Saturday, 8 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - উত্তরাধিকার


__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - উত্তরাধিকার
__________________________________________

উত্তরাধিকার

 

সাতটা বাজতে না বাজতেই স্কুলের আঙ্গিনায় পা রাখলেন মনির হোসেনছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় মনির স্যারপলাশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক

          স্কুলের দপ্তরী সবেমাত্র রুমগুলোর তালা খুলছেতারপর মনির স্যারের কাছে এসে সময় জেনে ঠিক সোয়া সাতটায় সতর্ক সংকেত বাজাবে আর সাড়ে সাতটায় স্কুল বসার ঘন্টা

          মনির স্যার কমন রুমে এসে ঢুকলেননিজের রুটিনটা আবার যাচাই করে নিলেন। প্রথম ঘন্টায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে অংকতারপর প্রথম শ্রেণিতে বাংলাতৃতীয় ঘন্টায় আবার দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাংলাএরপর আধাঘন্টা বিরতিবিরতির পর আবার শুরু হবে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসএভাবে চলবে বেলা তিনটা পর্যন্ত

          চারটা থেকে মনির স্যারের বিশেষ ক্লাসবন্ধ স্কুলঘরের বারান্দায় যতক্ষণ আলো থাকে ততক্ষণ তিনি পড়ানযে যে ছাত্র যে যে বিষয়ে দুর্বল তাদের আলাদা আলাদা করে পাঠদান করেনতারপর বাড়ি ফিরে যান

          স্কুলে আরো যে চারজন শিক্ষক আছেন তাঁরা মনির স্যারকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করেননামও দিয়েছেন একটা পাগলের পাঠশালাকিন্তু তাঁর ওসব গায়ে লাগে নাকারণ তাঁর জীবনে কী কষ্ট লুকিয়ে আছে সে কথাতো তারা জানে না

          সর্তক-ঘন্টা বাজার একটু আগে বারান্দায় এসে দাঁড়ান মনিরএকজন দুজন করে ছেলে মেয়ে মাত্র আসতে শুরু করেছেদু'একজন এখনও ঘুম চোখে থাকায় টলমল পা ফেলছেকেউ কেউ চোখ ডলছেসকালের সূর্যের আলো ওদের ছোট্ট মুখগুলোতে পড়ে আরোও মায়াবী দেখাচ্ছে বাচ্চাগুলোকে

          এবার আকাশের দিকে তাকালেনআশ্বিনের শুরুতে শরতের আকাশ উজ্জ্বল নীল হয়ে আছেদূরে রাস্তার দিকে তাকালেনসারি বেঁধে দলে দলে ছেলে-মেয়ে আসতে শুরু করেছেআর দুচার মিনিটের মধ্যে ওদের কলকাকলীতে মুখর হয়ে উঠবে শূন্য প্রাঙ্গণ।

          গেল ক'দিনের বৃষ্টির পর কাল আর আজ রোদ পেয়ে স্কুলে উপস্থিতির সংখ্যা বাড়ছে। হেডস্যার এসে গেছেনঅন্য শিক্ষকেরাওসবাই মিলে প্রাতঃকালীন সমাবেশের আয়োজনে ব্যস্ত হলেন

          মনির ভাঁজ করা জাতীয় পতাকাটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে মাঠে নেমে এলেনতাঁর মাথার ভেতর গুনগুন করতে লাগল জাতীয় সঙ্গীতের একটি লাইন -ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে

          মনির হোসেন এ স্কুলে যোগ দিয়েছেন প্রায় চার বছরপলাশপুর গ্রামের পাশে আলমডাঙায় তাঁর বাড়িকিশোর বয়স থেকে তার ভেতরে একটাই প্রতিজ্ঞা দৃঢ় ছিল - একদিন শিক্ষক হবেনগৃহের, সমাজের অন্ধকার দূর করবেনতাইতো বিএ পাশ করার পর বন্ধুরা যখন চাকরির সন্ধানে ছুটোছুটি করছিল তখন তিনি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন

          বন্ধুরা বলেছিল - "মনির, তোর যা রেজাল্ট কষ্টেসৃষ্টে এমএ টা পাশ করে বিসিএস দিলে নির্ঘাত সরকারি অফিসার হয়ে যাবিকেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হয়ে জীবনটা নষ্ট করবি?"

          কিন্তু মনির তাদের কথা শোনেনিতারা তো জানে না মনের ভিতরে একটা দগদগে ঘা তাকে এপথে আসতে তাড়িত করেছে

          চোখ বুঁজলে এখনও স্পষ্ট দেখতে পান মনির এরকমই একটি আশ্বিনের সকালশরতের আলোকছটায় উজ্জ্বল চারদিককিন্তু আলমডাঙার মনির হোসেনদের ঘরের ভিতরটা অন্ধকারদিনের আলো প্রবেশ করার মত পর্যাপ্ত জানালা দরজা নেইমাটির দেয়ালঘেরা সেই ঘরটাতে দিনের বেলায়ও হঠাৎ ঢুকলে কোথায় কী আছে বুঝে উঠতে কষ্ট হয়অন্ধকারটা চোখে সয়ে এলে তারপর আস্তে আস্তে জিনিসপত্রের আকার-আকৃতি আর অবস্থান বোঝা যায়সেই ঘর থেকে আশ্বিনের সে উজ্জ্বল সকালে স্কুলের পথে বেরিয়েছিল মনিরবাবা অনেক ভোরে মাঠে চলে গেছেনঘরে মা আর জ্বরে আক্রান্ত ছোটভাই আমীর

          সাত-আটদিন থেকে জ্বর ছিল আমীরেরএলাকার পল্লী চিকিৎসক থেকে ওষুধ এনে খাওয়ানো হচ্ছিলপল্লী চিকিৎসকই বলেছিল রক্তটা একবার পরীক্ষা করিয়ে নিতেতাহলে ধরা পড়বে টাইফয়েড না ম্যালেরিয়াকিন্তু পরীক্ষা করাতে উপজেলা হাসপাতালে যাওয়ার মত টাকাপয়সা বাবার হাতে ছিল নাতবু ডাক্তার যে ওষুধ দিচ্ছিল সেটাই খাওয়ানো হচ্ছিল

          কিন্তু সেদিন ওষুধ খাওয়ানোর সময় মা ভুল করে ভাইয়ের মুখে তুলে দিয়েছিলেন কীটনাশকআবছা অন্ধকার ঘরে নিরক্ষর মা তার বুঝতে পারেনি কোনটা ওষুধের শিশি আর কোনটা বিষের

          খবর পেয়ে বাবা, মনির এবং আরো সবাই যখন ছুটে এসেছে তখন ভাই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অনেক দূরে চলে গেছেউঠোনে গোসল দেবার সময় তার বিষ জর্জর নীলচে মুখের স্মৃতি এখনও মনিরের বুকটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়

          ভাইয়ের মৃত্যু শোকে তার স্মৃতি ভাবতে ভাবতেই একদিন যেন আলোর দেখা পায় কিশোর মনিরমা যদি পড়তে জানত তাহলে তো এমন হতো নাতাহলে এ অন্ধকার থেকে মুক্তির উপায় কী? শিক্ষা

          মনের গহীনে খুঁজে পাওয়া সে আলো নিয়েই পলাশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আজকের শিক্ষক মনির হোসেনের পথ চলা শুরু সেদিন থেকে

          "কী মনির সাহেব ক্লাসে যাবেন না?" - সহকর্মী শিক্ষক অভিজিতের ডাকে খেয়াল হল মনিরের

          ঘড়ির দিকে তাকালেনপাঁচ মিনিট লেট! এমন তো কখনও হয় নাআজ আশ্বিনের সকাল সেই পুরনো স্মৃতি জাগিয়ে দিয়ে তাকে কী সব ভুলিয়ে দিল! তাড়াতাড়ি চক-ডাস্টার আর বই-খাতা নিয়ে ক্লাসের দিকে দ্রুত পা চালালেন মনির

          বেশ কিছুদিন থেকে মনির লক্ষ্য করছেন স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি কমে এসেছেবিশেষ করে সকালের শিফট-এ বাচ্চাদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়ভাবে কমদ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাসে ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করেন-"স্কুলে আসোনা কেন?"

          ওরা চুপ করে থাকেবুঝতে পারেন সবাইকে একসাথে প্রশ্ন করলে কেউ উত্তর দেবে নাতাই একজন একজন করে জিজ্ঞেস করেন - "মায়মুনা নিয়মিত স্কুলে আসছ না কেন? স্যার না বলেছি ঝড়-বৃষ্টি-রোদ যাই হোক না কেন তোমরা স্কুল বাদ দেবে না।"

          মায়মুনা মেয়েটি বেশ চটপটে - "স্যার, আব্বায় বাড়িতে না থাকলে আম্মায় আসতে দেয় না।"

          "কেন?"

          "আব্বায় থাকলে স্কুলে পৌঁছাইয়া দিয়া যায়আবার আইসা নিয়া যায়আম্মা একলা দিতে চায় না, ভয় পায়।"

          "কিসের ভয়রে!এই সকাল বেলা কিসের ভয়?"

          "স্যার আপনি দ্যাখেন নাই নতুন গোডাউনের বড় বড় টেরাকগুলান এইখান দিয়া যায়এই চিকন রাস্তায় টেরাক চললে আমাগো হাঁটার জায়গা থাকে না।"

          হ্যাঁ তাইতোএ বিষয়টা এতদিন মাথায় আসে নি কেন মনিরেরসম্প্রতি এখানে এক শিল্পপতির মালের গুদাম হয়েছে সেই মাল আনা-নেয়া করতে স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে প্রায়ই ট্রাক চলাচল করেঅল্প ক'দিনে রাস্তাটা খানাখন্দে ভরে গেছেকিন্তু এটা যে ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়ের ভয়ের কারণ হতে পারে সেটা একবারও মাথায় আসেনি

          বিষয়টা ভাবিত করে মনির হোসেনকেসন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবতে থাকেন কী করা যায়হঠাৎ আবছা অন্ধকারে একটা গর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সোজা হয়ে দাঁড়ান মনির আর তক্ষুণি সাঁ করে চলে যাওয়া ট্রাকটা তাঁকে আতঙ্কিত করে তোলেআর একটু হলেই তো চাকার তলায় যাচ্ছিলেন। নাহ্‌, এর একটা বিহিত করতে হবে

          পরদিন টিফিন পিরিয়ডে হেডস্যারের কাছে কথাটা পাড়েন - "স্যার, স্কুলের সামনের এই সরু রাস্তা দিয়ে ট্রাক চলাচল তো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।"

          "তার জন্য আমি কী করতে পারি? রাস্তাটাতো স্কুলের সম্পত্তি নয়।"

          "না, তা যে নয় আমিও জানিকিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিপদের কথা আমারাতো উপজেলা প্রশাসনকে জানাতে পারি।"

          "বাদ দাও তো মনিরকেন অযথা ঝামেলায় জড়াচ্ছসবার উপর মাস্টারি করতে যেয়ে নিজের বিপদ ডেকো নাযাও যাও ক্লাশে যাও।"

          "তবু স্যার একটা কিছুতো করা দরকারঅন্ততপক্ষে প্রশাসনকে আপনি একটা দরখাস্ত লিখে বিষয়টা জানান।"

          হেডস্যার বিরক্ত হয়ে ধমকে ওঠেন - "পাগলামী করোনা মনিরযাও, এখন যাও তোআমার ম্যালা কাজ আছে।"

          কিন্তু মনির হতাশ হন নাছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি যানঅভিভাবকদের বোঝাতে চেষ্টা করেন - এই সরু রাস্তায় যখন-তখন ভারী যান চলাচল বিপদজনকযারা চালায় তারা কোন কিছুর পরোয়া করে নাএতে করে যে কোন সময় একটা শিশুর অমূল্য জীবন হারিয়ে যেতে পারে     

        না, তারা সাড়া দেয় নাগরিব মানুষ তারাকেউ চাষী, কেউ জেলে, কেউবা সামান্য দোকানদার প্রতিবাদ করার শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই তাদের নেইআর গোডাউনটা যার তিনি এলাকার প্রভাবশালী মানুষমাত্র কয়েক বছরে তিনি এত বেশি টাকার মালিক হয়েছেন যে একসময় যারা তার বন্ধুস্থানীয় ছিল তারাও তার দিকে চোখ তুলে কথা কয় না

          মনির তবুও তাদেরকে বোঝাতে চান - "আমরা সবাই এক হয়ে বাধা দিলে উনি একা কী করবেন? দেখছেন অল্প ক'দিনে রাস্তাটা কেমন খানা-খন্দে ভরে গেছেআসেন বাধা দিই আমরা।"

          না, কেউ আসে নাওদের সবার কাজ আছে

          একদিন ছুটি নিয়ে উপজেলায় যান মনিরনির্বাহী অফিসারের কাছে আবেদন জানান

          "হেডমাস্টার বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কোন দরখাস্ত এনেছেন?   জানতে চান নির্বাহী অফিসার

          "জ্বী না স্যার।"

          "তাহলে আমি কী করতে পারি? মুখের কথায় তো কাজ হবে নাতাছাড়া যার বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ তিনি কতবড়ো মানুষ জানেন?"

          মানুষ! টাকা হলেই মানুষ রাতারাতি বড়মানুষ হয়ে যায়! মনিরের ধন্দ লাগেতিনিতো জানেন বড়মানুষ হতে গেলে সাধনা করতে হয়একটা অশিক্ষিত, স্বার্থপর লোক শুধু কিছু টাকার মালিক হলেই বড়মানুষ হয়ে যায়! আশ্চর্য!

          "কী স্যার, বসে আছেন কেন? এবার উঠুন। আমার অনেক কাজ আছে।"

          হতাশ মনির হোসেন ধীর পায়ে বেরিয়ে আসেন

          বছর ঘুরে বর্ষা এসেছেস্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনির হোসেন মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে আছেনএবারের বাদলায় ছেলে-মেয়ের উপস্থিতি আরও  কমে গেছেঅথচ শিক্ষা নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন ছিলবিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা

          বুকের ধনকে বিষ খাইয়ে আজ  এতগুলো বছর তাঁর মা অর্ধউন্মাদ হয়ে বেঁচে আছেনমনিরের নিজের ভিতরেও ভাই হারানোর তুষের আগুনসেজন্য স্কুলের ছাত্রীগুলোকে অনেক বেশি যত্ন আর আদর দিয়ে পড়ান যাতে তাদের আগ্রহ তৈরি হয়

          কিন্তু এবারের বর্ষায় রাস্তাটা এত ভেঙে গেছে যে হাঁটাই দায়অথচ ট্রাক চলাচল বন্ধ হয়নিযিনি গুদামের মালিক তিনিতো এলাকায় আসেন নাএলে একবার তার কাছেই যেতেন মনির

          হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মত একটা বুদ্ধি খেলে যায় মনির হোসেনের মাথায়আচ্ছা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্ররা যখন বিকেলে পড়তে আসে তখন তাদের নিয়ে পাশ থেকে কিছু মাটি তুলে রাস্তাটা ভরাট করলে তো কিছুটা সমাধান হয়তারপর একটা লালপতাকা পুঁতে দিলে এখান দিয়ে আর ট্রাক চলবে না

          এতটা আশা করেননি মনিরবাড়ি থেকে কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে এসে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ছেলেরা রাস্তার গর্তগুলো বুঁজে দিল

          মেয়েরা প্রথম একটু মন খারাপ করে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু স্যার যখন বললেন - "মুগুর দিয়ে গর্তের মাটিগুলো সমান করে দাও" তখন ওরাও আর পিছিয়ে থাকল না

          তারপর সবাই মিলে হৈ হৈ রৈ রৈ করে একটা খুঁটিতে পতাকাটা বেঁধে স্কুলের সামনের রাস্তায় পুঁতে দিল

          কাজটা শেষ হতে মনির গেয়ে উঠলেন - "আমরা করব জয়, আমরা করব জয়, আমরা করব জয় একদিন।"

          স্যারের শেখানো এ গানটা হাতে তালি দিতে দিতে ওরা সবাই গেয়ে উঠলআনন্দে ভাসতে ভাসতে মনির বাড়ি ফিরলেনতাঁর শিক্ষা কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছে

          সকালে স্কুলের পথে আসতেই দেখলেন রাস্তা পূর্ববৎট্রাকের মোটা চাকার দাগ গর্তের নরম মাটিতে বসে গর্তগুলো আবার জেগে উঠেছেআর টুকরো টুকরো খুঁটিতে লাল পতাকার চিহ্নও নেইচোখ দুটো জ্বলে উঠল তাঁরক্রোধে প্রতিজ্ঞায় হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এল। বিড়বিড় করে উঠলেন - "তোমাদের প্রতিরোধ করবই।"

          স্কুলে এসে ছেলে মেয়েদেরও মন খারাপনিজের কষ্ট ভুলে ওদের সান্ত্বনা দিলেন তিনি

          হেডস্যার তার রুমে ডেকে নিলেন - "কেন এত পাগলামী কর মনির বলোতোমাস্টারদের এসব মানায়?"

          "ক্ষমা করবেন স্যারএটা পাগলামী নয়, এটা আমাদের অধিকারএ রাস্তা ট্রাক চলার জন্য নয়।"

          হেডস্যার রেগে গেলেন - "তোমার যা খুশি কর কিন্তু মনে রেখো, তুমি গোখরো সাপ নিয়ে খেলছতিস্তা গ্রুপের মালিক তোমার মত শত শত স্কুলমাস্টারের পরোয়া করেন না।"

          "দেখা যাক স্যার।"

          সারারাত একটা চিন্তাই দপদপ করতে থাকে মাথার ভেতরএ অন্যায়কে রুখতে হবেশিশুদের রক্ষা করতে হবেস্কুলে না এলে ওরা যে আলোর পথ থেকে দূরে সরে যাবেকচি কচি মুখগুলো যেন মিছিল করে মনিরের চোখের সামনেযেন বলে - "স্যার, এভাবে আমরা হারিয়ে যেতে আসিনিঅথচ দানবের মত ট্রাকগুলোর ভয়ে আমরা স্কুলে আসতে পারি না।"

          একটা খুঁটিতে লাল কাপড় জড়িয়ে স্কুলের পথে রওয়ানা হন মনিরএখনও পুরোপুরি সকাল হয়নিতার আগেই যাবেন খুঁটিটা পুঁততে হবে

          সারাটা  স্কুল জুড়ে হৈ চৈ কান্নাকাটিচারপাশের মানুষ ছুটে আসছে আসছে পলাশপুর, আলমডাঙা, কয়রাগঞ্জের মানুষমনিরস্যারকে ট্রাকচাপা দিয়েছে খুনি ট্রাকচালকতাঁর থেঁতলানো শরীরটা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে আর হাতের মুঁঠিতে শক্ত করে ধরা লাল পতাকার খুঁটিটা

          পিঁপড়ের মত সারিবদ্ধ হয়ে মানুষ আসছেছুটে আসছেন মহিলারাপ্রিয়জন হারানোর বেদনায় তারা মূহ্যমানতাদের সন্তানদের ভালবাসার মানুষটি যে আজ  চলে গেলওদের মুখে স্যারের কথা শুনে কখন যেন তাদেরও আপনজন  হয়ে উঠেছেন মনিরস্যার

          থানার ওসি আসে, সেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাজনতাকে শান্ত করতে পারেন না তারাতাদের দাবি - "এ রাস্তায় ট্রাক চলতে পারবে নাপ্রয়োজনে আমরা প্রতিদিন একজন করে মরব।"

          পরদিন সকালে দেখা গেল রাস্তাজুড়ে অজস্র লাল পতাকা তিস্তা গ্রুপের গোডাউন ঘিরে আছে অসংখ্য মানুষ তারা এখান থেকে আর কোন ট্রাক বের হতে দেবে না  


No comments:

Post a Comment

Latest Post

FLASH Radiotherapy: A New Possibility in Cancer Treatment

  Cancer is the disease before which humanity feels the most helpless. Every year, the number of cancer patients continues to rise at an ala...

Popular Posts