Sunday 13 June 2021

করোনাকাল ২০২০


 

১৫ এপ্রিল ২০২০

আমরা তো ঘরে থেকে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিরাপদে থাকছি। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকদের তো সেই সুযোগ নেই। আমাদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়েই তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ভাইরাস তো আক্রমণ করছেই, মানুষও তাঁদের আক্রমণ করতে ছাড়ছে না। রাষ্ট্র আমাদের চিকিৎসকদের কথায় কথায় কড়া ধমক দিচ্ছে, রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার হুমকি দিচ্ছে, চাকরি খাবার হুমকি দিচ্ছে। অথচ একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যিনি করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে করোনা-আক্রান্ত হয়েছেন - তাঁর জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা   করেনি। করতে পারেনি নয়, করেনি। এটাও কি আমাদের চিকিৎসকদের জন্য একটি বার্তা - যে আপনারা শুধু সেবা দিয়েই যাবেন, সেবা দিতে দিতে মরবেন। তারপর ভেবে দেখা যাবে - আপনাদের জন্য কী করা যায়। মনে রাখা ভালো যে আপনাদের পদ আছে, কিন্তু পদমর্যাদা নেই।


১৩ এপ্রিল ২০২০

সীমাহীন অব্যবস্থাপনার দায় তো ব্যবস্থাপকদের উপরই বর্তানোর কথা। অথচ বলির পাঁঠা হচ্ছেন তাঁরাই যারা মন-প্রাণ দিয়ে কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন। যুদ্ধে জিতলে সব কৃতিত্ব সেনাপতির - কিন্তু হারলে সব দায় সৈনিকের?


৫ এপ্রিল ২০২০


ঢাকামুখী মানুষের ঢল। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের ফলে সৃষ্ট মহামারীর দায়িত্ব কে নেবেন? পোশাক কারখানার মালিকরা কি দায়িত্ব নেবেন? সরকার কি দায়িত্ব নেবে? দায়িত্ব নেয়া তো দূরের কথা - দায় স্বীকার কি করবেন কেউ? 
ছবি - দীপু মালাকার। প্রথম আলো ৪/৪/২০২০। মাওয়া ঘাট।



৩১ মার্চ ২০২০

করোনা ভাইরাস শুধু বয়স্কদের মধ্যে সংক্রমিত হয় - এমন ধারণা সত্য নয়। অস্ট্রেলিয়ান ডাটা দেখুন।


অস্ট্রেলিয়ায় এপর্যন্ত ৪৫৫৭ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে মেডিকেল টেস্টে প্রমাণিত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৮০০ জনের বয়স ২০ থেকে ২৯ এর মধ্যে। এই ভাইরাস নারী-পুরুষ বিচার করে না। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ এবং নারীর সংখ্যা প্রায় সমান। দয়া করে ঘরে থাকুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। রাস্তা খালি পেয়ে যারা ক্রিকেট খেলছেন, দল বেঁধে আড্ডা দিচ্ছেন অলিতে-গলিতে - আপনারা ডাক্তারদের কাজ কঠিন থেকে কঠিনতর করে দিচ্ছেন। প্লিজ নিজেকে এবং আপনার পরিবারকে সুস্থ রাখার দায়িত্বটুকু পালন করুন।


২৭ মার্চ ২০২০
গত শুক্রবার সিডনির বন্ডাই বিচ গিজগিজ করছিলো। তারপর পুলিশ দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দিতে হয়েছে। আজ একই ঘটনা ঘটেছে মেলবোর্নের সেন্ট কিলদা বিচে। পৃথিবীজুড়েই কি অবিবেচক বাকসর্বস্ব মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, যারা সবসময় ভুল কাজ করবে আর অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবে?




২৬ মার্চ ২০২০
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা সবার। সবার ভেতরই আতঙ্ক কাজ করছে, আক্রান্ত হবার আতঙ্ক। লক ডাউন চলছে। বেশিরভাগ মানুষ ইচ্ছেয়, আবার কেউ কেউ ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও ঘরে থাকছেন। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘরে থাকার উপায় নেই। রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একেবারে সামনে থেকে যাদের যুদ্ধ করতে হয় - তারা হলেন ডাক্তার, নার্স, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য তাঁদের হাসপাতালে যেতে হয়, ক্লিনিকে যেতে হয়। রাষ্ট্র আদেশ জারি করেছে - জীবাণুর বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা-ব্যবস্থা যদি নাও থাকে - তাহলেও জনগণের চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। নইলে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হবে।  লকডাউনের সময় যখন সব ধরনের পাবলিক পরিবহন বন্ধ - তখন ডাক্তাররা কীভাবে কাজে যাবেন সে ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা কারো নেই। অথচ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপদে হাসপাতালে যাতায়াতের ব্যবস্থাটুকু করতে পারেন। করোনা-যুদ্ধে জিততে হলে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ব্যবস্থা করা সবচেয়ে বেশি জরুরি।


২৫ মার্চ ২০২০
বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গের কিছু বাড়িওয়ালা তাদের বাড়ি থেকে ডাক্তার ও নার্সদের চলে যেতে বলছেন, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছেন। কলকাতার কোন কোন "সচেতন" এলাকাবাসী ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীদের এলাকাছাড়া করার দাবি তুলছেন। ধন্য ধন্য। আপনারাই মানুষ - আর ডাক্তাররা তো কসাই। আপনাদের ভাইরাস তারা ধারণ করবে, আপনাদের কফ-থুতু আপনারা তাদের গায়ে মেখে আসবেন, তারপর ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে তাদের বাড়িছাড়া করবেন, এলাকাছাড়া করবেন। আপনারা সবাই ঘরের দরজা বন্ধ করে 'ছুটি' কাটাবেন। আর যে ডাক্তার-নার্সরা ফ্রন্ট-লাইনে থেকে যুদ্ধ করছে আপনাদের প্রাণ বাঁচাতে - তাদের এবং তাদের পরিবারকে অপমান করবেন। এই না হলে আপনারা মানুষ! আপনারা যতই নাক-মুখ ঢেকে রাখুন - ভাইরাস আপনাদের আসল চেহারা প্রকাশ করে দিচ্ছে।


২২ মার্চ ২০২০
বাংলাদেশে অহেতুক হৈ চৈ করার জন্য টাকার অভাব হয় না সরকারের। অথচ এই সংকটকালে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় মাস্ক বা গ্লাভস কেনার টাকা থাকে না। জীবাণুনাশক তো দূরের কথা হাত ধোয়ার পানি পর্যন্ত থাকে না। কিন্তু সবাই মারমুখী হয়ে থাকে ডাক্তারদের গালি দেয়ার জন্য। সবার নিরাপত্তার দরকার আছে, কেবল ডাক্তারদেরই কিছু থাকতে নেই। তাদের ছুটি থাকতে নেই, ঘরসংসার থাকতে নেই, ছেলে-মেয়ে থাকতে নেই, ক্লান্তি থাকতে নেই, ক্ষোভ থাকতে নেই, ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকতে নেই। সমস্ত দায়িত্ব পালন করার পরে সামান্য ধন্যবাদটুকুও তাদের আশা করতে নেই।

২১ মার্চ ২০২০
আর কত নিচে নামবে এসব ব্যবসায়ী? ব্যবহৃত মাস্ক আর গ্লাভস বিক্রি করছে অসহায় আতঙ্কিত মানুষের কাছে! নীচতাতেই কি সেরা হতে হবে আমাদের? জাতি হিসেবে নাকি আমরা ধনী হচ্ছি? তাহলে এসব ব্যবসায়ী দিনে দিনে এত ইতর হচ্ছে কেন?


২১ মার্চ ২০২০
"করোনা ভাইরাস কীভাবে বানাইসে?" 
দিব্যর প্রশ্নে আমরা সবাই হেসে উঠি। মা-বাবা নিয়ম করে দিয়েছে বাসায় কথাবার্তা বাংলায় বলতে হবে। দিব্যর বাংলা উচ্চারণ বেশ মজার। অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে ওঠা আট-নয় বছরের শিশুরা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, কোডিং এসব নিয়েই মেতে থাকে। দিব্যও তার ব্যতিক্রম নয়। সে ভেবেছে করোনা এক ধরনের কম্পিউটার ভাইরাস। 

আমার ক্ষুদে ভাইটির কথায় হেসে উঠলেও - তার প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা ভাইরাসের গঠন কি আমরা সম্পূর্ণ জানি? বিজ্ঞানীরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা এর বৈজ্ঞানিক প্রোফাইল জেনে যাবো এবং প্রতিষেধকও পেয়ে যাবো। 

কিন্তু তার আগে এর সংক্রমণ রোধ করা জরুরি। সাধারণ মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ তাঁদের প্রত্যেকেই মনে করেন - এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য অন্য কেউ দায়ী। এই জায়গায় আমাদের অহং অনেক বেশি কাজ করে। আমরা কিছুতেই স্বীকার করতে চাই না যে আমাদের ভুল আচরণের কারণে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে। কমন সেন্স কাজ করে না আমাদের আবেগ কিংবা ইগোর কারণে। অনেকদিন বিদেশে থাকার পর অনেকের অহংকার যে হারে বেড়েছে, বিবেচনাবোধ সে হারে বাড়েনি সেটাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। দিনের শেষে এদের কেউই তাদের নিজেদের ভুলের দায় স্বীকার করবেন না। তাই দায়িত্বপূর্ণ পদে যারা আছেন তাদের যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং তা বাস্তবায়নের জন্য দরকার হলে বল প্রয়োগ করতে পারতে হয়। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত কি যথাসময়ে নেয়া হচ্ছে? 

অস্ট্রেলিয়ায় পার্সোনাল স্পেস অনেক বেশি। তাদের সারাদেশে যত শিক্ষার্থী আছে বাংলাদেশের শুধু মাত্র ঢাকা শহরেই আছে তার চেয়ে বেশি পরীক্ষার্থী। তবুও অস্ট্রেলিয়ার যে ন্যাপল্যান টেস্ট (National Assessment Program - Literacy and Numeracy (NAPLAN)) হবার কথা ছিল মে মাসের মাঝামাঝি থেকে, সেই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু এপ্রিল মাসের শুরুতেই আমাদের সারাদেশে যে  উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে - তা এখনো পেছানো হয়নি, কোন সিদ্ধান্তও নেয়া হয়নি। রাষ্ট্র কি এখনো  বিশ্বাস করছে যে আগামী দশ দিনের মধ্যে কোন অলৌকিক উপায়ে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে?

****22/3/2020 আপডেট - এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সুবিবেচনার জন্য কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।

১৮ মার্চ ২০২০
COVID-19 ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য ভিক্টোরিয়া রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে ১৬ মার্চ থেকে পরবর্তী চার সপ্তাহের জন্য। রাজ্যের চিফ হেল্‌থ অফিসার অর্থাৎ প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তার হাতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার আইনী ক্ষমতা দেয়ার লক্ষ্যেই এই জরুরি অবস্থা। এই সময়ে প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তাই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন এবং তা সবাই মেনে চলবেন। মেলবোর্নের স্টেট লাইব্রেরি, ন্যাশনাল গ্যালারি, মিউজিয়ামসহ অন্যান্য অনেক কিছু সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে যাতে জনসমাগম রোধ করা যায়। কোন ব্যক্তি যদি জরুরি নির্দেশনা না মানেন তাকে বিশ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হতে পারে সাথে জেলও হতে পারে। আর কোন প্রতিষ্ঠান যদি নির্দেশনা না মানে তবে এক লক্ষ ডলার জরিমানা হতে পারে। রাজনৈতিক চাপাবাজি এখানেও আছে। তবে আপাতত জরুরি অবস্থায় তারা সবাই প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করছেন। অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য রাজ্যেও অনুরূপ ব্যবস্থা চলছে।






No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts