Sunday, 15 December 2019

চাঁদের নাম লুনা - ১৭




আমেরিকার চন্দ্রাভিযান

চাঁদে আমেরিকানদের অভিযানের শুরুটা খুব একটা ভালো হয়নি। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত পরপর ১৫টি মিশন ফেল করে আমেরিকানদের। সবাই ভেবেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন জিতে যাবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমেরিকানরাই সফল হয়।
            আমেরিকা তাদের পুরো মিশনকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে:

  • পাইওনিয়ার প্রোগ্রাম: চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানো অথবা চাঁদের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এই প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়। কিন্তু ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত সবগুলো চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
  • র‍্যাঞ্জার প্রোগ্রাম: চাঁদের গায়ে ধাক্কা লাগানোর লক্ষ্যে এই প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ এই পাঁচ বছরে মোট নয়বার চেষ্টা করা হয়। প্রথম ছয়বার ব্যর্থ হবার পর শেষের তিনবার সফল হয়।
  • সারভেয়ার প্রোগ্রাম: চাঁদের বুকে যন্ত্র নামিয়ে সেখান থেকে ছবি ও ভূতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ ছিল এই প্রোগ্রামের লক্ষ্য। সাতটির মধ্যে পাঁচটি প্রচেষ্টা সফলতা পায়।
  • লুনার অরবিটার প্রোগ্রাম: চাঁদের কক্ষপথে চন্দ্রযান পাঠিয়ে চাঁদের ছবি তোলার লক্ষ্যে এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। খুবই সফল হয়।
  • অ্যাপোলো প্রোগ্রাম: চাঁদে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্যে এই প্রকল্প। সফল হয়ে ইতিহাস তৈরি করেছে।

র‍্যাঞ্জার প্রোগ্রাম

১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে র‍্যাঞ্জার প্রোগ্রামের আওতায় মোট নয়টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। লক্ষ্য ছিল চাঁদের পিঠে যন্ত্রযান পাঠানো। চাঁদের গায়ে আছড়ে পড়ার আধঘন্টা আগে থেকে চাঁদের ছবি তুলে পাঠাবে পৃথিবীতে। নয়টি রেঞ্জারের  মধ্যে প্রথম ছয়টি র‍্যাঞ্জারই ব্যর্থ হয়। কিন্তু শেষের তিনটি র‍্যাঞ্জার সফল হয়। চাঁদের পিঠের প্রায় পনেরো হাজার ছবি তুলে পাঠায় এই র‍্যাঞ্জারগুলো।

            নিচের তালিকায় র‍্যাঞ্জার প্রোগ্রামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো:

র‍্যাঞ্জার প্রোগ্রাম
র‍্যাঞ্জার
উৎক্ষেপণের
তারিখ
লক্ষ্য
ফলাফল
র‍্যাঞ্জার-১
২৩/০৮/১৯৬১
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
র‍্যাঞ্জার-২
১৮/১২/১৯৬১
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
র‍্যাঞ্জার-৩
২৬/০১/১৯৬২
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
চাঁদ থেকে দূরে চলে যায়।
র‍্যাঞ্জার-৪
২৩/০৪/১৯৬২
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
চাঁদে গিয়ে ধাক্কা দেয়। কিন্তু ছবি পাঠাতে ব্যর্থ হয়।
র‍্যাঞ্জার প্রোগ্রাম
র‍্যাঞ্জার
উৎক্ষেপণের
তারিখ
লক্ষ্য
ফলাফল
র‍্যাঞ্জার-৫
১৮/১০/১৯৬২
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
চাঁদ থেকে দূরে চলে যায়।
র‍্যাঞ্জার-৬
৩০/০১/১৯৬৪
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
চাঁদে গিয়ে ধাক্কা দেয়। কিন্তু ছবি পাঠাতে ব্যর্থ হয়।
র‍্যাঞ্জার-৭
২৮/০৭/১৯৬৪
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
সাফল্যের সাথে চাঁদে ধাক্কা দেয়। ৪৩০৮টি ছবি পাঠায়।
র‍্যাঞ্জার-৮
১৭/০২/১৯৬৫
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
সাফল্যের সাথে চাঁদে ধাক্কা দেয়। ৭১৩৭টি ছবি পাঠায়।
র‍্যাঞ্জার-৯
২১/০৩/১৯৬৫
চাঁদে ধাক্কা দেয়া
সাফল্যের সাথে চাঁদে ধাক্কা দেয়। ৪৩০৮টি ছবি পাঠায়।





সারভেয়ার প্রোগ্রাম

সারভেয়ার প্রোগ্রামের লক্ষ্য ছিল চাঁদে যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চন্দ্রযান নামানো যায় তা প্রমাণ করা। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত এই প্রোগ্রামের আওতায় সাতটি রিমোট কন্ট্রোলড চন্দ্রযান চাঁদের সাতটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নামানোর পরিকল্পনা করা হয়। সফলভাবে চাঁদে নামার পর এই স্বয়ংক্রিয় গাড়িগুলো চাঁদের পিঠের ছবি পাঠাবে এবং চাঁদের উপরিতলের প্রকৃতি পরীক্ষানিরীক্ষা করবে। সাতটি স্বয়ংক্রিয় রিমোট নিয়ন্ত্রিত গাড়ি চাঁদে পাঠানো হয়। সাতটির মধ্যে দুটি ব্যর্থ হয়, বাকি পাঁচটি সাফল্যের সাথে কাজ করে।

সারভেয়ার প্রোগ্রামের সারাংশ নিচের তালিকায় দেয়া হলো:
সারভেয়ার প্রোগ্রাম
সার্ভেয়ার
উৎক্ষেপণের
তারিখ
লক্ষ্য
ফলাফল
সার্ভেয়ার-১
৩০/০৫/১৯৬৬
চাঁদে নামা
প্রথমবারের মতো আমেরিকান চন্দ্রযান চাঁদে নামলো। এগারো হাজার ছবি তুলে পাঠালো।
সারভেয়ার প্রোগ্রাম
সার্ভেয়ার
উৎক্ষেপণের
তারিখ
লক্ষ্য
ফলাফল
সার্ভেয়ার-২
২০/০৯/১৯৬৬
চাঁদে নামা
চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে বিধ্বংস হয়।
সার্ভেয়ার-৩
১৭/০৪/১৯৬৭
চাঁদে নামা
সফলভাবে চাঁদে নামে। ছবি তোলা ও চাঁদের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের লক্ষ্য অর্জিত হয়। ছয় হাজার ছবি পাঠায় পৃথিবীতে।
সার্ভেয়ার-৪
১৪/০৭/১৯৬৭
চাঁদে নামা
চাঁদে নামার আগেই পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মিশন ব্যর্থ।
সার্ভেয়ার-৫
০৮/০৯/১৯৬৭
চাঁদে নামা
সফলভাবে চাঁদে নামে। ছবি তোলা ও চাঁদের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের লক্ষ্য অর্জিত হয়। উনিশ হাজার ছবি পাঠায় পৃথিবীতে।
সার্ভেয়ার-৬
০৭/১১/১৯৬৭
চাঁদে নামা
সফলভাবে চাঁদে নামে। ছবি তোলা ও চাঁদের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের লক্ষ্য অর্জিত হয়। ত্রিশ হাজার ছবি পাঠায় পৃথিবীতে।
সার্ভেয়ার-৭
০৭/০১/১৯৬৮
চাঁদে নামা
সফলভাবে চাঁদে নামে। ছবি তোলা, লেজার ও চাঁদের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের লক্ষ্য অর্জিত হয়। একুশ হাজার ছবি পাঠায় পৃথিবীতে।





লুনার অরবিটার প্রোগ্রাম

চাঁদের হাজার হাজার ছবি এবং চাঁদের ভূতাত্ত্বিক জরিপের ফল বিজ্ঞানীদের হাতে এসে গেছে। চাঁদে রিমোট কন্ট্রোলড চন্দ্রযান নামানো হয়ে গেছে। এখন পৃথিবী থেকে চন্দ্রাভিযাত্রীদের যাবার পালা। নভোচারী পাঠানোর আগে চাঁদের কক্ষপথ আরো নিশ্চিতভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। সেই লক্ষ্যে ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে লুনার অরবিটার প্রোগ্রাম চালানো হয়।
            লুনার অরবিটার অর্থাৎ চাঁদের কক্ষপথে ভ্রমণকারী নভোযানগুলোর কাজ ছিল চাঁদে নামার উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করা। পাঁচটি অরবিটার পাঠিয়ে চাঁদের পিঠের শতকরা ৯৯ ভাগ জায়গা পরীক্ষা করে দেখা হয়। 
            স্বয়ংক্রিয় এই নভোযানগুলোতে খুবই শক্তিশালী চিত্রগ্রাহক যন্ত্রপাতি, প্রসেসর, স্ক্যানার এবং ট্রান্সমিটার যুক্ত ছিল। মনে রাখা দরকার সেই সময় কম্পিউটার প্রযুক্তি এখনকার মতো উন্নত ছিল না। তখন ছবির ব্যাক-আপ রাখার জন্য ফিল্ম ব্যবহার করা হতো। নভোযানে দুটো একটি ৬১০ মিলিমিটারের হাই রেজুলেশান ন্যারো অ্যাঙ্গেল লেন্স এবং আরেকটি ৮০ মিলিমিটারের মিডিয়াম রেজুলেশান ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স লাগানো ছিল। 
লুনার অরবিটার প্রোগ্রামের সারাংশ নিচের সারণিতে দেয়া হলো:

লুনার অরবিটার প্রোগ্রাম
অরবিটার
উৎক্ষেপণের
তারিখ
লক্ষ্য
ফলাফল
লুনার
অরবিটার-১
১০/০৮/১৯৬৬
চাঁদের কক্ষপথে যাওয়া এবং ছবি তোলা
সফল। চাঁদের কক্ষপথে ৮০ দিন ধরে ছবি তুলেছে।
লুনার
অরবিটার-২
০৬/১১/১৯৬৬
চাঁদের কক্ষপথে যাওয়া এবং ছবি তোলা
সফল। চাঁদের কক্ষপথে ৩৩৯ দিন ধরে ছবি তুলেছে।
লুনার
অরবিটার-৩
০৫/০২/১৯৬৭
চাঁদের কক্ষপথে যাওয়া এবং ছবি তোলা
সফল। চাঁদের কক্ষপথে ২৪৬ দিন ধরে ছবি তুলেছে।
লুনার
অরবিটার-৪
০৪/০৫/১৯৬৭
চাঁদের কক্ষপথে যাওয়া এবং ছবি তোলা
সফল। চাঁদের কক্ষপথে ১৮০ দিন ধরে ছবি তুলেছে।
লুনার
অরবিটার-৫
০১/০৮/১৯৬৭
চাঁদের কক্ষপথে যাওয়া এবং ছবি তোলা
সফল। চাঁদের কক্ষপথে ১৮৩ দিন ধরে ছবি তুলেছে।



No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts