রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - রুবার গল্প
__________________________________________
রুবার গল্প
সকালে ঘুম থেকে আজ একটু
তাড়াতাড়িই উঠল রুবা। অন্যদিন আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে এপাশ ওপাশ করে। তারপর
রান্নাঘরে মায়ের সাড়া পেলে উঠে পড়ে। নাস্তা বানাতে মায়ের সাথে হাত লাগায়। তারপর
বাবা এবং ভাই-বোন দুটো বেরিয়ে যেতে ঘরদোর গোছায়। একসময় সেটাও শেষ হয়।
সারাদিন আর তেমন কিছু করার থাকে না। বুয়া আসে। মা-কে সে-ই
সাহায্য করে। রুবা ক্যাসেট প্লেয়ারটা চালিয়ে কখনো গান শোনার চেষ্টা করে। কখনো
পত্রিকা এলে খুঁজতে লেগে যায় কর্মখালি বিজ্ঞাপন। এর ফাঁকে ফাঁকে মনের কোণে জমে ওঠে
অভিমানের মেঘ। কখনো বাথরুমে মুখ ধুতে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে মেঘ ঝরিয়ে
দেয়।
এছাড়া আর কী-ই বা করার আছে রুবার? মনে মনে রাগ আর অভিমানের ঝড়
তারপর জলোচ্ছ্বাস - অশ্রুর বন্যা। এই তো গত একবছরের রুবার জীবন।
এর মাঝে কিছুদিন তবু
স্বস্তি ছিল যতদিন চাকরিটা ছিল। একটা এন-জি-ওতে অস্থায়ী চাকরি। এম-এ পরীক্ষা দেয়ার
পর পরই এক বন্ধুর মাধ্যমে চাকরিটা পেয়েছিল। ছ’মাসের
কন্ট্রাক্ট - তারপর প্রায় আট মাস করেছিল। প্রজেক্ট শেষ হবার পর গত দু’মাস বাসায় কাটাতে হচ্ছে। অথচ প্রায় চার মাস হতে
চললো শিহাব একরকম লা-পাত্তা।
অভিমানে দুঃখে রুবার চোখে আবারও জল আসতে চায়। আশ্চর্য এই
মানুষটাই রুবার কৈশোর থেকে তাকে পেতে চেয়েছে। তার দুর্বার চাওয়ার কাছে রুবাকে শেষ
পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে। তার জেদের কারণে মা-বাবাকেও মেনে নিতে হয়েছে। আর মানবে
না কেন? রুবাতো ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে মা-মরা ভাইয়ের ছেলেটার ওপর মায়ের প্রচন্ড
দুর্বলতা। পরে জেনেছিল মামী মায়ের বান্ধবী ছিল।
শিহাব ছোটবেলা থেকেই দুর্দান্ত। অল্প
বয়সে ভালবাসার মানুষকে হারিয়ে মামাও ছেলের প্রতি দুর্বল ছিলেন। সবার এ দুর্বলতাই
তাকে দিন দিন দুরন্ত করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত মামা ওকে হোস্টেলে পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন। একদিন মারামারি করে সেখান থেকেও পালিয়েছিল। আর পালিয়ে যাবে কোথায়?
সরাসরি রুবাদের বাসায়। ফুপুর কাছে সাত খুন মাফ।
তারপর কলেজে উঠতে কিশোরী
রুবার পেছনে লাগল। চুল টেনে মুখটাকে উল্টে ধরে একই প্রশ্ন - "বল্ তুই আমাকে
ভালবাসিস কি না?"
রুবা ব্যথা পেয়ে বেনী ছাড়াতে গেছে। চোখ তার তখন ছলছল। তবু
উত্তর দিয়েছে - "জোর করে ভালবাসা যায় নাকি?"
"যায় যায়। আমি তোকে বাসি, তাহলে তুই কেন আমাকে ভালবাসবি
না? আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসলে তোকে আমি খুন করে ফেলব না! তুই আমার - শুধু
আমার।" - দারুণ একটা ঝাঁকি দিয়ে বিনুনীটা ছাড়ত।
ঘটনাটা মনে পড়লে এখনো রুবার যেন চুলে টান পড়ে। আশ্চর্য, এই
জোর করে করেই মানুষটা তাকে সত্যি সত্যি জয় করে নিল। মায়ের দুর্বলতা রুবাতেও
সংক্রামিত হল। একসময় রুবা অনুভব করল - দস্যুটাকে ছাড়া আর কাউকে আপন ভাবতে পারছে
না।
তারপর এম-এ পরীক্ষা দেয়ার আগেই জেদ ধরে বিয়েটা করে ছাড়ল। রুবা
কত করে বলল, বিয়ের পরে দায়িত্ব বেড়ে যায়, তুমি আগে পড়াশোনা শেষ করো তারপর বিয়ে।
কিন্তু তার এক কথা - "আমি আগে বিয়ে করব। পড়াশোনা করতে আমার ভাল লাগে না। আমি
অনেক টাকা আয় করতে চাই। বুঝলি? বাবাকে তো দেখলাম, সারাজীবন একগাদা বইয়ে মুখ গুঁজে
পড়ে রইলেন। তাতে হলটা কী? দেশের কোন্ উন্নতিটা হয়েছে আর ওনারই বা কি এমন দশটা
হাত-পা গজিয়েছে? তার চেয়ে ব্যবসা করে টাকা আয় করলে অনেক তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া যায়।
আমি ধনী হব - গাড়ি থাকবে, বাড়ি থাকবে। রাজার হালে থাকব, আর তুই আমার রাণী।"
বলে রুবার গালে আকস্মিক একটা টোকা মারত।
রুবা মুখ সরাতে সরাতে রেগে যেত - "তোমার এসব কথা শুনতে
আমার ভাল লাগে না, যাও।"
"কোথায় যাব? তোকে রেখে কোথাও যাব না। যেতে হয় এক সঙ্গে
যাব।"
এভাবে জোর করে বলতে বলতে
সত্যি একদিন রুবার মনটা জুড়ে বসল। আর এখন লোকটার পাত্তাই নেই।
বিয়ের পরই রুবা
লক্ষ্য করেছে আগের চেয়েও অস্থির শিহাব। হয়তো আগেও ছিল - এতটা কাছে আসেনি বলে তখন
বুঝতে পারে নি। হঠাৎ করেই এসে হাজির হত। দু’চারদিন
থাকত। রুবাকে নিয়ে দুরন্তপনা, হুল্লোড়, মাতামাতি। তারপর আবার চলে গেলে কিছুদিন কোন
খবরই নেই। জিজ্ঞেস করলে বলতো - "ব্যস্ত আছি। বিয়ে করেছি, টাকা কামাতে হবে না?
আর কিছুদিন অপেক্ষা কর, তারপর তোমাকে নিয়ে তুলব আমার প্রাসাদে।"
রুবা আপত্তি করত - "কেন তোমাদের পুরনো বাসাটা মন্দ কী? তাছাড়া
আমরা অন্য বাসায় গেলে মামাকে দেখবে কে?"
"ওসব জানি না। আমি শুধু তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই।"
তবু ভাল বিয়ের রাতে তুই-টা তুমিতে এসে ঠেকেছিল। রুবার তো মনে
হয়েছিল বাসর রাতেও লোকটা তাকে বলবে, "এই ঘোমটা দিয়ে বসে আছিস কেন? খোল্।"
এমনি করেই তো আসত যেতো। হঠাৎ হাওয়ার মত।
রুবার চাকরিটা ও পছন্দ
করেনি। কিন্তু রুবা লজ্জায় বলতে পারে নি - পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে, বিয়ে হয়েছে, এখন
বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাইতে বাধে। আবার শিহাবের কাছেও চাইতে পারে না। তাছাড়া শিহাব
তাকে দিয়েছেই বা কী? যখনই এসেছে তখনই শুধু বলেছে - "আর ক’টা দিন অপেক্ষা কর। ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে যাক, তারপরই
তোমাকে নিয়ে যাব।"
কিন্তু কী ব্যবসা, কিসের ব্যবসা? জিজ্ঞেস করলে সব সময় এড়িয়ে
গেছে। বলেছে, "সারপ্রাইজ দেব। জানার সময় হলেই জানতে পারবে। রাজপ্রাসাদ বানিয়ে
দেব তোমাকে।"
বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় দু’বছর
হতে চললো অথচ রুবার প্রাসাদ তো দূরে থাক, কুঁড়েঘরও হল না। মামার সঙ্গে কথা বলেও
কিছু জানা যায় না। বাবা ছেলেতে কেমন একটা দূরত্ব।
বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি মামাও চাননি। তাই বলে ছেলের ওপর অভিমান
করে রুবাকে কষ্ট দেয়া কেন? মা-বাবাও রুবার কষ্টের ভয়ে চুপচাপ পড়ে আছে। রুবা বোঝে -
তাদের কষ্ট হয়। মা-তো আজকাল শিহাবের কথা মুখেই আনেন না। সবচেয়ে আশ্চর্য - ছোট
ভাইবোন দুটো যারা শিহাবের ভক্ত ছিল - তারাও রুবার সামনে শিহাবের কথা বলে না। রুবা
বুঝতে পারে না কেন এমন হল।
এদিকে প্রজেক্টটা বন্ধ হয়ে
যাবার পর থেকে এ বেকার জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। হাতে টাকা পয়সাও নেই।
দু’মাস আগে একবার এসে
সেই যে শিহাব বলে গেল - "ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম যাচ্ছি।"- তারপর থেকে
তার দেখা নেই।
মামার কাছে গিয়ে জানতে চাইলে মামাও কিছু
বলতে পারেন না। বেশ বোঝা যায় বাবা-ছেলের দূরত্ব আরো বেড়েছে। সম্ভবত শিহাবের
অতিরিক্ত টাকার মোহ, পরীক্ষা না দেয়া - মামাকে আরো অভিমানী করে তুলেছে।
আজকাল বাসায় গেলেও মামা রুবার সঙ্গে তেমন কথা বলেন না। এমন
কোন সুযোগ আসে না যে রুবা বলবে তার অবস্থা মামার অবস্থার চেয়েও খারাপ। শিহাবের খবর
সে কিছুই জানে না। যতবার ভাবে ততবারই কষ্টে চোখে জল এসে যায়। অথচ এমন কষ্টের কথা
মা-কেও বলা যায় না। আত্মসম্মানে বাধে।
হুঁ! সম্মান কি আর আছে? বিয়ের পর আজ দু’বছর বাবার বাড়িতে পড়ে আছে। আগে তবু পড়াশোনা চাকরি
কিছু একটা করার ছিল। এখন তাও নেই।
আর বসে থাকা চলবে না। রুবা
কয়েকদিন ধরে ভাবছে একটা কিছু করা দরকার। অবশেষে কাল রাতে ঠিক করেছে রেহানা আপার
সাথে দেখা করবে। প্রজেক্টটা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন রেহানা আপা একদিন ডেকে নিয়ে
বাসার ঠিকানা দিয়েছিলেন। রুবার ঠিকানাও নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খুব শিগ্গিরই আরেকটা
প্রজেক্টের কাজ শুরু হতে পারে। তখন প্রয়োজন হলে ডাকবেন। কিন্তু দু’মাসেও যোগাযোগ করলেন না। না করুক। প্রয়োজন যার
সে-ই তো করবে।
রুবা কাল রাতে মনস্থির করেছে। আজ ছুটির দিন। আজ সকালে গেলে
দেখা হতে পারে। তাই আজ সকাল সকাল ওঠা।
কলিং বেল টিপতেই কাজের মেয়ে
দরজা খুলে দিল। রুবা বাইরে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, "রেহানা আপা আছেন?"
"হ্যাঁ আছেন, আপনি বসেন। উনি বাথরুমে।"
রুবা ঘরে ঢুকে একটা সোফায় বসলো। চারদিকে চোখ বুলাতে লাগল।
বসার ঘরের জিনিসপত্রে রুচি আর স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ। একপাশে রাখা ঝুড়ি থেকে একটা
ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগল।
"আরে রুবা তুমি!" রেহানা আপা কিছুটা বিস্মিত।
"হ্যাঁ আপা। আপনি বলেছিলেন যোগাযোগ রাখতে। তাই এলাম।
আপনার নতুন প্রজেক্ট কি শুরু হবে আপা?"
"এখনো শুরু করতে পারলাম কই। সারা পৃথিবীতেই দেখোনা একটার
পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে। এই টুইন টাওয়ারের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে লাদেন
সমস্যা। এখন আবার ইরাক যুদ্ধ। প্রজেক্টের টাকাতো দেয় বিদেশীরা। দেশের পরিস্থিতিও
দেখ- খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ - এত অরাজকতা - ওরা এখন কাজ গুটিয়ে নিতে চাচ্ছে। তবু
আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। তারপর তোমার কী খবর বল।"
"এই তো আছি।"
"এখনো সংসার শুরু করনি? তোমার হাজবেন্ড কোথায়?"
রুবা কেঁপে উঠল। প্রথম প্রশ্নটার উত্তর এড়িয়ে উত্তর দিল - "ব্যবসার
কাজে সিলেট গেছে।"
"কী ব্যবসা? আজকাল ব্যবসার তো কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
খোঁজখবর রাখোতো? এই দেখনা আজ সকালে উঠেই পেপার দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।"
"কী হয়েছে আপা?" রুবার কন্ঠে উদ্বেগ।
"আর বলো না। আমার ভাইয়ের এক বন্ধু। খুব ছোটবেলা থেকেই
চিনতাম। এই ব্যবসা করতে গিয়ে কেমন নষ্ট হয়ে গেল।"
রেহানা বলেই যান - “বেশ কিছুদিন আগে একবার আমার বাসায় এসেছিল। একেবারে
কেতাদুরস্ত। এমনিতেও দেখতে খুব সুন্দর ছিল। এসে বললো, "আপা আমি এখন সিলেটে
থাকি। ব্যবসা করি।" তারপর আরো কত গল্প। বিয়ে করেছে, বউ কলেজে পড়ায়, আর
কিছুদিন পর গাড়ি কিনবে। অবশেষে বললো, "আপা আপনার কাছে কি টাকা আছে? আমাকে শ’পাঁচেক টাকা দিতে হবে। এখানে এসে আমার পিকপকেট হয়ে
গেছে।" আমি পাঁচশো টাকা দিলাম। সে অনেকক্ষণ গল্প করে আমাকে সিলেট যাবার
দাওয়াত দিয়ে গেল। আমিও এমন বোকা - ঠিকানা নিলাম না। পরে আমার ভাইতো শুনে রেগে
আগুন। বললো, "ওকে আর জায়গা দিও না আপা। ও একটা বাটপার হয়ে গেছে বাজে লোকদের
সাথে মিশে। কোন্ কলেজে পড়ায় তার বউ? আমি তো শুনেছি সে তার এক ফুপাতো না মামাতো
বোনকে বিয়ে করেছে।" অথচ দেখো, তার জন্য আজ আমার মনটা খুব খারাপ। এত দুঃখজনক
ব্যাপারটা।”
"কেন আপা, তার কী হয়েছে?"
"আর কী হতে বাকি আছে? আজ সকালে পেপার খুলতেই দেখি তার
ছবি। কারা যেন তাকে খুন করে রাস্তায় ফেলে রেখেছে।"
রুবার বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। কিছুটা ব্যাকুল হয়ে সে জানতে চায়
- "কোথায় আপা?"
"এই তো মুগদাপাড়ায় কোন্ একটা হোটেলের সামনে।"
"তা নয় আপা, আমি খবরটা পড়তে
চাচ্ছিলাম। পেপারটা কোথায়?" - রুবা নিজের কন্ঠস্বরের কাঁপন ধরে রাখতে পারছে
না।
রেহানা কাজের মেয়েটাকে ডেকে পেপারটা নিয়ে আসতে বলেন। রুবার
মনে হয় সময় যেন যেতে চাইছে না।
মেয়েটা পেপারটা এনে দিতেই রুবা তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে দেখতে যায়।
পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার নিচের দিকে শিরোনাম - নগরীতে যুবক খুন। ছবি - একি! ছবিটা
কার? রুবা চিৎকার করে উঠে - "আপা, এ যে শিহাব, আমার হাজব্যান্ড।"
"কী, কী বলছ?" আঁতকে উঠে রুবার কাছে সরে আসেন
রেহানা।
"হ্যাঁ, আপা আমি জানতাম না ও এ শহরে আছে" - রেহানার
কোলে ঢলে পড়তে পড়তে বলে রুবা।
No comments:
Post a Comment