Tuesday 23 June 2020

মেঘনাদ সাহা - পর্ব ১৯



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মেঘনাদ সাহা 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে মেঘনাদ সাহার প্রথম দেখা হয় মিউনিখে বিজ্ঞানী সামারফেল্ডের মাধ্যমে। তারপর থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্র মেঘনাদ সাহার গবেষণা ও অন্যান্য কাজের খোঁজখবর নিতেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৮ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি অধ্যাপক সাহাকে শান্তি নিকেতনে আমন্ত্রণ জানান। শান্তিনিকেতনে প্রফেসর সাহাকে সম্বর্ধনা জানান রবীন্দ্রনাথ।

          ঐ সম্বর্ধনা সভায় অধ্যাপক সাহা বলেছিলেন, "জীবন সমস্যার সমাধানের জন্য অনেকে বলেন আমাদের শহর থেকে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করতে হবে। একটু ভেবে দেখলে এসব যুক্তির অসারতা বুঝা যায়। বৈজ্ঞানিক স্বভাব হলো সবসময় সংখ্যার সাহায্যে চিন্তা করা। আমাদের দেশে একজন সাধারণ লোক যে পরিমাণ কাজ করে, তার সাথে ইওরোপ ও আমেরিকার সাধারণ লোকের কাজের তুলনা করা যাক। অনায়াসে প্রমাণ করা যায় এবং আমি আগেও প্রমাণ করেছি যে আমরা ভারতবর্ষে জনপ্রতি পাশ্চাত্যের বিশ ভাগের একভাগ মাত্র কাজ করি। তার কারণ, পাশ্চাত্য দেশে যে প্রাকৃতিক শক্তি আছে - যেমন জলাধার শক্তি, কয়লা পোড়ালে যে শক্তি হয় সেই শক্তি - তার অধিকাংশই কাজে লাগানো হয়েছে। ... ... ভারতের অনেক শুভাকাঙ্খী আছেন, তাঁরা বলেন যে ভারতবর্ষের পক্ষে চিরকাল কৃষিপ্রধান হয়ে থাকা উচিত। এই মত দুরভিসন্ধিমূলক বলে মনে করি।"

          ৪৮ বছর আগে ১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

"দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,

লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর

হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,

দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি..."[1]

উনবিংশ শতাব্দীর শেষে প্রাচীন সভ্যতার জয়গান গেয়ে যে কবিতা লিখেছিলেন বিশ্বকবি, বিংশ শতাব্দীর এক বিজ্ঞানীর কথা শুনে তা ভুল ছিল বলে মনে হচ্ছে তাঁর। তিনি অধ্যাপক সাহার বক্তৃতায় খুব আলোড়িত হলেন।

          প্রফেসর সাহার বক্তৃতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, "ডক্টর সাহার বক্তৃতার দুটি জিনিস আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছে। প্রাচীনকালের অনাবশ্যক অর্থহীন প্রথা ও ঐতিহ্যকে অন্ধভাবে মেনে চলার প্রচন্ড প্রতিবাদ করেছেন তিনি, এবং তার জায়গায় জাতির সম্মুখে এক নূতন জীবনদর্শন তুলে ধরার পক্ষে তিনি শক্তিশালী যুক্তি দিয়েছেন - যা আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং শিল্প-উন্নয়নকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে। শিল্প-উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি তথ্যাদি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, এর মূল চাবিকাঠি রয়েছে রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রচেষ্টায় প্রাকৃতিক শক্তি-সম্পদকে শিল্পক্ষেত্রে প্রয়োগ ও তাকে সহজলভ্য করে তুলতে পারার উপর। আমাদের তথাকথিত হিতৈষী বন্ধুদের মন্ত্রণাকে অন্ধভাবে মেনে নিয়ে তাদেরকে স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে আর আমাদের শক্তি-সম্পদকে শোষণ করতে দিতে পারি না। যুগের অগ্রগতির তালে তাল রেখে আমাদের চলতে হবে - বিশেষ করে, আমাদের বৈজ্ঞানিক শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। অধ্যাত্মবাদের নামে দারিদ্র ও প্লেগকে বরণ করে নেবার দিনকাল চিরতরে শেষ হয়েছে এবং এ কথা আমাদের অতি অবশ্য উপলব্ধি করতে হবে যে, আমাদের সভ্যতা যত বড় ও মহানই হোক না কেন তা ভেঙে ধূলায় গুঁড়িয়ে যাবে যদি না তাকে রক্ষা করার মত উপযুক্ত শক্তি বা ক্ষমতা আমরা অর্জন করতে পারি।"

          প্রফেসর সাহার সাথে মিটিং এর পর রবীন্দ্রনাথ পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন মেঘনাদ সাহার প্রস্তাবিত প্ল্যানিং কমিটির কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। যদিও মহাত্মা গান্ধী প্ল্যানিং কমিটি গঠন করা খুব একটা পছন্দ করেননি, তবুও নেহেরু রবীন্দ্রনাথকে আশ্বাস দিয়েছিলেন প্ল্যানিং কমিটির ব্যাপারে।



[1] চৈতালি কাব্যগ্রন্থের 'সভ্যতার প্রতি' কবিতা

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts