১০
বার্ষিক পরিদর্শন -
বিমানবাহিনী প্রধান
বছরে একবার বিমান
বাহিনী প্রধান সবগুলো ঘাঁটি পরিদর্শনে আসতেন। একদিন বা দুদিনের সে পরিদর্শনের জন্য
দেড়-দুমাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হত। ডিসেম্বরের দিকেই ওনারা আসতেন। তখন
আবহাওয়া ভাল। ঘাঁটির বাগানগুলো অজস্র রঙিন ফুলে ভরা। গাছ-পালা, ঘাস সবকিছু ছেঁটে
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হত। বড় বড় গাছগুলোর হাঁটু পর্যন্ত সাদা রঙ দিয়ে মোজা পরানো
হত। আমাদের কলেজও রঙ করা থেকে ঘষামাজা সব করা হত। এর ফলে কলেজও সুন্দর হয়ে উঠত।
আবহাওয়া পরিবেশ সব মিলিয়ে খুব ভাল লাগত।
বিমান বাহিনী প্রধানের পরিদর্শনের সূচি
তখন থেকেই নির্দিষ্ট থাকত। কোন কোন বার কলেজে আসতেন। আমরা স্যার ম্যাডামরা দুপাশে
সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাতাম। তিনিও কুশল বিনিময় করতেন। স্কুল খোলা
থাকলে ছাত্রদের সাথেও সৌজন্য বিনিময় করতেন। ঘাঁটি জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব। তবে
সবচেয়ে মজা লাগত এক জায়গা পরিদর্শন শেষে তিনি যখন অন্যত্র যাবেন তখন ঠেলা গাড়িতে
কার্পেট, ফুলের টব তাঁর আগে আগে স্থান পরিবর্তন করে নতুন স্থানে জাঁকিয়ে বসত। এটা
দেখলে ‘শিয়াল আর
কুমির ছানা’র গল্প মনে
পড়ত।
আমি যখন কলেজে যোগদান করি তখন এয়ার চিফ
ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ। তাঁর স্ত্রী ফেরদৌস আরা মাহমুদ যার ডাক
নাম ছিল মায়া সে আমার স্কুল জীবনের বন্ধু ছিল। আমার খালার ননদের মেয়ে হিসেবে
আত্মীয়তাও ছিল। তবে বন্ধু হিসেবেই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। মাঝে মাঝে মনে হত বন্ধুকে দেখার
জন্য ওর সাথে যোগাযোগ করব নাকি একবার! অন্য বন্ধুদের কাছে শুনেছিলাম এয়ার চিফের
স্ত্রী হয়েও ওর কোন পরিবর্তন হয়নি। পুরনোদের মনে রেখেছে। পরমুহূর্তে মনে হত দুজন
যখন একই সমতলে নেই, বিশেষ করে আমি শাহীনের শিক্ষক সেজন্য হয়তো কোন সুবিধার জন্য,
অথবা আমার কলিগরাও মনে করতে পারে বড়র সাথে কুটুম্বিতা দেখিয়ে নিজেকে জাহির করছি।
এই সংকোচ কাটিয়ে তাই আর কোনদিন দেখা করতে পারিনি, করিনি।
চাকরি বিধিমালা প্রণয়নের পর
হেডকোয়ার্টারের শিক্ষা পরিচালনা দপ্তর থেকে নিয়ম চালু করা হল বছরে একবার
শিক্ষাবিভাগের অফিসাররা কলেজ পরিদর্শনে আসবেন এবং ক্লাস পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষকদের
মূল্যায়ন করবেন। সারা বছরের পাঠ-পরিকল্পনা, গবেষণাগার, ক্লাসরুম, শিক্ষকদের
পোশাক-আশাক, পাঠ পদ্ধতি সবকিছু অর্থাৎ ম্যানারিজম ইত্যাদি মিলিয়ে মূল্যায়ন করবেন।
এই মূল্যায়নে একশো নম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ষাট নম্বর পাশ মার্ক এবং আশি বা পঁচাশি
গুড মার্ক।
তারা এটাও ঘোষণা দিলেন পর পর তিনবার
অর্থাৎ তিন বছরের মূল্যায়নে যদি কেউ ৬০% বা এর নিচে নম্বর পায় তাহলে তাকে টারমিশন
অর্থাৎ ছাঁটাই করা হবে। এটা শুনে সবার মাঝে একটা টেনশান তৈরি হল। আমাদের পালাবার
পথ নেই, বুড়ো হাড়ে দুর্বা গজিয়ে গেছে। তাই কোন দুশ্চিন্তাও হল না। যা হয় হবে।
কিন্তু যারা নতুন বা মাত্র চাকরিতে যোগ দিয়েছে তাদের জন্য এটা একটা ফোবিয়া তৈরি
করল। ফলে পরবর্তী ইন্সপেকশন বা হেডকোয়ার্টারের টিম আসার আগে নয়জন শিক্ষক একসাথে
পদত্যাগের দরখাস্ত দিল। এবার আমরা পুরনো কয়েকজন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। একি অবিচার!
শাহীন কলেজের একজন শিক্ষক নিয়োগে তাকে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। ১। লিখিত
পরীক্ষা ২। ক্লাস ডেমনেস্ট্রেশান ৩। মৌখিক পরীক্ষা। এত যাচাই বাছাইয়ের পর যাদের
ওনারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন কথায় কথায় তাদেরই আবার বরখাস্ত করার হুকুম দেবেন এ
কেমন কথা! হয় এ অপমানজনক শর্ত তুলে নিতে হবে নতুবা আমরা সবাই মিলে পদত্যাগ করব। আমার
এবং আমাদের এ কথায় সবাই সায় দিলেন এবং প্রতিবাদপত্রে প্রথম স্বাক্ষর দিলেন আবদুস
সোবহান ফারুকীভাই।
বয়স্ক শিক্ষকদের প্রায় সবাই একমত,
নতুনরাও। কিন্তু সর্বত্রই দু-একজন থাকে সংসদে বিরোধীদলীয় দলীয় সদস্যের মত তারা
ওয়াক আউট করলেন। তারপর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দিলেন, এটাকে আপনারা এত সিরিয়াসলি
নেবেন না। এটা একটা আনুষ্ঠানিকতা বা বিধিমাত্র। কিন্তু যারা পদত্যাগ করল তাদের
অনেকেই আর ফিরে এল না। আমরা বিংশ শতাব্দীর বায়স হিসেবে একবিংশ শতকের প্রথম দশকও
কাটিয়ে দিলাম।
এই ঘটনায় আমার এবং পদার্থবিজ্ঞানের নতুন
শিক্ষক প্রদীপ দেবের নামে আমাদের মাঝ থেকে দু-একজন রিপোর্ট করেছিল। আর ফিল্ড ইউনিট
নামের জুজুর ভয় তো ছিলই। তখন আমার খুব আপন একজন অফিসার আমাকে সতর্ক করেছিল আমি
যাতে এসবে না জড়াই। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে পরবর্তীতে আমার ভাঙা মেরুদন্ডে দুবার
অস্ত্রোপচার হলেও প্রতীকী অর্থে মেরুদন্ড দৃঢ় করেই দাঁড়ানোর পক্ষে ছিলাম। আশৈশব
শেখা ‘শিক্ষা
জাতির মেরুদন্ড’ কথাটা
মস্তিষ্কে কোটরে এমন ছাপ মেরেছিল যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নমনীয় হতে বিবেকে লাগত। তবে
এটা অকপটে স্বীকার করব যখনই যেখানে যে কার্যোপলক্ষে গিয়েছি বিমান বাহিনীর
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়েছেন। এ বিষয়ে তাদের প্রতি আমি
কৃতজ্ঞ।
ইন্সপেকশন টিমের পরিদর্শনকাল ছিল
জুন-জুলাই। চট্টগ্রামে তখন ঘনঘোর বরষা। তারাও আসতেন ভিজতে ভিজতে। আমরা এবং
ছাত্র-ছাত্রীরাও ভেজাকাক হয়ে বেশিরভাগ সময় ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম। সবচেয়ে মজার হল
টিম পরিদর্শকদের মতদ্বৈততা। এক বছর একজন এলেন, তিনি ইংরেজি শিক্ষক সংযুক্তা দাসকে
বললেন, আপনি ইংরেজি ক্লাসে বাংলা বলেন কেন?
সংযুক্তার উত্তর, স্যার, ছোট বাচ্চারা
শুধু ইংরেজি বললে বুঝতে পারে না। ক্লাসে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছাত্র-ছাত্রী আছে। এমন
অনেকে আসে বিমানবাহিনীর চাকরির সূত্রে যাদের বাবা-মা বাংলাও ভাল পড়তে পারেন না।
-না এটা হতে পারে না। ইংরেজি ক্লাসে
ইংরেজি ভাষায় কনভারসেশন চালাতে হবে। নাহলে বাচ্চারা শিখবে কিভাবে?
-জী আচ্ছা।
পরের বছর অন্য একজন
এলেন। সংযুক্তা দাশ পুরো চল্লিশ মিনিট ইংরেজিতে ক্লাস নিলেন। এবার যিনি এলেন তার
মন্তব্য- এভাবে থরোলি ইংরেজি বললে বাচ্চারা কি কিছু বুঝতে পারবে না শিখতে পারবে!
এবার শিক্ষক বিস্ময়-বিমূঢ়! কোনটা ফলো
করবেন!
পরিদর্শন টিমের আরেকটি দুর্বলতা ছিল,
অফিসার হিসেবে তারা ইংরেজিটা প্র্যাকটিস করার ফলে ইংরেজি ক্লাস বুঝতে পারতেন অথবা
তাদের ভাল লাগত। তাই ইংরেজি শিক্ষকদের মূল্যায়নে প্রচুর নম্বর দিতেন। ফারুকী
স্যারকে না দিয়ে পারতেন না। কিন্তু সমাজবিজ্ঞান বা ইতিহাসের শিক্ষা অফিসার যখন
রসায়ন বা পদার্থ অথবা জীববিজ্ঞান ক্লাসে যান তখন তার মূল্যায়ন কতটুকু সঠিক হবে,
এটা তারা অনুধাবন করতে পারতেন না। আমরা নিজেরাই নিজেদের অধীত বিষয়ে কতটুকু জানি,
সেখানে অন্য বিষয় মূল্যায়ন করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
একজন ছিলেন উইংকমান্ডার সাত্তার। তিনি
সম্ভবত পদার্থবিজ্ঞানের ছিলেন, তাই সবাইকে অপদার্থ মনে করতেন। তিনি বিএড সিস্টেমে
পাঠ-পরিকল্পনা অনুসরণ করার জন্য কলেজ শিক্ষকদের বার বার সতর্ক করতেন। এবং বেশ কড়াভাবেই
করতেন। কিন্তু কলেজে বিএড পদ্ধতির এই নিয়ম হুবহু মানলে লেকচারের সময় আর থাকে না।
তাই সবার আল্লাহ আল্লাহ এই লোক কখন রিটায়ারমেন্টে যাবে! কিন্তু আমরা ভাবতাম না আরেকজন
আসবে এরচেয়েও হয়তো অদ্ভুত স্বৈরতন্ত্রের প্রতিনিধি। কেন যে তারা বুঝতে চাইত না
প্রত্যেক শিক্ষকের পৃথক পৃথক শিক্ষা পদ্ধতি বা মেথড আছে এবং শিক্ষকও দিনে দিনে
অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সেই পদ্ধতিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন।
অফিসারদের ভিতরও মতের বৈচিত্র্য ছিল।
একবার এসে বললেন, বাচ্চাকে ব্লকলেটারে ইংরেজি হাতের লেখা শেখাতে। দেখা গেল পরেরজন
এসে বললেন, ইটালিক অক্ষরে শেখাতে। এসব বিষয়ে আমরা মজাও পেতাম। বলতাম – হাকিম ও নড়ে হুকুমও
নড়ে।
গোলাম মহীউদ্দীন স্যারের সময়ে ওনার চেম্বার
আর আমাদের কমনরুম ছিল পাশাপাশি। পাশাপাশি তিন রুমের মাঝখানে স্যার একপাশে আমরা
অন্যপাশে জেন্টস টিচাররা। ম্যাডাম সংখ্যা বেশি হওয়াতে সরু আয়তাকার সেই রুমে সবার
জায়গা হত না। ফলে আমরা অনেকটা মিউজিক্যাল চেয়ারের মত একজন ক্লাসে গেলে অন্যজন বসার
সুযোগ পেতাম। কিন্তু এরই মাঝে আমাদের হৈ হৈ হাসি ঠাট্টার কমতি ছিল না। অনেক সময়
বড়কর্তাদের অর্থাৎ হুজুরদের নিয়েও আমরা হাসাহাসি করতাম। আমাদের এই হট্টগোলে
অধ্যক্ষ অনেক সময় বিব্রত বোধ করতেন এবং প্রায়ই ডেকে বলতেন আপনারা ‘লুজটক’ করবেন না, এখানে
আশেপাশে সবসময় এফ-ইউ (ফিল্ড ইউনিটের) লোকজন থাকে। একটু সাবধান থাকবেন। কিন্তু কে
শোনে কার কথা। ওনার রুম থেকে বেরিয়ে ‘যথা পূর্বং তথা পরং’ এবং মাঝে
মাঝে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সাবধানবাণী উচ্চারিত হত- এই লুজ টক মানা। তারপর আবার হাসির
হররা।
এরপর স্থান সংকুলান হচ্ছিল না দেখে
আমাদের পাশের একটা ক্লাসরুমে দেয়া হল আর আর আমাদের রুমটা ভাইস প্রিন্সিপ্যাল
ম্যাডামের জন্য বরাদ্দ হল। তখন একজন শিক্ষক এসেছিল নেভী অফিসারের স্ত্রী। নাম
নাসরীন জেবুন্নেসা। ইয়া লম্বা চওড়া,
দশাসই। ছাত্রজীবনে খেলোয়াড় ছিল। সে কোনমতে ক্লাস নিয়ে এসে পিছন দিকে একটা লো বেঞ্চ
পেতে তাতে শুয়ে শুয়ে বেসুরে কিশোরকুমারের একটা গান গাইতো ‘জানি না কেমন করে কি দেব তোমায়...’ ।
কিছুদিন পর জানা গেল সে আসলে অন্তঃস্বত্তা এবং
সহসা চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে চলে গেল। খুব হাসি খুশি এবং মজার এই মানুষটি। বাবার সরকারী চাকরি
সুত্রে দশ বছরে নয়টি স্কুলে পড়েছে। সুতরাং তার দেখাশোনাও কম ছিল না। কিন্তু
স্বল্প সময়ের জন্য এসে কলেজকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিল কারণ নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ
অনেক ঝামেলার ব্যাপার।
পুরনো শাহীনের চৌকো লাল দালানে আমাদের
সময়টা ছিল অনেক আনন্দের। ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যা স্বল্পতার কারণে ছাত্র-শিক্ষকের
মধ্যে চেনা-পরিচয় ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ছিল অনেক বেশি। ১৯৮৭ তে সম্ভবত ২৩ জন
ছাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল যাদের বেশিরভাগই প্রথম বিভাগ পেয়েছিল। গণিতে আর
ইসলামিয়াতে প্রচুর লেটার মার্কস আসত। আমি অবাক হতাম। কারণ বাইরের স্কুলে বা
আত্মীয়স্বজনের সন্তানরা ইংরেজি আর এ দুটোতেই অকৃতকার্য হত বেশি অথচ ফারুকী ভাই আর
মহীউদ্দীন ভাইয়ের শিক্ষায় শাহীনে এ দুটো বিষয়ে প্রচুর লেটার মার্কস আসত।
টিফিন নিয়ে আমাদের খুব সমস্যা হত।
কাটগড়ের দোকানে চুপসানো সিঙ্গারা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যেত না। আমাদের নিয়তিপ্রভা
রায় চা বানাত। কিন্তু যেদিন নিয়তি খিচুড়ি রান্না করত সেদিন আমরা খুব আনন্দিত হতাম।
ছোট্ট একটা হাফপ্লেট খিচুড়ি আর অর্ধেক ডিম দিয়ে পরিবেশিত নিয়তির সেই খিচুড়ির স্বাদ
ছিল অমৃততুল্য। সত্যিই নিয়তির রান্নার হাত ছিল অনন্য। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায়
আমরা যখন বিকেলে ডিউটি দিতাম। তখন নিয়তির রান্না স্বল্প মশলার এক টুকরো মুরগির
মাংস আর ডাল দিয়ে ভাত পরম তৃপ্তি সহকারে খেতাম। নিয়তির খিচুড়ি মাঝে মাঝে আমাদের
বাচ্চারাও খেত। তাই এখনও বাসায় খিচুড়ি রান্না হলে আমরা নিয়তির খিচুড়ির স্মৃতি চারণ
করি।
আমার বাবা বাড়ি থেকে প্রচুর চালের গুঁড়ো,
নারকেল আনতেন। একবার বার্ষিক পরীক্ষা শেষে উত্তরপত্র পরীক্ষণের সময় শীতের আমেজে
আমাদের মনে হল ভাপা পিঠা খেলে কেমন হয়! চাল-নারকেল আছে গুড়ের দরকার। তখন ঘাঁটিতে
প্রচুর খেজুরগাছ ছিল এবং শীতকালে এসব খেজুর গাছ লিজ নিয়ে ফরিদপুর এবং যশোরের গুড়ের
কারিগররা কলেজের পিছনেই গুড় জাল দিত। হুমায়রা আপা সেখান থেকে গুড় কিনে দিলেন।
নিয়তির কাঠপাতা কুড়িয়ে ইটের চুলায়
বানানো সেই ভাপাপিঠা পরবর্তীতে আমাদের স্মৃতিকাতর করত। অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে আমরা
সবাই এই শীতের পিঠা খাওয়া উপভোগ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল ৯১এর ঘূর্ণিঝড় এ
বেশিরভাগ খেজুরগাছ মারা গিয়েছিল। সম্ভবত নোনাপানি সহ্য করতে পারেনি।
১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে
কলেজে একদল সদ্য পাশ করা আনকোরা শিক্ষকের আগমন ঘটল। এদের মাঝে ছিল প্রদীপ, সুচরিত,
আলী হায়দার, হোসেন আসমা, ইন্দ্রানী মুৎসুদ্দী, পূর্ণিমা, ওয়াহিদা হাসনাত, আবুল
হোসেন। এরা কেউ প্রভাষক, কেউ প্রদর্শক। কলেজে ছাত্র সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষকেরও
প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।
স্কুলেও এর আগে বেশ কিছু শিক্ষক নেয়া
হয়েছিল। বিজ্ঞান শাখার অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষক বনি আমিন টিএসপি স্কুলে চলে গেলে
বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব দেখা দিয়েছিল। রশীদ সাহেব ভূগোলের প্রভাষক ঘোড়াশাল
সারকারখানার কলেজ, ইংরেজির শিক্ষক মোস্তফা কামাল চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজারের
স্কুলে চলে গেলে খুবই সমস্যা হচ্ছিল কারণ এরা প্রত্যেকে যার যার বিষয়ে অত্যন্ত ভাল
পড়াতেন।
নতুন এই প্রভাষক দলে প্রদীপ এবং সুচরিত
আসা মাত্রই ছাত্রদের মন জয় করে নিল। প্রদীপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রথম-দ্বিতীয় হওয়া ছাত্র তার সেখানেই চাকরি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর কিছু না পারুক দলীয় রাজনীতি করে নিজের কোলে ঝোল টানতে
ওস্তাদ! তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের দৌরাত্ম্য। সুতরাং ছাত্ররা বঞ্চিত
হল একজন মেধাবী শিক্ষক প্রাপ্তি থেকে। শাহীন কলেজ তাকে শিক্ষক নির্বাচন করল। খুব ভাল ফলাফলের শিক্ষকরা সাধারণত
শাহীনের বেশিদিন থাকত না। কিন্তু এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ছিল যে কদিনই থাক,
ছাত্ররা একজন ভাল শিক্ষকের কাছ থেকে ভাল কিছুতো শিখবে। সুচরিত আকৃতিতে মাঝারি,
স্বভাবে নম্র কোমল। কোন কাজেই তার না ছিল না। এরা সবাই যখন একসাথে এল অনেকটা ১৯৮৫র
আমাদের সময়ের মত। শিক্ষার্থীরাও উজ্জীবিত নতুন শিক্ষকদের পেয়ে।
এসময় একদিন অধ্যক্ষ মজিদ স্যার আমাকে
তাঁর রুমে ডাকলেন। বসার পর একটা চিঠি হাতে দিয়ে বললেন পড়ে দ্যাখেন। পড়লাম জাতীয়
টেলিভিশন স্কুল শাখার বির্তকে অংশগ্রহণের চিঠি। বিষয় যতটুকু মনে পড়ে ‘বাংলা ভাষার উৎকর্ষের
অবদানে ধনিক শ্রেণির অবদানই প্রধান’- এরকম কিছু একটা। আমরা পক্ষে। স্যার বললেন ম্যাডাম, কাজ শুরু করে দিন।
ছেলে মেয়ে বাছাই করুন এবং স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করুন। আপনাকে সহযোগিতার জন্য যাদের
লাগবে তাদের নাম বলুন। আমি তাদের ফ্রি করে দেব। কিন্তু আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে স্কুল শাখা এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এই দুই শাখায় বির্তক হত এবং
উপভোগ্য এ বির্তক প্রায় সবাই দেখত। বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল কলেজ, ক্যাডেট
কলেজগুলোর বির্তক যারা করত সারা দেশ তাদের চিনত। কারণ তাদের বুদ্ধিমত্তা,
বাচনভঙ্গী, উপস্থাপনা অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল। স্কুলের ছেলে-মেয়েরাও ট্যালেন্ট ছিল।
ভিকারুননেসা, হলিক্রসসহ সারা দেশের অনেক স্কুল জাতীয় স্কুল বির্তকে অংশগ্রহণ করত।
ক্যাডেট কলেজের স্কুল শাখা, গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরী ইত্যাদি ভাল স্কুলগুলোর বির্তক
এত উপভোগ্য হত যে বির্তক চলাকালীন সময়ে সামনে থেকে উঠতে ইচ্ছা করত না। এখন সেই
বির্তক করব আমরা! এবং তার মূল দায়িত্ব আমার কাঁধে! আমি বিহ্বল।
কিন্তু ঐ যে বললাম, মজিদ স্যার চাবুক
কষেছেন। সুতরাং এটা আমাকে করতেই হবে। আমারও সামান্য লেখালেখি এবং পাঠ্যবহির্ভূত
বই-পত্র পড়ার অভ্যাস ছিল। স্যার কমিটি গঠন করে দিলেন- আমি, নাসরীন বানু, সুচরিত,
প্রদীপ এদেরকে নিয়ে। আবার সব শিক্ষককে ডেকে বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে কিছু না কিছু
লিখতে বাধ্য করলেন। সেগুলো পড়া আরেক ঝামেলা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু স্যারের ভয়ে সবাই
কিছু না কিছু লিখল।
যতদূর মনে পড়ে প্রথমটা ছিল কলেজ বির্তক।
এতে আমরা বক্তা নির্বাচন করলাম, মোর্শেদ ইমতিয়াজ (পাপ্পু), আদেল জান্নাত ও শাহেদা
বেগমকে। পাপ্পু হুসনা’পার ছেলে। শাহেদা
মহীউদ্দীন স্যারের ভাগনি এবং আদেল আমাদের কলেজের ছাত্র। শুরু হল স্ক্রিপ্ট লেখা ও মুখস্থ
করানো। মজিদ স্যার সন্ধ্যায় বার কোয়ার্টারে এসে হুসনা আপার বাসায় বক্তাদের ও
আমাদের নিয়ে বসতেন। আদেল ছিল একটু লাজুক স্বভাবতই দ্বিধাগ্রস্থ। তাকে বার বার
রিহার্সাল করা হত।
প্রথম রাউন্ডে আমরা জিতেছিলাম। দ্বিতীয়
রাউন্ডে ট্রাফিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত একটা বিষয় ছিল, যাতে আমরা ভাল করতে পারিনি।
তবে এই বিতর্কের প্রভাবে মোর্শেদ ইমতিয়াজ অর্থাৎ আমাদের পাপ্পু বিশ্ববিদ্যালয় ও
জাতীয় পর্যায়ে অনেক দূর গিয়েছিল। বেশ কবার সে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল। বিতর্ক চর্চা
তাকে জ্ঞানসম্পদে অনেক ঋদ্ধ ও ব্যক্তিত্বে চৌকষ করে তুলেছিল। বর্তমানে সে
জুডিশিয়াল বিভাগের উচ্চপদস্থ আমলা।
স্কুল বিতর্কে আমাদের বক্তা ছিল তানজীবা
সুলতানা রীমা, অন্তরা, নাজমুল হক। আমি, সুচরিত, প্রদীপ, নাসরীন এই চারজন মূল
কমিটিতে ছিলাম।
জাতীয় টেলিভিশন স্কুল
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় পাঁচটি রাউন্ড ছিল। প্রত্যেক রাউন্ডে আমরা বিজয়ী হয়ে পরবর্তী
রাউন্ডে উঠেছি এবং প্রতিবারই শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়েছিল আমাদের দলনেতা তানজীবা সুলতানা
রীমা। ঢাকার হলিক্রস, ভিকারুননেসা, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ এবং আরো দুটি বিখ্যাত
স্কুলের সাথে আমাদের প্রতিযোগিতা হয়েছিল।
ভিকারুননেসার সাথে আমাদের বিতর্কটি ছিল
সবচেয়ে চমকপ্রদ। শিশুশ্রমের পক্ষে ও বিপক্ষে। আমরা পক্ষে। প্রথমে মাথা একটু ঘুরে
গিয়েছিল- জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ সমর্থন করেছে বাংলাদেশ, ব্যক্তিগতভাবে আমরা
শিশুশ্রম সমর্থন করি না। কিন্তু পরে যখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলাম তখন
মনে হল, এখানে শিশুশ্রম ছাড়া শিশুর পক্ষে বেঁচে থাকাই অসম্ভব। দরিদ্র শিশু
উপার্জনহীন বাবা মায়ের বোঝা না হয়ে বাধ্য হয় জীবিকা অর্জনে এবং কখনো কখনো পরিবার
প্রতিপালনে শিশুশ্রমে বাধ্য হয়।
বির্তকে আমরা জিতে গেলাম। বিচারক ছিলেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। অত্যন্ত সৌজন্যবোধসম্পন্ন
এ শিক্ষককে ভিকারুননেসার ছাত্রীরা অনুষ্ঠানের পর ঘিরে ধরল- স্যার এটা কীভাবে
সম্ভব?
স্যার স্মিথহাস্যে বললেন, আমিও তাই
ভাবছি এটা কিভাবে হল। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিশুশ্রমের বিপক্ষে। কিন্তু ওরা কিভাবে
যেন চমৎকার যুক্তি দিয়ে আমাদের প্রভাবিত করল এবং মনে হল এটাই সঠিক। ভিকি মানে
ভিকারুননেসার ছাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে গেল। একই ঘটনা ঘটেছিল হলিক্রস স্কুলের
বেলায়ও।
আমরা বিতর্ক করতে গেলে বিমান বাহিনীর
অফিসার্স মেসে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হত। টিভি ভবন রামপুরায় যাওয়ার জন্য বিমান
বাহিনীর বাস দিত এবং ঢাকা শাহীনের ছাত্রদের সাথে নেয়া হত। আমাদের পক্ষে ওরা না
থাকলে তালি দেবে কে? বিচারে হাততালিরও একটা প্রভাব আছে।
ফাইনালে জিতে আমরা যখন পুরস্কার নিতে
গেলাম সেবার বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে আমাদের ভিআইপি আতিথেয়তা দেয়া হল। ভিআইপি রুমে
থাকা-খাওয়া এবং রুমে প্রবেশ এবং বের হওয়ার আগে ব্যাটম্যান এসে দরজা খুলে দেওয়া-
এসব অনভ্যস্ত আমাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিত। কিন্তু সত্যি সেই দুটো দিন আমাদের অনেক
আনন্দে কেটেছিল। বির্তকের টেনশান নেই। ছাত্র-শিক্ষক মিলে হা-হা, হি-হি নানারকম
গল্প। দুঃখের বিষয় পুরস্কার নেয়ার আগেই মজিদ স্যার কলেজ থেকে চলে গিয়েছিলেন তাই
তাঁর অনুপস্থিতিটা খুব মনে পড়ছিল।
সোনার মেডেল এবং গোল্ডকাপ নিয়ে অনেক ছবি
তোলা হল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। এসব ছবি টাকা দিয়ে কলেজের উদ্যোগে
আনতে হয়। অনেক বলার পরও এটা-সেটা করে গাফিলতির কারণে ছবিটি টিভি কর্তৃপক্ষের সাথে
যোগাযোগ করে আনা হয়নি। এটার গুরুত্বটা তখন যারা কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের
দায়িত্বে ছিলেন অনেক বলেও তাঁদের বোঝাতে পারিনি। শিক্ষার্থীরাও একে শিশু তায় শুধু মুখস্থ
করে গোল্ডমেডেল জিতেছিল বলে সেটার গুরুত্ব ততোটা উপলব্ধি করেনি বলে আমার ধারণা।
এরপরে স্কুল বিতর্কে আমরা গিয়েছিলাম
কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায়। আসলে সবকিছুতে একজন পৃষ্ঠপোষক বা মেন্টর লাগে
মজিদ স্যার ছিলেন সেই মেন্টর।
অবশ্য এরপর চট্টগ্রামের স্থানীয় বিতর্কে
বিশেষত ‘দৃষ্টি’ বিতর্ক প্রতিযোগিতার
আমরা গেলেই মোটামুটি চ্যাম্পিয়ন রানার্স আপ হতাম। আমাদের বিতার্কিকদের মধ্যে স্কুল
শাখায় নাজমুল খুব সিরিয়াস ছিল, রীমার গুণ ছিল স্ক্রিপ্ট, যুক্তি ইত্যাদি
অভিব্যক্তিসহ ঝাড়া মুখস্থ বলতে পারত।
২০০৪ সালের ২৯ এপ্রিল আমার পিএলআইডি
অপারেশন হয়। হঠাৎ প্রচন্ড ব্যথায় আমি শোয়া, বসা, দাঁড়ানো কিছুই করতে পারছিলাম না।
ব্যথার চোটে আমি সার্জনকে অনুরোধ করে মে মাসের ২ তারিখের অপারেশন এপ্রিলের ২৯-এ
করিয়েছিলাম। আত্মীয়স্বজন যারা ডাক্তার তারা বলছিলেন অন্তত ঢাকা যেতে। আমার ছোট
মেয়ে দিঠি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে পড়ত এবং ‘সন্ধানী’ করার সূত্রে সিনিয়রদের সাথেও আলাপ পরিচয়
ছিল। তাদের অনেকেও পরামর্শ দিয়েছিল ভারতে বা নিদেনপক্ষে ঢাকায় নিয়ে যেতে। কিন্তু
আমি কোথাও যাব না। কিভাবে যাব! ব্যথায় দাঁড়ানো, হাঁটা, বসা, শোয়া কোন কিছুই করতে
পারছিলাম না তাই যানবাহন চড়ে কিভাবে পথ পাড়ি দেব?
আমার কেবলই মনে হচ্ছিল ডাক্তার আমাকে
এনেস্থেশিয়া দিলে তারপর আমি যদি মরেও যাই তাহলেও শান্তি পাব। আসলেই তখন ব্যথায় আমি
এভাবে আমার মৃত্যু কামনা করছিলাম। চট্টগ্রাম মেডিকেলের নিউরোসার্জন প্রফেসর
জিল্লুর রহমান আমার অপারেশন করেন এবং আমি সুস্থ হই। কিন্তু তারপর থেকে সম্পূর্ণ
ব্যথামুক্ত আজও হতে পারিনি। কারণ যেসব নিয়ম, ব্যায়াম তিনি দিয়েছিলেন শাহীনে চাকরি
করে সেসব নিয়ম আংশিক মেনে চলতেও আমি অপারগ ছিলাম।
এসময় ২০০৪ এর সেপ্টেম্বরে বিমানবাহিনী
কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন আন্তঃশাহীন বির্তক, কুইজ, ফুটবল এসব প্রতিযোগিতার। সব
শাহীনের মাঝে একটা সম্পর্ক বা যোগাযোগ গড়ে তোলার লক্ষে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
আমি সুস্থ হয়ে পাঁচলাইশের চারতলা বাসা
পরিবর্তন করে হালিশহর এইচ ব্লকে একতলায় নেমে এসেছি সিঁড়ি ভাঙার নিষেধাজ্ঞার জন্য।
কিন্তু শাহীনের বিতর্ক! সুতরাং আমাকে
বাদ দিয়ে হয় কি করে। কিন্তু আমার যে জার্নিও আপাতত মানা। এত মানার পরও আমার ঘরের
মানুষটি বললেন, চাকরি যখন কর কর্তব্য পালন করতে তো হবেই। তাছাড়া একবার গেলে নিজের
শরীরের অবস্থা বুঝতে পারবে। যথা আজ্ঞা, সবার যখন ইচ্ছা যা-ই।
এই বির্তকে আবার স্কুল-কলেজ মিলিয়ে দল
গঠন করা যেত। সম্ভবত ৮ম-১২শ শ্রেণী। কুইজ এবং বির্তকে দলের সবাই ছেলে শুধু সাঈদ
ভাই (উপাধ্যক্ষ)-এর মেয়ে নূরজাহান তান্নি একজন মেয়ে বিতার্কিক। ঢাকা শাহীন, সেমস,
কুর্মিটোলা এরা কলেজে প্র্যাকটিস করলেও বাসায় চলে যেত। যশোর, পাহাড় কাঞ্চনপুর,
চট্টগ্রাম অর্থাৎ যারা বাইরে থেকে আসত তারা কাঁথাবালিশ সাথে এনে কলেজেই রাত্রি
যাপন করত। কিন্তু আমি নিচে শুতে পারি না। হাঁটু গেড়ে শোয়া-বসা আমার জন্য নিষেধ।
তাহলে?
আমার মেয়ে রাকার সে বছরই বিয়ে হয়েছে এবং
সে তখন AIUB তে লেকচারার আর জামাতা রনি গ্রামীন ফোনের ইঞ্জিনিয়ার। বাসা মীরপুর। ঢাকা শহরে মীরপুর
থেকে আসা যাওয়া কষ্টকর। তবুও তান্নিকে নিয়ে আমি ওখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
সেবার খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে যাতায়াতটা
খুবই কষ্টকর হয়েছিল। আমরা বির্তকে সেমিফাইনালেই বাদ পড়েছিলাম। সম্ভবত কুইজে
রানার আপ হয়েছিলাম। তাই আমাদের পুরস্কার
অনুষ্ঠানে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল। সেদিন ১৩ সেপ্টেম্বর। ভোর থেকে অঝোর বৃষ্টি।
আমি তান্নিকে নিয়ে রওনা দিলাম। কোনরকমে ফার্মগেট পর্যন্ত যাওয়ার পর গাড়ি আর চলে
না। যেগুলো চলছে সেগুলোতে ভীড়! তারপর বাসের টিকেট করতে হয় ছাতার নিচে টুলে বসা
বাসের কর্মচারী থেকে।
একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। সেই লোক
বের হয়ে যেতে বলল, আমাদের গায়ের পানিতে তার জিনিসপত্র ভিজে যাচ্ছে। মানুষ থিক থিক
করছে রাস্তায়। আমি কিছুই চিনি না। উত্তরে যাব না দক্ষিণে! তান্নির হাতটা শক্ত করে
ধরে একবার রাস্তার এপাশে যাই আরেকবার ওপাশে।
ইতোমধ্যে আমার বডিগার্ড যিনি ঘর থেকে
আমাদের পরে বেরিয়েছিলেন তিনি নৌকায় চড়ে অনুষ্ঠানে পৌঁছেছেন এবং জানালেন অনুষ্ঠান
শেষ হয়ে গেছে। শেষ তো হবেই! নয়টায় অনুষ্ঠান ছিল তখন বাজে দেড়টার মত। শেষে কিভাবে
যেন একটা বাস ধরে আবার ফিরে গেলাম মীরপুর। গিয়ে দেখি আমার মেয়ের প্রচন্ড জ্বর এবং
সেদিন তার জন্মদিন।
আগেই টিকেট করা ছিল। কোন ট্রেন মনে নেই
তবে সুবর্ণই হবে। বাসায় পৌঁছলাম রাত দুটোয়। কর্তব্য এমনই আমার অসুস্থ মেয়েকে ফেলে
আমি চলে এলাম। দুবার তো দূর একবারও ভাবলাম না।
আরেকবার এরকম হয়েছিল জাতীয় বির্তকের
সময়। রাকার HSC টেস্ট পরীক্ষা, কিন্তু আমাকে তো যেতে হবে। ওদের দাদু ছিলেন
বয়সের ভারে নত। তবু মুরুব্বী ভরসা। আমি রওনা দেবার আগেই কাজের মেয়ে মায়ের অসুখের কথা
বলে বাড়ী চলে গিয়েছিল। আমি ৩/৪ দিনের রান্না করে রেখে গিয়েছিলাম। ওরা শুধু ভাত
রেঁধে নেবে। একদিন টেবিলে সব দিয়ে রাকা তার দাদুকে ভাত খেতে ডাকল। তারপর টেবিলে
বসে দাদী-নাতনী দেখল ভাতই রাঁধা হয়নি। আরেকদিন চুলার কাছে নিচু হয়ে কিছু একটা করতে
গিয়ে রাকার চুলে আগুন ধরে গিয়েছিল। সৌভাগ্য দিঠি পাশে ছিল। সে ড্রামের জমানো পানি
মগ দিয়ে মাথায় ঢেলে গিয়েছিল। নাহলে সেদিন কি হত জানি না। আবার এসবের মধ্যেই
নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার খাতা দেখা, নম্বর জমা দেয়া, নেয়া, রেজাল্ট তৈরি করা সবই
করতে হত। এটা করছি বলে ওটাতে ছাড় নেই।
আমার জীবনে শাহীন কলেজের বির্তক একটা বিশাল
অধ্যায়। ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কলেজে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বলয়ে, তারপর
আন্তঃশাহীন। আন্তঃশাহীন একবার এক কলেজে অনুষ্ঠিত হত। পরবর্তীতে ঢাকায় হলে আমার
সুবিধা ছিল আমার পরম সুহৃদ এবং যুগপৎ ভ্রাতুষ্পুত্র উইং কমান্ডার আমজাদ ঢাকায়
পোস্টিং এ ছিল। এবং আমি বিতর্কের পর দুপুরে ওর সাথে বাসায় চলে যেতাম। আবার বিকেলে
এসে বিতার্কিকদের প্র্যাকটিস করিয়ে, স্ক্রিপ্ট লিখে ওর বাসায় ফিরে যেতাম।
এসব ভাবলে আজও কষ্টে চোখে পানি এসে যায়।
আমজাদ আমার ক্লাসমেট ছিল আবার আমি যখন একটা চাকরি খুঁজছি তখন সেই আমাকে জানিয়েছিল
চট্টগ্রাম শাহীনে কলেজ শিক্ষক নেয়া হবে। পরে আমার এক বোনের মেয়ের সাথে আমারই
ঘটকালীতে তার বিয়ে হয়। এই একটা ঘটকালীই জীবনে করেছিলাম। এবং দম্পতি হিসেবে তারা এত
সুখী ছিল যে আত্মীয়-স্বজন এবং বিমানবাহিনীতে তাদের সুনাম ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ওর
স্ত্রী রোজি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অল্প বয়সে (২০১৪) মারা যায়। প্রায় পাঁচ ছ’বছর শয্যাশায়ী স্ত্রীর
সেবা চিকিৎসায় সে অনেক ব্যস্ততার মাঝেও এক মুহূর্তের জন্য গাফেলতি করেনি। আর আমার
মেয়েদের তারা দুজনেই এত স্নেহ করেছে যে রোজী আপুর কথা আজো তারা ভুলতে পারে না।
আন্তঃশাহীন বিতর্ক এবং কুইজে যেটা
দৃষ্টিকটু লাগত এবং মনকে পীড়া দিত সেটা হল শিক্ষকদের পক্ষপাতমূলক আচরণ। আমি হারলেই
যারা জিতেছে তারা পার্শিয়ালিটি করেছে এটা ছিল বিজিতদের অনিবার্য উক্তি। আবার যাদের
ভেন্যুতে হত তারা আসলে এমন কিছু মাঝে মাঝে করতেন যা নেইমারের পড়ে যাওয়ার মত দর্শক
ঠিকই বুঝতে পারত। এসব শিক্ষকরা ভাবতেন না এরা সবাই শিশু এবং সবাই আমাদের ছাত্র। আজ
ঢাকা শাহীনেতো, কাল চট্টগ্রামে। আবার যারা চট্টগ্রাম থেকে অন্য শাহীনে যেত তারা
আমরা সেখানে গেলেই তাদের বর্তমান ছেড়ে অতীতের শিক্ষক বন্ধুদের নিয়েই ব্যস্ত থাকত। সারাক্ষণ
তারা আমাদের সাথেই থাকত।
যতগুলো বিতর্ক হয়েছে, সবচেয়ে সুন্দর
ভেন্যু ছিল যশোর শাহীন। বিতর্কটাও হয়েছিল জম্পেশ। উপস্থিত সবাই মনে করেছিল আমরা
জিতব। এমনকি অতিথি যশোর ঘাঁটি-অধিনায়কও। পরে দেখা গেল কুর্মিটোলা শাহীনের এক
শিক্ষক-বিচারক আমাদের বিতার্কিকদের এত কম নম্বর দিয়েছেন যে জিততে জিততে আমরা
হারলাম। কুর্মিটোলা প্রথম রাউন্ডে আমাদের কাছে হেরেছিল। জানি না এটা তারই
প্রতিক্রিয়া কিনা। মানুষের ভিতরে কতরকম অসূয়া যে কাজ করে।
কিন্তু যশোর শাহীনের পরিবেশ, ফাইনাল হওয়ার
পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লাইব্রেরিয়ানের (এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না বলে দুঃখিত)
সুকন্ঠের আবৃত্তি আজও কানে মধু ঝরায়।
রাতে যশোর শাহীনের এক আপার সাথে রিক্সায়
চড়ে যশোরের বিখ্যাত কিছু জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছিলাম এবং ওনার বাসায় গিয়েছিলাম। আর মজা
করে খেয়েছিলাম, জামতলার বিখ্যাত রসগোল্লা। আসার সময় সবাই নিয়েও এসেছিলাম। তবে
ভ্রমণটা ছিল খুব বাজে। ঈগল পরিবহন নামের বাসে যাতায়াত করে যা কষ্ট পেয়েছি তা
কহতব্য নয়। যেমন নোংরা, তেমনি ধ্যাদ্ধেড়ে।
পরেরবার ভেন্যু ছিল চট্টগ্রাম শাহীন। সব
শাহীনের থাকার ব্যবস্থা হল পরিত্যক্ত RTS ভবনে।
সুপরিসর এ ভবনটি তখনো সুন্দর এবং ঝকঝকে ছিল। আমি বাসা থেকে এসে ঘাঁটি
গেড়েছিলাম কলেজের পিছনে শিক্ষকদের নতুন দশকোয়ার্টারে আসমত আরা ম্যাডামের বাসায়। আসমত আরা আর
ভাই তো তাদের বেডরুমের সুকোমল শয্যাই দিয়ে দিলেন আমাকে। আর এ বেলা এই
বাসায় তো, অন্যবেলা ঐ বাসায় খাওয়া। সুবিধা ছিল- কলেজে বসে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত
পড়াশোনা এবং স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ করা যেত।
শাহীন কলেজের চাকরি জীবনে আমি যত
বিতার্কিক পেয়েছিলাম তাদের মাঝে আমার দৃষ্টিতে অন্যতম ট্যালেন্টেড ছিল আবতাহির
রাহিম তাহা। মানুষে যে চেষ্টায় কত ভাল করতে পারে এর দৃষ্টান্ত আমার কাছে তাহা। সে
ক্লাসে কেজি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসে ফার্স্ট হত। কিন্তু তারচেয়েও
বড় কথা পাঠ্যবই ছাড়াও প্রচুর পড়াশোনা করত। প্রথম দিকে যদিও তাকে অতটা উজ্জ্বল মনে
হয়নি। কিন্তু দিনে দিনে সে আবৃত্তি এবং বিতর্কে যে দ্যুতি ছড়িয়েছিল তা সত্যিই
অনবদ্য। সে হিউমার বুঝতো এবং পড়াশোনা থাকাতে কোন বিষয়ে মজার ইঙ্গিতগুলো সহজে বুঝতে
পারত।
অনেকে আছে একটা কৌতুক বা মজার কিছু
বললে, মন্তব্য করে এটা কেন হল বা বলল? এই প্রশ্ন করলে কৌতুকই মাটি। জোকস বা ফানি
কিছু আমি খুব উপভোগ করি এবং উদ্ধৃতি দিতেও পছন্দ করি। অনেকে সেগুলো শুনে হাঁ করে
থাকত। তাহা বুঝতে পারত এবং উপভোগ করত। স্ক্রিপ্ট লেখাতেও তার হাত ছিল। তথ্য জানা
থাকলে আর লেখার অভ্যাস থাকলেই এটা সম্ভব। তাহার অর্থাৎ ‘তাহা'র এই গুণটি ছিল। হা-হা-হা।
বিতর্কের পাশাপাশি প্রথম প্রথম কুইজে
থাকলেও পরে অন্য শিক্ষকদের সে ভার দেয়া হয়। এদের মাঝে ভূগোলের সালমা বেগম ম্যাডামও
লেখা-পড়া-জানা এবং সাম্প্রতিক বিষয়ে যথেষ্ট দখল ছিল। সে এবং আমাদের প্রাক্তন ছাত্র
এবং পরবর্তীতে শিক্ষক ইমরানকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
দু-একবার হওয়ার পর কোন কারণে জানিনা
কুইজে প্রশ্ন করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হল এবং সব শাহীনের শিক্ষকরা সেটা সম্মতি
দিলেন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম নিরপেক্ষ থাকতে এবং ছাত্রদের দিকে না তাকিয়ে
প্রশ্ন করতে। এর ফলে কোন দুর্বোধ্য কারণে আমার সহকর্মীদের কারো কারো কাছে আমাকে
অপ্রিয়ভাজন হতে হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment