Tuesday 23 June 2020

মেঘনাদ সাহা - পর্ব ১৫




বিজ্ঞান সংগঠক

১৯২৫ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে ফিজিক্স সেকশানের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন প্রফেসর মেঘনাদ সাহা। দেশে বিজ্ঞানীদের শক্তিশালী পেশাগত সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি অনেকদিন থেকেই অনুভব করছিলেন। দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে। ১৯২১ সালে পশ্চিম-বঙ্গের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করতে গিয়ে সাহা দেখেছেন বৈজ্ঞানিক প্লাটফরমের কত দরকার।

          সায়েন্স কংগ্রেসে সভাপতির ভাষণে তিনি দেশীয় বিজ্ঞানীদের মনে করিয়ে দেন যে বিজ্ঞানের গবেষণায়, বিজ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য বিজ্ঞানীদের অনেক কষ্ট করতে হয়, এমনকি অতীতে অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিককে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন গ্যালিলিও, ব্রুনো ও কেপলারের কথা। প্রফেসর সাহা আরো স্মরণ করিয়ে দেন যে ইওরোপ অনেক সাধনা, ত্যাগ আর অধ্যবসায়ের ফলে উন্নত হয়েছে। অথচ ভারতবর্ষে সেরকম কোন নজির নেই।

          বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিজ্ঞানীদের পেশাগত সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে আইনত কোন বিধিনিষেধ ছিল না। স্যাডলার কমিশন শিক্ষকদের গবেষণা ও পেশাগত উন্নয়নের লক্ষ্যে সংগঠন করার ব্যাপারে উৎসাহও দিয়েছে। তবে শর্ত আছে যে সংগঠন রাজনৈতিক প্লাটফরমে পরিণত হতে পারবে না।

          বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞান সংগঠনেও মনযোগী হলেন মেঘনাদ সাহা। ১৯৩০ সালে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স ব্যাঙ্গালোরের রিভিউ কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী পদে এতদিন শুধু ব্রিটিশরাই কাজ করতেন। সাহা হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি কমিটিতে স্থান পেলেন। সাহা উপলব্ধি করলেন ভারতীয়দের নিয়েই জাতীয় পর্যায়ের বিজ্ঞান সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

          ১৯৩১ সালে তাঁর নেতৃত্বে এলাহাবাদে গঠিত হলো ইউনাইটেড প্রভিন্স অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস। ১৯৩২ সালের ১লা মার্চ থেকে অ্যাকাডেমির কাজকর্ম শুরু হয়। অধ্যাপক সাহা হলেন অ্যাকাডেমির প্রথম প্রেসিডেন্ট। এলাহাবাদে সমগ্র উত্তর প্রদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ইউনাইটেড প্রভিন্সের গভর্নর স্যার ম্যালকম হেইলি অ্যাকাডেমির উদ্বোধন করেন। অ্যাকাডেমির কাজকর্মের জন্য বার্ষিক চার হাজার টাকা মঞ্জুর করা হয় সরকারের তরফ থেকে।

          ১৯৩৩ সালে প্রফেসর সাহার উদ্যোগে কলকাতায় গঠিত হয় ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি। ফিজিক্যাল সোসাইটি থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স

          শুধুমাত্র আঞ্চলিক সংগঠন করে সন্তুষ্ট ছিলেন না মেঘনাদ সাহা। তিনি চাইছিলেন ইংল্যান্ডের রয়েল সোসাইটি এবং জার্মানির প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমির আদলে সর্বভারতীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি গড়ে তুলতে।  

          ১৯৩৪ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতির বক্তৃতায় সাহা জাতীয় পর্যায়ে সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। এই প্রক্রিয়ায় স্যার সি ভি রামনের নেতৃত্বে ব্যাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স ব্যাঙ্গালোর। ইউনাইটেড প্রভিন্স অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস এর নতুন নাম দেয়া হয় - ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস।

          ক্রমে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অব ইন্ডিয়া নামে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন গড়ে ওঠে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে ১৯৩৫ সালে এই ইনস্টিটিউটের প্রথম অধিবেশন বসে। স্যার ফার্মর এই ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান মনোনীত হন। প্রফেসর সাহা হলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। পরে ১৯৩৭-১৯৩৯ পর্যন্ত ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর সাহা।

          প্রফেসর  সাহা বার বার ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন অধ্যাপক ও কর্মকর্তাদের সাথে মত বিনিময় করে ভারতবর্ষের শিক্ষা ও গবেষণাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে তুলনীয় করে তুলতে।

 

আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে মেঘনাদ সাহা


বেশিরভাগ সমাজে দেখা যায় বিজ্ঞানীরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন এবং বেশিরভাগ মানুষ বিজ্ঞানের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। প্রফেসর সাহা জানেন - এর কারণ হলো বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থার অভাব। বিজ্ঞানই যে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার তা মানুষকে বোঝানো দরকার। সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকদের বেশিরভাগেরই বিজ্ঞান সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। বিদেশি সংবাদ মাধ্যম থেকে না বুঝে অনুবাদ করে অনেক সময় বিজ্ঞানের মূল সুরই পালটে যায় প্রকাশিত সংবাদে। তাই বিজ্ঞানের জন্য আলাদা বিজ্ঞানপত্রিকা থাকা দরকার যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে আছে। 

          মেঘনাদের মনে আছে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি সম্পর্কিত প্রতিবেদন রচনার কথা। ১৯১৯ সালের ২ জুন আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি অবজারভেটরির পরিচালক, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন টেলিস্কোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হন যে সূর্যের অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের টানে আলোর গতিপথ বদলে যায়।[1] এই ঘটনার পর সারা পৃথিবীতে আইনস্টাইনের জয়গান শুরু হয়ে যায়। খবরটা সারা পৃথিবীর সবগুলো নিউজ এজেন্সিতে পাঠানো হয়। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকার অফিসেও খবরটি আসে। কিন্তু কেউ বুঝতেই পারে না এই খবরের মূল বিষয় কী বা কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিজ্ঞানের এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন এমন কাউকে খুঁজতে শুরু করলো। স্টেটসম্যানের সাংবাদিক প্রেসিডেন্সি কলেজের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরিতে গিয়ে তরুণ মেঘনাদ সাহাকে পেয়ে গেলেন। আইনস্টাইনের স্পেশাল ও জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি এবং মহাবিশ্বকে বুঝতে হলে তাদের গুরুত্ব সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখে দিলেন মেঘনাদ সাহা। পরের দিনের স্টেটসম্যান পত্রিকায় তা প্রকাশিত হলো। সেটাই ছিল ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষের জন্য সহজ ভাষায় লেখা  আইনস্টাইনের তত্ত্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম প্রবন্ধ। (সেদিন তবুও স্টেটসম্যান উপযুক্ত মানুষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। আজকাল তো যা খুশি লিখে ছাপিয়ে দেয়। ভুল প্রতিবেদনের দায়িত্বও স্বীকার করে না।)

          ১৯৩৫ সালে মেঘনাদ সাহা লন্ডনের নেচার সাময়িকী এবং আমেরিকার সায়েন্স সাময়িকীর আদলে বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলার জন্য ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশান গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে নিয়মিত সায়েন্স এন্ড কালচার জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমৃত্যু তিনি এই জার্নালে নিয়মিত ভাবে লিখে গেছেন। এই জার্নালেই তিনি বিশ বছরে ১৩৬টি প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন।

          'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার' জার্নালে প্রশান্তচন্দ্র মহ্লানবীশ, দেবেন্দ্রমোহন বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, সত্যস্বরূপ ভাটনগর, স্যার আর্থার এডিংটন, বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিক্যান প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বের লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

          মেঘনাদ সাহা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে কোন দেশ ও জাতির  উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। সেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমাদের সংস্কৃতির অংশ করে তোলার জন্য তিনি 'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার' জার্নালে প্রচুর গঠনমূলক লেখা লিখেছেন। পাশাপাশি অন্যায় অসঙ্গতির গঠনমূলক সমালোচনাও করেছেন নির্ভয়ে নির্মোহভাবে।

          আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় 'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার'-এ প্রকাশিত লেখাগুলোকে চাবুকের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন যে এই লেখাগুলো যেসব মানুষ সবকিছু জেনেশুনেও চোখ বুঁজে ঘুমায় তাদের চাবুক মেরে জাগিয়ে তুলবে।

          'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার'-এর উদ্দেশ্য ও নীতির সাথে একমত পোষণ করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি বলেছিলেন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত যে দেশের তরুণ প্রজন্ম কী চায় এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে রাষ্ট্র তাল মেলাতে পারছে কি না। তিনি স্বাধীন ভারতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন।

মেঘনাদ সাহার সবগুলো লেখাই ছিল তথ্যসমৃদ্ধ। তিনি কোন লেখাই বিস্তারিত গবেষণা ছাড়া লেখেননি। সায়েন্স অ্যান্ড কালচারে প্রকাশিত তাঁর প্রত্যেকটি লেখাই ছিল তাঁর সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও গবেষণার ফসল।

 

১৯৩৫ সালে মেঘনাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত সায়েন্স অ্যান্ড কালচার জার্নাল এখনো নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে




[1] প্রদীপ দেব, আইনস্টাইনের কাল, মীরা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২, পৃ: ১২৫।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts