_____________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - বোধন ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯
গল্প - দহন
__________________________
দহন
¾ আলমগীর!
¾ যাই ভাইজান।
দোকানের পিছন দিকে ডাঁই করে রাখা বইয়ের স্তূপ থেকে সাড়া দেয় আলমগীর।
¾ কী করস অইখানে?
সারাদিন ভূতের মতন অইখানে কী খুঁজস? আয় বাইরে আয়। কাস্টমার আসার সময় অইছে।
এখন বিকেল। বইপাড়া সারাটা দুপুর নির্জন থাকে। বইয়ের দোকানী আর
মালিকরা তখন কেউ ঘুমিয়ে নেয়, কেউ অন্য দোকানে গিয়ে আড্ডা দেয়। তারপর বিকেল থেকে
ব্যস্ততা বাড়ে।
আলমগীর ঘুমোয় না। কারো সঙ্গে আড্ডাও দেয় না। আর দেবেই বা কার
সঙ্গে। এখানে তার বয়সী আর কেউ নেই। বই কিনতে বাবা-মার সাথে মাঝে মাঝে কিছু
ছেলে-মেয়ে আসে তার বয়সী। কিন্তু তারা তো আসে আর যায়। কেউ দু’একটা বই নাড়াচাড়া করে। কেউ মায়ের কাছে বায়না ধরে
নতুন বই কিনে দেবার জন্য। ওরা যখন দোকানে আসে, কথা বলে, বই খুলে দেখে তখন আলমগীরের
মনে হয় সে স্বপ্নে কোন দৃশ্য দেখছে। কী সুন্দর করে কথা বলে ওরা। সে হা করে তাকিয়ে
থাকে। ভুলে যায় কী করতে হবে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে বকুনি আর ধমক খেতে হয় আরিফ ভাইয়ের
কাছে। হ্যাঁ, আরিফ ভাইই তো তাকে নিয়ে এসেছে। চাকরিটা দিয়েছে মালিককে বলে কয়ে।
আরিফ ভাই ওদের গ্রামের ছেলে। সম্পর্কে মায়ের বোনের ছেলে। বাবা
মারা যাওয়ার পর মা যখন পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছিলেন না তখন বাড়িতে গেলে আরিফ
ভাইকে ধরেছিলেন শহরে নিয়ে একটা কাজ জুটিয়ে দিতে। পরের বার বাড়ি গিয়ে আরিফ ভাই তাকে
নিয়ে এসেছিল।
মাত্র ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছিল
সে। মাকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করেনি। ছোট ভাই-বোন দুটোকেও। সব থেকে বেশি খারাপ লেগেছিল
আর স্কুলে যেতে পারবে না বলে। পড়তে খুব ভাল লাগতো তার। এক বই কতবার করে পড়ত বলেই
না নিজে নিজে পাশ করে প্রাইমারি স্কুল ডিঙিয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। বাবা বলতেন¾ যত কষ্টই হোক, আমার
আলমগীরের পড়ার যখন এত্তো শখ, সে শখ আমি পুরা করুম। হায়¾ বাবার মৃত্যু
আলমগীরকে ঘরছাড়া করে এই বইয়ের দোকানে চাকরি দিল। এত কষ্টের মাঝেও এই একটা বিষয়
আলমগীরের ভাল লাগে। এখানে বই আছে। বই দেখতে ভাল লাগে। আর দুপুর বেলা যখনই সময় পায়
তখনই সে বই খুলে বসে।
গত এক বছরে অনেকগুলো বই পড়েছে আলমগীর।
সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছে হুমায়ূন আহমেদ নামে একজনের ‘বোতল
ভূত’ বইটা পড়ে। হুমায়ূন নাকি ভূত পোষে! পড়ে একা একাই
অনেক হেসেছিল আলমগীর। আজকের বইটাও মজার। একজন অদ্ভুত বিজ্ঞানী সফদর আলীর কান্ড
কারখানা। সত্যিই কি পৃথিবীতে এত মজার মানুষ আছে? জাফর ইকবাল কি সত্যি সত্যিই সফদর
আলীর জন্য বাঁদর নিয়ে গিয়েছিলেন? কই¾ আলমগীর তো তার চারপাশে কখনো
এরকম একজন মানুষও দেখেনি। তাছাড়া নিজের দুঃখিনী মা আর আত্মীয়-স্বজন ছাড়া আর কাকেই
বা দেখেছে।
রাস্তার কল থেকে হাতমুখ ধুয়ে আরিফের
সামনে এসে দাঁড়ায় আলমগীর।
¾
চা আনুম ভাইজান?
¾
হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যা দুই কাপ চা নিয়া আয় আর দুইটা সিঙাড়া।
বিকেলে এই সময় প্রতিদিন তারা চা খায়। এই
চা-সিঙাড়ার টাকাটা আরিফই দেয়। আলমগীরকে দিতে দেয় না। আরিফ ভাই অনেক দিন থেকে এই
দোকানে আছে। মালিক তাকে খুব বিশ্বাস করে। এখানে থেকেই আরিফ ভাই উন্মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এস-এস-সি ও এইচ-এস-সি পাশ করেছে। এখন নাকি বি-এ পরীক্ষা দেবে।
আরিফ ভাই তাকে বলেছে ¾ তুই যদি ভাল করে থাকস তাইলে তোরেও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি কইরা দিমু। এসএসসি পাশ করবি। তবে তার আগে মালিকেরে কাম কইরা খুশি করন লাগব।
আলমগীর
তো তাই চায়। ভাল কাজ করে মালিককে খুশি করে যাতে তিনি তাকে লেখাপড়ার সুযোগ দেন। খুব
স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হয়ে আলমগীর বাড়ি যাবে। মাকে
বলবে¾ মা, আমি আমার বাবার আশা পূরণ করেছি। তারপর খুব বড়
একটা চাকরি হবে। ছোট বোনটাকেও পড়াতে পারবে। আজকাল মেয়েরা লেখাপড়া শিখে চাকরি করে।
এখানে অনেক মেয়ে আসে। আরিফ ভাই বলেছে তারা অনেকে নাকি বড় বড়
অফিসার। কিন্তু আলমগীরের সবচেয়ে ভাল লাগে মিলি আপাকে। উনি নাকি একটা কলেজে পড়ান।
যখনই আসেন অনেকক্ষণ ধরে বই দেখেন। পাতা উল্টে পড়ে যান আর তখন তাকে দেখে মনে হয় তার
চারপাশে যে একটা দুনিয়া আছে উনি তা ভুলেই যান। যাওয়ার সময়ও কী সুন্দর করে বলে যান।
যেদিন বেশি বই কেনেন, সেদিন আরিফ ভাইয়ের হুকুমে আলমগীর বইগুলো গাড়ি পর্যন্ত বয়ে
নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ব্যাগ থেকে একটা লজেন্স বের করে আপা দেন। আবার কী সুন্দর করে
হেসে হেসে বলেন,
¾ তোমাকে কষ্ট দিলাম।
আসি।
¾ আবার কবে আইবেন আফা?
আলমগীর জিজ্ঞেস করে।
¾
আসব। আসব। এ বইগুলো পড়া হলে আবার আসব।
বলতে বলতে গাড়ি ছেড়ে দেয়। আলমগীর
দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত গাড়িটা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে না যায়।
¾
কি রে, কী এত ভাবতাছস? এমুন হইলে চলব?
আরিফ ভাইয়ের কথায় চমকে ওঠে আলমগীর।
ভাবতে ভাবতে এতক্ষণ সে বই গোছাতে ভুলেই গিয়েছিল। কাল সন্ধ্যায় একটা পার্টি এসেছিল।
একটা স্কুলে নাকি কী প্রতিযোগিতা হয়েছে। ওরা ওদের ছাত্র-ছাত্রীদের বই দেবে।
প্রাইজ। সারা সন্ধ্যা প্রচন্ড গরমে ঘেমে নেয়ে তিনজন স্যার আর আপা অনেকগুলো বই
বাছাই করে রেখে গেছেন। সেগুলো আজকের মধ্যে লিস্ট মিলিয়ে প্যাকেট করে রাখতে হবে।
আলমগীর
একপাশে ডাঁই করা বইগুলো গোছানোতে মন দেয়। একেকটা বই নেড়ে চেড়ে খুলে দেখে। ছোটদের
বইগুলোতে কী সুন্দর ছবি আর সাথে গল্প। এসব বই বেশির ভাগই তার পড়া। হঠাৎ
একটা বইয়ের মলাটে চোখ পড়ে। আরে! এই বইটাতো পড়া হয়নি! এটা মনে হয় পাশের দোকান থেকে
এনে দিয়েছে। বইটা উল্টে পাল্টে আরেকবার দেখল আলমগীর। নামটাও কেমন খটোমটো- ডন
কুইকসোট। ছবি দেখে মনে হচ্ছে লোকটা বিদেশী। বইটার পাতা উল্টাতে উল্টাতে কিছু লেখা
আর ছবি দেখে নিল আলমগীর। মনে হল বেশ মজার বইটি। আলমগীর লোভ সামলাতে পারল না। বইয়ের
প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ রাখল। দু’পাতা
পড়েই দোকানে লোকের শব্দশুনে তাকালো আলমগীর। একজন লোক এসেছে। হয়তো বই কিনতে। এখনই
হাঁক মারবে আরিফ ভাই।
ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে ক্যাশ-এ বসে থাকা আরিফ ভাইকে দেখে সে। না,
এদিকে নয়। আরিফ ভাই সামনে তাকিয়ে লোকটার সঙ্গে কথা বলছেন। টাল থেকে আস্তে করে টেনে
নেয় বইটা। আজ রাতে পড়ে কাল সকালে বইটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখবে। নাহলে হিসেবের বই
একটা এদিক ওদিক হলে আরিফ ভাই আস্ত রাখবে না। আর মালিকও বিশ্বাস করবে না।
অনেক রাত পর্যন্ত বই বিক্রি চলে। এখন বছরের শুরু। নতুন ক্লাসে
নতুন বই। আবার কত প্রতিযোগিতা হয় স্কুলে
কলেজে। সেসব প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার দেয়া হয় বই। সারা সন্ধ্যা বই গুছিয়ে, বই
খুঁজে দিতে দিতে ব্যস্ত সময় কাটে আলমগীরের। কিন্তু সারাক্ষণই মন পড়ে থাকে শেল্ফের
নিচে ঠেলে দেয়া বইটার দিকে।
রাতে বিছানায় শুয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে আলমগীর। একসময় রাস্তায়
শব্দ কমে আসে। রিক্সার টুং টাং শব্দও পাওয়া যায় না। আলমগীর বুঝতে চেষ্টা করে আরিফ
ভাই ঘুমিয়েছে কি না। এক সময় নিশ্চিত হয়। হাতড়ে হাতড়ে মোমবাতি আর দেশলাই বের করে
আনে ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে। তারপর বাতি জ্বালিয়ে বইটা টেনে বের করে বালিশের নিচ
থেকে। মশা ভন্ ভন করছে। হাত দিয়ে মারারও উপায় নেই। যদি আরিফ ভাই জেগে উঠে তাহলে
তাকে ফাঁকি দিয়ে আলমগীর যে বই পড়ে এটা গোপন থাকবে না। বিশ্বাস নষ্ট হবে। আলমগীর
বিশ্বাস নষ্ট করতে চায় না। শুধু বই পড়তে চায়।
এই এক বছর বই পড়তে পড়তে আরো বইয়ের পোকা হয়ে গেছে সে। আরিফ ভাই
যদি টের পায় তাকে ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলা বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ে তাহলে কাল সকালেই বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। আজ এই বইটা
লুকিয়ে আনতে কি কম কষ্ট হয়েছে! জামার ভেতরে সারাক্ষণ একটা হাত চালাকি করে বুকের
ওপর রাখতে হয়েছে।
বইয়ের পাতা ওল্টায় আরিফ। তারপর একসময় পড়ায় মগ্ন হয়ে যায়। মনে
হয় সেও যাচ্ছে অনেক দূরের দেশে ডন কুইক্সোটের সাথে সাথে। হাতের উপর একটা মশা কামড়
দিতে তন্ময়তা ভাঙ্গে আলমগীরের। বিরক্ত হয়ে অন্য হাতে চাপড় দিতে যায়। আলমগীরের হাত
লেগে মোমবাতিটা ছিঁটকে পড়ে মশারির প্রান্তে।
ঘরে তীব্র আলো। আশে পাশে মানুষ জমা হয়েছে। বাইরে চিৎকার। কিন্তু আলমগীর
কেন চোখে দেখতে পাচ্ছে না? বইটা কি তার পড়া হবে না?
No comments:
Post a Comment