১
যে পৃথিবীতে
আমাদের বসবাস সে পৃথিবীতে আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ঠিকানা আছে। আধুনিক স্যাটেলাইটের
কল্যাণে জিপিএস আমাদের অবস্থান (লোকেশান) মুহূর্তেই খুঁজে দেয়। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে
এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান ঠিক কোথায়?
প্ল্যানেট আর্থ
– পৃথিবী নামের এই গ্রহটি আমাদের কাছে যতই অনন্য হোক না কেন – মহাবিশ্বে গ্রহের আনুমানিক
সংখ্যা এক হাজার কোটি কোটি কোটি (১০২৪)। এদের প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব নক্ষত্রের
চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী গ্রহের আছে তার নিজস্ব সৌরজগৎ। এরকম কোটি কোটি কোটি নক্ষত্রজগত
আছে মহাবিশ্বে। এই নক্ষত্রগুলির আবার আছে নিজস্ব ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি – যেখানে নক্ষত্রগুলি
জোটবদ্ধ হয়ে থাকে। মহাবিশ্বে আনুমানিক দুই লক্ষ কোটি (দুই ট্রিলিয়ন) গ্যালাক্সি আছে।
আমাদের সৌরজগৎ যে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত – তার নাম মিল্কিওয়ে। এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে
অবস্থিত নক্ষত্রের সংখ্যা হতে পারে দশ হাজার কোটি থেকে চল্লিশ হাজার কোটি। এতগুলি সূর্যের
ভীড়ে আমাদের সৌরজগৎ-এর নাক্ষত্রিক ঠিকানা বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করেছেন কয়েক শ বছরের নিরলস
জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা্র মাধ্যমে।
আজ আমরা মহাবিশ্বের সাপেক্ষে আমাদের পৃথিবীর ঠিকানা বলতে
পারি এভাবে: দৃশ্যমান মহাবিশ্বে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সৌরজগতে আমরা থাকি। মিল্কিওয়ে
গ্যালাক্সি ছোট বড় আরো চুয়ান্নটি গ্যালাক্সি মিলে একটি গ্যালাক্সি-পাড়া বা লোকাল গ্রুপের
অন্তর্ভুক্ত। এই পাড়ায় আমাদের গ্যালাক্সি থেকে সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি হলো ক্যানিস
মেজর ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি – যা ছোট একটি গ্যালাক্সি। পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের এই
গ্যালাক্সিকে আমাদের গ্যালাক্সি আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে (মাধ্যাকর্ষণের টানে কাছে
নিয়ে আসছে)। আমাদের গ্যালাক্সি পাড়ার সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমিডা। এই
অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি এত বিশাল এবং এত উজ্জ্বল যে আমাদের কাছ থেকে পঁচিশ লক্ষ
আলোকবর্ষ দূরে হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী থেকে আমরা খালি চোখেও এই গ্যালাক্সির নক্ষত্রমন্ডলী
দেখতে পাই। তবে আমাদের জন্য বিপদ এই যে আগামী চার শ কোটি থেকে পাঁচ শ কোটি বছরের মধ্যে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে
গিলে খাবে – অর্থাৎ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি মিশে যাবে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সাথে।
আরো বিশাল সেই মহা-গ্যালাক্সির নাম হবে মিল্কোমিডা।
কিন্তু এতসব
আমরা জানলাম কীভাবে? আমাদের গ্যালাক্সির নামই বা কেন হলো মিল্কিওয়ে?
২
পৃথিবীতে প্রথম
প্রাণের উদ্ভব যখন হয়েছে ততদিনে মহাবিশ্বের বয়স হয়ে গেছে প্রায় এক হাজার কোটি বছর।
আর মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র পঁচিশ লক্ষ বছর আগে। তাই আদিমানুষ আকাশের দিকে চোখ তুলেই
দেখতে পেয়েছে দিনের বেলা সূর্য আলো দিচ্ছে, আর সূর্য ডোবার পর লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র রাতের
অন্ধকারে মিটমিট করছে। মানুষের অদম্য কৌতুহল আর অনুসন্ধিৎসা থেকে জন্ম নিয়েছে মহাকাশবিজ্ঞান
– পর্যবেক্ষণই যার প্রধান অবলম্বন। প্রকৃতিনির্ভর অসহায় আদিমানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে
প্রচন্ড ভয় পেতো। সেই ভয় থেকে জন্ম নিয়েছে ভক্তি এবং নানারকমের দেবদেবীর কল্পকাহিনি।
আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত নক্ষত্র-ছড়ানো ছায়াপথ দেখতে দেখতে পৃথিবীর
বিভিন্ন দেশের মানুষ কল্পনা করে নিয়েছে বিভিন্ন কাহিনি।
ভারতীয় কাহিনিতে
আমাদের ছায়াপথের নাম আকাশগঙ্গা। প্রাচীন মুনিঋষিরা ধারণা করে নিয়েছিলেন আকাশের এক প্রান্ত
থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত যে নক্ষত্রমন্ডলি দেখা যায় তা আসলে স্বর্গে বয়ে চলা নাক্ষত্রিক
নদী। গঙ্গা নদীর সাথে মিলিয়ে এর নাম রাখা হয় আকাশগঙ্গা। এই আকাশগঙ্গার সাথে মিল্কিওয়ে
নামের সরাসরি কোন শাব্দিক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং গ্রিক এবং রোমান গল্পে সরাসরি
‘মিল্কিওয়ে’ শব্দটির উৎস পাওয়া যায়।
গ্রিকদের গল্পে আছে – দেবতা জিউস আল্কমেনা নামে এক
মানবীর প্রেমে পড়ে। জিউস ও আল্কমেনার একটি সন্তান হয়, যার নাম হারকিউলিস। হারকিউলিসের
মা যেহেতু দেবতা নন, তাই হারকিউলিস জন্মসূত্রে অমরত্ব পাননি। জিউস জানেন হারকিউলিসকে
যদি কোন দেবীর বুকের দুধ খাওয়ানো যায়, তাহলে হারকিউলিস অমরত্ব লাভ করবে। দেবী হেরা
ছিলেন জিউসের স্ত্রী। হারকিউলিস যেহেতু হেরার সন্তান নয়, হেরা স্বাভাবিকভাবে হারকিউলিসকে
নিজের বুকের দুধ খাওয়াবেন না। তাই জিউস একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। একদিন হেরা যখন ঘুমাচ্ছিলেন,
জিউস ছোট্ট হারকিউলিসকে হেরার বুকে দিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙার পর হেরা যখন দেখলেন শিশু
হারকিউলিস তার বুকের দুধ পান করছে – দ্রুত হারকিউলিসকে বুক থেকে সরিয়ে দিলেন। এই সময়
হেরার বুক থেকে দুধ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে তৈরি হয়েছে “গ্যালাক্সিয়াস কাইক্লস” যার ইংরেজি
অনুবাদ মিল্কি ওয়ে। রোমানদের গল্পও প্রায় একই রকম। এসব গল্প খ্রিস্টজন্মের অনেক বছর
আগের। এরপর বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়ে গেলেও আমাদের গ্যালাক্সির নাম সেই প্রাচীন মিল্কিওয়েই
রয়ে গেছে।
৩
যতদিন পর্যন্ত
খালিচোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে, গ্যালাক্সি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জানার পরিধি
বিস্তার লাভ করেছে খুবই ধীর প্রক্রিয়ায়। পৌরাণিক কাহিনি বিশ্বাস করে কেউ কেউ এই ছায়াপথকে
দুধের নদী বললেও – মানুষ ক্রমেই বুঝতে পেরেছে এর সাথে প্রাকৃতিক কোন ঘটনার যোগাযোগ
আছে। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল মত দিয়েছিলেন এই ছায়াপথ হলো নক্ষত্র থেকে জ্বলন্ত বাষ্পের
নিঃসরণ। এরপর প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত এরকম গ্রিক ধারণাই প্রচলিত ছিল।
কিন্তু নবম
শতাব্দী থেকে এই ধারণার বদলে বাস্তবধর্মী বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রাধান্য পেতে শুরু করে।
নবম শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আল-আব্বাস আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে খাতির আল-ফারগানি
তাঁর “কিতাব ফি আল-হারাকাত আল-সামাইয়া ওয়া জাওয়ামি ইল্ম আল-নুজুম” [ইলিমেন্টস অব অ্যাস্ট্রোনমি]
বইতে পৃথিবীর ব্যাস, পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদের দূরত্ব পরিমাপের পাশাপাশি ছায়াপথ সম্পর্কেও
কিছু নতুন ধারণা দেন। তিনি মিল্কিওয়েকে আকাশের একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করেন
যা ছিল গ্রিকদের কাল্পনিক ধারণা থেকে অনেকটাই বাস্তবের কাছাকাছি [১]।
দশম শতাব্দীতে
গ্যালাক্সি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণার আরো উন্নতি হয় মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জ্যোতির্বিদদের
হাত ধরে। ইরানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আল-হুসাইন আবদুর রহমান ইবনে উমর আল-সুফি ৯৬৪
খ্রিস্টাব্দে লেখা তাঁর “কিতাব আল-কাওয়াকিব আল-তাবিদ আল-মুসাওয়ার” [দ্য বুক অব ফিক্সড
স্টারস] বইতে ৪৮টি তারামন্ডলের বর্ণনা দেন। মিল্কিওয়ে ছাড়াও আমাদের আকাশ থেকে আরো উজ্জ্বল
যে অন্য ছায়াপথ “অ্যান্ড্রোমিডা” দেখা যায় – তার প্রথম বৈজ্ঞানিক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি
এই বইতে। অ্যান্ড্রোমিডা নামটি দেয়া হয়েছে গ্রিক পুরানের রাজকন্যা অ্যান্ড্রোমিডার
নাম অনুসারে। সেই সময় অবশ্য মনে করা হতো অ্যান্ড্রোমিডা মিল্কিওয়েরই অংশ। বিজ্ঞানী
আল-সুফিই সর্বপ্রথম অ্যান্ড্রোমিডার প্রথম বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেন।
সেই সময়কার
আরেক বিজ্ঞানী আলী আল-হাসান ইবনে আল-হাসান ইবনে আল-হাইথাম, যিনি আলজাহিন নামে পরিচিত
ছিলেন এবং যাঁকে আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক মনে করা হতো, টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের
ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ১০১১-১২ সালে রচিত তাঁর বিখ্যাত “কিতাব আল-মানাজির”
[দ্য বুক অব অপটিকস]-এ তিনিই সর্বপ্রথম সম্ভাবনা প্রকাশ করেন যে মিল্কিওয়ে ছায়াপথ হতে
পারে অসংখ্য নক্ষত্রের সমষ্টি – যা দূরত্বের কারণে একটি আলোক রেখার মতো দেখায়। টেলিস্কোপ
আবিষ্কৃত হবার পাঁচ শ বছরেরও আগে মিল্কিওয়ে সম্পর্কে তিনি যে কথাগুলি বলেছিলেন – পরবর্তীতে
আমরা তা সত্য বলে প্রমাণিত হতে দেখেছি। দ্বাদশ শতকে স্পেনের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ
আবু আল-ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদও মিল্কিওয়েকে অনেকগুলি নক্ষত্রের সমষ্টি
বলে অনুমান করেছেন যা পরবর্তীতে আশ্চর্যজনকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের
পর আকাশ পর্যবেক্ষণ নতুন মাত্রায় উন্নীত হলো। আমরা সবাই জানি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালিলিও
সর্বপ্রথম আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে
গ্যালিলিওরও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে টেলিস্কোপ তৈরি এবং ব্যবহার করেছিলেন বৃটিশ বিজ্ঞানী
লিওনার্ড ডিগেস ১৫৫১ সালে [২]। তাঁর পুত্র থমাস ডিগেসও ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৫৫৯
সালে লিওনার্ড ডিগেসের মৃত্যু হলে থমাস ডিগেস তাঁর বাবার অসমাপ্ত গবেষণা চালিয়ে নেন।
১৫৭১ সালে তিনি তাঁর বাবার লেখা একটি বই প্রকাশ করেন যাতে টেলিস্কোপ তৈরি এবং ব্যবহারের
বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই বইতে মহাবিশ্বের অসীমতা এবং অসংখ্য নক্ষত্রমন্ডলী গুচ্ছাকারে
ছায়াপথ তৈরি করার সম্ভাবনার কথা বর্ণিত হয়েছে। সে হিসেবে বলা চলে মিল্কিওয়ে যে অসংখ্য
নক্ষত্রের সম্মিলন তা টেলিস্কোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে প্রকাশ করেছিলেন থমাস ডিগেস
- গ্যালিলিওরও অনেক বছর আগে।
১৬১০ সালে ইতালির
পদার্থবিজ্ঞানী গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ তাক করলেন আকাশের এক প্রান্ত থেকে
অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যাওয়া মিল্কিওয়ের দিকে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন খালি চোখে আবছা মেঘের
মতো যা দেখা যায় – তাতে রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র। এত বেশি নক্ষত্র সেখানে যে তার সীমিত
শক্তির টেলিস্কোপের মাধ্যমে তাদের সংখ্যা গণনা করা ছিল অসম্ভব [৩]। তবে গ্যালিলিওর
পর্যবেক্ষণ থেকে মিল্কিওয়ে সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা ছিল তা ভেঙে যায়। মিল্কিওয়ে যে
অসংখ্য তারার সমষ্টি সেই ধারণা বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করতে শুরু করেন।
কিন্তু মিল্কিওয়ের
আকার, আয়তন, গতি ইত্যাদি নিরুপনের কাজ শুরু হয় আরো প্রায় দেড়শো বছর পর। ইংরেজ দার্শনিক
থমাস রাইট ১৭৫০ সালে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত তত্ত্বীয় ধারণা দেন
তাঁর ‘এন অরিজিনাল থিওরি অর নিউ হাইপোথিসিস অব দ্য ইউনিভার্স’ বইতে। তিনি মনে করেন
মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলি চাকতির মতো দুটো স্তরে সজ্জিত। সেখানে আমাদের সূর্যের অবস্থানও
তিনি প্রায়-সঠিকভাবে অনুমান করেন – যা চাকতির কেন্দ্র থেকে দূরে কিনারার একটি প্রান্তে
অবস্থিত। গ্যালিলিওর পরে আরো অনেকে মিল্কিওয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন টেলিস্কোপের সাহায্যে।
মিল্কিওয়ের কিনারায় ছোপ ছোপ মেঘের মতো উজ্জ্বল যে বস্তু দেখা যায় তাকে গ্যালিলিও নেবুলা
বা নক্ষত্র তৈরির কারখানা হিসেবে ধারণা দিয়েছিলেন। থমাস রাইট ধারণা দিলেন যে ওগুলি
মিল্কিওয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন, হতে পারে অন্য কোন নক্ষত্রমন্ডলির অংশ। সমসাময়িক সুইডিশ
দার্শনিক ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ, জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট, সুইস-জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী
জোহান হেনরিক ল্যামবার্ট প্রমুখ মিল্কিওয়ের নক্ষত্র সম্পর্কে থমাস রাইটের ধারণাকে সমর্থন
দেন [৪]। কিন্তু এর সবগুলি ছিল পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক দার্শনিক অনুমান।
মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলির অবস্থান এবং উজ্জ্বলতার বৈজ্ঞানিক পরিমাপ শুরু করেন স্যার উইলিয়াম হারশেল ১৭৮০ সালে। জার্মান বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অনেকগুলি উন্নতমানের টেলিস্কোপ তৈরি করেন এবং সেগুলি দিয়ে নিয়মিত আকাশ পর্যবেক্ষণ করে ১৭৮১ সালে সৌরজগতের দূরবর্তী গ্রহ ইউরেনাস আবিষ্কার করেন। মিল্কিওয়ের বিভিন্ন দিক থেকে নক্ষত্রগুলির অবস্থান নির্ণয় করে তিনি মিল্কিওয়ের একটি ম্যাপ তৈরি করেন। ১৭৮৫ সালে ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশানে প্রকাশিত [সংখ্যা ৭৫, পৃ ২১৩-২৬৬] মিল্কিওয়ের ম্যাপ থেকে দেখা যায়, হারশেল আমাদের সূর্যের অবস্থান নির্ণয় করেছেন মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে। মিল্কিওয়ের দৈর্ঘ্য তিনি নির্ণয় করেছেন সেখানে অবস্থিত নক্ষত্রগুলির গড় দূরত্বের ৮০০ গুণ, আর প্রস্থ হিসেব করেছেন নক্ষত্রগুলির গড় দূরত্বের ১৫০ গুণ। হারশেল ধরে নিয়েছিলেন মিল্কিওয়ের প্রতি একক আয়তনে সমান সংখ্যক নক্ষত্র আছে। তাঁর হিসেব থেকে মিল্কিওয়ের সত্যিকারের আয়তন নির্ণয় করার কোন উপায় ছিল না, কারণ পৃথিবী থেকে কোন নক্ষত্রেরই সঠিক দূরত্ব তখনো নির্ণয় করা যায়নি। মিল্কিওয়ের আকার আকৃতির সঠিক পরিমাপের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।
![]() |
উইলিয়াম হারশেলের মিল্কি ওয়ের ম্যাপ (১৭৮৫) |
১৮৪৭ সালে রাশিয়ান
জ্যোতির্বিজ্ঞানী অটো স্ট্রুভ প্রমাণ দিলেন যে মিল্কি ওয়ের সব জায়গায় সমান সংখ্যক নক্ষত্র
নেই। অর্থাৎ উইলিয়াম হারশেল যে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রের ঘনত্ব সমান বলে ধারণা করেছিলেন
তা সঠিক ছিল না। তাহলে উইলিয়াম হারশেলের মিল্কি ওয়ের ম্যাপের আকৃতি ঠিক থাকলেও তার
ভেতর আমাদের সূর্যের অবস্থান সঠিক নয়। ততদিনে পৃথিবী থেকে সূর্য এবং সৌরজগতের অন্য
কয়েকটি গ্রহের দূরত্ব নির্ণয় করা হয়ে গেছে। তার ভিত্তিতে অটো স্ট্রুভ মিল্কিওয়ের আকার
নির্ণয় করলেন। তিনি দেখালেন চ্যাপ্টা চাকতির মতো মিল্কিওয়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের
দূরত্ব কমপক্ষে তেরো হাজার আলোকবর্ষ। অর্থাৎ মিল্কিওয়ের এক প্রান্তের একটি নক্ষত্রের
আলো অন্য প্রান্তের নক্ষত্রে পৌঁছাতে তেরো হাজার বছর সময় লাগবে। বর্তমানে আমরা জানি
মিল্কিওয়ের আকার এর চেয়ে আরো অনেক অনেক বড়। সে কথায় আমরা আসবো একটু পর।
৪
বিংশ শতাব্দীর
শুরু থেকেই টেলিস্কোপের শক্তি এবং ব্যাপ্তি দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের
গবেষণা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলি অবজারভেটরি বা মানমন্দির
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময় মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির সঠিক আকার ও আয়তন সম্পর্কে সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে যাঁর হাত দিয়ে – তাঁর নাম হারলো শাপলি, মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির
উদীয়মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী
হবার কোন লক্ষ্যই ছিল না হারলো শাপলির। আমেরিকার মিসৌরি রাজ্যের ছোট্ট একটি গ্রামে
তাঁর জন্ম ১৮৮৫ সালে। ছোট্ট এক রুমের একটি স্কুলে তাঁর প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা।
ষোল বছর বয়সে ক্যানসাসের ডেইলি সান পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ার জন্য কিছু টাকাপয়সা জমানোর পর তিনি সাংবাদিকতা পড়ার জন্য গেলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিন্তু গিয়ে দেখেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ তখনো খোলা হয়নি। অন্য রাজ্যের
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার সঙ্গতি তার ছিল না। তাই ঠিক করলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি্র ক্যাটালগে প্রথম যে বিভাগের নাম পাবেন সেই
বিভাগেই ভর্তি হয়ে যাবেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো বিষয়ে ভর্তি হওয়া যেতো। ক্যাটালগের
প্রথম নামটি ছিল আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের। হারলো শাপলি ‘আর্কিওলজি’ শব্দটি উচ্চারণ
করতে না পেরে পরের নামে গেলেন। পরের নামটি ছিল অ্যাস্ট্রোনমি। শাপলি অ্যাস্ট্রোনমি
ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়ে গেলেন [৫]। এরপর দ্রুত
ইতিহাস তৈরি করলেন তিনি। ১৯১০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি
গেলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি
নরিস রাসেলের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করলেন শাপলি। ১৯১৪ সালে পিএইচডি শেষ করার পর
পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে কাজ পেলেন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে। সেখানকার
১.৫২ মিটার ব্যাসের শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে তিনি দিনরাত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ
করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে মিল্কি ওয়ের সঠিক আকার নির্ণয় করেন। যদিও পরবর্তীতে প্রমাণিত
হয় যে শাপলির পরিমাপে কিছুটা ভুল ছিল, তবুও সেই ১৯১৮ সালে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির এত
বিস্তারিত পরিমাপ জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। হারলো শাপলি হিসেব
করে দেখিয়েছিলেন যে আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে
অবস্থিত। [পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে ছাব্বিশ
হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।]
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির
যে আকার শাপলি নির্ণয় করেছিলেন তার আয়তন এত বেশি ছিল যে তিনিসহ আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী
সেই সময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে মিল্কিওয়েই একমাত্র গ্যালাক্সি যা পুরো মহাবিশ্বব্যাপী
ছড়িয়ে আছে। কিন্তু অনেকের কাছেই এটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। ক্যালিফোর্নিয়ার লিক অবজারভেটরির
জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেবার কারটিস এবং তাঁর দল তাঁদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দাবি করলেন
– মিল্কি ওয়ে মহাবিশ্বের একটি গ্যালাক্সি, একমাত্র গ্যালাক্সি নয়। মহাবিশ্ব আরো অনেক
বড়, যেখানে মিল্কিওয়ের মতো আরো হাজার হাজার গ্যালাক্সি আছে।
এই দ্বন্দ্বের
অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স একটি বৈজ্ঞানিক বিতর্কের
আয়োজন করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি ‘দ্য গ্রেট ডিবেট’ নামে খ্যাতিলাভ করেছে।
১৯২০ সালের ২৬ এপ্রিল এই বিতর্ক সভা অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। প্রচলিত
তর্ক-বিতর্ক এটি ছিল না। এটি ছিল মূলত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন। হারলো শাপলি মিল্কিওয়েই
পুরো মহাবিশ্ব – এই মতের পক্ষে তাঁর তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন চল্লিশ মিনিট।
এরপর হেবার কারটিস উপস্থাপন করেন তাঁর তথ্য-উপাত্ত যেখানে তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝান যে
মিল্কিওয়ে ছাড়াও আরো অনেক গ্যালাক্সি আছে মহাবিশ্বে। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। উপস্থিত
বিজ্ঞানীদের ভোটে কারটিসের যুক্তি জয়লাভ করে।
অবশ্য পরবর্তী
চার বছরের মধ্যে এডউইন হাবল প্রমাণ করে দেন যে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের
অংশ নয়, বরং মিল্কি ওয়ে থেকে পচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের আলাদা আরেকটি গ্যালাক্সি।
৫
পৃথিবীর মানমন্দির
থেকে টেলিস্কোপের সাহায্যে নক্ষত্রের আলো পর্যবেক্ষণ করে আলোর তীব্রতার সাথে দূরত্বের
বিপরীত বর্গের সূত্র প্রয়োগ করে নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়
বাধা হয়ে দাঁড়ায় মহাজাগতিক ধুলিকণা যা নক্ষত্রের আলোর তীব্রতা কমিয়ে দেয়। ধুলিকণার
কারণে প্রায়ই হিসেবে গন্ডগোল হয়ে যায়। সেই গন্ডগোল মিটে গেল রেডিও টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের
পর থেকে। ধুলিকণা বেতার তরঙ্গের ওপর খুব বেশি প্রভাব খাটাতে পারে না। ফলে জ্যোতির্বিদ্যার
পরিমাপ অনেক সহজ এবং সঠিক হয়ে ওঠেছে। পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর পর
থেকে মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি
মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমরা এখন অনেক কিছু সঠিকভাবে জানি।
মিল্কিওয়ের
আকার আকৃতি
আমরা যেহেতু
মিল্কিওয়ের ভেতরে থাকি, সেহেতু দূর থেকে মিল্কিওয়েকে পুরোপুরি দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু
যদি সম্ভব হতো, যদি আমরা মিল্কিওয়ের উপর থেকে মিল্কিওয়েকে দেখতে পেতাম, তাহলে মিল্কিওয়েকে
মনে হতো রাতের বেলা আলো ঝলমলে এক শহরের মতো যেখানে বিশ হাজার কোটি সূর্য আলো ছড়াচ্ছে।
এই সূর্যগুলির ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আন্তনাক্ষত্রিক ধুলো ও গ্যাসের মেঘ – যেগুলি
থেকে ভবিষ্যতে আরো নক্ষত্র তৈরি হবে। এক পাশ থেকে দেখলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে একটি
চ্যাপ্টা চাকতির মতো লাগবে যার মাঝখানে বেশ উঁচু। চাকতির চারপাশে ঘিরে রয়েছে বিশাল
গ্যাসের গোলক – যার নাম গ্যালাক্টিক হ্যালো।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির
চাকতির কেন্দ্রে ফুলে ওঠা জায়গার ব্যাস প্রায় তিন হাজার আলোকবর্ষ। এর ভেতর আছে প্রায়
এক হাজারটি নক্ষত্র – যাদের আনুমানিক ভর এক হাজার সূর্যের ভরের সমান। চাকতির সমতল অংশ
থেকে কেন্দ্রের এই ঢিবির উচ্চতা প্রায় ১৮০০ আলোকবর্ষ। সমতল অংশে চাকতির পুরুত্ব প্রায়
এক হাজার আলোকবর্ষ। কেন্দ্র থেকে চাকতির ব্যাসার্ধ প্রায় পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ। পুরো
চাকতিকে ঘিরে অদৃশ্য হাইড্রোজেন গ্যাসের স্তর, কেন্দ্র থেকে যার ব্যাসার্ধ আশি হাজার
আলোকবর্ষ।
পুরো চাকতিটি
রয়েছে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধের একটি গোলকের ভেতর। এই গোলকটির নাম স্টেলার
হেলো। ধরে নেয়া হয় এই পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্ব পর্যন্ত মিল্কিওয়ের মাধ্যাকর্ষণ
কাজ করে। এর বাইরে যদি কোন নক্ষত্র পাওয়া যায় – তা অন্য কোন গ্যালাক্সির বলে ধরে নেয়া
হয়।
![]() |
মিল্কিওয়ের বিভিন্ন অংশ |
হ্যালো
মিল্কিওয়ের
হ্যালো অংশটি খুব রহস্যময়। এই গ্যাসীয় গোলকের ভেতর প্রায় দুই শ উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ
আছে যারা খুবই কাছাকাছি থেকে গুচ্ছ তৈরি করেছে। এদের একেকটি গুচ্ছের ব্যাস মাত্র কয়েকশ
আলোকবর্ষ। এই দুরত্বের ভেতরই লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র গাদাগাদি করে খুবই প্রতিসমভাবে একে
অপরকে আকর্ষণ করে আছে। এই ‘গ্লোবিউলার ক্লাস্টার’ গুলি নিঁখুত গোলকাকার। গ্যালাক্সির
সবচেয়ে বয়স্ক নক্ষত্রগুলিই থাকে এসব গুচ্ছে। চাকতির নক্ষত্রগুলির বয়স যদি এক হাজার
কোটি বছর হয়, গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের নক্ষত্রগুলির বয়স তেরো শ কোটি বছর।
গ্যালাক্টিক
হ্যালোর গ্লোবিউলার ক্লাস্টারগুলি উজ্জ্বল হলেও বাকি অংশ খুবই অন্ধকার। বিজ্ঞানীরা
হিসেব করে দেখেছেন গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের সূর্যগুলির ভর আর হ্যালোর মোট ভরের তুলনায়
খুবই সামান্য। তাহলে বাকি অন্ধকার স্থানে কি লুকিয়ে আছে ডার্ক ম্যাটার? এই রহস্যের
সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি।
চাকতি
একপাশ থেকে
দেখলে মিল্কিওয়েকে যেমন একটি সাদাসিধে চাকতির মতো লাগে, আসলে কিন্তু এটি সোজা একটি
চাকতি নয়। এর চারটি প্যাঁচানো বাহু আছে। কেন্দ্রের উঁচু ঢিবির কাছাকাছি দুটো প্রধান
বাহু পারসিয়াস আর্ম ও স্যাজিটারিয়াস আর্ম। তৃতীয় বাহুর নাম সেনটোরাস আর্ম এবং চতুর্থ
বাহু – আউটার আর্ম।
পারসিয়াস বাহু
মিল্কিওয়ের বেশ প্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বাহু যেখানে রয়েছে অনেকগুলি নীহারিকা বা নেবুলা
যেখানে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। এখানে নক্ষত্রের ঘনত্ব চাকতির নক্ষত্রের ঘনত্বের চেয়ে
বেশি। এই বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ষাট হাজার আলোকবর্ষ, কিন্তু সে তুলনায় প্রস্থ খুবই কম,
মাত্র তিন-চার হাজার আলোকবর্ষ। এখানেই আছে ব্রিলিয়েন্ট স্টার ফাই ক্যাসিওপিয়া – যা
আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় দুই লক্ষ গুণ উজ্জ্বল। এই বাহুতেই আছে ক্র্যাব নেবুলা সুপারনোভা।
মিল্কিওয়ের
প্রধান বাহু স্যাজিটারিয়াস আর্ম। এর দৈর্ঘ্য দশ থেকে পনের আলোকবর্ষ, প্রস্থ তিন থেকে
চার আলোকবর্ষ। ঈগল, ওমেগা, ট্রিফিড, ল্যাগুন নেবুলা এই বাহুতে অবস্থিত। এই বাহুতে একাধিক
ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পাওয়া গেছে। ষোলটি সূর্যের ভরের সমান ব্ল্যাকহোল সিগনাস এক্স-১
মিল্কিওয়ের এই বাহুতে অবস্থিত।
পারসিয়াস ও
স্যাজিটারিয়াস বাহুর মাঝখানে আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের বাহু আছে – যার নাম অরিয়ন বাহু
বা অরিয়ন স্পার। এই অরিয়ন স্পারের আগার দিকে আমাদের সূর্যের বাড়ি। এই সৌরজগতের ছোট্ট
গ্রহ পৃথিবীতে আমাদের বাস। এই বাহুতে আছে রিং
নেবুলা, অরিয়ন নেবুলা, বাটারফ্লাই ক্লাস্টার, টলেমি ক্লাস্টার ইত্যাদি।
মিল্কিওয়ের
কেন্দ্রে যে উঁচু ঢিবি আছে সেটাই আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র বা গ্যালাকটিক সেন্টার।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটাই গ্যালাক্সি রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের
মধ্যে কেন্দ্রের নক্ষত্রপুঞ্জ সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ভেরি লার্জ
রেডিও-টেলিস্কোপের মাধ্যমে জানা গেছে এর কেন্দ্রে ঘূর্ণায়মান গ্যাস চক্রাকারে ঘুরছে।
১৯৯৭ সালে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি নক্ষত্রগুলোর অস্বাভাবিক দ্রুত ঘূর্ণন বেগ
পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন মিল্কিওয়ের এই কেন্দ্রে আছে ২৫ লক্ষ সূর্যের
ভর সম্পন্ন বিশাল ব্ল্যাকহোল স্যাজিটারিয়াস এ স্টার। কেন্দ্র থেকে মাত্র দশ আলোকবর্ষ
দূরে উত্তপ্ত গ্যাসের মেঘ – স্যাজিটারিয়াস এ কমপ্লেক্স।
মিল্কিওয়ের
কেন্দ্রের এক শ আলোকবর্ষ ব্যাসের মধ্যে যে চৌম্বকক্ষেত্র পাওয়া গেছে তার তীব্রতা মিল্কিওয়ের
অন্যান্য জায়গার চোউম্বকক্ষেত্রের তীব্রতার চেয়ে প্রায় হাজার গুণ বেশি। এই চৌম্বকক্ষেত্রের
সঠিক উৎস এখনো অজানা।
ভর ও অন্যান্য
বৈশিষ্ট
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি
একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি। এর উজ্জ্বলতা ১৪০০ কোটি সূর্যের উজ্জ্বলতার সমান। ডার্ক
ম্যাটারসহ এর মোট ভর এক লক্ষ কোটি সূর্যের ভরের সমান, যার মধ্যে নক্ষত্রের ভর বিশ হাজার
কোটি সূর্যের ভর, মোট গ্যাসের ভর – দুই হাজার কোটি সূর্যের ভর, ধূলিকণার ভর – বিশ কোটি
সূর্যের ভরের সমান। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে আমাদের সূর্যের একবার ঘুরে আসতে
সময় লাগে বাইশ কোটী বছর।
৬
মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমাদের এখনো অনেক বিষয় জানার বাকি। অতি সম্প্রতি (১১ মার্চ ২০২৫) আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা ‘স্পেকট্রো-ফটোমিটার ফর দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ইউনিভার্স, ইপক অব রি-আয়নাইজেশান আন্ড আইসেস এক্সপ্লোরার (SPHEREx) মিশন চালু করেছে। এই স্যাটেলাইট ১১ মার্চ ২০২৫ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। ১ মে থেকে এই স্যাটেলাইট কাজ শুরু করেছে। আগামী দুই বছর ধরে মহাকাশে মহাবিশ্বের পঁয়তাল্লিশ কোটিরও বেশি গ্যালাক্সির তথ্য সংগ্রহ করবে এই স্যাটেলাইট। পাশাপাশি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরও দশ কোটিরও বেশি নক্ষত্রের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে জানার চেষ্টা করবে মহাবিশ্বের উদ্ভব হবার আসল রহস্য কী। প্রাণের উদ্ভব ঘটার জন্য যেসব উপাদানের দরকার, মিল্কিওয়ের অন্যান্য নক্ষত্রের জগতের অন্য কোন গ্রহে তা পাওয়া যায় কি না তাও অনুসন্ধান করে দেখবে এই মিশন [৬]। সেসব তথ্য থেকে মিল্কিওয়ের অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।
তথ্যসূত্র
১। জিম আল-খলিলি,
দ্য হাউজ অব উইজডম হাউ অ্যারাবিক সায়েন্স সেইভড অ্যানসিয়েন্ট নলেজ অ্যান্ড গেইভ আজ
দ্য রেনেসান্স, দ্য পেঙ্গুইন প্রেস, নিউইয়র্ক, ২০১১।
২। জন গ্রিবিন,
গ্যালাক্সি অ্যা ভেরি শর্ট ইনট্রোডাকশান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮।
৩। গাইলস স্পারো,
ফিফটি আইডিয়াস ইউ রিয়েলি নিড টু নো অ্যাস্ট্রোনমি,কুয়েরকাস, লন্ডন, ২০১৬।
৪। ফ্রাঙ্কোইস কমবিস ও জেমস লেকিস, ‘দ্য মিল্কি ওয়ে
স্ট্রাকচার, ডায়নামিক্স, ফরমেশান আন্ড ইভ্যুলিউশান’, কারেন্ট ন্যাচারাল সায়েন্সেস,
প্যারিস, ২০১৬।
৫। জে পি ম্যাকইভয়,
দ্য ইউনিভার্স ফ্রম এনসিয়েন্ট ব্যাবিলন টু দ্য বিগ ব্যাং, রবিনসন, লন্ডন, ২০১০।
৬। https://www.jpl.nasa.gov/missions/spherex/
_______________
বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment