Tuesday 29 September 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৪৯

 49

“দাদা, এটা কোন্‌ জায়গা?”

বাসের মাঝখানের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে একটু ঝুঁকে বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন শংকর স্যার। আমি যথাসম্ভব সিরিয়াসভঙ্গিতে বললাম, “হু কুইন্‌’স হ্যাট।”

“কী?” – শংকর স্যার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।

“এই জায়গার নাম হু কুইন’স হ্যাট” – একটুও না হেসে আমি আবার বললাম।

পাশাপাশি ডানদিকের সারিতে বসেছেন ইন্তেখাব স্যার। তিনি সিরিয়াস ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তাঁকে ঠাট্টা-তামাশা খুব একটা করতে দেখিনি কখনো। তিনি স্মিত হেসে বললেন, “শংকরদা, এই জায়গার নাম কেরানির হাট। প্রদীপদা ঠাট্টা করছেন আপনার সাথে।“

“আমিও তো তাই বলছি। হু কুইন্‌স হ্যাট। যদিও হাট বলা উচিত ছিল।“ – আমি নিরুত্তাপ গলায় বললাম।

কয়েক সেকেন্ড লাগলো ক্লিক করতে। তারপর হাহা করে হেসে উঠলেন দু’জনেই। আমরা বসেছি বাসের পেছনের দিকে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডের একটা বড় বাস ভাড়া করা হয়েছে আমাদের পিকনিকের জন্য। আমরা পিকনিকে যাচ্ছি অবশেষে। ডিসেম্বরের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ওরফে শান্তিবাহিনীর সাথে সরকারের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছে। জামায়াত-বিএনপি এই চুক্তির বিরুদ্ধে সারাদেশে হরতাল বোমাবাজি জ্বালাও-পোড়াও করেছে অনেক। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের সঙ্গে পুলিশ বিডিআর-এর সংঘর্ষে অনেক হতাহত হয়েছে। এই অবস্থায় বান্দরবানে পিকনিক করতে যাওয়া রিস্কি হতে পারে বলে যাওয়া উচিত কি অনুচিত দোলাচলে ছিলেন অনেকেই। কিন্তু জানুয়ারির শুরুতেই রমজান শুরু হচ্ছে। ঈদের পর কলেজ খুললে পিকনিক করার সময় থাকবে না আর। তাই ডিসেম্বরের শেষের এই শনিবার সকালে আমরা চলেছি। কেরানির হাট থেকে বাম দিকে মোড় নিয়ে বান্দরবান সড়কের মোড়ে থেমেছে আমাদের বাস। সাঈদ স্যার, অঞ্জন স্যার আর ছোলাইমান স্যার বাস থেকে নেমে পাশের দোকানের দিকে গেছেন। কিছু কিনবেন হয়তো।

আমাদের হাসির শব্দ শুনে সামনের দিক থেকে এগিয়ে এলো ইভা।

“অ্যাই প্রদীপ, কী নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছে?”

“না, একটু ইংরেজি অনুবাদের চেষ্টা করছিলাম।“

“লাইক হোয়াট?”

“মাই মাদার মাদার হু কুইন ওয়ার্ক ডাজ।“

“মানে কী?”

“বাংলায় অনুবাদ করলেই বুঝতে পারবে।“

কয়েক সেকেন্ড পরেই সবাই বুঝে গেল ব্যাপারটা।

“আমার মামা কেরানির কাজ করে। হাহাহা। প্রদীপ, টুমি পাড়োও বটে।“ ইভার ইংরেজি টোনে বাংলা উচ্চারণ বেশ মজার। কিন্তু আমি কি আসলেই কিছু পাড়ি? আমার মজার কথার ডিমগুলি যে কোনটাই আমার নিজের পাড়া নয়; তা মনে হয় বলে দেয়া উচিত। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই পূর্ণিমা ম্যাডামের গলা শোনা গেল, “ওগুলি মোটেও প্রকুদেবের কথা নয়। ওগুলি সব দুলাভাইয়ের কথা; উনি নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন।“

পূর্ণিমা ম্যাডামের ভেতর একটা পুলিশ-পুলিশ ভাব আছে। তিনি কোন কিছু ধরতে পারলেই চেঁচিয়ে উঠেন। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বেশ কয়েক মাস আগে কলেজে  ইন্সপেকশান উপলক্ষে ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন মনিষীর বাণী লিখে কলেজের বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে দিতে শুরু করেছে। কলেজের ম্যাগাজিন কমিটির সদস্য হিসেবে তখন রিফাৎ আরা ম্যাডামের সাথে লাইব্রেরিতে বসে দেয়ালিকার জন্য লেখা বাছাই করছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারের কয়েকজন ছেলে এলো আমাদের কাছে মনিষীর বাণী সংগ্রহ করার জন্য। স্বদেশী মনিষীর চেয়ে বিদেশি মনিষীর দাম বরাবরই বেশি। তাই রিফাৎ আরা ম্যাডাম বিদেশী মনিষীর বাণী দিলেন, “তোমরা বিজ্ঞান শিক্ষা করো, বিজ্ঞান উন্নতির সোপান।“

খাতায় লিখে নিয়ে ছাত্ররা জানতে চাইলো, “ম্যাডাম এটা কার বাণী?”

“স্ট্রাইপ” – রিফাৎ আরা ম্যাডাম গম্ভীরভাবে বললেন।

“ম্যাডাম, আরেকটা বলেন, প্লিজ।“

“আরেকটা স্যারের কাছ থেকে নাও।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডাম আমাকে দেখিয়ে দিলেন। ছাত্ররা খাতা খুলে কলম হাতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মহান মনিষীর বাণী পাওয়া গেলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই – “কুসংস্কার দূর করো। কুসংস্কার সভ্যতার পরিপন্থী।“

“এটা কার বাণী স্যার?”

“এটা- এটা ডেভিড ল্যাম্প, নাকি উইলিয়াম ল্যাম্প ম্যাডাম?” – আমি রিফাৎ আরা ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলাম।

“উইলিয়াম ল্যাম্প।“ – ম্যাডাম চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন।

কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ম্যাডামদের কমনরুমের দেয়ালে স্টাইপের বাণী শোভিত হলো। আর উইলিয়াম ল্যাম্পের বাণী দেখা গেলো দোতলার করিডোরের দেয়ালে। ছাত্ররা স্যারদের কমনরুমেও একটি মহান বাণী লাগিয়ে দিলো – ‘যাহার সব কিছুই শিক্ষণীয়, তিনিই শিক্ষক।‘ নিঃসন্দেহে জোরালো বাণী; তবে কতটুকু সত্য তা জানি না। পরিদর্শকরা আমাদের রুমে ঢুকে এই বাণী দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁরা তো সহজে খুশি হন না; বাণী দেখে খুশি হয়েছেন দেখে আমাদেরও বেশ খুশি লাগলো।

তারপর কয়েক মাস কেটে গেলো। একদিন টিফিন আওয়ারে পূর্ণিমা ম্যাডাম হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, “এখনই আসেন। খুব জরুরি দরকার।“

তাঁকে অনুসরণ করে বারান্দা পেরিয়ে দোতলার মেইন করিডোরে এলাম।

“এটা কার বাণী?” – দেয়ালের দিকে আঙুল তুলে রাগী মাস্টারের মত প্রশ্ন করলেন পূর্ণিমা ম্যাডাম।

উইলিয়াম ল্যাম্পের বাণীর দিকে তাকিয়ে আমার মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখা গিয়েছিল হয়তো। তাতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। “তারপর মিস্টার ল্যাম্প, ভেবেছিলেন কেউ বুঝতে পারবে না? আর ওদিকে মিসেস স্ট্রাইপ! ডোরা থেকে স্ট্রাইপ!”

আমার ইচ্ছে করছিলো জিজ্ঞেস করি, স্টাইপের বাণী সামনে নিয়ে এই তিন-চার মাস ধ্যান করার পর বুঝতে পারলেন যে স্ট্রাইপ হলো ডোরা ওরফে রিফাৎ আরা ম্যাডাম? কিন্তু ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম না। আমাদের বাঘ ম্যাডামের বিশেষ প্রশ্রয়ে তাঁর কনিষ্ঠারাও ক্রমশ ব্যাঘ্র হয়ে উঠছেন।

যাই হোক, পূর্ণিমা ম্যাডাম আজ আমাকে অন্যের কথা নিজের নামে চালাতে ধরে ফেলেছেন – এই খুশিতে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে দুলাভাই শুধু তাঁর একার। ইন্তেখাব স্যারের সাথে এখনো দুলাভাইয়ের পরিচয় হয়নি। তাঁকে পরিচয় দিতে হলো।

“রিফাৎ আরা ম্যাডামের হাজবেন্ড। এমন চমৎকার মজার মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না।“

আসলেই তাই। পদার্থবিজ্ঞানীরা খুব খটমটো টাইপের হয় বলে শুনেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুলাভাই পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ হলেও আনন্দের খনি। এমন সেন্স অব হিউমার খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। আজ আমাদের সাথে এলে অনেক মজা হতো। কিন্তু তাঁর অফিসে এখন ট্রেনিং চলছে। তিনি আয়োজক, তাই ছুটির প্রশ্নই উঠে না। মজার কথার কত স্টক যে তাঁর আছে। যে কোন বিষয়েই তিনি মজার কথা বলতে পারেন। একদিন আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এফ ইউ টি ইউ আর ই – উচ্চারণ ফুটারি, না ফাটারি?” আমি অলমোস্ট বলে ফেলেছিলাম ফাটারি।

ইভাকে বললাম, “তুমি তো ইংরেজির মাস্টার, ইন্তেখাব ভাইও আছেন, বলেন দেখি এই লাইনের অর্থ কী – ফিন্ড দি কিন্ট্রি অফ এ গাইভেন কিরকিলি?”

কয়েকবার শোনার পরেও ইভা বুঝতে পারলো না লাইনটা ইংরেজি না অন্যকিছু। পূর্ণিমা ম্যাডাম কিছু বলছেন না। হয়তো তিনি দুলাভাইয়ের এই লাইনটা শোনেননি, কিংবা ধরেই নিয়েছেন আমি যা বলছি সবকিছুই দুলাভাইয়ের কাছ থেকে ধার করা।

শেষে কাগজে লিখে দিতো হলো – Find the centre of a given circle.

“হাহাহাহা”।

হাসতে হাসতে আমরা বান্দরবান যাবার পথের মিলিটারি চেকপোস্ট পার হয়ে গেলাম। তারপর বান্দরবান। শহর থেকে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার দূরত্ব। আসতে লাগলো তিন ঘন্টার বেশি। বান্দরবানে একটা সরকারি রেস্ট হাউজে দুপুরের খাবার, একটু বিশ্রাম। ম্যাডামরা অনেকেই অনেক কিছু রান্না করে নিয়ে এসেছেন। মজার মজার খাবার, হৈ চৈ, ঘরোয়া গান-বাজনা, আর হাসি আনন্দে কেটে গেলো সারাদিন। পর্যটকরা যেখানে যেখানে যায়, সেসব জায়গা ঘুরে সন্ধ্যার আগেই অন দি রোড এগেইন।

বহদ্দার হাট দিয়ে শহরে ঢুকে পাঁচলাইশে রিফাৎ আরা ম্যাডামের বাসার সামনে আমিও নেমে গেলাম তাঁর সাথে। ইদ্রিস ভাই আর মিজান ভাই ম্যাডামের খালি ডেকসি দুটো বাস থেকে নামিয়ে গেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। বড় ক্যাসেট প্লেয়ার নেয়া হয়েছিল ম্যাডামের বাসা থেকে। সেটা আমি হাতে নিলাম। বাস দাঁড়িয়ে আছে ইদ্রিস ভাই আর মিজান ভাইয়ের জন্য। ম্যাডাম বললেন, “ইদ্রিস, মিজান – তোমরা চলে যাও। ওগুলি ওখানে রেখে চলে যাও। বাস দাঁড়িয়ে আছে, দেরি হয়ে যাবে সবার।“

দেখলাম সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন দুলাভাই। মনে হচ্ছে একটু আগেই অফিস থেকে ফিরেছেন।

“কেমন হলো পিকনিক?”

“খুব ভালো হয়েছে দুলাভাই। আপনি গেলে আরো ভালো হতো।“

খালি ডেকসিগুলোর একটা হাতে তুলে নিলাম। খালি ডেকসিই এত ভারী। খাবারভর্তি অবস্থায় ম্যাডাম এগুলি চুলা থেকে নামিয়েছেন কীভাবে কে জানে।

“ওগুলি রেখে দেন ওখানে। দারোয়ান তুলে দেবে। আপনি চলেন, বাসায় চলেন।“ দুলাভাই বললেন।

“আপনি আগে যান দুলাভাই, আমি আসছি আপনার পেছনে।“

“তাহলে তো বিপদে পড়বেন ভাই।“

“কী রকম বিপদ?“

“জানেন না, দুলাভাই আর ফুপার পেছনে গেলে গালি শুনতে হয়?”

“কীভাবে?”

“কেউ পরিচয় জিজ্ঞেস করলে দুলাভাই বলবে – শালা, আর ফুপা বলবে – শালার পুত।“

“হাহাহাহা”

>>>>>>>>>>>>>>>>> 

১৮তম বিসিএস এর ভাইভার ডেট দিয়েছে। আমার ভাইভা ফেব্রুয়ারির শুরুতে – ঈদের ছুটির পরপর। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছিল সাতানব্বইর শুরুতে। ভাইভা হচ্ছে আটানব্বই’র ফেব্রুয়ারিতে। লিখিত পরীক্ষার রেজাল্টের পর মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়ে গেছে রোজার আগে। সিরিয়াসলি পরীক্ষা দেয়া বলতে যা বুঝায় তা আমার এমএসসি পরীক্ষার সাথেই শেষ হয়ে গেছে। শুনেছি অনেকে দিনরাত পড়াশোনা করে বিসিএস পরীক্ষা দেয়। ঢাকায় নাকি বিসিএস কোচিং সেন্টারও চালু হয়েছে। দেখা যাবে অচিরেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমি যখন মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করার হ্যাট্রিক করছিলাম তখন রেটিনা কোচিং সেন্টার সবে উঁকিঝুঁকি মারছিল। তখন কেউ কেউ কোচিং করতো। আর পরের দশ বছরের মধ্যে দেখা গেলো – ভর্তি কোচিং করে না এমন একজনও নেই দেশে। বিসিএস পরীক্ষায় আগে দু’বার ফেল করেছি – সিরিয়াসলি পড়াশোনা করলেই যে মৌখিক পরীক্ষায় পাস করতাম তা বলা যায় না।

ঈদের ছুটির পর কলেজ খোলার আগেই বিসিএস ভাইভা হয়ে গেল। আলাদা করে আর ছুটি নিতে হলো না। ভাইভা দিয়ে বাংলা একাডেমির বইমেলায় গেলাম। রমজান ও ঈদের কারণে এবার বাংলা একাডেমির বইমেলা শুরু হয়েছে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে। আগামী প্রকাশনীতে দেখলাম হুমায়ূন আজাদ নিজেই নিজের বই এগিয়ে দিচ্ছেন পাঠকের হাতে। নিজের বই সম্পর্কে নিজেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। কেমন যেন খটকা লাগে বিখ্যাত ব্যক্তিদের আচরণ দেখলে। হুমায়ুন আহমেদ যেখানে বসেছেন সেখানে লম্বা লাইন। আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর বই কিনে অটোগ্রাফ নিলাম। খুব ছোট ছোট অক্ষরে লেখেন হুমায়ূন আহমেদ।

পরদিন কলেজ খুলবে। রাতের বাসেই চলে আসতে হলো। আমার বাড়িওয়ালা দোতলার বাসা রেডি হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে দোতলায় তুলে দিয়েছেন। নিচের তলা থেকে জায়গা বেড়েছে দুই ফুট, কিন্তু ভাড়া বেড়েছে পাঁচ শ টাকা। বেতনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে বাসা ভাড়ায়।

স্কুল সেকশানে এবার ক্লাস টেনের ফিজিক্স আর ফাইভের গণিত। আর কলেজে আমি যাদের ক্লাসটিচার তারা এবছর পরীক্ষা দেবে। এই সিস্টেমটা ভালো। আমি চুরানব্বইতে ফার্স্ট ইয়ারের যে সেকশানের ক্লাসটিচার হয়েছিলাম -ছিয়ানব্বইতে তাদের পরীক্ষা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাদের ক্লাসটিচার ছিলাম। তারপর সেবছর নতুন ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসটিচার হয়েছি। তারা এবার এইচএসসি দেবে। তারপর নতুন ফার্স্ট ইয়ার এলে তাদের ক্লাসটিচার। আটানব্বইর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হয়ে গেছে। টেস্ট পরীক্ষাতে বারো সাবজেক্টের পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। যারা সব বিষয়ে পাস করেনি তাদের ফরম ফিল আপ করতে দেয়া হচ্ছে না। এসময় অনেক অভিভাবক আসেন তাদের ছেলে-মেয়েদের পক্ষে তদবির করার জন্য। তাদের জন্য খারাপ লাগে, কিন্তু কিছু করার তো উপায় থাকে না। কারণ বোর্ড থেকে নিয়ম করে দেয়া হয়েছে টেস্টে পাস না করলে বোর্ডের পরীক্ষায় বসার সুযোগ না দেয়ার জন্য। এমনও হয়েছে যারা টেস্টে ফেল করেছে তাদেরকে আবার টেস্ট পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। আবারো যারা ফেল করেছে তাদেরকে পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

নাইন-টেনের সাবজেক্টগুলি যাঁরা পড়ান তাঁরা যে ব্যাচকে নাইনে শুরু করেন – তাদেরকে ক্লাস টেনেও পড়ান। এতে পড়ানোর ধারাবাহিকতা থাকে। আমি গতবছর নাইনে ফিজিক্স পড়িয়েছি, এবছর তারা টেনে উঠেছে। তাদের সাথে ক্লাস আমার।

ক্লাস ফাইভের ছেলেমেয়েরা বরাবরই ভালো। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ একসাথে হওয়াতে এরা ঠিক বড় হতে পারছে না এখানে। শুধুমাত্র প্রাইমারি স্কুল হলে ক্লাস ফাইভ হতো সবচেয়ে সিনিয়র। অথচ এখানে তাদের সিনিয়র আছে আরো সাত ক্লাস। তাই তাদের দাপট ক্লাসরুমের বাইরে খুব একটা খাটে না।

“এই ইসে, প্রদীপ, ছেলে তো এবার ক্লাস ফাইভে উঠলো।“ – দোতলায় উঠার সিঁড়ির মুখে শামসুন্নাহার ম্যাডামের সাথে দেখা হতেই হাসিমুখে বললেন তিনি।

“আশিক, শোন, স্যারকে সালাম দাও।“ – ছেলে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলো। মায়ের ডাকে দৌড়ে এলো।

“স্লামালাইকুম স্যার।“

“ঠিক আছে। আশিক, তুমি ক্লাসে যাও।“

আশিক হরিণের মত দৌড়ে চলে গেল।

“একটু দেখে রাখবেন ভাই।“

“অবশ্যই আপা, তা কি আর বলতে হবে?”

শামসুন্নাহার ম্যাডামের দুটো ছেলেই অলরাউন্ডার। সৈকত, আশিক দুজনই লেখাপড়া, গানবাজনা সবকিছুতেই চৌকশ। তবুও মায়ের মন সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় থাকে।

টিচার্স রুমে এখনো “ঈদ মোবারক” আর ঈদের কোলাকুলি চলছে। নতুন বছরের লেখাপড়া শুরু হবার আগে যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষ করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সাঈদ স্যার আর শংকর স্যার অনেক ব্যস্ত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্ল্যানিং নিয়ে। এর মধ্যেই সাঈদ স্যার বললেন, “প্রদীপ, মেয়ে তো এবার তোমার ক্লাসে।“

“তান্নি ক্লাস ফাইভে উঠে গেছে?”

সাঈদ স্যারের মেয়ে তান্নিকে দেখছি ক্লাস টু থেকে। এর মধ্যেই ক্লাস ফাইভে উঠে গেলো? বড় লক্ষ্মী মেয়ে তান্নি। আমার কেন যেন মনে হয় শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা সবসময় ভালো হয়ে থাকার একটা মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। কেয়ার ফ্রি তারা ঠিক মতো হতে পারে না, বিশেষ করে তারা যদি মা-বাবার স্কুলে পড়ে। বাবা-মা ক্লাসে পড়াতে এলে অন্যদের মতো স্যার-ম্যাডাম ডাকতে হয় নিজের বাবা-মাকেও। আর কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তো আছেই। নিজেদের যোগ্যতাতেই তারা ভালো করে। কিন্তু অনেকে মনে করে শিক্ষকের সন্তান হওয়াতে তারা বেশি সুযোগ পায়। অথচ দেখা যায় শিক্ষক মা-বাবা কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকতে গিয়ে অনেক সময় নিজের সন্তানের ছোট ভুলকেও অনেক বড় করে দেখেন। এর উল্টোটাও হয়তো আছে, কিন্তু আমি শাহীন কলেজের শিক্ষকদের দেখেছি নিজেদের ছেলে-মেয়েদের একটুও বাড়তি সুযোগ দেননি কখনো। তবে ইদানীং প্রিন্সিপাল স্যারের ব্যাপারে যা শুনছি তা খুব একটা সুখকর নয়।

ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা শেষ হলো। টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতার কোন চিঠি কি কলেজে আর আসে না? জানি না।

মার্চ থেকে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়ে গেল।

>>>>>>>>>>>>>> 

গতবছর জুড়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার অনেকগুলি ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর শিক্ষার প্রস্পেক্টাস চেয়ে চিঠি লিখেছিলাম। কলেজের পর ব্রিটিশ কাউন্সিল আর পাবলিক লাইব্রেরির রেফারেন্স ঘেঁটে ঘেঁটে বের করেছি বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ঠিকানা। রাত জেগে টাইপ রাইটারে চিঠি টাইপ করেছি। শ’খানেক চিঠি পোস্ট করতেও পুরো মাসের বেতন চলে যায়। কোন নির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। অনেকটা হাতড়ে হাতড়ে পথ খোঁজার মত অবস্থা আমার। প্রোস্পেক্টাস আসতে শুরু করেছে অনেকদিন থেকে। বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লিকেশন ফি চায় পঞ্চাশ ষাট ডলার। অক্সফোর্ডে দরখাস্ত করেছিলাম। ওরা আই-ই-এল-টি-এস দিতে বলেছিল। প্রতিটি ব্যান্ডে গড়ে সেভেন পাওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু আমি পেয়েছি সিক্স পয়েন্ট ফাইভ। অক্সফোর্ডে কিছু হলো না আর। আরো কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত করেছিলাম যেগুলিতে দরখাস্ত করতে কোন ফি লাগে না। দুটো ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাডমিশান অফার পেয়েছি, কিন্তু কোন স্কলারশিপ নেই। টিউশন ফি দিয়ে পড়ার মতো সংগতি আমার নেই। তারপরেও এই চ্যাপ্টারটা বন্ধ করে ফেলছি না কেন সেটাই আশ্চর্যের। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির প্রস্পেক্টাস এসেছিল গত বছরের জুলাইয়ের দিকে। অ্যাপ্লিকেশান ফি পঞ্চাশ ডলার। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। টোফেল আর জি-আর-ই দিয়েছিলাম। তারজন্য আমেরিকান ডলার পাঠাতে হয়েছিল। আগ্রাবাদের সোনালী ব্যাংকের বৈদেশিক শাখা থেকে পঞ্চাশ ষাট ডলারের চেক নিতে কত রকম ফরম যে ফিল আপ করতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম অস্ট্রেলিয়ান ডলারের চেক তারা দেয় না। অস্ট্রেলিয়ান ডলার পাওয়া যাবে কোথায়? একজন বললেন, গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে খোঁজ নিতে।

রাস্তার ঐপাড়ে খুঁজে পাওয়া গেলো এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক। বেশ হাইফাই ব্যাংক। সোনালী ব্যাংকের মতো ভীড় কিংবা হৈ চৈ নেই। রিসেপশানের স্মার্ট তরুণ জানিয়ে দিলেন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট না থাকলে ডলার পাওয়ার উপায় নেই। তাহলে উপায়? অস্ট্রেলিয়ার দরজাও কি বন্ধ হয়ে যাবে? বেরিয়ে আসার জন্য দরজার দিকে যাবার সময় হঠাৎ শুনতে পেলাম, “অ্যাই প্রদীপ, এদিকে এদিকে, টার্ন লেফ্‌ট।“

বামে ফিরতেই দেখলাম – লম্বা কাউন্টারের ভেতরে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে সুরজিৎ বড়ুয়া। চট্টগ্রাম কলেজে আমরা একই সাথে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছি। তারপর সে কমার্স ফ্যাকাল্টিতে। ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে, কিন্তু সেভাবে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। মাস্টার্সের পর গত পাঁচ বছরে একবারও দেখা হয়নি। সে যে আমাকে মনে রেখেছে এটাও তো বেশি। সে এই ব্যাংকে কাজ করছে গত তিন বছর ধরে। আমার অস্ট্রেলিয়ান ডলারের চেকের দায়িত্ব সে নিলো। অ্যাকাউন্ট না থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা দেয়ার নিয়ম নেই। তাই সে তার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে আমার জন্য পঞ্চাশ ডলারের চেক রেডি করে দিলো। আমি টাকাটা তাকে দিয়ে দিলাম। কিন্তু তার উপকারের জন্য আমি তার কাছে চিরঋণী হয়ে রইলাম।

সেই চেকসহ দরখাস্ত পাঠিয়েছিলাম মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে। ডিসেম্বরে একটা কন্ডিশনাল অফার লেটার এসেছে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে। কিন্তু সেখানে লেখা আছে অফারটি যেন আমি এখন গ্রহণ না করি। কারণ আমার স্কলারশিপের কিছু সিদ্ধান্ত এখনো মুলতবি আছে। স্কলারশিপ না পেলে বছরে সাড়ে সতের হাজার ডলার টিউশন ফি জোগাড় করার সাধ্য আমার নেই। তাই ঐ অফারটি আরো তিনটা অফার লেটারের সাথে ফাইলে রেখে দিয়েছি। আজ থেকে বহুবছর পর এগুলি দেখে দেখে হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলবো। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছোট্ট একটা খামে এক পৃষ্ঠার একটা চিঠি এলো মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে। ওরা আমাকে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্স লিডিং টু পিএইচডি গবেষণার জন্য একটা স্কলারশিপ অফার করেছে – মেলবোর্ন রিসার্চ স্কলারশিপ।

Friday 18 September 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৪৮

 48

সকাল দশটা থেকে পরীক্ষা। বলা হয়েছিল ন’টার মধ্যে পৌঁছে যেতে। আমি ন’টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছি নেভি কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপালের অফিসে। এইচএসসি পরীক্ষায় ডিউটি করার জন্য পালাক্রমে আমাদের কলেজ থেকে কয়েকজনকে এই কলেজে আসতে হচ্ছে, আবার এই কলেজ থেকে কয়েকজন আমাদের কলেজে যাচ্ছেন। ভাইস-প্রিন্সিপাল আমাকে বসতে বলে পরীক্ষার খাতা গণনায় মন দিলেন। তাঁকে সাহায্য করছেন এই কলেজের আরো দুজন শিক্ষক। মনে হচ্ছে একটু বেশি আগে চলে এসেছি। সাড়ে ন’টার দিকে এলেও হতো।

নৌবাহিনী কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি হবে না। নেভি অফিসারদের ছেলে-মেয়েদের বেশিরভাগই আমাদের কলেজে পড়ে। আমাদের লেখাপড়ার মান নিশ্চয় এদের চেয়ে ভালো। নইলে নৌবাহিনীর নিজস্ব কলেজ ফেলে কেউ বিমান বাহিনীর কলেজে পড়তে যায়!

“মিস্টার প্রদীপ, আপনাকে আরো তিন দিন আসতে হবে। কোন্‌দিন কোন্‌দিন আসতে হবে – আজ পরীক্ষার পরে যাবার সময় একটু জেনে যাবেন।“

“ঠিক আছে স্যার।“

পরীক্ষা শুরু হবার পনেরো মিনিট আগে হল খুলে দিলেও চলে। এখানে প্রায় বিশ মিনিট আগে হল খুলে দেয়া হলো। পুরনো ধাঁচের একটি বিল্ডিং-এর দোতলার বেশ বড় একটি রুমে আমার ডিউটি। সাথে আছেন নেভি কলেজের আরেকজন শিক্ষক। মোটাসোটা মানুষ হাসিখুশি টাইপ হয় বলে শুনেছি। কিন্তু শোনা কথা যে সবসময় সত্যি হয় না তার প্রমাণ পেলাম। ইনি প্রচন্ড গম্ভীর। এই গাম্ভীর্য সবার জন্য প্রযোজ্য, নাকি সিলেকটিভ বুঝতে পারছি না। ভাইস-প্রিন্সিপালের অফিস থেকে হল পর্যন্ত হেঁটে আসার সময় তাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময় করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাক্য যত ব্যয় হলো, বিনিময় ততো হলো না। অনেক উৎসাহ নিয়ে “আমার নাম প্রদীপ, আমি শাহীন কলেজে ফিজিক্স পড়াই” বলার পর আশা করেছিলাম তিনি তাঁর নাম বলবেন, সাবজেক্ট বলবেন। কিন্তু তাঁর গলা থেকে ‘ঘোঁৎ’ টাইপের একটা শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হলো না। ‘ঘোঁৎ’ নিশ্চয় তাঁর নাম নয়, কিন্তু আপাতত তিনি ‘ঘোঁৎ’ সাহেব।

কেমিস্ট্রি পরীক্ষা। ঘন্টা বাজার পর প্রশ্ন হাতে পেয়েই ছেলেরা লিখতে শুরু করেছে। সিগনেচার ফর্মে সাইন নিতে নিতে অনেকক্ষণ চলে গেলো। ঘোঁৎ সাহেব চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছেন। আমি সিগনেচার ফর্মগুলি টেবিলে রেখে ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।‘ তিনি গম্ভীরভাবে মাথাটা ইষৎ কাৎ করে মৃদুস্বরে ‘ঘোঁৎ’ করলেন।

বেশ বড় বারান্দা। কোমর-সমান দেয়ালের উপর কোন গ্রিল নেই। চারদিক সুনশান। এই রুমটা বিল্ডিং-এর একপাশে। ছাত্রদের টয়লেট এদিকে। টয়লেটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালাম। পাশেই বেশ প্রশস্ত নালা। চট্টগ্রামের নালায় সাধারণত উপচে পড়া ময়লা থাকে। কিন্তু এই নালার পানি ঘোলা হলেও কোন ময়লা ভেসে বেড়াচ্ছে না। টয়লেটে ঢুকলাম। টয়লেট পরিচ্ছন্ন, কিন্তু বাতাস ইউরিয়াসমৃদ্ধ। ইউরিনালের কয়েক ফুট উপরে ভেন্টিলেটারের খোপে চোখ আটকে গেল। একটা মোটা বইয়ের কোণাটুকু বের হয়ে আছে। হাত বাড়াতেই হাতে চলে এলো। উচ্চমাধ্যমিক রসায়ন প্রথম পত্র। টয়লেটে বই রাখার উদ্দেশ্য বোঝার জন্য খুব বেশি ঘিলু লাগে না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই টয়লেটের বিভিন্ন খোপ থেকে যতগুলি কেমিস্ট্রি বই বের হলো তা দিয়ে জলসা সিনেমার সামনের ওভারব্রিজে একটা দোকান দেয়া যায়। পরের কয়েক মিনিটে পাশের নালার পানিতে বেশ কয়েকবার ঝুপ ঝুপ শব্দ হলো। তারপর হাত ধুয়ে নিঃশব্দে রুমে ঢুকলাম। ঘোঁৎ সাহেব এখনো ঘাড় কাৎ করে চেয়ারেই বসে আছেন।

প্রথম ঘন্টা বাজতেই পেছন দিকের বেঞ্চ থেকে একজন হাত তুললো। কাছে যেতেই বললো, “স্যার, টয়লেটে যাবো।“

প্রথম ঘন্টার পর থেকে শেষ ঘন্টা বাজার পনের মিনিট আগপর্যন্ত টয়লেটে যাবার ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই নিষেধ করার প্রশ্নই উঠে না। ছেলেটা চোখেমুখে আনন্দের দীপ্তি নিয়ে গেলেও ফিরে এলো মুখ কালো করে। তারপর একে একে আরো কয়েকজন গেলো আর ফিরে এলো। অন্যদের বুঝতে বাকি রইলো না যে টয়লেটে গিয়ে আর কোন লাভ নেই। কিন্তু তারা সবাই আমার দিকে কঠিন চোখে তাকাতে শুরু করলো। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। পরীক্ষায় নকল করতে না দেবার ‘অপরাধে’ কত শিক্ষককে কে ছাত্রদের হাতে মার খেতে হয় পরীক্ষার সিজনে। এই কলেজে তেমন কিছু হবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই অপরাধীদের বেপরোয়া করে তোলে। ডিফেন্সের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই কুপ্রভাব থেকে মুক্ত।

খাতা জমা দিতে ভাইস-প্রিন্সিপালের অফিসের দিকে যাবার সময় হঠাৎ ঘোঁৎ সাহেব বললেন, “টয়লেট সাফ করে আপনি ফার্স্ট ক্লাস কাজ করেছেন।“

আমি অবাক হয়ে গেলাম তাঁর কথায়। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে তাঁর সঙ্গে আছি। এই প্রথম একটি বাক্য তিনি বললেন। এবং তাতেই বোঝা যাচ্ছে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধ দুটোই প্রবল। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কীভাবে বুঝতে পারলেন?”

তিনি আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। নির্বিকারভাবে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর গলা থেকে শব্দ বের হলো – ঘোঁৎ ঘোঁৎ।

>>>>>>>>>>> 

আজিজুর রহমান স্যারের হাত থেকে বইটা হাতে নিয়ে আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী বলেন? এই দেড় ঘন্টার মধ্যেই আপনি এই বই শেষ করে ফেলেছেন?”

“হ্যাঁ। বইটা ভালো। সত্যেন সেন খুবই চমৎকার লেখেন।“

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। প্রায় তিনশ পৃষ্ঠার বই আলবেরুনি – গত এক সপ্তাহ ধরে আমার সঙ্গে যাতায়াত করছে। শনিবার ক্লাস এইট পর্যন্ত ছুটি থাকে। তাই আজিজুর রহমান স্যারের আজ ক্লাস ছিল না। তিনি আমার কাছ থেকে বইটা নিয়েছিলেন ফার্স্ট পিরিয়ড শুরুর আগে। আর এখন থার্ড পিরিয়ড শেষ করে রুমে ফিরতেই তিনি আমার ডেস্কের সামনে এসে বইটা এগিয়ে দিয়ে বললেন পড়া শেষ। এত দ্রুত কীভাবে পড়ে মানুষ? অবিশ্বাস্য। এক মিনিটে কমপক্ষে দুই পৃষ্ঠা পড়তে হলে তো জাস্ট চোখ বোলানো হবে। এত দ্রুত পড়লে কি খুঁটিনাটি সব মনে থাকবে? কিন্তু বই খুলে অনেক প্রশ্ন করে দেখলাম বইয়ের প্রতিটি শব্দ পড়েছেন তিনি, সমস্ত ঘটনার খুঁটিনাটি তাঁর মনে আছে। দ্রুত পড়ার এই আশ্চর্য ক্ষমতার কারণে আজিজুর রহমান স্যারকে কেমন যেন অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তাঁর সাথে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলো। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপ্তি অনেক বড়।

আমাদের টিচার্স রুমে অনেক বিষয় নিয়েই নিয়মিত চর্চা হয়। সাঈদ স্যার প্রায়ই জীবন সম্পর্কে অনেক দার্শনিক উপদেশ দেন। কিন্তু নিয়মিত জ্ঞানচর্চা বলতে কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে যে ধরনের আলোচনা হবার কথা - সেরকম আলোচনার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। আমাদের শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ছে আস্তে আস্তে। বায়োলজির নতুন স্যার এসেছেন – মোশাব্বের স্যার। ইংরেজির নতুন স্যার – ইন্তেখাব স্যার জয়েন করেছেন। আমার বন্ধু আবুল হোসেন খান কাফ্‌কো স্কুলে চলে গেছে। সে কীভাবে এত নিশ্চিন্ত ছিল তার চাকরির ব্যাপারে তা সে বলেনি। একদিন চুপচাপ চলে গেছে এখান থেকে। যাবার আগে সে যখন বললো, “আমাকে ভুলে যাইয়েন না” – সাঈদ স্যার বলেছিলেন, “মানুষ মানুষকে কখন মনে রাখে জানেন? আপনি যখন কোন মানুষকে খুব কষ্ট দেবেন, তখন সে আপনাকে কোনদিন ভুলবে না। যদি কষ্ট না দেন, তাহলে সে ভুলে যাবে।“ ভেবে দেখলাম – ব্যাপারটা আসলেই ঠিক। আনন্দের কথা আমাদের যতটুকু মনে থাকে, তার চেয়ে বেশি মনে থাকে দুঃখের কথা। মানুষের ভালো ব্যবহার আমাদের মনে থাকে না। কিন্তু কেউ খারাপ ব্যবহার করলে তা আমরা কিছুতেই ভুলি না।

“আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।“ – হাফিজ স্যার কথা বলেন খুব নিচুস্বরে। ফিরে তাকালাম তাঁর দিকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালায় মুখ বাড়িয়ে ইশারা করছেন বাইরে যাবার জন্য। নিশ্চয় এমন কোন কথা যা সবার সামনে বলতে চাচ্ছেন না। বাইরে বের হয়ে একটু সামনে নিয়ে গিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কি আপনার কিছু হয়েছে?”

“কেন? আপনি কি কিছু শুনেছেন?”

“প্রিন্সিপাল স্যার বলছিলেন আপনার সম্পর্কে।“

“কী বলছিলেন?”

“বলছিলেন – পাগলরাও নিজের ভালোটা বোঝে। আপনি নাকি সেটাও বোঝেন না।“

“হা হা হা”

“আপনি হাসছেন? কী হয়েছে?”

“আগে বলেন, তিনি আপনাকে কেন আমার সম্পর্কে বলেছেন?”

“আমাকে ঢাকা পাঠাচ্ছেন ডিজি অফিসে। এমপিও-র কাজে।“

“যান। এবার আপনি যান। ঘুষ দিয়ে আসেন। টাকা দেখে নিয়ে যাবেন, যেন ছেঁড়া না থাকে। ওখানে ছেঁড়ানোট বদলে দিতে বলে।“

প্রিন্সিপাল স্যার খুবই ধুরন্ধর মানুষ। যাদেরকে একটু সহজ-সরল টাইপের বলে মনে করছেন, তাদেরকে নিজের দলে টানার চেষ্টা করছেন। ডিজি অফিস থেকে ফিরে এসে আমি তাঁকে সরাসরি বলেছি যে আমার হাত দিয়ে ঘুষ পাঠানোর ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। তিনি কিছুই বলেননি। এখন হাফিজ স্যারকে ধরেছেন। কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি চলছে। ভর্তি ফর্ম দেয়া হচ্ছে। ৬৫০ এর কম পেয়েছে এমন কাউকে ফর্ম দেয়া হচ্ছে না। কিছু কিছু অভিভাবক আছেন যাঁরা মনে করেন টাকা পয়সা দিলে যে কোন নিয়মই ভাঙা যায়। শোনা যাচ্ছে সেরকম অভিভাবকরা নাকি একজন শিক্ষকের মাধ্যমে প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে যোগাযোগ করছেন। এসব শুনে লজ্জা লাগে আমার। একজন মুক্তিযোদ্ধা কেন এরকম হবেন?

>>>>>>>>>> 

“নওশীন শারফুদ্দিন, তুমি কি শারমিন শারফুদ্দিনের বোন?”

টেবিলের উপর ক্লাসটেস্টের খাতাগুলি রেখে আমার দিকে তাকালো নওশীন। তাদের ক্লাস টেস্ট নিয়েছি আজ। ক্লাসটেস্টের খাতাগুলি অনেক মোটা মোটা। অতগুলি খাতা একা মৌসুমী রিজিয়ার পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। নওশীনও এসেছে মৌসুমীর সাথে বেশ কিছু খাতা নিয়ে।

“জ্বি স্যার। শারমিন শারফুদ্দিন নওশীন শারফুদ্দিনের বোন। কিন্তু স্যার নওশীন শারফুদ্দিন নিজের পরিচয়ে পরিচিত।“

নওশীনের পাশে দাঁড়িয়ে মৌসুমী চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে নওশীনের মুখের দিকে। আমি নওশীনের আত্মবিশ্বাস আর শব্দচয়নে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আসলেই তো, তার বোনের পরিচয়ে তাকে চিনবো কেন?

“অবশ্যই। তোমাকে সবাই তোমার নিজের পরিচয়েই চিনবে নওশীন। তুমি কার কে সেটা আসবে পরে। ভেরি গুড।“

মৌসুমী আর নওশীন বের হয়ে গেল। বারান্দায় তাদের আরো দুজন বন্ধু ক্রিস্টিন আর সাদিয়া অপেক্ষা করছিলো তাদের জন্য। চারজন এক সাথে প্রায় দৌড়ে চলে গেল ক্লাসের দিকে।

এবার ক্লাস ফাইভের ব্যাচটা তুখোড়। বিশেষ করে প্রথম মেয়াদী পরীক্ষার পর যখন দুই সেকশানের সবচেয়ে ভালোগুলিকে এক সেকশানে নিয়ে আসা হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য, তখন তাদের ক্লাস নিতে গিয়ে আমি সত্যি অবাক হয়ে যাই। এদের মেধা আর নিষ্ঠা দুটোই প্রচুর পরিমাণে আছে। অংক করাতে গিয়ে মনে হয় এরা সবাই একশ’র মধ্যে একশ’ পাবে। তাদের ক্লাস টেস্টের খাতা দেখতে আমার খুব একটা সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রায় সবার অংকই নির্ভুল।

“স্যার, আপনাকে ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডাকছেন, আর্জেন্ট।“ – পিয়ন ইদ্রিস এসে খবর দিলেন।

ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডেকেছেন মানেই হলো জরুরি কিছু। সেখানে আর্জেন্ট – মানে কী সাংঘাতিক বিষয় অপেক্ষা করছে কে জানে। এর আগে একবার আমাকে জরুরি ভিত্তিতে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। তার দু’দিন আগে বিজ্ঞানমেলা হয়েছিল নেভি কলেজে। আমাদের স্কুলের ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে গিয়েছিল। কিছু পুরষ্কারও পেয়েছিল। কিন্তু তাতে কতৃপক্ষের মন ভরেনি। একজন সহকর্মী ভাইস-প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, “প্রদীপ যদি একটু সিরিয়াস হতো তাহলে আমরা আরো অনেক ভালো করতে পারতাম।“ সেদিন আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে এনে সিরিয়াস বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল সেই সহকর্মীর সামনে। বলাবাহুল্য তাতে আমার শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তারপর থেকে ভাইস-প্রিন্সিপাল ডাকছেন শুনলেই আমার সিরিয়াসলি সিরিয়াসনেস বেড়ে যায়।

“প্রদীপবাবু, এখন তো আপনার কোন ক্লাস নেই।“ – ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কন্ঠ আজ আশ্চর্যরকমের মোলায়েম।

“না ম্যাডাম। কেন?”

“একজন অফিসার আপনার সাথে একটু দেখা করতে চান। মোস্তাফিজ সাহেব। আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি বলেছি আপনি ফ্রি থাকলে যাবেন। তিনি গাড়ি পাঠাচ্ছেন।“

“ওকে ম্যাডাম।“

“ইদ্রিস, নিচে দেখো, প্রদীপ স্যারের জন্য গাড়ি এলে স্যারকে খবর দিও।“

হঠাৎ এরকম মোলায়েমত্ব অস্বাভাবিক লাগছে। রুম থেকে বের হয়ে এলাম। প্রায় দৌঁড়ে প্রিন্সিপাল স্যারের রুম পার হবার সময় দেখলাম রুম বন্ধ। প্রিন্সিপাল স্যারকে ইদানীং আমি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি। ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে প্রিন্সিপাল স্যারের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত কেউ নেই তা আমি হলপ করে বলতে পারবো না।

সিঁড়ির কাছে যেতে না যেতেই দেখলাম ইদ্রিস ভাই ছুটে আসছেন।

“আপনার জন্য গাড়ি এসেছে স্যার।“

বিমানবাহিনীর একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে গাড়িবারান্দায়। উর্দিপরা ড্রাইভার নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। তিনি আমাকে চেনেন না। কিন্তু ইদ্রিস ভাইয়ের কথা তিনি শুনেছেন। আমি কাছে যেতেই সামরিক কায়দায় স্যালুট দিলেন।

জিপ চলছে কলেজের পুরনো বিল্ডিং-এর দিকে। অফিসারের গাড়িতে বসে চেনা পরিবেশকেও অচেনা লাগতে শুরু করেছে। পুরনো কলেজ বিল্ডিং পার হয়ে দুপাশে বিশালাকৃতির শিরিষ গাছের নিচে দিয়ে গিয়ে গাড়ি বামে ঘুরে একটা দোতলা বিল্ডিং-এর সামনে থামলো। গাড়ি থেকে নামতেই একজন লম্বা সুপুরুষ অফিসার এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। “আমি মুস্তাফিজ। সরি আপনাকে কষ্ট দিলাম। আমি নিজেই যেতাম। কিন্তু কলেজে বসে কথা বলার চেয়ে আমার অফিসে বসে অনেক নিরিবিলিতে কথা বলতে পারবো। তাই আপনাকে কষ্ট দিলাম।“

অফিসার এত বেশি ভদ্রতা দেখাচ্ছেন যে আমার কেমন যেন সংকোচ লাগছে। আমাকে কীজন্য ডেকেছেন এখনো জানি না।

তাঁর অফিসটা বেশ বড়, গোছানো সুন্দর। বসার একটু পরেই চা আর সিঙাড়া নিয়ে এলেন একজন। সম্ভবত আগেই বলে রেখেছিলেন।

“আমি কিন্তু এখনো জানি না আমাকে কেন আসতে বলেছেন।“

“আপনার সাথে ফিজিক্স নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। আমার ফিজিক্স সাবজেক্টটা খুবই প্রিয়। একাডেমিক ব্যাপারটাতে কন্টিনিউটি না থাকলে অনেক সময় অনেক সায়েন্টিফিক এডভান্সমেন্টের খবর পাওয়া যায় না।“

এরপর প্রায় এক ঘন্টা সময় কীভাবে কেটে গেল টেরই পেলাম না। আমরা ফিজিক্স নিয়ে কথা বললাম, স্টিফেন হকিং-এর বই ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম নিয়ে কথা বললাম, থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে আমার মাস্টার্সের কাজ নিয়ে কথা বললাম, আমার সুপারভাইজার প্রামাণিক স্যারের প্রসঙ্গেও কথা বললাম। শাহীন কলেজে আমার এই প্রায় চার বছরের কর্মজীবনে উচ্চতর ফিজিক্স গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা করার এরকম সুযোগ আর পাইনি। সুযোগ পেলে এরকম আলোচনা আরো হবে এই আশ্বাস নিয়ে আমাকে আবার গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন তিনি।

গাড়ি থেকে এক লাফে কলেজের সিঁড়িতে উঠে প্রায় লাফাতে লাফাতে দোতলায় উঠতেই হুমায়রা ম্যাডামের সাথে দেখা হয়ে গেল।

“অফিসারের গাড়ি করে এলেন দেখলাম।“

“মোস্তাফিজ সাহেব ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।“

“তাই? উনার মেয়েরা তো আপনার ক্লাসে পড়ে।“

“উনার মেয়ে?”

“চেনেন না? মুশতারি রিজিয়া, মৌসুমী রিজিয়া। একজন ইলেভেনে, একজন ফাইভে।“

“হ্যাঁ চিনি তো।“

হুমায়রা ম্যাডাম চলে গেলেন প্রিন্সিপালের রুমের দিকে। আমি আমাদের রুমে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম - প্রায় ঘন্টাখানেক কথা বললাম মুস্তাফিজ সাহেবের সাথে। অথচ একবারও তিনি বললেন না যে তাঁর দুটি কন্যা আমার ক্লাসে পড়ে। মেয়েরা তাদের নিজেদের যোগ্যতাতেই বড় হবে এই নীতিতে বিশ্বাস করেন বলেই তিনি বলেননি, যেন ব্যক্তিগত পরিচয়ের পক্ষপাতিত্বের ছায়াটুকুও তাদের স্পর্শ করতে না পারে। আহা, সবাই যদি এমন হতো।

Friday 11 September 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৪৭

47

“ইঁয়ান কন্‌অ পিকনিক অইয়ে নে বদ্দা? ইশকুলর পিছন্দি চুলা বানাই রান্ধি খঅন-“ – কৃষি-কাশেম স্যারের  কথা শেষ হবার আগেই সাঈদ স্যার বললেন, “পিকনিক ন অয়?”

সাঈদ স্যার মাঝে মাঝে যখন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি দুটি বাক্য বলতে চেষ্টা করেন – খুব মজা লাগে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শ্রুতিমাধুর্য খুব কম। কিন্তু চট্টগ্রামের বাইরের কেউ যখন শখ করে এই ভাষায় একটা দুটো শব্দ উচ্চারণ করে তখন শব্দগুলি কেমন যেন বদলে যায়; অনেক নরম এবং মিষ্টি হয়ে যায়।

কৃষি-কাশেম স্যারের বক্তব্য হলো- স্কুলের পেছনে চুলা বানিয়ে রান্না করা হচ্ছে, এটা কোন পিকনিক হলো? আমাদের এখন দু’জন কাশেম স্যার। একজন দাদাভাই, অন্যজন নবীন। নবীন কৃষিবিজ্ঞান পড়ান, তাই তাঁর নাম হয়ে গেছে কৃষি-কাশেম। পুরনো বিল্ডিং-এ টিচারদের পিকনিকের আয়োজন চলছে আজ। শনিবার ফোর্থ পিরিয়ডের পর শিক্ষার্থীদের ছুটি হয়ে যায়। এরপর সবাই দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি পুরনো বিল্ডিং-এ। এখানে আয়া-পিয়নরা রান্না-বান্না খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করছে। আমাদের টিচারদের কেউ কেউ গিয়ে দেখে আসছেন আয়োজন। আমরা বসেছি আমাদের আগের টিচার্স রুমে। অনেকদিন পরে এলে পরিচিত জায়গাও কেমন যেন অচেনা মনে হয়। বসে বসে গল্প করা ছাড়া আপাতত আর কোন কাজ নেই। টিচারদের পিকনিক এরকম সাদামাটাভাবে হচ্ছে এটা দেখে অবাক হচ্ছেন যাঁরা নতুন জয়েন করেছেন। কাশেম স্যার জয়েন করেছেন গতবছর। কিন্তু কলেজে তাঁর এটাই প্রথম পিকনিক। ১৯৯৬ সালের শুরুটা এত বেশি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে যে কেউ পিকনিকের কথা চিন্তাও করতে পারেনি। এর আগে আমরা কাপ্তাই ও মেরিন একাডেমিতে পিকনিক করেছি। ১৯৯৭ সালের রাজনৈতিক অবস্থা এখনো শান্ত। জানুয়ারির ২য় সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির  ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত রমজান ও ঈদের ছুটি গেল। এরপর ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা শেষ হতে হতে ফেব্রুয়ারি শেষ। এখন মার্চের প্রথম শনিবারেই আমাদের পিকনিক।

সাঈদ স্যার পিকনিক কমিটির চেয়ারম্যান। কৃষি-কাশেম স্যারের কথাটাকে তিনি বেশ সিরিয়াসলি নিয়েছেন।

“পাঁচ হাজার টাকা বাজেটে এর চেয়ে ভালো পিকনিক আপনি কীভাবে করবেন কাশেম সাহেব? কত জায়গাতেই তো যাবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু টিচাররা তো নিজের পকেট থেকে একটা টাকাও দিতে রাজি নন।“

কলেজের পিকনিক নিয়ে টিচারদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, ময়নামতি – অনেক জায়গার নামই করা হয়েছে। সব জায়গাই পছন্দ টিচারদের। কলেজ ফান্ড থেকে টাকা দিলে যে কোন জায়গাতেই যেতে রাজি, কিন্তু নিজের পকেট থেকে চাঁদা দিতে হলে প্রায় কেউই রাজি নন। তাছাড়া একটিমাত্র ছুটির দিন – শুক্রবার – সেটাও পিকনিকে গিয়ে ‘নষ্ট’ করতে রাজি নন কেউ কেউ। কিন্তু শিক্ষকদের পিকনিক করার জন্য কলেজ ছুটি দেবে – সেরকম ‘মামার বাড়ির আবদার’ এখানে চলে না। অতএব কলেজ ফান্ড থেকে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। তা দিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সব মিলিয়ে প্রায় ষাট জনের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নতুন বিল্ডিং থেকে পুরনো বিল্ডিং-এ এসে আমাদের পিকনিক হচ্ছে – শনিবার ক্লাসের পর।

একটার মধ্যেই খাবার রেডি হয়ে গেল। ক্লাসরুমের বেঞ্চে বসে আমাদের খাওয়া-দাওয়া। হোসনে আরা ম্যাডাম সুনিপুণ হোস্ট। তিনি আমাদের সবাইকে নিজের বাড়ির অতিথি আপ্যায়ন করার মতো করে যত্ন করে খাওয়ালেন। দেড়টার মধ্যে কার্যক্রম শেষ করে আমরা নতুন বিল্ডিং-এ চলে এলাম। প্রিন্সিপাল স্যার এলেন রিকশায় – আর আমরা সবাই হেঁটে। ভরপেট খাবার পর মার্চ মাসের রোদে এতদূর হেঁটে আসা শাস্তিতুল্য।

শনিবারে শিক্ষার্থীদের এগারোটায় ছুটি হয়ে যায়। তারপর কেউই দেড়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে না বাসের জন্য। আজও কোন স্টুডেন্ট নেই। আমরা টিচাররা নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টা করতে করতে শহরে চলে এলাম। স্যার-ম্যাডামদের কথা থেকে বোঝা গেল – কলেজের ব্যাকইয়ার্ডের এই পিকনিকে কারোরই মন ভরেনি। সবাই একমত হলেন যে নেক্সট ইয়ারে অবশ্যই দূরে কোথাও পিকনিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন সবাই মিলে নিজেরা চাঁদা দিয়ে। নেক্সট ইয়ার এলে এই মনোভাব অটুট থাকবে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

বাসার গলিপথে আজ অনেক মানুষ। আমার বাড়িওয়ালা সালাম সাহেব একতলা বাসাকে দোতলা বানাচ্ছেন। আজ ছাদ ঢালাই হচ্ছে। তিনি আমাকে বলে রেখেছেন দোতলা রেডি হলেই আমাকে দোতলায় উঠিয়ে দেবেন। অবশ্য তারজন্য মাসে চারশ’ টাকা বেশি দিতে হবে। দোতলায় উঠার সিঁড়িটা বানানো হয়েছে আমার দরজার সামনে। সেজন্য বাইরের রুমটাও এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। তালা খুলে ভেতরে ঢুকে লাইট-ফ্যান চালু করে দরজাটা বন্ধ করতেই দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌ করে তিনবার টোকা মারলো কেউ। জোরালো ছন্দোবদ্ধ টোকা। কোন এক গোয়েন্দা কাহিনিতে পড়েছিলাম – কীভাবে দরজা নক করছে সেটা দেখেই নাকি বোঝা যায় মানুষটার ব্যক্তিত্ব কেমন হবে। মনে হচ্ছে এই মানুষ তবলা বাজায়, ছন্দ ও তাল সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে। দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌ করা থেকেই বোঝা যাচ্ছে তা। এই বাসায় যারা মাঝে মধ্যে আসে তাদের মধ্যে গান-বাজনা জানে শুধু একজন – অসীম। নিজেকে শার্লক হোম্‌স ভাবতে ভাবতে “কী খবর অসীম” বলে দরজা খুললাম।

“আমি অসীম নই, সসীম।“– বলে লম্বা হাত বাড়িয়ে দিলো আগন্তুক।

আগন্তুকের পরনে খাকি পোশাক। কিছুটা অবাক হয়ে তার হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললাম, “একলা থাকার ইচ্ছা, এ কী অবস্থা তোমার?”

ইউনিভার্সিটিতে আমরা বন্ধুদের নাম নিয়ে অনেক শব্দের খেলা খেলতাম। যেমন বোতলে রাখার জল – বজল, একলা থাকার ইচ্ছা – একলাইছ্যা। আমাদের একলাইছ্যা – এখলাস এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

এরপর ঘন্টাখানেক সময় যেন উড়ে চলে গেল। এইচএসসি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত আমরা এক সাথে লেখাপড়া করেছি। ফতেয়াবাদে মেসেও আমরা একসাথে ছিলাম অনেক দিন। পাস করার পর সে এখন কাফকোতে জয়েন করেছে। গুরুত্বপূর্ণ কোন এক সেকশানের অফিসার। বললো সেখানে পদ পদবি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবাইকে একই পোশাক পরতে হয়। সাধারণত সে বাড়ি থেকেই অফিস করে। আজ শহরে এসেছে জরুরি ভিত্তিতে আমাকে একটা খবর দিতে। কাফকো স্কুল এন্ড কলেজে ফিজিক্সের টিচার নেবে।

“কয়েকদিনের মধ্যেই এডভার্টাইজ করবে তারা। তুমি অবশ্যই এপ্লাই করবা। আমি শিওর তোমার চাকরি হবে সেখানে।“

“আমি যেখানে আছি, ভালোই তো আছি।“

“কাফকোতে সুযোগ সুবিধা কত বেশি জানো? স্টুডেন্ট বেশি নেই, কাজ কম। অথচ এখন যে বেতন পাও – তার চার-পাঁচগুণ বেশি বেতন পাবে।“

“কিন্তু কলেজটার তো নামও শুনিনি তেমন।“

“এখনো তো নতুন। আস্তে আস্তে শুনবে নাম। আমাকে এখন যেতে হবে। বাট আই ওয়ান্ট টু সি ইউ দেয়ার।“

এখলাস এখন অনেক বেশি ইংরেজি বলছে। সম্ভবত বিদেশি কোম্পানিতে ইংরেজিতেই কথাবার্তা বলতে হয় তাকে।

এখলাস চলে গেলো একটু পরেই। এত কষ্ট করে সে আমাকে যে খবরটা দিতে এসেছে আমি সেই খবরে খুব একটা উৎসাহিত হতে পারছি না। শুধুমাত্র বেশি বেতন পাবো এই কারণে চাকরির জন্য দরখাস্ত করবো? কিন্তু সেখানে কি কাজের স্বাধীনতা অনেক বেশি থাকবে? বুঝতে পারছি না। শহর ছেড়ে আনোয়ারায় গিয়ে চাকরি করবো? কিন্তু স্টাফদের জন্য নাকি শহর থেকে বাস যায় অনেকগুলি। জাপান নাকি অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছে এই কর্ণফুলি ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে। মূলত কোম্পানির স্টাফদের ছেলেমেয়েদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে কাফকো স্কুল এন্ড কলেজ। কিছুদিন পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি আমার চোখে পড়েছে। সত্যিই বেশ আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা। দরখাস্ত করলেই যে চাকরি হবে তার তো কোন গ্যারান্টি নেই। আর চাকরি হলেই যে সেখানে যেতে হবে তারও কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ভাবলাম দরখাস্ত একটা করে দেখা যেতে পারে।

>>>>>>>> 

“প্রদীপবাবু, আপনি আমার সাথে দেখা করেন না কেন?”

প্রিন্সিপাল স্যার পিয়ন মিজানকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন একটু আগে। আমি ক্লাস শেষ করে টিচার্স রুমে না গিয়ে প্রিন্সিপালের রুমে এসে ঢুকেছি। প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে দেখেই প্রশ্ন করলেন আমি কেন তাঁর সাথে দেখা করি না। এটা কি ঘটমান বর্তমান? তাঁর সাথে কি আমার প্রতিদিন দেখা করার কথা? কোন দরকার ছাড়া প্রিন্সিপালের সাথে প্রতিদিন দেখা করতে হবে এমন কি কোন নিয়ম জারি হয়েছে?

বললাম, “আপনি ডাকলেই তো আসি স্যার।“

“ডাকতে হবে কেন? আসবেন, কথাবার্তা বলবেন, তবেই না জানাশোনা হবে।“

প্রিন্সিপাল স্যার কী জাতীয় জানাশোনার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না।

“বসেন বসেন। অনেক কথা আছে আপনার সাথে।“

“আমার স্যার এখন আরেকটা ক্লাস আছে।“ – যথাসম্ভব বিনীতভাবে বললাম।

“যাবেন আর কি ক্লাসে। কলেজের ক্লাসে দশ মিনিট পরে গেলেও কোন অসুবিধা নেই।“ – প্রতিষ্ঠানের প্রধানের মুখে এ কী কথা শুনছি!

“আমার স্যার স্কুলে ক্লাস। ক্লাস নাইনে।“

“ক্লাস নাইনে? আমাদের এওসি স্যারের মেয়ে আছে না ক্লাস নাইনে? যান তাহলে তাড়াতাড়ি যান। পরে আমার সাথে দেখা করবেন। আপনার এমপিও হয়নি এখনো।“

প্রিন্সিপালের স্যারের রুম থেকে বের হয়ে ক্লাসে ছুটলাম। ক্লাসে এওসি স্যারের মেয়ে থাকলে ঠিক সময়ে যেতে হবে, নইলে দেরি করে গেলেও চলবে – এটা কোন্‌ ধরনের নীতি? শিক্ষকের কাছে ক্লাসের সব শিক্ষার্থী তো সমান হবার কথা।

আমি গতবছর ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে অনুরোধ করেছিলাম আমাকে ক্লাস নাইনের ফিজিক্স ক্লাস দেয়ার জন্য। তিনি গতবছর ক্লাস নাইনের ত্রিসীমানায় আমাকে যেতে দেননি। এমনকি কোন এডজাস্টমেন্ট ক্লাসেও না। এবছর আমাকে ক্লাস নাইনের ফিজিক্স ক্লাস দেয়া হয়েছে। ক্লাস ফাইভের গণিতও আছে। একই সাথে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও হায়ার-সেকেন্ডারির শিক্ষক হওয়ার মধ্যে বেশ মজা আছে। নিজের পারফরম্যান্সের রেঞ্জ বোঝা যায় তাতে।

ক্লাস শেষে আবার গেলাম প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে। তিনি জানালেন আমাকে ঢাকায় যেতে হবে ডিজি অফিসে। আমিসহ আরো কয়েকজনের এমপিও হয়নি এখনো। আমাদের বেতনের যে অংশ সরকার দেয় সেই অংশ এখনো দেয়া হচ্ছে না। আমাদের পুরো বেতনই দেয়া হচ্ছে শাহীনের তহবিল থেকে। এমপিও হবার পর সরকার আমাদের এতদিনের সব বেতন এক সাথে দিয়ে দেবে। এসব প্রশাসনিক ব্যাপারের কিছুই আমি জানি না। কীভাবে কী করতে হবে তার কিছুই তো আমি জানি না। আমি ঢাকায় গিয়ে কী করবো?

“আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমার লোক আছে সেখানে। আপনি গিয়ে শুধু কাগজপত্রগুলি তার হাতে হাতে দিয়ে আসবেন। সে-ই সব করবে। আগামী সোমবার আপনি যাবেন।“

প্রিন্সিপাল স্যারের কথা শুনে মনে হচ্ছে এ জাতীয় কাজের মতো আনন্দজনক কাজ আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছে – কলেজে এত মানুষ থাকতে আমি কেন? আবার এটাও তো ঠিক – আমার নিজের এমপিও হয়নি বলা হচ্ছে। কিন্তু এমপিও মানে কী?

প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বের হয়ে অফিস রুমে ঢুকলাম। অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাদের সাহেব বিশাল সাইজের খাতা খুলে কী যেন লিখছেন। তিনিও বাঁশখালির মানুষ, আমার পাশের গ্রামের মানুষ হিসেবে খাঁটি চট্টগ্রামের ভাষায় বাতচিত চলে আমাদের।

“এমপিও হইল স্যার মান্থলি পে অর্ডার। গর্ভমেন্টের মান্থলি পে অর্ডারের তালিকায় নাম থাকলে মাসে মাসে সরকারি অংশটা অটোম্যাটিক চলে আসবে স্যার।“– কাদের সাহেব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন।

“আপনি তো আমার কাগজপত্র জমা নিয়েছিলেন প্রায় দুই বছর আগে। এতদিনেও আমার এমপিও হলো না?”

“আপনার এমপিও হয়নি কে বললো?”

“প্রিন্সিপাল স্যার বললেন। বললেন আমাকে ঢাকা যেতে হবে।“

কাদের সাহেবের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। বললেন, “প্রিন্সিপাল স্যার যখন আপনাকে পাঠাতে চাচ্ছেন, আপনি যান স্যার। সব ঠিক হয়ে যাবে। এমপিও হোক না হোক – আপনাদের বেতন কি একদিনের জন্যও দেরি হয়েছে স্যার?”

কাদের সাহেবের কথাবার্তা বেশ ডিপ্লোম্যাটিক। কিছু কিছু বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে অস্বীকার করার উপায় থাকে না।

অফিস রুম থেকে বের হতেই খান সাহেব পাকড়াও করলো।

“দোস্ত, তোমাকে খুঁজতেছি।“

“বলো।“

“আমাকে একটু সময় দিবা?”

“বলো।“

“একটু কনফিডেন্সিয়াল। চলো ঐদিকে যাই।“

টিচার্স রুমের পাশের রুমটা খালি। খান সাহেবের গোপনীয় কথা শোনার কৌতূহল হচ্ছে।

“দোস্ত, তুমি কি কাফ্‌কোর এডভার্টাইজটা দেখছো?”

“দেখেছি তো। তুমি কি অ্যাপ্লাই করবা?”

“তোমারে খুলে বলি ব্যাপারটা। আমার এই চাকরিটা হবে। এখন তুমি আমার দরখাস্তটা লিখে দাও। ইংরেজিতে লিখতে হবে তো। আমি মোটামুটি লিখছি। তুমি একটু চেক করে দিবা।“

খান সাহেব যখন বলছে তার চাকরিটি হবে – তখন আমি নিশ্চিত যে চাকরিটি তারই হবে। সে যতটুকু দেখায় তার চেয়ে অনেক বেশি জোর আছে তার খুঁটিতে।

>>>>>>>>>>> 

স্টেশন রোডে বিআরটিসি মার্কেটের কাছে পরপর অনেকগুলি বাসকাউন্টার। আগে টিকেট করে রাখিনি। হানিফ পরিবহনের বাস এখনই ছেড়ে দেবে। এই সকাল ছ’টায় খুব বেশি যাত্রী নেই। টিকেট নিয়েই বাসে উঠে পড়লাম। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। নিম্নচাপ আছে, তিন নম্বর সিগনাল দেয়া হয়েছে। আকাশ কুচকুচে কালো। এ অবস্থায় ঢাকায় যেতে হচ্ছে। কাল রাতে চলে গেলেই হতো। কিন্তু কয়েক মিনিটের একটি কাজের জন্য রাত জেগে ভ্রমণ করার  চেয়ে ভোরের বাসে যাওয়াই বেটার বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু রাতের ভেতর আবহাওয়া এত খারাপ হয়ে গেল।

কাল কলেজ ছুটির একটু আগে প্রিন্সিপাল স্যার একটি মুখবন্ধ মোটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি ডিজি অফিসে গিয়ে তিন তলায় উঠে আবুল হোসেনকে এই খামটা দেবেন। আর আমার নাম করে বলবেন যে আমি তার ভাইয়ের সচিবালয়ে ভালো জায়গায় পোস্টিং পাইয়ে দেবো।“

“ডিজি অফিসটা কোথায় স্যার?”

“তোপখানা রোডে সচিবালয়ের কাছেই। শিক্ষা অধিদপ্তর। যে কোন রিকশা বা ট্যাক্সিওয়ালা আপনাকে নিয়ে যাবে। আপনি গেলেই চিনতে পারবেন।“

“খামটা দিয়ে এলেই হবে? আবুল হোসেন সাহেব কি আমাকে কিছু দেবেন?”

“না। কিছু দেবেন না।“

ঢাকার আবুল হোসেন হয়তো কিছু দেবেন না। কিন্তু আমার বন্ধু আবুল হোসেন খানও একটি খাম ধরিয়ে দিয়েছে আমাকে।

“দোস্ত, পরশুদিন লাস্ট ডেট। আমি ক্যুরিয়ার করলেও পৌঁছাবে না। তুমি তো যাচ্ছো ঢাকায়। আমার এপ্লিকেশানটা তুমি হাতে হাতে দিয়ে আসবা কাফকোর কর্পোরেট অফিসে।“

“অফিসটা কোথায়?”

“অ্যাড্রেস লেখা আছে খামের উপর। দোস্ত এই উপকারটা তুমি করবা।“

দুটো খাম নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছি। ঘটনাক্রমে দুটো খামের সাথে জড়িত দু’জন ভিন্ন ভিন্ন আবুল হোসেন।

বাস যত জোরে ছুটছে বাতাসের বেগ ততই বাড়ছে। রাস্তায় জ্যামে না পড়লে দুপুর বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। জ্যামে পড়লে সমস্যা হয়ে যাবে। ডিজি অফিস নাকি দুপুর দুটার পর খালি হয়ে যায়। তখন আবুল হোসেনকে না পেলে ঝামেলা হবে।

প্রচন্ড বৃষ্টি আর বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে যে গতিতে ছুটছে বাস – যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বৃষ্টির তোড়ে জানালার বাইরে কিছু দেখাই যাচ্ছে না। ড্রাইভার কীভাবে রাস্তা দেখছে, সামনের দিক থেকে ছুটে আসা গাড়ি দেখছে আমি জানি না। আশেপাশের যাত্রীদের সবার ভেতর বেশ নির্বিকার ভাব। আমার সামনের সিটের যুবক যাত্রী হঠাৎ জানালা খুলে বাইরে মুখ বাড়াতে উদ্যত হলেন। বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগলো বাসের ভেতর। সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। বাসের হেল্পার ছুটে এলেন পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে। নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় তারা বুঝতে পারেন। একটু পরেই বমির শব্দ আর বাজ পড়ার শব্দ মিশে গেলো একটানা বৃষ্টির ঝমঝমানির সাথে।

কমলাপুরে যখন বাস থেকে নামলাম তখনো বৃষ্টি থামেনি। ফোল্ডিং ছাতাটি শুধু মাথাটা বাঁচালো কোনরকমে, বাকিটা ভিজে গেল। এখান থেকে শিক্ষাভবন খুব বেশি দূরে নয়। কাকভেজা রিকশাওয়ালা পর্দা উঁচিয়ে ধরলেন। আমি ছাতা মুড়ে ঢুকে পড়লাম রিকশার অন্দরে।

ঝড়বৃষ্টি বন্যাখরা যাই হোক রাজধানী শহর কাবু হয় না কিছুতেই। এই বৃষ্টিতে রাস্তায় পানির স্রোত যত, তার চেয়েও বেশি গাড়ি ও রিকশার স্রোত, মানুষের ঢল। প্রিন্সিপাল স্যার ঠিকই বলেছিলেন। শিক্ষাভবন খুঁজে পাওয়া কোন কঠিন কাজ নয়।

ভবনের উচ্চতার তুলনায় সিঁড়ির প্রস্থ বেশ কম। তিন তলায় উঠে ডানে ঢুকতেই মনে হলো কোন কাঁচাবাজারে ঢুকে গেলাম। গিজগিজ করছে মানুষ একটা রুমের ভেতর। রেয়াজউদ্দিন বাজারের অনেক আড়তে দেখা যায় লোকজন মুঠো মুঠো টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জিনিস নেয়ার জন্য। এখানেও দেখলাম একটা টেবিল ঘিরে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক মানুষ। প্রত্যেকের হাতেই কাগজপত্র আর তাড়া তাড়া টাকা। আমার হাতে কোন টাকা নেই। আমি ব্যাগ থেকে প্রিন্সিপাল স্যারের দেয়া খামটা বের করলাম।

“এটা কি আবুল হোসেন সাহেবের ডেস্ক?”

ফিসফিস করে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তিন চারজন একসাথে জবাব দিলেন, “জি জি, ঠিক জায়গাতেই আসছেন।“

ফেলে দেয়া আমের আঁটিকে যেভাবে মাছিরা গা ঘেঁষাঘেষি করে ঘিরে থাকে, এখানেও আবুল হোসেনের টেবিলের তিন পাশে সেরকম মাছির মতো ভীড়। অন্যপাশে দেয়াল। আবুল হোসেন সাহেবকে দেখা যাচ্ছে না। কী পদ্ধতিতে এখানে কাজ হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কিন্তু বেশ দ্রুতই কাজ হচ্ছে মনে হচ্ছে। একজন দু’জন করে বের হচ্ছেন, আর আমি পেছন থেকে একটু একটু করে সামনে এগোচ্ছি। ঘন্টাখানেক পর পৌঁছে গেলাম আবুল হোসেন সাহেবের কাছে। ছোট্ট একটা টেবিল - ক্লাস ফাইভ-সিক্সের বাচ্চাদের পড়ার টেবিলের মতো। আন্দাজ করা যায় – আবুল হোসেন সাহেব এই দপ্তরের একজন কেরানি। কোথাও তার নাম-পরিচয় লেখা নেই। কিন্তু তাঁকে সবাই চেনে। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। চেয়ারে বসে মাথা ঝুঁকে তিনি  টাকা গুণে নিচ্ছেন। গোণার সময় এত দ্রুত হাত চলছে যে মনে হচ্ছে তাঁর হাত এই কাজের জন্য বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। টাকা গুণে নেয়ার পর হাতের কাগজপত্রের কোণায় সাংকেতিক চিহ্নের মতো করে কিছু চিহ্ন দিয়ে পাশে রেখে দিচ্ছেন। এরকম প্রকাশ্যে ঘুষ-কার্যক্রম আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার আগে আরেকজন আছেন। তারপরেই আমার পালা। মনে হচ্ছে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে টাকা আনেনি।

“ভাই গভমেন্ট কলেজ কোন্‌ রুমে?” পেছনে কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন। সাথে সাথে কয়েকজন একসাথে উত্তর দিলেন, “গভমেন্ট কলেজ চার তলায়।“

আমার পালা এলো।

“আমি চিটাগং শাহীন কলেজ থেকে এসেছি। প্রিন্সিপাল মোয়াজ্জেম হোসেন স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন। এই খামটা আপনাকে দিতে বলেছেন।“

আবুল হোসেন সাহেব ভাবলেশহীন মুখে খামটা হাতে নিয়েই একটানে একপাশটা ছিঁড়ে ফেললেন। ভেতরে সাদা কাগজ মোড়ানো অনেকগুলো একশ’ টাকার নোট। আমি একবারও ভাবিনি যে খামে টাকা থাকবে। আমার ভালো লাগছে না। শিক্ষাজীবনের নানা পর্যায়ে ল্যাবের দাদু থেকে শুরু করে অনেককেই বিশ পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়েছে চা-খাওয়ার জন্য। কলেজেও পিয়নদের মাঝেমধ্যেই টাকা-পয়সা দিই। ওগুলোকে বখশিস বা টিপ্‌স হিসেবে ধরেছি। ফলে কখনোই ঘুষ দেয়ার গ্লানিবোধ করিনি। কিন্তু আজ প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে না জানিয়ে আমার হাত দিয়ে ঘুষের টাকা পাঠিয়েছেন। তিনি কি কোন কারণে বুঝতে পেরেছিলেন যে টাকা বললে আমি আসতে রাজি হবো না? মুখবন্ধ খামের গোপনীয়তা রক্ষা করার নীতিবোধ কীভাবে যেন ঢুকে আছে মাথার মধ্যে। নইলে খামে কী আছে তা দেখে নেয়া এমন কোন কঠিন কাজ ছিল না। নিজের কাছেই নিজে ছোট হয়ে গেলাম আজ।

“এটা বদলে দ্যান।“– একটা ছেঁড়া একশ’ টাকার নোট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে যান্ত্রিক গলায় বললেন আবুল হোসেন।

“খামের মধ্যে কী ছিল আমি জানি না। আপনি মোয়াজ্জেম স্যারের কাছ থেকে বদলে নিয়েন এই নোট। তিনি বলেছেন আপনার ভাইকে সচিবালয়ে ভালো জায়গায় পোস্টিং পাইয়ে দেবেন।“ – আমি অনেকটা নাটকের মুখস্ত সংলাপের মতো বলে গেলাম।

আবুল হোসেন সাহেব টাকার সাথে দেয়া কাগজে লেখা চার লাইনের চিঠিটি পড়লেন। তারপর নিজের পশ্চাৎদেশ চেয়ার থেকে একটু আলগা করে এক টান দিয়ে একটা ফাইল বের করলেন। দেখলাম তিনি অনেকগুলি ফাইলের উপর বসে তা দিচ্ছেন। এই ফাইলগুলি তিনি ছাড়া আর কারো পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। যেগুলির উপর আজ বসেছেন – সেগুলির লোক নিশ্চয় আজ আসবে। নইলে মোয়াজ্জেম হোসেন স্যার আমাকে আজকেই আসতে বললেন কেন, আর সেই ফাইলও এই আবুল হোসেনের পশ্চাৎদেশে অবস্থিত কেন।

“আচ্ছা, এটা কার এমপিওর ফাইল?” – কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম।

“মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রিন্সিপাল, বি এ এফ শাহীন কলেজ, চট্টগ্রাম।“

“আর কারো ফাইল নেই?”

“না।“

তার মানে আমাকে যে বলা হয়েছে আমার এমপিও হয়নি – সেটাও মিথ্যা কথা। আমার রাগ হচ্ছে না, কিন্তু খুবই কষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় যে প্রতিষ্ঠান থেকে – সেখানে এভাবে প্রকাশ্যে ঘুষ-বাণিজ্য চলছে। উচ্চশিক্ষিত মানুষ, প্রতিষ্ঠান-প্রধানরা কেন এভাবে একজন কেরানিকে টাকা দিচ্ছেন? সবকিছু নিয়মমোতাবেক চললে কি কারোরই কোন কাজ হবে না? আমি জানি না।

রুম থেকে বের হয়ে মনে হলো একবার সরকারি কলেজের দপ্তরে গিয়ে দেখি। সেখানে হয়তো এরকম কিছু নেই। চারতলায় উঠলাম। সেখানে ভীড় কিছুটা কম। কিন্তু লেনদেন সেখানেও হচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। দেখলাম একজন ভদ্রলোক চেয়ারে বসা কেরানির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলছেন, “আমি রাজশাহী সরকারি কলেজের গণিতের সহযোগী অধ্যাপক। আমাকে…”

চলে এলাম। এই দৃশ্যগুলি আমার কাছে খুবই অপমানজনক; সহ্য করা কঠিন।

শিক্ষাভবন থেকে বের হয়ে আবুল হোসেন খানের ঠিকানাটা খুঁজে বের করলাম রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে। তার দরখাস্ত জমা দিয়ে আমার কাজ শেষ।

বাতাসের বেগ ক্রমশ বাড়ছে। রাতেই ফিরে যাবো, নাকি ঢাকায় থেকে যাবো? কাকরাইলে অজিতের অফিসে যাওয়া যাক। তাকে পেলে থেকে যাবো। রিকশা নিয়ে গেলাম সেখানে। রিসিপশানিস্ট জানালেন সে চিটাগং গেছে। আর সময় পেলি না ব্যাটা। আমি ঢাকায় এলাম, আর তুই চিটাগং গেলি? ঢাকায় থেকে যাবার আর কোন যুক্তি নেই। ফিরে যাওয়াই ভালো।

এস আলমের বাস ছাড়লো সন্ধ্যা ছ’টায়। রাত বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু কুমিল্লা পার হবার পর বাতাসের বেগ এত বেশি। যাত্রীদের কাছে জানা গেলো সাত নম্বর সিগনাল চলছে। বাতাসের বেগ এত বেশি গাড়ির গতি বাড়লেই রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে যাবে। কিছুদূর থেমে, কিছুদূর চলে শেষপর্যন্ত রাত তিনটায় চট্টগ্রাম এসে পৌঁছলাম।

Tuesday 8 September 2020

আর যুদ্ধ নয়

 সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা

আর যুদ্ধ নয়



Saturday 5 September 2020

অপুর বিড়াল

 শিশুদের জন্য গল্পপাঠ - ১০

অপুর বিড়াল



ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৪৬

 46

আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন উদ্ভাবনের প্যাটেন্ট নিয়েছিলেন ১৮৭৬ সালে। তারপর ১২০ বছর কেটে গেছে। শুনেছি উন্নত দেশের ঘরে ঘরে আজ টেলিফোন। অথচ আমাদের দেশে এই টেলিফোন এখনো আভিজাত্যের প্রতীক। এটা এতই অভিজাত যে এর জন্য টিএন্ডটি নামে খুব পাওয়ারফুল একটি সরকারি বিভাগ আছে। নতুন টেলিফোন সংযোগ পাবার জন্য নাকি এই প্রতিষ্ঠানে অনেক দেনদরবার করতে হয়। খুব পাওয়ারফুল না হলে বা পাওয়ারফুল কারো সুপারিশ না থাকলে কিংবা টাকার বিনিময়ে পাওয়ার কেনার ব্যবস্থা করা না গেলে টেলিফোনের দরখাস্ত ফ্রুটফুলহয় না। এই কারণেই যাদের বাড়িতে টেলিফোন আছে – তাদের প্রতিবেশিরা তাদেরকে এক্সট্রা খাতির করেন। সামাজিক আভিজাত্যের এই নিদর্শনটি সম্প্রতি আমাদের টিচার্সরুমে সাঈদ স্যার ও মহিউদ্দিন স্যারের টেবিলে অধিষ্ঠিত হয়েছে। মজিদ স্যারের শাসনকালে একটি নতুন টেলিভিশনকে রাজকীয় আয়োজনে উদ্বোধন করা হয়েছিল। অথচ টেলিভিশনের চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন এই টেলিফোন যন্ত্রের কোন ধরনের আনুষ্ঠানিক অভিষেকের আয়োজন করা হলো না।

ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের এই যন্ত্রটির লম্বা তার বিমল স্যার যেখানে বসেন সেখানকার জানালা দিয়ে ঢুকেছে এবং দেয়ালের আশেপাশে ঘুরে সাঈদ স্যারের টেবিলে উঠেছে। সাঈদ স্যার যখন রুমে থাকেন, টেলিফোন বাজলেই তিনি রিসিভার উঠিয়ে গম্ভীরভাবে বলেন, হ্যালো। তখন তাঁর গলায় আভিজাত্য গমগম করে। কিন্তু ঝামেলাটা হয় যখন সাঈদ স্যার রুমে থাকেন না। তখন যদি টেলিফোন বাজে, মহিউদ্দিন স্যার টেবিলে থাকলেও রিসিভার ঊঠান না। যন্ত্র-সভ্যতার প্রতি তিনি প্রকাশ্যেই বিরক্তি প্রকাশ করেন। সাঈদ স্যারের অনুপস্থিতিতে শংকর স্যার টেলিফোন রিসিভ করতে ইতস্তত করেন না। কিন্তু এখন রুমে সাঈদ স্যারও নেই, শংকর স্যারও নেই কিন্তু টেলিফোনে কয়েকবার রিং হলো। আমি জানি আমার কাছে কোন ফোন আসবে না। কারণ আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারোরই কোন টেলিফোন নেই। আর নেই বলেই আমি সুযোগ পেলে তাদেরকে আমার কলেজের টেলিফোন নম্বর দিয়ে বুঝিয়ে দিই যে আমি কত অভিজাত কলেজে চাকরি করি যেখানে টিচারদের জন্য আলাদা টেলিফোন আছে। কয়েক সপ্তাহ আগেও কলেজে টেলিফোন ছিল শুধুমাত্র প্রিন্সিপালের রুমে। তারপর ভাইস-প্রিন্সিপাল স্যার ও ম্যাডামের টেবিলে টেলিফোন এসেছে। এখন টিচারদের রুমেও। কিন্তু টেলিফোন কীভাবে কাজ করে সেই গ্রন্থগত বিদ্যা আমার থাকলেও তার ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা আমার হয়নি এখনো।

টেলিফোনটি আবার বাজছে। ছোটদের ছড়ায় পড়েছি ক্রিং ক্রিং টেলিফোন, হ্যালো হ্যালো হ্যালো/ কে তুমি, কাকে চাই, বলো বলো বলো। কিন্তু এই টেলিফোনটি ক্রিং ক্রিং না করে অন্য ধরনের একটা বাজনা বাজাচ্ছে।  মনে হচ্ছে একটা সুযোগ আজ এসেছে টেলিফোন রিসিভ করার। ফিফ্‌থ পিরিয়ডে এখন আমি ছাড়া আর কেউ নেই রুমে। চেয়ার থেকে উঠে এক পা এগোতেই টেলিফোনের বাজনা বন্ধ হয়ে গেল।

পরের দুই ঘন্টা আমার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস আছে। কয়েকদিন পরেই নতুন ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হবে। এবছর এসএসসিতে ৬৪০ নম্বরের কম পেয়েছে এমন কাউকে ভর্তির ফর্মও দেয়া হয়নি। সব ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া ভালো শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে এখন। এইচএসসির রেজাল্টও বের হবে এই মাসে।

অ্যাই প্রদীপ, তোমার ফোন।

বারান্দা থেকে ডাক দিয়েছেন আয়শা আপা। আমি থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

আমার ফোন? কোথায় আপা?

কোথায় আবার? ফোনে আরকি। তোমার বন্ধু মনে হয় ফোন করেছে।

আপনাদের রুমে ফোন করেছে?

আমাদের রুম আর তোমাদের রুমের ফোন তো একই নম্বরের। প্যারালাল লাইন না? যাও, কথা বলো। বলেই আয়শা ম্যাডাম বারান্দা থেকেই চলে গেলেন। তাঁদের রুম থেকে এত দূরে নিজে এসে খবর দিয়ে গেলেন। পিয়নদের কাউকে দিয়ে খবর দিলেই হতো। টেলিফোনের রিসিভার উঠাতেই ম্যাডামদের রুমের কথাবার্তা শোনা গেল। প্যারালাল লাইনের এই অসুবিধা। ভুল রুমে রিসিভ করলে অন্য রুমে খবর দিতে হয়। এক রুমে কেউ টেলিফোনে কথা বললে অন্যরুমের রিসিভার তুলে সেই কথা ইচ্ছে হলেই শোনা যায়।

হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে গালিগালাজ করে উঠলো বিপ্লব। ম্যাডামদের কারো কানে এই বিপ্লবী শব্দাবলির অংশবিশেষও যদি প্রবেশ করে তাহলে সর্বনাশ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গালিগালাজ যে কতটা শ্রুতিকটু হতে পারে তা সহ্য করা তো দূরের কথা, অনেকে চিন্তাই করতে পারবে না। কিন্তু বিপ্লবের এসব শব্দচয়নে আমি অভ্যস্ত। সে বন্ধুকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে এসেছে। আমি এখনো কেন এয়ারপোর্টে উপস্থিত হইনি এটাই গালিগালাজের মূল কারণ। তাকে কোন রকমে আশ্বস্ত করে টেলিফোন রেখে দিলাম। আমাকে যে সে ফোন করবে এটা আমার ধারণাতেই ছিল না। এয়ারপোর্টে নাকি টাকা দিয়ে টেলিফোন করার ব্যবস্থা আছে।

ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ক্লাসে আমরা দুজন প্রদীপ ছিলাম। সে ফর্সা প্রদীপ, আমি কালো প্রদীপ। যারা সাদা-কালোর বিভেদ উচ্চারণ করতে চায় না তারা আমাকে ডাকে লম্বা প্রদীপ, তাকে বেঁটে প্রদীপ। আজ বেঁটে প্রদীপ চলে যাচ্ছে মিডল ইস্টে। দুপুর সোয়া দুটোয় তার ফ্লাইট। আমাকে বলেছিল এয়ারপোর্টে যেতে। আজ দেড়টা পর্যন্ত আমার ক্লাস আছে। এরপর যেতে যেতেই দুটো বেজে যাবে। এতক্ষণে নিশ্চয় তার ইমিগ্রেশান হয়ে গেছে। ইমিগ্রেশান গেট পার হলে আর দেখা হবার সুযোগ নেই। আবার কবে তার সাথে দেখা হবে জানি না। কিন্তু তাকে বিদায় দিতে অন্যান্য বন্ধু যারা এসেছে তারা প্লেন যাওয়ার এক মিনিট আগেও এয়ারপোর্ট ত্যাগ করবে না। তাদের সাথে দেখা করার জন্য হলেও আমাকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।

ছুটির পর তাড়াহুড়ো করে বের হবার সময় বন্ধু আবুল হোসেন খানকে বললাম, আজ বেঁটে প্রদীপ আবুধাবি  চলে যাচ্ছে। আমি একটু দেখাও করতে পারলাম না।“

“কেন? তার ফ্লাইট কখন?”

“সোয়া দুইটায়।“

“এখন তো মাত্র দেড়টা বাজে।“

“ইমিগ্রেশান হয়ে গেছে না?”

“ফ্লাইট অনেক সময় ডিলে হয়। চলো আগে এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি।“

খান সাহেব নিজের বাসায় না গিয়ে আমাকে নিয়ে চললো এয়ারপোর্টে। ঘাঁটির ভেতর দিয়ে খুব কম সময়ের ভেতর এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। ডিপার্চার গেটের বাইরে প্রচন্ড ভীড়। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট হিসেবে খুবই ছোট এয়ারপোর্ট চট্টগ্রাম। শুধুমাত্র কলকাতা আর মিডলইস্টের ফ্লাইট যায় এখান থেকে। এই ভীড়ের মধ্যে বিপ্লব এবং অন্যরা কোথায় আছে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু খান সাহেব ভীড়ের দিকে না গিয়ে সিভিল এভিয়েশান অথরিটির গেটের দিকে যাচ্ছে।

“ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?” – আমি জানতে চাইলাম।

“আসো না আমার সঙ্গে। দেখি কোথায় যাওয়া যায়।“ – হাঁটতে হাঁটতে বললো খান সাহেব। একটু মোটাসোটা হলেও বেশ দ্রুত হাঁটতে পারে সে। একটু পরেই সে আমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের অফিসে ঢুকে গেল। এরকম অফিসে এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ যে ঢুকতে পারে সেটাই আমার জানা ছিল না।

“আরে খান সাহেব, আসেন আসেন।“ – এয়ারপোর্ট ম্যানেজার বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা করলেন খান সাহেবকে। ভদ্রলোকের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে। সুগঠিত, সুদর্শন। খান সাহেবের জনসংযোগ অনেক বিস্তৃত তা জানতাম। কিন্তু তা যে ঘাঁটি পেরিয়ে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে তা জানা ছিল না।

“ও হচ্ছে প্রদীপ, আমার বন্ধু, ফিজিক্সের টিচার।“

“বসেন বসেন। প্লিজ।“

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ডেস্কের সামনের চেয়ারে আমাদের বসালেন। এত বড় অফিসার এত সৌজন্য দেখাচ্ছেন তাতেই আমি মুগ্ধ।

“আপনিই কি শাহীনের – প্রদীপ দেব?”

মনে হচ্ছে শাহীনের প্রদীপ দেবের নাম তিনি আগেও শুনেছেন। কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “জ্বি।“

“আমার মেয়ের কাছে আপনার নাম শুনেছি। আমার বড় মেয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আপনি চিনেন হয়তো – সিফাত তাসনিম। আর ছোটটা তো স্কুলে। খান সাহেবের ছাত্রী।“

বুঝতে পারছি খান সাহেব তাঁর ছোট মেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়। আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ম্যানেজার বেল টিপেছেন। একজন সহকারী উঁকি মারতেই তিনি নির্দেশ দিলেন, “আমাদেরকে চা দাও।“

খান সাহেব দ্রুত বললো, “চা এখন খাবো না। একটা কাজে এসেছি আপনার কাছে। আমাদের এক বন্ধু আবুধাবি চলে যাচ্ছে সোয়া দু’টার ফ্লাইটে। তার ইমিগ্রেশান হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা দেখা করতে পারিনি। একটু যদি দেখা করে সি অফ করতে পারতাম।“

“সোয়া দুটার আবুধাবি – ফ্লাইট ডিলে আছে। এক ঘন্টা ডিলে। দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবো। আগে চা খান। আপনাদের আর কখন পাবো তো ঠিক নেই। অ্যাই, আমাদের তিনজনকে চা দাও।“

স্বয়ং এয়ারপোর্ট ম্যানেজার যখন বলছেন দেখা করা যাবে – আর কী চাই। খান সাহেব আরাম করে বসলো। আমিও বেশ খুশি হয়ে গেলাম।

“আপনার বড়বোন জাপান গেছেন না কিছুদিন আগে?”

ম্যানেজারের প্রশ্নে আমি বেশ অবাক হলাম। এই ভদ্রলোক কি আমার দিদির পরিচিত?

“জ্বি। একটা ট্রেনিং-এ গেছে গত মাসে।“

“আমার সাথে দেখা ব্যাংকক এয়ারপোর্টে।“

“আপনি কি চেনেন আমার দিদিকে?”

“না, আগে কখনো পরিচয় হয়নি। দেখলাম ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ট্রানজিটের জন্য অপেক্ষা করছেন। হাতে চটের ব্যাগ দেখে বেশ অবাক হলাম। আজকাল তো কেউ চটের ব্যাগ নিয়ে কাঁচাবাজারেও যায় না, অথচ তিনি বিদেশে চলে যাচ্ছেন রেয়াজউদ্দিন বাজারের চটের ব্যাগ নিয়ে। কৌতূহল বশত আলাপ করলাম। অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয়েছে। আমার ফ্রাংকফুটের ফ্লাইট ডিলে ছিল। আমার মেয়েরা শাহীনে পড়ে শুনে তিনি আপনার কথা বলেছেন। গভমেন্ট অফিসারদের মধ্যে এরকম সিমপ্লিসিটি আজকাল খুব একটা দেখা যায় না।“

চা বিস্কুট খাবার পর ম্যানেজার একজন অফিসারকে ডেকে বললেন আমাদেরকে যেন আবুধাবির ফ্লাইটের বোডিং গেটে পৌঁছে দেন। ম্যানেজারকে ধন্যবাদ দিয়ে চললাম সিভিল এভিয়েশান অফিসারকে অনুসরণ করে।

আমাদের দুজনকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলো প্রদীপ। তার ধারণাই ছিল না যে আমরা বোর্ডিং-গেটে গিয়ে তার সাথে দেখা করতে পারবো। যাত্রীর তুলনায় ভেতরে জায়গা অনেক কম। ফ্লাইট ছাড়তে যে দেরি হবে তা যাত্রীদের জানানোও হয়নি। দেখলাম সবাই হাতে পাসপোর্ট আর বোর্ডিং পাস নিয়ে শুকনো মুখে অপেক্ষা করছে। সবাই নিজের দেশ ছেড়ে সব প্রিয়জনকে ছেড়ে মরুভূমির দেশে যাচ্ছে পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করার জন্য। ভ্রমণে যে আনন্দ থাকে – সে আনন্দ এখানে অনুপস্থিত। এখানে সবার ভেতরই ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগ। প্রদীপ এমনিতেই খুব ঘরকাতুরে মানুষ। ইউনিভার্সিটির হলে থাকতে সপ্তাহে দু’দিন বাড়ি চলে যেতো। এখন জানি না বিদেশে কীভাবে থাকবে। অবশ্য সেখানে তার নিজের বড় ভাইদের সাথে থাকবে।

বিদায়ের কোলাকুলি করে চলে এলাম। খান সাহেবকে একটা বড় ধন্যবাদ দেয়া উচিত। কিন্তু আমাকে ধন্যবাদের সুযোগ না দিয়ে সে দ্রুত চলে গেল। আমি ভীড়ের মাঝে বিপ্লবকে খুঁজতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ খোঁজার পরেও পরিচিত কাউকে পেলাম না। সোয়া দুটো বেজে গেছে। প্লেন ছেড়ে চলে গেছে ভেবে হয়তো এরাও চলে গেছে সবাই। আমাকে ফিরতে হবে লোকাল বাসে। এদিক থেকেই ছাড়ে শহর এলাকার তিন নম্বর বাস। দ্রুত রাস্তা পার হয়ে বাসের দিকে যাচ্ছি – শুনতে পেলাম - “অ্যাই প্রদীপ, প্রদীপ, এই যে এদিকে এদিকে।“ মনে হচ্ছে অনেক উপর থেকে কেউ ডাকছে আমাকে। শব্দ অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখলাম হাটহাজারি রোডের একটি বড় বাসের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে অপু। আমাদের আরেক বন্ধু। বিপ্লবকেও পাওয়া গেল আশেপাশে। তারা এই বড় বাসটি ভাড়া করেছে বন্ধুকে সি-অফ করতে এয়ারপোর্টে আসার জন্য। দেখলাম বন্ধু, আত্মীয়স্বজন সবাই চলে এসেছে। সবার মুখেই বিদায়ের বিষাদ। অপুরা বাসের ছাদে উঠে গেছে – প্লেন উড়ে যাবার সময় যথাসম্ভব কাছ থেকে দেখার জন্য।

>>>>>>>>>>> 

কলেজের দিন চলে যাচ্ছে বেশ দ্রুত। এইচএসসির রেজাল্ট আউট হয়েছে। শাহীনের রেজাল্ট বেশ ভালো। সায়েন্স থেকে সানিয়া স্ট্যান্ড করেছে। নতুন ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। দেখতে দেখতে ডিসেম্বর চলে এলো। প্রথমবারের মতো শাহীন কলেজে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ও বিজয় দিবস উদ্‌যাপনের আয়োজন করা হলো।

শাহীনের পুরনো ভবনের ঘাসের চত্বরে বেঞ্চ পেতে শিক্ষার্থীরা বসলো। আর বারান্দায় মঞ্চ। সুব্রত ও রেহনুমার উপস্থাপনায় খুব উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অনুষ্ঠান শুরু হলো। রিফাৎ আরা ম্যাডাম তাঁর বক্তৃতায় খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন যে বিজয়ের ২৫ বছর পূর্তিতে শাহীন কলেজে প্রথম বারের মত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছে এমন একজন প্রিন্সিপালের সভাপতিত্বে যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। শিক্ষার্থীরা সবাই আনন্দে হাততালি দিলো। কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার যখন বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, মনে হলো কোথায় যেন কিছু একটা গন্ডগোল আছে। এত নিরস বক্তৃতা সহ্য করা কঠিন। নিরস খাবার খুব কম পরিমাণে খেয়ে কোন রকমে সহ্য করা যায়।  সেরকম নিরস বক্তৃতাও খুব বড়জোর কয়েক মিনিট সহ্য করা যায়। সেখানে প্রিন্সিপাল স্যারের বক্তৃতা চলছে তো চলছেই – থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ছেলে-মেয়েরা উশখুস করতে করতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করলো। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে গেল। প্রিন্সিপাল স্যার একটু পরপরই বলতে শুরু করলেন, “অ্যাই তোমরা বস। এরপর কিন্তু তোমাদের জন্য খাবার আছে।“ ভাবলাম জোরে হাততালি দিলে মনে হয় কাজ হবে। হাততালি কিছুটা সংক্রামক। একজন দিলে অনেকেই দেয়। স্যার-ম্যাডমরা শুরু করলেন, ছাত্রছাত্রীরাও হাততালি দিতে শুরু করলো। কিন্তু বক্তা হাততালিতে আরো বেশি উৎসাহিত হয়ে গেলেন। কী বলতে কী বলছেন তার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাঁর উচিত ছিল বক্তৃতা লিখে আনা। নিজে না পারলে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারতেন। আর একজন দায়িত্বশীল মানুষের সময়জ্ঞান থাকবে না? বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ – যেটা পৃথিবীর সেরা ভাষণগুলির একটি – তার দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র দশ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর মতো বক্তা যদি ঘন্টার পর ঘন্টাও বলেন, সবাই আগ্রহভরে শুনবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন কোথায় থামতে হবে, কখন থামতে হবে। কিন্তু আমাদের আজকের বক্তার মাত্রাজ্ঞান একেবারেই নেই। একটা মহান অনুষ্ঠান শেষ হলো পুরোপুরি বিরক্তিকর একটা অনুভূতির ভেতর দিয়ে। কিন্তু এই অনুভূতির কথাটি কেউই তাঁকে জানিয়েছেন বলে আমার মনে হয় না। নিজের পায়ে যে কুড়োল মারতে হয় না সেটুকু জ্ঞান নিশ্চয় শিক্ষকদের আছে। তারা সবাই জানেন - নির্গুণ ক্ষমতাবানের অহং কত মারাত্মক হতে পারে।

>>>>>>>>>>>>>>> 

“আচ্ছা, আপনি আমাদের চিঠি পাননি?”

ট্রেনিং-কোঅর্ডিটেনর বিষ্ণুবাবু চোখের সোনালী চশমাটা খুলে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে মুছতে প্রশ্নটা করলেন আমাকে। এখন ট্রেনিং-এ চা-বিরতি চলছে। আমি চায়ের কাপ হাতে এদিক ওদিক তাকিয়ে অপরিচিত মুখগুলিকে মনে রাখার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় বিষ্ণুবাবু গিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছেন তাঁর টেবিলে। তার সামনে চেয়ারে বসার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি চিঠি পেয়েছি কি না।

“না, কোন চিঠি তো পাইনি। কিসের চিঠি?”

“আপনাকে আমরা ট্রেইনার হিসেবে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা আপনাকে ট্রেইনি হিসেবে পাঠালো।“

“চিঠি কাকে লিখেছিলেন? প্রিন্সিপালকে?”

“না, চিঠি তো পাঠিয়েছি আপনার নামে। পেলেন না কেন জানি না। যাক, ভালোই হলো আপনাকে তো পেয়েছি। আপনার সাথে অনেক কথা আছে আমার। এই তিন সপ্তাহের প্ল্যানিং-এর ব্যাপারে আপনার সাহায্য দরকার।“

“ঠিক আছে। কী করতে হবে জানাবেন।“

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষার উন্নয়নে কয়েক হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে সরকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান সংক্রান্ত ট্রেনিং-এর আয়োজন করে বিভিন্ন সময়ে। এখন ডিসেম্বরের ২১ তারিখ থেকে জানুয়ারির ৯ তারিখ পর্যন্ত তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে প্রশিক্ষণ চলছে আলাদা আলাদাভাবে। চট্টগ্রামের আশেপাশের অনেক স্কুল থেকে ফিজিক্সের টিচাররা এসেছেন ট্রেনিং-এ। চন্দনাইশ, গাছবাড়িয়া, পটিয়া থেকে শিক্ষকরা এসেছেন। এদিকে ফতেয়াবাদ, হাটহাজারি, রাউজান, ফটিকছড়ি থেকেও শিক্ষকরা এসেছেন। সবাই হাইস্কুলের শিক্ষক। কিন্তু শাহীন থেকে ফিজিক্সে পাঠানো হয়েছে আমাকে। গণিতে পাঠানো হয়েছে ফারুকী স্যারকে, আর ইংরেজিতে সংযুক্তা ম্যাডামকে।

পদার্থবিজ্ঞান প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সমন্বয় করছেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পরিসংখ্যানের শিক্ষক বিষ্ণুপদ রায়। ভদ্রলোক লিকলিকে লম্বা, শরীরে মাংস নেই বললেই চলে। সুন্দর ঝকঝকে হাসি দিয়ে কথা বলেন বেশ গুছিয়ে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকদের অতিথি প্রশিক্ষক হিসেবে আনার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। দেখলাম তাঁর লিস্টে আমার নামও আছে। আমার কথা তিনি শুনেছেন প্রামাণিক স্যারের কাছে। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদের এক অনুষ্ঠানে প্রামাণিক স্যার এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে। স্যার আমাকে খুবই স্নেহ করেন।

বিষ্ণুবাবুর সাথে বসে বেশ উৎসাহ নিয়ে তিন সপ্তাহের একটা কার্যকর কর্মসূচি দাঁড় করালাম। উপস্থিত শিক্ষকদের মতামত নিয়ে টপিক ঠিক করা হলো। কোন্‌ বিষয়ে কোন্‌ অতিথি শিক্ষক ভালো প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন তার ব্যাপারে পরামর্শ দিলাম। বিষ্ণুবাবু পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ নন। তাঁকে কেন পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়ের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো জানি না। কিন্তু দেখলাম শুধু তিনি নন, অনেক মানুষই কাজ করছেন এমন কিছু বিষয়ে – যে বিষয়ে কোন জ্ঞান তাঁদের নেই।

যাঁরা প্রশিক্ষণ দিতে এলেন – তাঁদেরকে টপিক ঠিক করে দেয়া হলেও – তাঁরা নির্দিষ্ট টপিকের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত আলাপ করে সময় কাটান। এবং বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করলেও – তার ধরন ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের শেখানোর মতো। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া আর শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দেয়া তো এক কথা নয়। এডুকেশন আর ট্রেনিং – দুটো আলাদা জিনিস। যাঁরা প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন তাঁদের বেশিরভাগই বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক। লাঞ্চের পরের সেশানে বেঞ্চের উপর মাথা রেখে নিঃসংকোচে ঘুমিয়ে পড়েন। বিষ্ণুবাবুর অতিথি প্রশিক্ষকদের কেউ না এলেই তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে দেন ক্লাস নেবার জন্য। আমার তো মাস্টারদের শেখানোর কোন যোগ্যতা নেই। আমি ছাত্র হিসেবে শিক্ষকদের কাছ থেকে কী কী আশা করি সেটুকুই বলার চেষ্টা করি। স্কুলের বয়স্ক বিজ্ঞানশিক্ষকরা নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে পড়ার সময় পান না, কিংবা পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁদেরকে নতুন কোন বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এত কষ্ট করে এত দূর থেকে কেন আসেন তাঁরা? মূল কারণ টাকা। দৈনিক দুইশ টাকা দেয়া হয় ট্রেনিং নেয়ার জন্য। ট্রেনিং দেয়ার জন্য কত দেয়া হয় আমি জানি না। সরকারি বাজেট যে অনেক বড় তা বোঝা যায়।

এর মধ্যে একদিন পিকনিকে নিয়ে যাওয়া হলো কাপ্তাই – কর্ণফুলি পেপার মিলে। বাস ভাড়া করে সবাইকে নিয়ে কর্ণফুলি পেপার মিল, কাপ্তাই লেক সব ঘুরিয়ে, বিরিয়ানি খাইয়ে ফিরিয়ে আনা হলো।

শেষের দিন দশটা থেকে বসিয়ে রাখা হলো শিক্ষার মহাপরিচালক এসে সার্টিফিকেট দেবেন বলে। দুপুর পর্যন্ত বসিয়ে রাখার পর বলা হলো ডিজি আসতে পারছেন না। বিষ্ণুবাবুই ডিজির হয়ে আমাদের সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন।

ভালো প্রশিক্ষণ কোথায় হয় আমি জানি না। কিন্তু আমি নিজে অংশ না নিলে বুঝতেই পারতাম না শিক্ষার নামে প্রশিক্ষণের নামে কীভাবে সময়ের অপচয় হয়, টাকার অপচয় হয়। এই তিন সপ্তাহের ট্রেনিং থেকে আমি পাঠদান সংক্রান্ত নতুন কিছুই শিখিনি। তবে এই তিন সপ্তাহে আমি এটুকু উপলব্ধি করেছি যে শাহীন কলেজের স্কুল পর্যায়ে যেভাবে পড়াশোনা হয়, অনেক স্কুল থেকে তা অনেক গুণ ভালো।

Wednesday 2 September 2020

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ১৮

 



ঘরে ফেরা

 সকাল ১১টায় রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কাউন্টারে হিসেবপত্তর মিটিয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম আমার ট্যাক্সি এসেছে কিনা। পাশের রুম থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো জেনি। সকালে সে-ই আমার জন্য ট্যাক্সি বুক করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার এই হাসিখুশী তরুণীর নাম Xenowien। ইংরেজি উচ্চারণে জেনোওয়েইন বা জেনোবিন হবার কথা কিন্তু সে বললো তার নামের উচ্চারণ ওরকম নয় তারপর নিজে যা উচ্চারণ করলো তা অনেকটা গলার ভেতর থেকে কফ পরিষ্কার করতে গেলে যেরকম শব্দ হয় সেরকম একটা শব্দ দিয়ে শুধু করতে হবে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম। মুখে থুথু উঠে এলো, কিন্তু সঠিক শব্দ উচ্চারিত হলো না। তখন সে বললো, ইউ ক্যান কল মি জেনি।

     ইওর কার ইজ রেডি স্যার

          লিকলিকে এক কিশোর বেলবয় এগিয়ে এলো আমার ব্যাগ নেয়ার জন্য। বাধা দিলাম না। এদেশে শ্রমের দাম এখনো অনেক কম। তাই অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাদের। কিছু টিপস তাদের আকাঙ্খিত পাওনা।

          হোটেলের নিজস্ব পরিবহন লুপের ঝকঝকে গাড়ি। এয়ারপোর্টে ড্রপ করার জন্য চার্জ নেবে ৩৫০ র‍্যান্ড।

          কালো স্যুট-টাই পরা ড্রাইভারকে ভি-আই-পি-দের নিরাপত্তারক্ষীর মতো লাগছে।

          বিদায় কেইপ টাউন। শহরটার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিছু কিছু শহর থেকে চলে আসার সময় কেমন যেন হালকা লাগে। মনে হয় একটা কাজ শেষ হলো, আর আসতে হবে না এখানে। আবার কিছু জায়গা আছে যেখান থেকে চলে আসার সময় মনে হয় - আবার আসতে হবে এখানে। কেইপ টাউন তেমনি একটা শহর।





 * * *

সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের চেকইন কাউন্টারগুলোর সামনে লম্বা লাইন। অনেকক্ষণ লাগলো কাউন্টারে পৌঁছাতে।

          যে কাউন্টারে গেলাম- একজন মাঝবয়সী রাগী রাগী চেহারার আফ্রিকান মহিলা। হাত বাড়িয়ে আমার পাসপোর্ট নেবার সময় খেয়াল করলাম তাঁর দুটো আঙুলে সাদা ব্যান্ডেজ জড়ানো।

     মেলবোর্ন?

     ইয়েস

          আনুষঙ্গিক রুটিন প্রশ্নমালা শেষে তিনটি বোর্ডিং পাস বুঝিয়ে দিলেন কেইপ টাউন টু জোহানেসবার্গ, জোহানেসবার্গ টু পার্থ, অ্যান্ড পার্থ টু মেলবোর্ন।

          পাসপোর্ট আর বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম, আপনার আঙুলে কী হয়েছে?

          দেখলাম তাঁর গম্ভীর মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো। বললেন, রান্না করতে গিয়ে পুড়ে গেছে। মনে হলো হাত পুড়ে যাওয়াতে তাঁর কষ্টের চেয়ে আনন্দই বেশি। প্রিয় মানুষের জন্য কিছু করতে গিয়েই হয়তো তাঁর এই কষ্টের আনন্দ।

 

* * *

 

জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে প্রচন্ড ভিড়। সিকিউরিটি চেকিং-এর দীর্ঘলাইন পেরিয়ে আসতে ঘন্টাখানেক লাগলো। ইমিগ্রেশান অফিসাররা প্রচন্ড ব্যস্ত। তাদের সবাইকে অতিরিক্ত সতর্ক বলে মনে হচ্ছে।

          দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাবার পরেও, সারা পৃথিবীর শ্বেতাঙ্গ জগৎ কৃষ্ণাঙ্গদের এখনো প্রায়ই কৃতদাস বলেই মনে করে। বর্নিল পৃথিবী বড়ই বর্ণবাদী। তাই ইউরোপ আমেরিকায় এখনো কেষ্টা ব্যাটাই চোর ভাবার লোকের অভাব নেই। সেজন্য আফ্রিকার যে কোন এয়ারপোর্ট থেকে ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাওয়ার ফ্লাইটগুলোতে অতিরিক্ত রকমের সতর্কতা।

          আমার ফ্লাইট গেট A16. গেটে এসে দেখি সেখানে আরেকটা নিরাপত্তাবেষ্টনী। অন্য গেটের ওয়েটিং এরিয়ায় অপেক্ষা করছে সবাই

     আপনার কি কয়েক মিনিট সময় হবে?

          চোখ তুলে তাকালাম লিকলিকে সুপারি গাছের মতো লম্বা এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ, কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট ব্যাগ আর হাতে আই-প্যাড

     কী ব্যাপার?

     বসি?

     বসেন

বসলো পাশের চেয়ারে। গলায় ঝুলানো আইডি দেখিয়ে বললো, আমার নাম বেদেল। আমি দক্ষিণ আফ্রিকার পর্যটন কর্তৃপক্ষের হয়ে জরিপ করছি।

          দক্ষিণ আফ্রিকার পর্যটনশিল্পকে আরো উন্নত করার জন্য পর্যটকদের মতামতের গুরুত্ব অনেক। তাই বেদেলদের কাজ হলো বিভিন্ন প্রশ্ন করে জেনে নেয়া - কেমন লাগলো দক্ষিণ আফ্রিকা।

          প্রশ্নমালা শেষে ব্যাগ থেকে একটা স্যুভেনির বের করে গিফট করলো বেদেল। জানতে চাইলাম, এটাই আপনার ফুল টাইম জব?

     না, এটা পার্ট টাইম। আমি ফুল টাইম স্টুডেন্ট।

          বেদেল ইন্টারন্যশনাল স্টুডেন্ট। এসেছে কঙ্গো থেকে। খন্ডকালীন কাজ করে থাকাখাওয়ার পয়সা জোগাড় করে। এক ধরনের একাত্মতা অনুভব করি বেদেলের সাথে। বিভিন্ন রকমের খন্ডকালীন কাজ করে একসময় আমাকেও জোগাড় করতে হয়েছে পড়াশোনার খরচ।

          আমি বাংলাদেশি শুনে বেদেল খুব প্রশংসা করলো বাংলাদেশিদের। জাতিসংঘের হয়ে অনেক বাংলাদেশি সৈনিক কঙ্গোতে কাজ করছেন সুনামের সাথে। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের সুনাম শুনতে কী যে ভালো লাগে, গর্বে বুক ফুলে যায়।

          আমাদের গেটের চেকিং শুরু হবার আগে পরের গেটের কার্যক্রম শুরু হলো। নিউইয়র্কের ফ্লাইট। মনে হচ্ছে যুদ্ধকালীন অবস্থা সেখানে। সবাই যার যার জুতো খুলে হাতে নিয়ে যাচ্ছেন এক একটা টেবিলের কাছে যেখানে ব্যাগ খুলে তন্ন তন্ন করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা আর কোন কিছু অর্জন না করতে পারলেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াতে পারছে সারা দুনিয়াজুড়ে।

          একটু পরে আমাদের প্লেনের চেকিং শুরু হলো। আমাদের অবশ্য জুতা খুলতে হলো না। আমার সিট প্লেনের পেছনের দিকে জানালার পাশে।

          যথাসময়ে প্লেন উড়লো আকাশে। দশ ঘন্টা পরেই অস্ট্রেলিয়া।

__________

Latest Post

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা - দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দশমাইল এলাকায় কিছু পুলিশ সদস্য ইয়াসমিন নামের এক ষোল বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এই ঘ...

Popular Posts