর পেপার নামে খ্যাতিলাভ করেছে। বিশেষ করে আমেরিকার প্রচারমাধ্যমগুলির কল্যাণে। এই পেপারটি প্রকাশিত হবার পর নিউইয়র্ক টাইমস “আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে আক্রমণ করেছেন” শিরোনামে মুখরোচক সংবাদ প্রকাশ করেছিল।

কী ছিল এই গবেষণাপত্রে? এই গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন আক্রমণ করেছিলেন কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্টকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা বিশেষ ধর্ম হলো – কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট বা কোয়ান্টামের জটাজাল। একই উৎস থেকে উৎপন্ন দুটো কোয়ান্টাম কণা এমন যুগলভাবে কাজ করে যেন কোন অদৃশ্য সূতার টানে একটি অপরটির সাথে যোগাযোগ করতে থাকে – তাদের মাঝখানের বাস্তব দূরত্ব যাই হোক না কেন। সেই অবস্থায় একটি কণাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অন্য কণাকেও আপনাআপনি  নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে তা সহজে বোঝা যায় না।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গোড়া থেকেই কোয়ান্টাম-কণার পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটাকে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেলের ভিত্তিই হলো কোয়ান্টাম নাম্বার  – যা কণাগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই পাওয়া যায়। যেমন হিলিয়াম পরমাণুর দুটো ইলেকট্রনের স্পিনের কথা আমরা আগেই বলেছি। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে কোয়ান্টাম-কণা তরঙ্গ আকারেও থাকতে পারে।

তরঙ্গের ক্ষেত্রে দুটো তরঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায় আরো সহজে। দুটো তরঙ্গ যখন একটি আরেকটিকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করে তখন তারা পরস্পরের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এরপর তাদের অবস্থা আর আগের মতো থাকে না। এরপর তারা যদি পরস্পরের কাছ থেকে অনেক দূরেও চলে যায়, তাদেরকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা যায় না। তখন একটি তরঙ্গের গতিপ্রকৃতি দেখে অন্য তরঙ্গের গতিপ্রকৃতি অনুমান করা যায়।




আইনস্টাইন এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলেন না। একই উৎস থেকে উৎপন্ন দুটি কণা পরস্পরের কাছ থেকে যত দূরেই যাক না কেন, একটির সাথে অন্যটি এনটেঙ্গেল্ড হয়ে থাকবে বা জটাজালে যুক্ত থাকবে তা স্বাভাবিক চিন্তায় কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অবশ্য কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট কথাটি প্রথম চালু করেছিলেন এরভিন শ্রোডিঙ্গার, আইনস্টাইনের ইপিআর গবেষণাপত্র প্রকাশের পর তার জবাব দিতে গিয়ে।

১৯৩৫ সালের ফিজিক্যাল রিভিউর ৪৭ সংখ্যায় প্রকাশিত Can quantum mechanical description be considered complete? প্রবন্ধ – যা ইপিআর পেপার নামে খ্যাত, আইনস্টাইন, পডলস্কি এবং রোজেন একটি মানস-পরীক্ষণ বিশ্লেষণ করেছেন। একই উৎস থেকে দুটো কোয়ান্টাম-কণা উৎপন্ন হয়ে পরস্পরের বিপরীত দিকে চলে গেছে অনেকদূর। এই দুটো কণা পারস্পরিক অদৃশ্য জটাজালে আবদ্ধ। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুযায়ী একজন পর্যবেক্ষণকারী যতক্ষণ কণাগুলির স্পিন না দেখছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের কোনটারই স্পিন সুনির্দিষ্ট নয়। তারা তখনো কোয়ান্টাম সুপারপজিশান স্টেটে আছে। এখন কোন দর্শক যদি একটি কণার স্পিন +১/২ বা স্পিন-আপ দেখে, তাহলে অন্য কণাটির স্পিন সাথে সাথে -১/২ বা ডাউন হতে বাধ্য। কারণ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী মোট স্পিন সংরক্ষিত। অর্থাৎ কোন সিস্টেমের শুরুতে যদি মোট স্পিন শূন্য হয়, শেষেও মোট স্পিন হবে শূন্য। সেক্ষেত্রে একটি কণার স্পিন +১/২ হলে অন্যটির স্পিন -১/২ হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে যে কোনো একটি কণা দেখে অন্য কণাটি যেখানে যত দূরেই থাকুক না কেন তার ধর্ম বলে দেয়া সম্ভব। আইনস্টাইনের ভাষায় এটা এক ধরনের স্পুকি অর্থাৎ ভুতুড়ে ব্যাপার। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে একটি কণা আরেকটি কণাকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাৎক্ষণিকভাবে। কণাগুলি যদি পরস্পরের কাছ থেকে আলোকবর্ষ দূরেও থাকে, তাহলেও তৎক্ষণাৎ নিয়ন্ত্রণ ঘটে যাচ্ছে। এরকম কাজের যে গতি তা আলোর গতির চেয়েও দ্রুত। কিন্তু তা তো অসম্ভব। এরকম ভুতুড়ে ব্যাপার বিজ্ঞানে চলতে পারে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স যদি সত্যিই এভাবে কাজ করে তাহলে এখানে এমন কিছু হিডেন ভ্যারিয়েবল বা গুপ্ত চলক আছে যা আমরা এখনো জানতে পারিনি। এই যুক্তি দেখিয়ে ইপিআর পেপারে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন আইনস্টাইন এবং তাঁর সহযোগীরা।

এই প্রবন্ধের উত্তরে আরভিন শ্রোডিঙ্গার Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society’র জার্নালে প্রকাশিত ‘Discussion of probability relations between separated system’ প্রবন্ধে লেখেন যে দুটো কোয়ান্টাম কণা পরস্পরের সান্নিধ্যে এলে পরস্পর এনটেঙ্গেল্ড বা জটাজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। কোয়ান্টাম জটাজাল বুঝতেও জটিল, তার কাজকর্মও জটিল, কিন্তু সত্য।

এরপর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাফল্য অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ইপিআর পেপার নিয়ে অনেক বছর কেউ আর মাথা ঘামায়নি। বিশেষ করে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী জন ফন নিউম্যান তত্ত্বীয়ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কাজ করার জন্য কোন গুপ্ত চলকের দরকার নেই।

কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুর প্রায় এক দশক পরে ইপিআর পেপারের সমর্থনে ১৯৬৪ সালে একটি নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট বেল। বেল কাজ করতেন জেনিভার সার্ন গবেষণাকেন্দ্রে। এক বছরের ছুটিতে তিনি এই পেপার লিখেছিলেন যা পরে ‘বেলস ইনইকুয়েলিটি’ নামে খ্যাতিলাভ করে। আইনস্টাইনের মতো বেলও একটি মানস-পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন যে কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্টে হিডেন ভ্যারিয়েবলগুলি তথ্য জোগান দেয়। যাদের উপস্থিতি দেখা যায় না, কিন্তু গুপ্তভাবেই তারা কাজ করে। তিনি তাঁর সহকর্মী গবেষক প্রফেসর বার্টলম্যানের উদাহরণ দিলেন – যিনি দুই পায়ে দুই রঙের মোজা পরেন। এখন এই তথ্য যদি কারো জানা থাকে, তাহলে তাঁর এক পায়ের মোজার রঙ দেখেই অন্য পায়ের মোজার রঙ জেনে যাবেন যে কেউই। এখানে গুপ্ত তথ্য দেয়াই আছে। একই রকম ভাবে স্পিনের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। কিন্তু সবগুলি গুপ্ত চলকের মান জানা না থাকলে কোয়ান্টাম-কণার একটিকে জানার পর অন্যটির সব ধর্ম জানা যাবে এমন কোন কথা নেই। সেখানে ফলাফলের অসমানতা থাকবে। এটাই বেলের অসমানতা বা বেলস ইনইকুয়েলিটি। জন বেল তাঁর প্রবন্ধে পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানীদের আহ্বান করেছিলেন কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করার জন্য।

জন বেলের তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য প্রথম এগিয়ে এলেন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জন ক্লাউজার – যিনি এবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

জন ফ্রান্সিস ক্লাউজারের জন্ম ১৯৪২ সালের ১ ডিসেম্বর, ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনায়। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি করেন ১৯৬৪ সালে। এরপর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে এমএ এবং ১৯৬৯ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল মলিকিউলার অ্যাস্ট্রোফিজিক্স। কিন্তু ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাশাপাশি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রতিও খুব আগ্রহী ছিলেন।

১৯৭২ সালে জন ক্লাউজার  ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় পোস্টডক্টরেট করার সময় তাঁর পিএইচডি গবেষক-ছাত্র স্টুয়ার্ড ফ্রিডম্যানের সাথে মিলে বেলের অসমানতা পরীক্ষা করার প্রস্তুতি নিলেন। তিনি ইলেকট্রনের স্পিনের বদলে আলোর কণা ফোটনের পোলারাইজেশানের মাধ্যমে ফলাফল মাপার চেষ্টা করলেন। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানসহ অনেকেই তখন ক্লাউজারকে নিরুৎসাহিত করে বলেছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে আর পরীক্ষা দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু জন বেল ক্লাউজারকে খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন পরীক্ষাটি করে দেখার জন্য। জন বেল দুই ডলার বাজি ধরেছিলেন আইনস্টাইনের পক্ষে। অর্থাৎ বেলস ইনইকুয়েলিটি সত্য প্রমাণিত হবে।


 



ক্লাউজার ক্যালসিয়াম পরমাণুর উপর বিশেষ আলো ফেলে ক্যালসিয়াম থেকে ফোটন নির্গমনের ব্যবস্থা করলেন। ফোটনগুলি একই জায়গা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে – ফলে কোয়ান্টাম জটাজালে আবদ্ধ। দুইটি বিপরীত পাশে ফিল্টার স্থাপন করে ফোটনের পোলারাইজেশান মেপে দেখলেন। ফিল্টারের দিক অনেকবার পরিবর্তন করে তিনি দেখলেন যে একটি ফোটনের পোলারাইজেশান থেকে অন্য ফোটনের পোলারাইজেশান যেরকম হবার কথা ঠিক সেরকমই হচ্ছে। তার মানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্য কোন হিডেন ভ্যারিয়েবলের দরকার নেই। বেলস ইনইকুয়েলিটি ভুল। জন বেল বাজিতে হেরে গেলেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জয় হলো।


 

জন ক্লাউজার তাঁর পরীক্ষা করছেন (ফিজিক্স টু ডে’র সৌজন্যে প্রাপ্ত ছবি)



জন ক্লাউজারের পরীক্ষণে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটাজাল সঠিক প্রমাণিত হলেও সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। ফিল্টারগুলিকে আগে থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় বসানো হয়েছিল। হতে পারে এই ফিল্টারের অবস্থান ফোটনগুলির গতিতে কোনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আরো নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করে দেখার জন্য এগিয়ে এলেন ফ্রান্সের পদার্থবিজ্ঞানী আলান অ্যাসপেক্ট যিনি এবছরের আরেকজন নোবেলজয়ী।

অ্যলান অ্যাসপেক্ট এর জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ জুন ফ্রান্সের আজান (Agen) শহরে। ১৯৬৯ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন প্যারিস-সুদ থেকে। এরপর তিনি তিন বছর ক্যামেরুনে গিয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৮৩ সালে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। পিএইচডি গবেষণা করার সময়েই তিনি বেলস ইনইকুয়েলিটির পরীক্ষাটি করেন।

 



জন ক্লাউজারের পরীক্ষণে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল – যেমন ফিল্টারের অবস্থান আগে থেকে জানা, এসব দূর করার ব্যবস্থা করেন অ্যালান অ্যাসপেক্ট। তিনি ফোটন নির্গমনের হার বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রান্সডিউসার ব্যবহার করে ফিল্টারের অবস্থান প্রতি সেকেন্ডে কয়েক লক্ষবারের বেশি পরিবর্তন করার ব্যবস্থা করলেন। আলোর দিক পরিবর্তন করার ব্যবস্থা করলেন সেকেন্ড আড়াই কোটি বার। এই পরিবর্তনের ফলে ফোটনগুলি আলোর গতিতে চললেও একটি থেকে অন্যটিতে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারবে না। ফলে কোন গুপ্ত চলক থাকলেও তা কাজে লাগবে না। এবারেও দেখা গেল – কোয়ান্টামের জটাজালে আবদ্ধ ফোটনগুলি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম মেনেই চলছে।

অ্যালান অ্যাসপেক্টের পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টে কোন ধরনের গুপ্ত চলকের মাধ্যমে কণাগুলি আগে থেকে কোন তথ্য পেয়ে যায় না। কিন্তু তারপরেও বিজ্ঞানীদের সন্দেহ যায় না। এমনও তো হতে পারে কণাগুলি আগে থেকেই বুঝে ফেলছে কীভাবে ডিটেক্টরগুলি কিংবা ফিল্টারগুলির দিক পরিবর্তন হবে! এই সন্দেহও দূর করার জন্য এগিয়ে এলেন অস্ট্রিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী আন্তন সাইলিঙ্গার – যিনিও এবার নোবেল পুরষ্কার পেলেন।

আন্তন সাইলিঙ্গারের জন্ম অস্ট্রিয়ায় ১৯৪৫ সালের ২০ মে। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি অর্জন করেছেন ১৯৭১ সালে। বর্তমানে তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর।

২০১৭ সালে প্রফেসর সাইলিঙ্গারের গবেষকদল মহাকাশের তারার আলো থেকে ভেসে আসা ফোটনকে কাজে লাগিয়ে বেলস ইনইকুইলিটি পরীক্ষাটি আবার করেন।



 

প্রফেসর সাইলিঙ্গার বিশেষ ধরনের কৃস্টালের উপর লেজার আলো প্রয়োগ করে ফোটন তৈরি করেন। আবার একই সাথে মহাকাশের দূর নক্ষত্র থেকে ভেসে আসা আলো ফেলার ব্যবস্থাও করেন কৃস্টালের উপর। মহাকাশ থেকে ভেসে আসা ফোটনগুলিও কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট মেনে চলেছে। তার মানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্য কোন ধরনের গুপ্ত চলকের দরকার নেই। কিন্তু কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট কীভাবে কাজ করে তা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।

এই পরীক্ষা করার বিশ বছর আগে থেকেই কোয়ান্টামের জটাজাল কাজে লাগিয়ে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশান পরীক্ষা করা শুরু করেছেন। যেহেতু কোয়ান্টামের জটাজালে আবদ্ধ কণার একটিকে জানতে পারলে অন্যটিকেও জানা হয়ে যায়, সেহেতু একপ্রান্তের কণার পর কণা সাজিয়ে অন্যপ্রান্তে হুবহু কপি করে ফেলা সম্ভব। প্রফেসর সাইলিঙ্গারের দল কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশানে কিছুটা সাফল্য অর্জন করেছেন।

কোয়ান্টামের জটাজালের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে এবং কোয়ান্টাম এনক্রিপশানে। তথ্যপ্রযুক্তির এই দুর্বার গতির যুগে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়তে হয় তথ্যচুরি হয়ে যাবার সম্ভাবনার কারণে। প্রচলিত ডিজিটাল কম্পিউটারের তথ্যপ্রবাহে তথ্যচুরির হাত থেকে বাঁচতে এবং গোপনীয়তা রক্ষায় যে কৌশল অবলম্বন করা হয় – তাতে একই তথ্যের অনেকগুলি কপি করে গুপ্ত সংকেতের মাধ্যমে তা সুরক্ষিত রাখা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম এনক্রিপশানে কোয়ান্টামের জটাজাল অত্যন্ত জটিল গুপ্ত সংকেত তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করবে যা চুরি করার কোন উপায় থাকবে না।

আমাদের ভবিষ্যত প্রযুক্তি হবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি – যার অনেক প্রয়োগ আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। এই সময় এবছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলপুরষ্কার কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যবহারিক সাফল্যের উজ্জ্বল স্বীকৃতি।

 

তথ্যসূত্র:

১। এ এম হারুন অর রশীদ, একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত, (বিজ্ঞান সমগ্র), অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা ২০১০।

২। Brian Clegg, Cracking Quantum Physics, Cassell, London, 2017.

৩।  www.nobelprize.org

৪। Louisa Gilder, The age of entanglement, Vintage Books, New York, 2008. 

____________

বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত











Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts