Sunday 15 December 2019

চাঁদের নাম লুনা - ১২


জোয়ার-ভাটা

চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে কেন ঘুরছে? আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি মহাকর্ষ বলের কারণে পৃথিবী চাঁদকে নিজের দিকে টানছে, আর চাঁদও পৃথিবীকে টানছে। পৃথিবী থেকে যখন চাঁদের দূরত্ব কমে যায় তখন এই টান বেড়ে যায়, আবার দূরত্ব যদি বেড়ে যায় টান কমে যায়। সুপারমুনের সময় পৃথিবীর অনেক কাছে এসে পড়ে চাঁদ। তখন পৃথিবীর ওপর চাঁদের টান অনেকটা বেড়ে যায়।
            কী হয় তাতে পৃথিবীর? পৃথিবীর শক্তভূমি পাহাড়-পর্বত এগুলোকে কিছুই করতে পারে না চাঁদের টান। কিন্তু পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গা দখল করে আছে তরল পানি। চাঁদ যখন পৃথিবীর যেদিকে থাকে সেদিকের পানিগুলো চাঁদের টানে চাঁদের দিকে ছুটে যেতে চায়। তার ঠিক বিপরীত দিকের পৃথিবীর পানিগুলো চাঁদের উল্টোটানের কারণে উল্টোদিকে চলে যেতে চায়।
            কিন্তু এদিকে পৃথিবী নিজেও ঘুরছে নিজের অক্ষের ওপর। পৃথিবী ঘুরছে চাঁদের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত। ফলে পৃথিবীর যেসব পানি চাঁদের দিকে চলে যেতে চায় তারা চাঁদ যেদিকে আছে তার চেয়েও একটু সামনে চলে যায়। তাতে হয় কি পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। এটাকেই আমরা জোয়ার বলি।
            তারপর চাঁদ যখন সামনের দিকে সরে যায় তখন পানির ওপর টান কমে যায়। পানির উচ্চতা তখন আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে। আর পানিও ফিরে যেতে থাকে আগের জায়গায়। এটাকে আমরা ভাটা বলি। পৃথিবীর ওপর চাঁদের টানে এই জোয়ার-ভাটা অবিরাম চলছে। চাঁদের অবস্থান বদলের কারণে জোয়ার-ভাটার স্থানও বদলে যায়।




দিনে দুবার জোয়ার হয়, দুবার ভাটা হয়। এই জোয়ার ভাটার সময়ও চাঁদ ওঠার মতো প্রতিদিন ৫০ মিনিট দেরিতে হতে থাকে। অর্থাৎ মনে করো কর্ণফুলি নদীতে আজ জোয়ার এলো সকাল দশটায়। তাহলে আগামী কাল জোয়ার আসবে সকাল দশটা পঞ্চাশ মিনিটে, পরশু জোয়ার আসবে সকাল এগারোটা চল্লিশ মিনিটে।
            চাঁদের মতো সূর্যও পৃথিবীকে টানছে নিজের দিকে। কিন্তু সূর্য পৃথিবী থেকে চাঁদের তুলনায় অনেক অনেক দূরে বলে সূর্যের টান খুব বেশি বোঝা যায় না। কিন্তু সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ যখন পরস্পর সমকোণে থাকে, তখন দেখা যায় চাঁদ পৃথিবীকে টানছে একদিক থেকে, সূর্য টানছে অন্যদিক থেকে। তখন সূর্যের টানে চাঁদের টান কিছুটা কমে যায়। ফলে সেই সময় জোয়ারের তেজ খুব একটা থাকে না। সেরকম জোয়ারকে ইংরেজিতে বলে নিপ টাইড (neap tide) আর বাংলায় বলে মরা কটাল।
            আবার যখন সূর্য ও চাঁদ পৃথিবীর সাথে একই লাইনে থাকে তখন সূর্য যেদিকে টানছে পৃথিবীকে, চাঁদও একই দিকে টানছে। ফলে চাঁদ ও সূর্যের মিলিত টানে জোয়ারের তেজ অনেক বেড়ে যায়। অনেক উঁচু হয়ে জোয়ার আসে। এরকম জোয়ারকে ইংরেজিতে বলে স্প্রিং টাইড (spring tide), বাংলায় তেজ কটাল।


জোয়ার-ভাটার প্রভাব

জোয়ার-ভাটার প্রভাবে পৃথিবী ও চাঁদের ওপর প্রতিদিন কিছু স্থায়ী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। জোয়ারের সময় পানি একদিকে উঠে যাচ্ছে, ভাটার সময় নামছে - এতে পৃথিবীর প্রচুর শক্তিক্ষয় হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি কমে যাচ্ছে। ফলে দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে। ৩৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য ছিল ২১ ঘন্টা। এখন দিনের দৈর্ঘ্য হয়েছে ২৪ ঘন্টা। এখন প্রতি পঞ্চাশ হাজার বছরে এক সেকেন্ড করে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। এভাবে চললে আরো একশ' কোটি বছর পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য হবে ৫৫ ঘন্টার সমান। ভেবে দেখো কী অবস্থা হবে তখন। অবশ্য একশ কোটি বছর অনেক দীর্ঘ সময়।
            চাঁদের ওপর জোয়ার-ভাটার কোন প্রভাব পড়ছে না? অবশ্যই পড়ছে। জোয়ারের পানির ধাক্কার বল (force) চাঁদের গায়েও লাগছে। ফলে চাঁদ একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। চারশ কোটি বছর আগে চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছে ছিল। আমার দাদুর গল্পের কথা মনে পড়ছে না? সেই যে বুড়ির মাথায় চাঁদ ঠেকে যেতো। আসলে অতটা কাছে ছিল না। পৃথিবীর সাথে চাঁদের এখন যে দূরত্ব তার চেয়ে কিছুটা কাছে ছিল।
            অ্যাপোলো মিশনে নভোচারীরা চাঁদে গিয়ে চাঁদের পিঠে কিছু বিশেষ আয়না (mirror) রেখে এসেছে। পৃথিবী থেকে প্রতিদিন শক্তিশালী লেসার রশ্মি পাঠানো হয় চাঁদে। চাঁদের পিঠে রাখা আয়নায় প্রতিফিলিত হয়ে সেই লেজার ফিরে আসে পৃথিবীতে। এই আসা যাওয়ার সময়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে চাঁদ আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদের যেখানে প্রথম পা রেখেছিলেন নিল আর্মস্ট্রং - চাঁদের সেই জায়গাটা এখন প্রায় এক মিটার দূরে চলে গেছে পৃথিবী থেকে। হিসেব করে দেখা গেছে চাঁদ বছরে প্রায় তিন সেন্টিমিটার করে দূরে সরে যাচ্ছে। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts