Sunday, 17 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ২৩


 
রামনের ছাত্রীরা

রামন যেই সময়ে এবং সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছিলেন সেখানে নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করা হলেও নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল মূলত গৃহকর্মে সুনিপুণা হওয়া। রামনের বাবা একটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন, কিন্তু রামনের মা তেমন লেখাপড়া জানতেন না। রামনের ভাইয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু বোনেরা কেউই তেমন লেখাপড়া করেননি। রামনের ভাই-বোনের ছেলেরা সবাই উচ্চশিক্ষার শেষ ধাপ অতিক্রম করেছেন, বেশিরভাগই বিজ্ঞানী। রামনের ভাইয়ের ছেলে সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, বোনের ছেলে রামশেসন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ডিরেক্টর ছিলেন, কিন্তু ভাই-বোনের মেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেননি। তেরো বছর বয়সী লোকসুন্দরীকে রামন বিয়ে করেছিলেন নিজের পছন্দে। কিন্তু তারপর লোকসুন্দরীকে লেখাপড়া করানোর কথা মনেও হয়নি রামনের। ১৯৩৩ সালে তিনি যখন ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর পদে যোগ দিলেন - তখন কিন্তু ঐ ইন্সটিটিউটে একজনও ছাত্রী ছিলেন না। সায়েন্স ইন্সটিটিউটে ছাত্রী ভর্তির ব্যাপারে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। অথচ রামন ইওরোপে গিয়ে মেরি কুরি  ও তাঁর মেয়ে আইরিন কুরির সাথে দেখা করেছেন। তাঁদের বৈজ্ঞানিক মেধা, চেষ্টা ও সাফল্যের প্রশংসা করেছেন। নিজের দেশের মানুষের ভেতর বৈজ্ঞানিক-সত্ত্বা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেখানে মেয়েদের কোন স্থান ছিল না। রামন ছেলে-মেয়েদের এক প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেখানোর বিরোধী ছিলেন।
            কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতীয় মেয়েদের কেউ কেউ এই প্রথা ভাঙতে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথমে যিনি ছিলেন তাঁর নাম কমলা সোহোনি। ১৯১১ সালে জন্ম কমলার। বোম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে বিএসসি পাস করে তিনি ব্যাঙ্গালোরের ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হতে চাইলেন মাস্টার্স করার জন্য ১৯৩৩ সালে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট তাঁকে ভর্তির অনুমতি দিলো না। তখন তিনি ডিরেক্টরের কাছে দরখাস্ত করলেন। রামন তখন সবে যোগ দিয়েছেন। তিনি দেখলেন ইন্সটিটিউটে ছাত্রী ভর্তির নিয়ম নেই। কিন্তু কমলা সোহোনি দমে যাবার পাত্রী নন। তিনি বোম্বে থেকে ব্যাঙ্গালোরে এসে রামনের অফিসের সামনে সত্যাগ্রহ শুরু করলেন। ভর্তির অনুমতির জন্য তিনি রামনের অফিসের সামনে বসে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত রামন কমলা সোহোনিকে ইন্সটিটিউটে ভর্তির অনুমতি দিলেন। ১৯৩৬ সালে কমলা সোহিনি কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স পাস করে কেমব্রিজে গিয়ে পিএইচডি করে দেশে ফিরে এসে ভারতের অন্যতম সেরা বায়োকেমিস্ট হয়েছিলেন। কমলা সোহোনি ছিলেন ভারত-বর্ষের প্রথম নারী যিনি বিজ্ঞানে ডক্টরেট করেছিলেন।
            ক্রমে রামন নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু নারী-পুরুষ একই সাথে পড়াশোনা করবেন, গবেষণা করবেন এটা তিনি কখনোই সমর্থন করেননি। তিনি মাত্র তিনজন ছাত্রীকে নিজের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করতে অনুমতি দিয়েছিলেন।
            প্রথম ছাত্রী ছিলেন ললিতা দোরাইস্বামী। ললিতা মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাস করে একটা স্কুলের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি রামনের সাথে গবেষণার জন্য ব্যাঙ্গালোরে আসেন। মাত্র কয়েকমাস কাজ করেছিলেন তিনি। তারপর তাঁর বিয়ে হয়ে যায় বিজ্ঞানী সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের সাথে। তারপর ললিতা আমেরিকা চলে যান স্বামীর সাথে। তাঁর পড়ালেখা এবং গবেষণার সেখানেই ইতি। চন্দ্রশেখর আর ললিতা মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসমেট ছিলেন। চন্দ্রশেখর পরে নোবেল পুরষ্কার পান, আর ললিতা তাঁর স্ত্রী পরিচয়েই কাটিয়ে দেন সারাজীবন।
            ১৯৩৯ সালে রামনের দ্বিতীয় ছাত্রী হিসেবে আসেন সুনন্দা বাই। খুব ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল সুনন্দার। কিন্তু বিয়ের পরেও তিনি লেখাপড়া থামাননি। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করে তিনি আসেন রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার জন্য। ১৯৪৫ পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। সেই সময়ের মধ্যে দশটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তিনি। রামন ইফেক্ট ও হীরার দ্যুতির ওপর তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের প্রসিডিংস-এ। ১৯৪৫ সালে তিনি পিএইচডি থিসিস জমা দেন। কিছুদিন পরেই তাঁর সুইডেনে চলে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে তিনি পোস্টডক্টরেট করার জন্য স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। কিন্তু সুইডেন যাবার কিছুদিন আগে তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর আত্মহত্যার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে এটুকু জানা গেছে যে রামন বা ইন্সটিটিউটের সাথে তাঁর আত্মহত্যার কোন সম্পর্ক ছিল না।
            সুনন্দা বাইয়ের যোগদানের এক বছর পর ১৯৪০ সালে রামনের ছাত্রী হিসেবে যোগ দেন আন্না মণি। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত তিনি রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করেন। হীরার আলো সম্পর্কিত তাঁর পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এই পাঁচ বছরে। আন্না মণি ও সুনন্দা বাই এক সাথে কাজ করতেন। গবেষণাগারের অন্য কোন পুরুষ গবেষকের সাথে কাজ করার বা কাজ নিয়ে আলোচনা করারও অনুমতি ছিল না তাঁদের। রামন তাঁর ইন্সটিটিউটে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে কোন ধরনের বাক্যালাপ পছন্দ করতেন না। রামনের গবেষক ছাত্রদের প্রায় সবাই ছিলেন বিবাহিত। তাঁদের স্ত্রীরাও ক্যাম্পাসে এসে স্বামীর সাথে কথাবার্তা বলতে পারতেন না।


কমলা সোহোনি, আন্না মণি, ও ললিতা চন্দ্রশেখর



আন্না মণি পিএইচডি গবেষণা শেষ করে থিসিস জমা দিয়েছিলেন মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি তাঁর থিসিস গ্রহণ করেননি। কারণ আন্না মণির মাস্টার্স ডিগ্রি ছিল না। আন্না মণি আটটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন তাঁর গবেষণার উপর। তাই পিএইচডি ডিগ্রি না পেলেও তিনি স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ড চলে যান। সেখানে তিনি মেটিওরলজি বা আবহাওয়াবিদ্যায় ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণা করে পরে ইন্ডিয়ান আবহাওয়া অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর হয়েছিলেন।
            সুনন্দা বাইয়ের আত্মহত্যার পর রামন আর কখনো কোন ছাত্রীকে তাঁর সাথে গবেষণা করার সুযোগ দেননি। তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটেও তিনি বেঁচে থাকতে কোন ছাত্রী ছিল না।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts