Tuesday, 22 June 2021

অ্যালিয়েনের খোঁজে

ছবি: Flickr, creative commons licenses

অ্যালিয়েন শব্দটার আক্ষরিক অর্থ  'ভিনদেশি' বা 'বিদেশি' হলেও আমরা কিন্তু অ্যালিয়েন বলতে বুঝি অন্যগ্রহের প্রাণী। অবশ্য আমেরিকানদের অনেকে নিজের দেশকেই মনে করে সমগ্র পৃথিবী এবং অন্য দেশ থেকে যারা আমেরিকায় আসে তাদেরকে তারা 'অ্যালিয়েন' বলে ডাকে। কল্পবিজ্ঞান লেখকদের হাতে অতিউন্নত অ্যালিয়েনের জন্ম হয়েছে ঠিক, কিন্তু পৃথিবীতে অন্য গ্রহ-নক্ষত্র থেকে মানুষ আসার ধারণাটা আরো অনেক প্রাচীন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোককাহিনিগুলোতে অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণির অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা আছে। সেসব কাহিনিতে অন্য গ্রহ থেকে প্রাণি শুধু নয়, পুরো গ্রহ-নক্ষত্রগুলোই পৃথিবীতে চলে আসে মানুষের বেশে। সূর্য, চাঁদ, মঙ্গল, শনি - এসবের বিজ্ঞান জানার পরেও এখনো অনেক মানুষ বিশ্বাস করে এগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। কয়েক হাজার বছর আগে পৃথিবী ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের সঠিক কোন ধারণা ছিল না - তখন ভয় ও অজ্ঞানতা থেকে অনেক অন্ধবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল। পরে বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও উন্নতির সাথে সাথে অনেক অন্ধবিশ্বাসের অবসান হলেও কিছু কিছু ব্যাপারে মানুষের বিশ্বাস এখনো রয়ে গেছে। অ্যালিয়েনে বিশ্বাস হলো সেগুলোর অন্যতম।

পৃথিবী ছাড়াও অন্য আরো অনেক গ্রহে প্রাণি আছে এবং তারা মানুষের চেয়েও উন্নত - এরকম কথায় বিশ্বাস করে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে 'নিউইয়র্ক পোস্ট' পত্রিকা পৃথিবীর চব্বিশটি দেশের ২৬০০০ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদনে দাবি করে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বিশ্বাস করে অ্যালিয়েন আছে এবং তারা মানুষের চেয়ে উন্নত। মাত্র ছাব্বিশ হাজার মানুষ সাত শ কোটি মানুষের হয়ে মত দিতে পারে না সেটা আমরা জানি। কিন্তু জরিপগুলো এরকমই হয়। নিজেদের চারপাশের মানুষের মতামত নিলেও আমরা দেখবো বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে অন্যগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক মানুষ মাঝে মাঝে দাবি করেন যে তাদের সাথে অ্যালিয়েনের দেখা হয়েছে, কিংবা অ্যালিয়েনরা এসে তাদেরকে কোথাও ধরে নিয়ে গেছে, কিংবা অবিশ্বাস্য অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। অনেক গুপ্তহত্যাকান্ডকেও অ্যালিয়েনের কাজ বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই ইউ-এফ-ও বা unidentified flying object দেখেছেন বলে দাবি করেন। অ্যালিয়েনের সাথে মানুষের সাক্ষাৎ ঘটার ব্যাপারটা যে পুরোপুরি বানানো সেটা মানতে রাজি নন অনেকে। এই অনেকের মধ্যে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও আছেন। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাইকিয়াট্রির প্রফেসর জন ম্যাক বিশ্বাস করতেন যে অ্যালিয়েনরা আছে এবং তারা মানুষের সাথে দুর্ব্যবহারও করে। এ নিয়ে "অ্যাবডাকশান: হিউম্যান এনকাউন্টার উইথ অ্যালিয়েনস" নামে একটা ঢাউস বইও লিখেছিলেন তিনিবইটাতে যেসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন - সেগুলো সবই মানুষের সাথে অ্যালিয়েনের সংযোগ, সংঘাত ইত্যাদি নিয়ে। এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে এগুলো সব সত্য ঘটনা।

কিন্তু বিশ্বাস আর প্রমাণ এক জিনিস নয়। প্রমাণ করা না গেলে সেটা আর যাই হোক - বিজ্ঞান নয়। কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করলেও কিংবা জন ম্যাকের মত পুলিৎজার পুরষ্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী/লেখক বললেও প্রমাণ না পেলে অ্যালিয়েনকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেয়া বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়।  বিজ্ঞানীরা এখনো কোন ইউ-এফ-ও'র প্রমাণ পাননি, খুঁজে পাননি অ্যালিয়েনের অস্তিত্ব।

কিন্তু এত বড় মহাবিশ্বের এত এত সৌরলোকের কোটি কোটি গ্রহ-উপগ্রহের মধ্যে আমাদের পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও কি প্রাণের উদ্ভব ঘটেনি? মহাবিশ্বে পৃথিবী কি আসলেই একা? এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য বিজ্ঞানীরা অ্যালিয়েনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন অনেক অনেক বছর থেকে - যখন থেকে মহাবিশ্বের স্বরূপ বুঝতে পেরেছে তখন থেকে। আমাদের মহাবিশ্বের আয়তন বিশাল। সবচেয়ে বড় আয়তন কত হতে পারে তার একটা হিসেব আমরা সহজে করে নিতে পারি। প্রায় চৌদ্দ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং থেকে উদ্ভব হবার পর মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। সর্বোচ্চ বেগ আলোর বেগেও যদি এটা প্রসারিত হয় - তাহলে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত সর্বোচ্চ দূরত্ব হতে পারে ১৪০০ কোটি আলোকবর্ষ - অর্থাৎ ১৪০০ কোটি বছরে আলো যতদূর যেতে পারে ততটুকু। সেভাবে হিসেব করে যে আয়তন পাওয়া যায় সেখানে আনুমানিক এক শ বিলিয়ন বা দশ হাজার কোটি গ্যালাক্সি আছে। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে আছে প্রায় দশ হাজার কোটি সূর্য। সুতরাং মহাবিশ্বে যত সূর্য আছে তাদের মোট সংখ্যা পৃথিবীতে মোট যত বালিকণা আছে তার চেয়েও শত গুণ বেশি। সেই সব সূর্যের সবগুলো গ্রহ ও উপগ্রহের মোট সংখ্যা যে কত হবে তা ভেবে দেখার বিষয়। এত বিশাল সংখ্যক গ্রহ-উপগ্রহের মধ্যে শুধুমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণের উদ্ভব হয়েছে - আর কোথাও হয়নি এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।

কিন্তু প্রশ্ন সেখানেই - অন্যগ্রহের প্রাণিগুলো তাহলে কোথায়? কল্পকাহিনি ছাড়া বাস্তবে তাদের প্রমাণ নেই কেন? নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি এই প্রশ্ন করেছিলেন ১৯৫০সালে। অ্যালিয়েনের অস্তিত্ব সম্পর্কে ফার্মি'র মন্তব্য "তারা সব কোথায়?" ক্রমে পরিণত হয় প্যারাডক্স বা কূটাভাসে - যা 'ফার্মি প্যারাডক্স' নামে পরিচিতি লাভ করে। গ্যালাক্সিজুড়ে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার জন্য  জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মাইক্রোওয়েভ বেতারতরঙ্গ ব্যবহার করতে শুরু করেন ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে। ১৯৬১ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ড্রেইক মহাবিশ্বে পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজের পাবার সম্ভাবনার একটি যুগান্তকারী সমীকরণ দেন - যা ড্রেইক ইকুয়েশান নামে প্রসিদ্ধ। ড্রেইক ধারণা দেন যে বিশাল এই মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব থাকলেই যে আমরা তা খুঁজে পাবো এমন কোন কথা নেই। খুঁজে পেতে হলে তাদেরকে আমাদের সমান বা আমাদের চেয়েও উন্নত হতে হবে। তাই আমাদের দেখতে হবে আমাদের মত সভ্যতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা মহাবিশ্বের আর কোথায় আছে। ড্রেইকের সমীকরণটি লেখা হয় এভাবে: N = R* x fp x ne x fl x fi x fc x L - অর্থাৎ মহাবিশ্বে সভ্যতার সম্ভাবনাময় জায়গার সংখ্যা (N) হলো নক্ষত্র সৃষ্টির হার (R*), সেই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে গ্রহ থাকার সম্ভাবনা (fp), গ্রহগুলোর মধ্যে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা (fl), প্রাণসম্পন্ন গ্রহগুলোর মধ্যে সভ্যতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা (fc), এবং সেই সভ্যতা কত বছর টিকে থাকবে (L) তার সংখ্যার গুণফলের সমান। এই সমীকরণ অনুযায়ী হিসেব করে দেখা গেলো মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাবার মত সভ্যতাসম্পন্ন গ্রহের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। কিন্তু সমস্যা হলো সমীকরণের প্রত্যেকটি উপাদানই অনুমাননির্ভর। ১৯৬১ সালে ফ্রাঙ্ক ড্রেইক এবং আরো কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর উদ্যোগে শুরু হয় সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা SETI প্রকল্প। ১৯৭৫ সালে নাসা এই প্রকল্পকে স্বীকৃতি দেয় এবং প্রকল্পের অর্থ ও কারিগরী সহায়তা দিতে শুরু করে। নাসার সহায়তার বাইরেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে SETI'র বিভিন্ন প্রকল্প চালানো হয়। ১৯৮৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় গঠিত হয় SETI ইন্সটিটিউট। ১৯৮৮ সালে নাসার উদ্যোগে SETI প্রকল্পের জন্য যন্ত্রপাতি প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত নাসা SETI প্রকল্পের সহায়তাকল্পে প্রজেক্ট অরিয়ন, মাইক্রোওয়েভ অবজারভিং প্রজেক্ট, হাই রেজ্যুলেশান মাইক্রোওয়েভ সার্ভে সিস্টেম - ইত্যাদি বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয় - যার সবগুলোরই উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া। কিন্তু আশা জাগানোর মত কোন ফল পাওয়া যায়নি। ১৯৯৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেস SETI প্রকল্প বাতিল করে দেয়। নাসার সহায়তা না পেলেও SETI ইন্সটিটিউট তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে। কিন্তু মহাবিশ্বের আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি এখনো।

তাই বলে বিজ্ঞানীরা হাল ছেড়ে দেননি। বরং আরো জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে। ১১ মার্চ ২০১৯ আমেরিকান সরকার নাসার ইওরোপা ক্লিপার মিশনের জন্য ৬০ কোটি ডলার দিয়েছে। এই মিশন বৃহস্পতির উপগ্রহ ইওরোপায় প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধান করবে। ২০২৩ সালে এই মিশন পাঠানো হবে ইওরোপায়। বৃহস্পতির বরফাচ্ছন্ন উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা খুব আশাবাদী। ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সিও জুপিটার আইসি মুন্‌স এক্সপ্লোরার বা JUICE প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০২২ সালে তারা স্যাটেলাইট পাঠাবে সেখানে। প্রাণের উদ্ভব ঘটার জন্য যা যা দরকার তার কী কী আছে সেখানে - তা খুঁজে দেখবে JUICE। এখানেও যদি প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া না যায়, তখন কী হবে? আরো চেষ্টা চলবে। অবশ্য কেউ কেউ ইতোমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন - অ্যালিয়েনরা মানুষের চেয়ে এত বেশি চালাক যে মানুষের সাধ্য নেই তাদের খুঁজে বের করে। আবার কেউ কেউ আরো এক কাঠি বাড়িয়ে বলে ফেলেন - অ্যালিয়েনরা এই পৃথিবীতেই আছে মানুষের বেশে, হয়তো আপনার আশেপাশেই ঘুরছে, আপনি চিনতে পারছেন না। কিন্তু আপনি যদি বিজ্ঞানচিন্তা করেন, তাহলে আপনি প্রমাণ ছাড়া কোন কিছুই বিশ্বাস করবেন না। কারণ যা প্রমাণ করা যায় না, তা বিজ্ঞান নয়।

_____________

বিজ্ঞানচিন্তা এপ্রিল ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত



No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts