Showing posts with label মহাকাশ. Show all posts
Showing posts with label মহাকাশ. Show all posts

Monday, 4 August 2025

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি: আমাদের মহাজাগতিক ঠিকানা

 



যে পৃথিবীতে আমাদের বসবাস সে পৃথিবীতে আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ঠিকানা আছে। আধুনিক স্যাটেলাইটের কল্যাণে জিপিএস আমাদের অবস্থান (লোকেশান) মুহূর্তেই খুঁজে দেয়। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান ঠিক কোথায়?

প্ল্যানেট আর্থ – পৃথিবী নামের এই গ্রহটি আমাদের কাছে যতই অনন্য হোক না কেন – মহাবিশ্বে গ্রহের আনুমানিক সংখ্যা এক হাজার কোটি কোটি কোটি (১০২৪)। এদের প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী গ্রহের আছে তার নিজস্ব সৌরজগৎ। এরকম কোটি কোটি কোটি নক্ষত্রজগত আছে মহাবিশ্বে। এই নক্ষত্রগুলির আবার আছে নিজস্ব ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি – যেখানে নক্ষত্রগুলি জোটবদ্ধ হয়ে থাকে। মহাবিশ্বে আনুমানিক দুই লক্ষ কোটি (দুই ট্রিলিয়ন) গ্যালাক্সি আছে। আমাদের সৌরজগৎ যে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত – তার নাম মিল্কিওয়ে। এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত নক্ষত্রের সংখ্যা হতে পারে দশ হাজার কোটি থেকে চল্লিশ হাজার কোটি। এতগুলি সূর্যের ভীড়ে আমাদের সৌরজগৎ-এর নাক্ষত্রিক ঠিকানা বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করেছেন কয়েক শ বছরের নিরলস জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা্র মাধ্যমে।

আজ আমরা  মহাবিশ্বের সাপেক্ষে আমাদের পৃথিবীর ঠিকানা বলতে পারি এভাবে: দৃশ্যমান মহাবিশ্বে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সৌরজগতে আমরা থাকি। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি ছোট বড় আরো চুয়ান্নটি গ্যালাক্সি মিলে একটি গ্যালাক্সি-পাড়া বা লোকাল গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এই পাড়ায় আমাদের গ্যালাক্সি থেকে সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি হলো ক্যানিস মেজর ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি – যা ছোট একটি গ্যালাক্সি। পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের এই গ্যালাক্সিকে আমাদের গ্যালাক্সি আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে (মাধ্যাকর্ষণের টানে কাছে নিয়ে আসছে)। আমাদের গ্যালাক্সি পাড়ার সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমিডা। এই অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি এত বিশাল এবং এত উজ্জ্বল যে আমাদের কাছ থেকে পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী থেকে আমরা খালি চোখেও এই গ্যালাক্সির নক্ষত্রমন্ডলী দেখতে পাই। তবে আমাদের জন্য বিপদ এই যে আগামী চার শ কোটি থেকে পাঁচ শ কোটি বছরের মধ্যে  অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে গিলে খাবে – অর্থাৎ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি মিশে যাবে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সাথে। আরো বিশাল সেই মহা-গ্যালাক্সির নাম হবে মিল্কোমিডা।

কিন্তু এতসব আমরা জানলাম কীভাবে? আমাদের গ্যালাক্সির নামই বা কেন হলো মিল্কিওয়ে?


পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উদ্ভব যখন হয়েছে ততদিনে মহাবিশ্বের বয়স হয়ে গেছে প্রায় এক হাজার কোটি বছর। আর মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র পঁচিশ লক্ষ বছর আগে। তাই আদিমানুষ আকাশের দিকে চোখ তুলেই দেখতে পেয়েছে দিনের বেলা সূর্য আলো দিচ্ছে, আর সূর্য ডোবার পর লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র রাতের অন্ধকারে মিটমিট করছে। মানুষের অদম্য কৌতুহল আর অনুসন্ধিৎসা থেকে জন্ম নিয়েছে মহাকাশবিজ্ঞান – পর্যবেক্ষণই যার প্রধান অবলম্বন। প্রকৃতিনির্ভর অসহায় আদিমানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রচন্ড ভয় পেতো। সেই ভয় থেকে জন্ম নিয়েছে ভক্তি এবং নানারকমের দেবদেবীর কল্পকাহিনি। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত নক্ষত্র-ছড়ানো ছায়াপথ দেখতে দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ কল্পনা করে নিয়েছে বিভিন্ন কাহিনি।

ভারতীয় কাহিনিতে আমাদের ছায়াপথের নাম আকাশগঙ্গা। প্রাচীন মুনিঋষিরা ধারণা করে নিয়েছিলেন আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত যে নক্ষত্রমন্ডলি দেখা যায় তা আসলে স্বর্গে বয়ে চলা নাক্ষত্রিক নদী। গঙ্গা নদীর সাথে মিলিয়ে এর নাম রাখা হয় আকাশগঙ্গা। এই আকাশগঙ্গার সাথে মিল্কিওয়ে নামের সরাসরি কোন শাব্দিক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং গ্রিক এবং রোমান গল্পে সরাসরি ‘মিল্কিওয়ে’ শব্দটির উৎস পাওয়া যায়।

 গ্রিকদের গল্পে আছে – দেবতা জিউস আল্কমেনা নামে এক মানবীর প্রেমে পড়ে। জিউস ও আল্কমেনার একটি সন্তান হয়, যার নাম হারকিউলিস। হারকিউলিসের মা যেহেতু দেবতা নন, তাই হারকিউলিস জন্মসূত্রে অমরত্ব পাননি। জিউস জানেন হারকিউলিসকে যদি কোন দেবীর বুকের দুধ খাওয়ানো যায়, তাহলে হারকিউলিস অমরত্ব লাভ করবে। দেবী হেরা ছিলেন জিউসের স্ত্রী। হারকিউলিস যেহেতু হেরার সন্তান নয়, হেরা স্বাভাবিকভাবে হারকিউলিসকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াবেন না। তাই জিউস একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। একদিন হেরা যখন ঘুমাচ্ছিলেন, জিউস ছোট্ট হারকিউলিসকে হেরার বুকে দিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙার পর হেরা যখন দেখলেন শিশু হারকিউলিস তার বুকের দুধ পান করছে – দ্রুত হারকিউলিসকে বুক থেকে সরিয়ে দিলেন। এই সময় হেরার বুক থেকে দুধ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে তৈরি হয়েছে “গ্যালাক্সিয়াস কাইক্লস” যার ইংরেজি অনুবাদ মিল্কি ওয়ে। রোমানদের গল্পও প্রায় একই রকম। এসব গল্প খ্রিস্টজন্মের অনেক বছর আগের। এরপর বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়ে গেলেও আমাদের গ্যালাক্সির নাম সেই প্রাচীন মিল্কিওয়েই রয়ে গেছে।

 

যতদিন পর্যন্ত খালিচোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে, গ্যালাক্সি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জানার পরিধি বিস্তার লাভ করেছে খুবই ধীর প্রক্রিয়ায়। পৌরাণিক কাহিনি বিশ্বাস করে কেউ কেউ এই ছায়াপথকে দুধের নদী বললেও – মানুষ ক্রমেই বুঝতে পেরেছে এর সাথে প্রাকৃতিক কোন ঘটনার যোগাযোগ আছে। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল মত দিয়েছিলেন এই ছায়াপথ হলো নক্ষত্র থেকে জ্বলন্ত বাষ্পের নিঃসরণ। এরপর প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত এরকম গ্রিক ধারণাই প্রচলিত ছিল।

কিন্তু নবম শতাব্দী থেকে এই ধারণার বদলে বাস্তবধর্মী বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রাধান্য পেতে শুরু করে। নবম শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আল-আব্বাস আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে খাতির আল-ফারগানি তাঁর “কিতাব ফি আল-হারাকাত আল-সামাইয়া ওয়া জাওয়ামি ইল্‌ম আল-নুজুম” [ইলিমেন্টস অব অ্যাস্ট্রোনমি] বইতে পৃথিবীর ব্যাস, পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদের দূরত্ব পরিমাপের পাশাপাশি ছায়াপথ সম্পর্কেও কিছু নতুন ধারণা দেন। তিনি মিল্কিওয়েকে আকাশের একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করেন যা ছিল গ্রিকদের কাল্পনিক ধারণা থেকে অনেকটাই বাস্তবের কাছাকাছি [১]।

দশম শতাব্দীতে গ্যালাক্সি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণার আরো উন্নতি হয় মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জ্যোতির্বিদদের হাত ধরে। ইরানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আল-হুসাইন আবদুর রহমান ইবনে উমর আল-সুফি ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা তাঁর “কিতাব আল-কাওয়াকিব আল-তাবিদ আল-মুসাওয়ার” [দ্য বুক অব ফিক্সড স্টারস] বইতে ৪৮টি তারামন্ডলের বর্ণনা দেন। মিল্কিওয়ে ছাড়াও আমাদের আকাশ থেকে আরো উজ্জ্বল যে অন্য ছায়াপথ “অ্যান্ড্রোমিডা” দেখা যায় – তার প্রথম বৈজ্ঞানিক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এই বইতে। অ্যান্ড্রোমিডা নামটি দেয়া হয়েছে গ্রিক পুরানের রাজকন্যা অ্যান্ড্রোমিডার নাম অনুসারে। সেই সময় অবশ্য মনে করা হতো অ্যান্ড্রোমিডা মিল্কিওয়েরই অংশ। বিজ্ঞানী আল-সুফিই সর্বপ্রথম অ্যান্ড্রোমিডার প্রথম বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেন।

সেই সময়কার আরেক বিজ্ঞানী আলী আল-হাসান ইবনে আল-হাসান ইবনে আল-হাইথাম, যিনি আলজাহিন নামে পরিচিত ছিলেন এবং যাঁকে আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক মনে করা হতো, টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ১০১১-১২ সালে রচিত তাঁর বিখ্যাত “কিতাব আল-মানাজির” [দ্য বুক অব অপটিকস]-এ তিনিই সর্বপ্রথম সম্ভাবনা প্রকাশ করেন যে মিল্কিওয়ে ছায়াপথ হতে পারে অসংখ্য নক্ষত্রের সমষ্টি – যা দূরত্বের কারণে একটি আলোক রেখার মতো দেখায়। টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হবার পাঁচ শ বছরেরও আগে মিল্কিওয়ে সম্পর্কে তিনি যে কথাগুলি বলেছিলেন – পরবর্তীতে আমরা তা সত্য বলে প্রমাণিত হতে দেখেছি। দ্বাদশ শতকে স্পেনের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ আবু আল-ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদও মিল্কিওয়েকে অনেকগুলি নক্ষত্রের সমষ্টি বলে অনুমান করেছেন যা পরবর্তীতে আশ্চর্যজনকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের পর আকাশ পর্যবেক্ষণ নতুন মাত্রায় উন্নীত হলো। আমরা সবাই জানি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে গ্যালিলিওরও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে টেলিস্কোপ তৈরি এবং ব্যবহার করেছিলেন বৃটিশ বিজ্ঞানী লিওনার্ড ডিগেস ১৫৫১ সালে [২]। তাঁর পুত্র থমাস ডিগেসও ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৫৫৯ সালে লিওনার্ড ডিগেসের মৃত্যু হলে থমাস ডিগেস তাঁর বাবার অসমাপ্ত গবেষণা চালিয়ে নেন। ১৫৭১ সালে তিনি তাঁর বাবার লেখা একটি বই প্রকাশ করেন যাতে টেলিস্কোপ তৈরি এবং ব্যবহারের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই বইতে মহাবিশ্বের অসীমতা এবং অসংখ্য নক্ষত্রমন্ডলী গুচ্ছাকারে ছায়াপথ তৈরি করার সম্ভাবনার কথা বর্ণিত হয়েছে। সে হিসেবে বলা চলে মিল্কিওয়ে যে অসংখ্য নক্ষত্রের সম্মিলন তা টেলিস্কোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে প্রকাশ করেছিলেন থমাস ডিগেস - গ্যালিলিওরও অনেক বছর আগে।  

১৬১০ সালে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ তাক করলেন আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যাওয়া মিল্কিওয়ের দিকে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন খালি চোখে আবছা মেঘের মতো যা দেখা যায় – তাতে রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র। এত বেশি নক্ষত্র সেখানে যে তার সীমিত শক্তির টেলিস্কোপের মাধ্যমে তাদের সংখ্যা গণনা করা ছিল অসম্ভব [৩]। তবে গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণ থেকে মিল্কিওয়ে সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা ছিল তা ভেঙে যায়। মিল্কিওয়ে যে অসংখ্য তারার সমষ্টি সেই ধারণা বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করতে শুরু করেন।

কিন্তু মিল্কিওয়ের আকার, আয়তন, গতি ইত্যাদি নিরুপনের কাজ শুরু হয় আরো প্রায় দেড়শো বছর পর। ইংরেজ দার্শনিক থমাস রাইট ১৭৫০ সালে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত তত্ত্বীয় ধারণা দেন তাঁর ‘এন অরিজিনাল থিওরি অর নিউ হাইপোথিসিস অব দ্য ইউনিভার্স’ বইতে। তিনি মনে করেন মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলি চাকতির মতো দুটো স্তরে সজ্জিত। সেখানে আমাদের সূর্যের অবস্থানও তিনি প্রায়-সঠিকভাবে অনুমান করেন – যা চাকতির কেন্দ্র থেকে দূরে কিনারার একটি প্রান্তে অবস্থিত। গ্যালিলিওর পরে আরো অনেকে মিল্কিওয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন টেলিস্কোপের সাহায্যে। মিল্কিওয়ের কিনারায় ছোপ ছোপ মেঘের মতো উজ্জ্বল যে বস্তু দেখা যায় তাকে গ্যালিলিও নেবুলা বা নক্ষত্র তৈরির কারখানা হিসেবে ধারণা দিয়েছিলেন। থমাস রাইট ধারণা দিলেন যে ওগুলি মিল্কিওয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন, হতে পারে অন্য কোন নক্ষত্রমন্ডলির অংশ। সমসাময়িক সুইডিশ দার্শনিক ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ, জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট, সুইস-জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী জোহান হেনরিক ল্যামবার্ট প্রমুখ মিল্কিওয়ের নক্ষত্র সম্পর্কে থমাস রাইটের ধারণাকে সমর্থন দেন [৪]। কিন্তু এর সবগুলি ছিল পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক দার্শনিক অনুমান।

মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলির অবস্থান এবং উজ্জ্বলতার বৈজ্ঞানিক পরিমাপ শুরু করেন স্যার উইলিয়াম হারশেল ১৭৮০ সালে। জার্মান বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অনেকগুলি উন্নতমানের টেলিস্কোপ তৈরি করেন এবং সেগুলি দিয়ে নিয়মিত আকাশ পর্যবেক্ষণ করে ১৭৮১ সালে সৌরজগতের দূরবর্তী গ্রহ ইউরেনাস আবিষ্কার করেন। মিল্কিওয়ের বিভিন্ন দিক থেকে নক্ষত্রগুলির অবস্থান নির্ণয় করে তিনি মিল্কিওয়ের একটি ম্যাপ তৈরি করেন। ১৭৮৫ সালে ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশানে প্রকাশিত [সংখ্যা ৭৫, পৃ ২১৩-২৬৬] মিল্কিওয়ের ম্যাপ থেকে দেখা যায়, হারশেল আমাদের সূর্যের অবস্থান নির্ণয় করেছেন মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে। মিল্কিওয়ের দৈর্ঘ্য তিনি নির্ণয় করেছেন সেখানে অবস্থিত নক্ষত্রগুলির গড় দূরত্বের ৮০০ গুণ, আর প্রস্থ হিসেব করেছেন নক্ষত্রগুলির গড় দূরত্বের ১৫০ গুণ। হারশেল ধরে নিয়েছিলেন মিল্কিওয়ের প্রতি একক আয়তনে সমান সংখ্যক নক্ষত্র আছে।  তাঁর হিসেব থেকে মিল্কিওয়ের সত্যিকারের আয়তন নির্ণয় করার কোন উপায় ছিল না, কারণ পৃথিবী থেকে কোন নক্ষত্রেরই সঠিক দূরত্ব তখনো নির্ণয় করা যায়নি। মিল্কিওয়ের আকার আকৃতির সঠিক পরিমাপের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

 



উইলিয়াম হারশেলের মিল্কি ওয়ের ম্যাপ (১৭৮৫)


১৮৪৭ সালে রাশিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী অটো স্ট্রুভ প্রমাণ দিলেন যে মিল্কি ওয়ের সব জায়গায় সমান সংখ্যক নক্ষত্র নেই। অর্থাৎ উইলিয়াম হারশেল যে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রের ঘনত্ব সমান বলে ধারণা করেছিলেন তা সঠিক ছিল না। তাহলে উইলিয়াম হারশেলের মিল্কি ওয়ের ম্যাপের আকৃতি ঠিক থাকলেও তার ভেতর আমাদের সূর্যের অবস্থান সঠিক নয়। ততদিনে পৃথিবী থেকে সূর্য এবং সৌরজগতের অন্য কয়েকটি গ্রহের দূরত্ব নির্ণয় করা হয়ে গেছে। তার ভিত্তিতে অটো স্ট্রুভ মিল্কিওয়ের আকার নির্ণয় করলেন। তিনি দেখালেন চ্যাপ্টা চাকতির মতো মিল্কিওয়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব কমপক্ষে তেরো হাজার আলোকবর্ষ। অর্থাৎ মিল্কিওয়ের এক প্রান্তের একটি নক্ষত্রের আলো অন্য প্রান্তের নক্ষত্রে পৌঁছাতে তেরো হাজার বছর সময় লাগবে। বর্তমানে আমরা জানি মিল্কিওয়ের আকার এর চেয়ে আরো অনেক অনেক বড়। সে কথায় আমরা আসবো একটু পর।

 

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই টেলিস্কোপের শক্তি এবং ব্যাপ্তি দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলি অবজারভেটরি বা মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময় মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির সঠিক আকার ও আয়তন সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে যাঁর হাত দিয়ে – তাঁর নাম হারলো শাপলি, মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির উদীয়মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী হবার কোন লক্ষ্যই ছিল না হারলো শাপলির। আমেরিকার মিসৌরি রাজ্যের ছোট্ট একটি গ্রামে তাঁর জন্ম ১৮৮৫ সালে। ছোট্ট এক রুমের একটি স্কুলে তাঁর প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা। ষোল বছর বয়সে ক্যানসাসের ডেইলি সান পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য কিছু টাকাপয়সা জমানোর পর তিনি সাংবাদিকতা পড়ার জন্য গেলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু গিয়ে দেখেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ তখনো খোলা হয়নি। অন্য রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার সঙ্গতি তার ছিল না। তাই ঠিক করলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের  ভর্তি্র ক্যাটালগে প্রথম যে বিভাগের নাম পাবেন সেই বিভাগেই ভর্তি হয়ে যাবেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো বিষয়ে ভর্তি হওয়া যেতো। ক্যাটালগের প্রথম নামটি ছিল আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের। হারলো শাপলি ‘আর্কিওলজি’ শব্দটি উচ্চারণ করতে না পেরে পরের নামে গেলেন। পরের নামটি ছিল অ্যাস্ট্রোনমি। শাপলি অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়ে গেলেন  [৫]। এরপর দ্রুত ইতিহাস তৈরি করলেন তিনি। ১৯১০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি গেলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেলের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করলেন শাপলি। ১৯১৪ সালে পিএইচডি শেষ করার পর পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে কাজ পেলেন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে। সেখানকার ১.৫২ মিটার ব্যাসের শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে তিনি দিনরাত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে মিল্কি ওয়ের সঠিক আকার নির্ণয় করেন। যদিও পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে শাপলির পরিমাপে কিছুটা ভুল ছিল, তবুও সেই ১৯১৮ সালে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির এত বিস্তারিত পরিমাপ জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। হারলো শাপলি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। [পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।]

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির যে আকার শাপলি নির্ণয় করেছিলেন তার আয়তন এত বেশি ছিল যে তিনিসহ আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সেই সময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে মিল্কিওয়েই একমাত্র গ্যালাক্সি যা পুরো মহাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। কিন্তু অনেকের কাছেই এটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। ক্যালিফোর্নিয়ার লিক অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেবার কারটিস এবং তাঁর দল তাঁদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দাবি করলেন – মিল্কি ওয়ে মহাবিশ্বের একটি গ্যালাক্সি, একমাত্র গ্যালাক্সি নয়। মহাবিশ্ব আরো অনেক বড়, যেখানে মিল্কিওয়ের মতো আরো হাজার হাজার গ্যালাক্সি আছে।

এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স একটি বৈজ্ঞানিক বিতর্কের আয়োজন করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি ‘দ্য গ্রেট ডিবেট’ নামে খ্যাতিলাভ করেছে। ১৯২০ সালের ২৬ এপ্রিল এই বিতর্ক সভা অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। প্রচলিত তর্ক-বিতর্ক এটি ছিল না। এটি ছিল মূলত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন। হারলো শাপলি মিল্কিওয়েই পুরো মহাবিশ্ব – এই মতের পক্ষে তাঁর তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন চল্লিশ মিনিট। এরপর হেবার কারটিস উপস্থাপন করেন তাঁর তথ্য-উপাত্ত যেখানে তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝান যে মিল্কিওয়ে ছাড়াও আরো অনেক গ্যালাক্সি আছে মহাবিশ্বে। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। উপস্থিত বিজ্ঞানীদের ভোটে কারটিসের যুক্তি জয়লাভ করে।

অবশ্য পরবর্তী চার বছরের মধ্যে এডউইন হাবল প্রমাণ করে দেন যে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের অংশ নয়, বরং মিল্কি ওয়ে থেকে পচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের আলাদা আরেকটি গ্যালাক্সি।

 

পৃথিবীর মানমন্দির থেকে টেলিস্কোপের সাহায্যে নক্ষত্রের আলো পর্যবেক্ষণ করে আলোর তীব্রতার সাথে দূরত্বের বিপরীত বর্গের সূত্র প্রয়োগ করে নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় মহাজাগতিক ধুলিকণা যা নক্ষত্রের আলোর তীব্রতা কমিয়ে দেয়। ধুলিকণার কারণে প্রায়ই হিসেবে গন্ডগোল হয়ে যায়। সেই গন্ডগোল মিটে গেল রেডিও টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের পর থেকে। ধুলিকণা বেতার তরঙ্গের ওপর খুব বেশি প্রভাব খাটাতে পারে না। ফলে জ্যোতির্বিদ্যার পরিমাপ অনেক সহজ এবং সঠিক হয়ে ওঠেছে। পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর পর থেকে মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমরা এখন অনেক কিছু সঠিকভাবে জানি।

 

মিল্কিওয়ের আকার আকৃতি

আমরা যেহেতু মিল্কিওয়ের ভেতরে থাকি, সেহেতু দূর থেকে মিল্কিওয়েকে পুরোপুরি দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি সম্ভব হতো, যদি আমরা মিল্কিওয়ের উপর থেকে মিল্কিওয়েকে দেখতে পেতাম, তাহলে মিল্কিওয়েকে মনে হতো রাতের বেলা আলো ঝলমলে এক শহরের মতো যেখানে বিশ হাজার কোটি সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। এই সূর্যগুলির ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আন্তনাক্ষত্রিক ধুলো ও গ্যাসের মেঘ – যেগুলি থেকে ভবিষ্যতে আরো নক্ষত্র তৈরি হবে। এক পাশ থেকে দেখলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে একটি চ্যাপ্টা চাকতির মতো লাগবে যার মাঝখানে বেশ উঁচু। চাকতির চারপাশে ঘিরে রয়েছে বিশাল গ্যাসের গোলক – যার নাম গ্যালাক্টিক হ্যালো।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চাকতির কেন্দ্রে ফুলে ওঠা জায়গার ব্যাস প্রায় তিন হাজার আলোকবর্ষ। এর ভেতর আছে প্রায় এক হাজারটি নক্ষত্র – যাদের আনুমানিক ভর এক হাজার সূর্যের ভরের সমান। চাকতির সমতল অংশ থেকে কেন্দ্রের এই ঢিবির উচ্চতা প্রায় ১৮০০ আলোকবর্ষ। সমতল অংশে চাকতির পুরুত্ব প্রায় এক হাজার আলোকবর্ষ। কেন্দ্র থেকে চাকতির ব্যাসার্ধ প্রায় পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ। পুরো চাকতিকে ঘিরে অদৃশ্য হাইড্রোজেন গ্যাসের স্তর, কেন্দ্র থেকে যার ব্যাসার্ধ আশি হাজার আলোকবর্ষ।

পুরো চাকতিটি রয়েছে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধের একটি গোলকের ভেতর। এই গোলকটির নাম স্টেলার হেলো। ধরে নেয়া হয় এই পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্ব পর্যন্ত মিল্কিওয়ের মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে। এর বাইরে যদি কোন নক্ষত্র পাওয়া যায় – তা অন্য কোন গ্যালাক্সির বলে ধরে নেয়া হয়।


মিল্কিওয়ের বিভিন্ন অংশ


হ্যালো

মিল্কিওয়ের হ্যালো অংশটি খুব রহস্যময়। এই গ্যাসীয় গোলকের ভেতর প্রায় দুই শ উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ আছে যারা খুবই কাছাকাছি থেকে গুচ্ছ তৈরি করেছে। এদের একেকটি গুচ্ছের ব্যাস মাত্র কয়েকশ আলোকবর্ষ। এই দুরত্বের ভেতরই লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র গাদাগাদি করে খুবই প্রতিসমভাবে একে অপরকে আকর্ষণ করে আছে। এই ‘গ্লোবিউলার ক্লাস্টার’ গুলি নিঁখুত গোলকাকার। গ্যালাক্সির সবচেয়ে বয়স্ক নক্ষত্রগুলিই থাকে এসব গুচ্ছে। চাকতির নক্ষত্রগুলির বয়স যদি এক হাজার কোটি বছর হয়, গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের নক্ষত্রগুলির বয়স তেরো শ কোটি বছর।

গ্যালাক্টিক হ্যালোর গ্লোবিউলার ক্লাস্টারগুলি উজ্জ্বল হলেও বাকি অংশ খুবই অন্ধকার। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের সূর্যগুলির ভর আর হ্যালোর মোট ভরের তুলনায় খুবই সামান্য। তাহলে বাকি অন্ধকার স্থানে কি লুকিয়ে আছে ডার্ক ম্যাটার? এই রহস্যের সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি।

 

চাকতি

একপাশ থেকে দেখলে মিল্কিওয়েকে যেমন একটি সাদাসিধে চাকতির মতো লাগে, আসলে কিন্তু এটি সোজা একটি চাকতি নয়। এর চারটি প্যাঁচানো বাহু আছে। কেন্দ্রের উঁচু ঢিবির কাছাকাছি দুটো প্রধান বাহু পারসিয়াস আর্ম ও স্যাজিটারিয়াস আর্ম। তৃতীয় বাহুর নাম সেনটোরাস আর্ম এবং চতুর্থ বাহু – আউটার আর্ম।

পারসিয়াস বাহু মিল্কিওয়ের বেশ প্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বাহু যেখানে রয়েছে অনেকগুলি নীহারিকা বা নেবুলা যেখানে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। এখানে নক্ষত্রের ঘনত্ব চাকতির নক্ষত্রের ঘনত্বের চেয়ে বেশি। এই বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ষাট হাজার আলোকবর্ষ, কিন্তু সে তুলনায় প্রস্থ খুবই কম, মাত্র তিন-চার হাজার আলোকবর্ষ। এখানেই আছে ব্রিলিয়েন্ট স্টার ফাই ক্যাসিওপিয়া – যা আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় দুই লক্ষ গুণ উজ্জ্বল। এই বাহুতেই আছে ক্র্যাব নেবুলা সুপারনোভা।

মিল্কিওয়ের প্রধান বাহু স্যাজিটারিয়াস আর্ম। এর দৈর্ঘ্য দশ থেকে পনের আলোকবর্ষ, প্রস্থ তিন থেকে চার আলোকবর্ষ। ঈগল, ওমেগা, ট্রিফিড, ল্যাগুন নেবুলা এই বাহুতে অবস্থিত। এই বাহুতে একাধিক ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পাওয়া গেছে। ষোলটি সূর্যের ভরের সমান ব্ল্যাকহোল সিগনাস এক্স-১ মিল্কিওয়ের এই বাহুতে অবস্থিত।

পারসিয়াস ও স্যাজিটারিয়াস বাহুর মাঝখানে আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের বাহু আছে – যার নাম অরিয়ন বাহু বা অরিয়ন স্পার। এই অরিয়ন স্পারের আগার দিকে আমাদের সূর্যের বাড়ি। এই সৌরজগতের ছোট্ট গ্রহ পৃথিবীতে আমাদের বাস।  এই বাহুতে আছে রিং নেবুলা, অরিয়ন নেবুলা, বাটারফ্লাই ক্লাস্টার, টলেমি ক্লাস্টার ইত্যাদি।

মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে যে উঁচু ঢিবি আছে সেটাই আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র বা গ্যালাকটিক সেন্টার। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটাই গ্যালাক্সি রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে কেন্দ্রের নক্ষত্রপুঞ্জ সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ভেরি লার্জ রেডিও-টেলিস্কোপের মাধ্যমে জানা গেছে এর কেন্দ্রে ঘূর্ণায়মান গ্যাস চক্রাকারে ঘুরছে। ১৯৯৭ সালে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি নক্ষত্রগুলোর অস্বাভাবিক দ্রুত ঘূর্ণন বেগ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন মিল্কিওয়ের এই কেন্দ্রে আছে ২৫ লক্ষ সূর্যের ভর সম্পন্ন বিশাল ব্ল্যাকহোল স্যাজিটারিয়াস এ স্টার। কেন্দ্র থেকে মাত্র দশ আলোকবর্ষ দূরে উত্তপ্ত গ্যাসের মেঘ – স্যাজিটারিয়াস এ কমপ্লেক্স।

মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের এক শ আলোকবর্ষ ব্যাসের মধ্যে যে চৌম্বকক্ষেত্র পাওয়া গেছে তার তীব্রতা মিল্কিওয়ের অন্যান্য জায়গার চোউম্বকক্ষেত্রের তীব্রতার চেয়ে প্রায় হাজার গুণ বেশি। এই চৌম্বকক্ষেত্রের সঠিক উৎস এখনো অজানা।

 

ভর ও অন্যান্য বৈশিষ্ট

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি। এর উজ্জ্বলতা ১৪০০ কোটি সূর্যের উজ্জ্বলতার সমান। ডার্ক ম্যাটারসহ এর মোট ভর এক লক্ষ কোটি সূর্যের ভরের সমান, যার মধ্যে নক্ষত্রের ভর বিশ হাজার কোটি সূর্যের ভর, মোট গ্যাসের ভর – দুই হাজার কোটি সূর্যের ভর, ধূলিকণার ভর – বিশ কোটি সূর্যের ভরের সমান। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে আমাদের সূর্যের একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে বাইশ কোটী বছর।

 

মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমাদের এখনো অনেক বিষয় জানার বাকি। অতি সম্প্রতি (১১ মার্চ ২০২৫) আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা ‘স্পেকট্রো-ফটোমিটার ফর দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ইউনিভার্স, ইপক অব রি-আয়নাইজেশান আন্ড আইসেস এক্সপ্লোরার (SPHEREx) মিশন চালু করেছে। এই স্যাটেলাইট ১১ মার্চ ২০২৫ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। ১ মে থেকে এই স্যাটেলাইট কাজ শুরু করেছে। আগামী দুই বছর ধরে মহাকাশে মহাবিশ্বের পঁয়তাল্লিশ কোটিরও বেশি গ্যালাক্সির তথ্য সংগ্রহ করবে এই স্যাটেলাইট। পাশাপাশি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরও দশ কোটিরও বেশি নক্ষত্রের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে জানার চেষ্টা করবে মহাবিশ্বের উদ্ভব হবার আসল রহস্য কী। প্রাণের উদ্ভব ঘটার জন্য যেসব উপাদানের দরকার, মিল্কিওয়ের অন্যান্য নক্ষত্রের জগতের অন্য কোন গ্রহে তা পাওয়া যায় কি না তাও অনুসন্ধান করে দেখবে এই মিশন [৬]। সেসব তথ্য থেকে মিল্কিওয়ের অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। 

 

তথ্যসূত্র

১। জিম আল-খলিলি, দ্য হাউজ অব উইজডম হাউ অ্যারাবিক সায়েন্স সেইভড অ্যানসিয়েন্ট নলেজ অ্যান্ড গেইভ আজ দ্য রেনেসান্স, দ্য পেঙ্গুইন প্রেস, নিউইয়র্ক, ২০১১।

২। জন গ্রিবিন, গ্যালাক্সি অ্যা ভেরি শর্ট ইনট্রোডাকশান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮।

৩। গাইলস স্পারো, ফিফটি আইডিয়াস ইউ রিয়েলি নিড টু নো অ্যাস্ট্রোনমি,কুয়েরকাস, লন্ডন, ২০১৬।

৪।  ফ্রাঙ্কোইস কমবিস ও জেমস লেকিস, ‘দ্য মিল্কি ওয়ে স্ট্রাকচার, ডায়নামিক্স, ফরমেশান আন্ড ইভ্যুলিউশান’, কারেন্ট ন্যাচারাল সায়েন্সেস, প্যারিস, ২০১৬।

৫। জে পি ম্যাকইভয়, দ্য ইউনিভার্স ফ্রম এনসিয়েন্ট ব্যাবিলন টু দ্য বিগ ব্যাং, রবিনসন, লন্ডন, ২০১০।

৬। https://www.jpl.nasa.gov/missions/spherex/

_______________

বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত











Thursday, 30 November 2023

চন্দ্রায়ন ৩

 




মহাবিশ্বে পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবী থেকে গড়ে মাত্র ৩,৮৪,৪০০ কিলোমিটার দূরে থাকে। সৌরজগতের অন্য গ্রহগুলি এবং তাদের উপগ্রহগুলির দূরত্বের সাথে তুলনা করলে চাঁদই পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী। এই প্রতিবেশী উপগ্রহই এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে একমাত্র জায়গা যেখানে পৃথিবীর মানুষ সশরীরে গিয়ে ঘুরে এসেছে ছয় বার। তাও সেই ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে। ১৯৫৩ সাল থেকে শুরু করে এই ২০২৩ সালের এপর্যন্ত গত সত্তর বছরে পৃথিবী থেকে মোট ১৪৬টি মিশন পরিচালনা করা হয়েছে চাঁদের উদ্দেশ্যে। 

পৃথিবীর এতগুলি দেশের মধ্যে মাত্র বারোটি দেশ চাঁদের মিশনের সাথে যুক্ত হয়েছে। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ৫৮টি মিশন পরিচালনা করেছিল – যার মধ্যে ১৮টি সফল হয়েছে, বাকি ৪০টি মিশন ব্যর্থ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর রাশিয়া মাত্র একটি চাঁদের মিশন পরিচালনা করেছে সম্প্রতি (লুনা ২৫), কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) এপর্যন্ত ৫৯টি চাঁদের মিশন পরিচালনা করেছে, যার মধ্যে চল্লিশটি সফল হয়েছে। নাসাই এখনো পর্যন্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে। জাপান ছয়টি মিশন পরিচালনা করেছে যার মধ্যে তিনটি সফল হয়েছে। চীন পাঁচটি মিশন চালিয়ে পাঁচটিতেই সফল হয়েছে। ভারত তিনটি মিশন চালিয়ে দুটিতে সফল হয়েছে। ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন, লুক্সেমবার্গ, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইতালি একটি করে মিশন পরিচালনা করেছে সফলভাবে। ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি করে মিশন পরিচালনা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবী থেকে চাঁদে নভোযান পাঠিয়ে সফলভাবে চাঁদের পিঠে নামাতে পেরেছে মাত্র চারটি দেশ – সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, চীন এবং ভারত। আর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সর্বপ্রথম চন্দ্রযান অবতরণ করানোর কৃতিত্ব অর্জন করেছে ভারত – অতি সম্প্রতি। 

১৯৮০র দশকে চাঁদের মিশনের প্রতি মহাকাশ সংস্থাগুলির আগ্রহ একবারেই কমে গিয়েছিল। তখন মহাকাশে উন্নত টেলিস্কোপ পাঠিয়ে মহাবিশ্বের আরো গভীরে পর্যবেক্ষণ করার দিকে নজর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৯০র দশকের পর থেকে চাঁদের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। একবিংশ শতাব্দীতে মহাকাশ গবেষণায় অনেক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে – যেখানে চাঁদ একটা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশনগুলিতে। 

মহাকাশবিজ্ঞানীরা পরিকল্পনা করছেন – চাঁদকে মহাকাশের স্থায়ী স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। তা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? চাঁদে একসময় পানি ছিল তার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন চাঁদের বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করে। চাঁদে এখনো কিছু পানি জমাট বরফের আকারে রয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে – এরকমই ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। এরকম ভাবার কারণ কী? 

চাঁদ নিজের অক্ষের উপর যে বেগে ঘুরছে – তা পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগের তুলনায় অনেক কম। পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর চব্বিশ ঘন্টায় একবার ঘুরে আসে – যার ফলে চব্বিশ ঘন্টায় পৃথিবীর এক দিন। কিন্তু চাঁদ নিজের অক্ষের উপর একবার ঘুরতে সময় নেয় প্রায় আটাশ দিন। অর্থাৎ চাঁদের একদিন সমান পৃথিবীর ২৮ দিন। সূর্যের সাথে চাঁদের অবস্থানের কারণে চাঁদের এক পিঠে একটানা চৌদ্দ দিন সূর্যালোক পড়ে, অন্যপিঠে তখন থাকে অন্ধকার। একইভাবে অন্যপিঠে আবার চৌদ্দদিন দিনের আলো পড়ে। কিন্তু চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি এমন কিছু গর্ত আছে যেখানে কখনোই সূর্যালোক পড়ে না। সেই গর্তগুলির ভেতরের তাপমাত্রা এত কম যে মাইনাস একশ ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। সেই তাপমাত্রায় চাঁদের আদিকালের জমাট বরফ এখনো রয়ে যেতে পারে। এই জমাট বরফ মানেই তো পানি। 

এই পানির সন্ধান করাই চাঁদের সাম্প্রতিক মিশনগুলির প্রধান উদ্দেশ্য। চাঁদে পানির সন্ধান পাওয়া গেলে সেই পানি ব্যবহার করা যাবে ভবিষ্যৎ মিশনগুলিতে। পৃথিবী থেকে যদি পানি বয়ে নিয়ে যেতে না হয়, তাহলে নভোচারীদের একটা বিরাট সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, চাঁদে পানি পাওয়া গেলে ভবিষ্যতের মিশনগুলি চাঁদ থেকে পরিচালনা করা যাবে – যেখানে পানির উপাদান হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন থেকে তৈরি করা যাবে নভোযানের জ্বালানি। নভোচারীদের জন্য দরকারি অক্সিজেন চাঁদেই তৈরি করে নেয়া যাবে। 

কিন্তু পানি থাকার সবচেয়ে সম্ভাব্য যে জায়গা – সেই দক্ষিণ মেরুতে পৃথিবী থেকে পাঠানো নভোযান অবতরণ করানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) তাদের চন্দাভিযান চন্দ্রায়ন-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করাতে পেরেছে, এটা সত্যিই যুগান্তকারী মাইলফলক। 

ভারতের চন্দ্রায়ন প্রকল্প শুরু হয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে। প্রথম মিশন চন্দ্রায়ন-১ ছিল চাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে চাঁদের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের মিশন। ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর পৃথিবী থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল চন্দ্রায়ন-১ স্যাটেলাইট। নির্দিষ্ট সময়ে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে চাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তথ্য পাঠিয়েছে পৃথিবীতে পরবর্তী দশ মাস ধরে। সেই তথ্য থেকে আশা করা যায় যে চাঁদের মেরু অঞ্চলের কিছু গর্তের ভেতর জমাট বরফে পানি থাকতে পারে। ২০০৯ সালের ২৮ আগস্ট এই মিশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। 

এরপর শুরু হয় চন্দ্রায়ন-২ এর প্রস্তুতি। চন্দ্রায়ন-২ এর তিনটি অংশ ছিল – লুনার অরবিটার, লুনার ল্যান্ডার বিক্রম এবং লুনার রোভার প্রজ্ঞান। পরিকল্পনা অনুসারে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই উৎক্ষেপণ করা হয় চন্দ্রায়ন-২। প্রায় এক মাস ধরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার পর ২০ আগস্ট চাঁদের এক শ কিলোমিটার দূরত্বে পৌছে চাঁদের চারপাশে ঘুরতে থাকে। সেখানে অরবিটার থেকে চাঁদে নামার জন্য ল্যান্ডার বিক্রমকে আলাদা করা হয়। হিসেব অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ বিক্রমের চাঁদে নামার কথা ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই এগোচ্ছিল। কিন্তু চাঁদের পিঠ থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার উপরে থাকতেই বিক্রমের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ধরে নেয়া যায়, বিক্রম চাঁদের পিঠে আছড়ে পড়ে বিকল হয়ে গেছে। 

 চন্দ্রায়ন-২ ব্যর্থ হবার পরেও একটুও দমে যাননি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা। চার বছরের মধ্যেই তাঁরা চাঁদে পাঠিয়েছেন পরবর্তী মিশন চন্দ্রায়ন-৩। চন্দ্রায়ন-২ এর ব্যর্থ হবার সম্ভাব্য সব কারিগরি ত্রুটি কাটিয়ে উঠে সাফল্য অর্জন করেছেন চন্দ্রায়ন-৩ প্রকল্পে। 

ইতিহাস সৃষ্টিকারী চন্দ্রায়ন-৩ প্রকল্পের খুটিনাটি একটু দেখা যাক। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো চাঁদের পিঠে সঠিকভাবে একটি ল্যান্ডার অবতরণ করানো। এরপর ল্যান্ডারের ভেতর থেকে বিশেষভাবে তৈরি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি (রোভার) বের করে চাঁদের পিঠে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো। 

২০২৩ সালের ১৪ জুলাই সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় তিন হাজার নয়শ কেজি ভরের চন্দ্রায়ন-৩। যার তিনটি অংশ। প্রপালশান মডিউল যা ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞানকে পৌঁছে দিয়েছে চাঁদের কক্ষপথের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। প্রপালশান মডিউলের ভর ২,১৪৮ কিলোগ্রাম। যার মধ্যে জ্বালানির ভর ১৬৯৬ কিলোগ্রাম। পৃথিবীর চারপাশে পাঁচবার ঘুরে ৫ আগস্ট চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়ে চন্দ্রায়ন-৩র প্রপালশান মডিউল। এবার চাঁদের চারপাশে পাঁচবার প্রদক্ষিণ করার পর ১৭ আগস্ট প্রপালশান মডিউল থেকে ল্যান্ডার আলাদা হয়ে যায়। প্রপালশান মডিউল চাঁদের চারপাশে ঘুরতে থাকবে আরো ছয় মাস। এই ছয়মাস ধরে চাঁদ থেকে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করবে এই মডিউল। এরজন্য একটি বিশেষ যন্ত্র Spectropolarimetry of Habitable Planet Earth (SHAPE) লাগানো হয়েছে প্রপালশান মডিউলের গায়ে। 


বিক্রম সারাভাই


মুন ল্যান্ডারের নাম রাখা হয়েছে ভারতের মহাকাশ গবেষণার পথিকৃৎ বিক্রম সারাভাইয়ের নামে – বিক্রম। বিক্রমের ভর ১৭২৬ কিলোগ্রাম। আয়তাকার দুই মিটার দৈর্ঘ্য, দুই মিটার প্রস্থ এবং ১.১৭ মিটার উচ্চতার একটি বড় বাক্সের মতো বিক্রম ল্যান্ডারের সাথে চারটি ধাতব পা এবং পায়ে চারটি ইঞ্জিন লাগানো আছে। বিক্রমের গায়ে লাগানো সোলার প্যানেল থেকে ৭৩৮ ওয়াট বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন করা যায়। চাঁদের পিঠে নিরাপদে অবতরণ করার জন্য বিক্রমের গায়ে লাগানো আছে বেশ কয়েকটি সেন্সর – এক্সিলারোমিটার, অল্টিমিটার, ডপলার ভেলোসিমিটার, স্টার সেন্সর, ইনক্লাইনোমিটার এবং ক্যামেরা। বেতার যোগাযোগের জন্য লাগানো আছে শক্তিশালী অ্যান্টেনা। বিক্রমের ভেতর একটা প্রকোষ্ঠে সযত্নে লাগানো আছে মুন রোভার – স্বয়ংক্রিয় চন্দ্রযান প্রজ্ঞান। 

প্রপালশান মডিউল থেকে আলাদা হবার সাথে সাথেই বিক্রমের থ্রাস্টার ইঞ্জিনগুলি চালু হয়ে যায়। নিয়ন্ত্রিত গতিতে সেন্সর এবং অন্যান্য কারিগরি নিয়ন্ত্রক কাজে লাগিয়ে বিক্রম নিরাপদে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট। চাঁদের সেই পিঠে তখন দিন, অর্থাৎ সূর্যালোক আছে, থাকবে চৌদ্দ দিন। এই চৌদ্দ দিন কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েই চাঁদে নামানো হয়েছে বিক্রমকে। 

বিক্রমের সোলার প্যানেল সৌরবিদ্যুৎ তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে। বিক্রমের ভেতর একটা প্রকোষ্ঠ এমনভাবে তৈরি যেন ওটা খুলে গিয়ে একটা ঢালু ধাতব পথ তৈরি করতে পারে যেখান দিয়ে বের হয়ে এসেছে চাঁদের রোভার প্রজ্ঞান। 

প্রজ্ঞান একটি ছোট্ট আয়তাকার ধাতব গাড়ি। এর দৈর্ঘ্য ৯১.৭ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ৭৫ সেন্টিমিটার আর উচ্চতা ৩৯.৭ সেন্টিমিটার। ২৬ কিলোগ্রাম ভরের এই স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে ছয়টি চাকা লাগানো আছে। লাগানো আছে সোলার প্যানেল যেখান থেকে ৫০ ওয়াট বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। ২৩ আগস্ট বিক্রম থেকে বের হয়েই কাজ শুরু করে দিয়েছে প্রজ্ঞান। প্রজ্ঞানের গায়ে লাগানো নেভিগেশান ক্যামেরার সাহায্যে এর গতিপথ নির্ধারিত হয়, আর কী দেখছে তার সিগনাল পাঠানো হয় অ্যান্টেনার সাহায্যে ল্যান্ডার বিক্রমে।

বিক্রম যেখানে নেমেছে সেখানে কার্যকর থাকবে মোট চৌদ্দদিন। প্রজ্ঞানও তাই। চৌদ্দ দিন পর চাঁদে রাত নেমে এলে পরবর্তী চৌদ্দদিন অন্ধকারে প্রচন্ড ঠান্ডা এবং সৌরকোষ থেকে কোন শক্তি উৎপন্ন করতে না পেরে বিক্রম এবং প্রজ্ঞানের সংবেদী ইলেকট্রনিক্স আর কার্যকর থাকার সম্ভাবনা খুব কম। এই চৌদ্দ দিনের ভেতরই তারা যা করার করে ফেলছে। 

বিক্রমে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে। চাঁদের ভূমির তাপমাত্রার ধর্মাবলি পরীক্ষার জন্য আছে Chandra’s Surface Thermophysical Experiment (ChaSTE), চাঁদের ভূমির আশেপাশে কম্পন মাপার জন্য আছে ‘Instrument for Lunar Seismic Activity (ILSA)’, চাঁদের অতিসংবেদী আবহাওয়ায় গ্যাস ও প্লাজমা পর্যবেক্ষণের জন্য আছে Radio Anatomy of Moon Bound Hypersensitive ionosphere and Atmosphere (RAMBHA)। এই যন্ত্রপাতিগুলি সব ভারতীয় ল্যাবেই তৈরি করা হয়েছে। আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) একটি লেজার রেট্রোরিফ্লেকটর দিয়েছে যা বিক্রমের সাথে চাঁদে গেছে চাঁদের ভূমি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। 

প্রজ্ঞানে লাগানো আছে দুইটি যন্ত্র – আলফা পার্টিক্যাল এক্সরে স্পেকট্রোমিটার (APXS) এবং Laser Induced Breakdown Spectroscope (LIBS) - যেগুলি দিয়ে চাঁদের মাটির রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করছে। প্রজ্ঞান কাজ শুরু করার এক সপ্তাহের মধ্যেই চাঁদের মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, লোহা, ক্রোমিয়াম, টিন, ম্যাঙ্গানিজ, সিলিকন এবং অক্সিজেন শনাক্ত করে ফেলেছে। এগুলির অস্বিত্ব আগেও পাওয়া গিয়েছিল অন্যান্য মিশনের পরীক্ষা থেকে। কিন্তু এই প্রথম চাঁদের মাটিতে সালফারের অস্তিত্ব ধরা পড়লো সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে। চাঁদের মাটিতে হাইড্রোজেনের খোঁজ চলছে, এখনো পাওয়া যায়নি। 

চন্দ্রায়নের এই সাফল্য চাঁদের অভিযানের গতি এবং সম্ভাবনা আরো অনেকদূর বাড়িয়ে দিয়েছে। নাসার আর্টেমিস মিশনের কাজ চলছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবীর মানুষ আবার চাঁদের বুকে পা রাখবে। কয়েক দশকের মধ্যেই হয়তো চাঁদে তৈরি হয়ে যাবে গ্রহান্তরে যাবার স্টেশন। আর যদি চাঁদে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দুটোই পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণে, অনন্ত সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে। 


তথ্যসূত্র:

১। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা www.isro.gov.in

২। প্রদীপ দেব, চাঁদের নাম লুনা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৭। 

_____________
বিজ্ঞানচিন্তা  সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত








Thursday, 3 February 2022

দর্পণে মহাবিশ্ব: হাবল স্পেস টেলিস্কোপ

 


পৃথিবীর বাইরে গিয়ে পৃথিবীকে দেখার ধারণাটা প্রথম দিয়েছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস সেই ২৪০০ বছর আগে। তখনো খালিচোখে আকাশের চন্দ্র-সূর্য দেখে প্রকৃতিকে বুঝতে চেষ্টা করেছে মানুষ। তখনো মানুষের চিন্তাভাবনায় মহাবিশ্বের মূলকেন্দ্র ছিল পৃথিবী। পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে অনেক দার্শনিক-গবেষণা হয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে। কিন্তু সেইসব ধারণার সুনির্দিষ্ট প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরের পর বছর। 

পৃথিবী থেকে আকাশ দেখার দৃশ্যপট দ্রুত পালটে গেলো যখন গ্যালিলিও আকাশের দিকে তাক করলেন প্রথম টেলিস্কোপ। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ দিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের চারপাশে ঘূর্ণনরত চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করলেন। বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদগুলোর গতিপথ দেখার পর গ্যালিলিওর মনে হলো এই উপগ্রহগুলো যেন তাদের মনিব-গ্রহের আদেশে একটি কক্ষপথে থেকে চাকরের মতো ঘুরছে মনিবের চারপাশে। ল্যাটিন ভাষায় তিনি উপগ্রহগুলোর নাম দিলেন 'satelles' (স্যাটেলিস) - যার অর্থ হলো servant বা চাকর। satelles থেকে ইংরেজিতে স্যাটেলাইট (satellite) কথাটি এসেছে। মানুষ যে কৃত্রিমভাবে স্যাটেলাইট তৈরি করে আকাশে পাঠিয়ে দিতে পারে সেরকম কোন কল্পনাও তখন কেউ করেনি। কিন্তু গ্যালিলি-যুগের পরবর্তী তিন শ বছরের মধ্যেই মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত শত কৃত্রিম স্যাটেলাইট – মানুষেরই কাজে।

গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের পর আরো অনেক শক্তিশালী টেলিস্কোপ তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবী থেকেই সেসব টেলিস্কোপ মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করছে দিনরাত। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে মহাকাশ থেকে আলো আসার সময় অনেক ধরনের মিথস্ক্রিয়া ঘটে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে অনেক আলো শোষিত হয়, ধুলাবালিতে আলো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ফলে মহাকাশের মহাজাগতিক ঘটনাগুলি নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। শত শত আলোকবর্ষ দূরের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে আসার সময় উজ্জ্বলতা হারায়। বায়ুমন্ডলের কারণেই তারাগুলি মিটমিট করে। ফলে অনেক কিছুই ধরা পড়ে না শক্তিশালী টেলিস্কোপেও। পৃথিবীর টেলিস্কোপগুলিকে বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপন করেও অনেক সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়নি। তাই বিশাল আকৃতির এক টেলিস্কোপকে স্যাটেলাইট হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবীর বাইরে। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মহাবিশ্বকে দেখার প্রথম শক্তিশালী এবং প্রচন্ড সফল এই টেলিস্কোপের নাম হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। 

মহাকাশে টেলিস্কোপ স্থাপনের ধারণা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে জার্মানির বিজ্ঞানী হারমান ওবের্থ-এর “দ্য রকেট ইনটু প্ল্যানেটারি স্পেস’ বইতে। তখনো কিন্তু কোন ধরনের মহাকাশযান তৈরি হয়নি। তাই ওবের্থ-এর ধারণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি কেউ সেই সময়। এরপর ১৯৪৬ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাইম্যান স্পিৎজার-এর “অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল আডভান্টেজেজ অব অ্যান এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল অবজারভেটরি” প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে ওবের্থ-এর ধারণা আবার সামনে চলে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে শীতল-যুদ্ধ শুরু হলে মহাকাশ গবেষণায় দ্রুত উন্নতি ঘটে। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক মহাকাশে পাঠালে আমেরিকা দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকান মহাকাশ প্রশাসন প্রতিষ্ঠান - নাসা। 

১৯৬০ সালে প্রফেসর স্পিৎজার এবং আমেরিকার আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাসা এবং আমেরিকান কংগ্রেসের কাছে আবেদন করেন মহাকাশে টেলিস্কোপ পাঠানোর  “লার্জ অরবিটাল টেলিস্কোপ” প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার জন্য। ১৯৬৯ সালে এই প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। তবে সেই সময় মানুষ প্রথমবার চাঁদে অবতরণ করার পর নাসার প্রকল্পে বাজেট ঘাটতি দেখা দেয়। অনেক বড় প্রকল্প বাজেটের অভাবে ছোট করতে হয়। লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের প্রাথমিক নকশায় মূল দর্পণের ব্যাস ছিল ১২০ ইঞ্চি। টাকার অভাবে পুরো নকশা বদলে আরো ছোট আকারের টেলিস্কোপের পরিকল্পনা করতে হয়। এবার মূল দর্পণের ব্যাস দাঁড়ালো ৯৪ ইঞ্চিতে। ১৯৭৭ সালে আমেরিকান কংগ্রেস লার্জ স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্প অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের বাজেট কিছু বাড়ানোর জন্য নাসা ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সাথে একটি চুক্তি করে। লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের শতকরা ১৫ ভাগ খরচ ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি দেবে, কিন্তু তার বিনিময়ে টেলিস্কোপের শতকরা ১৫ ভাগ পর্যবেক্ষণ সময় তারা ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাড়ে তিন ঘন্টা সময় থাকবে ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির জন্য সংরক্ষিত। 

১৯৭৯ সালের মধ্যে স্পেস টেলিস্কোপের নকশা চূড়ান্ত হয় এবং নির্মাণ-কাজ শুরু হয়। বিশটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইওরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা এই নির্মাণ-কাজের সাথে যুক্ত। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ১৯৮৩ সালের মধ্যে টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানোর। কিন্তু কাজ শুরু করার পর দেখা গেলো খরচ আর সময় কোনটাতেই কুলোচ্ছে না। ১৯৮৩ সালের মধ্যে কিছুতেই এই টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো সম্ভব নয়। এসময় এই টেলিস্কোপের নাম লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের বদলে রাখা হলো আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল-এর নামে ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’। ঠিক করা হয় ১৯৮৬ সালে মহাকাশে পাঠানো হবে এই টেলিস্কোপ। 

১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার দুর্ঘটনায় সাতজন নভোচারীর সবাই মর্মান্তিকভাবে নিহত হলে নাসার সব মহাকাশ প্রকল্প কয়েক বছরের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।  সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো যায়নি তখন। অবশেষে ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। পরেরদিন ২৫ এপ্রিল তা কক্ষপথে পৌঁছে যায়।

স্পেস শাটল ডিসকভারি তার প্রকোষ্ঠে ভরে টেলিস্কোপটিকে পৃথিবী থেকে মহাকাশে নিয়ে গিয়ে লো-আর্থ অরবিটে রেখে আসে। পৃথিবীর ভূমি থেকে ১৫০ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ১২০০ কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চতায় লো-আর্থ অরবিট। হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘন্টায় প্রায় ২৭ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে তার সময় লাগে প্রায় ৯৫ মিনিট। 

হাবল স্পেস টেলিস্কোপ একটি বিশাল আকৃতির স্যাটেলাইট। এর মূল দেহের আকৃতি ৪.৩ মিটার ব্যাসের ১৩ মিটার লম্বা একটি চোঙার মতো। মহাকাশে পাঠানোর সময় এর ভর ছিল ১০,৮০০ কিলোগ্রাম। শেষবার সার্ভিসের পর বর্তমানে এর বর্তমান ভর দাঁড়িয়েছে ১২,২০০ কিলোগ্রামে। এই টেলিস্কোপকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন যন্ত্রপাতিগুলিকে আলাদা আলাদাভাবে মেরামত করা যায় বা দরকার হলে বদলে দেয়া যায়। পৃথিবী থেকে মহাকাশচারী পাঠিয়ে এই টেলিস্কোপ মেরামত করা যায়। সেজন্য টেলিস্কোপের বাইরের খোলে বিভিন্ন জায়গায় হাতল দেয়া হয়েছে – যেন মহাকাশচারীরা সেই হাতল ধরে মহাকাশে ভাসতে ভাসতে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারেন।

এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে সোলার প্যানেলের সাহায্যে। ৭.১ মিটার দীর্ঘ এবং ২.৬ মিটার চওড়া দুটো সোলার প্যানেল আছে এই টেলিস্কোপের দুই পাশে। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে পারে এই প্যানেলদুটি। ছয়টি নিকেল-হাইড্রোজেন ব্যাটারিতে এই শক্তি সংরক্ষণ করে। এই শক্তি প্রায় ২২টি গাড়ির ব্যাটারির সঞ্চিত শক্তির সমান। 

এই টেলিস্কোপটি একটি রিফ্লেকটিং টেলিস্কোপ বা প্রতিফলক দুরবিন। আলোর প্রতিফলনের জন্য দুটি আয়না আছে এই টেলিস্কোপে – প্রাইমারি মিরর বা মুখ্যদর্পণ এবং সেকেন্ডারি মিরর বা গৌণদর্পণ। মুখ্যদর্পণের ব্যাস ৯৪ ইঞ্চি বা  ২.৪ মিটার এবং ভর ৮২৮ কিলোগ্রাম। গৌণদর্পণের ব্যাস মাত্র ১২ ইঞ্চি, এবং ভর ১২.৪ কিলোগ্রাম। যে কাচ দিয়ে এই আয়নাদুটো বানানো হয়েছে, সেই কাচ প্রচন্ড বা গরমেও একটুও সংকুচিত বা প্রসারিত হয় না। কাচের উপর প্রতিফলক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ম্যাগনেসিয়াম ফ্লোরাইডের উপর অ্যালুমিনিয়ামের আস্তরণ। 

মহাকাশ থেকে আগত আলো টেলিস্কোপের চোঙার মধ্যে ঢুকে মুখ্যদর্পণে প্রতিফলিত হয়ে গৌণদর্পণে পড়ে। গৌণদর্পণ থেকে আবার প্রতিফলিত হয়ে মুখ্যদর্পণের মাঝামাঝি সূক্ষ্ণছিদ্রের ভেতর দিয়ে মূল টেলিস্কোপের নলে প্রবেশ করে। সেখানেই প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। টেলিস্কোপে সৃষ্ট ফোকাস পয়েন্ট – যেখানে প্রতিবিম্ব তৈরি হয় – সেখান থেকে তা টেলিস্কোপে লাগানো বিভিন্ন ক্যামেরা এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ভেতর চলে যায়। 

হাবল টেলিস্কোপের প্রধান পাঁচটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি হলো – ওয়াইড-ফিল্ড অ্যান্ড প্ল্যানেটারি ক্যামেরা (WF/PC), ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা (FOC), হাইস্পিড ফটোমিটার (HSP), গডার্ড হাই-রেজ্যুলেশন স্পেকট্রোগ্রাফ (GHRS), এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোগ্রাফ (FOS)।  



১৯৯০ সালে যে যন্ত্রপাতিগুলি পাঠানো হয়েছিল পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে টেলিস্কোপ সার্ভিসিং-এর সময় সেই যন্ত্রপাতিগুলি বদলে আরো উন্নতমানের যন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বিগত তিরিশ বছরে। এপর্যন্ত মোট পাঁচবার পৃথিবী থেকে নভোচারীরা হাবল টেলিস্কোপে গিয়ে যন্ত্রপাতি বদলে দিয়ে এসেছে। প্রথম সার্ভিস মিশন গিয়েছিল ডিসেম্বর ১৯৯৩, দ্বিতীয় সার্ভিস মিশন ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, তৃতীয় সার্ভিস মিশনের প্রথম ধাপ ডিসেম্বর ১৯৯৯, তৃতীয় সার্ভিস মিশনের দ্বিতীয় ধাপ ফেব্রুয়ারি ২০০২, চতুর্থ এবং শেষ সার্ভিস মিশন মে ২০০৯। 

হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় WF/PC। দুইটি ক্যামেরার সমন্বয়ে WF/PC। ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা বিস্তীর্ণ আকাশের বিশাল এলাকা ধারণ করে, আর প্ল্যানেটারি ক্যামেরা সেই ছবির রেজ্যুলেশন বাড়ায় এবং ছবিকে বিবর্ধিত করে। ১৯৯০ সালে টেলিস্কোপ কাজ শুরু করার পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে মুখ্যদর্পণে সামান্য ত্রুটি রয়ে গেছে, ফলে ছবি ঝাপসা আসছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম সার্ভিসের সময় WF/PC প্রতিস্থাপন করে এই ত্রুটি দূর করা হয়। ২০০৯ সালে শেষবার সার্ভিসিং এর সময় আরো উন্নত-প্রযুক্তির WF/PC প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। 

মহাকাশে অনুজ্জ্বল বস্তুর ছবি তোলে ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা। এই কাজ করার জন্য ইমেজ ইন্টেন্সিফায়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ২০০২ সালে সার্ভিসিং-এর সময় আরো উন্নতমানের সার্ভে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে টেলিস্কোপের সাথে। 

হাইস্পিড ফটোমিটারের কাজ হলো উচ্চশক্তির উৎস থেকে উৎপন্ন আলোর পরিবর্তন শনাক্ত করা। শুরুতে এটা ঠিকমতো কাজ করছিলো না। ১৯৯৩ সালে প্রথমবার সার্ভিসিং-এর সময় এটা বদলে একটা নতুন প্রযুক্তির COSTAR (corrective optics space telescope axial replacement) স্থাপন করা হয়। 

মহাকাশ গবেষণায় আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণের গুরুত্ব অপরিসীম। লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে আগত আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে জানা যায় আলোর উৎসের গতিপথ। আলোর তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে আমাদের বর্ণালী ভাগ করা হয়েছে। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। যদি আগত আলোর স্বাভাবিক বর্ণালীরেখা নীল রেখার দিকে সরতে থাকে (ব্লু-শিফ্‌ট) – তাহলে বুঝতে হবে বস্তুটি আমাদের দিকে আসছে, আর যদি লাল রেখার দিকে সরতে থাকে (রেড শিফ্‌ট) তাহলে বুঝতে হবে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাকাশের আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করার জন্য হাবল টেলিস্কোপে আছে দুইটি স্পেকট্রোগ্রাফ - গডার্ড হাই-রেজ্যুলেশন স্পেকট্রোগ্রাফ (GHRS), এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোগ্রাফ (FOS)। দুটোই চমৎকারভাবে কাজ করেছে ১৯৯৭ পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় সার্ভিসিং-এর সময় এগুলি বদলে স্পেস টেলিস্কোপ ইমেজিং স্পেকট্রোগ্রাফ (STIS) হয়েছে। এই স্পেকট্রোগ্রাফ অতিবেগুনি থেকে অবলোহিত তরঙ্গ পর্যন্ত সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোই বিশ্লেষণ করতে পারে। 

লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে ছবি তোলার জন্য হাবলকে খুবই স্থির থাকতে হয়। অনেকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বোঝাতে বলে থাকেন একচুলও না হেলার কথা। হাবল একটি চুলকে এক কিলোমিটার দূর থেকে দেখলে যত ছোট দেখা যাবে – সেটুকুও না হেলে ছবি তুলতে পারে। এই কাজটি করার জন্য হাবলে আছে অত্যন্ত সংবেদী সেন্সর – ফাইন গাইডেন্স সেন্সরস (FGS)। তিনটি সেন্সর হাবল টেলিস্কোপকে কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির রাখতে পারে দীর্ঘ সময়। 

টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতির সাথে লাগানো আছে অনেকগুলি কম্পিউটার এবং মাইক্রোপ্রসেসর। দুটি প্রধান কম্পিউটারের একটি যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যটি পুরো স্যাটেলাইটকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

হাবল টেলিস্কোপের মূল নিয়ন্ত্রণ আছে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের হাতে। হাবল টেলিস্কোপের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে। আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট গডার্ডের নাম অনুসারে এই সেন্টার এবং হাবল টেলিস্কোপের স্পেকট্রোগ্রাফের নামকরণও করা হয়েছে। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় কমান্ড পাঠান। সেই কমান্ড যায় ট্রেকিং অ্যান্ড ডাটা রিলে স্যাটেলাইটে। সেখান থেকে কমান্ড যায় হাবল টেলিস্কোপে লাগানো হাই-গেইন অ্যান্টেনার সাহায্যে হাবলের কম্পিউটারে। এখন টেলিস্কোপ থেকে ছবি এবং তথ্য পৃথিবীতে পাঠানো হয় হাবলের অ্যান্টেনার সাহায্যে ট্রেকিং অ্যান্ড ডাটা রিলে স্যাটেলাইটে। স্যাটেলাইট থেকে চলে আসে পৃথিবীতে। প্রতি সপ্তাহে হাবল প্রায় ১৫০ গিগাবিট ডাটা পৃথিবীতে পাঠায়। 

অন্যান্য স্যাটেলাইটের মতোই পনেরো বছর কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে পাঠানো হয়েছিল হাবল টেলিস্কোপ। কিন্তু এটা নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছে গত একত্রিশ বছর ধরে। সার্ভিসিং এবং যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের কারণে এই টেলিস্কোপ দিনের পর পর দিন আরো শক্তিশালী হয়েছে। 

হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যেই আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে কমপক্ষে ১৩৮০ কোটি বছর আগে। হাবলের সাহায্যে প্রমাণ পেয়েছি ব্ল্যাকহোলের। হাবল আমাদের খুঁজে দিয়েছে অনেকগুলি নতুন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা। হাবল টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দিয়েছে আশ্চর্য গতি। এপর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে হাবলের সাহায্যে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে। 

মহাকাশে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ পাঠানো হচ্ছে। এই নতুন টেলিস্কোপ হাবল টেলিস্কোপের বিকল্প নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীও নয়। হাবল টেলিস্কোপ যেভাবে কাজ করছে সেভাবেই কাজ করতে থাকবে আরো অনেক বছর। 


তথ্যসূত্র: 

রবিন কেরড ও ক্যারোল স্টট - ‘হাবল দি মিরর অন দি ইউনিভার্স’ (২০০৮), প্রদীপ দেব – ‘সবার জন্য স্যাটেলাইট’ (২০১৯), nasa.gov, ডেভিড সায়লার ও ডেভিড হারল্যান্ড – ‘দি হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ফ্রম কনসেপ্ট টু সাকসেস’ (২০১৬)। 

______________
বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত








Sunday, 28 March 2021

সবার জন্য স্যাটেলাইট - পর্ব ৮

 



অষ্টম অধ্যায়

স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে

 

কক্ষপথে স্থিত হবার পর মাধ্যাকর্ষণের টানে স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর চারপাশে নির্দিষ্ট কৌণিক বেগে ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতেই স্যাটেলাইটকে সব কাজ করতে হয়। স্যাটেলাইটের প্রথম কাজ হচ্ছে স্টেশন কিপিং। কক্ষপথ থেকে যেন বের হয়ে না পড়ে সেজন্য স্যাটেলাইটকে সারাক্ষণই তার গতি, দিক এবং উচ্চতা ঠিক রাখার জন্য কাজ করে যেতে হয়। এই কাজকে বলা হয় স্টেশন কিপিং।

          কক্ষপথে নিজের অবস্থান বজায় রেখে স্যাটেলাইটগুলো তার জন্য নির্দিষ্ট কাজ - যেমন কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট হলে - গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে পাঠানো সিগনাল রিসিভ করে তা পৃথিবীতে নির্দিষ্ট রিসিভারে সম্প্রচার করে দেয়া বা পাঠিয়ে দেয়া; আবহাওয়া স্যাটেলাইট হলে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে ঘুরে আবহাওয়া সংক্রান্ত যেসব সূচক থাকে তা পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করা এবং প্রয়োজনীয় ছবি তুলে তা গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠানো। দিক নির্দেশক বা জিপিএস স্যাটেলাইটগুলো - অনেকগুলো স্যাটেলাইট মিলে নিজেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে এবং পৃথিবীতে জিপিএস রিসিভারে সিগনাল পাঠায়। বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইটগুলোর জন্য খুবই সুনির্দিষ্ট কাজ ঠিক করে দেয়া থাকে। তারা সেগুলো করে। বিভিন্ন স্যাটেলাইট বিভিন্নভাবে কাজ করলেও কাজের ধরন মোটামুটি এক রকম। স্যাটেলাইটগুলো মূলত পৃথিবীপৃষ্ঠের অনেক উপর থেকে পৃথিবীর অ্যান্টেনার কাজ করে। এই অধ্যায়ে আমরা বিভিন্ন স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে তা আলোচনা করবো।

 

স্টেশন কিপিং

 কক্ষপথে স্থাপনের পর স্যাটেলাইটের সোলার প্যানেলগুলো পুরোপুরি খুলে যায়। সোলার সেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে থাকে এবং স্যালেটাইটের সবগুলো যন্ত্রপাতি কাজ শুরু করে দেয়। সোলার প্যানেলগুলোকে সবসময় সূর্যের দিকে করে রাখার ব্যবস্থা করা হয় যেন সোলার সেলগুলো প্রচুর সূর্যালোক পায় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়। কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় স্যাটেলাইটের সোলার সেলগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। তখন স্যাটেলাইট ব্যাটারি থেকে চার্জ নিয়ে কাজ অব্যাহত রাখে।

          জিওস্টেশনারি অরবিটের মোট পরিসীমা প্রায় দুই লক্ষ ৬৬ হাজার কিলোমিটার। এই পরিসীমাকে চারপাশে ৩৬০ কোণে ভাগ করলে প্রতি ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের মধ্যে দূরত্ব থাকে প্রায় ৭৪০ কিলোমিটার। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে দ্রাঘিমাংশের পার্থক্য যদি মাত্র ০.০১-ও হয় তাহলে একটি স্যাটেলাইট থেকে অন্য স্যাটেলাইটের মধ্যবর্তী দূরত্ব থাকবে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলো কক্ষপথে ঘন্টায় প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। সেখানে মাত্র সাড়ে সাত কিলোমিটার দূরত্ব কিছুই না। কিন্তু স্যাটেলাইটগুলো যেহেতু সবগুলো একই দিকে একই বেগে ঘুরছে তাদের মধ্য সংঘর্ষ ঘটার সম্ভাবনা অনেক কম। কিন্তু কক্ষপথে প্রবেশ করার সময় যদি নির্দিষ্ট অবস্থানের ০.০১ পার্থক্যও ঘটে তাহলে অন্য স্যাটেলাইটের গায়ের ওপর গিয়ে পড়তে পারে। সারণি-৪ থেকে দেখা যায় জিওস্টেশনারি অরবিটে স্যাটেলাইটগুলোর দ্রাঘিমাংশ কত কাছাকাছি। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের দ্রাঘিমাংশ ১১৯. পূর্ব - যার কাছাকাছি আরো ২০-২৫টি কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট আছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক দ্রাঘিমাংশ প্রায় ৯৪ পূর্ব। কিন্তু সেই দ্রাঘিমাংশে জিওস্টেশনারি অরবিটে কোন জায়গা খালি না পাওয়ায় বাংলাদেশের স্যাটেলাইট হংকং ও চীনের কাছাকাছি ১১৯. পূর্ব দ্রাঘিমাংশে পাঠানো হয়েছে।

          এই স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথে নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে হয় ১৫ বছর ধরে। মহাশূন্যে প্রচন্ড বেগে ঘুরতে ঘুরতে এই অবস্থান ধরে রাখা খুব সহজ নয়। পৃথিবীর ঘনত্ব সব জায়গায় সমান না হওয়ার কারণে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণও সব জায়গায় সমান নয়। ফলে যে মাধ্যাকর্ষণের টানে স্যাটেলাইট জিওস্টেশনারি অরবিটে থাকে - সেই টানের মান মাঝে মাঝে পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে স্যাটেলাইট কক্ষপথ থেকে নড়ে যেতে পারে। এটাকে ঠিক রাখার জন্য স্যাটেলাইটে অ্যাটিচিউড অ্যান্ড অরবিট কন্ট্রোল থ্রাস্টার ব্যবহার করা হয়। স্যাটেলাইটের তরল জ্বালানি ব্যবহার করে এই থ্রাস্টারগুলো স্যাটেলাইটকে নির্দিষ্ট জায়গায় ধরে রাখে।

 

সারণি ৪: জিওস্টেশনারি কক্ষপথে দ্রাঘিমাংশের বিন্যাস ও স্যাটেলাইটের সংখ্যা

জিওস্টেশনারি অরবিটে দ্রাঘিমাংশ বিন্যাস

দ্রাঘিমাংশের পরিসর

স্যাটেলাইটের সংখ্যা

এই দ্রাধিমাংশে প্রধান শহর

১৮০ পশ্চিম - ১৬৫ পশ্চিম

আডাক, আলাস্কা

১৬৫ পশ্চিম - ১৫০ পশ্চিম

হনলুলু, হাওয়াই

১৫০ পশ্চিম - ১৩৫ পশ্চিম

ফেয়ারব্যাংকস, আলাস্কা

১৩৫ পশ্চিম - ১২০ পশ্চিম

১২

সানফ্রান্সিসকো

১২০ পশ্চিম - ১০৫ পশ্চিম

২০

লস আঞ্জেলেস

১০৫ পশ্চিম - ৯০ পশ্চিম

৩৬

মিনিয়াপোলিস

৯০ পশ্চিম - ৭৫ পশ্চিম

১৫

শিকাগো

৭৫ পশ্চিম - ৬০ পশ্চিম

১৯

নিউইয়র্ক

৬০ পশ্চিম - ৪৫ পশ্চিম

১০

ব্রাসিলিয়া, ব্রাজিল

৪৫ পশ্চিম - ৩০ পশ্চিম

১৪

রিও ডি জেনেরিও, ব্রাজিল

৩০ পশ্চিম - ১৫ পশ্চিম

১২

ডাকার, সেনেগাল

১৫ পশ্চিম - ০

২৪

লন্ডন

- ১৫ পূর্ব

২২

প্যারিস

১৫ পূর্ব - ৩০ পূর্ব

২৮

অ্যাথেন্স, গ্রিস

৩০ পূর্ব - ৪৫ পূর্ব

১৯

মস্কো, রাশিয়া

৪৫ পূর্ব - ৬০ পূর্ব

২০

তেহরান, ইরান

৬০ পূর্ব - ৭৫ পূর্ব

২০

কাবুল, আফগানিস্তান

৭৫ পূর্ব - ৯০ পূর্ব

২৪

দিল্লী, ভারত

৯০ পূর্ব - ১০৫ পূর্ব

২০

সিঙ্গাপুর, ঢাকা

১০৫ পূর্ব - ১২০ পূর্ব

২৪

হং কং, চীন

১২০ পূর্ব - ১৩৫ পূর্ব

১২

সাংহাই, চীন

১৩৫ পূর্ব - ১৫০ পূর্ব

১৩

টোকিও, জাপান

১৫০ পূর্ব - ১৬৫ পূর্ব

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

১৬৫ পূর্ব - ১৮০ পূর্ব

ক্রাইস্টচার্চ, নিউজিল্যান্ড

 

জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলোকে পৃথিবীতে সিগনাল পাঠাতে হয়। পৃথিবী থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরের এই স্যাটেলাইটগুলো থেকে পুরো পৃথিবীর কৌণিক বিস্তার হয় মাত্র ১৭.। স্যাটেলাইটের অ্যান্টেনাগুলো যে সিগনাল পাঠায় তার কৌণিক বিস্তার রাখা হয় ১৪ বা তার চেয়েও কম। স্যাটেলাইটগুলোর অবস্থানের সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেই এই সিগনালগুলো পৃথিবীর অ্যান্টেনায় ঠিকমত এসে পৌঁছাতে পারবে না। তখন স্যাটেলাইটের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।

          জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলোকে বাতাসের বেগ সামলাতে হয় না, কারণ সেই উচ্চতায় বাতাস নেই। কিন্তু লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কাছাকাছি থাকে বলে তাদেরকে বাতাসের বেগের সাথেও যুদ্ধ করতে হয়। বাতাসের ঘনত্ব খুবই ক্ষীণ হলেও লো আর্থ অরবিটের স্যাটেলাইটগুলোর প্রচণ্ড বেগের কারণে স্যাটেলাইটগুলো বাতাসের বাধা অনুভব করে এবং সে কারণে তাদের গতি ক্রমাগত কমে যেতে থাকে। গতি খুব বেশি কমে যাবার বিপদ ভয়াবহ। গতি অনেক কমে গেলে তারা পৃথিবীর ঘন বায়ুমন্ডলে ঢুকে যেতে পারে - আর একবার সেখানে ঢুকে গেলে বাতাসের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে স্যাটেলাইটে আগুন ধরে যাবে। তাই এই স্যাটেলাইটগুলোকে প্রায়ই থ্রাস্টার দিয়ে উপরের দিকে তুলে দিতে হয়। তাই লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটগুলোতে অনেক বেশি জ্বালানি খরচ হয় - এবং সে কারণে তাদের আয়ু হয় মাত্র কয়েক বছর।

          স্যাটেলাইটে কী হচ্ছে, যন্ত্রপাতিগুলো কেমন আছে ইত্যাদির খবর গ্রাউন্ড স্টেশনে পৌঁছে যায়। স্যাটেলাইটের ট্র্যাকিং, টেলিমেট্রি অ্যান্ড কমান্ড (TT&C) সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রাউন্ড স্টেশন খবর পেয়ে যায় স্যাটেলাইটে কী হচ্ছে। গ্রাউন্ড স্টেশন আপলিংক সিগনালের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে প্রয়োজনীয় কমান্ড পাঠায় - এবং স্টেশন কিপিং-এর সব কাজ সম্পন্ন হয়।

গ্রাউন্ড স্টেশন

স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগের জন্য দরকার গ্রাউন্ড স্টেশন। স্যাটেলাইটের প্রস্তুতির সময় গ্রাউন্ড স্টেশনও তৈরি করা হয়। স্যাটেলাইট ডাউনলিংক সিগনাল পাঠায় এবং সেই সিগনাল পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনার মাধ্যমে গ্রাউন্ড স্টেশনের রিসিভারে ধরা পড়ে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের জন্য দুটো গ্রাউন্ড স্টেশন কাজ করছে এখন।

          রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালি উপজেলার বেতবুনিয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন। এই ভূ-কেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে। স্বাধীনতার পর এই কেন্দ্র অন্য কোন জায়গায় শিফ্‌ট করার কথা উঠেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চাননি এই উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র অন্য কোথাও স্থানান্তর হোক। এই ভূকেন্দ্রের সাথে অন্য দেশের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচারে বিপ্লব এসেছিল।

          বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর কার্যক্রমের জন্য বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ করে নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। একই সাথে গাজিপুরের জয়দেবপুরে আরেকটি নতুন উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-১ এখন এই গ্রাউন্ড স্টেশন দুটো থেকে ডাটা গ্রহণ ও সম্প্রচার শুরু করেছে।

 

চিত্র ৫৩: গাজিপুর উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র

 

স্যাটেলাইট ঠিকমত কাজ করার জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন অপরিহার্য। স্যাটেলাইটের যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করছে কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয় TT&C সিস্টেমের মাধ্যমে। গ্রাউন্ড স্টেশনের ট্র্যাকিং, টেলিমেট্রি অ্যান্ড কমান্ড (TT&C) সিস্টেম স্যাটেলাইটের গতির উপর নজর রাখে। টেলিমেট্রি সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়মিত জানতে পারে স্যাটেলাইটের যন্ত্রপাতিগুলো কেমন আছে, সোলার প্যানেলগুলো ঠিকমত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে কি না, ব্যাটারিগুলো চার্জ হচ্ছে কি না, তরল জ্বালানি কতটুকু আছে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ঠিকমত কাজ করছে কি না ইত্যাদি। TT&C সিস্টেমের রিপোর্ট অনুসারে স্যাটেলাইটে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠানো হয়। যন্ত্রপাতিগুলোর ছোটখাট সমস্যা গ্রাউন্ড স্টেশনের ইঞ্জিনিয়াররা সিগনাল পাঠিয়ে ঠিক করে ফেলতে পারেন। কক্ষপথ থেকে স্যাটেলাইটের অতি সামান্য বিচ্যুতিও ধরা পড়ে গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠানো তথ্য থেকে। তখন প্রয়োজনীয় কমান্ড পাঠিয়ে থ্রাস্টার চালু করে স্যাটেলাইটের প্রয়োজনীয় দিক পরিবর্তন করে ফেলা হয়।

          গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনা, ট্রান্সমিটার, রিসিভার, সিগনাল প্রসেসিং, রাউটিং ইত্যাদি সবকিছুকে একসাথে বলা হয় টেলিকমিউনিকেশান পোর্ট বা টেলিপোর্ট। এই টেলিপোর্টের মাধ্যমেই গ্রাহকদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়। স্যাটেলাইট থেকে যে সিগনাল পৃথিবীতে আসে তা এত দূর থেকে আসতে আসতে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বল সিগনালগুলোকে ফিল্টার করার পর অ্যামপ্লিফাই করা হয়। তারপর সেগুলোকে ব্যবহারকারীর গ্রাহকযন্ত্রে পাঠানো হয়।

         

চিত্র ৫৪: ডিশ অ্যান্টেনা

  

গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনার আকার মূলত নির্ভর করে স্যাটেলাইটের কাজের উপর। ইন্টেলস্যাট স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনার ব্যাস ৩০ মিটার। বেশিরভাগ সাধারণ কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড অ্যান্টেনার ব্যাস ৭ থেকে ১২ মিটারের মধ্যে হয়ে থাকে। ডাইরেক্ট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস প্রদানকারী স্যাটেলাইটগুলো গ্রাহকদের বাড়ির ডিশ অ্যান্টেনায় টেলিভিশন সিগনাল পৌঁছে দেয়। এই ডিশ অ্যান্টেনাগুলোর ব্যাস মাত্র ৭০ সেন্টিমিটার।

          চিত্র ৫৫ স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের প্রধান কাজগুলো নির্দেশ করছে। গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনার গঠন এমন হয়ে থাকে যে স্যাটেলাইট থেকে যে সিগনাল আসে তা অ্যান্টেনার কেন্দ্রে এসে পড়ে। অ্যান্টেনার কাছাকাছি ইলেকট্রনিক মডিউল হলো ডাইপ্লেক্সার। ডাইপ্লেক্সার অ্যান্টেনার আপলিংক ও ডাউনলিংক ফ্রিকোয়েন্সিকে আলাদা করে যার যার নির্দিষ্ট মডিউলে পাঠিয়ে দেয়। স্যাটেলাইট যে সিগনাল পৃথিবীর অ্যান্টেনায় পাঠায় তাকে বলা হয় ডাউনলিংক এবং পৃথিবী থেকে যে সিগনাল গ্রহণ করে তাকে বলা হয় আপলিংক। গ্রাউন্ড স্টেশনের ডাইপ্লেক্সার ডাউনলিংক সিগনালগুলোকে লো নয়েজ এমপ্লিফায়ারে (LNA) পাঠিয়ে দেয় আর আপলিংক সিগনালগুলোকে অ্যান্টেনার মাধ্যমে স্যাটেলাইটে পাঠিয়ে দেয়।

  

চিত্র ৫৫: স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের প্রধান কাজ

  

স্যাটেলাইট থেকে আসা ডাউনলিংক সিগনাল অ্যান্টেনায় গৃহীত হবার পর তা LNA-র ভেতর দিয়ে যাবার সময় বিবর্ধিত হয়। তারপর সেই বিবর্ধিত সিগনাল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়ার ডিভাইডারে প্রবেশ করে। পাওয়ার ডিভাইডারের আউটপুট রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ডাউন কনভার্টারের (DC) সাথে যুক্ত থাকে। DC রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিকে ইন্টারমিডিয়েট ফ্রিকোয়েন্সিতে (IF) রূপান্তরিত করে। এই IF ফ্রিকোয়েন্সিগুলো যুক্ত হয় ডি-মডিউলেটরের সাথে। ডি-মডিউলেটর মডিউলেটেড ইন্টারমিডিয়েট ফ্রিকোয়েন্সি থেকে তথ্য আলাদা করে নেয়। এই সিগনালগুলো মাল্টিপ্লেক্সড সিগনাল - অর্থাৎ অনেকগুলো সিগনাল একসাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। এই সিগনালগুলোকে আলাদা করার জন্য ডি-মাল্টিপ্লেক্সার ব্যবহার করা হয়। ডি-মাল্টিপ্লেক্সার সিগনালগুলোকে আলাদা করে তাদের ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা লাইনে পাঠিয়ে দেয়। ভয়েস বা শব্দ পাঠানো হয় ইলেকট্রনিক প্রাইভেট অটোম্যাটিক প্রাইভেট এক্সচেঞ্জে (EPABX), আর ডাটা পাঠানো হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কে (LAN)। যদি তথ্যগুলোর গন্তব্য স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন না হয়ে অন্য কোথাও হয়ে থাকে - তাহলে গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে সেগুলো বিভিন্ন লিংকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেমন মাইক্রোওয়েভ লিংক, অপটিক্যাল ফাইবার লিংক ইত্যাদি। স্যাটেলাইটের কাজের উপর নির্ভর করে কোন্‌ লিংকে কোন্‌ সিগনাল পাঠানো হবে।

         

কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের সেবাগুলো 

যোগাযোগ উপগ্রহ বা কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব ব্যবস্থাপনার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যে সেবাগুলো গ্রাহকরা সরাসরি গ্রহণ করে তাদের মধ্যে আছে - স্যাটেলাইট টেলিভিশন, মোবাইল টেলিভিশন, স্যাটেলাইট রেডিও, স্যাটেলাইট বিজনেস, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট টেলিফোন, স্যাটেলাইট ডিজাস্টার রিকভারি ইত্যাদি।

 

স্যাটেলাইট টেলিভিশন: বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী টেলিভিশন স্টেশনগুলো তাদের অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। প্রধানত দুই ধরনের স্যাটেলাইট সার্ভিস ব্যবহার করা হয় এই কাজে - ডাইরেক্ট ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইট (DBS) এবং ফিক্সড সার্ভিস স্যাটেলাইট (FSS)।

          ডাইরেক্ট ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইটগুলো খুবই ছোট ছোট অ্যান্টেনার সাহায্যে  সরাসরি ভোক্তাদের বাসার টেলিভিশনে অনুষ্ঠানমালা পৌঁছে দেয়। এই আন্টেনাগুলোকে বলা হয় ভেরি স্মল অ্যাপারচার টার্মিনাল বা ভিস্যাট (VSAT)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কোম্পানি এখন এধরনের ডাইরেক্ট টু হোম (DTH) টেলিভিশন সার্ভিস দিচ্ছে।

          ফিক্সড সার্ভিস স্যাটেলাইট সার্ভিসগুলো সাধারণত স্থানীয় টেলিভিশন স্টেশনে সিগনাল পৌঁছে দেয়। টেলিভিশন স্টেশনগুলো তাদের ট্রান্সমিশান সার্ভিসের মাধ্যমে ঐ এলাকায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। যে কোন দেশের ফ্রি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এই পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এই সার্ভিসের জন্য টেলিভিশন স্টেশনগুলোতে অনেক বড় আকারের অ্যান্টেনা থাকে।

 

মোবাইল টেলিভিশন:চলন্ত গাড়িতে, ট্রেনে, প্লেনে বা জাহাজে সরাসরি টেলিভিশন অনুষ্ঠান পৌঁছে দেয়ার জন্য এই সার্ভিস ব্যবহার করা হয়। স্যাটেলাইটে এজন্য খুবই শক্তিশালী অ্যান্টেনা থাকে যেগুলো জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলমান গাড়ি, ট্রেন, প্লেন বা জাহাজের আন্টেনাতে সিগনাল পৌঁছে দেয়। যে কোন অনুষ্ঠানের লাইভ কভারেজ দেয়ার জন্য সংবাদ মাধ্যমের গাড়িতে অ্যান্টেনা যুক্ত থাকে। সেই অ্যান্টেনার সাথে স্যাটেলাইটের অ্যান্টেনার সংযোগ ঘটে। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট এই পদ্ধতিতে চার হাজার বিদেশী জাহাজ এবং ৩৫ হাজার দেশী জাহাজে টেলিকমিউনিকেশান সার্ভিস প্রদান করবে।

 

স্যাটেলাইট রেডিও: রেডিও স্টেশনের সম্প্রচার তরঙ্গের শক্তি সাধারণত খুব বেশি হয় না। কিন্তু স্যাটেলাইট থেকে যে ডিজিটাল রেডিও সিগনাল সম্প্রচার করা হয় তা ইচ্ছে করলে পুরো পৃথিবীতেই ছড়িয়ে দেয়া যায়। অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে রেডিও রিসিভারের মাধ্যমে সেই রেডিও সম্প্রচার শোনা যাবে। দুর্গম এলাকাতেও এই পদ্ধতিতে রেডিও বার্তা পৌঁছে দেয়া যায়।

 

স্যাটেলাইট বিজনেস:সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। ব্যাংকগুলোর এক শাখার সাথে অন্য শাখার বা এক ব্যাংকের সাথে অন্য ব্যাংকের লেনদেনের যোগাযোগব্যবস্থা করা হচ্ছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। যেখানে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে যে ইন্টারনেট ব্যবস্থা আছে তা কোন কারণে খুব সামান্য সময়ের জন্যও বিঘ্নিত হলে বিরাট ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে - সেখানে স্যাটেলাইটের যোগাযোগ অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।

 

স্যাটেলাইট ইন্টারনেট: পৃথিবীব্যাপী ইন্টারনেটের গতি এখন ক্রমশ বাড়ছে। ইন্টারনেটের সংযোগ এখন বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। টেলিফোনের তারের মাধ্যমে, অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে। মানুষের ঘরে বাইরে এখন ওয়াই-ফাই সিস্টেম। এই সিস্টেমে ইন্টারনেটের ল্যাটেন্সি বা সময়ক্ষেপণ খুবই কম - মাত্র ৩০ মিলিসেকেন্ড। কিন্তু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা নিতে গেলে সবচেয়ে বড় অসুবিধা তা হলো সময়ক্ষেপণ। কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে যে দূরত্বে থাকে - কোন সিগনাল পৃথিবী থেকে সেই দূরত্বে গিয়ে আবার পৃথিবীতে আসতে গেলে - আলোর বেগে ছুটলেও - প্রায় ২৫০ মিলিসেকেন্ড লেগে যায়। তাই যেখানে ক্যাবল কানেকশান আছে সেখানে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সার্ভিস খুব একটা লাভজনক নয়।

          কিন্তু সাবমেরিন ক্যাবল বা অন্যান্য সংযোগ যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ - ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় - তখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়া যায়। জাপানে ভূমিকম্পের কারণে প্রায়ই ইন্টারনেট সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন জাপানের প্রত্যেকটি ডাকঘরে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়েছে। চলন্ত উড়োজাহাজে এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা হয়েছে। যাত্রীরা উড়োজাহাজে বসে টাকায় বিনিময়ে এই সেবা নিতে পারেন।

 

স্যাটেলাইট টেলিফোন: আমাদের বেশিরভাগ টেলিফোনবার্তাগুলো যায় ল্যান্ড লাইন ও সাবম্যারিন ক্যাবলের মাধ্যমে। মোবাইল ফোনের কলগুলো যায় বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে স্থানীয় রিলে সেন্টার বা মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ারের অ্যান্টেনার মাধ্যমে। ল্যান্ড ফোন কিংবা মোবাইল ফোন সার্ভিসের জন্য দরকার হয় সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো। যেখানে এই অবকাঠামো নেই - সেখানে টেলিফোন সার্ভিস দেয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক বড় বড় দেশের অনেক এলাকায় তেমন কেউ বাস করে না। যেমন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ বা দক্ষিণ আমেরিকা বা কানাডার অনেক দুর্গম জায়গায় তেমন কেউ থাকে না। সেখানে তাই কোন টেলিফোন অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। সেসব জায়গায় প্রচলিত টেলিফোন বার্তা পাঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সহজেই পৃথিবীর যে কোন জায়গায় টেলিফোন বার্তা পাঠানো যায়। সেই সব জায়গায় কিছু পাবলিক ফোনবুথ থাকে যেগুলোর সাথে স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের সংযোগ থাকে। এই পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক টেলিফোন কলগুলো পাঠিয়ে দেয় স্যাটেলাইট আর্থ স্টেশনে। সেখান থেকে সেই কল চলে যায় স্যাটেলাইটে। স্যাটেলাইট সেই কল রিসিভ করে ডাউনলিংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় সুনির্দিষ্ট স্যাটেলাইটে যেখান থেকে সেই কল চলে যাবে সেই স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশনে। সেই গ্রাউন্ড স্টেশন সেই কল পাঠিয়ে দেবে নির্দিষ্ট পাবলিক বুথে।

 

স্যাটেলাইট ডিজাস্টার রিকভারি: প্রাকৃতিক বা অন্য কোন ভয়ংকর দুর্যোগের সময় যখন স্বাভাবিক সব বার্তা যোগাযোগের মাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন সংযোগ বন্ধ হয়ে যায় - তখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সেই জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন সংযোগ ইত্যাদি চালু করা যায়।

 

আবহাওয়া স্যাটেলাইট 

আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলো কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের চেয়ে ভিন্ন। এদের উদ্দেশ্য ভিন্ন, তাই এদের পে-লোডও ভিন্ন। আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলোতে থাকে রেডিওমিটার। রেডিওমিটারের মাধ্যমে স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীকে স্ক্যান করতে থাকে এবং সেখান থেকে সংগৃহীত ডাটাগুলো ছবির রূপ নেয়। পে-লোডে আরও থাকে রেডিওমিটারকে সহায়তা করার জন্য উপযুক্ত অ্যান্টেনা, স্ক্যানিং সিস্টেম, টেলিস্কোপ, ডিটেক্টর ইত্যাদি। এই টেলস্কোপিক ডিটেক্টরগুলো স্বাভাবিক আলোতে তো কাজ করেই, অবলোহিত কিংবা মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশানও শনাক্ত করতে পারে। তাই দিন রাত যে কোন সময় পৃথিবীকে স্ক্যান করতে কোন অসুবিধা হয় না এই স্যাটেলাইটগুলোর। পে-লোড যে তথ্য সংগ্রহ করে তা ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল থেকে ডিজিটাল সিগনালে রূপান্তরিত হয়ে স্যাটেলাইটের সংশ্লিষ্ট গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যায়। সেখান থেকে তথ্যগুলো চলে যায় পৃথিবীর বিভিন্ন আবহাওয়া দপ্তরে এবং ইন্টারনেটে তাদের ওয়েবসাইটে।

 

চিত্র ৫৬: আবহাওয়া স্যাটেলাইট

 

আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলো জিওস্টেশনারি অরবিটেও থাকতে পারে, আবার পোলার অরবিটেও থাকতে পারে। জিওস্টেশনারি অপারেশনাল এনভাইরনমেন্টাল স্যাটেলাইট (GOES) পশ্চিম গোলার্ধের অনেকটাই কভার করে। জিওস্টেশনারি অরবিটের আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলোকে যেহেতু অনেক দূর থেকে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করতে হয় - তাদের টেলিস্কোপের ক্ষমতা হতে হয় অনেক বেশি। এগুলো থেকে পৃথিবীর মাত্র কিছু অংশে নজর রাখা যায়। এদের স্ক্যানিং থেকে যে ছবি পাওয়া যায় তাদের পরিস্ফূটন ক্ষমতা (রেজ্যুলেশান) খুব ভালো হয় না। সাধারণ এক কিলোমিটারের চেয়ে ছোট জায়গার ছবি এরা তৈরি করতে পারে না।

          পোলার অরবিটের আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলোর ক্ষমতা অনেক বেশি। এগুলো পৃথিবীর খুব কাছে থেকে (৮০০ কিমি) পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকে প্রচন্ড বেগে। এগুলো প্রতি ১০০ মিনিটে পৃথিবীকে একবার উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুর দিকে প্রদক্ষিণ করে। মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে এরা মেঘের ভেতরের তাপমাত্রা, জলীয়বাষ্প, গতি ইত্যাদি পরিমাপ করে আবহাওয়া, ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস নিখুঁতভাবে দিতে পারে। এরা সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাপতে পারে, সমুদ্রের উপরিতলে বায়ুপ্রবাহের গতি ও তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিতে পারে। ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের চোখের ওপর নজর রাখতে পারে সারাক্ষণ। সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসযোগ্য পূর্বাভাসের কারণে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।

 

মহাকাশের আবর্জনা

মহাকাশে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য আবর্জনা। এই মহাকাশ-আবর্জনাগুলো মূলত মহাকাশে মানুষের পাঠানো স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ। যে রকেটগুলোতে করে স্যাটেলাইট পাঠানো হয় - সেই রকেটের শুধুমাত্র নিচের অংশটা পৃথিবীতে ফিরে আসে, কিংবা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু রকেটের দ্বিতীয় অংশ যেটা স্যাটেলাইটকে ট্রান্সফার অরবিটে পৌঁছে দেয় - সেই অংশগুলো মহাকাশে ওজনহীন অবস্থায় ভাসতে থাকে।

 

চিত্র ৫৭: মহাকাশের আবর্জনা

 

তারপর যে স্যাটেলাইটগুলো ঠিকমত কক্ষপথে পৌঁছাতে পারে না তারাও সেখানে ঘুরতে থাকে। মহাকাশে স্যাটেলাইটের মধ্যে সংঘর্ষ হলে যেসব ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয় সেগুলোও সেখানে ভাসতে থাকে। যে স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর চারপাশে বছরের পর বছর ধরে অনবরত ঘুরছে তাদের গা থেকে প্রায়ই খসে পড়ছে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদার্থ - হতে পারে রঙের আস্তরণ, সোলার সেলের আবরণ ইত্যাদি। হিসেব করে দেখা গেছে মহাকাশে প্রায় এক কোটির মতো ধাতব আবর্জনা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগেরই আকার আধ-ইঞ্চির চেয়েও ছোট। এই যে অসংখ্য ছোট ছোট আবর্জনা ঘুরে বেড়াচ্ছে স্যাটেলাইটের কক্ষপথের কাছাকাছি - সেগুলো স্যাটেলাইটের গায়ে লেগে - বিশেষ করে সেন্সরগুলোতে, বা টেলিস্কোপে লেগে গিয়ে তাদের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে পারে।

          লো আর্থ অরবিটের স্যাটেলাইটগুলোকে আরো বড় বড় আকারের ধাতব আবর্জনার সাথে সংঘর্ষের ঝুঁকিতে থাকতে হয়। এই অরবিটের স্যাটেলাইটগুলোর গতি জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের চেয়ে অনেক বেশি। বড় বড় ধাতব টুকরোগুলোও প্রায় একই বেগে ঘুরে। এগুলোর সাথে স্যাটেলাইটের সংঘর্ষ হলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে স্যাটেলাইটের।

          মাঝে মাঝে দুটো স্যাটেলাইটের মধ্যেও প্রচন্ড সংঘর্ষ ঘটতে পারে। ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ইরিডিয়াম-৩৩ ও কসমস-২২৫১ স্যাটেলাইট দুটোর মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। সাইবেরিয়ার ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭৯০ কিলোমিটার উপরে এই সংঘর্ষ ঘটেছিল। সংঘর্ষের সময় এই স্যাটেলাইট দুটোর গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ৪২ হাজার কিলোমিটার। এই সংঘর্ষের ফলে প্রায় ২১৪০টি ধাতব খন্ড মহাকাশের আবর্জনায় যুক্ত হয়। আমেরিকার স্পেস সার্ভেইলেন্স নেটওয়ার্ক এই আবর্জনাগুলোর অবস্থান ও গতির দিকে নজর রাখছে। দেখা যাচ্ছে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন করতে পারলেই সেটা সারাজীবন কাজ করতে থাকবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।


স্যাটেলাইটের মৃত্যু 

কোন ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলেও নির্দিষ্ট সময় পরে স্যাটেলাইটগুলোর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।  স্যাটেলাইটগুলোর জীবনকাল মূলত নির্ভর করে তারা কোন কক্ষপথে থাকে তার উপর।

 

জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইটগুলোর জীবনকাল সাধারণত ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এই জীবনকাল মূলত নির্ভর করে স্যাটেলাইটের থ্রাস্টারের জন্য জ্বালানির পরিমাণ, রিচার্জ্যাবল ব্যাটারিগুলোর জীবনকাল এবং সোলার প্যানেলের সোলার সেলগুলোর কার্যকারিতার উপর।

          কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে এবং স্যাটেলাইটের সব যন্ত্রপাতি ঠিক থাকলে জিও স্যাটেলাইটগুলোর ব্যাটারি ও সোলার সেল গড়ে ১৫ বছর ধরে কাজ করে। সেই হিসেব করে স্টেশন কিপিং-এর থ্রাস্টারগুলোর জন্য তরল জ্বালানি ভরে দেয়া থাকে স্যাটেলাইটের ফুয়েল ট্যাংকে। থ্রাস্টারগুলো ব্যবহার করতে করতে এই ফুয়েল ক্রমশ কমতে থাকে। শেষ পর্যায়ে কিছু জ্বালানি অবশিষ্ট থাকতে থাকতে স্যাটেলাইটকে সার্ভিস থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

          এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে এত দূরে থাকে যে সার্ভিস শেষে এগুলোকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যায় না। আর কক্ষপথের জায়গা যেহেতু সীমিত সেহেতু সেখানে একটি অকার্যকর স্যাটেলাইট বসিয়ে রাখাও যায় না। তাই এই স্যাটেলাইটগুলোকে তখন শেষ জ্বালানিটুকু ব্যবহার করে থ্রাস্টারের মাধ্যমে জিও-স্টেশনারি অরবিট থেকে ঠেলে আরো উপরের দিকে সুপার-সিঙ্ক্রোনাস অরবিটে তুলে দেয়া হয়। এখানে স্যাটেলাইটগুলো থাকে কোটি কোটি বছর।

          কিন্তু যদি এই অরবিটে ঠেলে দেয়ার মত যথেষ্ট জ্বালানি অবশিষ্ট না থাকে, কিংবা ঠেলে দেয়ার আগেই তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় - তাহলে অকার্যকর এই স্যাটেলাইটগুলো আস্তে আস্তে সরতে সরতে কক্ষপথ থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উপরে উঠে স্ট্যাবল ইকুইলিব্রিয়াম পয়েন্টে চলে যায়। দ্রাঘিমাংশের ১০৫ পশ্চিম এবং ২৮৫ পশ্চিম বিন্দুতে এই ইকুইলিব্রিয়াম পয়েন্ট দুটোকে বলা হয় স্যাটেলাইটের কবরস্থান।

 

মিডল আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইটগুলো জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের তুলনায় পৃথিবীর অনেক কাছে থাকে বলে পুরো পৃথিবীকে স্যাটেলাইট সেবার আওতায় নিয়ে আসার জন্য ৮ থেকে ১৮টি স্যাটেলাইটের গুচ্ছ তৈরি করা হয় যারা একত্রে কাজ করে। এই স্যাটেলাইটগুলোও আবহাওয়ামন্ডল থেকে অনেক উপরে থাকে বলে বাতাসের বেগ নিয়ে কোন সমস্যা হয় না, এবং পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানও তত তীব্র নয়। ফলে মোটামুটি ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত জীবনকাল পায় এই স্যাটেলাইটগুলো।

          জীবনকাল শেষে এই স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে অনেক বেগ পেতে হয়। এই কক্ষপথ জিওস্টেশনারি কক্ষপথের মত অত উপরে নয়, ফলে সহজে এই স্যাটেলাইটগুলোকে সুপার সিঙ্ক্রোনাস অরবিটে ঠেলে দেয়া সহজ নয়। আবার এগুলো পৃথিবীর তত কাছেও থাকে না যে সহজে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ভেতর নিয়ে এসে ধ্বংস করে ফেলা যাবে। তাই এই স্যাটেলাইটগুলোকে জীবনকাল শেষে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য তরল জ্বালানির কমপক্ষে ৪০% রেখে দিতে হয়। এই জ্বালানি খরচ করে জীবনকাল শেষে এগুলোকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নিয়ে এসে সমুদ্রে ফেলা হয়। পরে সেখান থেকে সেটাকে উদ্ধার করে রিসাইকেল করা হয়।

 

লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর খুব কাছাকাছি থাকে বলে পুরো পৃথিবীকে সারাক্ষণ স্যাটেলাইটের সেবার আওতায় রাখতে হলে ৪৮ থেকে ৭০টি এধরনের স্যাটেলাইটের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে গুচ্ছ তৈরি করতে হয়। এই কক্ষপথে স্যাটেলাইটগুলোকে অনেক বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয় স্টেশন কিপিং-এ। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কাছাকাছি হওয়াতে তার একটা তীব্র টান তো আছেই, তার ওপর আছে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান। পৃথিবী পৃষ্ঠের ৫০০ থেকে ১২০০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকে বলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ও মাধ্যাকর্ষণ বল স্যাটেলাইটগুলোকে পৃথিবীর দিকে টেনে কক্ষপথ থেকে বের করে দিতে চায়। ফলে স্টেশন কিপিং-এ প্রচুর জ্বালানি খরচ হয়ে যায়। তাই লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটগুলোর জীবনকাল হয় মাত্র ৫ থেকে ১০ বছর। জীবনকাল শেষে এই স্যাটেলাইটগুলোকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে খুব বেশি জ্বালানি খরচ হয় না। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার সময় এগুলোর বেশিরভাগ অংশই পুড়ে যায়। বাকিটা সমুদ্রে ফেলে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় ধ্বংসাবশেষ।


ভবিষ্যতের স্যাটেলাইট

বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশানের আধুনিকায়ন ঘটেই চলেছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমশ স্যাটেলাইটনির্ভর হয়ে উঠছে। স্যাটেলাইট সিস্টেম এবং গ্রাউন্ড সিস্টেম উভয় ক্ষেত্রেই কারিগরী দক্ষতা বাড়ছে। স্যাটেলাইট ব্যবহারের ক্ষেত্র বৃদ্ধির সাথে সাথে স্যাটেলাইটের খরচ কমানোর দিকেও মনযোগ দেয়া হচ্ছে। স্যাটেলাইট পে-লোডের অপটিক্যাল সেন্সর, অডিও সেন্সর, র‍্যাডার, ইনফ্রারেড সেন্সর, আলট্রা-ভায়োলেট সেন্সর, টেলিকমিউনিকেশান সিস্টেম ক্রমশ উন্নত হচ্ছে। স্যাটেলাইট 'বাস'-এর উন্নতি হচ্ছে সলিড স্টেট ডিজাইন এবং সোলার সেল টেকনোলজির ক্রমাগত উন্নতির ফলে। ফুয়েল টেকনোলজির উন্নতির সাথে সাথে ব্যাটারি ও তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারও উন্নতি হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে স্যাটেলাইটের জীবনকাল এবং ক্ষমতা আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতে স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথে অবস্থানকালে মহাকাশ স্টেশন থেকে রোবটের মাধ্যমে স্টেশন কিপিং-এর জন্য জ্বালানি সরবরাহ করার চেষ্টা চলছে। সেটা করতে পারলে কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলোর জীবনকাল অনেক বেড়ে যাবে এবং স্যাটেলাইটের বাৎসরিক খরচ অনেক কমে যাবে।


তথ্যসূত্র 

1.         C. Robert Welti, Satellite Basics for Everyone,   iUniverse, Bloomington, 2012.

2.         Scott L. Montgomery, Moon A tribute to Earth's nearest neighbour, The Five Mile Press, Sydney, 2009.

3.         Joseph N. Pelton, Satellite Communications, Springer,    New York, 2012.

4.         Peter Bond, Space Recognition Guide, Colins, London,   2008.

5.      Joseph N. Pelton, Scott Mardy, Sergio Camacho-Lara   (ed), Handbook of Satellite Applications, 2nd Edition Springer, Switzerland, 2017.

6.         Robert M. Gagliardi, Satellite Communications, 2nd   Edition, Van Nostrand Reinhold, New York, 1991. 

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts