Saturday, 21 May 2022

অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন ২০২২

 



অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল ইলেকশান হয়ে গেল একটু আগে। এখন ভোট গণনা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভোট দেয়া হয়ে গেলো এই দেশে। অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ নাগরিকের  মতোই আমারও রাজনীতির ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু ভোট দেয়া এখানে বাধ্যতামূলক। তাই দিতে হয়। কিন্তু এদেশে নির্বাচনের ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই খুশির ব্যাপার বলে মনে হয়। নাগরিক অধিকার বলে উচ্চকন্ঠ হতে দেখা যায় প্রায় সব দেশেই। কিন্তু নাগরিক দায়িত্বের ব্যাপারটা সেভাবে গুরুত্ব পায় না। এখানে নাগরিক দায়িত্বের ব্যাপারটাতে গুরুত্ব দেয়া হয়। এই দায়িত্ব পালন করা বাধ্যতামূলক।

এখানে ভোট দিতে গেলে যেসব ব্যাপার দেখে আমার আনন্দ লাগে সেগুলির মধ্যে আছে – ভোট কেন্দ্রের কোথাও কোন পুলিশ নেই, নির্বাচন কমিশননিযুক্ত নিরস্ত্র কর্মীরাই ভোট পরিচালনা করে, নির্বাচনী সহিংসতা নামক কোন ব্যাপার এখানে ঘটে না, ভোট দিয়েছি কি না প্রমাণ করার জন্য আঙুলে কোন কালি লাগানো হয় না –– একবার ভোট দিয়ে আরেকবার যে দিতে যাবে না সেই বিশ্বাসে নাগরিকের সততা ও দায়িত্বকে সম্মান করা হয় সবখানে, বেশিরভাগ কেন্দ্রেই কোন পরিচয়পত্রও দেখাতে হয় না; কেবল নাম-ঠিকানা বললেই হয়, এমপি পদে যে আসনে যতজন প্রার্থী হন – তাদের সবাইকেই ভোট দিতে হয় পছন্দ অনুসারে ১, ২, ৩ ইত্যাদি লিখে। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রার্থীই ভোট পান – শুধু যিনি সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রথম পছন্দ তিনিই জিতেন।

আর কয়েক ঘন্টা পরেই চূড়ান্ত হয়ে যাবে – বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবার দায়িত্বে আসবেন, নাকি লেবার পার্টি সরকার গঠন করবে। যেই করুক, অন্যদল তাকে অভিনন্দন জানিয়ে হাসিমুখে সরে যাবে।

ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট প্র্যাকটিস বলে একটা ব্যাপার আছে। পৃথিবীর উন্নত ব্যবস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার অবিরাম চেষ্টার নামই সত্যিকারের উন্নতি। অস্ট্রেলিয়ায় সরকারের মেয়াদ তিন বছর নির্ধারণ করা হয়েছে এজন্য যে দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকলে দায়িত্বে অবহেলার ভাব চলে আসে, দায়িত্বকে ক্ষমতা বলে ভাবতে শুরু করে। দুর্নীতিও হতে পারে। কম মেয়াদী হলে নির্বাচিতদের ভয় থাকে – কিছুদিন পরেই দায়িত্ব হারানোর। এদেশের রাজনীতিকরা জনগণকে সমীহ করেন, কারণ জনগণের ভোটেই আছে তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত। এদেশে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে, দুর্নীতি করলে – রাজনৈতিক দলগুলি তাদেরকে বহিস্কার করতে বাধ্য হয়। না হলে তাদের আবার নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যায়। দুর্নীতিবাজকে ভোটের মাধ্যমে উপড়ে ফেলার দায়িত্বটা তখন নাগরিকরাই নেয়।

আমার প্রশ্ন হলো এরকম একটা কল্যাণকর সমাজব্যবস্থা যদি অস্ট্রেলিয়া তৈরি করতে পারে, কানাডা পারে, ইওরোপের অনেক দেশ পারে – পৃথিবীর অনেকগুলি দেশ পারে না কেন?


Tuesday, 17 May 2022

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন

 



আমাদের শরীরের মূল নক্‌শা বা ব্লু-প্রিন্ট থাকে আমাদের ডিএনএ-তে। বলা চলে শারীরিক কার্যাবলির সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত ডিএনএ দ্বারা। এই ডিএনএ’র আণবিক গঠন আবিষ্কৃত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। ১৯৬২ সালে ফ্রান্সিস ক্রিক, জেম্‌স ওয়াটসন এবং মরিস উইলকিন্‌স চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের জন্য। ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের পর জীবের শারীরবৃত্তিক কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি নিঁখুতভাবে জানার অনেকগুলি পথ খুলে গেল।

শরীরের তথ্যনির্দেশ জমা থাকে জিনে। এই তথ্যনির্দেশ কার্যকর করার জন্য তথ্যগুলি কপি করে কোষের বাইরের অংশে পাঠানো হয়। সেখানে এগুলি প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেয়। মূলত বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন মিলে আমাদের শারীরিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই তথ্য কপি করার ব্যাপারটাকে বলা হয় ট্রান্সক্রিপশান। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবকোষ থেকে শুরু করে অতিকায়  ডায়নোসর – সব রকমের জীবনের জন্যই এই ট্রান্সক্রিপশান অপরিহার্য। ট্রান্সক্রিপশান বা তথ্যনির্দেশ যদি কোষের বাইরে আসতে না পারে বা কপি করা না হয়, তাহলে কোষগুলি বুঝতে পারে না কী করতে হবে। ফলে দেহের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে জীবকোষের মৃত্যু হয়। এই ট্রান্সক্রিপশানের সময় যদি কোন গন্ডগোল হয়, তবে কোষগুলির বাইরে ভুল তথ্যনির্দেশ চলে আসে। ফলে নানারকম রোগের উৎপত্তি হতে পারে, বিশেষ করে কোষঘটিত রোগ – যেমন ক্যান্সার।

এই ট্রান্সমিশান কীভাবে ঘটে তার পারমাণবিক পর্যায়ের নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কার করে ২০০৬ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানী রজার কর্নবার্গ। ডিএনএর পাশাপাশি আমরা জেনেছি আরএনএর কথা। ডিএনএ-তে যেমন সিঁড়ির মতো পাশাপাশি দুটো স্ট্র্যান্ড থাকে, আরএনএতে থাকে একটি স্ট্র্যান্ড। প্রধানত তিন ধরনের আরএনএ পাওয়া যায় – ম্যাসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ), রাইবোজোমাল আরএনএ (আরআরএনএ), এবং ট্রান্সফার আরএনএ (টিআরএনএ)। রজার কর্নবার্গ আবিষ্কার করেছিলেন ডিএনএর তথ্যনির্দেশ কীভাবে এমআরএনএ-তে যায় যেখান থেকে কোষগুলি দরকারি প্রোটিন তৈরির নির্দেশ পায়।

তখনো পর্যন্ত আরআরএনএগুলি কীভাবে কাজ করে – অর্থাৎ রাইবোজোমের আণবিক গঠন নিঁখুতভাবে জানা সম্ভব হয়নি। রাইবোজোমকে বলা হয় জীবকোষের প্রোটিন তৈরির কারখানা। এই রাইবোজোমের কার্যপদ্ধতি হলো কোষের কাজগুলির মধ্যে সবচেয়ে জটিল কাজ। রাইবোজোম এই জটিল কাজগুলি কীভাবে করে তা আবিষ্কার করেছেন যে তিনজন বিজ্ঞানী – তাঁদের একজন হলেন ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন – যাকে পরিচিতরা সবাই ভেঙ্কি বলে ডাকেন।

রাইবোজোমের কার্যপ্রণালী আবিষ্কার করার জন্য ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন অ্যাডা ইওনাথ, থমাস স্টিজ এবং ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন। তাঁদের আবিষ্কারের ফলেই শরীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজকর্মের অনেক অজানা জটিল রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। আমরা এখন জানি কীভাবে ডিএনএ/আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরির নির্দেশ আসে, এবং রাইবোজোম কীভাবে যথাসময়ে যথামাত্রায় যথাযথ প্রোটিন তৈরি করে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আবিষ্কৃত এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে অনেক নতুন অ্যান্টি-বায়োটিক। সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অতিদ্রুত ভ্যাক্সিন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে রাইবোজোমের কাজকর্ম ভালোভাবে জানা ছিল বলেই।

পারমাণবিক পর্যায়ে গেলে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান – বিজ্ঞানের এরকম শাখাপ্রশাখার মধ্যে খুব বেশি বিভেদ থাকে না। রসায়নে নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানী ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন ছিলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী। পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করার পর তিনি জীববিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই তিনি সাফল্যের চূড়ায় উঠেছেন, নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনিই ছিলেন রয়েল সোসাইটির সাড়ে তিন শ বছরের ইতিহাসে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। 

বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বনেদী আর গৌরবজনক সংগঠন হলো লন্ডনের রয়েল সোসাইটি। ১৬৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের ফেলোশিপ পাওয়াটা বিজ্ঞানীদের জন্য খুবই গৌরবজনক ব্যাপার। স্যার আইজাক নিউটন, স্যার হামফ্রে ড্যাভি, থমাস হাক্সলি, লর্ড কেলভিন, লর্ড রেলে, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, উইলিয়াম ব্র্যাগ, প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট প্রমুখ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী যারা রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মনোনীত হয়েছিলেন, তাঁদের পাশে রয়েল সোসাইটির এপর্যন্ত একমাত্র প্রেসিডেন্ট স্যার ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন যার জন্ম আমাদের উপমহাদেশে।

ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন - ভেঙ্কির জন্ম তামিলনাড়ুর চিদাম্বরমে ১৯৫২ সালে। তাঁর বাবা সিভি রামকৃষ্ণন এবং মা রাজলক্ষ্মী – দু’জনই ছিলেন জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের পরিমন্ডলে বড় হয়েছেন ভেঙ্কি। তাঁর জন্মের সময় তার বাবা আমেরিকার উইসকনসিনে পোস্টডক্টরেট গবেষণা করছিলেন। আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে তিনি সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে তামিলনাড়ুতে রেখে গিয়েছিলেন। রাজলক্ষ্মীকে সাথে নিয়ে গেলে ভেঙ্কি জন্মসূত্রে আমেরিকান হতে পারতেন। বাবা পোস্টডক্টরেট করে ফিরে আসার পর মা গেলেন কানাডায় পিএইচডি করার জন্য। তখন বাবাও সাথে গেলেন দেড় বছরের ভেঙ্কিকে নানা-নানীর জিম্মায় রেখে। ফিরে আসার পর তারা চিদাম্বরম থেকে বরোদায় চলে গেলেন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে।

বরোদায় ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে লেখাপড়া শুরু হলো ভেঙ্কির। ১৯৫৯ সালে ভেঙ্কির ছোটবোন ললিতার জন্ম হয়। ১৯৬০-৬১ সালে বাবা-মায়ের অস্ট্রেলিয়ায় ফেলোশিপ নিয়ে আসার সুবাদে এক বছর অস্ট্রেলিয়ার এডেলেইডের স্কুলে পড়াশোনা করে ভেঙ্কি। আবার ভারতে ফিরে গিয়ে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করলো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কী নিয়ে পড়াশোনা করবে স্থির করতে পারছিলেন না ভেঙ্কি। তাঁর বাবা চাচ্ছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। ডাক্তারিতে ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টিকেছিল ভেঙ্কি। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চরম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টিকে আই-আই-টিতে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মেডিকেল কলেজে পড়াশোনাটাকে খুব একটা আকর্ষণীয় মনে হলো না ভেঙ্কির কাছে- কারণ সেখানে অনেক জিনিস মুখস্থ করতে হয়। তাঁর কাছে মৌলিক বিজ্ঞানের পড়াশোনাকেই অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো। সেইসময় মৌলিক বিজ্ঞানে পড়াশোনায় উৎসাহিত করার জন্য ভারত সরকার একটা আকর্ষণীয় বৃত্তি দিচ্ছিলো মেধাবী শিক্ষার্থীদের। ভেঙ্কি সেই বৃত্তি নিয়ে বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন বিএসসি কোর্সে।

বিএসসি পাস করার পর তিনি আমেরিকার ওহাইও ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করলেন। দুই বছর কোর্সওয়ার্ক করার পর  অধ্যাপক তমোইয়াসু তানাকার তত্ত্বাবধানে সলিড-স্টেট ফিজিক্সের তত্ত্বীয় গবেষণা শুরু করলেন। কিন্তু গবেষণা শুরুর কিছুদিন পরেই মনে হলো তিনি ভুল বিষয়ে ভর্তি হয়েছেন। সায়েন্টিফিক আমেরিকানে জীববিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কারের কাহিনি পড়তে পড়তে ভেঙ্কির মনে হলো পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কার হচ্ছে শামুকের গতিতে, কিন্তু জীববিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। পদার্থবিজ্ঞানে কোন উত্তেজনাই পাচ্ছেন না তিনি। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের দীর্ঘ জটিল সমীকরণ ও গাণিতিক হিসেবে তিনি কোন আনন্দ পাচ্ছিলেন না। কিন্তু অন্য কোন বিষয়ে যে চলে যাবেন সেই সুযোগও নেই। এই বিষয়ে তিন বছরের বেশি সময় ব্যয় করেছেন তিনি। যে জীববিজ্ঞানকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সময় অযৌক্তিক মুখস্থ করার বিষয় বলে মনে করেছিলেন, এখন মনে হচ্ছে সেখানেই আছে অনেক বেশি উত্তেজনার খোরাক।

গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলার পর ভেঙ্কি পড়াশোনা বাদ দিয়ে হাইকিং করতে লাগলেন, গান শুনতে লাগলেন, দাবা খেলতে শুরু করলেন। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানোর সময় তাঁর সাথে পরিচয় হলো ভেরা রোজেনবারির সাথে। ভেরা ফাইন আর্টসের ছাত্রী। পেইন্টিংস নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। সত্তরের দশকের শুরুতে ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বেশি নিরামিষভোজী ছিল না। ভেরা ছিলেন নিরামিষাশী, ভেঙ্কিও। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ক্রমে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। ভেরা ছিলেন ডিভোর্সি। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী একটা মেয়েও আছে। ১৯৭৫ সালে তেইশ বছর বয়সী ভেঙ্কি তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ভেরাকে বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করলেন। ভেঙ্কির পিএইচডি তখনো শেষ হয়নি। কোন উপার্জন নেই। ভেরা নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটদের জন্য বই লিখতে শুরু করলেন। তাঁর ভেরা সিরিজের বইগুলি শিশুরা খুবই পছন্দ করে।

ঘরসংসার, স্ত্রী এবং সৎকন্যার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি ইচ্ছের বিরুদ্ধেই পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি শেষ করলেন। সেই সময় তাঁদের সন্তান রামনের জন্ম হয়। তিনি জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন। জীববিজ্ঞানের যেসব খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে তিনি জানতে আগ্রহী, তারজন্য সবচেয়ে ভালো হয় যদি ডাক্তারিতে ভর্তি হতে পারেন। ভারতে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েও পড়েননি। এখন আমেরিকায় পিএইচডি শেষ করার পর ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। এম-ক্যাটে অনেক ভালো ফলাফল করার পরেও তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পেলেন না। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় মৌখিক সাক্ষাৎকারের জন্য ডেকেছিল। কিন্তু ভেঙ্কি যখন বললেন যে তিনি ডাক্তারি করবেন না, শুধুমাত্র শরীরের বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য ডাক্তারি পড়তে চান, তাকে ভর্তি হবার সুযোগ দেয়া হলো না।

ডাক্তারিতে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়ে তিনি জীববিজ্ঞানে পিএইচডি করার জন্য দরখাস্ত করতে শুরু করলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই ফিজিক্সে পিএইচডি করা একজনকে আরেকটি পিএইচডি করার জন্য অনুমতি দিলো না। মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পিএইচডি কোর্সে ভর্তির অফার দিলো। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগোতে ভর্তি হলেন। জীববিজ্ঞানের গবেষণার কোন নিয়মকানুন তিনি জানতেন না। সবকিছু একেবারে গোড়া থেকে শিখতে শুরু করলেন। পরের বছর গবেষণাগারে কীভাবে গবেষণা করতে হয় তা শিখে ফেলার পর তাঁর মনে হলো এবার তাঁর পিএইচডি থিসিস লেখার কোন দরকার নেই। তিনি সরাসরি জীববিজ্ঞানের গবেষণাই শুরু করতে পারেন।

ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক পিটার মুরের সাথে রাইবোজোম সংক্রান্ত গবেষণা করার জন্য পোস্টডক্টরেট শুরু করলেন। বছরখানেক পোস্টডক গবেষণার পর তাঁর একটা স্থায়ী পদের দরকার হলো। কিন্তু পঞ্চাশটির অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করার পরেও কোন সাড়া পেলেন না। পদার্থবিজ্ঞান থেকে পিএইচডি করে জীববিজ্ঞানে গবেষণা করছেন এরকম কাউকে নিয়োগ দেবার ব্যাপারে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই খুব একটা আগ্রহী হলো না। শুধুমাত্র ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবে একটি টেকনিশিয়ানের পদ পাওয়া গেল। সেখানে যোগ দিয়ে দেখলেন স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ খুব বেশি নেই সেখানে। কিছুদিন পরেই তাঁকে আবার চাকরি খোঁজায় মন দিতে হলো। ইয়েলে নিউট্রন স্ক্যাটারিং-এর মাধ্যমে রাইবোজোম সংক্রান্ত গবেষণা করছিলেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবে তাঁর চাকরি হলো। ব্রুকহ্যাভেনে তিনি গবেষণার স্বাধীনতা পেলেন। রাইবোজোম সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফলও পেতে শুরু করলো।

ব্রুকহ্যাভেনে স্থায়ী গবেষক পদে নিয়োগ পেলেন তিনি। পদার্থবিজ্ঞানের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির প্রয়োগে রাইবোজোমের আণবিক গঠন সম্পর্কে অনেক নতুন ফলাফল পাওয়া গেল। ভেঙ্কি এই ব্যাপারে আরো গভীরভাবে জানার জন্য তিনি ব্রুকহ্যাভেন থেকে ছুটি নিয়ে ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবে গেলেন। সেখানে তিনি বিজ্ঞানী জন ফিঞ্চের তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করলেন। এক বছর সেখানে গবেষণা করে তিনি রাইবোজোমাল প্রোটিনের ক্রিস্টালোগ্রাফির অনেক নতুন কিছু শিখলেন। ব্রুকহ্যাভেনে ফিরে তিনি শুধুমাত্র ক্রিস্টালোগ্রাফি ও রাইবোজোম নিয়ে গবেষণা করতে চাইলেন। কিন্তু আকাঙ্খিত স্বাধীনতা পেলেন না। তিনি অন্য জায়গায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ভেঙ্কি যোগ দিলেন উটাহ্‌ ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে। সেখানেই তিনি রাইবোজোমের বেশ কয়েকটি প্রোটিনের গঠন আবিষ্কার করলেন। তিনি দেখলেন এ কাজে প্রচুর ফান্ডিং দরকার। উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভবিষ্যত চিন্তা করে তিনি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমেরিকান ভেঙ্কি চলে এলেন ইংল্যান্ডে। সেখানেই তিনি রাইবোজোমের সাবইউনিট 30S এর আণবিক গঠন নির্ণয়ের মূল গবেষণা শুরু করেন।

সেই সময় একই বিষয়ে ইসরায়েলে গবেষণা করছিলেন অ্যাডা ইয়োনাথ। এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হলো ভেঙ্কি ও অ্যাডার মধ্যে। ভেঙ্কি ক্রিস্টালোগ্রাফির সবচেয়ে সূক্ষ্ম পরীক্ষা করার জন্য চলে গেলেন আমেরিকার আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবের এডভান্সড ফোটন সোর্স ফ্যাসিলিটিতে। ভেঙ্কি তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করলেন ২০০০ সালে। এই কাজের জন্য ২০০৯ সালের রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ভেঙ্কি। রাইবোজোমের আণবিক গঠন আবিষ্কারের জন্য ভেঙ্কির সাথে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন অ্যাডা ইয়োনাথ এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল বায়োলজিস্ট থমাস স্টিজ।

এপর্যন্ত মাত্র পাঁচজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন আমাদের উপমহাদেশ থেকে। সিভি রামন, হরগোবিন্দ খোরানা, আবদুস সালাম, চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের পর  ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন। ভেঙ্কির আবিষ্কারের প্রয়োগ সুদুরপ্রসারী। তাঁর আবিষ্কারের ফলে এখন আরো অনেক শক্তিশালী এবং কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।

ভেঙ্কি রামকৃষ্ণনকে ব্রিটিশ নাগরিকত্বও দেয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি দেয় ২০১২ সালে। যদিও ভেঙ্কি কখনো ‘স্যার’ উপাধি ব্যবহার করেননি। ২০১০ সালে তাঁকে ভারত সরকার পদ্মবিভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করে। ২০১৫ সালে ভেঙ্কি রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি সম্মানের সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন। করোনা মহামারির সময়ে কোভিড ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন ও উদ্বুদ্ধকরণে ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

তথ্যসূত্র:

ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন, ফ্রম চিদাম্বরম টু কেমব্রিজ – এ লাইফ ইন সায়েন্স ২০০৯; পিএনএএস সেপ্টেম্বর ২০, ২০১১।

_______________

বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত







চেতন ভগতের 400 Days

 



ইংরেজি ভাষায় যে ক’জন ভারতীয় লেখক উপন্যাস লিখে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন – চেতন ভগত তাঁদের অন্যতম। শুধুমাত্র অন্যতম বললে কম বলা হবে, চেতন ভগতের লেখা সবগুলি উপন্যাস খুবই পাঠকপ্রিয় হয়েছে। কোন্‌ বই কতটা ভালো লেগেছে পাঠকের – তা বিচারের প্রধান মাপকাঠি হলো সেই বইয়ের কত কপি বিক্রি হয়েছে। চেতন ভগতের প্রতিটি বই বিক্রি হয় দশ লক্ষ কপিরও বেশি। সে তো গেলো মূল ইংরেজিতে। অন্যান্য ভাষাতেও তাঁর বইয়ের বৈধ-অবৈধ অনেক অনুবাদ হচ্ছে। বৈধ অনুবাদ হচ্ছে মূল লেখক এবং/অথবা মূল প্রকাশকের অনুমোদিত অনুবাদ, আর অবৈধ অনুবাদ হচ্ছে – যে অনুবাদের কথা লেখক/প্রকাশক জানেনও না।

চেতন ভগতের লেখা কেন এত মানুষের ভালো লাগছে? তাঁর লেখার সাহিত্যমূল্য কোন স্তরের? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ নয়। কারণ গল্প-উপন্যাসের মান বিচার করার ব্যাপারটা বস্তুনিষ্ঠ নয়। একেকজনের ভালো লাগার কারণ একেক রকম। নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিকের লেখাও যে সবার ভালো লাগবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

আর কে নারায়ণের প্রত্যেকটি উপন্যাস কালোত্তীর্ণ, কিন্তু সেভাবে জনপ্রিয় নয়। জনপ্রিয় হবার উপাদান চেতন ভগত খুব ভালো করেই জানেন কীভাবে পাঠকপ্রিয় হওয়া যায়। তাঁর লেখার ভাষা, ঘটনার বর্ণনা, সংলাপ পড়ার সময় মনে হয় বই নয়, সিনেমা পড়ছি। সিনেমার বিজ্ঞাপনের মতো করেই তিনি তাঁর বই প্রকাশের আগে বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করেন।

চেতন ভগতের সবগুলি বই থেকেই সিনেমা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি নিজেও সিনেমার চিত্রনাট্য লেখেন। তাঁর প্রথম বই Five Point Someone অবলম্বনে আমির খানের বিখ্যাত সিনেমা Three Idiots তৈরি হলেও সেই সিনেমাতে চেতন ভগতকে সেভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তারপর থেকে তিনি অনেক বেশি সতর্ক। নিজে সরাসরি যুক্ত থাকেন চিত্রনাট্য তৈরিতে।

তার উপন্যাসগুলির লক্ষ্য থাকে ইংরেজিপড়ুয়া তরুণ উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পাঠকদের মন জয় করা। আধুনিক প্রেম, যৌনতা, এবং ভারতীয় তরুণরা যেসব  সমস্যার সামনে প্রায় প্রতিদিন পড়ে – সেগুলিকেই তুলে আনেন কাহিনি-বিন্যাসে, বর্ণনায় এবং সংলাপে।

তাঁর সাম্প্রতিক বইগুলি সরাসরি থ্রিলার। The girl in room 105, One arranged murder, এবং 400 days  - রোমাঞ্চকর থ্রিলার গোত্রের। কেশব আর সৌরভ – দুই বন্ধু – গোয়েন্দা। অপেশাদার গোয়েন্দা। এদেরকে দিয়েই জটিল রহস্যের সমাধান করিয়ে নিচ্ছেন চেতন ভগত। কেশবের জবানীতেই ঘটনা এগোয়।

400 days এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একটি বারো বছরের মেয়ের অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। দাদাবাড়ির নিরাপদ বাড়ি থেকে রাতের বেলা উধাও হয়ে যায় আলিয়া-মনীশ দম্পতির বারো বছর বয়সী কন্যা সিয়া। রাতের বেলা নিজের ছোট বোন সুহানা আর চাচাতো ভাইদের সাথে এক রুমে ঘুমিয়েছিল সিয়া। কিন্তু সকালে দেখা গেলো সিয়া উধাও। কেউ জানে না সে কোথায়। কেবল সুহানা বললো রাতে কেউ একজন এসে ছুরি দেখিয়ে সিয়াকে নিয়ে গেছে। সুহানার বয়স মাত্র পাঁচ। সে ঘুমের ঘোরে কী দেখেছে ঠিকমতো বলতেও পারে না। আলিয়া-মনীশ অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী। টাকা-পয়সা প্রভাব-প্রতিপত্তির অভাব নেই। কিন্তু পুলিশ-গোয়েন্দা কেউই কিছু করতে পারলো না। ধরে নেয়া হয় যে সিয়াকে মেরে ফেলা হয়েছে। সবাই হাল ছেড়ে দিলেও সিয়ার মা আলিয়া হাল ছেড়ে দেয় না। আলিয়া মেয়ের খোঁজ করার জন্য কেশব আর সৌরভের সাহায্য চায়। মূলত কেশবেরই সাহায্য চায়। কেশব সৌরভকেও কাজে লাগায়।

প্রচলিত গোয়েন্দা-কাহিনীর চেয়ে চেতন ভগতের স্টাইল কিছুটা ভিন্ন। এখানে আলিয়া ও মনীশের প্রেম-কাহিনীর বিশদ বিবরণ আছে। আবার কেশব আর আলিয়াও পরস্পর প্রেমে পড়ে যায়। এই প্রেম ভারতীয় রক্ষণশীল টাইপের প্রেম নয়। উদ্দাম ইওরোপিয়ান স্টাইলের প্রেম – যেখানে মনের সাথে, অনেকটা মনের আগেও শরীর এগোয়। শরীরের ব্যাপারে কোন ধরনের জড়তা দেখা যায় না চেতন ভগতের নায়ক-নায়িকাদের। সে রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সতেরো বছরের মেয়ে আলিয়া হোক – কিংবা ত্রিশ বছরের গৃহবধূ আলিয়া হোক।

তবে এখানেও আছে প্রচলিত পদ্ধতি – কেউই সন্দেহের উর্ধ্বে নয়, আবার শেষপর্যন্ত দেখা যায় – যার দিকে সন্দেহের তীর কম ছোড়া হয়েছে সে-ই দোষী। তবে ভারতীয় পুলিশকে যেরকম অদক্ষ প্রমাণ করা হয়েছে – জানি না এত বাস্তব সমস্যার সমাধান তারা কীভাবে করেন।

চেতন ভগতের লেখা পাঠককে টেনে রাখে এটাই সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর লেখার। আর কোন নতুন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। 400 Days স্বতন্ত্র কিছু নয়, রহস্যও আহামরি রকমের কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়। কিন্তু তাঁর ভাষা চমৎকার। অহেতুক বর্ণনার বাহুল্য নেই। সেন্স অব হিউমার অসাধারণ।

কিন্তু গল্পের বিচার করলে বলতে হয় - আজকাল ভালো গোয়েন্দা গল্পের অভাব দেখা দিয়েছে, নাকি গোয়েন্দাগল্প বেশি পড়ার কুফল বুঝতে পারছি না। 



Wednesday, 11 May 2022

মন্ত্রীত্ব এবং সারমেয় সমাচার

 


আচ্ছা, আপনি কাসুন্দি চিনেন? খেয়েছেন কখনো? আমি খাইনি, চিনিও না। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে দেখলাম কাসুন্দি হলো সরিষার তৈরি আচার বিশেষ। কাসুন্দি পুরনো হলে কী হয়? ঝাঁজ কমে যায়? নাকি স্বাদ চলে যায়? নিশ্চয় কিছু একটা হয়, নইলে পুরনো কাসুন্দির কথা আসতো কোত্থেকে। পুরনো কাসুন্দি বলতে কী বোঝায় তা আমরা জানি।

তাহলে একটু পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা যাক। পাঁচ-ছয় বছরের পুরনো কথা। অস্ট্রেলিয়া দেশের ভিক্টোরিয়া রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন স্টিভ হারবার্ট। ট্রেনিং অ্যান্ড স্কিলস মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল তাঁর। বড়ই সুখে-শান্তিতে-মন্ত্রীত্বে দিন কাটছিলো তাঁর। কিন্তু একদিন তাঁর মন্ত্রীত্ব চলে গেল। কী অপরাধ? তিনি তাঁর সরকারি গাড়িতে তাঁর দুটো পোষা কুকুরকে চড়িয়েছেন। জি, এটাই অপরাধ। আপনি হাসছেন? সে আপনি হাসতে পারেন, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে এই ব্যাপারটি হাস্যকর ছিল না মোটেও। তারা বিশ্বাস করে মন্ত্রীদের সরকারি গাড়ি দেয়া হয় সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য। নিজের পরিবারের লোকজন কিংবা পোষা সারমেয়কে চড়াবার জন্য নয়।


এই কুকুরদুটোকে গাড়িতে চড়াবার কারণেই স্টিভ হারবার্টের মন্ত্রীত্ব চলে যায়



সাংবাদিকরা এই খবর হৈ হৈ করে প্রচার করলো। বিরোধীদল সংসদে ঝড় তুললো এই ইস্যুতে। মন্ত্রীর বাড়ি হলো পার্কডেলে। সেখান থেকে ট্রেনথাম-এ তার ছুটি কাটানোর বাড়ির দূরত্ব প্রায় এক শ কিলোমিটার। এই এক শ কিলোমিটার ভ্রমণের জন্য সারমেয়দের পেছনে জনগণের ট্যাক্সের পয়সা খরচ হয়েছে ১৯২ ডলার ৮০ সেন্ট। মন্ত্রী সেই পরিমাণ ডলার নিজের পকেট থেকে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে অসংখ্যবার ক্ষমা চাওয়ার পরেও ক্ষমা পাননি। তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কারণ তিনি সরকারি সম্পদের অপব্যবহার করেছেন।

মন্ত্রী বললেই আমরা যেরকম এলাহী ব্যাপার, অফুরন্ত ক্ষমতা বলে মনে করি – অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রীদের কিংবা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের সেই সুখ নেই। ক্ষমতার আসল মজা তো তার অবৈধ ব্যবহারে। ক্ষমতার অপব্যবহারই যদি করা না যায়, তাহলে ক্ষমতার আর মূল্য কী??

এই পুরনো কাসুন্দির সাথে অন্য কোন দেশের মন্ত্রীর কিংবা তাদের স্ত্রীর কিংবা তাদের আত্মীয়স্বজনের কিংবা তাদের সারমেয়দের পুরনো কিংবা নতুন কোন কাসুন্দিরই কোন সম্পর্ক নেই।

অস্ট্রেলিয়ান সংবাদপত্রে প্রকাশিত লিংক:

দ্য এজ



Latest Post

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - স্বপ্নের ঠিকানা

__________________________________________ রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪ গল্প - স্বপ্নের ঠিকানা _...

Popular Posts