Friday, 17 April 2020

অব্যক্ত: জগদীশচন্দ্র বসু পর্ব ২১




অব্যক্ত

জগদীশচন্দ্র বসুকে বাংলা ভাষায় পপুলার সায়েন্স বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার পথিকৃৎ বলা যায়। বর্তমানকালে সাধারণত দেখা যায় যাঁরা মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণা করেন তাঁরা জনপ্রিয় বিজ্ঞান তেমন লেখেন না। বিদেশী ভাষায় কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম থাকলেও বাংলা ভাষায় সেরকম কোন উদাহরণ নেই। জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি একেবারে শিশুদের জন্যেও লিখেছেন কয়েকটি বাংলা বিজ্ঞান-রচনা। আর সাধারণ মানুষের জন্যেও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। তাছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে তিনি যে সব বাংলা বক্তৃতা দিয়েছেন সেগুলোর সাহিত্য-মূল্যও অসীম। দুই শতাধিক মৌলিক গবেষণাপত্র, চৌদ্দটি গবেষণা-গ্রন্থের বিশাল ইংরেজি রচনার পাশে সামান্য কয়েকটি বাংলা রচনা সংখ্যার দিক থেকে হয়তো বেশি নয়, কিন্তু তার গুরুত্ব অনেক। তাঁর বাংলা রচনাগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে মুকুল, দাসী, প্রবাসী, সাহিত্য, ভারতবর্ষ ইত্যাদি সাহিত্য-পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেকদিন থেকে বলে আসছিলেন সেগুলোকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার জন্য।
          ১৯২১ সালে (আশ্বিন ১৩২৮) জগদীশচন্দ্রের বাংলা রচনাগুলির সংকলন গ্রন্থ 'অব্যক্ত' প্রকাশিত হয়। অব্যক্ত'র প্রথম প্রকাশক ছিলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স, কলিকাতা। মূল্য ছিল আড়াই টাকা। ১৯৩৮ সালে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ বইটি প্রকাশ করে ভাদ্র ১৩৫৮ ও পৌষ ১৩৬৪ বাংলায়। ১৯৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মশতবার্ষিক সমিতি 'অব্যক্ত'র শতবার্ষিক সংস্করণ প্রকাশ করে পুলিন বিহারী সেনের সম্পাদনায়। বইটির দাম রাখা হয়েছিল সাড়ে তিন টাকা। ১৯৮৯ সালের জুন মাসে বসু বিজ্ঞান মন্দির অব্যক্ত'র পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশ করে। ভারত ও বাংলাদেশের আরো অনেক প্রকাশক 'অব্যক্ত' প্রকাশ করেছেন নিজেদের প্রকাশনী থেকে কপিরাইটের আওতামুক্ত হয়ে যাবার সুবাদে।
          প্রথম প্রকাশের পর বইটির রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন, "আজ জোনাকির আলো রবির প্রখর আলোর নিকট পাঠাইলাম।"
          রবীন্দ্রনাথ উত্তরে ২৪/১১/১৯২১ তারিখে লিখেছিলেন:
          "তোমার অব্যক্ত'র অনেক লেখাই আমার পূর্ব-পরিচিত এবং এগুলি পড়িয়া বার বার ভাবিয়াছি যে যদিও বিজ্ঞানবাণীকেই তুমি তোমার সুয়োরাণী করিয়াছ তবুও সাহিত্য সরস্বতী সে পদের দাবী করিতে পারিত; কেবল তোমার অনবধানেই সে অনাদৃত হইয়া আছে।"
          অব্যক্ত'র ভূমিকায় জগদীশচন্দ্র সেই ১৯২১ সালেই উল্লেখ করেছিলেন মাতৃভাষায় ভাব প্রকাশের গুরুত্ব:
            "প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে আমার বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য কয়েকটি প্রবন্ধ মাতৃভাষাতেই লিখিত হইয়াছিল। তাহার পর বিদ্যুৎ-তরঙ্গ ও জীবন সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছিলাম এবং সেই উপলক্ষে বিবিধ মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত হইয়াছি। এ বিষয়ের আদালত বিদেশে, সেখানে বাদ-প্রতিবাদ কেবল ইওরোপীয় ভাষাতেই গৃহীত হইয়া থাকে।"
          বিজ্ঞানের ভাষার আন্তর্জাতিকতা অর্থাৎ ইংরেজি ভাষাতেই যে বিজ্ঞান বিশ্ব-দরবারে গৃহীত হয় তা তাঁর কথাতে তখন থেকেই স্পষ্ট। বাংলায় যে তিনি আর বেশি লেখার সময় পাননি তার কারণ তাঁর ব্যস্ততা। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা না করতে পারাটাকে তিনি মনে করতেন, "জাতীয় জীবনের পক্ষে ইহা অপেক্ষা অপমান আর কী হইতে পারে?"
          এর প্রতিকারের জন্য তিনি দেশে বৈজ্ঞানিক আদালত স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এই শত বছর পরেও আমাদের দেশে বৈজ্ঞানিক আদালত বলে কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
          বাংলায় লেখার জন্য উৎসাহ কম ছিল না জগদীশচন্দ্রের। তাঁর ছাত্র রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন 'দাসী' ও 'প্রদীপ' নামে দুটো পত্রিকার সম্পাদক। তিনি 'প্রদীপ' পত্রিকায় নিয়মিত লেখার জন্য জগদীশচন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন। জগদীশ উত্তর দিয়েছিলেন:
            "আমি তোমার কাগজে লিখিতে পারিলে বাস্তবিকই সুখী হইতাম। কিন্তু নানা কার্যে জড়িত হইয়া আমি এখন অনেক সুখে বঞ্চিত হইয়াছি। আমি যে কার্যে বৃত হইয়াছি, তাহার কুলকিনারা দেখিতে পাই না - অনেক সময়েই কেবল অন্ধকারে ঘুরিতে হয়। বহু ব্যর্থ প্রযত্নের পর কদাচ অভীষ্টের সাক্ষাৎ পাই।"[1]
          জগদীশচন্দ্র প্রথম বাংলায় লিখতে শুরু করেন ইংল্যান্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরার পর। সঞ্জীবনী পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। ওটা ছিল অনেকটা ভ্রমণ-কাহিনির মতো। ইংল্যান্ডে ফসেট পরিবারে তিনি যে আদর-যত্ন পেয়েছিলেন তার বিবরণ।
          শিশু-কিশোরদের জন্য মাসিক সচিত্র মুকুল পত্রিকা প্রকাশিত হয় মূলত জগদীশচন্দ্রের উৎসাহে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও যোগীন্দ্রনাথ সরকার প্রকাশ করেছিলেন মুকুল। সেখানে নিয়মিত লেখার কথা ছিল জগদীশচন্দ্রের। অবলা বসুও কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেখানে। মুকুলে লেখার ব্যাপারে জগদীশচন্দ্র ১৯০০ সালের ১৬ মার্চ রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন:
          "লেখার জন্য আমার উপর বিশেষ তাড়া। আমি বলিয়াছি যদি আমার গৃহিনী আগামীবারে আমার সহিত শিলাইদহ উপস্থিত হন, তাহা হইলে যতদিন থাকিব ততদিন মুকুলের জন্য আপনার এক একটি লেখা পাইব। গৃহিনীর journalistic instinct অতিশয় প্রবল দেখিতেছি। বিশেষত শ্রীযুক্তা সরলা দেবী নির্বাপিত অগ্নিতে ইন্ধন দিয়া গিয়াছেন।"
          জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু মুকুলে যেসব প্রবন্ধ লিখেছিলেন পরে তা "প্রবন্ধাবলী" নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
          জগদীশচন্দ্রের হাতের সাহিত্য-সরস্বতীকে চিনতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভুল হবার কথা নয়। মাঝে মাঝে উচ্ছ্বাসের আধিক্য থাকলেও জগদীশচন্দ্রের বাংলা রচনায় উচ্চ-মার্গের সাহিত্যিক উপাদানের অভাব ছিল না। তাঁর সবচেয়ে যেটা আকর্ষণীয় সেটা হলো বিজ্ঞানের জটিল বিষয় সহজ করে বলা। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।
            তরঙ্গের কম্পন বা ফ্রিকোয়েন্সির সাথে মানুষের অনুভূতির সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে তিনি কত সহজ ভাবেই বলেছেন:
          "সেতারের তার যতই ছোটো করা যায়, সুর ততই চড়া হয়। যখন প্রতি সেকেন্ডে বায়ু ৩০,০০০ বার কাঁপিতে থাকে তখন কর্ণে অসহ্য অতি উচ্চসুর শোনা যায়। তার আরও ক্ষুদ্র করিলে হঠাৎ শব্দ থামিয়া যাইবে। তখনও তার কাঁপিতে থাকিবে, তরঙ্গ উদ্ভুত হইবে; কিন্তু এই উচ্চ সুর আর কর্ণে ধ্বনি উৎপাদন করিবে না।"
          তাপ ও আলোর সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে বলেছেন:
          "যে স্পন্দন ত্বক দ্বারা অনুভব করি তাহার নাম উত্তাপ; আর যে কম্পনে দর্শনেন্দ্রিয় উত্তেজিত হয় তাহাকে আলোক বলিয়া থাকি।"
          একেবারে শিশুদের জন্য কী সহজভাবে তিনি বুঝিয়েছেন 'গাছের কথা' প্রবন্ধে গাছের জীবনের কথা: 
          "জীবিত বস্তুতে গতি দেখা যায়; জীবিত বস্তু বাড়িয়া থাকে। কেবল ডিমে জীবনের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। ডিমে জীবন ঘুমাইয়া থাকে। উত্তাপ পাইলে ডিম হইতে পাখির ছানা জন্মলাভ করে। বীজগুলি যেন গাছের ডিম; বীজের মধ্যেও এরূপ গাছের শিশু ঘুমাইয়া থাকে। মাটি, উত্তাপ ও জল পাইলে বীজ হইতে বৃক্ষশিশুর জন্ম হয়।"
          উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু প্রবন্ধে লিখেছেন:
          "আমরা যেরূপ আহার করি, গাছও সেইরূপ আহার করে। আমাদের দাঁত আছে, আমরা কঠিন জিনিস খাইতে পারি। ছোটো ছোটো শিশুদের দাঁত নাই; তাহার কেবল দুধ খায়। গাছেরও দাঁত নাই, সুতরাং তাহারা কেবল জলীয় দ্রব্য কিংবা বাতাস হইতে আহার গ্রহণ করিতে পারে। মূল দ্বারা মাটি হইতে গাছ রস শোষণ করে। চিনিতে জল ঢালিলে চিনি গলিয়া যায়। মাটিতে জল ঢালিলে মাটির ভিতরের অনেক জিনিস গলিয়া যায়। গাছ সেই সব জিনিস আহার করে। গাছের গোড়ায় জল না দিলে গাছের আহার বন্ধ হইয়া যায়, ও গাছ মরিয়া যায়।"
          শিশুদের জন্য এরচেয়ে সরলভাবে বিজ্ঞান বোঝানো কি সম্ভব? তবে মাঝে মাঝে অতিসরলীকরণের ফলে কিছু কিছু ব্যাপার দুর্বোধ্য হয়ে গেছে যা শিশুদের ভুল তথ্য দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যেমন 'উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু' প্রবন্ধের এক জায়গায় আছে:
          "গাছের শরীরে সূর্যের কিরণ আবদ্ধ হইয়া আছে। কাঠে আগুন ধরাইয়া দিলে যে আলো ও তাপ বাহির হয়, তাহা সূর্যেরই তেজ। গাছ ও তাহার শস্য আলো ধরিবার ফাঁদ। জন্তুরা গাছ খাইয়া প্রাণ ধারণ করে, গাছে যে সূর্যের তেজ আছে তাহা এই প্রকারে আবার জন্তুর শরীরে প্রবেশ করে। শস্য আহার না করিলে আমরাও বাঁচিতে পারিতাম না। ভাবিয়া দেখিতে গেলে, আমরাও আলো আহার করিয়া বাঁচিয়া আছি।"
          এখান থেকে শিশুরা আলো ও শক্তি সম্পর্কে ভুলতথ্য পাবে - জগদীশচন্দ্র তা নিশ্চয় চাননি। বিজ্ঞানে অতিসরলীকরণের এটাই বিপদ।
          জগদীশচন্দ্রের বাংলা-বিজ্ঞান-রচনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো তাঁর কৌতুকপ্রিয়তা। তাঁর সেন্স অব হিউমার সত্যিই চমৎকার। 'অদৃশ্য আলোক' রচনা থেকে দুটো উদাহরণ দেয়া যাক।
            হীরা ও চীনা-বাসনের আলো শোষণ ও প্রতিসরণ করা প্রসঙ্গে হীরার মূল্য ও চীনা-বাসনের মূল্যের বর্তমান পার্থক্য সম্পর্কে বর্তমানে হীরার উচ্চমূল্যের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি লিখছেন:
            "প্রথমবার বিলাত যাইবার সময় অত্যন্ত কুসংস্কার হেতু চীনাবাসন স্পর্শ করিতে ঘৃণা হইত। বিলাতে সম্ভ্রান্ত ভবনে নিমন্ত্রিত হইয়া দেখিলাম যে, দেওয়ালে বহুবিধ চীনা-বাসন সাজানো রহিয়াছে। ইহার এমন কি মূল্য যে, এত যত্ন? প্রথমে বুঝিতে পারি নাই, এখন বুঝিয়াছি ইংরেজ ব্যবসাদার। অদৃশ্য আলো দৃশ্য হইলে চীনা-বাসন অমূল্য হইয়া যাইবে। তখন তাহার তুলনায় হীরক কোথায় লাগে! সেদিন শৌখিন রমণীগণ হীরকমালা প্রত্যাখ্যান করিয়া পেয়ালা-পিরিচের মালা সগর্বে পরিধান করিবেন এবং অচীনধারিণী নারীদিগকে অবজ্ঞার চক্ষে দেখিবেন।"
          আলোর পোলারাইজেশান বা একমুখীকরণ সম্পর্কিত অনেক পরীক্ষা করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। পাটের আঁশের ভেতর আলো একদিকে প্রবেশ করিয়ে অন্য দিক দিয়ে বের হবার সময় খেয়াল করেছেন যে পোলারাইজেশান হচ্ছে। মানূষের চুল নিয়েও এরকম পরীক্ষা করেছিলেন বিলাতে গিয়ে। তার বর্ণনা দিচ্ছেন তিনি:
            "আলো একমুখী করিবার অন্য এক উপায় আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। যদিও এলোমেলোভাবে আকাশ-স্পন্দন রমণীর কেশগুচ্ছে প্রবেশ করে, তথাপি বাহির হইবার সময় একেবার শৃঙ্খলিত হইয়া থাকে। বিলাতের নরসুন্দরদের দোকান হইতে বহু জাতির কেশগুচ্ছ সংগ্রহ করিয়াছিলাম। তাহার মধ্যে ফরাসী মহিলার নিবিড় কৃষ্ণকুন্তল বিশেষ কার্যকরী। এ বিষয়ে জার্মান মহিলার স্বর্ণাভ কুন্তল অনেকাংশে হীন। প্যারিসে যখন এই পরীক্ষা দেখাই তখন সমবেত ফরাসী পন্ডিতমন্ডলী এই নতুন তত্ত্ব দেখিয়া উল্লসিত হইয়াছিলেন। ইহাতে বৈরী জাতির উপর তাহাদের প্রাধান্য প্রমাণিত হইয়াছে, ইহার কোন সন্দেহই রহিল না। বলা বাহুল্য, বার্লিনে এই পরীক্ষা প্রদর্শনে বিরত হইয়াছিলাম।"
          এখানে এটাও উল্লেখ করা দরকার যে আলোর পোলারাইজেশান প্রক্রিয়ার যে সহজ ব্যাখ্যা জগদীশচন্দ্র দিয়েছেন বাংলা ভাষায় এর চেয়ে প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা এ-পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি। ব্যাখ্যাটা তিনি দিয়েছেন 'বক-কচ্ছপ সংবাদ' নামে একটি গল্পের মাধ্যমে।
         


"মনে কর, দুই দল জন্তু মাঠে চরিতেছে- লম্বা জানোয়ার বক ও চেপ্‌টা জীব কচ্ছপ। সর্বমুখী অদৃশ্য আলোকও এইরূপ দুই প্রকারের স্পন্দনসঞ্জাত। দুই প্রকারের জীবদিগকে বাছিবার সহজ উপায়, সম্মুখে লোহার গরাদ খাড়াভাবে রাখিয়া দেওয়া। জন্তুদিগকে তাড়া করিলে লম্বা বক সহজেই পার হইয়া যাইবে, কিন্তু চেপ্‌টা কচ্ছপ গরাদের এ-পাশে থাকিবে। প্রথম বাধা পার হইবার পর বকবৃন্দের সম্মুখে যদি দ্বিতীয় গরাদ সমান্তরালভাবে ধরা যায়, তাহা হইলেও বক তাহা দিয়া গলিয়া যাইবে। কিন্তু দ্বিতীয় গরাদখানাকে যদি আড়ভাবে ধরা যায়, তাহা হইলে বক আটকাইয়া থাকিবে। এইরূপে গরাদ অদৃশ্য আলোর সম্মুখে ধরিলে আলো একমুখী হইবে। দ্বিতীয় গরাদ সমান্তরালভাবে ধরিলে আলো উহার ভিতর দিয়াও যাইবে, তখন দ্বিতীয় গরাদটা আলোর পক্ষে স্বচ্ছ হইবে। কিন্তু দ্বিতীয় গরাদটা আড়ভাবে ধরিলে আলো যাইতে পারিবে না, তখন গরাদটা অস্বচ্ছ বলিয়া মনে হইবে। যদি আলো একমুখী হয় তাহা হইলে কোনো কোনো বস্তু একভাবে ধরিলে অস্বচ্ছ হইবে; কিন্তু ৯০ ডিগ্রি ঘুরাইয়া ধরিলে তাহার ভিতর দিয়া আলো যাইতে পারিবে।"
          বাংলা ভাষায় প্রথম বৈজ্ঞানিক রহস্য লেখার কৃতিত্বও জগদীশচন্দ্র বসুকে দেয়া যায়। তাঁর লেখা কল্পকাহিনী 'নিরুদ্দেশের কাহিনী' 'কুন্তলীন পুরষ্কার' প্রবর্তনের প্রথম বছর প্রথম পুরষ্কার পায়। এটার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে।             বাংলা সাহিত্যে এইচ বোস প্রবর্তিত কুন্তলীন পুরষ্কার একটা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এক সময়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবাই কুন্তলীন পুরষ্কারের জন্য গল্প লিখেছিলেন বিভিন্ন সময়ে। এর প্রবর্তক এইচ বোসের পুরো নাম হেমেন্দ্র মোহন বসু। ব্যক্তিগত সম্পর্কে তিনি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগনে।
            জগদীশচন্দ্রের দিদি স্বর্ণপ্রভার স্বামী আনন্দমোহন বসু ও ছোটবোন সুবর্ণপ্রভার স্বামী মোহিনীমোহন বসুর দাদা  হরমোহন বসুর ছেলে হেমেন্দ্রমোহন বসু। হরমোহন বসু বিলাত থেকে উচ্চশিক্ষিত হয়ে দেশে ফিরে এসে ময়মনসিংহে মোক্তারি করতেন। তাঁর ছেলে হেমেন্দ্রমোহন ছিলেন আরো করিৎকর্মা।
            তিনি ভারতে অনেক নতুন শিল্পের সূচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতায় পারফিউম তৈরির অগ্রদূত। তাঁর একটি বিখ্যাত পারফিউম ছিল 'দেলখোস'। চুলের সুগন্ধী তেল আবিষ্কার করে নাম দিয়েছিলেন 'কুন্তলীন'। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম পানের মশলা বাজারজাত করেন তিনি। সেই মশলার নাম ছিল 'তাম্বুলিন'। এগুলির বাজারজাত করার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে বিজ্ঞাপন লিখিয়ে নিয়েছিলেন:
"কেশে মাখ "কুন্তলীন"।
রুমালেতে "দেলখোস"।।
পানে খাও "তাম্বুলীন"।
ধন্য হোক এইচ্‌ বোস।।"
রবীন্দ্রনাথের নামে আরেকটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো:
          "কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নূতন কেশ হইয়াছে।"
            এইচ বোস ভারতে প্রথম সাইকেল ও মোটর গাড়ির ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। ভয়েস রেকর্ডিং বা শব্দ গ্রাহক যন্ত্রের বাণিজ্যিক প্রসারে এইচ বোসের অবদান অনেক। ১৯০৫ সালে তিনি ফনোগ্রাফের ব্যবসা শুরু করেন। ধর্মতলা স্ট্রিটে "দি টকিং মেশিন হল" স্থাপন করেন তিনি।


এইচ বোসের বিজ্ঞাপন


বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনের সময় ১৯০৬ সালে তিনি প্রথম ফনোগ্রাফিক রেকর্ড যা সেই সময় সিলিন্ডার রেকর্ড নামে পরিচিত ছিল - বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করেন। "এইচ বোসের রেকর্ড" নামে পরিচিত সেই রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গান রেকর্ড করেছিলেন। "সার্থক জনম আমার", "এবার তোর ভরা গাঙে", "ও আমার দেশের মাটি", "আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে" এইচ বোসের রেকর্ডে প্রথম বাজারে এসেছিল। ১৯০৬ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিবিশান অব ক্যালকাটায় এইচ বোসের ফনোগ্রাফিক রেকর্ড স্বর্ণপদক লাভ করে। উল্লেখ্য সেখানে প্রধান বিচারক ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। সিলিন্ডার রেকর্ড থেকে ডিস্ক রেকর্ডের উত্তরণেও এইচ বোস অগ্রদূত ছিলেন।[2]
          কুন্তলীন তেলের প্রচারের উদ্দেশ্যেই ১৩০৩ বাংলায় (১৯০৬ ইংরেজি) চালু হয়েছিল কুন্তলীন পুরষ্কার। গল্পগুলির জন্য শর্ত ছিল যে গল্পে কুন্তলীন তেলের উল্লেখ থাকতে হবে। প্রথম বারেই 'নিরুদ্দেশের কাহিনী' নামে একটি কল্প-গল্প লিখে পাঠান জগদীশচন্দ্র। স্বজনপ্রীতি এড়ানোর জন্য তিনি গল্পে লেখকের নাম উল্লেখ করেননি; এবং সাথে একটা কাগজে লিখিত অনুরোধ করেছিলেন যদি গল্পটি পুরষ্কার পায়, তবে যেন সেই টাকা ব্রাহ্ম সমাজের অন্তর্গত রবিবাসরীয় নীতিবিদ্যালয়ে দান করা হয়। জগদীশচন্দ্রের গল্পটি প্রথম পুরষ্কার পায়। ওটা যে তাঁর গল্প ছিল তা অনেক বছর পর্যন্ত কেউ জানতেই পারেনি। 'অব্যক্ত' প্রকাশিত হবার পর দেখা গেলো গল্পটি অনেক পরিবর্তিত হয়ে 'পলাতক তুফান' নামে সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
          'নিরুদ্দেশের যাত্রা' কিংবা 'পলাতক তুফান' গল্পটিকে সার্থক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বলা যায় কি না তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবে বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ছিল নিঃসন্দেহে - বঙ্গোপসাগরে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর ঘূর্ণিঝড় আসার ঠিক কয়েক মিনিট আগেই ঘূর্ণিঝড়টি উধাও হয়ে যায়। কেন কীভাবে কোথায় যায় তা কেউ বলতে পারে না। সবাই বিজ্ঞানকে দোষ দিতে থাকে। বলতে থাকে আবহাওয়া দপ্তরের অকর্মণ্যতা ইত্যাদি। কিন্তু আসল ঘটনা হলো তখন বঙ্গোপসাগরে একটি জাহাজ চলছিলো এবং সেই জাহাজের একজন যাত্রীর ব্যাগে এক শিশি কুন্তলীন তেল ছিল। তিনি শিশির সব তেল সমুদ্রের ঘূর্ণিঝড়ের প্রকাণ্ড ঢেউয়ের ওপর ঢেলে দেন। এই এক শিশি কুন্তলীন তেলেই সমুদ্র শান্ত হয়ে যায়।  
          অব্যক্ত গ্রন্থের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো জগদীশচন্দ্রের বাংলা বক্তৃতাগুলি। বিশেষ করে বিজ্ঞান-মন্দির উদ্বোধনের দিন তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেটা এখনো যে কোন বাঙালির জন্য অনুপ্রেরণা।



[1] রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ, মাঘ ১৩০৪।
[2] Amitabha Ghosh, Indian Journal of History of Science, 29 (1), 1994.



No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts