Saturday 26 June 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ২৬

 



স্বপ্নলোকের চাবি – ২৬

ক্যাম্পাসের নিয়মিত ঘটনাগুলির একটি হলো পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে মিছিল। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে যেকোনো পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করার কয়েকদিনের ভেতর সেই পরীক্ষা পেছানোর জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের কাছে এটা অনেকটাই নৈমিত্তিক ব্যাপার। ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের রাজত্ব চলছে প্রায় দু’বছর হয়ে গেলো। এই দুবছরে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলি ক্যাম্পাসে বা হলে কোন ধরনের প্রকাশ্য কার্যক্রম চালাতে পারেনি। গোপন কার্যক্রম মাঝে মধ্যে চলে, কিন্তু সেখানে ঘাপটি মেরে থাকা শিবিরের গুপ্তচরদের মারফত সেগুলির খবরও যথাসময়ে পৌঁছে যায় শিবিরের নেতাদের কাছে। তাই শিবিরছাড়া অন্য কোন সংগঠনের মিছিল ক্যাম্পাসে খুব একটা হয় না বললেই চলে। কিন্তু  পরীক্ষা পেছানোর মিছিলে কেউ কোনদিন বাধা দেয় না। সেখানে নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে সবাই একজোট। পরীক্ষা পেছালে লাভ তো সব দলের নেতাদেরই হয়। নেতাদের বেশিরভাগই তো চায় তাদের ছাত্রজীবন যতদূর পারা যায় দীর্ঘায়িত করতে।

কিন্তু আজ ক্যাম্পাসে একটি নতুন ধরনের ইতিহাস তৈরি হলো। ব্যতিক্রমী একটা মিছিলে অংশ নিলাম আমরা সেকেন্ড ইয়ারের বেশ কয়েকজন। এই মিছিলের স্লোগান ছিল – ‘সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা – দিতে চাই, নিতে হবে’, ‘সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা পেছানো – চলবে না, চলবে না’, ‘পরীক্ষা নিয়ে ছিনিমিনি – চলবে না, চলবে না’, ইত্যাদি।

আমাদের আগের ব্যাচের সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়ে গেছে অনেকদিন হয়ে গেল। অন্যান্য বছর এক ব্যাচের পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই অন্য ব্যাচের পরীক্ষার ডেট দিয়ে দেয়। তারপর যথারীতি পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন এবং কয়েকবার পেছানোর পরে তৃতীয় বা চতুর্থ ডেটে পরীক্ষা হয়। এবার এখনো প্রথম ডেটও দেয়া হয়নি।

শোনা যাচ্ছে আমাদের নতুন ভিসি প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন ইউনিভার্সিটির সেশান জট নিরসন করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। এরকম সংকল্পের কথা আমরা অনেকের মুখেই শুনেছি অনেকবার। কিন্তু সংকল্প যাই থাকুক, বাস্তবায়ন হয় না কিছুই। বছরের পর বছর আমাদের একাডেমিক সেশন - জট পাকাতে পাকাতে এত জটিল হয়ে গেছে যে এখন সেই জট খুলতে চাইলেও আরো কয়েক বছর লেগে যাবে। ১৯৮৮ সালে আমাদের অনার্স পাস করে ফেলার কথা, অথচ ১৯৮৮’র শেষের ভাগে চলে আসার পরেও আমরা এখনো সেকেন্ড ইয়ারে আটকে আছি। আমাদের সঙ্গীদের অনেকেই ইতোমধ্যে পাস কোর্সে পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি পাস করে ফেলেছে। বছরের পর বছর ধরে লেখাপড়ার নামে সময় নষ্ট করার ব্যাপারে আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ছি।

এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে আমাদের সিলেবাস শেষ হয়ে গেছে, কিংবা আমরা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। বরং তার উল্টো। আমাদের সিলেবাস কখনোই ঠিকমতো শেষ হয় না। সিলেবাস যত কম শেষ হয় – ততই খুশি হই আমরা। কারণ আমরা জানি, ক্লাসে যতটুকু পড়ানো হবে – ততটুকুর মধ্য থেকেই প্রশ্ন হবে। কয়েকটা প্রশ্ন এদিক-ওদিক হলেও তেমন কিছুই যায় আসে না। আর পরীক্ষার প্রস্তুতি? সেটাও কখনোই ঠিকমতো হয় না। যখন বুঝতে পারি পরীক্ষা আর পেছানোর কোন সম্ভাবনা নেই, তখন শুরু হয় দৌড়। সবকিছু শেষ মুহূর্তে করাটা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

আমাদের পরীক্ষার প্রক্রিয়া এত দীর্ঘদিন ধরে চলে যে ধৈর্য রাখা যায় না। একেকটা থিওরি পরীক্ষার মাঝখানে পাঁচ-ছ’দিন করে গ্যাপ থাকে। তারপর কয়েক সপ্তাহ পরে হয় প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা, প্র্যাকটিক্যাল ভাইভা, জেনারেল ভাইভা। সব শেষ হতে কয়েক মাস লেগে যায়। যতই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি না কেন, এই কয়েকমাস ধরে কিছুটা টেনশান তো কাজ করতেই থাকে। সেই টেনশান যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই ভালো। তাই এবার আমরা চাই সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা এক ডেটেই হয়ে যাক। টেনশান-প্রক্রিয়া যত সংক্ষিপ্ত করা যায় ততই ভালো।

মিছিল করার উদ্যোগটা নিয়েছিল আমাদের লুৎফুল কবীর। সে কাউকে জোর করেনি, কেবল তার আইডিয়াটা বলেছে। ক্লাসের সবাই যে আইডিয়াটা পছন্দ করেছে তা নয়। কিন্তু আমাদের অনেকেরই খুব ভালো লেগেছিল। দশ-বারোজনের মিছিল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির করিডোরের একদিক থেকে অন্যদিকে যেতে যেতেই তিরিশ-পঁয়ত্রিশজনে পরিণত হলো। আমরা আরো সাহসী হয়ে সায়েন্স ফ্যাকাল্টি থেকে বের হয়ে আর্টস ফ্যাকাল্টিতেও গেলাম।

আর্টস ফ্যাকাল্টির ব্যাপারটা আমার কাছে খুব রহস্যময় লাগে। এখানকার করিডোরে ভীড় সায়েন্স ফ্যাকাল্টির করিডোরের ভীড়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু দুপুর একটার পর উধাও হয়ে যায় এই ভীড়ের মানুষগুলো, নিস্তব্ধ হয়ে যায় এই করিডোর।

আমরা পরীক্ষা পেছানোর বদলে পরীক্ষা দেবার জন্য মিছিল করছি দেখে তারা অবাক হয়েছে, আমাদের দেখে হাসাহাসিও করেছে, কিন্তু একজনও আমাদের মিছিলে যোগ দেয়নি। তাতে আমরা অবশ্য খুব একটা অবাক হইনি। আমাদেরও রাগ আছে কয়েকটি বিশেষ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের উপর। সব ডিপার্টমেন্টের ফাইনাল পরীক্ষা একই সময়ে হলেও সব রেজাল্ট কিন্তু একই সময়ে প্রকাশিত হয় না। অনেক সময় দেখা যায় পরীক্ষা শেষ হবার ছয় মাস পরেও কোন কোন ডিপার্টমেন্টের রেজাল্ট দেয়া হয় না। আর সেই ডিপার্টমেন্টের কারণে সবগুলি ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা আটকে থাকে। আমাদের প্রামাণিক স্যার তো বলেন, তাঁর হাতে ক্ষমতা থাকলে তিনি পরীক্ষা শেষ হবার দুই সপ্তাহের মধ্যেই রেজাল্ট দিয়ে দিতেন। স্যারই বলেছেন, এমন ঘটনাও নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে – দেখা গেছে পরীক্ষার খাতা আলমারিতে বন্ধ করে রেখে পরীক্ষক বিদেশ সফরে চলে গেছেন। আর সেই একটা বিষয়ের নম্বরের জন্য মাসের পর মাস আটকে রয়েছে সেই ডিপার্টমেন্টের রেজাল্ট।

এর কয়েকদিন পরেই আমাদের পরীক্ষার তারিখ দেয়া হলো। ডিপার্টমেন্টে নোটিশ আসার আগেই আমরা জেনে গিয়েছি জানুয়ারির ৩০ তারিখ থেকে আমাদের সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হবে। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রামাণিক স্যারের মেয়াদ পূর্ণ হবার পর চেয়ারম্যান হয়েছেন রশীদুন্নবী স্যার। তিনি ইলেকট্রিসিটি ক্লাস নিতে এসে আমাদের বললেন, সব ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানদের সাথে ভিসিস্যারের মিটিং হয়েছে। সেই মিটিং-এ আমাদের মিছিলের কথা আলোচিত হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে ঘোষিত তারিখেই পরীক্ষা হবে। ক্যাম্পাসের মিছিলের খবর তাহলে ভিসিস্যারের কান পর্যন্ত পৌঁছায়?

পরীক্ষার জন্য পড়ালেখা শুরু করার সময় হয়ে গেলো। যীশু বরাবরই সিরিয়াস, এবার আরো সিরিয়াস হয়ে উঠলো। বললো তার বাসায় পড়ালেখা ঠিকমতো হচ্ছে না। বললাম, ‘চাইলে আমার রুমে চলে আসতে পারিস।‘ পরদিনই সে আমার রুমে চলে এলো। তার দেখাদেখি প্রদীপ নাথও চলে এলো রুমে।

আমি, যীশু আর  প্রদীপ নাথ – আমরা  তিন জনের একটা গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে ফার্স্ট ইয়ার থেকে। যতক্ষণ ফ্যাকাল্টিতে থাকি – প্রায় এক সাথেই থাকি তিন জন। এখন তিনজনই মেসে আমার রুমে। লক্ষ্য ছিল সিরিয়াসলি পড়াশোনা করা – ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল – লেখাপড়ার চেয়ে গল্প করছি বেশি। তারপর রান্নাবান্না। যীশুর আবার বাজার করার খুব শখ। স্বল্পতম সময়ে খাবার তৈরি করার আমার নিজস্ব যেসব রেসিপি আছে যীশু তার সবগুলি নাকচ করে দিয়েছে। ডালের মধ্যে সিঙাড়া দিয়ে যে অমৃততুল্য খাবার তৈরি হয় – তা সে একবার খেয়ে দেখতেও রাজি হলো না। কোন ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই কোন কিছু বাতিল করে দেয়া যে পদার্থবিজ্ঞানের নীতির পরিপন্থি তাকে সেটা বলতেই সে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললো, “খাদ্যের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের কোন সংযোগ নেই। খাদ্য পুষ্টিবিজ্ঞানের বিষয়, পদার্থবিজ্ঞানের নয়।“

কাছেই চৌধুরিহাট। সপ্তাহে কয়েকদিনই যাওয়া হয় চৌধুরিহাটের উপর দিয়ে বিপ্লবদের বাড়িতে আড্ডা মারতে। বিকেলে এই বাজারটি জমজমাট হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি কখনোই এখান থেকে বাজার করিনি। আমি কিংবা নাথ – দু’জনের কারোরই বাজারের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই। কিন্তু যীশু এখানে আসার পর এই বাজারের প্রতিটি অলিতে গলিতে হাঁটতে শুরু করলো। টাটকা মাছ, শাকসব্‌জি দেখে তার মতো এতটা উল্লসিত হতে আর কাউকে এপর্যন্ত দেখিনি। বড় বড় সবুজ বেগুন দেখে সে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে, “ওডা, বাইয়ন চা না, বাইয়ন দেইক্ষস্‌নি কত্তর্‌তর?” বেগুন দেখে এত উৎফুল্ল হয়ে ওঠার কী কারণ থাকতে পারে না বুঝতে পারি না। তার কান্ড দেখে আমি আর নাথ হাসতে থাকি। যীশুর আগ্রহে বেগুন কিনতে হয়, মাছ কিনতে হয়, সেগুলি রান্না করতে হয়। রান্না করতে করতে কিছুটা কাব্যচর্চাও করতে হয়।

কবিতাও যে সংক্রামক তা বোঝা গেলো ক’দিনের মধ্যেই। নাথ আর আমার ছন্দের রোগ আগে থেকেই ছিল। এবার যীশুর মধ্যেও তা সংক্রমিত হলো। যেমন, আমি বললাম,

‘সিদ্ধ হচ্ছে না বেগুন’

নাথ বললো, ‘বাড়িয়ে দে আগুন’

যীশু বললো, ‘এবার আসিবে ফাগুন।“

ছন্দের সংক্রমণ এতটাই তীব্র যে অক্টোবর মাসে সে ফাগুন নিয়ে আসছে বেগুন আগুনের সাথে মেলানোর জন্য। শুধু তাই নয়, সে দুই লাইনের একটা নিজস্ব কবিতাও রচনা করে ফেলেছে – যার নাম দিয়েছে খাদ্যকাব্য। কবিতাটি এরকম – ‘এসো কিছু খাই, এসো ঘুম যাই’। খুবই জীবনমুখী কবিতা – তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটাতে সুরও দিয়েছে সে। ঘুমপাড়ানিয়া সুর।

মাসখানেক কেটে গেলো – অনেক হাসি আনন্দ, রান্না, কবিতা আর সামান্য কিছু ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, ইলেকট্রিসিটি-ম্যাগনেটিজম, স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স হলো। এর মধ্যেই তারা যার যার গৃহে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠলো। গৃহের আকর্ষণ কুলম্বের ইলেকট্রোস্ট্যাটিক আকর্ষণের চেয়েও তীব্র। যীশুকে চৌধুরিহাটের বেগুনের লোভ দেখিয়েও আর রাখা গেলো না। রুমে আমি আবার একা হয়ে গেলাম। আবার আমার নিজস্ব রুটিনে ফিরে এলাম।

এবছর বন্যায় দেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলার অনেকটুকু অঞ্চল পানির নিচে চলে গিয়েছিল। জাতিসংঘে বাংলাদেশের বন্যা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহায়তা দান করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ এ উপলক্ষে শতাধিক সরকারি আমলা ও দলীয় নেতা পরিবেষ্টিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করে বেড়াচ্ছেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের বুদ্ধি লাভ করার জন্য বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ দল চীন ভ্রমনে যাচ্ছেন।

আমার রুমের সবকিছু বন্যার পানিতে ভাসার পর অনেক বইখাতা ফেলে দিতে হয়েছে। বুকশেল্‌ফ খাট সবকিছুর নিচে ইট দিয়ে সেগুলির উচ্চতা অনেক বাড়িয়ে নিয়েছি। তবুও শেল্‌ফের নিচের তাকে কিছু রাখতে ভয় লাগে। আবারো পানি ঢুকার ভয়ে খান সাহেবকে অনুরোধ করে আমার দরজায় একটা দেড় ফুট উঁচু পাকা দেয়াল তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। আশা করি বন্যার পানি আর ঢুকবে না, বা ঢুকলেও বেশি ঢুকবে না।

দেখতে দেখতে নভেম্বরের শেষ হতে চললো। এই সময় একদিন আমাদের ক্যাম্পাসে নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম এলেন। প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন আমাদের ক্যাম্পাসে। শহীদ মিনার থেকে যে রাস্তাটি শামসুন্নাহার হলের সামনে দিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে চলে গেছে সেদিকে কিছুদূর গেলেই বেশ ঝকঝকে নতুন তৈরি এই গবেষণাকেন্দ্র। বিজ্ঞানী আবদুস সালাম এসেছেন একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের অতিথি হয়ে। আমাদের সেই সম্মেলনে প্রবেশাধিকার নেই। এত বড় একজন বিজ্ঞানীর সেমিনার শোনার সুযোগ আমরা পেলাম না। মনের ভেতর একটা কষ্ট লাগলো। ডিপার্টমেন্ট চাইলে কি পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞানী আবদুস সালামের একটা সেমিনারের আয়োজন করতে পারতো না? অবশ্য আমাদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের মধ্যেও কতজন গিয়েছিলেন জানি না। কারণ কোন শিক্ষকই এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলেননি। আমি এব্যাপারে জেনেছিলাম আমাদের গণিতের বন্ধু শৈবাল খাস্তগীরের কাছ থেকে।

পরীক্ষার আর মাত্র দু’মাস বাকি। কিন্তু এখনো আমাদের ক্লাস শেষ হয়নি। পরীক্ষার ফরম ফিল আপ হয়ে গেছে। সাধারণত সকালে ক্লাসে যাবার আগেই নাথ চলে আসে সাইকেল নিয়ে। আমার রুমে সাইকেল রেখে দু’জন একসাথে ক্লাসে যাই। কিন্তু গতকাল সে আসেনি। আজ সকালেও তার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। আসেনি। ফ্যাকাল্টিতেও সে যায়নি। কী হলো কে জানে।

বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পর বিপ্লব এলো ছুটতে ছুটতে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “প্রদীপের গুলি লেগেছে।“

শুনে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। বিপ্লবের কথা পুরোটা শোনার আগেই আমার মনে হলো নিশ্চয় সন্ত্রাসীরা গুলি করেছে তাকে। তাদের ওদিকে জাতীয় পার্টির সন্ত্রাসী আবদু’র রাজত্ব চলছে। আবদু যখন খুশি প্রকাশ্যে স্টেনগান দিয়ে মানুষ মারে। প্রথম যে প্রশ্ন বিপ্লবকে করলাম তা হলো, “সে কি বেঁচে আছে?”

বিপ্লবের কাছ থেকে পুরোটা শোনার পর কিছুটা দুশ্চিন্তা কাটলো। স্টেনগানের গুলি নয়, এয়ারগানের গুলি লেগেছে তার হাতে। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।

দ্রুত রুম থেকে বের হলাম। বিপ্লবসহ প্রদীপনাথের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গতকাল সকালে ইউনিভার্সিটিতে আসার জন্য রেডি হচ্ছিল নাথ। পুকুর থেকে স্নান করে উঠে ঘাটে দাঁড়িয়ে কাপড় বদলাচ্ছিল। এমন সময় সাইফুল ও কামাল এয়ারগান নিয়ে হাজির। কোনকিছু বলার আগেই কামাল নাথের দিকে এয়ারগান তাক করে গুলি ছুঁড়ে। গুলি করেছিল বুক বরাবর। সাইফুল হাত দিয়ে এয়ারগান সরিয়ে দেয়। গুলি এসে লাগে নাথের চোখ বরাবর। পূর্বদিক থেকে সূর্যের আলো এসে পড়ছিল নাথের চোখে। সেই আলো আড়াল করার জন্য নাথ হাত তুলেছিল চোখের সামনে। এয়ারগানের গুলি এসে ঢুকে যায় সেই হাতে। গুলি হাতের মধ্যে আটকে থেকেছে বলেই তার চোখ বেঁচে গেছে।

তাকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সেখানে হাত থেকে গুলি বের করতে পারে না। হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন নষ্ট। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চকবাজারে, ডাক্তার শিবুনাথের চেম্বারে। শিবুনাথ হাতে কাটাছেঁড়া করার পরেও গুলি বের করতে না পেরে জবাব দিয়ে দেয়। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় প্যানোরোমা হাসপাতালে। সেখানে অপারেশান করে গুলি বের করতে করতে রাত এগারোটা বেজে যায়। গুলি বুড়ো আঙুলের গোড়ায় হাড়ের মধ্যে গেঁথেছিল।

আমরা যখন নাথের বাড়িতে গেলাম, তখনো সে প্যানোরোমা হাসপাতালে। সাইফুলের কাছ থেকে সবকিছু শুনলাম। কামাল নাকি মনে করেছিল এয়ারগানে গুলি ভরা নেই। গুলি না থাকলেও মানুষের দিকে বন্দুক তাক করবে কেন মানুষ?

হাসপাতাল থেকে ফেরার দু’দিন পর আবার যেতে হলো হাসপাতালে ক্ষতস্থানের ড্রেসিং আর ড্রেন চেঞ্জ করতে। সেদিন বিকেলে তাদের বাড়ি গিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। কাজ শেষ হতে হতে রাত হয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে টেক্সি করে বহদ্দারহাট। সেখান থেকে কাপ্তাই বাসে মদুনাঘাট। সেখান থেকে রিকশা করে মধ্যমাদার্শা পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল।

ছোট্ট একটা ঘটনা থেকে কত বড় বিপদ হয়ে গেল। আরো কত বড় বিপদ হতে পারতো চিন্তা করলেই আঁৎকে উঠতে হয়। ফাইনাল পরীক্ষার আগে এরকম বিপদের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। এত কষ্টের মধ্যেও নাথের কাব্যচর্চা থেমে নেই। বলে – ‘হাতে লাগলো গুলি, আরেকটু হলেই গেছিল মাথার খুলি।‘

নাথকে ছাড়াই ক্যাম্পাসে যেতে হলো অনেকদিন। লিপি একদিন জিজ্ঞেস করলো, ‘কি রে, ছোটপ্রদীপকে দেখছি না ক’দিন হলো।“

“তাকে গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা।“

“বলিস কী?” – লিপি আঁৎকে উঠে।

কী গুলি লেগেছে সেটা আর বলা হয়নি লিপিকে।


পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>>

<<<<<<<<<< আগের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts