Friday, 21 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ১৪



-----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

__________________________________

১৪

 

"এই একটা ফোন করব?"

          "কাকে?"

          "ভাবীকে ওরা কতদূর গেল, কোথায় আছে জানা যেত আমরা তো জ্যামে ড়ে আটকে গেলাম"

          "তাতে কী? আমাকে ছাড়াতো জানাজা হবে না"

          "না, সেটা নয় কিন্তু লাশের গাড়ি ওদের সঙ্গে যাচ্ছে, একটু কি খবর নেওয়া উচিত নয়?"

          "কিসের উচিত? চোরা নিল কেন? না হলে আমার মাকে আমি নিতাম না? আমার কি টাকা পয়সার অভাব ছিল?"

          "উহ্‌ টাকা টাকা আর টাকা টাকা ছাড়া মানুষটার মুখে কথা নেই মানুষ এত চামারও হতে পারে" মনে মনে বিড়বিড় করল আন্না এই টাকার অহংকার শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে চোখ-কান সবই পচে গেল কী হবে এত টাকা দিয়ে নিজেকে নিজে এভাবে টাকার কারাগারে বন্দী রেখে কী পেল মানুষটা আন্না বুঝতে পারে না

          এটা সত্যি বিয়ের পর সেই অল্প বয়সে আন্নাও ভুলেছিল টাকার মোহে সেই সময় এই বাংলাদেশে কতজন আর হীরের গহনা পরত? ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর বেড়াতে যেত? আন্না যেত রূপসী আন্নার রূপের মোহে টাকা খরচ করতে কার্পণ্য ছিল না শরীফের

          কিন্তু যেদিন খালাত বোন দীপা হঠাৎ মুখের উপর ফস করে বলে বসল, "আদম ব্যাপারীর বউ হয়ে তুই দেখি খুব মজে গেছিস আন্না এত যে টাকা খরচ করে শরীফ এগুলো দেশের অসহায় মানুষের জমি বেচা আর বাড়ি বন্ধকের টাকা বিদেশ যাওয়ার জন্য গ্রামের কর্মহীন বেকার মানুষগুলো সব বিক্রি করে পোটলা বেঁধে এসব আদম বেপারীদের দেয় আর যেখানে বিশ হাজার টাকা লাগবে সেখানে দুইলাখ টাকা নেয় তোর ভাল লাগে আন্না?"

          দীপা তখন ভার্সিটিতে পড়ে ছাত্র ইউনিয়ন করে তার দেহ মনে একটা খর তীব্রতা খাপখোলা তলোয়ারের মত আন্না যেন পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল আর দীপার স্পষ্ট উক্তি তাকে সেখান থেকে গড়িয়ে খাদে ফেলে দিয়েছিল

          আন্নার একবার মনে হয়েছিল দীপা কি তার সুখ দেখে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরছে? কিন্তু না, দীপার চোখে সেদিন হিংসা দেখেনি, যা দেখেছিল তা তিরস্কার তারপর আন্নার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, "আন্না তুই আমার শুধু বোন না, বন্ধুও মনে করে দেখ আশৈশব আমরা একসাথে সবকিছু শেয়ার করে বড় হয়েছি আজ যদি তোর পেছনে সবাই তোকে আদম বেপারীর বউ বলে, আমার কষ্ট হয় রে তুই নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা কর কলেজ ছেড়ে দিলি কেন? আবার লেখাপড়া শুরু কর পৃথিবীটা এত বড় আর তুই সোনার খাঁচায় বন্দী হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিবি?"

          সেদিনই বাসায় এসে আন্না সমস্ত অলংকার খুলে রেখেছিল আর কোনদিন পরেনি শরীফ অনেক রাগারাগি করেছে শেষ পর্যন্ত আন্নার নীরবতায় ওগুলো লকারে ঠাঁই পেয়েছে তারপর একদিন যখন শরীফকে জানাল সে আবার কলেজে পড়তে চায়, সেদিন রাগে বিস্ময়ে শরীফ চিৎকার করে উঠেছিল, "হোয়াট? কী বলতে চাইছ? কিসের অভাব তোমার? কলেজ পাশ দিয়ে তুমি কি চাকরি করবে?"

            "না চাকরি করতে হবে কেন? মানুষের ইচ্ছা থাকে না? শখ থাকে না?"

          "আচ্ছা, এত খন শখ তখন দেখা যাক কতটুকু পূরণ করা যায়"

          শরীফের কথা শুনে আন্না ভেবেছিল সত্যি সত্যি তার শখ পূরণ করবে সে তাছাড়া বিয়ের পর শরীফ একটাই কথা বলত, "আগে কিছুদিন নিজেদের জীবনটা ইচ্ছে মত উপভোগ করি, তারপর বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার কথা ভাবব"     

          যদিও শরীফ বাইরে চলে গেলে টুকটাক কেনাকাটার জন্য বাইরে যাওয়া ছাড়া তেমন কোন কাজ ছিল না তখনও ওরা যৌথ পরিবারে কিন্তু বৌয়েরা যে যার ঘরে বড় দুজন নিজেদের বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত শাশুড়ি তাঁর ঘরে প্রথমত মাঝে মাঝে তাঁর ঘরে ঢুকলেও সেই অল্প বয়সে তাঁর সঙ্গ আন্নার ভাল লাগত না তাই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত আবার লেখা পড়া শুরু করতে আর দীপার এককথার খোঁচায়তো তাকে যেন ভূতে পেয়েছিল তাই কিছু না বুঝেই শরীফের কাছে প্রস্তাবটা দিয়েছিল

          কিন্তু আন্না বুঝতে পারেনি সে রাতেই শরীফ তার ওপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে কোন রকম সতর্কতা ছাড়াই আন্নার শরীরে তার বীজ বুনে দিয়েছিল

          "এটা কী করলে তুমি?" আর্ত চিৎকার করে উঠেছিল আন্না

          "যা স্বাভাবিক তাই এটা তো অবৈধ কিছু না আমরা স্বামী-স্ত্রী আমাদের বাচ্চা হবে না?"

          "কিন্তু এতদিনতো একথা বলনি"

          "বলিনি, প্রয়োজন মনে করিনি কেন তুমি চাওনা একটা ফুটফুটে বাচ্চা?"

          "বাচ্চা চাওয়া আর তোমার আচরণ কি এক হল?"

          " একই"

          তারপর পর পর কয়েক রাত সেই একই পুনরাবৃত্তি আন্নার মনে হত সন্তান কামনা নয়, শরীফ যেন তার ওপর পাশবিক প্রতিশোধ নিচ্ছে সেই মাসেই গর্ভবতী হল কিন্তু শরীফের কাছে লেখাপড়ার বায়না নিয়ে আর কোনদিন কথা তোলেনি অথচ দীপা আজ জাতিসংঘে কতবড় চাকরি করে PhD করেছে আর সে সেই ম্যাট্রিক পাশ একজন আদম ব্যাপারীর বউ এর মধ্যে একটাই সুখ বাচ্চাগুলো বাবার মত হয়নি

          আচমকা মালিহাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে টেনে নিল আন্না কিছুটা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল মালিহা

          "মা, তোমার কি দাদুর জন্য বেশি খারাপ লাগছে? তুমিতো তাঁকে দেখেছ"

          "হ্যাঁ, খারাপ লাগছে এত খারাপ লাগবে আগে বুঝিনি আসলে মায়ের জন্য সবার খারাপ লাগে"

          "তাহলে আমরা তাঁকে দেখতে যেতাম না কেন? কেন দাদু আমাদের কাছে আসত না?"

          "বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন তো, আসার শক্তি ছিল না"

          "কেন? পাপা বুঝি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নিয়ে আসতে পারত না? তাছাড়া আমরা কেন যাইনি?"

          "বাজে বকবে না তো! তোমাদের এসব কথা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার আছে? যখন বড় হবে তখন বুঝবে দাদু আমার শত্রুর কাছে ছিল সে আমার বড় ভাই হলেও আমার সবচেয়ে বড় শত্রু" মা-মেয়ের কথার মাঝখানে বলে উঠলো শরীফ।

          "কী যা তা বলছ!" আন্না চেঁচিয়ে উঠল "ভাল কিছু তো শেখালে না, এখন আবার বাচ্চাদের মনটাই বিষিয়ে দিচ্ছ তোমার শত্রু তোমার ওদের এসবের মধ্যে নিও না আমি অনেক সহ্য করেছি কিন্তু ছেলেমেয়েকে খারাপ কিছু শেখালে আমি তোমাকে শাস্তি দিতে পিছপা হব না" বলতে বলতে কাঁপতে থাকল আন্না মালিহা জড়িয়ে ধরল,  "মা, মা"

আন্না ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল

          "ড্রামা নাটক সারাজীবন নাটকই করল।" অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মন্তব্য করল শরীফ

          গাড়ির ভেতরে আন্নার ফোঁপানি আর ইঞ্জিনের শব্দ সত্ত্বেও একধরনের নীরবতা নেমে এল মালিহার খুব খারাপ লাগছে মায়ের মন খারাপ হলে তার একটুও ভাল লাগে না অন্য বন্ধুদের মায়ের তুলনায় তার মাকে কেমন খাঁচায় বন্দী পাখি মনে হয় পাপাকে ছাড়া মা কখনো বাইরে যায় না অবশ্য পাপার সাথেও যে খুব খুশি হয়ে যায় তা নয় একমাত্র তাদের দুভাইবোন ছাড়া আর কোন কিছুতে মায়ের যেন আনন্দ নেই এত সুন্দর দেখতে মা অথচ কী সাধারণ চালচলন একটুও সাজে না পাপাটা যে কেন এরকম মালিহা বুঝতে পারে না মামা-খালামনিরা ছাড়া তাদের বাসায় আর কেউ কখনও আসে না পাপার কোন রিলেটিভকে মালিহা কখনও বাসায় আসতে দেখেনি আজ বড়ফুপু আর ছোটফুপুকে দেখে অবাক হয়েছে সে তারাও অনেক বুড়ো একজনতো হাঁটতেই পারে না অথচ পাপা কোনদিনও বলেনি কোনদিনও দেখতে যায়নি বোনকে আশ্চর্য! মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে? ভাইমনির কিছু হলে মালিহা কি পারবে দূরে থাকতে? পাপা দাদুর সবচেয়ে ছোট ছেলে কিন্তু হসপিটালে একজন মানুষও পাপার সাথে ভাল করে কথা বলল না মালিহার মনে হয় সে কখনও এরকম হবে না ভাইকে সে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে

          "ড্রাইভার একটু স্লো করো"

          "জী স্যার"

          "হ্যাঁ সামনে যে বাজার দেখা যাচ্ছে এর পরে আমরা মেইন রোড থেকে বাঁ দিকে নামব"

          "আমরা এসে গেছি পাপা?" ইফতি বলল

          "হ্যাঁ, পাপা আর দেড়-দুমাইল ভিতরে গেলে আমাদের বাড়ি"

          "এখানে ইলেকট্রিসিটি আছে?"

          "ইয়েস মাই বয় সব আছে এভরিথিং হ্যাজ"

          "ওয়াও বাংলাদেশের গ্রামগুলোও তাহলে শহরের মত"

          "না, সব গ্রাম সব বাড়ি নয় কো কোন বাড়ি"

          গাড়ি ছুটছে পাকা সড়ক ধরে দুপাশে ধান ক্ষেত, মাঝে মাঝে গাছপালা ঘেরা বাড়ি হৈমন্তিক চাঁদের আলোয় সব কেমন বিষন্ন আর রহস্যময় মনে হচ্ছে পথের পাশে একটা বিশাল বট পাকুড়ের গাছ দেখে ইফতি প্রশ্ন করল, "এই গাছে কি ভূত আছে পাপা?"

          "না না ভূত টূত নেই তবে অনেক পাখি থাকে কালকে আমরা যখন ঘুরতে বের হব তখন তোমাকে পাখির বাসা দেখাব"

          "হ্যাঁ আমরা সাইট সিয়ি এসেছি তো!" আচমকা আন্নার বিদ্রু হুলের মত এসে বিঁধল শরীফকে ততক্ষণে গাড়িটা আরেকটা বাঁক ঘুরে পুলের কাছে এসে গেছে এই সেই পুল উটের পিঠের মত যার একপাশে নেমে রিক্সার পিছন থেকে ঠেলে রিক্সাওলাকে এপারে আসতে সাহায্য করতে হত আর আজ রাস্তা একদম সমান

 

****

পর্ব ১৫


No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার ঘড়ি

  মানব সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকেই সময় সম্পর্কে মানুষ সচেতন হতে শুরু করেছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষ যতই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক হচ্ছে ত...

Popular Posts