Saturday 19 June 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ২৫

 


স্বপ্নলোকের চাবি – ২৫

 

ট্রেন থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে ক্যাম্পাসগামী বাসের দিকে যাবার সময় যীশু বললো – “ওডা, বাদলদা ত আইয়ের পা-আল্লা।“

বাসে উঠে বসতে না বসতেই যীশুর কথা সত্য হয়ে গেল। ‘বাদলদা’ অর্থাৎ বৃষ্টি এসে গেল হুড়মুড় করে।

গত ক’দিন থেকে সারাদেশে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। বন্যার্তদের সত্যিকারের সাহায্য কতটুকু করা হচ্ছে জানি না, কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরশাদ বন্যা উপলক্ষে যে গান রচনা করেছেন সেই গান টেলিভিশনে বাজানো হচ্ছে প্রতি সন্ধ্যায় বুলেটিন আকারে। সেখানে দেখানো হচ্ছে প্রেসিডেন্ট সাহেব সাঙ্গপাঙ্গসহ হাঁটুউঁচু বুট পরে বন্যার পানিতে হাঁটছেন। দেখানোপনা কীভাবে করতে হয় তা তিনি ভালোভাবেই জানেন। বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখল করার পর তিনি একদিন সাইকেল চালিয়ে অফিসে গিয়েছিলেন। তার সামনে পেছনে ছিল টেলিভিশন-ক্যামেরা। তাঁর সেই মহান সাইকেল চালানোর ঘটনা অসংখ্যবার প্রচারিত হয়েছে বিটিভিতে। সেই সাইকেল এখন কোথায় কে জানে। এখন বন্যার খবর যতটা প্রচারিত হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি প্রচারিত হচ্ছে বুটপরা প্রেসিডেন্টের বন্যার পানিতে হাঁটার খবর।

আমাদের এদিকেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে – তবে এখনো রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ ডুবে যায়নি। কাল রাতে বৃষ্টি হয়নি। সকালেও আকাশ ফর্সা ছিলো, ঝলমলে রোদও ছিল। নাথ সকালে সাইকেল চালিয়ে আমার রুমে এসে সাইকেল রেখেছে। তারপর দুজন একসাথে হাঁটতে হাঁটতে ফতেয়াবাদ স্টেশনে এসে ফার্স্ট ট্রেনে ক্যাম্পাসে এসেছি।

যীশু সাধারণত ট্রেনে আসে না, আজ টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আছে বলেই ট্রেনে এসেছে। পরীক্ষা থাকলে কেন সে ট্রেনে আসে তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানি না। ক্যাফেটোরিয়ার সামনে বাস থেকে নেমে সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে আসতে আসতে আধভেজা হয়ে গেলাম। নাথের ছাতাটি ছোট। সেখানে দু’জনের মাথা কোনরকমে গুঁজেছি, কিন্তু শরীরের বাকি অংশ ভিজে গেছে।

এখন আষাঢ় মাসের প্রায় শেষের দিকে। আকাশের অবস্থা অভিমানী আফ্রিকান রাজকন্যার মতো – থমথমে কালো। আক্ষরিক অর্থেই এখন “নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।“ কিন্তু রবিঠাকুরের সাবধানবাণী - “ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে” মানার উপায় আমাদের ছিল না। ক্লাসে যে কোনদিন আসে না, সেও এসেছে আজ টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দেয়ার জন্য। ফরায়জি কামালস্যার আজ ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নেবেন। ধরতে গেলে এটাই আমাদের প্রথম টিউটোরিয়াল পরীক্ষা। ফার্স্ট ইয়ারে টিউটোরিয়ালের নম্বর কীভাবে দিয়েছে জানি না। আমাকে দশের মধ্যে পাঁচ দেয়া হয়েছে। সেকেন্ড ইয়ারে আর কোন পেপারের টিউটোরিয়াল পরীক্ষা হবে কি না তাও জানি না। তবুও ভালো যে ফরায়জি কামালস্যার পরীক্ষা একটা নেবেন বলেছেন।

ফার্স্ট পিরিয়ডে পরীক্ষা। সময় হয়ে গেছে, কিন্তু স্যারের দেখা নেই। মিজান, তাজুল, হারুন, শাকিল, দৌলতুজ্জামান দুলাল – এরা বেশ কয়েকবার করিডোরের এদিক সেদিক ঘুরে এসেছে স্যারের সন্ধানে। কিন্তু স্যারের দেখা নেই।

আমাদের ক্লাস ছাড়া অন্য ইয়ারের ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও খুব কম আজ। প্রেমাঙ্কর এসে খবর দিলো – ডিপার্টমেন্টে প্রামাণিকস্যার ছাড়া আর কোন স্যারই আসেননি আজ এই বৃষ্টিতে। প্রামাণিকস্যার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। যন্ত্রের মতো দায়িত্ব পালন করেন। ঝড়বৃষ্টি গ্রীষ্মবর্ষা কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। কিন্তু ফরায়জি কামালস্যারও তো কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষক। কোন ধরনের সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়।

আমান আর আজিজ গেলো নোটিশবোর্ড চেক করতে – কোন নোটিশ যদি থাকে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের নোটিশবোর্ডে মাঝে মাঝে কিছু নোটিশ লাগানো হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে টাইপ করে। খুব কাছে গিয়ে না দেখলে চোখেও পড়ে না ওগুলি। এখানে আমাদের কোনকিছু জানানোর দায়িত্ব কেউ নেন বলে মনে হয় না। আমাদের যা কিছু দরকার আমাদের নিজেদের দায়িত্বেই তা জেনে নিতে হয়।

আধঘন্টা ধরে বসে রইলাম সবাই। স্যারের দেখা নেই। ডিপার্টমেন্টের কেউ কিচ্ছু জানেন না। স্যার কি ডিপার্টমেন্টে ফোন করে একটা নোটিস দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারতেন না?

মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো এত স্বাধীনতা আর কোন পেশায় নেই। এখানে কাউকে কোন কিছুর জবাবদিহি করতে হয় না। সারাবছর একটা ক্লাসও যদি কেউ না নেন, সম্ভবত কেউ জিজ্ঞেসও করেন না।

কেউ কেউ ক্লাস থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে গেল। আমরা বেশিরভাগই বসে রইলাম ক্লাসে। এরপর ম্যাথস সাবসিডিয়ারি ক্লাস আছে।

ক’দিন আগে ম্যাথস আর স্ট্যাটিসটিক্স সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে স্ট্যাটিসটিক্স প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা আছে। স্ট্যাটিসটিক্সের বড় বড় গাণিতিক ফর্মুলাগুলি সব মুখস্থ করতে জান বের হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সেকেন্ড ইয়ারের সাবসিডিয়ারি ক্লাসও চলছে। এই সাবসিডিয়ারি বস্তুটা অদ্ভুত। সাবসিডিয়ারিতে ভালো নম্বর পেলেও তা অনার্সে যোগ হবে না, অর্থাৎ কোন লাভ হবে না। কিন্তু সাবসিডিয়ারি পাস  করতে না পারলে অনার্স ডিগ্রি দেয়া হবে না। অর্থাৎ সাবসিডিয়ারি হলো এমন কিছু সাবজেক্ট যা তোমার উপকার করবে না, কিন্তু ক্ষতি করতে পারবে।

“আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে, জানিনে জানিনে, কিছুতে কেন যে মন লাগে না” – গুনগুন করে গাইছে কেউ। বেশ মিষ্টি গলা। চিত্রলেখা চৌধুরি কি? মেয়েদের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। না,  চিত্রলেখা চৌধুরি নন। শুরুতে কে গাইছিল বুঝতে পারিনি – এখন লিপি, ইলা, পারুল, রানু একসাথে গাইছে। চিত্রলেখা আজ আসেননি। তিনি সম্ভবত টিউটোরিয়েলের ধার ধারেন না। অবশ্য যেদিন আমাকে ক্লাসনোট ফটোকপি করতে বলেছিলেন, সেদিনের পর তাকে আর কোনদিন দেখিনি ক্লাসে।

বাইরের পরিবেশের সাথে রবীন্দ্রনাথের গান এমন সুন্দরভাবে মিলে গেছে যে ক্লাসের মধ্যে মনে হচ্ছে একটা আশ্চর্য জগত তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই দেখলাম রিনা আর রুমা গভীর মনযোগে লেখাপড়ায় মগ্ন।

পড়াশোনার ব্যাপারে রিনা যে খুবই সিরিয়াস – সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। নইলে ক্লাসের ভিড়ের মধ্যে বসে কেউ এভাবে ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স পড়তে পারে? অবশ্য শুধু ক্লাসের ভীড়ে কেন – তাকে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে দেখেছি - পড়ছে। হাতে গোনা যে ক’বার আমি লাইব্রেরিতে গিয়েছি – প্রতিবারই তাকে দেখেছি লাইব্রেরিতে – পড়ছে। হঠাৎ সে বই থেকে মুখ তুলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো আমার দিকে। স্বাভাবিক রিফ্লেক্সেই আমার মুখে দাঁত-বের-করা হাসি। কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট বিরক্তি। সে নাকচোখ কুঁচকে এ্মনভাবে তাকালো যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। শুধু আমি কেন এভাবে তাকালে বাঘও ভয় পেয়ে যাবে। আমি চোখ সরিয়ে রুমার দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে গেলাম।

রুমা পড়ছে শংকরের তীরন্দাজ। এই বইটি সম্ভবত বাংলাদেশে সম্প্রতি এসেছে। মুকিতভাই আমাকে ক’দিন আগে উপহার দিয়েছেন এই বই। বইটা পড়া হয়ে গেছে আমার। নিজেকে জাহির করার সুযোগ পেলে ছাড়া যায় নাকি? রুমাকে বললাম, “নারীরা অগ্নি থেকে জল, আর জল থেকে অগ্নি সৃষ্টি করতে পারে।“ রুমা বই থেকে চোখ তুলে হাসিমুখে বললো, “তুমি পড়ে ফেলেছো এর মধ্যে?”

আমি এমনভাবে মাথা নাড়লাম যেন পড়ে ফেলাটাই তো স্বাভাবিক। রিনা বেশ গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি উপন্যাস পড়ো?”

“পড়বো না কেন?”

আমার উত্তর শুনে রিনার মুখের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। কিন্তু আমার মনে হলো সে সম্ভবত সিলেবাসের বাইরের কোনকিছু ধরেও দেখে না।

একটু পরে নিচের তলার এক নম্বর গ্যালারিতে ম্যাথস সাবসিডিয়ারি ক্লাস। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর স্ট্যাটিসটিক্সের ছেলেমেয়েরা ম্যাথস সাবসিডিয়ারি নেয়। আজ কেমিস্ট্রি ও স্ট্যাটিসটিক্সের শিক্ষার্থী তেমন কেউ আসেনি। ক্লাস হবে বলেও মনে হচ্ছে না। আমরাই বসে বসে গল্প করতে লাগলাম।

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। গ্যালারিগুলি বানানো হয়েছে পাহাড় কেটে। বাইরে পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টি পড়তে পড়তে গ্যালারির পেছনের দেয়াল ভিজে গেছে। একটা ক্ষীণ পানির ধারা গ্যালারির উপর থেকে নিচের দিকে গড়িয়ে নামতে নামতে সামনের ফ্লোরে এসে জমা হয়েছে।

আর কোন ক্লাস হবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এত জোরে বেশি নেমেছে যে ফ্যাকাল্টি থেকে বের হবার জো নেই। যে যার মতো ছোট ছোট গ্রুপে গল্প হচ্ছে।

আমরা যারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত - আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলি। অঞ্জন, অর্পন, নাথ, আমি, যীশু, আশিস দাশগুপ্ত, মানস – চুটিয়ে গল্প করছি। মেয়েদের মধ্যে ধরতে গেলে কেউই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না। শীলা আমাদের সাথে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করলেও – মেয়েদের কারো সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না। ইলা আমার সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে বাধ্য হয়ে। কারণ যারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা জানে – তাদের সাথে আমি প্রমিত বাংলায় কথা বলি না। শহরে বড় হওয়া চট্টগ্রামের অনেকেই আঞ্চলিক ভাষা জানে না। একটা ভাষা শেখা থেকে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে হয় আমার।

“অ্যাই তোরা কী কদ্দে?” – লিপির মুখে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা শুনে মনে হলো ফরাসিরা বাংলা বললে এরকমই শোনাবে। লিপি আমাদের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করছে দেখে রিনা সম্ভবত রেগে গেলো। সে বললো, “ক্লাসের ভেতর এভাবে কথা বলছিস কেন?”

কথায় কথায় জানা গেল রিনার বাড়িও চট্টগ্রামে। আর যায় কোথায়। এবার তার সাথেও আমরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা শুরু করলাম। কিন্তু তার মুখ থেকে একটাও আঞ্চলিক শব্দ বের হলো না। মনে হলো সে আমাদের কথা বোঝে, কিন্তু বলতে পারে না। এরকম হতেই পারে। আমার মনে হলো চট্টগ্রামের ভাষাটা তার শেখা দরকার। তাকে বললাম সে কথা -  “তোঁয়ার চিটাগাইংগা শিঘন উচিত।“  

সে বিরক্ত হয়ে বললো, “কখনোই না।“

এতক্ষণ দিলীপ বর্ধন চুপচাপ শুনছিলো আমাদের কথা। রিনার বিরক্ত হওয়া দেখে সে বললো, “রিনা, তুমি তো সিলেটি শিখবে।“

দিলীপের কথা শুনে আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। কিন্তু রিনার চোখ জ্বলে উঠলো রাগে।

দিলীপ সাধারণত কথাবার্তা খুব বেশি বলে না। কিন্তু আজ সে রিনাকে সিলেটি ভাষা শেখানোর ব্যাপারে এত আগ্রহী হয়ে উঠলো কেন বুঝতে পারছি না।

বৃষ্টি কিছুটা কমলে ট্রেন স্টেশনে এলাম। দেড়টার ট্রেনে খুব একটা ভীড় নেই আজ। ট্রেন লাইনের দুই পাশের জমির কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অথৈ সাগরের মাঝখানে শুধুমাত্র রেললাইনটি জেগে আছে। কোন কোন জায়গায় রেললাইনও ডুবে গেছে। প্রায় শামুকের গতিতে চলতে হচ্ছে ট্রেন। ফতেয়াবাদ স্টেশনে নামার পর দেখলাম রাস্তা ডুবে গেছে। জামা-কাপড় ভিজে গেছে ইতোমধ্যে। যে রাস্তা দিয়ে স্টেশন থেকে আমাদের বিল্ডিং-এর মেইন রোডে আসি সেই রাস্তায় এক হাঁটু পানি। নাথের ছাতায় দু’জনে মাথা ঢেকে এক সাথে হাঁটার উপায় নেই। পানিতে স্রোত আছে, রাস্তা পিচ্ছিল। সরু রাস্তা থেকে ছিটকে পড়লে সাঁতার দিতে হবে।

আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নাথ বললো, “তরে ছাতি আইন্ত কইলাম, ন হুনস”।

সকালে বের হবার সময় সে আমাকে ছাতা নিয়ে বের হতে বলেছিল। “রইদর বিশ্বাস নাই, ছাতি ল” –রুম থেকে বের হবার সময় বলেছিল সে। বর্ষাকালের রোদকে বেশি বিশ্বাস করতে নেই জানতাম। কিন্তু আপাতত আমার বহনযোগ্য কোন ছাতা নেই। আমার নতুন ছাতা হারানো গেছে, পুরনো ছাতার ‘শুধু ক’টি শিক আছে’ অবস্থা। লম্বা ছাতাটি অনেক বছরের ব্যবহারে জীর্ণ হবার কারণে রেয়াজুদ্দিন বাজার থেকে একটি চায়নিজ ফোল্ডিং ছাতা কিনেছিলাম। দোকানদার বলেছিল তিন বছরেও কিছু হবে না। কিন্তু তিন দিনের মাথায় সেই ছাতা উধাও হয়ে গেছে। দিদির বাসায় গিয়েছিলাম। তার দেবর আমার ছাতা হাতে নিয়ে বের হয়েছিলেন, এবং ঘন্টাখানেক বাদে খালিহাতে ফিরে এসেছিলেন। জিজ্ঞেস করলে রেগে গিয়ে বলেছিলেন – ওরকম ছাতা ইচ্ছে করলে তিনি কয়েক হাজার কিনে দিতে পারেন। তিনি নিজে এক পয়সাও রোজগার করেন না, দাদা-বৌদির দেয়া টাকায় বাহাদুরি করেন, আর বাপের অদৃশ্য জমিদারির বড়াই করেন। সুতরাং তার চাপার নিচে আমার ছাতা-প্রসঙ্গ চাপা পড়লো। আরেকটি ছাতা কেনার জন্য আমাকে মাসের শেষ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। টিউশনির টাকা পাবো, তবে আরেকটি ছাতা হবে। 

নাথকে এসব বলা হলো না। বৃষ্টির তোড় এত বাড়লো যে আর এগুনো গেলো না। পাশের পাড়ার রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। একটা বাড়ীর সামনে একটা খালি রিকশা। সম্ভবত এটা রিকশাওয়ালার বাড়ি। আমরা দু’জন রিকশায় উঠে কোন রকমে বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচালাম। ঘন্টাখানেক পরেও বৃষ্টি কমার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।

আবার হাঁটা। মেইন রোডে উঠে আমাদের বিল্ডিং-এর দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। বিল্ডিং-এর আশেপাশে জমি, পুকুর কিছুই আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না – সব বন্যার ঘোলা পানিতে একাকার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সাগরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাদা বিল্ডিং- যার নিচের তলার অর্ধেকটা পানির নিচে।

নিচের তলার প্রত্যেকটি রুমে এখনো দুই ফুট পানি। দেয়ালে পানির দাগ দেখে মনে হচ্ছে পানি আরো অনেক উপরে উঠেছিল। এখন নামতে শুরু করেছে। টয়লেট ডুবেছে, সেপটিক ট্যাংক ডুবেছে – তার মানে যে পানির উপর দিয়ে এখন রুমে ঢুকছি – তা কিসের পানি বুঝতে পারছি।

রুমে ঢুকে কী করা উচিত বুঝতে পারছি না। রুমের ভেতর ভাসছে আমার বইপত্র, নোট, ডেকসি-পাতিল, স্টোভের কেরোসিন। খাটের নিচে ছিল আমার টিনের ট্রাংক। অক্ষত থাকলে ওটা পানিতে ভাসতো। কিন্তু শিবিরের তলোয়ারের ক্ষতস্থান দিয়ে পানি ঢুকে এখন সেটা অর্ধ-নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসছে। ভেতরে আমার দরকারি কাগজপত্র, জামাকাপড় সব ভিজে গেছে। বুকশেল্‌ফ-এর দুই তাক বরাবর পানি উঠেছিল। পানি নামার সময় বইগুলিও ভাসিয়ে নিয়েছে। ভাসমান বই-খাতাগুলিকে ধরে ধরে খাটের উপর তুলে রাখলাম। বিছানাও ভিজে গেছে। সাবসিডিয়ারি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্য যত প্রস্তুতি নিয়েছিলাম সব গেছে বানের পানিতে। কম টাকায় বেশি কাগজ কেনার জন্য নিউজ প্রিন্টে লিখি। নিউজপ্রিন্টে লেখা সব নোট ভিজে ফুলে উঠেছে।

শখ করে কিছু গল্প আর দুটো নাটক লিখেছিলাম। সেই পান্ডুলিপি ট্রাংকের ভেতর ছিল। সব গেছে। আজাদীতে আমার কয়েকটি গল্প ছাপানো হয়েছিল। সেগুলির কাটিং ছিল বাক্সে। সব গেছে।

নাথের সাইকেলের সিট পর্যন্ত পানি উঠেছিল। সে তার সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকালাম। এই প্রচন্ড ঝামেলার মধ্যেও আমাদের লাফিং ডিজিজ শুরু হয়ে গেল। আমরা দুজনই হা হা করে হাসতে শুরু করলাম।

সব পানি নেমে যাবার আগে কিছুই করা যাবে না। নাথ তার সাইকেল নিয়ে, আর আমি একটা ব্যাগে ভেজা জামা-কাপড় কিছু নিয়ে বের হয়ে গেলাম।

পরের দিন বৃষ্টি একটু কমেছে। শহর থেকে সরাসরি ক্লাসে গেলাম। ফরায়জি কামালস্যার ক্লাসে এসেই বললেন, আজ তোমাদের পরীক্ষা। গতকাল মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম – পরীক্ষা হয়নি। আর আজ? কাল যে কী অবস্থার ভেতর আমার গেছে তা তো আর কাউকে বলা যাবে না। স্যার বলছেন পরীক্ষা, সুতরাং পরীক্ষা। রিনাকে দেখে আমার শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। সে ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স পড়া একবারও বন্ধ করেনি।

স্যার বললেন – তোমরা নিজেদের কাগজে নাম রোলনম্বর আর প্রশ্নের উত্তর লিখে আমাকে জমা দেবে।

স্যার বোর্ডে প্রশ্ন লিখলেন – ‘রাইট অ্যানি টু কোয়েশ্চেন অব ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স এন্ড এনচার দেম’  

এধরনের ব্যাপারের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এভাবে টিউটোরিয়েল পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারটা আগে কোথাও ঘটেছে কি? আমার জানা নেই। পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন জানি। কিন্তু প্রশ্ন করাটাই যদি পরীক্ষা হয়, তা যে তার চেয়েও কঠিন, তা আজ বুঝলাম। 

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>

<<<<<<<<< আগের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts