Tuesday 23 June 2020

মেঘনাদ সাহা - পর্ব ১৭



কার্নেগি ফেলোশিপ 

১৯৩৬ সালে প্রফেসর সাহা কার্নেগি ফেলোশিপ পান। এই ফেলোশিপের আওতায় পুরো এক বছর সময়ের জন্য তিনি ইওরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক-ভ্রমণে বের হন। তিনি তাঁর বড়ছেলে অজিতকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। অজিতের বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। মাত্র ১২ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল অজিত। মেঘনাদ সাহা তাঁর ছেলেকে এক বছর সুইজারল্যান্ডের একটি বোর্ডিংস্কুলে রেখে নিজে ইওরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণ করেন সেই সফরে।

          বিজ্ঞানের পাশাপাশি প্রাচীন ইতিহাসের প্রতিও প্রচন্ড ভালোবাসা ছিল মেঘনাদ সাহার। সুযোগ পেলেই তিনি প্রাচীন স্থাপনা দেখতে যেতেন। এবার ইওরোপ যাবার পথে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক প্রাচীন জায়গা দেখার সুযোগ তিনি ছাড়লেন না।

          বোম্বে থেকে নদীপথে গেলেন বশরা। বশরা থেকে ট্রেনে গেলেন বাগদাদ। বাগদাদে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের ব্যাবিলনিয় সাম্রাজ্যের প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন দেখলেন। তারপর মরুভূমির মধ্য দিয়ে সড়কপথে বৈরুত হয়ে ইসরাইলের হাইফায় পৌঁছলেন। সেখান থেকে নদীপথে গেলেন ইতালির ট্রিয়েস্তে। ইতালি থেকে ইহুদিরা তখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছে। ইওরোপে নাৎসিদের উত্থান ঘটতে শুরু করেছে।

          ইতালি থেকে প্রফেসর সাহা অস্ট্রিয়া হয়ে গেলেন জার্মানির মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর সামারফেল্ডের অতিথি হয়ে। মেঘনাদ সাহার সম্মানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে।


১৯৩৬ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় মেঘনাদ সাহা ও অজিত সাহা (ডান থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয়)। (১৭/৩/১৯৩৬ সালে মেঘনাদ সাহা তাঁর স্ত্রীকে লেখা চিঠির সাথে এই ছবি পাঠিয়েছিলেন।)


মিউনিখ থেকে গেলেন সুইজারল্যান্ডের জেনিভায়। সেখানে ইন্সটিটিউট অব মনিয়ের-এ কিশোর অজিত সাহাকে ভর্তি করালেন। মনিয়ের ইন্সটিটিউটের পরিচালক পল গ্যাহিব ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু। পল গ্যাহিব জেনিভায় শান্তি নিকেতনের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠান। সেখানে কিছু ভারতীয় শিক্ষকও ছিলেন। ছেলেকে তাঁদের কাছে রেখে লন্ডনে চলে গেলেন প্রফেসর সাহা।

          লন্ডন ফিজিক্যাল সোসাইটির ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রফেসর সাহা। তারপর লন্ডন থেকে চলে গেলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। অক্সফোর্ডে তখন গবেষণা করছিলেন সাহার ছাত্র পি কে কিছলু। প্রফেসর মিল্‌নির সাথে মাস খানেক অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পর আমেরিকা চলে গেলেন প্রফেসর সাহা।

          হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অবজারভেটরির পরিচালক ডক্টর হারলো শ্যাপলির সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব হয়ে যায় প্রফেসর সাহার। দুই মাস ছিলেন তিনি সেখানে। হার্ভার্ড থেকে তিনি অ্যারিজোনায় লওয়েল অবজারভেটরিতে গিয়ে প্রফেসর স্লিফারের সাথে দেখা করেন। সেখান থেকে যান মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে। ডক্টর হাবলের সাথে দেখা করেন সেখানে। তারপর পুরো ওয়েস্ট কোস্ট ঘুরে আবার ফিরে আসেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে অবস্থানকালে তিনি একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন যেখানে তিনি ওজোন স্তরের উপরে উঠে সূর্যের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করলে সূর্যের আলোতে হাইড্রোজেনের লাইম্যান (Lyman) রেখা দেখতে পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন। [এর ১৮ বছর পর জার্মান ভি-২ রকেট ব্যবহার করে ওজোন স্তরের উপর থেকে সূর্যের বর্ণালী পরীক্ষা করে মেঘনাদ সাহার অনুমানের সত্যতা প্রমাণিত হয়।]

 

১৯৩৬ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর সাহা


হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রফেসর সাহা যান ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি বার্কলেতে প্রফেসর লরেন্সের সাথে দেখা করার জন্য। প্রফেসর লরেন্স সাইক্লোট্রন আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। প্রফেসর সাহা লরেন্সের সাইক্লোট্রন ল্যাবোরেটরি ঘুরে দেখেন। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা দেখে ভারতে সাইক্লোট্রন স্থাপনের পরিকল্পনা করতে শুরু করেন প্রফেসর সাহা। তাঁর ছাত্র বি ডি নাগচৌধুরিকে লরেন্সের ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করে আসেন এ সময়। সাহার ভ্রমণের তিন বছর পর ১৯৩৯ সালে লরেন্স পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।

          সেখান থেকে শিকাগোর ইয়র্কার অবজারভেটরি পরিদর্শন করে ম্যাসাচুসেস্টস-এ এম-আই-টিতে আসেন প্রফেসর সাহা। সেখানে নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন তাঁকে স্বাগত জানান। তখন এম-আই-টির পরিচালক ছিলেন আর্থার কম্পটনের ভাই কে টি কম্পটন। তাঁর সাথেও বন্ধুত্ব হলো প্রফেসর সাহার।

 

আমেরিকায় প্রফেসর সাহা (১৯৩৬)। ডানে প্রফেসর সাহার নিজের হাতে লেখা বর্ণনা।


আমেরিকা থেকে ইওরোপে এসে কোপেনহ্যাগেনে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ যোগ দেন প্রফেসর সাহা। ইওরোপের সব প্রধান পদার্থবিজ্ঞানী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী হোমি ভাবার সাথে এখানেই প্রথম পরিচয় হয় প্রফেসর সাহার। ২৭ বছরের যুবক হোমি ভাবা তখন পিএইচডি শেষ করে কোপেনহ্যাগেনে নিল্‌স বোরের ল্যাবে কাজ করছিলেন। কনফারেন্সের পর নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রতি ভালোবাসা আরো গাঢ় হয় মেঘনাদ সাহার।

১৯৩৬ সালের ডেনমার্কের কোপেনহ্যাগেনে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। সামনের সারিতে প্রফেসর পাউলি, জর্ডান, হাইজেনবার্গ, ম্যাক্স বর্ন, লিজ মেইটনার, অটো স্টার্ন, ফাইয়াংক। দ্বিতীয় সারিতে মেঘনাদ সাহা, ওপেনহাইমার, চতুর্থ সারিতে হোমি ভাবা। সামনের সারিতে দাঁড়ানো নিলস বোর।


১৯৩২ সালে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন কণা আবিষ্কৃত হবার পর কোপেনহ্যাগেনের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স কনফারেন্স থেকে উদ্ভূত জ্ঞান ও গবেষণা নিউক্লিয়ার শক্তির নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এর দু'বছর পর আবিষ্কৃত হয়েছে নিউক্লিয়ার ফিশান। এলাহাবাদে বসে প্রফেসর সাহা বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়েছিলেন বিটা ক্ষয় সংক্রান্ত গবেষণায়।

          ইওরোপ এবং আমেরিকা সফর থেকে ফিরে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন প্রফেসর সাহা। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে তাঁর আমন্ত্রণে এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে আসেন বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশান ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স এর প্রতিনিধি হয়ে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশানের সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে আসার কথা ছিল এডিংটনের। প্রফেসর সাহার আমন্ত্রণে তিনি আগে এসে এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে দেখে যান প্রফেসর সাহার গবেষণাকর্ম। প্রফেসর সাহার উদ্যোগে এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যালিটি গণসম্বর্ধনা দেয় স্যার এডিংটনকে।


এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সাথে স্যার আর্থার এডিংটন


এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টকে দেশের অন্যতম সেরা ডিপার্টমেন্টে পরিণত করার পরও মেঘনাদের খুব বেশি ভালো লাগছিলো না সেখানে। সহকর্মীদের মধ্যে আঞ্চলিকতার প্রভাব খুব বেশি। আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো খুব সংক্রামক। যাদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করতে হয় তাদের কেউ এরকম হলে অন্যজনের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৮ এই ১৫ বছরেও এলাহাবাদকে একেবারে নিজের করে নিতে সমস্যা হচ্ছিলো মেঘনাদের। পারিবারিকভাবেও তাঁর সাথে স্থানীয়রা প্রাণখুলে মিশতে চান না সেটা তিনি বোঝেন। তিনি কলকাতায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন অনেক বছর থেকে। অবশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের 'পালিত অধ্যাপক' পদে যোগদানের জন্য অফার পেলেন প্রফেসর সাহা।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts