Sunday 15 December 2019

চাঁদের নাম লুনা - ৩০




অ্যাপোলো-১৭

মিশন
অ্যাপোলো-১৭
কমান্ডার
ইউজিন কারনান (Eugene Cernan)
কমান্ড মডিউল পাইলট
রোনাল্ড ইভান্‌স (Ronald Evans)
লুনার মডিউল পাইলট
হ্যারিসন স্মিট (Harrison Schmitt)
কমান্ড মডিউলের ডাক নাম
আমেরিকা (America)
লুনার মডিউলের ডাক নাম
চ্যালেঞ্জার (Challenger)
উড্ডয়নের তারিখ
০৭/১২/১৯৭২
চাঁদে নামার তারিখ
১১/১২/১৯৭২
প্রত্যাবর্তনের তারিখ
১৯/১২/১৯৭২
মহাকাশে অতিবাহিত সময়
১২ দিন ১৩ ঘন্টা ৫১ মিনিট
চাঁদে অবস্থানের সময়
৩ দিন ২ ঘন্টা ৫৯ মিনিট
মিশনের লক্ষ্য
নিরাপদে নভোচারীদের চাঁদে নামা এবং সেখানে কিছু সময় থেকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসা। চাঁদে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার যন্ত্রপাতি বসানো। চাঁদে ব্যাটারিচালিত গাড়ি নিয়ে যাওয়া।  
ফলাফল
সফল। পৃথিবীর মানুষ ষষ্ঠবারের মতো চাঁদে পা রাখলো। গাড়ি করে ঘুরলো চাঁদের পিঠে।
চাঁদে নামার স্থান
টোরাস-লিটরো (Taurus-Littrow)


অ্যাপোলো-১৭ এর তিনজন নভোচারী

অ্যাপোলো-১৭ ছিল অ্যাপোলো প্রোগ্রামের সর্বশেষ মিশন। এই মিশনের পর মানুষ আর চাঁদে যায়নি। কারণ চাঁদে যেসব যন্ত্রপাতি মানুষ বসিয়ে এসেছে এবং বর্তমানে প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে চাঁদে সশরীরে না গিয়েও চাঁদের ছবি তোলা যাচ্ছে। চাঁদের কক্ষপথে স্থাপিত কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা যাচ্ছে।
            অ্যাপোলো-১৭ মিশনের তিনজন নভোচারীর মধ্যে দুজন ইউজিন কারনান  ও রোনাল্ড ইভান্‌স ছিলেন মিলিটারি অফিসার। অন্যজন হ্যারিসন স্মিট ছিলেন দক্ষ ভূ-তাত্ত্বিক। এই মিশনে চাঁদের বুকে বেশ কিছু গবেষণা চালানো হয়।
            ১৯৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর আমেরিকার ফ্লোরিডার জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে যাত্রা শুরু করে ১১ ডিসেম্বর চাঁদে নামে লুনার মডিউল চ্যালেঞ্জার। ইউজিন কারনান ও হ্যারিসন স্মিট তিনদিন ছিলেন চাঁদের মাটিতে চ্যালেঞ্জারের মধ্যে। তিন দফায় সাত ঘন্টা করে একুশ ঘন্টা তাঁরা চাঁদের উপরিতলে পরীক্ষানিরীক্ষা ও জরিপ চালিয়েছিলেন।
            এপোলো-১৭ মিশনে অনেকগুলো যন্ত্রপাতি চাঁদে নিয়ে যাওয়া হয়। চাঁদের তেজষ্ক্রিয়তায় স্নায়ুতন্ত্রে কী প্রতিক্রিয়া হয় পরীক্ষা করে দেখার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাঁচটি ইঁদুর। সেগুলোকে চাঁদের মাটিতে কোন ধরনের পোশাক ছাড়াই রাখা হয়েছিল। পরে পৃথিবীতে এনে তাদের স্নায়ুতন্ত্র পরীক্ষা করা হয়।

চাঁদের বুকে ইউজিন কারনান

চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ মাপার জন্য বসানো হয় গ্র্যাভিমিটার। চাঁদের ধুলো রেগোলিথের রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক ধর্ম পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেন্সর ও মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব পরীক্ষার জন্য নিউট্রন-মিটার বসানো হয়। চাঁদের পিঠে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব ও তাপমাত্রা মাপার জন্য স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতিও বসানো হয়। চাঁদের পাথর পরীক্ষা করার জন্য একটা অত্যাধুনিক যন্ত্র তাঁরা সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন যেটা দিয়ে পাথরের আকার, ভর, কোনদিক থেকে চাঁদের পিঠে পড়েছে সব নিঁখুতভাবে জানা যায়। এতে চাঁদের পিঠে যে গ্রহাণুগুলো পড়েছিল সেগুলো কীভাবে কখন পড়েছিল জানা যায়। তাছাড়া চাঁদে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ হয়ে যে লাভার সাগর তৈরি হয়েছিল - সেগুলো সম্পর্কেও বাস্তবসম্মত তথ্য পাওয়া যায়। চাঁদের গঠন সম্পর্কে জানার জন্য চাঁদের পিঠে গর্ত করে সেখানে বিস্ফোরক বসিয়ে দেয়া হয়। চাঁদ থেকে চলে আসার সময় সেই বিস্ফোরক বিস্ফোরিত করে চাঁদের ভূত্বকের ধর্মাবলী রেকর্ড করা হয়।
অ্যাপোলো-১৭ মিশনের পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে চাঁদের বায়ুমন্ডল সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। চাঁদে খুব সামান্য পরিমাণে হিলিয়াম ও আর্গন গ্যাস আছে। সেগুলো মিলে খুব পাতলা একটা আবহাওয়া মন্ডল তৈরি করেছে।
            অ্যাপোলো-১৭ মিশন চাঁদ থেকে নিয়ে এসেছিল অনেক পাথর পৃথিবীর অন্যান্য দেশকে শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে দেয়ার জন্য। ১৯৭৩ সালে আমেরিকান সরকার পৃথিবীর ১৩৫টি দেশকে চাঁদের পাথর উপহার দিয়েছিল। আমাদের পাশের দেশ ভারত তাদের পার্লামেন্ট জাদুঘরে চাঁদের পাথর রেখেছে প্রদর্শনীর জন্য। তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে চাঁদের পাথর দেয়া হয়েছিল কিনা আমরা জানি না। ইন্টারনেটের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ অ্যাপোলো-১৭ মিশনের আনা চাঁদের পাথরের একটা নমুনা পেয়েছিল আমেরিকার কাছ থেকে। কিন্তু সেই পাথর এখন কোথায় আছে আমরা জানি না।[1],[2]
            চাঁদ থেকে ফিরে আসার সময় অ্যাপোলো-১৭ পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে একটি ধাতব ফলক স্থাপন করে আসে চাঁদের বুকে। সেখানে লেখা আছে:



Here Man Completed his first exploration of the moon December 1972 AD. May the spirit of peace in which we came be reflected in the lives of all mankind.

এখানে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে মানুষ শেষ করেছে তার প্রথম চাঁদে অনুসন্ধান। যে শান্তির বার্তা নিয়ে আমরা এখানে এসেছিলাম সেই শান্তি সমস্ত মানবজাতির জীবনে প্রতিফলিত হোক।

উনিশে ডিসেম্বর তিনজন নভোচারীকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে অ্যাপোলো-১৭ এর কমান্ড মডিউল 'আমেরিকা'। সেই সাথে শেষ হয় চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম দফার অভিযান।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত সময়ে মোট ছয়বার চাঁদে সশরীরে উপস্থিত হয়েছে পৃথিবীর মানুষ। চাঁদের বুকে হেঁটে এসেছেন বারো জন নভোচারী। নিচে তাঁদের নামের তালিকা দেয়া হলো।

যারা চাঁদে হেঁটেছিলেন
নভোচারী
মিশন
চাঁদে নামার
তারিখ
কতক্ষণ চাঁদে ছিলেন
নীল আর্মস্ট্রং
অ্যাপোলো-১১
২০/০৭/১৯৬৯

২১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট ২০ সেকেন্ড

এডউইন অলড্রিন
চার্লস কনরাড
অ্যাপোলো-১২
১৯/১১/১৯৬৯

৩১ ঘন্টা ৩১ মিনিট

অ্যালেন বিন
অ্যালেন শেপার্ড
অ্যাপোলো-১৪
০৫/০২/১৯৭১

১ দিন ৯ ঘন্টা ৩০ মিনিট
এডগার মিশেল
ডেভিড স্কট
অ্যাপোলো-১৫
৩০/০৭/১৯৭১

২ দিন ১৮ ঘন্টা ৫৪ মিনিট
জেমস ইরউইন
জন ইয়ং
অ্যাপোলো-১৬
২১/০৪/১৯৭২

২ দিন ২৩ ঘন্টা ২ মিনিট
চার্লস ডিউক
ইউজিন কারনান
অ্যাপোলো-১৭
১১/১২/১৯৭২
৩ দিন ২ ঘন্টা ৫৯ মিনিট
হ্যারিসন স্মিট




অ্যাপোলোর পরে

অ্যাপোলো মিশন বন্ধ হয়ে যাবার পর কিন্তু চাঁদের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে তা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চাঁদের গবেষণার জন্য নানারকম প্রকল্প হাতে নেয়। আমেরিকার নাসা অনেকগুলো আধুনিক যান্ত্রিক মিশন পরিচালনা করছে।
            ১৯৯৪ সালে স্বয়ংক্রিয় স্যাটেলাইট ক্লিমেনটাইন চাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে কয়েক লাখ ছবি তুলে পাঠায়। চাঁদের পূর্ণাঙ্গ ম্যাপ তৈরি করা সম্ভব হয় তা থেকে। চাঁদের পাহাড়ের উচ্চতাও মেপে আনে ক্লিমেনটাইন। এটা ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার সময় দেখে যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে খুব সামান্য পরিমাণে জমাট বরফ আছে। ১৯৯৮ সালে লুনার প্রস্পেক্টর চাঁদে পৌঁছায়। সেটাও চাঁদে বরফের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। ধারণা করা হচ্ছে চাঁদের উত্তর ও দক্ষিণ উভয় মেরুর গর্তে বরফ থাকতে পারে। 
            ২০০৩ সালে ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির লুনার অরবিটার স্মার্ট-১ চাঁদের রাসায়নিক উপাদানের পরীক্ষা শুরু করে। ২০০৭-২০০৮ সালে জাপান, চীন ও ভারত স্যাটেলাইট পাঠায় চাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে ছবি ও তথ্য সংগ্রহের জন্য। চীনের মুন স্যাটেলাইটের নাম চাঙ্গি আর ভারতের স্যাটেলাইটের নাম চন্দ্রায়ন। ২০১৩ সালে চীনের রোবট চাঙ্গি-৩ সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করে। চীন হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার পর তৃতীয় জাতি যাদের রোবট চাঁদে নামে। পৃথিবীব্যাপি এখন চাঁদ সম্পর্কে অনেক গবেষণা চলছে।
            গুগল ও নাসা সম্মিলিতভাবে চাঁদের হাই রেজুলেশন ছবি তুলছে। বেসরকারি উদ্যোগেও চাঁদের অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে।
            আমেরিকাসহ আরো অনেক দেশ এখন চাঁদে স্পেস স্টেশন স্থাপন করার পরিকল্পনা করছে। চাঁদ থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ করার কথাও বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। সেই আলোচনায় আসার আগে চলো জেনে নিই এত বছর ধরে গবেষণা করে, চাঁদে গিয়ে, চাঁদের মাটি পরীক্ষা করে চাঁদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে আমরা কী কী জানলাম।
            কখন, কীভাবে এবং কোথায় জন্ম হয়েছিল চাঁদের?



[1] https://en.wikipedia.org/wiki/Lunar_sample_displaysএই রেফারেন্সে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ অ্যাপোলো-১৭মিশনের চাঁদের পাথরের অংশ পেয়েছিল।
[2] http://www.collectspace.com/resources/moonrocks_goodwill.htmlএই রেফারেন্সেও বাংলাদেশের নাম আছে।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts