Friday, 26 June 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৩৬

36

এজুকেশান ইজ দ্য ব্যাকবোন অব দ্য ন্যাশান। এটাকে বেঙ্গলিতে আপনারা কী বলেন?”

স্বাভাবিক অবস্থায় ক্লাস থ্রি-ফোরের ছেলেমেয়েরাও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু এখন আমাদের কারোরই স্বাভাবিক অবস্থা নয়। আমাদের বলতে এখানে – প্রিন্সিপাল স্যার থেকে শুরু করে আমরা সবাই। সকাল ন’টা থেকে ঘাঁটির প্রশাসনিক কর্মধ্যক্ষ শিক্ষকদের সাথে মিটিং-এর কথা বলে ক্লাস নিচ্ছেন। উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। আজ স্কুল সেকশানের ক্লাস নেই। আর যেদিন পরীক্ষা থাকে সেদিন কলেজের ক্লাস ছুটি। সকালেই নাসির স্যার বলে দিয়েছিলেন – সকাল সাড়ে আটটা থেকে জরুরি মিটিং। সাড়ে আটটা থেকে আমরা সবাই ইলেভেন-এ সেকশানের ক্লাসরুমে এসে বসেছিলাম। কিন্তু মিটিং শুরু হয়েছে ন’টায় – কারণ তিনি এসেছেন আধঘন্টা দেরি করে। প্রিন্সিপাল স্যার আর দু’জন ভাইস-প্রিন্সিপাল স্যার-ম্যাডাম আধঘন্টা ধরে কলেজের গেটে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। অঞ্জন স্যার আর সাঈদ স্যার একটু পর পর আসা-যাওয়া করে আমাদের খবর দিয়েছেন তিনি কতদূর এসেছেন।

ন’টার দিকে হাতে ছোট্ট একটা ডায়েরি এবং লম্বা অ্যান্টেনাযুক্ত ওয়াকিটকি হাতে গম্ভীরভাবে প্রবেশ করলেন প্রশাসনিক কর্মধ্যক্ষ। তাঁর পেছনে আমাদের অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষদ্বয়। তিনি এসেই সরাসরি ডায়াসে চলে গেলেন। তাঁর কালো কুচকুচে তেলতেলে বিছাকৃতি গোঁফের কারণে তাঁকে নায়ক সোহেল রানার মতো লাগছে। এ জে মিন্টুর সিনেমাতে সোহেল রানা যেভাবে রাগী রাগী কন্ঠে কাটা-কাটা উচ্চারণে সংলাপ প্রক্ষেপণ করেন, কর্মধ্যক্ষ মহোদয়ও সেভাবেই কথা বলছেন। তবে মাঝে মাঝে ভিলেন জসিমের মতো হুংকারও দিচ্ছেন। কলেজ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁকে যে কতকিছু করতে হচ্ছে তাঁর কিছু বর্ণনা দিলেন।  

মায়ের কাছে খালার গল্প আমরা তো বেশ উৎসাহ নিয়েই করে থাকি। আর মা-তো তার বোনের কথা শতবার শোনার পরেও শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন না। আমরাও সেরকমভাবে গভীর মনযোগ দিয়ে শুনছি। তাঁর কথা থেকে এপর্যন্ত যতটুকু বুঝতে পারলাম তার সারাংশ লিখতে হলে লেখা যায় - আমাদের কলেজ পরিচালনা পরিষদের দ্বিতীয় কর্তাব্যক্তি হলেন প্রশাসনিক কর্মধ্যক্ষ। তিনি বিশ্বাস করেন কলেজ হলো একটা ট্রেনের মত। একে জোর করে লাইনে ধরে না রাখলে লাইনচ্যুত হয়ে পার্শ্ববর্তী খালে পড়ে যেতে পারে। আর লাইনে রাখার জন্য দরকার শান্টিং। এই শব্দটি নাকি আসলেই রেলওয়ের অভিধানে আছে। আমাদের বর্তমান প্রশাসনিক কর্মধ্যক্ষ বহুদিন থেকেই লক্ষ্য করছেন – ঠিকমতো শান্টিং-এর অভাবে কলেজ বেলাইনে চলে যাচ্ছে। শিক্ষকদের শান্টিং দিতে তিনি চান না। কারণ তিনি নিজে শিক্ষকের সন্তান। কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে তাঁকে অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হচ্ছে। যেমন শান্টিং একটি অপ্রিয় কাজ। এটুকু বলার পর তিনি বলেছেন, এজুকেশান ইজ দ্য ব্যাকবোন অব দ্য ন্যাশান।

আমি এডুকেশনের উচ্চারণ যে এজুকেশান হয় – তা আত্মস্থ করার চেষ্টা করছি। তাই তিনি যে বাক্যটির বঙ্গানুবাদ জিজ্ঞাসা করছেন তা নিয়ে খুব একটা বিচলিত হলাম না। কিন্তু দেখলাম নাসির স্যার খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তিনি বারবার ঘড়ি দেখছেন। দশটা থেকে এইচ-এসসি পরীক্ষা আছে। পরীক্ষার সব দায়িত্ব নাসির স্যারের উপর। কলেজের সব টিচারেরই ডিউটি আছে পরীক্ষার হলে। পরীক্ষার্থীরা বারান্দায় ভীড় করতে শুরু করেছে। মিটিং তাড়াতাড়ি শেষ করে আমাদের এখনই পরীক্ষার হলে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু ইঁদুরেরা বিড়ালের গলাতেই ঘন্টা বাঁধার সাহস পায় না, এখানে তো স্বয়ং বাঘ। এই বাঘের ভয়ে ‘এজুকেশান ইজ দ্য ব্যাকবোন অব দ্য ন্যাশান’ – এর বাংলা ভুলে গেছি সবাই।

তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কই বলেন কেউ একজন। ট্রান্সলেট ইট ইন্টু বেঙ্গলি।“

“শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড স্যার।“  

দেখলাম মেরুদন্ড সোজা করে উত্তর দিলো ইভা। কিন্তু ভুল করে সে বসে বসেই উত্তর দিয়ে ফেলেছে। বাঘ মোছের ফাঁকে সামান্য দন্ত-বিকশিত করে জিজ্ঞেস করলেন, “কে বললেন?”

ইভা তাঁর সামনে বসেই উত্তর দিয়েছে। তিনি দেখেছেন ইভাকে। কিন্তু দন্ডায়মান না হয়ে উত্তর দেয়াকে ‘ইগনোর’ করা শান্টিং নীতির পরিপন্থি। ইভা এবার দাঁড়াতে বাধ্য হলো।

“স্যার আমি”

“আপনার নাম?”

“হোসেইন আসমা।“

“হোসেইন আসমা। এনি নিক নেম?”

“ইভা”

“ইভা। এনি মিনিং অব ইট?”

ইভা কোন উত্তর দিলো না। আমি বসেছি পেছনের বেঞ্চে। এখান থেকে তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তার হাত দেখতে পাচ্ছি। দেখলাম হাইবেঞ্চের উপর রাখা তার বাম হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল। সে রেগে গেলে এরকম করে। ব্যাঘ্র-মহোদয় তাঁকে আর ঘাঁটালেন না। আগুনকে বাঘও ভয় পায়।

 

“আপনারাই জাতির মেরুদন্ড। তার মানে আপনারা জাতির জন্য খুব দরকারি জিনিস। বাট ডোন্ট ফিল কমপ্লেইসেন্ট অ্যাবাউট ইট।“ – এবার গলাটা সোহেল রানার বদলে জসিমের মতো শোনালো। আমি মনে করার চেষ্টা করছিলাম ‘জনি’ সিনেমার শেষ দৃশ্যে জসিম সোহেল রানাকে কী বলেছিল। কিন্তু কানে এলো “কমপ্লেইসেন্টের বেঙ্গলি কী হবে?”

কেউ কোন উত্তর দিচ্ছেন না। আমি চিড়িয়াখানায় গিয়েও বাঘের দিকে তাকাতে ভয় পাই। এখানে তাকাবার তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু ক্লাসে সবচেয়ে অমনোযোগী ছেলেটাও মাঝে মাঝে মনোযোগীর ভাব ধরে শিক্ষকের দিকে তাকায়। আমিও সেরকম করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। তিনি সম্ভবত খেয়াল করেছেন যে আমি তাঁর দিকে না তাকিয়ে আইভী ম্যাডামের গ্রামীন চেকের নতুন ডিজাইনের শাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

“কমপ্লেইসেন্টের বেঙ্গলি কী হবে? বলুন আপনি।“

“স্যার আত্মতৃপ্তি”

“হুঁ, আত্মতৃপ্তি। আপনার নাম কী?”

“প্রদীপ দেব।“

“আপনি ফিজিক্সের?”

আমার হঠাৎ গরম লাগতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে ক্লাসরুমের ফ্যানগুলো কাজ করছে না। আমার নাম কি কোনভাবে বাঘের কানে গিয়েছে? আমি কি খুশি হবো, নাকি ভয়ে কাঁপতে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। ক্ষমতাবানরা চিনতে পারলে কেউ কেউ নাকি খুশি হয়, এমনকি স্ত্রীর ভাই হিসেবে সম্বোধন করলেও নাকি তাদের খুশি উপচে পড়ে। কিন্তু আমি ক্ষমতাবানদের ভয় পাই। তাদের কেউ আমার নাম জানলে আমার কেবলই মনে হয় - আমি কি ইতোমধ্যেই তাঁর ব্ল্যাকলিস্টে উঠে গিয়েছি?

“এক্স-কিউজ মি স্যার, এইচ-এসসি পরীক্ষার আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে স্যার। বোর্ডের ইন্সপেকশান টিম এসে গেছে স্যার।“ – নাসির স্যারের পক্ষে আর ধৈর্য ধরে রাখা সম্ভব হলো না।

মিটিং এখানেই শেষ হয়ে গেল। শান্টিং মুলতবি রইলো। প্রিন্সিপাল স্যার দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে কথা বলতে গেলেন। আমরা সবাই দ্রুত বের হয়ে দৌড়ে চলে গেলাম পরীক্ষার হলে। খাতা আর প্রশ্ন একই সাথে দেয়া হলো। খাতায় রোলনম্বর লেখা, বৃত্ত ভরাট করা ইত্যাদির জন্য যে সময় লাগে – সেই সময়টুকু শিক্ষার্থীরা লস করলো।

আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরা আমাদের কলেজেই পরীক্ষা দিচ্ছে – এটা তাদের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। অবশ্য শহরের বেশিরভাগ কলেজেই এই ব্যবস্থা আছে। এবার বোর্ড থেকে পরিদর্শক দলে কারা এসেছেন জানি না। গতবার কমার্স কলেজের যে প্রফেসর এসেছিলেন – এবার সেরকম কেউ আসেননি। আমাদের কলেজের কয়েকজন শিক্ষককেও অন্য সেন্টারে যেতে হচ্ছে এক্সটার্নাল হিসেবে।

আমাদের নিজেদের শিক্ষার্থীরা নিজেদের কলেজে পরীক্ষা দিলেও কোন ধরনের অন্যায় সুবিধা পাচ্ছে না এটা দেখে আমার খুবই ভালো লাগছে। আমাদের শিক্ষকদের কেউই কোন ধরনের অন্যায় সুযোগ কাউকে দিচ্ছেন না। অনেকে নাকি সুযোগের অভাবে ভালো থাকেন। আমাদের শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকদের ব্যাপারে সেটা আমি মানতে রাজি নই। আমাদের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা অন্যায় করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমার জানা মতে কোন অন্যায় করেননি। সারাবছর ধরে যে প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পড়াশোনা হয়, সেখানে তো অন্যায় সুযোগ নেয়ার বা দেয়ার দরকার হয় না।

>>>>>>>>>>>>>>> 

পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে একটায়। বিকেলে আরেকটি পরীক্ষা আছে। ডিউটি আছে কলেজের অনেকের। বিকেলে ডিউটি থাকলে কোন একজন পিয়ন গিয়ে সার্জেন্ট মেস থেকে খাবার নিয়ে আসেন। ছোলাইমান স্যার অবশ্য মেসে গিয়ে খেয়ে আসার পক্ষপাতী। কিন্তু একবার তাঁর সাথে গিয়ে সেই যে কাঁটা-চামচ আর হাসি-কাশির ঝামেলায় পড়েছিলাম – আর সেমুখো হইনি। আজ অবশ্য দুপুরের খাবার হবে অন্য জায়গায়। বন্ধু আবুল হোসেন খান বিমল স্যার, সুপাল স্যার, আর আমাকে লাঞ্চের দাওয়াত করেছে তার বাসায়। তার বাসায় খেয়ে তারপর বিকেলের ডিউটি করবো। তার বাসায় যাবার জন্য টিচার্স রুমে অপেক্ষা করছি।

জুলাই মাসের প্রচন্ড গরম বাইরে। আকাশে মেঘ আছে প্রচুর, কিন্তু বৃষ্টি নেই। ভ্যাপসা গরম চারদিকে। ছোলাইমান স্যার গরমের কারণে এই সময় পায়ের জুতা খুলে ফেলেন। তারপর মোজাও খুলে ফেলেন। তিনি খুব গোছালো মানুষ। অন্যদের মতো মোজা গুটিয়ে জুতার ভেতর লুকিয়ে ফেলেন না। তিনি মোজা জোড়া খুলে টানটান করে নিজের চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে রাখেন। ফ্যানের বাতাসে মোজা শুকাতে থাকে – আর রুমের ভেতর এক ধরনের ঝাঁঝালো অ্যারোমাও পাওয়া যায়।  আজও সেরকম শুকাতে দিয়ে তিনি বাথরুমে ঢুকেছেন খালি পায়ে। এমন সময় প্রিন্সিপাল স্যার এসে রুমে ঢুকলেন। সকাল থেকে অনেক ঝামেলা যাচ্ছে তাঁর উপর দিয়ে। প্রশাসনিক কর্মাধ্যক্ষকে অনেক সময় দিতে হয়েছে সকাল থেকে। তিনি আমাদের রুমে এসে জানতে চাইলেন আমরা কেমন আছি – ইত্যাদি।

সাফারি স্যুট মনে হয় প্রিন্সিপাল স্যারের খুব প্রিয় পোশাক। আজও পরেছেন। তিনি সাধারণত আমাদের রুমে এসে বেশিক্ষণ থাকেন না। আজ মনে হয় অনেক ক্লান্ত ছিলেন। রুমে ঢুকে বসলেন ছোলাইমান স্যারের চেয়ারে। একে একে জানতে চাইলেন আমরা সবাই কেমন আছি। বিকেলে ডিউটি আছে এবং খান সাহেবের বাসায় লাঞ্চের দাওয়াত  আছে শুনে বললেন, “আমার কোয়ার্টার তো খান সাহেবের কাছেই। সময় থাকলে আমার বাসায় আসতে বলতাম।“

“আরেকদিন যাবো স্যার। আমরা তো আছি।“

“শিওর শিওর জেন্টলম্যান।“ – বলে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন প্রিন্সিপাল স্যার। আমরাও খান সাহেবের সাথে যাবার জন্য বের হচ্ছি। হঠাৎ চোখ গেল প্রিন্সিপাল স্যারের পিঠের দিকে। সেখানে সাফারির গায়ে ঝুলছে ছোলাইমান স্যারের একটি মোজা। প্রিন্সিপাল স্যার দ্রুত হাঁটেন। কিন্তু তাতেও মোজা পড়ে যাচ্ছে না, স্যারের পিঠে এক্সট্রা একটা পকেটের মত ঝুলছে।

মোজাটা কেন পড়ে যাচ্ছে না তা জানি। খুবই সিম্পল ফিজিক্স। প্রিন্সিপাল স্যারের সাফারির সাথে নাইলনের মোজার ঘর্ষণে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি বা স্থির বিদ্যুৎ তৈরি হয়েছে। বিপরীতমুখি চার্জের আকর্ষণে মোজা লেগে আছে। দেখলাম আরেকটি মোজা চেয়ারের কাছেই পড়ে আছে। অঞ্জন স্যারও দেখতে পেয়েছেন। দেখলাম তিনি হঠাৎ ছুটে গেলেন। হাত বাড়িয়ে মোজা ধরার চেষ্টা করলেন কয়েকবার। কিন্তু যতবারই হাত বাড়ান – স্যার চলে যান আরো সামনে। অবশেষে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে  “স্যার স্যার” বলতে বলতে স্যারের কাছে গিয়ে কিছু একটা বললেন। প্রিন্সিপাল স্যার একটু থেমে অঞ্জন স্যারের কথা শুনে মাথা নেড়ে চলে গেলেন। দূর থেকে দেখলাম স্যারের পিঠ থেকে মোজা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

ছাত্রদের কাছে শুনেছি অঞ্জন স্যার জাদু জানেন। তিনি যে আসলেই জাদু জানেন তা চোখের সামনেই দেখলাম। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কথা বলতে বলতে কোন ফাঁকে ঝুলন্ত মোজা নিয়ে লুকিয়ে ফেলেছেন হাতের তালুতে তা টেরই পেলাম না। রুমে এসে ছোলাইমান স্যারকে বললেন, “ছোলাইমান ভাই, এই নেন আপনার মোজা। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে চলে যাচ্ছিল।“

কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে কোন কৌতুহলই দেখালেন না ছোলাইমান স্যার। আমরা চললাম খান সাহেবের বাসায়।

খান সাহেব আমার ক্লাসমেট। কিন্তু বিশ্বসংসারের সব বিষয়ে অনেক বছর এগিয়ে আছে সে। তার বড় মেয়ে এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ভাবী ডাইনিং টেবিল ভর্তি করে ফেলেছেন ডজনখানেক তরকারি আর হরেক রকম খাবার-দাবারে।

“খান সাহেব, আপনি তো আমার চাকরি খাবার ব্যবস্থা করলেন।“ – বিমল স্যার খেতে খেতে বললেন।

“কেন?”

“এত বেশি খাবার পর তো ঘুম আসবে। ডিউটি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়বো। আর সেই দোষে আমার চাকরিটা যাবে।“

“হাহাহা” – বিমল স্যারের রসবোধ প্রবল।

এত বিপুল পরিমাণ সুখাদ্য সীমিত সময়ে শেষ করা অসম্ভব। টইটুম্বুর পেট নিয়ে পরীক্ষার হলে যখন ঢুকলাম তখন মনে হলো বিমল স্যার ঠিক কথাই বলেছেন। এত তৃপ্তি করে খেয়েছি যে যেকোনো মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়তে পারি পরীক্ষার হলের ভেতর। তখন প্রশাসনিক কর্মধ্যক্ষ আমার চাকরির বারোটা বাজিয়ে দিয়ে “দোস্ত দুশমনের” জসিমের গলায় বলবেন, “কমপ্লেইসেন্ট হতে মানা করেছিলাম মনে নেই?”

>>>>>>>>>>>>>> 

প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ঢুকার সময় আমার মতো এত ভয় আর কারো লাগে বলে মনে হয় না। নাসির স্যার, অঞ্জন স্যার, সাঈদ স্যারতো প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ঢুকেন অনেকটা নিজের রুমে ঢুকার মতো স্বাভাবিকভাবে। রিফাৎ আরা ম্যাডাম তো “স্যার আসি” বলেই হাসিমুখে ঢুকে যান। তাঁর “স্যার আসি” – প্রশ্নবোধক বাক্য নয়, বিবৃতিমূলক বাক্য বলেই আমার ধারণা। হোসনে আরা ম্যাডামতো প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসের লাল ট্রাফিক সিগনালকেও কেয়ার করেন না। কিন্তু আমার এত ভয় করে কেন? যত দিন যাচ্ছে – ভয়ের পরিমাণ বাড়ছে তো বাড়ছেই। প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ঢুকার সময় আমার অনেকটা বাঘের খাঁচায় ঢোকার মতো অনুভূতি হয়। অবশ্য বাঘের খাঁচায় আমি কোনদিন ঢুকিনি। তাই এখানে তুলনাটা ঠিক বাস্তবসম্মত হয়নি। কিন্তু ভয় যে লাগে সেটা বাস্তব। এখনো লাগছে। কারণ প্রিন্সিপাল স্যার একটু আগেই আমাকে ডেকেছেন তাঁর রুমে।

উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা প্রায় শেষ। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হবে ক’দিন পরে। আরেকটু পরেই ছুটি হবে। এমন সময় পিয়ন আবুল হোসেন এসে বললেন, “পদিব ছাররে পিঞ্ছিপাল ছার ছালাম দিছে।“ ডেকেছেন না বলে আবুল হোসেন সবসময় “ছালাম দিছে” কেন বলেন কে জানে। প্রিন্সিপাল স্যার নিশ্চয় তাঁকে ডেকে বলেননি, “যাও, প্রদীপ স্যারকে সালাম বলে আসো।“ আচ্ছা, এদের কি পিয়ন হবার কোন ট্রেনিং দেয়া হয়? আমাদের কারোরই তো কোন ট্রেনিং নেই। যেমন আমি কোন ধরনের ট্রেনিং ছাড়াই শিক্ষক হয়ে গিয়েছি। পড়ালেখা যা করেছি তা তো সব বিষয়ভিত্তিক। কোন কিছু জানলেই যে তা অন্যকে শেখানোর ক্ষমতা জন্মাবে তা তো নয়। তাহলে? প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ঢুকার ভয় কাটানোর জন্য কত কিছু চিন্তা করছি।

রুমে ঢুকার পারমিশান নেয়ার জন্য যে বাক্যটা বলতে হবে সেটা কয়েকবার মনে মনে আওড়ালাম। কিন্তু বলার আগেই পর্দা ফাঁক করে বের হয়ে এলেন শংকর স্যার। প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে দেখতে পেয়েছেন।

“প্লিজ কাম ইন মিস্টার প্রদীপ।“

ইংরেজি ভাষার কিছু সুবিধা আছে। কথায় কথায় প্লিজ, থ্যাংক ইউ ইত্যাদি বলা যায়। অথচ এই কথাগুলি বাংলায় বললে কেমন শোনাবে। “দয়া করে ভেতরে আসুন জনাব প্রদীপ“ – শুনলে মনে হবে ‘আলিফ লায়লা’র বাংলা সংলাপ।

“প্লিজ বি সিটেড।“

প্রিন্সিপাল স্যারের মুখে হাসি নেই। তার মানে সিরিয়াস কিছু বলবেন। আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম।

“আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।“

“কী কাজ স্যার?”

“আপনাকে শংকর মন্ডলের সাথে যেতে হবে আজকে।“

“আমরা তো এক সাথেই যাই স্যার। বাসে যাই।“

“না, আজ একটু তার সাথে দরকার হলে তার বাসায় যেতে হবে।“

“কেন স্যার? কিছু হয়েছে?” – আমি কিছুটা উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ছি। শংকর স্যারকে একটু আগেই এই রুম থেকে বের হতে দেখলাম।

“শংকরকে আমি একটি কথা বলতে পারিনি। কীভাবে বলবো, বা এখন বলা উচিত হবে কি না বুঝতে পারছি না। আপনাকে বলছি।“

“কী হয়েছে স্যার?”

“শংকরের বাবা মারা গেছেন। আমার কাছে ফোন এসেছে। শংকরকে তার বাড়িতে পাঠাতে হবে। আপনি শংকরকে আজই বাসে তুলে দেবেন। বলবেন তার বাবা অসুস্থ। খুলনায় যেতেও তো সময় লাগবে।“

“কিন্তু তিনি তো বাড়িতে ফোন করতে পারেন, বা অন্যভাবে খবর পেতে পারেন।“

“সেটা পারেন। অথবা বেশি জোর করলে তিনি বুঝেও ফেলতে পারেন। সেটা তার ব্যাপার। তবে আমি চাই – তিনি যেন মানসিকভাবে শক্ত অবস্থায় বাড়িতে যেতে পারেন। বাবার মৃত্যুর খবর পেলে সন্তানের যে কেমন লাগে তা আমি বুঝি।“

প্রিন্সিপাল স্যারের গলা নরম হয়ে আসে। প্রিন্সিপাল স্যারের এমন মানবিক রূপ আমি আগে দেখিনি কখনো। তাঁকে সবসময় মনে হয়েছে ফিল্ড মার্শালের মতো কঠিন একজন মানুষ। অথচ তিনি তাঁর অধীনস্ত একজন সাধারণ শিক্ষকের জন্যও কতটা দরদ দিয়ে ভাবছেন।

“আর জিজ্ঞেস করবেন তাঁর যাবার গাড়ি-ভাড়া ইত্যাদি লাগবে কি না। আপনি কিছু টাকা নিয়ে যান আমার কাছ থেকে।“

“লাগবে না স্যার। যদি লাগে আমি ম্যানেজ করে দেবো।“

“থ্যাংক ইউ মিস্টার প্রদীপ। আই ফিল সরি ফর হিম। কিন্তু সরিটা তাকে এখন বলতেও পারছি না। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড।“

“জি স্যার।“

প্রিন্সিপাল স্যারের অফিস থেকে বের হবার সময় মনে হলো – আমার ভেতরে যে ভয়ের ভাবটা ছিল, সেটা চলে গেছে। মানবিক মানুষকে ভয় পাবার তো কিছু নেই।  

বাসে উঠে শংকর স্যারকে বললাম, “আজ আপনার ওদিকে যাবো।“

“কোথায়, নিউমার্কেটে?”

শংকর স্যারের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গি দেখে আমি নিশ্চিত যে তিনি এখনো জানেন না যে তাঁর বাবা মারা গেছেন। কীভাবে তাঁকে বাড়িতে পাঠানো যায় তা ভাবছি, আবার তাঁর সাথে স্বাভাবিক এলেবেলে কথাবার্তাও বলছি।

নিউমার্কেটে নামার পর অনেকটা যেচেই তাঁর বাসায় যেতে চাইলাম। সদরঘাটের ওদিকে বাসা। তাঁর রুমমেট বিপুলের সাথে পরিচয় হলো। বিপুলও কিছু জানেন না। বিপুলকে বললাম যেন শংকর স্যারকে আজকের মধ্যেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। কারণ তাঁর বাবা অসুস্থ। শংকর স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, “প্রিন্সিপাল স্যার কী বলেছেন?”

“বলেছেন আমার বাবা একটু অসুস্থ। আমি বাড়ি যেতে চাইলে যেতে পারি। ছুটির ব্যবস্থা তিনি করবেন।“

“তাহলে আর দেরি করবেন না। আজকেই চলে যান।“

“হ্যাঁ যাবো। আজকেই যাবো।“

শংকর স্যার সহজেই বাড়ি যাবার জন্য রাজি হয়ে গেলেন। আমাকে গলির মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে বললেন, “আমার বাবা মারা গেছেন, তাই না?”

আমি শংকর স্যারকে জড়িয়ে ধরলাম।

>>>>>>>>>>> 

“রীমা-অন্তরা-নাজমুল, আমাদের কিন্তু হারানোর কিছু নেই। সুতরাং নির্ভয়ে প্রাণ খুলে বিতর্ক করবে। এবার ফাইনাল। জিতলে চ্যাম্পিয়ন, হারলে রানার্স আপ।“

যে কোন ম্যাচের প্রস্তুতির সময় কোচরা বিভিন্নভাবে খেলোয়াড়দের উদ্দীপ্ত করে তোলেন। আমাদের তিনজন বিতার্কিককেও আমরা ফাইনাল বিতর্কের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেছি। জাতীয় টেলিভিশন স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের সাথে আমাদের সেমি-ফাইনাল হয়েছে। আমরা সেখানে জিতেছি। এখন ফাইনাল হবে হলিক্রস বালিকা বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। আমাদের প্রথম বক্তা সৈয়দ নাজমুল কবীর, ২য় বক্তা নাজমুস সেহার অন্তরা, আর দলনেতা তানজীবা সুলতানা রীমা।

সুচরিত স্যার আমাদের সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে কলেজ থেকে চলে গেছেন শিপিং কর্পোরেশনে। সেমিফাইনালের আগে রিফাৎ আরা ম্যাডাম আমাকে সিরিয়াসলি ঝাড়লেন একদিন। বললেন, “এতদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তখন সুচরিত ছিল, আপনি বেঁচে গিয়েছিলেন। এখন সব দায়িত্ব আপনার। আমি আর নাসরীন আগেও কাজ করেছি, এখনো করছি। কিন্তু আপনি আগে তেমন কিছুই করেননি। সুচরিত সব করেছিল। এখন সুচরিত নেই। সুচরিতের সব কাজ আপনাকে করতে হবে। সুচরিত থাকতে আমরা একবারও হারিনি। এবার সুচরিত না থাকাতে যদি আমরা হারি – তার সব দায়-দায়িত্ব আপনার।“

“তা কেন হবে ম্যাডাম? বিতর্কে হার-জিত তো থাকবেই।“ – আমি পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করি।

“ওসব বলে লাভ নেই। সিরিয়াসলি কাজ করেন।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডামকেই এখন বাঘের মত মনে হচ্ছে।

সেমিফাইনালে জেতার পর মনে হয়েছে ফাইনালে তো পৌঁছে গেছি। রানার্স-আপ হলেও তো চলে। কিন্তু রিফাৎ আরা ম্যাডাম কীভাবে যেন বুঝে ফেলেন আমার মনোভাব। ফাইনালের চিঠি আসার পর বিতার্কিকদের কিছু বলার আগে আমাকেই ধমক দিলেন, “খবরদার, একটুও যদি গাফেলতি দেখি …” বাক্যটা শেষ করলেন না। কিন্তু আমি বুঝে ফেলি। বাক্যের অসমাপ্ত অংশটা হবে “জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো” বা এই টাইপের কিছু। বিতর্কের স্ক্রিপ্ট লেখা, রিহার্সাল দিতে দিতে মুখস্থ করানো, যুক্তিখন্ডন এসব চললো অনবরত। ছুটির দিন বলে কিছু রইলো না আমাদের। শুক্রবারও কলেজে আসি। সারাদিন রিহার্সাল করে তারপর বাসায় যাই। সবার ভেতর প্রচন্ড উত্তেজনা। অবশেষে রেকর্ডিং এর দু’দিন আগে আমরা ঢাকায় রওনা দিলাম।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসার্স মেসের গেট দিয়ে ঢুকে গার্ড-রুমের সামনে বেবি-টেক্সি থামিয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করার পর যখন বললাম “চট্টগ্রাম শাহীন কলেজ থেকে এসেছি” – ইউনিফর্ম পরা প্রহরী হঠাৎ স্যালুট দিলো। এরকম তো সাধারণত হয় না।

রাস্তার এক পাশে দেখলাম তিনজন সাদা অ্যাপ্রোন পরা মানুষ বড় বড় ডেকসি মাথায় নিয়ে মূর্তির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন ডেকসি-অভ্যর্থনাও তো আগে দেখিনি কখনো।

>>>>>>>>>> পরের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts