Wednesday 10 June 2020

মেঘনাদ সাহা - পর্ব ১



মডার্ন অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বা আধুনিক  জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে কজন মানুষের মৌলিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তাঁদের অন্যতম। ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহার তাপীয় আয়ননের সমীকরণ (আয়নাইজেশান ইকুয়েশান) প্রকাশিত হবার পর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে যত গবেষণা হয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোই সাহার সমীকরণ দ্বারা প্রভাবিত। নরওয়ের বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সেভিন রোজল্যান্ড অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোফিজিক্স[1] বইতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এ কথা।

          আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পারমাণবিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে বিগ-ব্যাং তত্ত্বের পরীক্ষণ পর্যন্ত সহজ হয়ে উঠেছে যে যন্ত্রের উদ্ভাবনের ফলে - সেই সাইক্লোট্রনের উদ্ভাবক নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট লরেন্সসহ অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেছেন মেঘনাদ সাহা তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ড, নীল্‌স বোর, ম্যাক্স বর্ন, আলবার্ট আইনস্টাইন, আর্থার এডিংটন, এনরিকো ফার্মি, আর্থার কম্পটন প্রমুখ দিকপাল মুগ্ধতার সাথে স্বীকার করেছেন মেঘনাদ সাহার অনন্য প্রতিভার কথা।[2]

          ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার সাথে বিশ্বের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া এবং ভারতের বিজ্ঞান-গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার ব্যাপারে মেঘনাদ সাহার অবদান অনস্বীকার্য। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ পাবার পাশাপাশি মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন চার বার। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্বমাপের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার অক্লান্ত পরিশ্রমে। দেশে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়েছে মেঘনাদ সাহার হাতে। নিরলস চেষ্টা ও পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশান - সবগুলো সংগঠনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে।

          বাংলাদেশ ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই মেঘনাদ সাহার টেক্সট বুক অব হিট বইটা পড়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেঘনাদ সাহা মূলত পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি বিএসসি ও এমএসসি পাশ করেছেন মিশ্র গণিতে। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পদার্থবিজ্ঞান শুধু শিখেছেন তাই নয় - ক্রমশঃ পৌঁছে গেছেন এই বিষয়ের শিখরে।

          উপমহাদেশে প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপিত হয়েছিল মেঘনাদ সাহার প্রচেষ্টায়। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পরও থেমে থাকেননি তিনি। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তিনি। দরিদ্র অশিক্ষিত মা-বাবার সন্তান হয়েও মেধা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার জোরে একজন মানুষ যে কত বড় হয়ে উঠতে পারেন মেঘনাদ সাহা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

          সামাজিক জীবনে বিজ্ঞানের অবদানকে কাজে লাগানো এবং বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ে তোলার জন্য বিপ্লব শুরু করেছিলেন মেঘনাদ সাহা। সেই বিপ্লব তিনি আজীবন চালিয়ে গেছেন, করেছেন প্রগতিশীল নতুন সমাজ গড়ার সংগ্রাম। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার দূর করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অগ্রণী সৈনিক।

          বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই বই লিখেছি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পাবে এই প্রত্যাশায়।



[1] S. Rosseland, Theoretical Astrophysics. U.K.: Oxford University Press, 1939.

[2] G. Venkatraraman, Saha and His Formula, Delhi: Sangam Books Ltd., 1995.

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts