Friday, 21 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ১৬ - ১৮

 


-----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

১৬

 

লাশবাহী গাড়িটা এসে বাড়ির উঠানে থামতে তৌহিদা বেগমের মনটা কি আকুলি বিকুলি করে উঠল? প্রথম যেদিন ঘেরদেয়া পালকিতে চড়ে বাড়িতে এসেছিলেন তখন তিনি ছিলেন প্রায় অর্ধমূর্ছিত সারাদিনের না খাওয়া পথের নানারকম বাহন পালকি, রেলগাড়ি, নৌকা আবার পালকি নৌকাতেও তাকে পালকিতে বসে থাকতে হয়েছিল

          আজ হিম হিম ঠান্ডা গাড়িতে এসেছেন কিন্তু কোন বোধ ছিল না না কষ্ট না সুখ বেঁচে থাকলে দেখতেন হৈ চৈ পড়ে গেছে যদি দেখার সামর্থ থাকত তাহলে দেখতেন সেই বহুকাল আগে পালকী থেকে ঘেরা পর্দায় যেমন মামীশাশুড়ির কোলে করে জলচৌকিতে দাড়িয়েছিলেন, তারপর তার পা ধুয়ে দিয়েছিল ননদ সম্পর্কের কয়েকজন আজ তাও করতে হবে না হাসপাতালেই সব করে বাক্সবন্দী করে তাঁকে আনা হয়েছে হায় সময়ের পরিবর্তনে যুগের কত পরিবর্তন

          কয়েকজন নিকটাত্মী আর নাতিরা মিলে তাকে খাটিয়ায় তোলে লাশের কষ্ট হবে তাই অন্যরা তাদের বার বার সাবধান করে সবাই কলমা শাহাদাত পড়ো, কলমা শাহাদাত, "লাইলাহা ইল্লালাহু ওয়াহ্‌দা হু  লা শারীকালা হু ওয়া আশহাদু ন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু"'           

বারান্দায় খাটিয়াটা এনে রাখতেই একসঙ্গে অনেকের কথা শোনা যায়- "বেগানা পুরুষ সইরা খাড়ান মহিলারা আগে দ্যাখেন নিকট আত্মীয় ছাড়া কেউ মুখ দ্যাখনের হুকুম নাই"

          নিঃসাড় তৌহিদার মনটা কি কেঁদে উঠে তাঁর প্রিয় সন্তানদের ন্য? তাঁর কি ইচ্ছে করে ডেকে বলতে, "জহির, তারিক, শরীফ, শেলি, লীলা তোরা আমার কাছে আয় আমার চারপাশে ঘিরে বসে থাক আমি তোদেরকে দেখতে চাই কতদিন পর তোরা পাঁচ ভাইবোন একসাথে হলি এই সুখ আমি বেঁচে থাকতে কেন পেলাম না"

          তার কি মনে পড়ছে এমন ফুটফুটে জোছনায় রাতের বেলা মনজিলাকে নিয়ে তারা দুবোন নদীতে ঘুরতে যেতেন রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কোন কোনদিন দীঘিতে গোসল করতে যেতেন চৌধুরি সাহেবরা দুই ভাই জানলেও নৌকার মাঝি আর মনজিলা ছাড়া এসব কথা আর কেউ জানত না সেই জোছনা, নদী, পানির ঢেউ আর মাঝির বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তাদের দু'বোনকে সংসারের খাঁচা থেকে মুক্তি দিত

          বোনটার বাচ্চা হল না তৌহিদার দেবরের কোন হেলদোল ছিল না শেষে ফাহমিদার বাচ্চাটাকে সে মারা যাওয়ার পর নিয়ে এল তারপর দুইজন সেই বাচ্চা নিয়ে মাতোয়ারা তৌহিদা কী বাচ্চাটার নাম মনে করতে পারছেন? কী যেন নাম ছিল বাচ্চাটার - শীলা, শীলা কতদিন তৌহিদা শীলাকেও দেখেননি বড় পর হয়ে গেছিল মেয়েটা প্রায়ই তার মনে হতো আমি কী ঠিক করেছিলাম, আমার ছেলেমেয়েরা কি ওদের চাচার দায় পূরণ করেছিল, তিনি কী ওদের বলেছিলেন? কই মনে পড়ছে না তো

          বেঁচে থাকতে অনেকদিন দ্বন্দ্বে ভুগতে হয়েছিল- ব্যাপারটা ঠিক হল কী না? বিশেষ করে তাঁর ছোটমেয়ে লীলা যখন মামলা করে শ্বশুরবাড়ির অংশ পেল তখন মাঝে মাঝেই মনে হত, সাদের সংসার না করে লীলা যদি সম্পত্তির দাবিদার হয় তাহলে শীলা কি পালক সন্তান হিসেবে পালক পিতার সম্পত্তির কিছুই পাবে না? কিন্তু ইসলামে তো দত্তক সন্তানের কোন আইন নাই লীলারতো বিয়ের কাবিন ছিল সে আইনত সাদের স্ত্রী শীলা সন্তান সমতুল্য হলেও সন্তান নয় তাছাড়া আপন ছোটবোনের সন্তান হলেও তাঁর শ্বশুরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজের সন্তানদের ছাড়া অন্য কারো অধিকার মেনে নিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না মনের ভেতর কোথায় যেন একটা কাঁটা খচখচ করত এতগুলো সম্পত্তি মেয়েটা একা পেয়ে যাবে? হলোই বা বোনের মেয়ে, নিজের মেয়ে তো নয় আবার রক্তের টানে স্নেহের টানে ভালওবাসতেন তাঁর কি জানতে ইচ্ছা করছে, আজও কি শীলা আসেনি? রাগ করেই থাকল?

          চারপাশে দোয়া দরুদ আতর লোবানের গন্ধ সবাইকে দেখানোর পর তৌহিদা বেগমের মুখটা বেঁধে ফেলা হচ্ছে শুরু হল অন্তিম যাত্রা কেউ শুনতে পাচ্ছে না তবুও বলতে ইচ্ছে করছে, বিদায়

 

****

১৭

 

শীলা খালাম্মার মুখটা একটু দেখেই সরে গেল কষ্টের পাশাপাশি নিজেকে কেমন যেন অপরাধী লাগছে কেবলি মনে হচ্ছে, আহা বেঁচে থাকতে একবার দেখতে গেলাম না কেন? কিন্তু আজকে তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাড়িটাতে পা দেওয়ার পর থেকে অজস্র স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফিরছে বাবার মৃত্যুর পর চল্লিশা হয়ে গেলে খালাম্মার হাতে চাবিটা তুলে দিয়ে বিদায় নেয়ার সময় বুকভাঙ্গা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মনে হয়েছিল এই শেষ যে ঘরে ছত্রিশ বছর তার জীবন কেটেছে, একমাত্র সন্তান হয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে সেখানে আর কোনদিন ঢুকবে না,  সেই দরজা আর নিজ হাতে খুলবে না

            "শীলা আপা, শীলা আপা, আসেন দ্যাখেন জেঠিমারে নিয়ে যাচ্ছে, চল্লিশ কদম গোনা শুরু করছে" চাচাতো বোন নিরুর ডাকে যেন সম্বিত ফিরে পেল শীলা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নীরুর হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল

          বাহির বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মসজিদ মাঠে বাড়ির মেয়েরা মসজিদের গাছগাছালির পিছনে এসে দাঁড়াল প্রচুর জনসমাগম ঘটেছে মসজিদের আঙিনা ঘিরে জ্বালানো টিউবলাইটের আলো শুক্লপক্ষের জোছনাকে ম্লান করে দিয়েছে

          জানাযার আগে তিন ভাই সারিবদ্ধ জনতার সামনে এসে দাঁড়াল কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকাল না তৎক্ষনাৎ ছুটে এলো এলাকার এম পি ফয়েজুর রহমান তিনভাইয়ের একজনকে ডানহাতে ধরে বাঁ দিকে থাকা তারিকের হাত ধরল শরীফ একটু সরে দাঁড়িয়ে অবাক হল ফয়েজুর রহমান জনতার উদ্দেশ্যে দুভাইয়ের হাত পরের দিকে তুলে বলল, "আজ তৌহিদা বেগম চৌধুরানী ইন্তেকাল করেছেন, আমরা সবাই  তাঁর জানাযার কাতারে শরীক হয়েছি এই মুহূর্তে আমি তাঁর ছেলেদের পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে চাচী আম্মার জন্য মাফ চাইছি জীবিতকালে তিনি যদি জানা মতে বা অজান্তে কারো মনে কোন কষ্ট দিয়ে থাকেন তাহলে তার ছেলেদের পক্ষ হয়ে আমি উপস্থিত অনুপস্থিত সকলের কাছে মাফ চাইছি আর একটা কথা যদি কারো কো দেনা পাওনা থাকে তাহলে প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যাবেন।"

          "না না আমাগো কোন পাওনা নাই ওনার কাছে দেনা আছে ভাইজানগো কাছে আমরা মাফ চাই" বেশ কয়েকজন হাত তুলে বলল, "আমাগোরে মাফ কইরা দেন ভাইছাবেরা বহুত নিছি, বহুত খাইছি জেডিমা বহুত মহব্বত করছেন, বিপদে আপদে সাহাইয্য সহানুভূতি করছেন কারো কো দাবি নাই"

            বয়োজ্যেষ্ঠ একজন পিছন ফিরে বলল, "তোমাগো হগলের কী মত?"

          "না না, আমাগো কোন দাবি নাই আমরা আল্লাহর দরবারে ওনার মাগফেরাত চাই"

          তারি বুঝতে পারে না এই একসঙ্গে মাফ চাওয়ার কোন পরিকল্পনা তার ছিল না এটাও নিশ্চয় বড় শয়তানটার চালাকি মানুষরে বুঝাইতে চাচ্ছে তারা তিন ভাই এক শয়তান! মায়েরে নিয়াও পলিটিক্স করে

          হঠাৎ তিন ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কিন্তু দীর্ঘকায় শরীফ হাত তোলে তারপর বলে, "গ্রামের সবার কাছে আমি মায়ের পক্ষে মাফ চাইছি আর আগামী মঙ্গলবার আমি আমার আম্মার কুলখানির আয়োজন করব ইনশাল্লাহ আপনারা যারা উপস্থিত আছেন সকলের দাওয়াত রইল সবাই কবুল করলে খুশি হব" উপস্থিত জনতা সানন্দে সম্মতি জানাল

          ফয়জুর রহমান এমপি অবাক হয়ে গেল তার ইচ্ছা ছিল আজকে তিন ভাইকে একসাথে মিলিয়ে দেবে জহিরও তাকে সে দায়িত্ব দিয়েছিলকিন্তু শরীফতো পাত্তাই দিল না গ্রামের সব মানুষের সামনে ভাইদের বিভেদটা আরো স্পষ্ট হয়ে গেল রফিক এসে জহির চৌধুরীর পিছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, "ভাইজান, রাত হইয়া যাইতাছে"

          ওরা চারজনই সামনের কাতারে এসে দাঁড়ালো ইমাম সাহেব নামায পড়াতে শুরু করলেন মসজিদের পিছনে দাঁড়িয়ে সাবেরা আর আন্না দুজনেরই মনে হলো ভাইয়ে ভাইয়ে মিলটা এবারও ভেস্তে গেল

 

****

১৮

 

এখন মধ্যরাতেরও বেশি সারাদিনের ধকলে খাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই গভীর ঘুমে নিমগ্ন জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে অভীর ঘুম আসছে না আর 'দিন পরই অরিন চলে যাবে ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে খেলাধুলা, গল্পগুজব করে বড় হতে হতে মনের গোপন কোণে কখন যেন অরিনের জন্য একটা অন্যরকম আকর্ষণ তৈরি হয়েছে সেটা নিজেও বুঝতে পারেনি কিন্তু যেদিন শুনল অরিনকে তার বাবা আমেরিকা পাঠিয়ে দেবে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য সেদিন থেকে অভীর মন উচাটন অবস্থা কেবলই মনে হয়, অরিন যদি আর ফিরে না আসে, যদি ওখানে গিয়ে অন্য কাউকে ওর ভাল লাগে! ভুলে যায় আশৈশব খেলার সাথী অভীকে তাহলে অভী কীভাবে থাকবে? হ্যাঁ চাইলে অভী এখনই আমেরিকা যেতে পারে কিন্তু মাত্র সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে অনার্স কোর্স শেষ হতে অনেক দেরি আর মায়ের তো সেই এক কথা, গ্র্যাজুয়েশানের আগে দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না লেখাপড়ার বিষয়ে মা সবসময়েই কড়া

          "কিন্তু কতদিন অরিনকে না দেখে থাকব আমি?"- বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল সে অস্থিরতায় আক্রান্ত হয়ে বিছানায় উঠে বসল সে

          ঢালা বিছানা যে যেখানে জায়গা পেয়েছে শুয়ে পড়েছে সারাদিনের ক্লান্তিতে সবাই ঘুমে বেহুঁশ চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল বলা যায় না কে ঘুমাচ্ছে আর কে মটকা মেরে পড়ে আছে        কিছুক্ষণ স্থির থেকে একরকম হামাগুড়ি দিয়ে বিছানার বাইরে এল সে তারপর পা টিপে টিপে বারান্দায়

          টানা বারন্দায় এসে অভীর অবাক হওয়ার পালা এত চাঁদের আলো! উঠানটায় যেন আলোর বন্যা বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়েও আলো এসে আলোছায়ার এক অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে অভী কিছুক্ষণ মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকে তার কাছে মনে হয় জীবনে এই প্রথম এক অপার্থিব সৌন্দর্য দেখল সে সম্মোহিত ভাব কেটে গেলে কিছুক্ষণ পর মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে দ্রুত আঙুল চালা

          ঘুম নেই অরিনের চোখেও অনেকের মাঝে শুয়ে খুব সাবধানে এপাশ ওপাশ করতে হচ্ছে তার নড়াচড়ায় কার কখন ঘুম ভেঙে যায় অভীর কথা মনে হচ্ছে সরাসরি না বললেও ইশারা ইঙ্গিতে অনেকবার তার আমেরিকা যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে কখনও কখনও বলেছে তোর মতো একজন ট্যালেন্ট আর আগুন সুন্দরী চলে গেলে আমাদের সভাটা অন্ধকার হয়ে যাবে আবার ওখানকার শ্বেত সুন্দরীদের মাঝে তোর মতো বঙ্গীয় সুন্দরীর কোন আদরই থাকবে না অথচ দ্যাখ এখানে আমরা তোকে কত তোয়াজ করি তারপর দুষ্টুমি করে গান ধরেছে- যেওনা সাথী

          অরিন ছদ্মকোপে তাকে মারতে উঠেছে আর অন্যরা হেসে গড়াগড়ি দিয়েছে অথচ এখন এই মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে দূরে চলে যাওয়ার কথা মনে হতেই মনটা কেমন হু হু করে উঠল

          মনে হল অভীর কথা কতবার নানা ছলে নানাভাবে তাকে বিদেশ যেতে মানা করেছে বলেছে, "এখানে পড় তোর বাবাকে বল গ্র্যাজুয়েশানের পর যাবি আমিও যাব তোর সাথে বিদেশ বিভূঁইয়ে আমার বোনটাকে দেখভাল করার জন্য একজনতো লাগবে"

          অরিন রাগ দেখিয়ে বলেছে, "তোকে কে দায়িত্ব দিয়েছে আমাকে দেখভালের জন্য কী আমার গার্ডিয়ান হরিবল্‌"

          মুখে যত কথাই বলুক বাবাকে বোঝাতে কী কম চেষ্টা করেছে সে নিজে মাকে এমনকি নানীকে দিয়েও চেষ্টা করেছে যাতে আপাতত যাওয়াটা কোনভাবে বন্ধ করা যায় কিন্তু বাবা অনড়

          মোবাইলে ম্যাসেজ আসার শব্দ হতেই বালিশের নিচ থেকে বের করে বাটন টিপল অভী! অভী ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, "বারান্দায় আয় অপূর্ব চাঁদের আলো! এরকম কখনও দেখিসনি"

          "পাগল! এতরাতে বাইরে গেলে কেউ জানতে পারলে রক্ষা থাকবে! বাবা কালকেই প্লেনে তুলে দেবে"

          অরিন শুতে যায় কিন্তু শোয়া হয় না কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তি কাটিয়ে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে বাইরে এসেই সে বুঝতে পারে অভী মিথ্যে বলেনি এমন চাঁদের আলো এর আগে কখনও দেখেনি

          "ছাদে যাবি?" অভী জানতে চায়

          "How dare you! এত রাতে ছাদে! জানতে পারলে বাবা আস্ত রাখবে? তুই জানিস না রেগে গেলে বাবা কিরকম cruel হয়ে যায়"

          "কেউ জানবে না আমি দাদুকে মাটি দিয়ে এসে ছাদে গিয়েছিলাম দরজাটা খোলাই থাকে কোন তালা-টালার ব্যবস্থা নেই চল না please."

          "দ্যাখ যদি কেউ জেনে ফেলে তাহলে কিন্তু আমি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ব"

          "আমি কি বসে থাকব নাকি? তোকে ধরেই লাফ দেব একেবারে কেয়ামত সে কেয়ামত তক"

          "অভী"- ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় অরিন

          অভী তাকে একরকম টেনে নিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে আবছা আলোছায়াতে তার হাতের টানে সিঁড়ি ভাঙে অরিন সাবধানে দরজাটা ঠেলে ছাদে উঠতে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে তারা দুজন আকাশ জুড়ে এমন আলোর প্লাবন আর কখনও দেখেনি তারা

          নাগরিক জীবনে নিজেদের সাজানো আলোয় আলোকিত জৌলুসে তারা বেড়ে উঠেছে প্রকৃতির এই অপার্থিব আলোর এমন রূপ আছে একথা এই মুহূর্তের আগে অরিন জানত কি কী মনে করে দুহাত বুকের কাছে ধরে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল হয়তো কয়েক নিমেষ, কিন্তু অভীর কাছে মনে হল কতযুগ ধরে এমনি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরিন

          "কিরে লুনাটিক হয়ে গেলি নাকি?"

          অভীর কথায় তন্ময়তা ভাঙে অরিনের তারপর অভীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, “ধন্যবাদ

          "কাকে?"

          "তোকে তুই না দেখালে এত সুন্দর রাত দেখতে পেতাম! I am really spellbound.

          "এ্যাই কথায় কথায় ইংরেজি বলিস না"

            "তাহলে কী বলব?" বাঁকাচোখে অভীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অরিন

          "বল আমি মুগ্ধ বিমোহিত"

          "তোর মত অত বাংলাজ্ঞান আমার নেই"

          "থাকবে কী করে? আবার যাচ্ছিস ইয়াংকিদের দেশে যেটা জানতিস সেটা ভুলে যাবি"

          "আচ্ছা আমার আমেরিকা যাওয়া নিয়ে তুই এত displeased কেন?"

          "হ্যাঁ আমি বিরক্ত কারণ তুই চলে গেলে আমি ভীষণ একা হয়ে যাব আর honestly বল তো তোর ভাল লাগবে আমাকে ছেড়ে থাকতে? বল বল"

          আলোর প্লাবনে মুখ লুকোবার উপায় নেই তবু মুখ নিচু করে অন্ধকার তৈরি করে অরিন নিজেকে ঢাকতে চেষ্টা করে তার নীরবতা অভীকে আঘাত করে অস্থির হয়ে আবার যখন বলে, "প্লিজ অরিন বল, আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না কত চেষ্টা করেছি মনকে ভোলাতে কিন্তু মন কেবল আমাকে পোড়াচ্ছে আজ তুই যদি খুব কঠিন সত্যও বলিস আমি মেনে নেব কারণ আমি তোকে ভালবাসি"

          এতক্ষণ পর অরিন চোখ তুলল আর চাঁদের আলোয় অভী স্পষ্ট দেখতে পেল অরিন কাঁদছে

          "অরিন!" স্থান-কাল-পাত্র ভুলে অভী অরিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার দুহাত টেনে নিয়ে নিজের মুখ ঢাকল

          "আমি দুঃখিত, অরিন আমি সত্যি সত্যি দুঃখিত আমি তোকে কাঁদাতে চাইনি শুধু তোর ভালবাসা ভিক্ষা করেছি"

          "অভী ওঠ কেউ দেখলে একটা scandal হয়ে যাবে" অরিনের হাত দুটো দুহাতে ধরে রেখে উঠে দাঁড়ায় অভী

          "হাত ছাড় আচ্ছা তুই এত বোকা কেন রে? এতদিনেও আমার মন বুঝতে পারলি না silly boy."

          "হ্যাঁ প্রেমে পড়লে মানুষতো silly আর stupid হয়ে যায় এটাতো শাস্ত্রে আছে"

          "এ্যাই শাস্ত্র কী? বাংলা বই পড়িয়ে মামী দেখি তোকে মাস্টার বানিয়ে ফেলেছে"

          "বানাবে না তো কি তোর বাবার মতো আমেরিকান বানাবে?"

          "চুপ স্টুপিড তোর বাবা কী রে? বাবা তোর কী হয়?"

          "হয় না, হবে শ্বশুর আব্বা তখন বাবা ডাকতে হবে ভেবে এখন ফুপা, আঙ্কেল কিছুই ডাকি না"

          অরিনের চোখের জল শুকিয়ে সেখানে হাসির রেখা ফুটেছে অভীর খুব খুশী লাগছে শঙ্কা-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব কেটে গেছে আজ রাতটা সত্যিই অপূর্ব

          "চল ওদিকটাতে গিয়ে বসি তোদের ছাদটা এত সুন্দর বাড়িটাও তবু তোরা বাড়িতে আসিস না, আমি হলে এখানেই থাকতাম"

          "stop it. এত obsessed হলে বিপদ হবে বাংলায় কী যেন বলে- হ্যাঁ মনে পড়েছে দিবাস্বপ্ন"

          "দিবাস্বপ্ন কোথায়? এখনতো রাত আর গভীর রজনীতে স্বপ্ন দেখব না যখন পাশে তুই?"

          ওরা হাত ধরাধরি করে ছাদের মাঝখানে দোলনার কাছে যায় দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে আকাশ দেখে রাত বাড়তে থাকে কিন্তু দুটি তরুণ-তরুণীর সেদিকে খেয়াল নেই অফুরন্ত আলোর ধারা তাদের এক স্রোতে মিলিত করেছে

 

****

পর্ব ১৯-২০


No comments:

Post a Comment

Latest Post

জামাল নজরুল ইসলাম: মহাবিশ্বের নিয়তির সন্ধানে

  বিজ্ঞানজগতে বাংলাদেশের গর্ব বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও কসমোলজিতে তাঁর যুগান্তকারী অবদান রয়েছে। তাঁর মৌলিক গবেষণা...

Popular Posts