Saturday, 8 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - একটি মৌন মিছিল



__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - একটি মৌন মিছিল
__________________________________________

একটি মৌন মিছিল

পত্রিকার পাতার ছোট্ট খবরটুকুতে চোখ আটকে গেল নুসরাত হায়দারের। পড়লেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আগামী ১৪ মার্চ রোববার বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক মঈনুল কবিরের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে প্রতিবাদসভা ও মৌন মিছিল। স্থান জামাল খান প্রেস ক্লাব। ইচ্ছুক সচেতন ও সমমনা নাগরিকদের সভায় যোগ দিতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

          অগ্নি- অগ্নি- শুনে যা - মেয়েকে ডাকলেন নুসরাত।

          কেন ডাকছ মা! পড়ছি তো

          মেয়ের কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ পেল। কিন্তু তাকে পাত্তা না দিয়েই আবার ডাকলেন, আয় না, একটা খবর আছে পেপারে দ্যাখ।

          অগ্নি এলে পেপারের ঐ বিশেষ জায়গাটা তার চোখের সামনে তুলে ধরলেন। অগ্নি পড়ল। হ্যাঁ, গত কদিন যে বিষয়টা নিয়ে তাদের মা-মেয়ের মন খারাপ সেটির প্রতিবাদ সভা।

          পড়লাম - মায়ের দিকে তাকাল অগ্নি।

          যাবি?

          কোথায়?

          কেন সভায়, মিছিলে। লিখেছে না সচেতন ও সমমনা নাগরিকদের সভায় যোগ দিতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। তো আমরাও তো সচেতন নাগরিক। না কি? - মেয়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।

          আমার কলেজ আছে না?

          তাতে কী? আমারও তো স্কুল আছে। যাব না সেদিন। এরকম একটা ঘটনার প্রতিবাদের সুযোগ পেয়েও যাব না? শুধু ঘরে বসেই গুমরে মরলে লাভ কী?

          আসলে গত কদিন থেকে মঈনুল কবিরের গ্রেপ্তারের বিষয়টি তাদের মা-মেয়েকে কষ্ট দিচ্ছে। একজন শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক আর সবচেয়ে বড় কথা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য এই মানুষটা। এবারের নির্বাচনের পর দেশের হিন্দু-সম্প্রদায়ের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তার ছবি ও সংবাদ তিনি দেশে বিদেশে পাঠিয়েছেন। এই অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করেছে রাজাকারের মিত্র সরকার।

          রাজাকার আলবদররা মন্ত্রী হয়েছে, তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা। ক্ষোভে দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছুই করা হয় না। শুধু টিভির সংবাদে যখন ওদেরকে দেখায় তখন দুম করে টিভিটা অফ করে দেন। এটুকু ঘৃণা না দেখালে নিজেকেই বড় বেশি ছোট মনে হয়।

          একটা ফাইলের মধ্যে রাখা পেপারকাটিংগুলো আবার বের করলেন নুসরাত। তার মধ্যে একটা ছবির দিকে চোখ পড়তে আবারো চোখে জল এল নুসরাতের। গত কয়েকদিনে এই ছবিটা তাকে অসংখ্যবার কাঁদিয়েছে। ছবিটাতে দুজন মা-বাবা কাঁদছেন। তাঁদের মেয়েকে দুর্বৃত্তরা তাঁদেরই সামনে দল বেঁধে ধর্ষণ করেছে। কারণ তারা হিন্দু, তারা বিরোধী দলকে ভোট দিয়েছে। এ দুর্বৃত্ত কারা? একাত্তরে যারা পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করেছিল তারাই তো।

          নুসরাত কি ভুলতে পারেন একাত্তরের সেই সব স্মৃতি! দুলাভাইয়ের মৃত্যু, বড় আপার কান্না। অথচ আজ- দীর্ঘশ্বাসটা চেপে প্রতিজ্ঞায় স্থির হলেন- আমি যাব। এটুকুও যদি না করি তবে আর মানুষ কেন?

          পাঁচলাইশ থেকে একটা রিক্সা নিয়ে জামালখান আসতে আসতে এগারোটা বেজে গেল। প্রেসক্লাবের সামনে থামলেন।

          না, এখনও লোকজন তেমন দেখা যাচ্ছে না। তাহলে দেরি হয়নি। পত্রিকায় অবশ্য ছিল এগারোটায় প্রতিবাদ সভা। মেয়েটা আসতে পারেনি। পরশু থেকে হঠাৎ জ্বর।

          যারা এসেছে তারা ছোট ছোট দলে জটলা পাকাচ্ছে। চারদিকে তাকালেন। তেমন পরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে না। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দুএকজনকে দেখা যাচ্ছে। কেমন একা একা লাগতে থাকে। বুঝতে পারেন না কোথায় কার পাশে দাঁড়াবেন। মাথার ওপরে কড়া রোদ। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আসেন নি। তিনিই এ সভার আহ্বায়ক।

          সবাই দাঁড়িয়ে বসে গল্প করছে। মেয়েটা এলে মা-মেয়েতে গল্প করে হলেও সময় কাটত। এ সময় একজন এলো কালো কাপড় নিয়ে। এসেই হন্তদন্ত হয়ে কাঁচি চাইল। কিন্তু কাঁচি আনার কথা যার সে তো এখনো আসেনি। যে কাপড় নিয়ে এসেছে সে যুবকটি ক্ষেপে গেল -  ধুর! সব কাজ আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে সবাই লা-পাত্তা।

          কেন? তুমি এত কী কাজ করলে! এক টুকরো কাপড়ই তো এনেছ - ফোঁড়ন কাটল জটলার মধ্যে থাকা একজন। আরো ক্ষেপে গেল যুবক।

          বেশি নেতাগিরি দেখিও না। আমি তো কাপড় এনেছি। তুমি কী করেছ? খালি কথার পন্ডিত।

          আচ্ছা তোমরা কী শুরু করলে! এভাবে করলে সভা হয়! - এগিয়ে এলেন মধ্যবয়সী নেতা গোছের একজন।

          বেলা বাড়ছে। জটলাগুলো নানা রকম আলাপে ব্যস্ত। একজন কলেজ শিক্ষক প্রাইভেট পড়িয়ে মাসে কত টাকা উপার্জন করেন বেশ গর্বের সঙ্গে তার বর্ণনা দিচ্ছেন।

          আরেকজন বলছেন সবচেয়ে ভাল ব্যবসা এখন এনজিও করা। কোন রকমে একটা পেপার সাবমিট করে দুএকটা ডোনার পার্টি পেলে আর ভাবতে হবে না।

          কয়েকজন মহিলা গল্প করছেন তাদের সহকর্মীর মেয়ের বিয়েতে কত টাকা এবং কী কী যৌতুক দিতে হয়েছে।

          একটা পিলারের পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সবার গল্পগাছা শুনতে থাকেন নুসরাত। কই কেউতো একবারও মঈনুল কবিরের নাম বলছে না। তবে কি ভুল জায়গায় এলেন? হাতে ভাঁজ করা পেপারটা খুলে আবার পড়লেন- প্রেস ক্লাব। সকাল এগারোটা

          সাড়ে বারোটার দিকে এলেন প্রেস ক্লাবের সচিব- প্রতিবাদ সভার আহ্বায়ক। এসেই জানতে চাইলেন- ক্যামেরা এসেছে? আজাদী, পূর্বকোণের সাংবাদিকরা আসেনি?

          এসেছে, চা খেতে গেছে

          ডাকো, ডাকো, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো

          নুসরাতের হাসি পায়। উনি এলেন দেড়ঘন্টা পর। আর এখন বলছেন দেরি হয়ে যাচ্ছে।

          একটা হ্যান্ডমাইক আনা হল। ষাট জনের মত মানুষ ঘিরে দাঁড়াল। একজন একটা কাগজে সবার পরিচয় লিখতে শুরু করলেন।

          আপনারা কোন্‌ এন-জি-ও থেকে এসেছেন? আপনারা? আপনারা? লিখতে লিখতে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন - আপনি?

          আমি একজন শিক্ষক। একাই এসেছি

          নুসরাত লক্ষ্য করলেন কাগজে কিছুই লিখলেন না লোকটা। মর্মাহত হলেন নুসরাত। একা এলে কি কোন আইডেন্টিটি নেই?

          মাইক হাতে নিয়ে একের পর এক বক্তারা বলে যাচ্ছেন। সবাইকে দাঁত দিয়ে কেটেই কালো কাপড়ের টুকরো দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে একজনের নাম ঘোষণা করা হল। তিনি রেগে গেলেন। তিনি কিছুতেই বলবেন না। তাঁর নাম এত পরে কেন? আহ্বায়ক তাঁর কাছে গেলেন। গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলেন।

          সোয়া একটা বাজে। সবাইকে মিছিলের জন্য সারিবদ্ধ হতে বলা হচ্ছে। এখন মৌন মিছিল।

          সবাই মুখে কালো কাপড় বাঁধছে। কেউ কেউ একজন আরেকজনেরটা বেঁধে দিচ্ছে। সারিবদ্ধ হতে গিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই সামনের দিকে থাকতে চায়। পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে।

          মিছিল জামালখান চেরাগীপাহাড় হয়ে শহীদ মিনারে যাবে। নুসরাত সবার শেষে দাঁড়িয়েছেন। সামনের মহিলাটি প্রশ্ন করলেন- আপনি কোন্‌ এন-জি-ও আপা?

          আমি এন-জি-ও করি না। আমি শিক্ষক। স্কুলে পড়াই

          - মহিলা চুপ করে গেলেন।

          মিছিলে সবাই কথা বলছে। নুসরাত অবাক হলেন। মৌন মিছিলে এত কথা!

          চেরাগী পাহাড়ের মোড় ফেলে আসতেই ফটোগ্রাফাররা বিদায় নিলেন। সামনের সারির বেশ কয়েকজন কাজের অজুহাতে চলে গেলেন। ষাট জনের মিছিলে এখন জনা চল্লিশেক আছে। হাঁটতে হাঁটতেই ভাবছেন নুসরাত। কত দিন পত্রিকায় এসব মিছিল আর সভাসমিতির কথা পড়ে ব্যাকুল হয়েছেন। চাকরি আর সংসারের জন্য এসবে অংশ নিতে পারেন না বলে মাঝে মাঝে নিজেকে স্বার্থপরও ভেবেছেন। একজন শিক্ষিত সচেতন নাগরিক হিসেবে তার যে আরো কর্তব্য আছে এবং সে কর্তব্য পালনের ব্যর্থতায় নিজেকে তুচ্ছ ভেবেছেন। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে না এলেই ভাল করতেন। ছুটি নেয়াটা মোটেও ভাল হয়নি।

          মিছিল এখন আন্দরকিল্লার মোড়ে। সামনের সারিতে কয়েকজন। এরপরে প্রায় ফাঁকা। নুসরাত দেখলেন তাঁর ও মিছিলের মধ্যে অনেক দুরত্ব। কালোকাপড়টা খুলে হাতব্যাগে ঢোকালেন - স্মৃতি হয়ে থাক।

          একটা রিক্সা ডাকলেন। তাকিয়ে দেখলেন মিছিলের গুটিকতক মানুষ মুখবাঁধা অবস্থায় কথা বলছেন। আশ্চর্য!

          মিছিলের উল্টোদিকে ঘুরলেন নুসরাত। বাসায় যেতে হবে - মেয়েটার জ্বর।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Enigmatic quantum theory

  “ ‘There is actually no such thing as a quantum world. The quantum state exists only inside my head, something I use to do calculations. Q...

Popular Posts