Saturday, 12 June 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ২৪

 


স্বপ্নলোকের চাবি – ২৪

অনেকক্ষণ থেকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি, কিন্তু ঘুম আসছে না। বিছানা বদল হলে অনেক সময় ঘুম আসতে চায় না। কিন্তু আজ বিছানা বদল হওয়া ছাড়াও আরো অনেক কারণ আছে ঘুম না আসার। পাশের খাট থেকে নজরুলের নাক ডাকার শব্দ কানে আসছে। নিজের রুমে সে আরামে ঘুমাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাকে আজ তার রুমে আসতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। যতটা না ভয় পেয়ে, তার চেয়েও বেশি তার আর মুকিতভাইয়ের জোরাজুরিতে। এই বিল্ডিং-এর নিচের তলা আজ নিরাপদ নয়, তাই দোতলায় উঠে আসতে হয়েছে। খবর পাওয়া গেছে আজ রাতের যে কোন সময় নিচের তলায় আক্রমণ ঘটতে পারে। সেই সম্ভাব্য আক্রমণের আতঙ্ক ঢুকে গেছে মাথার মধ্যে।       

সারাদিনে অনেক কিছু ঘটেছে আজ। ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলি একজোট হয়ে সংবিধানের ৮ম সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে মিছিল বের করেছিল। শিবিরের কর্মীরা সেই মিছিলে চড়াও হয়েছে। ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছে। ছাত্রশিবির ক্যাম্পাস থেকে এরশাদের ছাত্রসমাজকে বিতাড়িত করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে দেড় বছরেরও বেশি আগে। কিন্তু আজ তারা এরশাদের নীতির বিরুদ্ধে যে মিছিল, সেই মিছিলে আক্রমণ করে বুঝিয়ে দিলো নিজেদের স্বার্থের পক্ষে গেলে তারা এরশাদের নীতিকেও সমর্থন করে।

প্রেসিডেন্ট এরশাদ দেশের সাধারণ মানুষের মনে ধর্মীয় উন্মাদনার নামে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে সংবিধানের ৮ম সংশোধনী বিল পাস করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। ৭ই জুন এই বিল পাস করা হয়েছে। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানী পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে এগারো জন বাঙালি শহীদ হয়েছিলেন সেদিন। তার ঠিক ২২ বছর পর, ১৯৮৮ সালের ৭ জুন স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে পাস হলো দেশের মানুষকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত করার রাষ্ট্রধর্ম বিল। মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যকে যেভাবে পারছে অপমান করেই চলেছে এই সরকার।

ইসলাম এখন রাষ্ট্রধর্ম। এখন এই রাষ্ট্রের যেসব নাগরিক ইসলাম ধর্মের অনুসারী নয়, তাদের কী হবে? সরাসরি না বললেও রাষ্ট্র তো এটাই ইংগিত করছে যে তারা সব দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক! এরশাদ এবং তাঁর পারিষদবর্গ যে কেমন ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তা সবাই জানে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এরশাদ যে ধর্মকে ব্যবহার করছেন তা যে কেউ বোঝে। কিন্তু সবকিছু বুঝার পরেও মানুষ এই বিলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে। কারণ এর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই বলা হচ্ছে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে বলছে। দুর্বল মস্তিষ্কে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দিলে তা দ্রুত ডালপালা ছড়িয়ে বিষবৃক্ষে পরিণত হয়। এরশাদ তা ভালো করেই জানেন। তাই রাষ্ট্রধর্ম বিলের বিরুদ্ধে ঢিলেঢালা একটি অর্ধদিবস হরতাল ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি কেউ।

আজ ক্যাম্পাসে মারপিটের পর আর কোন ক্লাস হবার সম্ভাবনা ছিল না। রুমে এসে দেখলাম আমার দরজায় বিশাল এক পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছে শিবিরের ছেলেরা। সেখানে বড় বড় অক্ষরে আরবি আর বাংলায় লেখা – এসো দ্বীনের পথে। ছাত্রশিবিরে যোগ দিন। দেখেই মেজাজ গরম হয়ে গেল। কিন্তু করার কিছু নেই। পোস্টার এমনভাবে লাগানো হয়েছে যে টেনে তোলা যাচ্ছে না। আমাকে এখানে সবাই চেনে। সুতরাং এটা ভুল করে লাগানো হয়েছে ভাবার কোন কারণ নেই। আমি এই পোস্টার ছিঁড়লে আমাকে ইসলাম অবমাননার দায়ে ফাঁসানো যাবে – কারণ এই পোস্টারে কোরানের আয়াত উদ্ধৃত আছে। তাই পোস্টার সেখানেই থাকলো।

মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই। আমি মনে করি অন্যান্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মতোই ধর্মবিশ্বাসও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত পর্যায়কে সম্প্রদায়গত পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে লাভক্ষতির হিসেব কষা শুরু হলেই ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয়। এই সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপারটা খুব জটিল। এর সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। নিজের সম্প্রদায় সম্পর্কে সচেতনতার নামই কি সাম্প্রদায়িকতা? নাকি নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্বই সাম্প্রদায়িকতা? পৃথিবীতে কত ধরনের সাম্প্রদায়িকতা যে আছে – তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসেব নেই। পৃথিবীর সব মানুষ মিলে মনুষ্য সম্প্রদায়। মানুষগুলোর মধ্যে  আবার পুরুষ সম্প্রদায় ও মহিলা সম্প্রদায়। তারপর গায়ের বর্ণের ভিত্তিতে বিভাজন হলো – সাদা, কালো, বাদামী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সমস্যা এখনো চলছে। সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হলো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। সবার আগে আমি একজন মানুষ – এই পরিচয়ের চেয়েও ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছে – আমি মুসলমান, কিংবা হিন্দু, কিংবা বৌদ্ধ, কিংবা খ্রিস্টান পরিচয়। যে ধর্মীয় পরিচয় আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পাচ্ছি, যেখানে আমার নিজের কোন হাত নেই, যেটা আমি অর্জন করিনি - সেটা কীভাবে আমার যোগ্যতা মাপার মাপকাঠি হতে পারে আমি বুঝি না।

বিকেলে আরেকটা ঘটনা ঘটলো যার জন্য আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না। বাইরের প্যাসেজে হৈচৈ শুনে দরজা খুলে বের হয়ে দেখি প্যাসেজের মুখে পাঁচ-ছয় জনের জটলা। “ধর ধর শান্তিবাহিনীরে ধর” বলে চেঁচাচ্ছে দুজন ছেলে। এরা সম্ভবত এবার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। আমাদের দু’ব্যাচ জুনিয়র। এই বিল্ডিং-এ নতুন এসেছে। শিবিরের উঠতি নেতা। আমার সাথে এখনো কথা হয়নি তাদের। এরাই আমার দরজায় পোস্টার লাগিয়েছে বলে আমার ধারণা। কিন্তু শান্তিবাহিনীকে ধর বলে চেঁচাচ্ছে কেন ওরা? একটু এগিয়ে যেতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। “অ্যাই, কী করছেন আপনারা! খবরদার, ওর গায়ে হাত দেবেন না´- বলতে বলতে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালাম আশিসের পাশে। আমার গলার স্বর এতটাই উঁচুতে উঠে গিয়েছিল যে ওরা দ্রুত সরে গেলো। আমি আশিসকে নিয়ে রুমে এলাম।

আশিস চাকমা আমার ক্লাসমেট বন্ধু। এর আগেও একদিন এসেছিল মৃণালের সাথে। আজ একাই এসেছে। কিন্তু সে তো জানতো না যে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হবার পর উপজাতি হিসেবে তার অধিকার এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। পত্রিকার সাংবাদিকদের কল্যাণে প্রায় প্রতিদিনই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় শান্তিবাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ডে মানিকছড়িতে এতজন নিহত, মাটিরাঙ্গায় এতজন নিহত ইত্যাদি। কিন্তু নিরস্ত্র আদিবাসীরা নিজেদের শত শত বছরের আদি বাসভূমি থেকেই কীভাবে উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছে তার খবর কে রাখে! আমার মেসে এসে জাতিগত সাম্প্রদায়িকতার শিকার হলো আমারই বন্ধু। আশিসের ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে অপমানে। আমি তার চোখে চোখ রাখতে পারছিলাম না।

শোকে সান্ত্বনা দেয়া যায়। কিন্তু এধরনের অপমানের কোন সান্ত্বনা থাকে না। তাড়াতাড়ি কাজের কথা শুরু করলাম। সে এসেছিল ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের একটা নোট নিতে। ফরায়জি কামাল স্যার ক্লাস টেস্টের ডেট দিয়েছেন। আমাদের পরীক্ষায় মোট ২২০ নম্বরের মধ্যে ১০ নম্বর বরাদ্দ আছে ক্লাস টেস্টের জন্য। ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের কোন ক্লাস টেস্টই নেয়া হয়নি। মোবাশ্বের স্যার ক্লাসে প্রশ্ন করতেন – সেখান থেকেই নাকি ক্লাস টেস্টের নম্বর দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাকে কীভাবে কোন সাবজেক্টে কত নম্বর দেয়া হলো – আমরা কিছুই জানতে পারিনি। আমাকে দশের মধ্যে পাঁচ নম্বর দেয়া হয়েছে। এখন সেকেন্ড ইয়ারে কী হবে জানি না। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স ছাড়া অন্য কোন সাবজেক্টের ক্লাস টেস্টের কোন ইঙ্গিতও আমরা এখনো পাইনি। আশিসকে নোট দিয়ে সাথে নিয়ে বের হলাম। নিচের প্যাসেজ ধরে না গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম দোতলায়। সেদিক দিয়ে বের হলাম রাস্তায়। চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে চা-সিঙাড়া খাওয়ানোর সাহস হলো না। বলা তো যায় না – আবার কে কীভাবে অপমান করে বসে। ছড়ারকুলের ব্রিজে হাটহাজারির বাসে তুলে দিলাম আশিসকে।

সারাসন্ধ্যা খুব খারাপ লেগেছে। এই একুশ বছরের জীবনে অনেক ধরনের অপমানের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। মানুষ ভালো অভিজ্ঞতাগুলি অনেক সময় ভুলে যায়। কিন্তু অপমানের অভিজ্ঞতা ভুলতে পারে না। আশিস আজকের অভিজ্ঞতা ভুলতে পারবে না কোনদিন। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা যে তার আরো হবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

রাতে টিভি দেখতেও গেলাম না। মুকিতভাই রুমে এসে ডেকে নিয়ে গেছেন রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে এসেছি। আমাদের আগের ব্যাচের সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা চলছে। ফার্স্ট পেপার হয়ে যাবার পর আমি অজিতের নোটগুলি নিয়ে এসেছিলাম। সেকেন্ড পেপারের আগেই সেগুলি লিখে তাকে ফেরৎ দিতে হবে। ফটোকপি করানোর চেয়ে নিজের হাতে লিখতেই পছন্দ করি, কারণ তাতে লিখতে লিখতে পড়াও হয়ে যায়। অজিতের নোটগুলি খুলে টেবিলে বসেছিলাম, কিন্তু এক লাইনও লেখা হয়নি। এসময় মাহমুদভাই এলেন। তিনি সাধারণত বেশ উচ্চস্বরে কথা বলেন। কিন্তু আজ কথা বলছেন বেশ চাপাস্বরে।

“প্রদীপ, আজ রাতে তুমি রুমে থেকো না। উপরের কোন রুমে চলে যাও।“

“কেন?”

“খবর পেয়েছি আজ রাতে ছাত্রলীগের ছেলেরা এই বিল্ডিং-এ হামলা করতে পারে।“

“ছাত্রলীগের ছেলেরা হামলা করলে আমার ভয় পাবার কী আছে?”

“তোমার গায়ে কি লেখা আছে যে তুমি শিবির করো না? রুমের দরজায় তো শিবিরের পোস্টার লাগিয়ে রেখেছো। শিবির করো না বললে কেউ বিশ্বাস করবে?”

এ তো মহা ঝামেলায় পড়লাম। শিবিরের আক্রমণের কারণে হল ছাড়তে হলো। অনেক জায়গায় ঘুরে এই মেসে এলাম – অথচ এখানে সব শিবিরের কর্মী। এখন ছাত্রলীগের আক্রমণের ভয়ে নিজের রুম ছাড়তে হবে? তাছাড়া এই বিল্ডিং-এর মালিকের বড় ছেলে ছাত্রলীগের বড় নেতা। তিনি কি তাঁর কর্মীদের দিয়ে নিজের বাপের বিল্ডিং আক্রমণ করাবেন?

আমি ইতস্তত করছি দেখে মাহমুদভাই বললেন, “কথা শোন। উপরে চলে যাও তাড়াতাড়ি। একটু পরেই আমি সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দেবো। উপরে কেউ ঢুকতে পারবে না।“

মাহমুদভাই চলে গেলেন। আমি রুম থেকে বের হয়ে দেখলাম নিচের একটা রুমেও আলো নেই। সবগুলি দরজায় তালা। শিবিরের কর্মীরা প্রত্যেকেই খবর পেয়ে গেছে এবং উধাও হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের ছেলেরা যদি ভেতরে ঢুকতে পারে – আমাকে ছাড়া আর কাউকে পাবে না। মারার সময় তো জিজ্ঞেস করে মারবে না, মেরে জিজ্ঞেস করবে।

রুমের ভেতর তাকালাম। আমার বুকশেল্‌ফে এখন অনেক বই। ক্যাসেট প্লেয়ার আছে, রেডিও আছে। রুমের তালা ভেঙে যারা রুমে ঢুকবে – তারা রুমটা তছনছ করবে, বইপত্র ছিঁড়বে। তাতে কী এমন রাজ্যজয় হবে তাদের? কোন্‌ আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে এরা? যারা রাতের অন্ধকারে শারীরিক আক্রমণ করার প্ল্যান করতে পারে – তাদের ভেতর কোন আদর্শ কাজ করে বলে আমি মনে করি না। শিবিরের সাথে তাদের কোন পার্থক্য নেই। শিবিরের কর্মীরা আমার বাক্স কেটে টাকা নিয়ে গিয়েছিল। এখন সেই কাটা বাক্সে টাকা পেলে তা এরা ফেলে যাবে? নিজের জিনিস গেলে ক্ষতি নেই। কিন্তু অজিতের নোটগুলি নষ্ট হলে তার ক্ষতিপূরণ হবে না। তাই তাড়াতাড়ি নোটগুলি ব্যাগে ভরলাম। এমন সময় মুকিতভাই আর নজরুল একসাথে এলো আমাকে উপরে নিয়ে যাবার জন্য। আমার জন্য তাদের উদ্বেগ দেখে আমি বুঝতে পারছি -  এরশাদ সাহেব যত চেষ্টাই করুন, বাংলাদেশের সব মানুষকে বিষিয়ে দিতে পারবেন না তিনি।

এখলাস হলে চলে যাবার পর এখলাসের সিটে নতুন ছাত্র এসেছে। নজরুল চলে এসেছে আমার রুমের ঠিক উপরের রুমে। মুকিতভাই আর তৌহিদভাই এখন নজরুলের রুমের সামনের বড় রুমে। তৌহিদভাই ফতেয়াবাদ গার্লস স্কুলের শিক্ষক – বেশ হাসিখুশি মানুষ। আমাকে দোতলায় নিয়ে আসার সাথে সাথে সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। উপরে – নিচে যত দরজা আছে – সব বন্ধ করে দিয়ে যেন কিছু একটা ঘটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো দোতলার সবাই যে যার রুম থেকে।

শুয়ে শুয়ে নজরুলের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। নজরুল এমনিতে খুব চুপচাপ থাকে, কথাবার্তা খুব একটা বলে না। আজ অনেক কথা বললো। তার অনেক ব্যক্তিগত দুঃখের কথাও জানা হয়ে গেলো। মা না থাকার কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু মা থেকেও না থাকার কষ্ট যে আরো অনেক গভীর।

নজরুল ঘুমিয়ে পড়ার পর অনেকক্ষণ কেটে গেছে। আমার ঘুম আসছে না এখনো। গরমের রাত। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারে চোখ খুলে রাখলে চোখের রেটিনার রড কোষগুলি অন্ধকারের সাথে সখ্য গড়ে তোলে। একেবারে বিচ্ছিন্ন ফোটনগুলি থেকেও তারা আবছা একটা ছবি তৈরি করে নিতে পারে। এটাকেই আমরা অন্ধকারের রূপ বলি। জানালায় সুপারি গাছের পাতা দেখা যাচ্ছে – আবছা কালো। এই গাছটির পুষ্ট কান্ড দেখি প্রতিদিন আমার জানালায়। সুপারিগাছ পেরিয়ে দৃষ্টি চলে যায় আরো দূরে – আকাশে। মিটিমিটি তারার মেলা সেখানে। কে বলে বিজ্ঞানের সাথে কল্পনার কোন সম্পর্ক নেই? এই যে তারাগুলি – প্রত্যেকেই সূর্যের চেয়ে বড় বড় নক্ষত্র – রয়েছে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। এই বাস্তবতাকে চোখের সামনে যা দেখছি তার সাথে মেলানোর জন্য কল্পনার আশ্রয় তো নিতেই হয়। এই কল্পনা যে যত সঠিকভাবে করতে পারে – অধরা প্রকৃতির রহস্য তার হাতেই তত বেশি উদ্ঘাটিত হয়।

কোন আক্রমণ হলো না। একটি স্বাভাবিক সকাল হলো। আমি জিনিসপত্র নিয়ে সিঁড়ির দরজা খুলে নিচে নেমে দেখলাম তখনো কেউ আসেনি। সবাই রাতে কোথায় চলে গেছে কে জানে। সবকিছু ভুলে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম – কিন্তু যতবারই দরজা খুলি – শিবিরের পোস্টারে চোখ যায়। না, এর একটা বিহিত করতে হবে। ফ্লোর মোছার একটা কাপড় ভিজিয়ে ঘষে ঘষে তুলে ফেললাম শিবিরে যোগ দেয়ার আবাহন বাণী। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের একটি বড় ছবি ছিল রুমে। গতবছর তাঁর মৃত্যুর পর একতা পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল সেই ছবি। মাস্টারগাম দিয়ে লাগিয়ে দিলাম সেই ছবি আমার দরজায়। এটুকুতেই একটা বিপ্লবী ভাব চলে এলো মনের ভেতর। সেই ভাব নিয়ে চলে গেলাম ক্যাম্পাসে।

বিকেলে ক্যাম্পাস থেকে ফিরে দেখলাম আমার দরজার কমরেড ফরহাদের মুখে খুব যত্নসহকারে দাড়ি একেঁ দিয়েছে কেউ। মাথায় একটা টুপিও এঁকেছে। তাঁর চেহারা এখন অনেকটা দেলোয়ার হোসেন সাইদীর চেহারার মতো হয়ে গেছে। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম এই অজানা শিল্পীর দক্ষতায়। যে এঁকেছে সে যদি শিবির করে – তাহলে তো শিবিরের আদর্শের সাথে তার কাজ সাংঘর্ষিক। কারণ শিবির তো ছবি আঁকাকে বেশরিয়তি কাজ বলে প্রচার করে।

পরদিন সন্ধ্যায় আরেকটি ঘটনা ঘটলো। কেমিস্ট্রির ইদ্রিসভাই রুমে এলেন তাঁর এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে। ইদ্রিসভাই আমাদের দুই বছরের সিনিয়র। থার্ড ইয়ার ফাইনাল দেবেন। আমার রুমে তিনি আগে কখনো আসেননি। বোঝাই যাচ্ছে কোন দরকারি কাজে এসেছেন। কোন ভনিতা না করে সরাসরি কাজের কথায় এলেন তিনি।

“আমি এসেছি তোমাকে একটা অনুরোধ করতে। ও আমার বন্ধু। ওর ভাই এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে ফটিকছড়ি থেকে। আগামীকাল ফিজিক্স ফার্স্ট পেপার, পরশু সেকেন্ড পেপার। তোমাকে এই দু’দিন একটু ফটিকছড়ি সেন্টারে যেতে হবে।“

“কেন?”

“ফিজিক্সের অংকগুলি তুমি সল্‌ভ করে দেবে।“

“পরীক্ষার হলে ঢুকে?”

“না, না। সব ব্যবস্থা করা আছে।“ – এবার ইদ্রিস ভাইয়ের বন্ধুটি ব্যাখ্যা করছেন ব্যাপারটা। “পরীক্ষা শুরু হবার কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রশ্ন বাইরে চলে আসবে। আমরা তোমাকে একটা জায়গায় বসিয়ে রাখবো। সব বইপত্র তোমার সাথে থাকবে। প্রশ্নটি তোমার কাছে নিয়ে আসা হবে। তুমি তাড়াতাড়ি সবগুলি অংক করে দেবে। তারপর তোমার কাজ শেষ। ট্যাক্সি করে তোমাকে নিয়ে যাবো, আবার ট্যাক্সি করে এখানে পৌঁছে দেবো।“

“মানে আমি নকল সাপ্লাই দেবো?”

“না না, সাপ্লাই তোমাকে দিতে হবে না। তুমি শুধু অংকগুলি করে দেবে। বই থেকে যে কেউ খুঁজে বের করতে পারবে। তুমি যেহেতু ফিজিক্সে পড়ো – তাই তুমি একটু ভালো বুঝবে। প্রতিদিন তোমাকে এক শ’ টাকা করে দেবো।“

“এক শ’ টাকা?”

“হ্যাঁ, দু’দিনে দু শ টাকা। তোমার আধা মাসের টিউশনির টাকা তুমি মাত্র কয়েক ঘন্টায় পাবে।“

আমি কী বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। যথাসম্ভব চেষ্টা করছি মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে। চুপ করে আছি দেখে ইদ্রিস ভাইয়ের বন্ধু এবার তাঁর পরীক্ষার্থী ভাইয়ের গুণগান করতে শুরু করলেন। - “আমার ভাই খুবই ভালো ছাত্র। ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। গতবছর পরীক্ষা দিয়েছিল। সব সাবজেক্টে স্টার মার্কস পেয়েছিল। কিন্তু এক্সটার্নাল তাকে প্র্যাকটিক্যালে ফেল করিয়ে দিয়েছে। তাই সে রাগ করে আর ক্যাডেট কলেজে যায়নি। এবার ফটিকছড়ি থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে।“

এত ভালো ছাত্রকে কেন নকল সাপ্লাই করতে হবে? আর তারা কীভাবে ভাবলেন যে আমাকে বললেই – দু শ’ টাকার লোভ দেখালেই আমি রাজি হয়ে যাবো! অবশ্য আমি রাজি না হলেই যে তাদের কাজ আটকে থাকবে তা নয়। সারাদেশে জাতীয় পরীক্ষায় নকলের মহোৎসব চলে। শিক্ষকরাই পরীক্ষার হল থেকে প্রশ্ন বাইরে পাঠান। বাইরে থেকে বস্তা বস্তা নকল ভেতরে যায়। অনেক সময় শিক্ষকরাই নকল করতে সহায়তা করেন। আমি তো এসব অন্যায় বন্ধ করতে পারবো না। কিন্তু নিজে তো অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারবো।

“সরি ইদ্রিসভাই। আমার পক্ষে সম্ভব নয়।“

“কেন? টাকা কম হচ্ছে? দরকার হলে টাকা একটু বাড়িয়ে দেবে। টাকার জন্য ভেবো না। এদের টাকার অভাব নেই। তিন ভাই তারা মিডলইস্টে থাকে।“

ইদ্রিসভাইয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে টাকার মূল্যেই তিনি সবকিছুকে বিচার করতে অভ্যস্ত। মানুষের মূল্যবোধ নামক একটা ব্যাপার যে থাকতে পারে তা তিনি জানেনই না। কিন্তু সমস্যা হলো এই ব্যাপারটা যাদের ভেতর নেই – তাদেরকে তা বোঝানো যায় না। বোঝানোর চেষ্টা করাও বৃথা।

“ঠিক আছে, ডেইলি দেড় শ’ টাকা করে দেবো।“ – ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ভালো ছাত্রের ভাই টাকার অঙ্ক বাড়াতে শুরু করেছেন। বাংলা সিনেমায় আমি এরকম অনেক দৃশ্য দেখেছি যেখানে এই পরিস্থিতিতে যাকে টাকা সাধা হয় তিনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে  চিৎকার করে ইংরেজিতে বলেন, “গেট আউট।“ কিন্তু বাস্তবে এরকম নাটকীয় সংলাপ চলে না। আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, “টাকার জন্য নয়, আমি নীতির জন্যই যেতে পারবো না।“

“দুই শ করে দিলেও হবে না?”

আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ইদ্রিসভাই আর ভালো ছাত্রের ভাই থমথমে মুখে বের হয়ে গেলেন। বের হবার সময় ইদ্রিসভাই অনেকটা আমাকে শুনিয়েই তাঁর বন্ধুকে বললেন, “দুই শ’ টাকা দিলে কলেজের প্রফেসররা বসে লিখে দেবে। একে খোসামোদ করার দরকার নেই।“ 

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>

<<<<<<<<<< আগের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts