Sunday 13 June 2021

দুর্নীতির রীতিনীতি

 "প্রদীপ, তুমি কি আমার একটা কাজ করতে পারবে?"

"জ্বি স্যার, পারবো।"

"কী কাজ না জেনেই কীভাবে বললে যে পারবে?"

"সরি স্যার, চেষ্টা করবো। কী কাজ স্যার?"

"--- এই দোকানে গিয়ে আমার জন্য ছয় ইঞ্চি লম্বা একটি স্ক্রু-ড্রাইভার কিনে নিয়ে আসবে। এই কাগজে স্ক্রু-ড্রাইভারের ডেসক্রিপশান দেয়া আছে। সব মিলিয়ে নেবে।" 

"স্যার ঐ দোকান থেকেই কি কিনতে হবে?"

"হ্যাঁ"

"যদি ঐ দোকানে না থাকে? অন্য দোকান থেকে আনবো স্যার?"

"না। ক্যাশ মেমো নিয়ে আসবে।"

কাগজ আর পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে প্রামাণিক স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। 

যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রামাণিক স্যারকে মন থেকে পছন্দ করতেন এমন মানুষ খুব বেশি ছিল বলে মনে হয় না। স্যারের মত কাঠখোট্টা চাঁছাছোলা সত্যবাদী অধ্যাপক বাংলাদেশে আমি খুব একটা দেখিনি। যারা সবসময় সত্য কথা বলেন তাদেরকে সবসময় পছন্দ করা কঠিন কাজ। আমরা সত্যবাদীদের ততক্ষণ পছন্দ করি, যতক্ষণ সেই সত্যবাদিতা আমাদের পক্ষে যায়। 

তখন সবে অনার্স পাস করেছি। মাথার ভেতর যুক্তিবাদের ভূত বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। তাই "কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কভু করে না বঞ্চনা" - নীতি অবলম্বন করে প্রামাণিক স্যারের কাছে গবেষণার প্রথম পাঠ শুরু করেছি। 

স্যারের নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ইলেকট্রনিক্সের দোকানে গিয়ে নির্দিষ্ট স্ক্রু-ড্রাইভারটা কিনে নিয়ে এলাম। দাম নিলো নয় টাকা। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে স্যারের হাতে স্ক্রু-ড্রাইভার, ক্যাশ মেমো আর ৪১ টাকা ফেরত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "স্ক্রু-ড্রাইভারের রহস্য কী স্যার?"

স্যার খুবই মন খারাপ করে উত্তর দিলেন, "একটা সামান্য ফ্যাক্টচেক করলাম।" আর কিছু জানা গেলো না স্যারের কাছ থেকে। 

কিছুদিন পরে ব্যাপারটা জানলাম অন্য সোর্স থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিগুলোতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার জন্য যে ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি টেন্ডার পেয়েছে তারা একটা ছয় ইঞ্চি স্ক্রু-ড্রাইভারের দাম ধরেছে ৪৫ টাকা। ঐ কোম্পানির দোকান থেকেই যা আমি কিনেছি নয় টাকা দিয়ে। স্যার পারচেজ কমিটিতে ছিলেন বলেই এই ফ্যাক্টচেকের ব্যবস্থা। স্যারের পক্ষে অন্যান্য আইটেমের ফ্যাক্টচেক করা সম্ভব হয়েছিল কি না জানি না। তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন, স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। স্যারকে কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। কয়েক হাজার ৯ টাকার স্ক্রু-ড্রাইভার ৪৫ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে আমাদের বিদ্যাদান করার জন্য। এভাবেই ইংরেজিতে যাকে বলে -  we were screwed. 

আজ এত বছর পরেও দেখি একই অবস্থা। সামিয়ানার রঙ বদলেছে, কিন্তু ভেতরে সব একই জিনিস। এখন সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বই সাড়ে পঁচাশি হাজার টাকায় কেনা হচ্ছে। এত বেশি দাম দিয়ে কেনা বই পড়ে আমরা যে কী পরিমাণ জ্ঞানী হবো! আচ্ছা, এত জ্ঞান আমরা রাখবো কোথায়?

৩১ আগস্ট ২০১৯

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts