১৯০১ থেকে ২০২৩ - এই ১২৩ বছরে ২২৪ জন বিজ্ঞানী
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। এই ২২৪ জনের মধ্যে মাত্র পাঁচজন হলেন নারী।
বিংশ শতাব্দীতে এই সংখ্যা ছিল মাত্র দুই। এই পাঁচজন নোবেলজয়ী নারী
পদার্থবিজ্ঞানীর একজন হলেন মেরি কুরি। ১৯০৩ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল
পুরষ্কার পেয়েছিলেন। বিশ্বের অনেকেই মেরি কুরিকে চেনেন। কিন্তু নোবেলজয়ী
দ্বিতীয় নারী পদার্থবিজ্ঞানী ততটা পরিচিত নন আমাদের অনেকের কাছে। তাঁর নাম মারিয়া
গোয়েপার্ট-মেয়ার। মেরি কুরির নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার ৬০ বছর পর ১৯৬৩ সালে নিউক্লিয়ার
ফিজিক্সের Shell Model
আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ার।
২৮ জুন মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ারের জন্মদিন।
১৯০৬ সালের ২৮ জুন জার্মানির কাটোভিজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মারিয়া গোয়েপার্ট।
তাঁর বাবা ছিলেন গটিংগেন (Gottingen) ইউনিভার্সিটির
মেডিকেল ফ্যাকাল্টির প্রফেসর, মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মেরি কুরির মত অর্থনৈতিক ও
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সহ্য করতে হয়নি মারিয়াকে। অভিজাত মা-বাবার একমাত্র সন্তান
ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা তাঁকে সবসময় বলতেন, "মেয়েমানুষের মত হয়ো না, মানুষ হতে
চেষ্টা করো।'' মা-বাবার প্রভাবে বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন মাথার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল
মারিয়ার। গণিতের প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণ ছিল তাঁর।
কিন্তু সেই ১৯২০-এর দশকে যখন ইওরোপে কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের বেড়ে ওঠার কাজ চলছে - তখন সেখানে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই
সীমিত। তবুও গণিতের প্রফেসর হতে চেয়েছিলেন মারিয়া। কিন্তু ম্যাক্স বর্নের প্রভাবে
গণিত থেকে পদার্থবিজ্ঞানে চলে এলেন তিনি। ম্যাক্স বর্নের তত্ত্বাবধানে শুরু করলেন
পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ।
১৯২৭ সালে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। আর্থিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। মারিয়ার মা তাঁদের বাড়ির কয়েকটা রুম ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের ভাড়া দিতে শুরু করেন। একদিন মারিয়াদের বাড়ির একটা রুম ভাড়া নিয়ে এলেন আমেরিকান কেমিস্ট জোসেফ মায়ার। ধরতে গেলে প্রথম দর্শনেই প্রেম। ১৯৩০ সালে বিয়ে।
মারিয়া ও জোসেফ মেয়ার |
মারিয়া
জোসেফের প্রেমে এতই মশগুল হয়ে যান যে - ফিজিক্সে পিএইচডি'র কাজ পর্যন্ত ছেড়ে দেন।
কিন্তু জোসেফ জানতেন মারিয়ার স্বপ্নের কথা। তিনি অনেক বুঝিয়ে মারিয়াকে পিএইচডি
সম্পন্ন করতে রাজি করান।
মারিয়ার পিএইচডি অর্জিত হওয়ার পর জোসেফ মারিয়াকে
নিয়ে আমেরিকায় ফিরে আসেন। জন হফকিন্স ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন জোসেফ মেয়ার। কিন্তু
মারিয়া তাঁর সন্তানদের লালনপালন আর ঘরসংসারের কাজ করতে করতে নিজের ক্যারিয়ারের কথা
ভুলেই যান।
জার্মানিতে মারিয়া বড় হয়েছেন অনেকটা প্রাচুর্যের
মধ্যে। বাড়িতে কাজ করার লোক ছিল। নিজেকে কিছুই করতে হয়নি তেমন। কিন্তু আমেরিকাতে
ঘরের কাজ করতে করতেই সময় চলে যায়। কিন্তু তাঁর স্বামী জোসেফ মারিয়ার ক্যারিয়ার
গড়ার ব্যাপারে মারিয়ার চেয়েও সচেষ্ট। তিনি মারিয়াকে বলেন, "আমেরিকাতে কাজের
লোক রাখার খরচ যত বেশিই হোক, আমি তোমার ঘরের কাজের জন্য কাজের লোক রাখবো, কিন্তু
তোমাকে কথা দিতে হবে যে - তুমি বিজ্ঞান ছাড়বে না।"
বিজ্ঞান ছাড়তে না চাইলেও - বৈজ্ঞানিক গবেষণার কোন
সুযোগই পাচ্ছিলেন না মারিয়া। কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁকে নিয়োগ দেয়নি। অনেক চেষ্টা
করার পর জন হফকিন্স ইউনিভার্সিটিতে তিনি বিনাবেতনে কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৪৬ সাল
পর্যন্ত বিনাবেতনে কাজ করেন তিনি সেখানে।
তারপর তাঁর স্বামী জোসেফ মায়ার যখন শিকাগো
ইউনিভার্সিটিতে চলে যান, মারিয়াও যান তাঁর সাথে এবং সেখানেও তিনি বিনাবেতনে কাজ
শুরু করেন। কিছু সময়ের মধ্যে সেখানে আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবোরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর্গন ল্যাবের ডিরেক্টর হলেন রবার্ট স্যাচ।
মজার ব্যাপার হলো রবার্ট স্যাচ পিএইচডি করেছিলেন
জন হফকিন্স ইউনিভার্সিটিতে মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ারের তত্ত্বাবধানে। ছাত্র রবার্ট
একটা ন্যাশনাল ল্যাবের পরিচালক হয়ে গেছেন, অথচ শিক্ষক মারিয়ার কোন সবেতন চাকরি
নেই।
রবার্ট মারিয়াকে আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবে খন্ডকালিন
চাকরি দিলেন। প্রায় ১৫ বছর বিনাবেতনে কাজ করার পর এই প্রথম তিনি বেতন পেলেন।
এখানেই তিনি কাজ করেছেন এনরিকো ফার্মিসহ আরো অনেক বিখ্যাত নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্টের
সাথে।
এখানে কাজ করতে করতে মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ার
নিউক্লিয়ার শেল মডেল আবিষ্কার করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি যখন তাঁর মডেল প্রকাশ করেন,
তখন প্রায় একই সময়ে জার্মানিতে এই মডেল আবিষ্কার করেন হ্যান্স জেনসেন। ক্রমে
মারিয়া ও হ্যান্স জেনসেনের মধ্যে পেশাগত বন্ধুত্ব তৈরি হয়। নিউক্লিয়ার শেল মডেলের
উপর একটি ক্লাসিক বই লেখেন তাঁরা।
বিজ্ঞানী হিসেবে এত নামডাকের পরেও একটা
পূর্ণকালীন চাকরি জোটেনি মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ারের ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। ১৯৬০ সালে
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগোতে অধ্যাপক পদে প্রথম পূর্ণকালীন চাকরি
পান মারিয়া। তাঁর স্বামী জোসেফ মেয়ারও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দেন।
দেখা গেলো জোসেফকে যত বেতন দেয়া হয়, মারিয়াকে দেয়া হয় তার অর্ধেক।
১৯৬৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান
মারিয়া মেয়ার, হ্যান্স জেনসেন এবং ইউজিন বিগনার। নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর মারিয়া
মেয়ারের বেতন হয় পুরুষ অধ্যাপকদের সমান।
১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন
মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ার।
No comments:
Post a Comment