Tuesday, 23 June 2020

মেঘনাদ সাহা - পর্ব ২২



ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স 

ভারতীয় উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের সূচনা হয়েছিল প্রফেসর মেঘনাদ সাহার হাত দিয়ে। কোপেনহ্যাগেনের কনফারেন্সে অংশ নেয়ার পরেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অসীম সম্ভাবনার কথা। আমেরিকা সফরে গিয়ে বিজ্ঞানী লরেন্সের সাইক্লোট্রোন ল্যাবোরেটরি দেখে এসে তিনি দেশের প্রথম সাইক্লোট্রন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

          প্রফেসর সাহার ছাত্র বাসন্তী নাগচৌধুরিকে (বি ডি নাগচৌধুরি) ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে পাঠানো হয় প্রফেসর লরেন্সের কাছ থেকে সাইক্লোট্রন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় সব জেনে আসতে।

          সাইক্লোট্রন ল্যাবোরেটরি তৈরি করতে গেলে প্রচুর টাকার দরকার। টাকার অভাবে প্রফেসর সাহা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক গবেষণা করতে পারেননি। কিন্তু গবেষণার টাকার জন্য তিনি কতৃপক্ষের কাছে হাত পাততে দ্বিধা করেন না। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তাঁর সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক মেঘনাদ সাহার। তিনি সাইক্লোট্রন স্থাপনের জন্য দোতলা ভবন তৈরি করে দিলেন। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর সাহায্যে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর কাছ থেকে ষাট হাজার রুপি পাওয়া গেলো। বিড়লা গোষ্ঠীও প্রায় সমপরিমাণ টাকা দিয়েছে। কিন্তু সাইক্লোট্রনের যন্ত্রপাতির যা দাম তাতে এই টাকা খুব সামান্য। তবুও কাজ থেমে থাকলো না। ১৯৪১ সালে অধ্যাপক লরেন্সের কাছ থেকে সাইক্লোট্রনের কাজ শিখে কলকাতায় এলেন নাগচৌধুরি।

          নাগচৌধুরি আমেরিকা থেকে সাইক্লোট্রনের যন্ত্রপাতি কিনে জাহাজে করে পাঠিয়েছিলেন। একটি জাহাজে ছিল ম্যাগনেট তৈরির যন্ত্রপাতি। সেগুলো যথাসময়ে কলকাতায় এসে পৌঁছলো। কিন্তু ভ্যাকুয়াম পাম্প তৈরির যন্ত্রপাতি ছিল পরের জাহাজে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকা এতদিন চুপ করে ছিল। কিন্তু জাপানিরা পার্ল হারবার আক্রমণ করার পর আমেরিকাও জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জাপানিদের বোমার আঘাতে আমেরিকা থেকে ভারতগামী একটি জাহাজ ডুবে যায়। সেই জাহাজে ছিল মেঘনাদ সাহার সাইক্লোট্রন তৈরির ভ্যাকুয়াম পাম্পের যন্ত্রাংশ। সেগুলো ছাড়া সাইক্লোট্রন তৈরি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।

          এদিকে যুদ্ধের আগুন কলকাতাতেও লেগে গেছে। জাপানিরা বার্মা দখল করে কলকাতার দিকে এগোচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও নতুন মোড় তৈরি হয়েছে। বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে বেশিরভাগ মানুষ পালিয়ে চলে গেছে গ্রামের দিকে। অধ্যাপক সাহাও সপরিবারে রাজশাহী চলে যেতে বাধ্য হলেন। পুরো এক বছর বন্ধ থাকলো সব বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম।

          সাইক্লোট্রন নির্মাণের কাজ যন্ত্রপাতির অভাবে বন্ধ। আমেরিকা থেকে যন্ত্রপাতি আবার আনার কোন সুযোগ নেই। স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে কলকাতায় তৈরি করিয়ে নিতে হবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। কিন্তু সেটা অনেক সময় সাপেক্ষ।

          ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের পর জাপান আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু সারাবিশ্বে পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে একটা প্রচন্ড ভীতির পাশাপাশি আগ্রহও জন্মে। সবাই  হঠাৎ করে নিউক্লিয়ার শক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে।

          প্রফেসর সাহা একটি আলাদা স্বায়ত্বশাসিত ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে ইন্সটিটিউটেই সাইক্লোট্রন তৈরির কাজ শুরু হয় আবার নতুন উদ্যমে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেশেই তৈরি করে নেয়ার চেষ্টা করা হয়।

          ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর জওহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্পমন্ত্রী হয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। যদিও প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সাথে সাহার কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সহায়তায় ১৯৪৮ সালে ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স স্থাপন করতে সমর্থ হলেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ কলকাতার আপার সার্কুলার রোডে ইন্সটিটিউটের ভিত্তি স্থাপন করেন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি।

          সাইক্লোট্রনের ম্যাগনেট তৈরি করা হয় দেশীয় ইঞ্জিনিয়ারদের সহযোগিতায়। কিন্তু সাইক্লোট্রন চালু করা যায়নি অনেক বছর। (সাইক্লোট্রন চালু করা যখন সম্ভব হয়েছিল ততদিনে প্রফেসর সাহা মৃত্যুবরণ করেছেন।) প্রফেসর সাহা কসমিক রশ্মি সংক্রান্ত কিছু গবেষণা করেছিলেন ইন্সটিটিউটে।


ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর ভিত্তি স্থাপন করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি (সর্ব ডানে)

ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে সাইক্লোট্রন এর ম্যাগনেট (১৯৪৮)


১৯৪৮ সালে প্রফেসর নিরজ নাথ দাসগুপ্ত ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে ভারতবর্ষের প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরি করেন


১৯৫০ সালের ১১ জানুয়ারি। ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর উদ্বোধনী বক্তৃতা করছেন আইরিন জুলিও-কুরি



১৯৫০ সালের ১১ই জানুয়ারি নোবেল বিজয়ী নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী আইরিন জুলিও-কুরি ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

          ইন্সটিটিউট চালানোর জন্য প্রচুর ফান্ড দরকার। সেই ফান্ড জোগাড় করার জন্য অনেক দেনদরবার করতে হলো প্রফেসর সাহাকে। বিজ্ঞানী হোমি ভাবা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান। সাহা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের বিরোধিতা করেছিলেন, হোমি ভাবার নেতৃত্বের প্রতিও অনাস্থা দেখিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও হোমি ভাবা ১৯৫৪ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য বছরে পঞ্চাশ লাখ টাকার গ্রান্ট মঞ্জুর করলেন।

          ১৯৫৩ সালে মেঘনাদ সাহার ষাট বছর পূর্ণ হওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত প্রফেসর এবং ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর ডিরেক্টরশিপ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। তারপরও ইনস্টিটিউটের উন্নয়নের জন্য সবসময় সচেষ্ট ছিলেন তিনি।

          ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে এমএসসি ডিগ্রি দেয়া শুরু হলো। ১৯৫৬ সালে ছাত্রদের জন্য হোস্টেল তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছিলেন প্রফেসর সাহা। সেই সময় তিনি লোকসভার সদস্য। ১৯৫৬ সালের ১৯ জানুয়ারি হোস্টেলের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন পেট্রোলিয়াম ও খনিজ মন্ত্রী কে ডি মাল্‌ব। প্রফেসর সাহা এই হোস্টেল দেখে যেতে পারেননি। তার এক মাস পরেই তিনি মারা যান। প্রফেসর সাহার মৃত্যুর পর ইন্সটিটিউটের নাম দেয়া হলো, "সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স"।

 

ইন্সটিটিউটের এম-এসসি সেকেন্ড ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রফেসর সাহা


হোস্টেলের ভিত্তি স্থাপন করেন পেট্রোলিয়াম ও খনিজ মন্ত্রী কে ডি মালব্


পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট হোস্টেলের ভিত্তি স্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন প্রফেসর সাহা (১৯৫৬)


পরের পর্ব >>>>>>>>>>

<<<<<<<<< আগের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts